সংশয়-৩: রাষ্ট্র ক্ষমতা ছাড়া জিহাদ করা যায় কিনা?
সংশয়-৩: রাষ্ট্র ক্ষমতা ছাড়া জিহাদ করা যায় কিনা?
————-
সৌদি রাজপরিবারের ভক্ত তথাকথিত অনেক আলেম জিহাদের জন্য একটা আজব শর্ত যোগ করেনঃ তা হলো জিহাদের জন্য নাকি রাস্ট্রক্ষমতা থাকা জরুরী।
প্রথমতঃ এসব ‘আজব আলেম’দের পূর্বে কোন সলফে সালেহীন এ রকম ‘আজব কথা’ বলেন নি।
তারা অনেক ব্যাপারে সলফে সালেহীনদের অনুসরণের দাবী করলেও জিহাদের ক্ষেত্রে সলফে সালেহীনদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সৌদি রাজার গুনগ্রাহী আলেমদেরকে অনুসরণ করেন।
দ্বিতীয়তঃ রাষ্ট্র ক্ষমতা ছাড়াই একত্রিত হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দলীল হলো সহীহ বুখারীতে বর্ণিত আবু বছীর (রাঃ) এর ঘটনা। যেখানে বলা হয়েছে হুদাইবিয়ার সন্ধির পর যখন মক্কা থেকে পালিয়ে আসা মুসলমানদেরকে মদীনা থেকে মক্কায় ফেরত দেওয়া হলো। সে সময় আবু বছীর (রাঃ) মদীনাতে পালিয়ে আসেন। তখন কাফিরদের পক্ষ থেকে দুজন দূত তাকে নিতে আসলে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে তাদের হাতে তুলে দেন। পথিমধ্যে তিনি তাদের একজনকে হত্যা করেন এবং আবার মদীনাতে ফিরে আসেন। তাঁকে দেখে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
وَيْلُ أُمِّهِ مِسْعَرَ حَرْبٍ، لَوْ كَانَ لَهُ أَحَدٌ
‘কি আশ্চর্য ! এ তো যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে সক্ষম। যদি এর সাথে কেউ থাকতো!’
এ কথা শুনে আবু বছীর (রাঃ) বুঝতে পারেন যে, তাকে আবার মুশরিকদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। তাই তিনি বের হয়ে পড়েন এবং সিফাল বাহর নামক এলাকাতে অবস্থান নেন। পরবর্তীতে মুসলমানরা একেরপর এক মক্কা থেকে পালিয়ে এসে আবু বছীর (রাঃ) এর সাথে মিলিত হতে থাকেন। তারা মক্কার যে কোনো ব্যবসায়ী কাফেলার কথা শুনলে তার উপর হামলা করে তাদের হত্যা করতেন এবং তাদের সম্পদ কেড়ে নিতেন। পরে কুরাইশরা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিকট পত্র লিখে সন্ধির উক্ত শর্তটি বতিল করার অনুরোধ জানায়। (সহীহ বুখারী)
এই হাদীসে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়,
ক) বিশ্ব নেতা বা খলীফা অনুপস্থিত না থাকলে বা তাঁর সাথে যোগাযোগ সম্ভব না হলে স্থানীয়ভাবে আল্লাহর শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করা যায়। কেননা আবু বছীর বা অন্য যেসব সাহাবা উক্ত স্থানে একত্রিত হয়েছিলেন তাদের কেউই খলীফা ছিলেন না। আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেঁচে থাকতে এমন দাবী কখনই যৌক্তিক হতে পারে না। আবার তারা মদীনা রাষ্ট্রের অনুগত নাগরিকও ছিলেন না। তাহলে তারা কুরাইশদের সাথে মদীনা রাষ্ট্রের সন্ধিকে মানতে বাধ্য থাকতেন। তারা যা করেছেন সে বিষয়ে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নির্দেশ দেন নি। এসকল সাহাবাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা নিয়ন্ত্রিত ভূখন্ড ছিল না। এসবই স্পষ্ট প্রমাণ করে যে জিহাদ করার জন্য একজন খলীফা থাকতে হবে বা রাষ্ট্র থাকতে হবে এটা শর্ত নয়।
অনেকে বলতে পারেন এ ঘটনা একদল সাহাবাদের আমল বর্ণনা করে এটা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথা বা কাজ নয়। এর উত্তর হলো রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এ খবর পৌঁছেছিল কিন্তু তিনি এর নিন্দা করেননি। তাছাড়া রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথা,
لَوْ كَانَ لَهُ أَحَدٌ
যদি এর সাথে কেউ থাকতো!
এই অংশের ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার আল আসকালানী (রঃ) বলেন,
لَوْ كَانَ لَهُ أَحَدٌ أَيْ يَنْصُرُهُ وَيُعَاضِدُهُ وَيُنَاصِرُهُ وَفِي رِوَايَةِ الْأَوْزَاعِيِّ لَوْ كَانَ لَهُ رِجَالٌ فَلُقِّنَهَا أَبُو بَصِيرٍ فَانْطَلَقَ وَفِيهِ إِشَارَةٌ إِلَيْهِ بِالْفِرَارِ لِئَلَّا يَرُدَّهُ إِلَى الْمُشْرِكِينَ وَرَمَزَ إِلَى مَنْ بَلَغَهُ ذَلِكَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ أَنْ يَلْحَقُوا بِهِ قَالَ جُمْهُورُ الْعُلَمَاءِ مِنَ الشَّافِعِيَّةِ وَغَيْرِهِمْ يَجُوزُ التَّعْرِيضُ بِذَلِكَ لَا التَّصْرِيحُ كَمَا فِي هَذِهِ الْقِصَّةِ وَاللَّهُ أَعْلَمُ
যদি তার সাথে কেউ থাকতো অর্থাৎ যদি তাকে কেউ সাহায্য ও সহযোগীতা করতো। ইমাম আওযাঈ (রঃ) এর রেওয়ায়েতে আছে যদি তার সাথে কিছু লোক থাকতো। এই কথাটি আবু বছীর (রাঃ) কে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে তিনি ফিরে গেছেন। এই কথার মধ্যে ইঙ্গিতে তাঁকে পালিয়ে যেতে বলা হয়েছে যাতে তাকে মুশরিকদের নিকট ফিরিয়ে দিতে না হয় এবং মক্কার অন্যান্য মুসলিমদের মধ্যে যার নিকট এই কথা পৌঁছায় তাকে আবু বছীরের সাথে মিলিত হওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। শাফিঈ মাযহাব ও অন্যান্য বেশিরভাগ আলেমরা বলেছেন (সন্ধি থাকা অবস্থায়) এধরনের কথা আকার ইঙ্গিতে বলা যেতে পারে যেমনটি এই ঘটনায় রয়েছে তবে সরাসরি নয়। (ফাতহুল বারী)
তৃতীয়তঃ রাষ্ট্র ক্ষমতা ছাড়াও যে জিহাদ ফরজ হয় এ বিষয়ে আর একটি দলীল হলো উবাদা ইবনে সমিত (রাঃ) বর্ণিত হাদীস,
وَأَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ، إِلَّا أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا، عِنْدَكُمْ مِنَ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিকট অঙ্গিকার নিয়েছিলেন যে, আমরা ক্ষমতাশীনদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবো না যতক্ষন না তারা স্পষ্ট কুফরীতে লিপ্ত হয় যে বিষয়ে আমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে প্রমান বিদ্যমান আছে।(মুত্তাফাকুন আলাইহি)
এই হাদীসের ভাষ্য হলো ক্ষমতাশীন খলীফা বা বাদশা যদি কুফরীতে লিপ্ত হয় তবে তখনি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ওয়জিব হবে।
ইমাম নববী (রঃ) বলেন,
قَالَ الْقَاضِي عِيَاضٌ أَجْمَعَ الْعُلَمَاءُ عَلَى أَنَّ الْإِمَامَةَ لَا تَنْعَقِدُ لِكَافِرٍ وَعَلَى أَنَّهُ لَوْ طَرَأَ عَلَيْهِ الْكُفْرُ انْعَزَلَ
কাজী ঈয়াদ বলেছেন আলেমরা ইজমা করেছেন যে,কোনো কাফির মুসলিমদের ইমাম (খলীফা) হতে পারে না আর যদি পরবর্তীতে কোনো খলীফা কাফির হয়ে যায় তবে তাকে পদচুত করতে হবে। (শরহে মুসলিম)
এখন একটু চিন্তা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ধরুন মুসলিম জাহানের একজন খলীফা রয়েছেন। মুসলিমরা তার আনুগত্য করে চলেছে। এখন যদি হঠাৎ উক্ত খলীফা কাফির হয়ে যায় এবং অস্ত্র বলে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায় তবে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ হলো ইসলামী রাষ্ট্রের অধিবাসী মুসলিমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। এখানে রাষ্ট্র ক্ষমতা কিন্তু উক্ত মুরতাদ শাসক ও তার সমর্থকদের দখলে আর মুসলিমরা রাষ্ট্র ক্ষমতাহীন। একজন কাফিরকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে হটিয়ে একজন মুসলিমকে সে স্থানে বসানোর জন্য মুসলিমরা যুদ্ধ করবে। তাহলে এ হাদীস এবং উম্মতের ইজমা থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা ছাড়াই জিহাদ শুধু বৈধ নয় বরং ওয়াজিব প্রমানিত হচ্ছে।
যারা মনে করেন হাদীসে কেবল খলীফা মুরতাদ হয়ে গেলে তাকে অপসারনের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য মুরতাদ শাসকদের অপসারনের প্রয়োজন নেই। এটা যেমন একদিকে হাদীসের শব্দের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক অন্যদিকে যুক্তির দিক থেকেও হাস্যকর। হাদীসে বলা হয়েছে,
وَأَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ، إِلَّا أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا، عِنْدَكُمْ مِنَ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিকট অঙ্গিকার নিয়েছিলেন যে আমরা ক্ষমতাশীনদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবো না যতক্ষন না তারা স্পষ্ট কুফরীতে লিপ্ত হয় যে বিষয়ে আমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে প্রমান বিদ্যমান আছে।
প্রথমে বলা হয়েছে (وَأَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ) আমরা ক্ষমতাশীনদের সাথে লড়াই করবো না। এখানে খলীফা (خليفة) বা খিলাফত (الخلافة) শব্দ ব্যাবহার করা হয়নি বরং (الامر) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ ক্ষমতা আর (أهل الأمر) শব্দের অর্থ ক্ষমতাসীন। এক কথায় হাদীসের প্রথম অংশে যে কোনো ধরনের ক্ষমতাসীনদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। পরে বলা হয়েছে (إِلَّا أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا) যতক্ষন না তোমরা স্পষ্ট কুফরী দেখতে পাও। তাহলে ক্ষমতাসীন যে কারো মধ্যে স্পষ্ট কুফরী দেখলে পেলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলা হচ্ছে। সে খলীফা হোক বা বাদশা হোক বা জন্মগতভাবেই কাফির হোক।
এখন যদি কেউ বলেন হাদীসে তোমরা ক্ষমতাশীনদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়োনা বলতে ক্ষমতাসীন খলীফাকে বুঝানো হচ্ছে। এবং স্পষ্ট কুফরী দেখতে পেলে যুদ্ধ করার যে বৈধতা দেওয়া হয়েছে সেটাও খলীফা যখন কুফরী করে তখন প্রযোজ্য, অন্য শাসকদের ক্ষেত্রে নয়। তাদের জন্য কথা হলোঃ যদি হাদীসের প্রথম অংশে ক্ষমতাশীনদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়োনা বলতে শুধু খলীফাকে বুঝানো হয় তাহলে তো খলীফা ছাড়া অন্যান্য শাসকদের সাথে যুদ্ধ করা এমনিতেই প্রমানিত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ হাদীসের অর্থ হবে ক্ষমতাশীন খলীফার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ো না যতক্ষন না তার মধ্যে কুফরী দেখা যায়। আর অন্যান্য শাসক যারা খলীফা নয় তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো সময়ই যুদ্ধ করতে পারো। একটু চিন্তা করলেই বিষয়টি বোঝা যাবে।