প্রবন্ধ-নিবন্ধ

বিষাক্ত বাতাস

বিষাক্ত বাতাস

অস্বস্তির দিনে মন জুড়ানো বাতাস, কিন্তু সেটা বিষাক্ত হলে যে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশি বয়ে আনতে পারে। প্রকৃত বুদ্ধিমানরা তাই বাতাসের মনপ্রাণ জুড়ানোর বৈশিষ্ট্যেরও উপরে এর বিশুদ্ধতাকেই প্রাধান্য দেয়। বিষাক্ততার মধ্যে আরামের দিনানিপাত করে শেষমেশ নিজেরই ক্ষতিসাধন আকলসম্পন্ন মুসলিমকে মানায় না।
.
অথচ আজ এমন মুসলিম অহরহ পাওয়া যায় যারা দিনের পর দিন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ﷺ নির্দেশিত পবিত্র বাতাসে না থেকে নানা বাহানায় বিষাক্ত বাতাসে জীবন অতিবাহিত করাকে বেছে নেয়। একেবারে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আদর্শিক পর্যায় পর্যন্ত, সাধারণ আবিদ থেকে একেবারে শীর্ষস্থানীয় উলামা পর্যন্ত – সকল শ্রেণিতেই কিছু বান্দা যেন এব্যাপারে একেবারেই অন্ধ। আর ফলস্বরূপ যে বিষক্রিয়া তাদের অন্তরে শুরু হয়, সময়ের সাথে সাথে তা কখনও তাদের হিদায়াত-প্রদীপের টিপটিপ করা শেষ আলোটুকুও নিভিয়ে দেয়।
.
[এক] .
আল্লাহর রহমতে যখন কোনো আবদুল্লাহ বা আমাতুল্লাহর হিদায়াতের পথে চলা শুরু হয়, তখন সে আল্লাহর জন্য জীবনের রুটিনটাকে সাজিয়ে নিতে চায়। প্রথমদিকে সলাত, লিবাস, ব্যক্তিগত পর্যায়ের ইবাদাত, হালাল-হারাম ইত্যাদিতে মনোযোগী হওয়া, নিজস্ব গন্ডির মধ্যে ইলম অর্জন, আশপাশের মানুষদের দাওয়াহ ইত্যাদি চলে। কিন্তু একটা পর্যায়ে অনেকেরই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় খেয়াল থাকে না। সেটা হল নিজের সাধ্যের বাহিরে গিয়ে জাহিল সঙ্গীসাথীদের সাথে বেশি সময় কাটানো।
.
হয়তো বান্দা জাহিলিয়্যাতের বিষাক্ততা উপলব্ধি করতে পারে, আর তাই নিজেকে সেগুলো থেকে গুটিয়ে নিতেও চায়। কিন্তু হিদায়াত পূর্ববর্তী জীবনের সঙ্গীসাথীর সাথে অপ্রয়োজনীয় মেলামেশার ফলে সে আবারও কোনো জাহিলিয়্যাতে জড়িয়ে যায়। জাহিল সঙ্গীসাথীর আশেপাশের বাতাসটা যে বিষাক্ত তা তার খেয়াল থাকে না। এসময় শয়তান তাকে ‘দাওয়াহর নিয়্যাতের’ ধোঁকা দেয়। নিজের দাওয়াহর সাধ্য কতটুকু, যাদের দাওয়াহ দেওয়া হচ্ছে তারা কি আসলেই প্রভাবিত হচ্ছে নাকি দাঈ নিজেই ক্ষণসময়ের জন্য প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো খেয়াল থাকে না।
.
প্রথমত, সিরতল মুস্তাকিমে চলতে শুরু করা প্রথমদিকের বান্দাদের জন্য জাহিলদের সঙ্গ যে কতটা বিষাক্ত তা অল্পই অনুধাবণ করে। জাহিলদের সঙ্গ বেশিরভাগ সময়ে জাহিলিয়্যাতের দিকেই টানে। হয়তো এমন কোনো কথা বা কাজ যাতে মুমিনের হাসা উচিত ছিল না, হয়তো এমন কোনো চটকদার আলোচনা যাতে মুমিনের নির্লিপ্ত থাকবার কথা ছিল তাতে সে সহাস্যে অংশ নিয়ে নেয়। সরাসরি জাহিলিয়্যাতে না জড়ালেও বান্দা অন্তত ঈমান কমিয়ে বাড়ি ফেরে। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন –
.
مَثَلُ الْجَلِيسِ الصَّالِحِ وَالْجَلِيسِ السَّوْءِ كَمَثَلِ صَاحِبِ الْمِسْكِ، وَكِيرِ الْحَدَّادِ، لاَ يَعْدَمُكَ مِنْ صَاحِبِ الْمِسْكِ إِمَّا تَشْتَرِيهِ، أَوْ تَجِدُ رِيحَهُ، وَكِيرُ الْحَدَّادِ يُحْرِقُ بَدَنَكَ أَوْ ثَوْبَكَ أَوْ تَجِدُ مِنْهُ رِيحًا خَبِيثَةً ‏”
.
“সৎ ও অসৎ বন্ধুর উদাহরণ হল আতর বিক্রেতা ও কামারের ন্যায়। আতর বিক্রেতা হয়তো তোমাকে একটু আতর লাগিয়ে দেবে, অথবা তুমি তার কাছ থেকে আতর ক্রয় করবে, অথবা তুমি তার কাছে আতরের ঘ্রাণ পাবে। আর কামার হয়তো তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে, নয়তো তার কাছ থেকে খারাপ গন্ধ পাবে।’ [সহিহ বুখারি, ২১০১] .
এমনও অনেক ঘটনা রয়েছে যে জাহিলদের সাথে নিত্য মেলামেশার ফলে দীর্ঘদিনের প্র্যাকটিসিংরা আবার জাহিলিয়্যাতে ফিরে গিয়েছে। জাহিল সঙ্গের বিষাক্ততা এতটাই মারাত্নক হতে পারে। আউযুবিল্লাহ –আল্লাহর কাছে এমন অবস্থা থেকে আশ্রয় চাই। হিদায়াতের ছিটেফোঁটা যার মধ্যে উপস্থিত, সে পুনরায় জাহিলিয়্যাতে ফিরে যাওয়াকে তো আগুনে ঝাঁপ দেওয়াই মনে করে। কিন্তু এই ব্যাপারটাই খেয়াল থাকে না যখন তা দীর্ঘদিনের পরিচিত কেউ হয়।
.
الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ
.
“ব্যক্তি তার বন্ধুর দ্বীন গ্রহণ করে। তাই প্রত্যেকে যেন যাচাই করে নেয় কাকে সে বন্ধু বানায়।” [সুনানে আবু দাঊদ, ৪৮৩৩] .
আর এখানে গাইরে মাহরামদের কথাও বলা হচ্ছে না। গাইরে মাহরামদের সাথে তো দাওয়াহর নিয়্যাতেও কথা বলা জায়িজ নেই। বরং পুরুষদের ক্ষেত্রে পুরুষ, আর নারীদের ক্ষেত্রে নারী – জায়িজভাবেই যারা দাওয়াহর যোগ্য তারাও জাহিল হলে তাদের নিয়মিত সঙ্গ কতটা ক্ষতিকর হতে পারে সেটাই উদ্দেশ্য। আর বাস্তবতা হল, জাহিলদের সাথে সময় কাটানোগুলো অনেকসময়ই খোশগল্প, কোয়ালিটি টাইম কাটানো ইত্যাদি গাইরুল্লাহ নিয়্যাতেও হয় – যেন মনজুড়ানো… কিন্তু বিষাক্ত বাতাস।
.
দ্বিতীয়ত, জাহিলদের সঙ্গে নিত্য মেলামেশার আরেকটি মহামারি বিপর্যয় হল তাদের মনমতো দাওয়াত দিতে গিয়ে দ্বীন ইসলামকেই ছেঁটে ফেলতে শুরু করা। মুসলিমপ্রধান সমাজগুলোতে দ্বীনকে খাহেশাত অনুযায়ী কাঁটছাট করার এক অন্যতম কারণ – জাহিলদের সাথে নিত্য মেলামেশা করে তাদের জন্য আল্লাহর দ্বীনকে আকর্ষণীয় করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা।
.
খেয়াল রাখা উচিত, প্রথমে কিন্তু এমন বিচ্যুতিগুলো থাকে খুবই সীমিত আর তা ভাল নিয়্যাতেই শুরু হয়। কিন্তু দিনে দিনে বিচ্যুতি বাড়তে থাকে আর কখনও কখনও তা বান্দাকে দ্বীন ইসলামের অবিসংবাদী বিষয় অস্বীকার, আল্লাহর রাসূল ﷺ বা তাঁর সাহাবাদের ঘটনা নিয়ে মিথ্যাচার, দ্বীনের কোনো উসুল বিকৃতি ইত্যাদিতে লিপ্ত করায়। একটা সময় পর দেখা যায়, যে বান্দা একসময় উদ্যোমের সাথে সিরতল মুস্তাকিমে চলতো, সে বান্দাই লিখে-বই বের করে ইত্যাদি নিত্যনতুন পন্থায় আল্লাহর দ্বীনকে বিকৃত করে চলেছে। অথচ দ্বীনকে সহজ করতে বলা হয়েছিল, বিকৃত করতে নয়।
.
আর এই বিষয়টা পূর্বোল্লিখিতের মতো একজনের হিদায়াত থেকে ফিরে যাবার চেয়েও ক্ষতিকর। কেননা এমন দাঈ’রা নিজেই গোমরাহিতে হাঁটে না, বরং অন্যান্যদেরও খাহেশাতের বিকৃত দ্বীনে শামিল করায়। এই ধরনের মানুষেরা নিজেদের গোমরাহি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকে আর ভাবে যে তারা সরল পথেই রয়েছে।
.
قل هل ننبئكم بالأخسرين أعمالا الذين ضل سعيهم في الحياة الدنيا وهم يحسبون أنهم يحسنون صنعا
.
“বলুন, আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব, কর্মে কারা সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? তারা সেইসব লোক, পার্থিব জীবনে যাদের সমস্ত দৌড়-ঝাপ সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, অথচ তারা মনে করে, তারা খুবই ভাল কাজ করছে।” [সূরা কাহফ, ১০৪] .
এই অংশের শেষে উল্লেখ্য, অবশ্যই যেসকল দাঈরা জাহিলদেরকে দাওয়াতও দেয় আবার নিজেরা জাহিলিয়্যাতে প্রভাবিত হয়ে যায় না, জাহিলদের জন্য সহজ করতে গিয়ে আল্লাহর দ্বীনকে কাটছাঁট করে না তারাই উত্তম দাঈ ইলাল্লাহ। কিন্তু একইসাথে মনে রাখা উচিত সকলের তেমন সামর্থ্য থাকে না। আর নিজেরা চাইলেই পরিচিত মহলের কাউকে হিদায়াত দেওয়া যায় না। স্বয়ং রাসূলুল্লাহর ﷺ চাচা আবু তালিবের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে কুরআনের আয়াত –
.
إِنَّكَ لَا تَہۡدِى مَنۡ أَحۡبَبۡتَ وَلَـٰكِنَّ ٱللَّهَ يَہۡدِى مَن يَشَآءُ‌ۚ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ (٥٦)
.
“আপনি যাকে পছন্দ করেন, তাকে (চাইলেই) সৎপথে আনতে পারবেন না, তবে আল্লাহ তা’আলাই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন। কে সৎপথে আসবে, সে সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন।” [সূরা কাসাস, ৫৬] .
তাই হিদায়াতের ব্যাপারে মুমিনদের সাবধান হওয়া উচিত, আল্লাহকে ভয় করা উচিত। এক ঘণ্টা জাহিলদের দাওয়াতের জন্য ব্যয় করলে তিন ঘণ্টা দ্বীনদারদের সাথে ব্যয় করা উচিত। অপ্রয়োজনীয় কারণে জাহিলিয়্যাতের বিষাক্ত বাতাস এড়িয়ে চলা উচিত। আল্লাহ আমাদেরকে বোঝার এবং সাধ্যানুযায়ী দাওয়াতের তাওফিক দিন।
.
ٱلۡأَخِلَّآءُ يَوۡمَٮِٕذِۭ بَعۡضُهُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوٌّ إِلَّا ٱلۡمُتَّقِينَ (٦٧)
.
“ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও সেদিন হবে একে অপরের শত্রু, মুত্তাকীরা ব্যতীত।” [সূরা যুখরুফ, ৬৭] .
.
[দুই] .
জাহিল মুসলিমদের সাথেই নিত্য অবস্থানের পরিণতি এতটা ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা থাকলে কাফিরদের দেশে কাফিরদের মাঝে বসবাসের পরিণতি কেমন হতে পারে?
.
(চলবে ইন-শা-আল্লাহ…)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × three =

Back to top button