জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণ কি?
– নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সম্ভ্রান্ত-ধনী ঘরের ছেলেরা কেন জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে?
.
#উত্তর – আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন –
তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নির্বাপিত করতে চায়। কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই তাঁর নূরের পূর্ণতা বিধান করবেন, যদিও কাফেররা তা অপ্রীতিকর মনে করে।[আত-তাওবাহ ৩২]
এর ব্যাখ্যা হিসেবে এতোদিন বলা হত, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বেকারত্ব, হতাশা, সুক্ষ চিন্তার অক্ষমতা ইত্যাদির কারনে মুসলিম যুবকরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যায়। এ ব্যাখ্যা শুধু বাংলাদেশেই জনপ্রিয় এমন না, সারা বিশ্বব্যাপী অনেক মাথামোটা আছে যারা এখনো এ বস্তাপচা ব্যাখ্যা প্রচার করে বেড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কারনে এখন হঠাৎ এরা বুঝতে পেরেছে তাদের এ তত্ত্ব হাস্যকর ভাবে ভুল ছিল।
.
এখন তারা দেখতে পাচ্ছে নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, “সম্ভ্রান্ত” ধনী-পরিবারের ছেলে সবাই জঙ্গি হয়ে যাচ্ছে। অভাব-অনটন, হতাশা-বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা – ইত্যাদির কথা বলে এখন আর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। আর তাই এখন তারা হন্যে হয়ে নতুন উত্তর খুজছে। কখনো দোষ দিচ্ছে জাকির নায়েককে, কখনো দোষ দিচ্ছে নর্থ-সাউথ আর ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা ব্যবস্থাকে। আবার অনেকে অলীক কল্পনার ব্রেইনওয়াশ তত্ত্ব নিয়ে পড়ে আছে।
.
কেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাদ্রাসা, ইংলিশ মিডিয়াম থেকে উর্দু মিডিয়াম, ধনী থেকে গরীব, সফল ব্যবসায়ী থেকে সফল শিক্ষক – সকলেই জঙ্গিদের সাথে যোগ দিচ্ছে তার ব্যাখ্যা আসলে খুব সহজ। একটা শব্দে এর উত্তর দেওয়া যায়, আর তা হল আদর্শ। একজন ঠান্ডা মাথার, চিন্তা করতে সক্ষম যুবক যখন আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকায় তখন এটা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় আওয়ামী চেতনা, বিএনপি চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, হাজার বছরের বাঙ্গালী চেতনা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ – এসব গালভরা বুলি ছাড়া আর কিছুই না। এগুলোর না কোন বাস্তব অস্তিত্ব আছে আর না এগুলো পারে পৃথিবী তো দূরের কথা, বাংলাদেশের কোন সমস্যার সমাধান দিতে। অন্যদিকে ইসলাম শুধুমাত্র এক বিশুদ্ধ আদর্শই দিচ্ছে না, বরং সমগ্র পৃথিবীর জন্য একটি বাস্তব সমাধান দিচ্ছে। আর এ এমন এক পথ যে পথে প্রতিটি পদক্ষেপের পুরস্কার দেবেন আসমান ও যমীনের মালিক।
.
দিন শেষে ক্ষমতাসীনদের দর্শন হল নিজেদের জমিদারী-জোতদারী টিকিয়ে রাখা। আর সাধারণ মানুষের দর্শন হল নিজে কামাই করা, নিজে শান্তিতে থাকা, আরাম-আয়েশে থাকা, নির্বিঘ্নে সন্তান-সন্তন্তি নিয়ে ভালোয় ভালোয় জীবন কাটিয়ে দেওয়া। চরম ব্যাক্তিকেন্দ্রিকতা এবং নিস্তরঙ্গ জীবনের আকাঙ্ক্ষা দিয়ে আপনি ঐসব মানুষকে বুঝ দিয়ে রাখতে পারবেন না, যারা আসলেই বুঝে জীবনের সাফল্য শুধু খাওয়া-ঘুমানো-বাচ্চা দেওয়া-বুড়ো হওয়া আর মরে যাওয়ার মধ্যে না।
যারা বুঝে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ শুধু একটি বুলি না বরং একটি চিরন্তন দর্শন। যারা বোঝে শুধু ঈমান এনেছি এটুকু বললেই জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সমীকরণটা এমন না।
.
তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্য্যশীল। [আলে ইমরান, ১৪২]
.
তাই সহজ ভাষায় যেহেতু এ সমাজ, এ রাষ্ট্র, এ সভ্যতা যুবকদের সামনে, টাকা-পয়সা-বাড়ি-গাড়ি-মেয়ে-মদ এসবের বাইরে আর কোন আদর্শ-লক্ষ্য-উদ্দেশ্য দিতে পারছে না তাই তাদের এ সত্য মেনে নেওয়া উচিৎ যে আল্লাহর ইচ্ছায় ক্রমান্বয়ে আরো বেশি বেশি যুবক জঙ্গি হওয়া শুরু করবে। শুধুমাত্র যেসব মাথামোটা,কাপুরুষ, ছাপোষা-গৃহী নিজের পেট, নিজের শরীর, নিজের মনের চাহিদা আর নিজের শান্তিকে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মনে করে, এদের বাদ দিয়ে বাকি যতো যুবক আছে, হোক তারা মাদ্রাসার কিংবা ইউনিভার্সিটির, তারা এ আদর্শের দিকেই আসবে।
যেহেতু এ ঘুণে ধরা সমাজ কোন আদর্শ-সমাধান-দৃষ্টান্ত কোন কিছুই দিতে পারছে না, আর যেহেতু ইসলাম এসব কিছুই দিতে পারছে তাই যেকোন বুদ্ধিমান মানুষ ইসলামকেই বেছে নিবে। পৃথিবীর সব মানুশে খোয়ারের গবাদি পশুর মতো আরাম-আয়েশের কাঙ্গাল হয় না। আর তাই সুশীলরা যেসব কিছুর জন্য প্রতিদিন নিজেদের বিক্রি করে, সেসব কিছু পায়ে ঠেলেই জঙ্গিরা জান্নাতের দিকে পাড়ি দেয়।
.
বস্তুত জঙ্গিদের ইতিহাস ঘাটলে আপনারা দেখবেন উচ্চশিক্ষিত এবং ধনী-সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেরাই অধিকহারে জঙ্গি হয়। এটা নতুন কোন ট্রেন্ড না। শায়খ উসামার পরিবার পুরো আরবের সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে একটি। সাউদী বাদশার যখন নিজস্ব প্লেন ছিল না তখন শায়খ উসামা তার বাবার প্লেনে চড়ে মক্কা-মদীনা আর আল-আক্বসাতে একেক ওয়াক্তের নামায আদায় করতেন। মাসজিদুল হারামের সংস্কার কাজ শায়খ উসামার বাবা নিজের খরচে করে দিয়েছিলেন।
শায়খ উসামা নিজে ছিলেন সফল ব্যাবসায়ী। শায়খ আইমান আল-যাওয়াহিরির নানা ও দাদার মধ্যে একজন ছিলেন পাকিস্তানে মিশরের রাস্ট্রদূত আরেকজন ছিলেন আল-আজহারের প্রধান ইমাম। শায়খ আইমান নিজে একজন আই-সার্জন। শায়খ আনওয়ার আল-আওলাকীর বাবা ছিলেন একসময় ইয়েমেনের কৃষিমন্ত্রী, আর শায়খ আওলাকী নিজে ছিলেন একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। শায়খ আবু মুস’আব আল-সুরী ছিলেন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার।
.
৯/১১ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী শায়খ খালিদ শেইখ মুহাম্মাদ ছিলেন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার, ৯/১১ হামলাকারী দলের আমীর মুহাম্মাদ আতা থিসিস করেছিলেন আরবান প্ল্যানিং-এর উপর জার্মানীর টেকনিকাল ইউনিভার্সিটি থেকে। শায়খ আবু ইউসুফ আল তুর্কি ছিলেন তুর্কি আর্মির এলিট স্নাইপার। শহীদ খালিদ ইসলামবুলি, শায়খ মুহাম্মাদ ইসলামবুলি, শায়খ সাইফ আল আদল ছিলেন মিশরীয় আর্মির চৌকস অফিসার। পাকিস্তান আর্মির স্পেশাল ইউনিটের সদস্য মেজর হারুন আর্মি ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন জঙ্গিদের সাথে। যোগ করেছিলেন আফগানিস্তানে ন্যাটো বিরোধী গেরিলা যুদ্ধে নতুন মাত্রা।
শায়খ ইলিয়াস কাশ্মীরীকে তার জীবদ্দশায় গণ্য করা হত বিশ্বের সবচেয়ে দুধর্ষ গেরিলা কমান্ডার হিসেবে। এরা সকলেই ছিলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি, যারা একই আদর্শের ছায়াতলে আল-ক্বা’ইদাতে একত্রিত হয়েছিলেন। যেকারনে সি.আই.এ এর অফিসার মাইকেল শ’ইয়ার আক্ষেপ করে বলেছিলেন –
.
“আল-ক্বা’ইদা আরব ও মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে সেরা ও ধারালো মাথাগুলোকে নিজেদের কাজে লাগাচ্ছে এবং শুরু থেকে লাগিয়ে আসছে।“
.
যদি আমরা শেকড়ের দিকে তাকাই, তাহলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে। এ ট্রেন্ডের শুরু আসলে আরো অনেক অনেক আগে। মুস’আব ইবন উমাইর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন শুধুমাত্র তাওহীদের বিশ্বাসের কারনে ধন-সম্পদ, আরাম-আয়েশের জীবন ছেড়ে দিলেন, তখনই এ ট্রেন্ডের শুরু।
আবু বাকর, উসমান, তালহা, যুবাইর, সা’দ এর মতো সম্ভ্রান্ত ক্বুরা’ইশ ব্যক্তিত্ব ও যুবারা যখন প্রভাব-প্রতিপত্তি-যশ-খ্যাতি-সম্পদ সব তুচ্ছ করে, নিজেদের আরাম-আয়েশের জীবনকে ছুড়ে ফেললেন ইসলামের জন্য, তখন থেকেই এ ট্রেন্ডের শুরু – রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন। আর তখন থেকেই এ ট্রেন্ড চলে আসছে।
.
সুতরাং বাংলাদেশের নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, ধনী-“সম্ভ্রান্ত” পরিবারের ছেলেরা জঙ্গিদের সাথে যোগ দিচ্ছে এটা আলাদা কিছু না, দীর্ঘদিনের বৈশ্বিক ট্রেন্ডের ধারবাহিকতা মাত্র। এবং এ ট্রেন্ড আরো শক্তিশালীই হবে। এবং এর মোকাবেলা করার মতো আদর্শিক শক্তি, সক্ষমতা, যোগ্যতা কোনটাই ব্যাক্তিকেন্দ্রিক কাপুরুষতা নির্ভর সেক্যুলার সমাজের নেই। সেক্যুলারদের সুবিধার জন্য এক সেক্যুলার চিন্তাবিদের উক্তি দিয়ে বিষয়টা বোঝাচ্ছি।
.
ফরাসি সেক্যুলার দার্শনিক ভিক্টর হুগো বলেছিল –
.
No army can stop an idea whose time has come
যে আদর্শের সময় উপগত হয়েছে, কোন বাহিনীর পক্ষেই সম্ভব না তাকে দাবিয়ে রাখার।
.
আল্লাহর ইচ্ছায় জঙ্গিদের আদর্শের সময় উপগত।
যারা আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করে তাদেরকে এক টুকরা রঙ্গিন কাপড় আর কাল্পনিক মানচিত্রের জন্য যুদ্ধ করা জাতীয়তাবাদী ভাড়াটে আর্মি দিয়ে, মোবাইল কোম্পানীর নাচ-গান নির্ভর দেশপ্রেমের হাওয়াই মিঠাই দিয়ে, শাহবাগী আলিমদের ফাতাওয়া, আর শাহবাগীদের বস্তাপচা রাবীন্দ্রিক চেতনা দিয়ে, মুজিব আর জিয়ার রঙ্গ চড়ানো কেচ্ছা শুনিয়ে, কাপুরুষতাকে হিকমাহ দাবি করে, বুশ আর ওবামার প্রেসক্রিপশান দিয়ে ইন শা আল্লাহ বুঝ দেওয়া যাবে না, দাবিয়েও রাখা যাবে না।