নির্বাচিতপ্রবন্ধ-নিবন্ধ

শাইখ আল-মাকদিসির ব্যাপারে শাইখ আত-তারতুসির বক্তব্য কি তাঁদের বিরোধীদের অবস্থানকে সঠিক প্রমাণ করে?

কিছুদিন ধরে আমরা একটি প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। মুজাহিদিনের মানহাজ ও আকিদার বিরোধিতা করতে গিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই আক্রমণের নিশানা বানিয়েছে শাইখ আবু মুহাম্মাদ আসিম আল-মাকদিসি হাফিজাহুল্লাহ-কে। এটি দুঃখজনক তবে পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত না। এ বিষয়টি নতুন কিছু না জিহাদের মানহাজের বিরোধিতাকারীরা সেই ৮০ এর দশক থেকেই তাওহিদের এই শাইখকে তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে আসছে।
শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির মানহাজ ও আকিদা নিয়ে প্রশ্ন উঠায় আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা তাঁর স্বপক্ষে বর্তমানে যুগের তাওহিদের ইমাম আল্লামা হামুদ বিন উক্বলা আশ-শুয়াইবি রাহিমাহুল্লাহ ও তাঁর প্রধান ছাত্র শাইখ আলি আল-খুদাইর ফাকাল্লাহু আসরাহ –এর বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলাম। তখন আমরা দেখেছি কিছু ভাই শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির ব্যাপারে শাইখ আবু বাসির আত-তারতুসির কিছু কথা, শাইখ আল-মাকদিসির অবস্থানের সাথে ইমাম আব্দুল্লাহ আযযাম রাহিমাহুল্লাহ –এর কিছু ভিন্নতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় উত্থাপন করেছেন। সম্ভবত তাঁরা ধারণা করেছেন এ দ্বারা শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির আকিদা ও মানহাজকে ভুল প্রমাণ করা যাবে। কিন্তু তাঁরা এখানে হিসাবে কিছু ভুল করেছেন, যা ইনশাআল্লাহ আমরা এ লেখা ও পরবর্তী কিছু লেখায় তুলে ধরবো।

শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির ব্যাপারে শাইখ আবু বাসির আত-তারতুসির বক্তব্য সম্বলিত এমনি একটি প্রবন্ধের ব্যাপারে একজন প্রশ্ন করেছে – “শাইখ তারতুসি কিসের ভিত্তিতে শায়েখকে খারিজী আখ্যা দিলেন বি্ষয়টা ক্লিয়ার করবেন কি?”

প্রবন্ধের লিঙ্ক – https://arabi21.com/story/855199
আমাদের উত্তর –
এই প্রবন্ধে শাইখ আবু বাসির আত-তারতুসি শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাক্বদিসিকে “খারেজি” বলেননি। আপনি হয়তো মূল প্রবন্ধটি না পড়েই কারো কোন লেখা দেখে ধারণা করেছে।
শাইখ আত-তারতুসি বলেছেন, “দাইশের খারেজিরা হল আবু মুহাম্মাদ আল মাকদিসির অবাধ্য সন্তান” (الدواعش هم أبناؤه العصاة)
এছাড়া শাইখ আত-তারতুসি আরো বলেছেন দাইশের সাথে শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির দ্বন্দ্ব বা মতপার্থক্যের মূল কারণ হল তাদের (দাইশের) তানজীম আল-কায়েদা ত্যাগ করা।
এছাড়া তিনি আরো কিছু অভিযোগ করেছেন যেমন – শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসি শামের ময়দানে স্বশরীরে উপস্থিত না থাকার কারণে তিনি ময়দানের অনেক বাস্তবতা সম্পর্কে জানেননা, তাঁর বক্তব্যের কারণে শামের ময়দানে অনেক ফিতনাহ হয়েছে, তিনি তানজীম আল-কায়েদার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট।
শাইখ আবু-মুহাম্মাদ আল-মাকদিসি কর্তৃক আহরার আশ-শামের কাজের সমালোচনার প্রেক্ষিতে শাইখ আত-তারতুসি এ বক্তব্য দেন।
কয়েকটি বিষয় নিয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে আলোচনা করলে এই মতপার্থক্য ও অভিযোগের বাস্তবতার বিষয়টি ইনশাআল্লাহ পরিষ্কার হয়ে যাবে।।

১) শাইখ আত-তারতুসি কি শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসিকে খারেজি বলেছেন?

২) শাইখ আত-তারতুসি ও শাইখ আল-মাকদিসির মতপার্থকের কারণ কি?

৩) দুজনের কেউ কি তাঁদের পূর্বের অবস্থান বদলে ফেলেছেন? যে কারণে এই মতপার্থক্য?

আমরা সংক্ষেপে প্রতিটি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করবো-

১) শাইখ আত-তারতুসি কি শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসিকে খারেজি বলেছেন?

না। এই বক্তব্য শাইখ আত-তারতুসি কোথাও শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসিকে “খারেজি” বলেননি। তিনি যা বলেছেন তা হল – খারেজি দাইশ হল শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির অবাধ্য সন্তান।
অনেকে একথা থেকে মনে করতে পারেন যে এখানে শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসিকে “খারেজি” বলা হচ্ছে। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। শাইখ আত-তারতুসির এ কথার পেছনে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে যা জানতে পারলে যেকেউ একথার মূল অর্থ বুঝতে পারবে।
শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসি ও তানজীম আদ-দাওলাহ (আইএস/আইসিস)-এর সম্পর্কঃ
বর্তমানে যে দলটি নিজেদেরকে “দাওলাতুল ইসলাম” (ইসলামিক স্টেট) বলে ডেকে থাকে তাদের এর আগের নাম ছিল দাওলাতুল ইসলাম ফিল ইরাক ওয়া আশ-শাম (আইসিস)। ২০১৪ সালের জুনে তারা “দাওলাতুল ইসলামিয়া” (আইএস) এই নাম গ্রহণ করে। কিন্তু এ দলটির ইতিহাসের শুরু ১৯৯৩ এর দিকে।
১৯৯৩ এর শেষ দিকে শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসি জর্ডানে একটি জিহাদি তানজিম গড়ে তুলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল জর্ডান ও পার্শ্ববর্তী ইজরাইলে কেন্দ্রিক সামরিক কর্মকান্ড চালানো। শাইখ আল-মাকদিসি ছিলেন এ তানজীমের আমীর। শাইখ আবু মুহাম্মাদ আজ-জারকাওয়ি রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন এই তানজীমের সদস্য ও আসকারি অংশের দায়িত্বশীল। ১৯৯৪ এর মার্চ ও এপ্রিলে সীমান্ত ক্রস করে ইজরাইলে গিয়ে একটি হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে শাইখ আজ-জারকাওয়ি ও শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসি গ্রেফতার হন। এসময় তানজীমের অন্যান্য অধিকাংশ সদস্যও গ্রেফতার হন। জেলের ভিতরেও এই তানজীমের সদস্যরা দাওয়াতি কার্যক্রম চালাতে থাকেন। এ তানজীমের নাম ছিল “তাওহিদ ওয়াল জিহাদ”/ “জামাত তাওহিদ ওয়াল জিহাদ” ।
পরবর্তী সময় জেলে থাকা অবস্থায় শাইখ আল-মাকদিসি ইলম চর্চা ও দাওয়াতী কাজে আরো বেশি মনোনিবেশের সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়া জন্মসূত্রে শাইখ আল-মাকদিসি ছিলে ফিলিস্তিনী, অন্যদিকে শাইখ আজ-জারকাওয়ি ছিলেন জর্ডানের শক্তিশালী বনু হাসান গোত্রের। একারনে শাইখ আল-মাকদিসি মনে করেন যে জর্ডান-কেন্দ্রিক কর্মকান্ডের জন্য শাইখ আজ-জারকাওয়ি অধিকতর উপযুক্ত হবে। এসব কারণে শাইখ আবু মুসআব আজ-জারকাওয়ির অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাইখ আল-মাকদিসি জামাত তাওহিদ ওয়াল জিহাদের নেতৃত্ব তাঁকে অর্পন করেন।
১৯৯৯ সালে দুজন জেল থেকে মুক্তি পান। শাইখ আজ-জারকাওয়ি এসময় আফগানিস্তানে চলে যেতে সক্ষম হন যেখানে ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান সকল মুহাজিরকে নিরাপত্তা ও আশ্রয় দিচ্ছিল। অন্যদিকে ৯৯ এর মার্চে মুক্ত হবার কিছুদিন পর ২০০০ সালে শাইখ আল-মাকদিসি আবারো গ্রেফতার হন।
পরবর্তী সময় আমেরিকার আফগানিস্তান আক্রমনের পর ও ইরাক আক্রমণের আগে শাইখ আবু মুসআব আফগানিস্তান থেকে উত্তর ইরাকে চলে আসেন। যখন আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করে তখন শাইখ আবু মুসআব আল-জারকাওয়ির নেতৃত্ব “তাওহিদ ওয়াল জিহাদ” তানজীমটি ইরাকে আমেরিকার বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করে। উল্লেখ্য যে শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির ওয়েবসাইটের নাম শুরু থেকে আজ পর্যন্ত “মিম্বার আত-তাওহিদ ওয়াল জিহাদ”।
২০০৪ সালে আল ইমাম ওয়াল মুজাদ্দিদ শাইখ উসামা বিন লাদিনকে বাইয়াত দেয়ার মাধ্যমে “তাওহিদ ওয়াল জিহাদ” পরিণত হয় তানজীম আল-কায়েদার ইরাকি শাখায়, নাম বদলে রাখা হয় তানজীম কায়েদাতুল জিহাদ ফি বিলাদুর রাফিদাইন, যা সাধারণের কাছে আল কায়েদা ইরাক নামে পরিচিত হয়।
২০০৬ সালে শাইখ উসামা বিন লাদিনের নির্দেশে আল-কায়েদা ইরাকসহ ইরাকের অন্যান্য কিছু মুজাহিদিন দল নিয়ে গঠন করে “মুজাহিদিন শুরা কাউন্সিল”। তার কিছুদিন পর শাইখ আজ-জারকাওয়ি আমেরিকান হামলায় শহীদ হন (ইনশাআল্লাহ)। তার স্থলাভিষিক্ত হন আবু আইয়ুব আল-মাসরি (আবু হামযা আল-মাসরি) রাহিমাহুল্লাহ।
এর কিছুদিন পর দাওলাতুল ইরাক আল-ইসলামিয়া (আইএসআই) গঠন করা হয়, যার আমীর নিযুক্ত হন শাইখ আবু উমার আল-বাগদাদি রাহিমাহুল্লাহ। দাওলাতুল ইরাক ও আল-কায়েদার কাছে বাইয়াতবদ্ধ ছিল।
২০১০ সালে আবু উমার আল বাগদাদি আমেরিকান হামলায় শহীদ হন (ইনশাআল্লাহ)। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয় আবু বকর আল-বাগদাদী। ২০১০ থেকে ২০১৪ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবু বকর আল-বাগদাদী তানজীম কায়েদাতুল জিহাদের আমীরের কাছে বাইয়াতবদ্ধ ছিল।
২০১৩ সালে আবু বকর আল-বাগদাদী দাওলাতুল ইরাক ও জাবহাতুন নুসরা (আল কায়েদার দুটি শাখা) একত্রিত করে দাওলাতুল ইসলাম ফিল ইরাক ওয়া আশ-শাম গঠনের ঘোষণা দেয়।
২০১৪ এর ফেব্রুয়ারিতে তাদের অবাধ্যতা ও চরমপন্থার কারণে আল-কায়েদা তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে।
২০১৪ এর জুনে তানজীম আদ-দাওলাহ ঘোষণা করে যে তারা খিলাফাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে এবং এখন থেকে তাদের নাম হবে “দাওলাতুল ইসলামিয়্যাহ”।
সুতরাং আমরা দেখলাম, শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির গড়া জামাত তাওহিদ ওয়াল জিহাদ বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনার পর এক সময় আজকের আইএস-এ পরিণত হয়। সুতরাং এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রাখলে তানজীম আদ-দাওলাহকে শাইখ আল-মাকদিসির “অবাধ্য সন্তান” বলা এক অর্থে ভুল হবে না। কারণ প্রথমত শাইখের গড়া তানজীম থেকেই তাদের সূচনা। এমনকি আইএস এর প্রধান শার’ঈ তুর্কি বিন আলি ছিল শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির সরাসরি ছাত্র।
দ্বিতীয়ত শাইখ বিভিন্ন সময় তাদের সমালোচনা করেছেন, এবং তাদের চরমপন্থা, কৌশল ও তাকফির নীতির বিরোধিতা করেছেন। এবং তিনি বারবার আল-কায়েদার কাছে দেয়া বাইয়াত ভঙ্গের ব্যাপারে তাদের সমালোচনা করেছেন। যদিও তাঁরা শাইখের কথা গ্রাহ্য করেনি, বরং তাঁর উপর অনেক অপবাদ ও মিথ্যাচার আরোপ করেছে।
এছাড়া ২০১৫ তে দেয়া এক বক্তব্য শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসি দাওলাহকে “খারেজিদের চেয়েও নিকৃষ্ট” বলেছেন। শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির লিখিত ও প্রকাশিত রচনাবলী থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার যে তাকফির, উজর বিল জাহল, আল ওয়ালা ওয়াল বারা, ফিদায়ী হামলা – বিভিন্ন বিষয়ে গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর অবস্থান অপরিবর্তিত আছে। অন্যদিকে তানজীম আদ-দাওলাহই তাদের অবস্থান ও মানহাজ পরিবর্তন করেছে। (এব্যাপারে বিস্তারিত জানতে দেখুন উস্তাদ আহমাদ নাবিলের “দাওলাহর আসল রূপ”)।
সুতরাং আমরা দেখলাম, এক অর্থে তানজীম আদ-দাওলাহ শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির অবাধ্য সন্তানের মতোই। তবে শাইখ আল-মাকদিসি তাঁদের চরমপন্থা ও সীমালঙ্ঘন থেকে মুক্ত এবং যেকোন আদল ইনসাফসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে এ ব্যাপারটি মধ্যাহ্নের সূর্যের আলোর মতো স্পষ্ট।
অর্থাৎ দাইশ হল শাইখ আল-মাকদিসির অবাধ্য সন্তান – এ কথা বলার অর্থ এই না যে, শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসিকে খারেজি বলা হচ্ছে। সম্ভবত যারা এমন মনে করেছেন তারা এই ঐতিহাসিক বাস্তবতার ব্যাপারে জানেন না।

২) শাইখ আত-তারতুসি ও শাইখ আল-মাকদিসির মতপার্থকের কারণ

মূলত যারা এই দুই শাইখের রচনাবলীর সাথে পরিচিত তারা জানবেন যে আগে থেকেই তাঁদের দুজনের অবস্থানের মধ্যে কিছু ভিন্নতা ছিল। আর আলিমদের মধ্যে এধরণের মতপার্থক্য থাকা অদ্ভুত কিছু না। মোটা দাগে যারা একই মাসলাক কিংবা মানহাজের, তাঁদের মধ্যকার মতপার্থক্যকে পুঁজি করে সুযোগসন্ধানী তর্ক করার প্রবনতাও নতুন না। যেমন ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ – এর সাথে তাঁর ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ ও ইমাম আবু ইউসুফের ফিকহী মতের অনেক পার্থক্য ছিল, এ কথাকে পুঁজি করে দেশীয় আহলে হাদিসদের অনেকে হানাফি মাজহাবকে ভুল প্রমাণ করার হাস্যকর চেষ্টা চালায়। একইভাবে শাইখ বিন বায, শাইখ ইবনে উসাইমিন, শাইখ আল-আলবানির মধ্যে মাসআলাগত অনেক পার্থক্য ছিল, এ কথাকে ব্যবহার করে কিছু দেশীয় হানাফিরা ফিকহের ক্ষেত্রে সালাফি মানহাজকে ভুল প্রমাণ করার হাস্যকর চেষ্টা চালায়। এই একই রাস্তায় শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির সাথে শাইখ আবু বাসির আত-তারতুসি, শাইখ আব্দুল্লাহ আযযামের সাথে শাইখ উসামা বিন লাদেন, শাইখ আবু কাতাদা আল-ফিলিস্তিনির সাথে তানজীম কায়েদাতুল জিহাদের কিছু মতপার্থক্যের কথা এনে কিছু মানুষ মুজাহিদিনের মানহাজকে ভুল প্রমাণ করতে চায়।
কিন্তু এই মতপার্থক্য দ্বারা যেমন হানাফি মাজহাব ভুল প্রমাণ হয় না, ফিকহের ক্ষেত্রে সালাফি মানহাজ ভুল প্রমাণ হয় না, তেমনিভাবে মুজাহিদিনের মানহাজও ভুল প্রমাণ হয় না। আসলে যারা এমন দুর্বল তর্ক করে তারা হয় সঠিকভাবে প্রতিপক্ষের অবস্থান খন্ডনের নিয়ম সম্পর্কে অজ্ঞ, অথবা তর্কে জেতার ক্ষেত্রে অতি আবেগের বশবর্তী হয়ে ব্যাপারটি গভীরভাবে ভেবে দেখেননি, অথবা যেকোন মূল্যে তর্কে জিততে বেপরোয়া, অথবা তর্কের ক্ষেত্রে অসৎ, ওয়াল্লাহু আলাম। তবে আমরা আমাদের মুসলিম ভাইয়ের ব্যাপারে সর্বোচ্চ ভালো ধারণা রাখার চেষ্টাই করবো।
এ বিষয়টি বুঝতে পারলে শাইখ আবু বাসির আত-তারতুসির সাথে শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির মতপার্থক্য সঠিক আলোতে দেখা আমাদের জন্য সহজ হবে ইনশাআল্লাহ। তাদের মধ্যকার মতপার্থক্য মূল কারণ হল শামে যুদ্ধরত দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরণের দলের ব্যাপারে কী মনোভাব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন। শামের কিছু দল জাতীয়তাবাদী, কিছু দল সেকুলার, কিছু দল গণতন্ত্রপন্থি, কিছু দল কুয়েত, কাতার, সৌদির সমর্থনপুষ্ট, আর কিছু দল ইসলামী শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার জন্য ক্বিতালরত। জাতীয়তাবাদী, সেকুলার, গণতান্ত্রিক ও আরব দেশগুলোর সমর্থনপুস্ট দলগুলোর সাথে আচরণ কেমন হবে – মূলত এ প্রশ্নে এই দুই শাইখের মতের পার্থক্য। আর বিশেষ করে তুর্কির সাথে আচরণ কেমন হবে, ও এরদোগানের ব্যাপারে মত কেমন হবে – এই প্রশ্নে তাঁদের মতের পার্থক্য। এই মতপার্থক্য ও কোন দলিল ও যুক্তির ভিত্তিতে তাঁদের অবস্থান, এ নিয়ে ঠিকমতো বুঝাতে হলে বিস্তারিত আলোচনার দরকার, তাই আমরা এখন এই আলোচনাতে যাবো না।
তানজীম কায়দাতুল জিহাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে “ফিতনা সৃষ্টি হওয়া” এসবই শামের ময়দানে হওয়া ফিতনার ব্যাপারে শাইখ আত-তারতুসির নিজস্ব বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা কথা। একইভাবে তাঁর ব্যাপারে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন বিশ্লেষণ এসেছে। কিন্তু এসব ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ নিয়ে আলোচনায় আমাদের আগ্রহ নেই এবং এ আলোচনা আসলে অনর্থক।
কিন্তু লক্ষনীয় বিষয় হল, এই মতপার্থক্য হল শামের জিহাদের প্রেক্ষাপটে করণীয়, রণকৌশল, পদ্ধতি – ইত্যাদি প্রশ্ন নিয়ে। শাইখদের নিজেদের মধ্যের এধরণের মতপার্থক্যের সাথে বর্তমান যুগের মুরজিয়া, ইরজাগ্রস্থ ও জগাখিচুড়ি মানহাজ কিংবা বিভ্রান্তদের সাথে তাঁদের উভয়ের মতপার্থক্যের কোন তুলনা হয়না।
বস্তুত এ মতপার্থক্য হাইলাইট করা হয় যাতে করে এর দ্বারা মুজাহিদিনের মানহাজ ও দাওয়াহকে হালকা করা যায়। আরব বিশ্বে এগুলো আগেই হয়েছে, এখন দেশীয়রাও এই চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ এ দুর্বল প্রচেষ্টা আগেও তাদের দিকেই ফিরে গেছে এবং ভবিষ্যতেও যাবে ইনশাআল্লাহ।

৩) দুজনের কেউ কি তাঁদের পূর্বের অবস্থান বদলে ফেলেছেন? যেকারনে এই মতপার্থক্য?

আমরা ছোটখাট মতপার্থক্যের কারণে কোন শাইখের সমালোচনা করতে ইচ্ছুক নই। আমরা শুধু এ একারনেই এ বিষয়টির অবতারণা করছি যাতে করে পাঠক বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পান।
শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসি এবং শাইখ আবু বাসির আত-তারতুসির রচনাবলী অনলাইনে সহজেই পাওয়া যায়, এবং এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সুতরাং চক্ষুষ্মান, বিবেকমান, সত্যান্বেষীদের জন্য এ বিষয়টি যাচাই করা খুব সহজ। বাস্তবতা হল এই যে আমাদের শাইখ, বর্তমান যুগের মুওয়াহিদিনের শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির অবস্থান শুরু থেকেই স্পষ্ট। তিনি নির্ভীক ও দৃঢ়ভাবে কোন নিন্দা ও নির্যাতনের পরোয়া না করে শুরু থেকেই তাঁর অবস্থান ঘোষণা করে আসছেন। মুশরিক, কাফির, মুরতাদ, মুনাফিক ও মুরজিয়াদের কোন পরোয়া তিনি করেননি। আর গত ৩০ বছরে তাঁর অবস্থানে তিনি তাঁর আক্বিদা ও মানহাজে মৌলিক কোন পরিবর্তন আনেননি। তিনি সেই সত্যের উপরেই আছেন যেই সত্যের উপর তিনি তিন দশক আগে ছিলেন।
তানজীম আদ-দাওলাহর দিক থেকে অভিযোগ করা হয়েছে তিনি তাঁর মানহাজকে “নরম” করে ফেলেছেন। অন্যদিকে অনেকে অনেক অভিযোগ করেছে যে তাঁর মানহাজই হল দাইশের মানহাজ। কিন্তু তিনি উভয় অভিযোগ থেকেই মুক্ত এবং যাচাইকারীরা তাঁর সুপরিচিত ও সুস্পষ্ট বইগুলো এ কথা যাচাই করে নিতে পারেন।
অন্যদিকে শাইখ আবু বাসির আত-তারতুসির দুই দশক আগে লেখা কিতাবাদিও পাঠকের জন্য উন্মুক্ত আছে। আর এগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে আদল, ইনসাফের অধিকারী যে কেউ স্বীকার করবে যে তিনি বেশ কিছু বিষয়ে, যেমন গণতন্ত্র, সেকুলার শাসক, তাওয়াল্লি ইত্যাদি, নিজের পূর্বের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। গণতন্ত্র ও আল্লাহর আইন ব্যাতীত শাসন করা শাসকের ব্যাপারে তাঁর পূর্বের বক্তব্য এবং এরদোগানের ব্যাপারে তাঁর এখনের বক্তব্য পাশাপাশি রাখলেই যেকেউ একথা বুঝতে পারবে। আমরা সমালোচনা হিসাবে এ কথা বলছি না, একটি সত্য তথ্য হিসাবে একে উপস্থাপন করছি।
সুতরাং শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাক্বিদিসি আজো সেই অবস্থানের উপরেই আছেন যে অবস্থানের কারণে শাইখ আল-আল্লামা হামুদ বিন উকলা আশ-শুয়াইবি রাহিমাহুল্লাহ তাঁদের প্রশংসা করেছেন, তাঁদের রচনাবলী পড়তে ও তাঁদের অধীনে শিক্ষাগ্রহণ করার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন, তাঁদের জন্য দুয়া করেছেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের মোকাবেলায় তাঁদের প্রতিরক্ষায় কথা বলেছেন। এবং শাইখ আল-মাকদিসি আজো সেই অবস্থানেই আছেন যে অবস্থান নিয়ে শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসি, শাইখ আবু কাতাদা ও শাইখ আবু বাসির আত-তারতুসির ব্যাপারে শাইখ আলি আল-খুদাইর ফাকাল্লাহু আসরাহ বলেছেন –
“তাঁরা বিশুদ্ধ তাওহীদ ও সঠিক আক্বিদার উপর প্রতিষ্ঠিত আহলে সুন্নাহ্ ওয়াল জামাহর আলেম, তারা আহলে জিহাদ এবং লেখনী ও তালিমের লোক। তাদের ব্যাপারে আমরা ভালো ব্যতীত অন্য কিছুই জানি না। কিছু কিছু লোক তাকফিরের বিষয়ে তাদের ব্যাপারে মিথ্যে ও বানোয়াট কথা আরোপ করে, এটা মুরজিয়াগোষ্ঠীর কাজ । অথচ তাঁরা ঈমান এবং তাকফিরের ব্যাপারে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাহর সঠিক উসূলের (মূলনীতির) উপর প্রতিষ্ঠিত আছেন।
লিঙ্ক – https://bit.ly/2nNXKOR
অন্যদিকে পরিবর্তন এসেছে শাইখ আবু বাসির আত-তারতুসির অবস্থানে। সুতরাং বুঝা গেল, যদি এই মতপার্থক্যের কারণে কারো অবস্থানের ব্যাপারে প্রশ্ন উঠে তবে সেটা হলে শাইখ আত-তারতুসির অবস্থান, শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসির অবস্থানে না।
আল্লাহ শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল মাকদিসিকে উত্তম পুরস্কার দিন, তাঁকে দুই কল্যাণময় ফলাফলের একটি দান করুন। তিনি আমাদের শাইখ, তিনি আমাদের জন্য বিভ্রান্তির এ যুগে সত্যের দিকনির্দেশনা ও সত্যের উপর অবিচল থাকার এ উজ্জ্বল নক্ষত্র। আমরা আল্লাহর জন্য তাঁকে ভালোবাসি, তাঁকে আমাদের শাইখ বলতে পারাকে নিজেদের জন্য মর্যাদা মনে করি এবং তাঁর প্রতিরক্ষায় দুই লাইন লিখতে পারাকে সৌভাগ্য ও সম্মান মনে করি।
(তাড়াহুড়া করে লেখার কারণে অনেক তথ্যসূত্র এখানে যুক্ত করতে পারিনি। ইনশাল্লাহ ব্যস্ততা থেকে অবসর পেলে এগুলো যুক্ত করে দেওয়া হবে- লেখক)
[ সংগৃহীত ]

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

7 − 5 =

Back to top button