ইজরায়েল এগিয়ে, মুসলিমরা কেন পিছিয়ে?
#প্রশ্ন –কটা মুসলিম কান্ট্রি প্রগ্রেস করেছে বলুন তো? যারা করেছে পেট্রোলের জন্য করেছে…মুসলিম কান্ট্রিগুলোর এ অবস্থা কেন? ইজরায়েল এত প্রগ্রেস করে এগিয়ে গেলো, তার পাশের দেশটা পারলো না কেন?
[ভারত থেকে প্রশ্ন করেছে – সুমিত পাল]
#উত্তর – এ প্রশ্নটি বহুল প্রচলিত। ইসলামের পশ্চিমা সমালোচক, ওরিয়েন্টালিস্ট, ইজরায়েলি-ইহুদী এবং হিন্দুস্তানি মুশরিকদের এটি একটি প্রিয় প্রশ্ন।
দুঃখজনক ভাবে পরাজিত মানসিকতার এবং হীনমন্যতায় ভোগা কিছু মুসলিম আছে যারা এ ধরনের প্রশ্ন দ্বারা বিভ্রান্ত হয়।
.
মূলত এ প্রশ্নের ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত (অধিকাংশক্ষেত্রে) বা অনিচ্ছাকৃতভাবে কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরকে এড়িয়ে যাওয়া এবং গোপন করা হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।
হঠাৎ করে এধরনের কথা শুনে আপনার হয়তো মনে হবে, যে পত্রিকার ছবি এসেছে – ১০ টা ছেলে একসাথে দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। সবার সামনে আছে ইহুদী ছেলেটা, তার পেছনে সাদা চমড়ার খ্রিষ্টান ছেলেগুলো, তাদের পায়ে ঝুলছে হিন্দু ছেলেটে আর সবার পেছনে মুসলিম ছেলেটা ধুকতে ধুকতে আগাচ্ছে।
অনেক মুসলিম এটুকু চিন্তা করে খুব লজ্জায় পড়ে যান। চিন্তা করা শুরু করেন – আসলেই তো মধ্যপ্রাচ্যে এতো গোলমাল কেন, মুসলিম দেশগুলো এতোও গরীব কেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
.
এখানে যে ভুলটা করা হচ্ছে তা হল, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। আর এ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে বুঝতে আমাদের আরেকটু আগে থেকে চিন্তা শুরু করতে হবে। ইসলামের সূচনার সময় পৃথিবীতে সুপারপাওয়ার ছিল দুটি – রোমান সভ্যতা এবং পারস্য সভ্যতা।
ইসলাম এ দুটো সভ্যতাকেই পরাজিত করে। খলীফা উমর রাঃ এর শাসনকালে আনুষ্ঠানিক ভাবে এ সভ্যতা দুটো ইসলামের কাছে হার স্বীকার করে নেয়, এবং ইসলামী খিলাফাহ বিশ্বের একমাত্র সুপারপাওয়ারের আসনে আসীন হয়।
.
পরবর্তী প্রায় এক হাজার কিছু কম সময় ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তি, অর্থনীতিতে উন্নতি করতে থাকে। অর্থনীতি থেকে শুরু করে অপটিক্স, কেমিস্ট্রি থেকে শুরু করে ক্যালকুলাস সকল ক্ষেত্রেই অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করে মুসলিমরা। সমগ্র বিশ্বজুড়ে মুসলিমরা তাদের এসকল প্রযুক্তি ও জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়।
পাশাপাশি ইসলামী সভ্যতায় কখনই দখলকৃত অঞ্চলের জনগণকে শোষণপূর্বক কেন্দ্রকে শক্তিশালি করার নীতি গৃহীত হয় নি। যেহেতু প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দখল অঞ্চলের অধিকাংশ জনগণ ইসলাম গ্রহন করতো, ফলে প্রতিটি অঞ্চলের মুসলিমের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির মাধ্যমে প্রসার হতে থাকে ইসলামী সভ্যতার।
#সুত্রঃ
http://www.huffingtonpost.com/…/overcoming-historical-amnes…
http://www.islamweb.net/…/contribution-of-islam-to-the-worl…
http://www.muslimheritage.com/article/what-islam-did-us
https://archive.org/details/04isart
.
অন্যদিকে ইউরোপের জন্য এ সময়টা ছিল অন্ধকারের যুগ। ইউরোপিয়ান এ অন্ধকার যুগের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল অর্থনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক ও জ্ঞানগত অধঃপতন।
মজার ব্যাপারটা হল ইউরোপের এ অন্ধকার যুগ থেকে বের হয়ে আসার পেছনে তিনটি মূল ফ্যাক্টরের ভূমিকা ছিল।
১) ইসলামী সভ্যতা থেকে জ্ঞান আহরন,
২) উপনিবেশ স্থাপন,
৩) তীব্র ইসলাম বিদ্বেষ।
ইউরোপে রেনেসা এবং এনলাইটেনমেন্টের মশলা যদিও মুসলিমদের কাছ থেকেই গ্রহন করা হয়েছিল, তথাপি এনলাইটেনমেন্টের গুরুদের চিন্তায় ইসলাম ও মুসলিমরা ছিল শত্রু। এবং খ্রিষ্টান ইউরোপকে ধরে নেওয়া হয়েছিল মানবতা ও নৈতিকতার চূড়া হিসেবে। এবং এরকম করাটা তাদের জন্য আবশ্যক ছিল, যেহেতু তারা অনুধাবন করেছিল।
.
এ ব্যাপারে পড়তে পারেন – “Orientalism” by Edward Said
http://www.muslimheritage.com/…/how-islamic-learning-transf…
http://socialistreview.org.uk/304/islam-and-enlightenment
.
এ সময়টাতে এসে ইউরোপীয় উপনিবেশি শক্তিগুলো সারা বিশ্বে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধন-সম্পদ লুটপাট করে এনে, নিজেদের দেশগুলোর উন্নতি সাধনে মনোযোগ দেয়। হত্যা-লুন্ঠন- ধর্ষন-শোষনের মাধ্যমে তৈরি হয় শিল্প বিপ্লবের (Industrial Revolution) ভিত্তি প্রস্থর।
শিল্প বিপ্লব এবং ঔপনিবেশিকতার মাধ্যমে মাধ্যমে ইউরোপ অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তির দিক দিয়ে শক্তিশালী হতে শুরু করে এবং বিভিন্ন ভাবে ইসলামী খিলাফাহকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র জোরদার করতে থাকে।
যার ফলশ্রুতিতে মুসলিমদের ঐক্য বিনষ্ট করা হয়, জাতীয়তাবাদ, বর্নবাদ, আরববাদের মত হারাম ও বাতিল চিন্তাধারা মুসলিমদের ভেতর প্রচার করা হয় এবং খিলাফাহর পরিবর্তে জাতি-রাস্ট্রের ধারণা দিকে মুসলিম সমাজগুলোকে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
.
পাশাপাশি এ সময়টাতে মুসলিম বিশ্ব অভ্যন্তরীন বিভিন্ন ত্রুটি এবং সমস্যার কারনে দুর্বল হতে শুরু করে। এ ত্রুটিগ্রুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ ত্যাগ করা এবং দুনিয়ার প্রতি আসক্তি যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদিসে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখিত হয়েছে –
.
“যদি তোমরা আর্থিক লেনদেন এবং গরুর লেজ অনুসরণ কর এবং কুষক হয়ে পরিতৃপ্ত— হয়ে যাও এবং জিহাদ প্রত্যাখ্যান কর, তবে আল্লাহ তোমাদের উপর লাঞ্ছনা অবতরন করবেন যা ততক্ষণ পর্যন্ত উঠিয়ে নেওয়া হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের দীনের দিকে প্রত্যাবর্তন কর।” (আবু দাউদ-সহীহ, অধ্যায় ২৩, নং ৩৪৫৫)
.
“শীঘ্রই এমন একসময় আসবে, যখন এই পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিরা একে অপরকে মুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য পরস্পরকে আহবান করবে, যেভাবে ক্ষুধার্ত নেকড়ে তাদের খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।” কেউ একজন জিজ্ঞেস করলেন,“সেই সময় কি আমরা সংখ্যায় কম থাকবো?”
উত্তরে রাসুল(সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “না, সে সময় সংখ্যায় তোমরা হবে অগণিত। কিন্তু’তোমরা হবে বানের জলে ভেসে আসা খড়কুটোর মতো [অর্থাৎ, শক্তিহীন], শত্রুদের অন্তরে তোমাদের সম্পর্কে যে ভয় আছে আল্লাহ তা উঠিয়ে নেবেন এবং তোমাদের
অন্তরে তিনি ওয়াহন নিক্ষেপ করবেন।” একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন,“ইয়া রাসুলুল্লাহ! ওয়াহন কি?” রাসুল(সাঃ) বললেন,“দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা আর মৃত্যুর প্রতি ঘৃণা।”
[আবু দাউদ এবং আহমদ]
.
ইসলামী খিলাফাতের পতন ঘটে এ প্রেক্ষাপটে। আর এ প্রেক্ষাপটে উত্থান ঘটে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার বা World Order এর। খিলাফাহর পতনের পর মুসলি ভূখন্ড গুলোকে খন্ড খন্ডে ভাগ করা হয়, এবং শেখানে এমন পুতুল শাসকগোষ্ঠীকে বসানো হয়।
এ শাসক গোষ্ঠীর কাজ খুব সহজ – জনগণকে ইসলাম থেকে দুড়ে, রাখা, পশ্চিমাদের স্বার্থ সংরক্ষন করা, মুসলিমদের ধন সম্পদ, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ নামমাত্র মূল্যের পশ্চিমাদের হাতে তুলে দেওয়া। আর এর বিনিময়ে পশ্চিমারা এসব শাসকগোষ্ঠীকে লুটপাট করার স্বাধীনতা, সমর্থন ও আন্তর্জাতিক ভাবে বৈধতা করে।
বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে যে ব্যবস্থা চলছে্ সৌদি বাদশা থেকে শুরু করে সিসি, হাসিনা থেকে শুরু করে বাশার আল আসাদ – এদের সবার বাস্তবতা এটাই। এটা ভিন্ন আঙ্গিকে ঔপনিবেশিকতা ছাড়া আর কিছুই না।
উদাহারণস্বরূপ, খিলাফাহ পরবর্তী সময়ে তিউনিশিয়াতে মুসলিমদের বিদ্রোহের কাছে ধোপে টিকতে না পেরে তখন থেকেই নিজস্ব দালাল শাসক বসিয়ে আজো নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে চলেছে পশ্চিমারা। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার মিলনস্থলের এই দেশটি সেখানকার সবচেয়ে রক্ষণশীল মুসলিম জাতি থেকে পশ্চিমাদের সংস্কৃতির অনুসরণে আজ সবাইকে ছাড়ীয়ে গিয়েছে (ইন্না লিল্লাহ)। শুধুমাত্র নিজদেশীয় দালাল শাসকদের চিহ্নিত করতে না পারার ভুলের কারণে… আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের এথেকে শিক্ষা নেয়ার তাওফিক দিন। আমীন।
.
বর্তমান মুসলিম বিশ্বের যে অস্থিরতা এর পেছনে মূল কারন হল পশ্চিমারা জানে মুসলিম বিশ্ব যদি স্থিতিশীল হয় তবে তারা তাদের হক্ব আদায় করে নেবে। তারা ইসলামকে আকড়ে ধরবে এবং নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নামবে।
পশ্চিমারা যে লুটপাট আজো চালিয়ে যাচ্ছে তা তখন বন্ধ হয়ে যাবে। মুসলিমরা কি করতে পারে, এটা আজকে অনেক মুসলিমরা ভুলে গেলেও কুফফার তা মনে রেখেছে। তাই মুসলিম বিশ্বে চোর-বাটপাড়দের শাসন ক্ষমতায় টীকিয়ে রাখা, এবং মুসলিম বিশ্বকে অস্থিতিশীল রাখা পশ্চিমের পলিসি।
.
একারন বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতিটি অক্ষের, সামরিক অক্ষে ন্যাটো থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক অক্ষে বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ এবং রাজনৈতিক অক্ষে জাতিসংঘ সকলের মূল উদ্দেশ্য হল মুসলিমদের দাবিয়ে রাখার মাধ্যমে নিজের জমিদারি টিকিয়ে রাখা।
এবং তারা জানে যে আদর্শ মুসলিমদের এ অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে পারে তা হল জিহাদ এবং শারীয়াহ। একারনে বিশ্বের যেকোন প্রান্ত থেকে জিহাদ ও শারীয়াহর ডাককে নিশ্চিহ্ন করতে, মুসলিমদের অধিয়ার আদায়ের যেকোন চেষ্টাকে পিষে ফেলতে পশ্চিমা ক্ষমতা ও তাদের আঞ্চলিক দোসররা সক্রিয় ভাবে যুদ্ধে লিপ্ত।
আফগানিস্তানে ন্যাটোর হামলা থেকে শুরু করে মিশরে রাবা ম্যাসাকার। শায়খ আনওয়ার আল আওলাকীকে হত্যা জন্য ড্রোন হামলা থেকে শুরু করে এ ছোট ফেইসবুক পেইজের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার গলা চেপে ধরার বিরুদ্ধে আনন্দবাজারের রিপোর্ট, সবই এ বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের অংশ।
কৃত্রিম ভাবে ইজরায়েল নামক ক্যান্সারকে টিকিয়েও রাখছে অ্যামেরিকার নেতৃত্বাধীন এ বিশ্বব্যবস্থা।
.
তাই দৌড় প্রতিযোগিতার উদাহরনের বাস্তবতা হল পেছনে পড়ে থাকা মুসলিম ছেলেটাকে না একই সময়ে দৌড় শুরু করতে দেয়া হচ্ছে, আর নাই বা তাকে দৌড়াতে দেয়া হচ্ছে, বরং প্রতিবার দৌড় শুরু করার চেস্টার সময় তাকে আঘাত করা হচ্ছে। অন্যদিকে সামনে যে ইহুদী আছে, বাকি সবাইকে থামিয়ে, চারপাশ থেকে ঘিরে রেখে নিরাপত্তা দিয়ে তাকে সবার সামনে নিয়ে আসা হয়েছে – আর তাঁর পর সাংবাদিক ডেকে এনে ছবি তোলা হচ্ছে।
.
আর রইল ইজরায়েলের কথা। ইজরায়েলের টিকে থাকার একমাত্র কারন হল ইস্রাইলের পরতি পশ্চিমা বিশ্বের বিশেষ করে অ্যামেরিকার নিয়ত অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক স্মর্থন।
এবং ইজরায়েলের চারপাশের ভূখন্ডগুলোর, অর্থাৎ মিশর, লেবানন, জর্ডান, সিরিয়ার মুরতাদ-কাফির শাসকদের দ্বারা সে দেশের সামরিক বাহিনীগুলোকে ইস্রাইলের সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা পালন বাধ্য করা।
যদি আজ থেকে এদুটি বন্ধ হয়ে যায়, তবে আগামী কাল ইজরায়েলকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার জন্য মাসজিদুল আক্বসার সামনে পাথর হাতে টহলরত তরুণরাই যথেষ্ট।
ওয়াল্লাহু ‘আলাম।