উস্তাদ আহমাদ ফারুক রহ. এর সাথে কিছুক্ষণ (পর্ব – ৩+৪) – মুঈনুদ্দিন শামী
তারবিয়াহ
ইস্যু-৫ | ১৪৪১ হিজরি | ২০২০ ইংরেজি
বিষয়ঃ স্মৃতিচারণ
উস্তাদ আহমাদ ফারুক রহ. এর সাথে কিছুক্ষণ (পর্ব – ৩+৪) – মুঈনুদ্দিন শামী
অনুবাদঃ আবু খাদিজা
(পর্ব – ১ ও ২ তারবিয়াহ – ২ ও ৩ এ প্রকাশিত হয়েছে)
বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
সকল প্রশংসা নিঃসন্দেহে কেবলমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই, যিনি আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরই আল্লাহ্। তিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই আমাদের মরণ দান করেন। নিঃসন্দেহে তিনি জীবন ও মরণ এজন্যই সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে তিনি দেখে নিতে পারেন যে আমাদের মধ্যে থেকে কে উত্তম আমল করে?
নোট: উক্ত আলোচনায় যেখানেই ‘উস্তাদ’ বা ‘উস্তাদজী’ শব্দটির ব্যবহার হয়েছে, তার দ্বারা উদ্দেশ্য হলোঃ ‘শহিদ আলেমে রব্বানী উস্তাদ আহমাদ ফারুক (রহমাতু্ল্লাহি আলাইহি)।
উস্তাদ আহমাদ ফারুক রহ. এর সাথে কয়েকটি সাক্ষাৎকার। তার থেকে কিছু স্মৃতিচারণ করা। তার কিছু কথা এমন ছিল যা বিশেষভাবে আমার হৃদয়ে প্রচণ্ড আন্দোলনের ঝড় তুলতো। উস্তাদ আহমাদ ফারুক রহ. এর জীবদ্দশায় তার প্রিয় ব্যক্তিদের মধ্যে হয়তোবা গণ্য ছিলাম না, কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলার নিকট আমি আশাবাদী যে, তার শাহাদাতের পরে তার বন্ধুদের মধ্যে শামিল হয়েছি। আল্লাহর ইচ্ছায়- যদিও তার জীবদ্দশাতেই তার বন্ধুদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। উস্তাদের মহব্বতের উল্লেখ এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ যে, ইনশা আল্লাহ্ – তিনি আমাদের আল্লাহ্ তা’আলার প্রিয় লোকদের একজন ছিলেন। তিনি আমাদেরও প্রিয় ছিলেন এবং আমিও তার প্রিয় ছিলাম। আর এ ভালোবাসার সোনালি জিঞ্জির যা আল্লাহর দরবারে আলোচিত হওয়ার অন্যতম একটি পন্থা বা কারণ যার মাধ্যমে উস্তাদও আমাদের ভুলবেন না। ইনশা আল্লাহ্!।
হযরত উস্তাদ (রহ.) এর সাথে আজ পর্যন্ত যতবার সাক্ষাৎ হয়েছে তার সকল স্মৃতি ও কথাতো স্মরণে নেই, কিন্তু তার যতটুকু স্মৃতিতে এখনো সজিবতার সাক্ষ্য রেখে চলছে, তার সবটুকু কাগজের গায়ে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করবো। যা পরপারে ঘাটের কড়ি হিসেবে কাজে দিবে- ইনশা আল্লাহ্। আমি সহ যারা হযরত উস্তাদজী (রহ.) কে ভালোবাসেন তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের ফায়দা হবে। আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে যেন সঠিক কথা, সঠিক নিয়্যতে ও সঠিক পন্থায় ব্যক্তকারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন।
উত্তর ওয়াজিস্তানে পুনরায় ফিরে আসা-
হযরত উস্তাদজী (রহ.) নিজেই উত্তর ওয়াজিস্তানে অবস্থান করছিলেন এবং তারই তাশকীলে লেখক আঙ্গুরাডায় ছিলেন। আঙ্গুরাডায় উস্তাদজী (রহ.) এর মাজমুয়ার পক্ষ থেকে পত্র আদান প্রদান অর্থাৎ সম্মুখ জিহাদের খবরাখবর রাখার মূল দায়িত্বে ছিলেন ভাই আব্দুল হাসিব। উস্তাদজী (রহ.) এর মজলিসের সূত্র অনুযায়ী উস্তাদজী (রহ.) এর সাথীদের আলোচনা করার ইচ্ছা পোষণ করছি।
হাফেজ আব্দুল হাসিব ভাই!
ভাই আব্দুল হাসিবের সাথে লেখকের বিশেষ সম্পর্ক ছিলো। জিহাদের ময়দানে আব্দুল হাসিব ভাই লেখকের আনুষ্ঠানিক শিক্ষকদের মধ্যে থেকে অন্যতম একজন ছিলেন, যার আলোচনা সামনে আসতেছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষক এজন্যই বলা হয়েছে যে, মানুষ অনানুষ্ঠানিক ভাবে অনেক কিছুই শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক ভাবে দ্বীনের জ্ঞান ও বিষয়াদি যারা শিখেছেন, তার মধ্যে সুহাইল ভাইয়ের পরে, এমন শিক্ষার্থীর আসনের সম্মান অর্জনে আব্দুল হাসিব ভাই-ই সক্ষম হন। আব্দুল হাসিব ভাইয়ের আসল নাম ছিল ‘মুহাম্মাদ উসমান’। তিনি অত্যন্ত ভালো মানের হাফেজে কুরআন ছিলেন এবং তিনি ক্বিরাতে সাবয়া’ তথা সাত হরফের ক্বারী ছিলেন। আর অত্যন্ত চমৎকার লাহানে ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করতেন। শিক্ষা জীবনে যখন ‘জামায়াতে ত্বলাবায়ে আরাবিয়্যাহ্’ এর ছাত্র তখন থেকেই জিহাদের কাজে সংযুক্ত ছিলেন। পরে যখন কুরআন বর্ষে ‘انفروا’ তথা ‘জিহাদের জন্য বের হও’ এর মর্মার্থ অনুধাবন করেন তখনই জিহাদের ময়দানে দৌড় শুরু করেন। তার এক অনন্য গুণ ছিলো যা আমি সর্বদাই অনুভব করি তা হলো জিহাদের সাথে পরম ভালোবাসা ও এ ময়দানে অবস্থান করার অদম্য স্পৃহা।
সাহাবায়ে হাফেজ (রা.)-দের জিহাদি জযবা!
যখন সে প্রথমে জিহাদের ময়দানে তাশরীফ রাখেন, তখন হাফেজ আব্দুল হাসিব ভাইয়ের বয়স প্রায় বাইশ তেইশ বছর। তার দৃষ্টান্ত ছিলো হযরতে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) দের মধ্যেকার হুফফাজদের মতো। বিশেষ করে সাহাবা হুফফাজগণ যেমন আকাঙ্ক্ষা ও জযবার সাথে ক্বিতালের ময়দানে অবস্থান করতেন। তেমনি জযবা ও তামান্না আব্দুল হাসিব ভাইয়ের মধ্যেও বিদ্যমান ছিলো। তিনি যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে খুবই অভিজ্ঞ ছিলেন। প্রথমে তিনি কাশ্মীরের জিহাদি ট্রেনিং ক্যাম্পে পৌঁছান। সেখানে তিনি যুদ্ধের মূল দাওরাহ করেন, যাকে মায়াসকিরাতের পরিভাষায় বেসিক (Basic) বলা হয়। তারপর বিশেষ দাওয়াহতে অন্তর্ভুক্ত হন, যাকে এস.টি.এফ. (STF) বলা হয়ে থাকে। উক্ত দাওরাহ দেড় মাস পর্যন্ত সময় লাগে। আর এতে কঠোর শারীরিক ব্যয়াম ও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে। যাইহোক, এখানে যেহেতু STF এর আলোচনা চলে আসলো তাই এ বিষয়ে লেখা জরুরি মনে করছি যে, উস্তাদজী (রহ.) তিনি নিজেও উল্লেখিত দাওরাহ সম্পন্নকারীদের মধ্যে থেকে ছিলেন, বরং যারা এ দাওরাহ গ্রহণ করেন, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন।
হযরত উস্তাদজী (রহ.) একজন সিপাহসালারও বটে!
হযরত উস্তাদজী (রহ.) নিজেই আমাদেরকে আলোচনা করেছেন যে, ঐ ট্রেনিং-এ ‘অগ্নি’ উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি বলেন, এ ট্রেনিং-এ প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার দৌড়াতে হয়, যার মধ্যে বিশ কিলোমিটার পট্টো নিয়ে বাকি আরো চৌদ্দ কিলোমিটার এল.এম.জি (লাইট মেশিনগান) নিয়ে অর্থাৎ চৌত্রিশ কেজি ওজনসহ দৌড়াতে হয়। আর এ দৌড়ের মধ্যে কোন বিশ্রামের সুযোগ নেই। উক্ত দৌড়ের সাথে সাথে বালুর বস্তায় দু’শ করে ঘুষি মারার কসরত করার কথা শুনেছি। এ ট্রেনিং-এর কথা শুনে হযরত সায়্যেদ আহমাদ শহিদ (রহ.) এর স্মৃতি মনে পড়ে যায়। কিছু ঐতিহাসিকদের বর্ণনানুসারে তিনি তিনশত কখনো চারশত বা আবার কখনো পাঁচশত ঘুষি মারার কসরত করতেন কোন ধরনের বিশ্রাম ছাড়াই একসাথে। এই ছিলো আমাদের পূর্বসূরিদের জিহাদি প্রশিক্ষণের ইতিহাস। আল্লাহর শুকরিয়া যে, আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে যাদের অনুগত বানিয়েছেন তাদের অবস্থাও আমাদের পূর্বসূরিদের মতোই ছিলো। হযরত সায়্যেদ আহমাদ শহিদ (রহ.) এর জিহাদি জিন্দেগীর এ আলোচনার দ্বারা এ কথা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তিনি কেবলমাত্র একজন দা’য়ী বা মুবাল্লিগ এবং মুরুব্বী ছিলেন না যার হাওয়ালাহ অধিকাংশ লোক দিয়ে থাকেন। তেমনি হযরত উস্তাদজী (রহ.) আল্লাহর মেহেরবানীতে জিহাদের ময়দানে অনন্য যোদ্ধা ছিলেন। বরং তিনি সিপাহসালার ছিলেন।
আব্দুল হাসিব ভাই ঐ ক্যাম্পেই অবস্থান করেন এবং কাশ্মীর জিহাদে অংশগ্রহণ করেন এবং ওখানে অবস্থানরত সংগঠনের উপর পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের প্রভাব প্রতিপত্তির অবস্থা অনুভব করতে সক্ষম হন। তাইতো যখন ঐ সংগঠনের পক্ষ থেকে আযাদ কাশ্মীরের জন্য জিহাদের দাওয়াত পান তখনই তিনি উপজাতিদের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং নিজেকে উস্তাদজী (রহ.) এর নিকট অর্পণ করার মোক্ষম সুযোগ পান। তিনি ওয়াজিস্তানে পৌঁছে পুনরায় মূল ট্রেনিং বা দাওরাহ করেন। যেখানে তার উস্তাদ ছিলো ‘কমান্ডার খুর্রম সাঈদ ক্বিয়ানী’ অর্থাৎ কাসেম ভাই। শারীরিক ও অস্ত্রের ট্রেনিং-এ তিনি পূর্বে থেকেই অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। এ জন্য কিছু পরেই যখন নতুন কিছু সাথীরা অস্ত্রের ট্রেনিং-এর জন্য আসেন তাদেরকে ট্রেনিং করানোর গুরুদায়িত্ব ভাই হাফেজ আব্দুল হাসিবকেই গ্রহণ করতে হয়।
স্বয়ং লেখকও আব্দুল হাসিব ভাইয়ের নিকট দাওরাহ্ করেন। আব্দুল হাসিব ভাই এই দাওরায় আমাদেরকে খুব সুন্দরভাবে ট্রেনিং ও আমল করে অতিবাহিত করেন। ফজর নামাজের পরেই আমাদের একত্রিত (অর্থাৎ এসেম্বলি) করতে হতো। তারপর ব্যয়াম করতে হতো আর আব্দুল হাসিব ভাই নিজেও উক্ত ব্যয়ামে অংশগ্রহণ করতেন এবং দুর্বল সাথীদেরকে এক একটা করে অনেক সাহায্য করতেন। সাথে সাথে নিজেও দৌড়াতে থাকতেন। তারপর নাস্তা করার পরে যুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন দিক নিয়ে পড়াতেন তারপর বাস্তব প্রশিক্ষণ শুরু করতেন। দুপুরে আধ ঘণ্টা ছুটি হতো। পুনরায় যোহরের নামাযের পরে তাজবিদ এবং মাসনূন দু’য়া সমূহ মুখস্ত করাতেন। তারপরে খানা খেয়ে অস্ত্র বিষয়ে বাস্তব প্রশিক্ষণ। আসরের পরে খুবই গুরুত্বের সাথে জিকির আযকারের জন্য বসে যেতেন। মাগরিবের পরে রাতের খানা খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ঈশার নামাযের ওয়াক্ত হয়ে যেত। ঈশার নামাযের পরে আমাদেরকে পাহারায় লাগাতেন এবং তার কিছুক্ষণ পরেই আমাদেরকে হ্যাকিং এবং ট্র্যাকিং-এর জন্য কিছু সাথীদেরকে রাতের অন্ধকারে পাঠাতেন। অনেক সময় আমরা দু’ এক ঘন্টা পরেই ফিরে আসতাম আবার অনেক সময় পুরা রাত পাহাড়ের আশপাশে ঘোরাফেরা করতে করতেই সকাল হতো।
যাইহোক, আব্দুল হাসিব ভাইয়ের আলোচনাই এখানে মুখ্য ছিলো। তিনি খুবই নিয়ম মেনে চলতেন। সাথীদেরকে নিজের সাথে জুড়ে রাখতেন। অনেক সময় সাথীদেরকে সাধারণ শক্তি সামর্থ্যের বাইরেও চাপ প্রয়োগ করতেন শুধুই তারবিয়্যাতকে সামনে রেখে। তার এ সিফাত সম্পর্কে তারই এক ছাত্র যে আব্দুল হাসিব ভাইয়ের থেকে বয়সে বড় এবং একজন বিজ্ঞ আলেম ছিলেন তিনি বলেন, সাধারণত যখন কোন ব্যক্তি কল্যাণমুখী হয় এবং স্বীয় সাথীদেরকে নিজের সাথে জুড়ে নিতে পারেন। তখন এমন ব্যক্তি নিজেই একটা দল বা হালকাহ বানিয়ে নেয় এবং উক্ত সাথীদের উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আব্দুল হাসিব ভাইয়ের এ গুণ ছিলো যে, নিজের সাথে জুড়ে নেওয়া সাথীদেরকে জামাত এবং কেন্দ্রীয় আমীরদের সাথে জুড়ে দিতেন। এ আমলটা জিহাদের শক্তিকে বাড়ানোর সহায়ক। যখন সাথীদেরকে জুড়া বা জুড়ানোর আলোচনা চলছে, সেখানে মুর্শিদ সাহেবকে কীভাবে ভুলে থাকা যায়? হযরত ক্বারী উসামা ইব্রাহিম গুরী তিনিও এমনই ছিলেন। বরং কোথাও কোথাও অনেক বেশিই ছিলেন। সাথীরা খুব তাড়াতাড়িই তার আন্তরিক হয়ে উঠতেন এবং তার পথের পথিক হয়ে যেতেন। কিন্তু মুর্শিদ (রহ.) সর্বদাই সাথীদেরকে জামাতের মুরুব্বীদের সাথে জুড়িয়ে দিতেন। মুর্শিদ (রহ.) সত্যিকারেই একজন শায়েখ ছিলেন। তাকে এ অর্থেই শায়েখ বলছি যে, যখন কোন সাথী কোন জিম্মাদার থেকে এমন কোন বিষয় যা তারই (সাথীর ভালোর) জন্যই করা হয়েছে সে কারণে মনক্ষুন্ন হন, মুর্শিদ (রহ.) মেহনত ও চেষ্টা করে সেই সাথীকে পুনরায় জিহাদ ও জিহাদের মুরুব্বীদের আনুগত্যের আচলে জুড়ে দিতেন। যখন মুর্শিদ (রহ.) এর বিষয়ে কোন কিছু লিখার সুযোগ হলে সেখানে তার গুনাবলি সবিস্তারে আলোচনা করবো।
আব্দুল হাসিব ভাই এক যোদ্ধা পুরুষ ছিলেন কিন্তু তার দিল ছিলো অত্যন্ত নরম প্রকৃতির। সাধারণ এবং যোদ্ধাদের সাথে অবস্থানকালে দাওয়াত খুবই কম হয়, যা সাধারণ কথা। কিন্তু আব্দুল হাসিব ভাই দাওয়াতের কাজ খুব বেশি করতেন। আর এর উপকারীতাও ছিলো। নরম ব্যবহার এবং ভালোবাসা দিয়ে সাথীদের সংশোধন করতেন।
মাজহাব প্রীতি না হওয়া!
আব্দুল হাসিব ভাই যদিও বেশি লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি তথাপি কেউ মাজহাবের ভিত্তিতে দলগঠন করতে চেষ্টা করলে নরম দিলের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাকে কঠিন শাস্তি দিতেন। যেমন একবার এক সাথী একটি শাখাগত মাসয়ালার ক্ষেত্রে একটাকে প্রাধান্য দিতে লাগলো। এ কথা জানতে পেরে আব্দুল হাসিব ভাই তাকে সে মারকায থেকে অন্যত্র কোন এক স্থানে পাঠিয়ে দেন। যাতে করে এ মাসয়ালা খতম হয়ে যায়।
জিহাদের ময়দান যেমন প্রশস্ত তেমনই সাথীদের খানাপিনা এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও খরচের ব্যাপারে প্রশস্ত দ্বিলের পরিচয় দিতেন। বিশেষ করে রমযান মাসে। দানশীলতা ও মেহমানদারীর গুণাবলীও ছিলো অতুলনীয়। রমযান মাসে অন্য কোন মাযমুয়া বা দলের সাথীদেরকে ইফতারের দাওয়াত দিতেন। যাইহোক- এই হলো আব্দুল হাসিব ভাইয়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী। তিনি ২০১৫ ঈসায়ীর শেষের দিকে শাহাদাত লাভে ধন্য হন। আমেরিকা ও আফগান কমান্ডো বাহিনী তাকে ঘিরে ফেলে এবং যুদ্ধের ফলাফল দাড়ায় তার আল্লাহর রাস্তায় নিহত হওয়া। আমাদের এক কবি ভাই ‘عزیزم’ তথা ‘আমাদের প্রিয়’ শিরোনামে আব্দুল হাসিব ভাইয়ের শাহাদাতে একটি কবিতা রচনা করে বলেন আল্লাহ তার প্রতি প্রশস্ত রহমতের বারিধারা জারি করুন।
রাতের অতন্দ্র প্রহরী!
আঙ্গুরাডায় প্রায় দু’মাস অবস্থানের পর লেখককে ১৩ রমযানে হযরত উস্তাদজী (রহ.) উত্তর ওয়াজিস্তানে ডেকে পাঠালে লেখক মিরানশাহ নামক স্থানে পৌঁছান। রাতের বেলা ছিলো তাই তারাবীহ ও অন্যান্য কাজ থেকে অবসর হয়ে স্বীয় সাথীর ঘুমানো ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন।
হযরত উস্তাদজী (রহ.) এর সাথে সাক্ষাৎ করে সফরের সকল ক্লান্তি দূরীভূত করেন। উস্তাদজী (রহ.) এর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে দেখেন তিনি একাকী বসে আছেন এবং মাথায় তেল দিচ্ছিলেন। আমি একটু বড় করে বললাম যে, আমি তেল দিয়ে দেই! এ কথা শুনে উস্তাদজী (রহ.) বললেন অনুমতি দিতে বাধ্য হচ্ছি। আমি জানতে চাইলাম কতটুকু তৈল লাগাতে হবে? উত্তরে উস্তাদজী (রহ.) এর অভ্যাস অনুযায়ী বললেন, যতটুকু আমার মাথাকে সতেজ করে তোলে। আমি তৈল মালিশ করছিলাম এবং সাথে সাথে উস্তাদজী (রহ.) আমার কৃত কাজের বর্ণনা তথা কারগুজারী শুনছিলেন। ফজরের দেড় ঘন্টা পূর্বে উঠলেন এবং ঘুমানোর জন্য চলে গেলেন। মোটামুটি আধা ঘণ্টা পরে আবার জাগ্রত হলেন এবং ইবাদত ও জিকিরে মাশগুল হলেন। যেহেতু সেটা ভিন্ন একটা কামরা ছিলো এজন্য আওয়াজ করছিলেন। যে সাহরীর সময় শেষ হওয়ার আর মাত্র দশ মিনিট বাকি আছে তাই উস্তাদজী (রহ.) আমাকে বললেন যে, মেহমান খানায় যাও এবং দেখো সেহরীর কোন ব্যবস্থা আছে কি-না? আমি বের হলাম এবং দেখলাম যে, ‘সাদিক’ ভাই সামনের দিকে আসছেন। তার আসল নাম হচ্ছে ‘সায়্যেদ কাসেম হাশেমী’। সে একজন পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ ও হক্ব পন্থী ছিলেন। তার সম্পর্কিত কিছু বিষয় লিখবো। কিন্তু আগামী কয়েক মজলিস পর তার আলোচনা আসবে তাই এখানেই তার আলোচনা স্থগিত করছি।
সাহরীর যতটুকু সময় বাকি ছিলো তার মধ্যেই হযরত উস্তাদজী (রহ.) এবং আমি সাহরী খেয়ে নেই। তারপরে ফযর নামায আদায় করি এবং এরপরে বিশ্রামের জন্য শুয়ে পড়ি। যখন বিশ্রাম সেরে উঠলাম তখন হযরত উস্তাদজী (রহ.) আমাকে ডাকলেন এবং আমার পূর্বে বর্ণিত কারগুজারীর উপর চিন্তা করতে লাগলেন। এর মধ্যে যে বিষয়টিকে হযরত উস্তাদজী (রহ.) নির্বাচিত করলেন সেটা হলো ‘সংশোধনের পন্থা’। লেখক যখন আঙ্গুরাডায় ছিলেন তখন মানুষের মুয়ামালাতের কিছু মাসয়ালার সম্মুখীন হয়েছিলেন তার কয়েকটা নিয়েও আলোচনা হয়। লেখক কয়েকটি বিষয়কে সংশোধন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা উল্টো হয়ে গিয়েছিলো। এ ব্যাপারে উস্তাদজী (রহ.) দৃষ্টিপাত করে বললেন যখনই কোন বিষয় সংশোধন করতে চাইবে, তখন সংশোধনের পূর্বেই বান্দাকে নিজের অবস্থান দেখে নেওয়া চাই। যদি সংশোধনকারী বান্দা সবদিক থেকেই ছোট হয়ে থাকে তাহলে অন্য কোন দ্বিতীয় ব্যক্তি কীভাবে তার কথাকে গ্রহণ করবে? সম্ভবত এমন না-ও হতে পারে। যাইহোক কল্যাণ যেখান থেকেই আসুক তাকে গ্রহণ করা। তবে সবখানে এটা হয় না। উপস্থিত কোন জায়গায় সংশোধন করার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে প্রথমেই এটা দেখা জরুরী যে, আপনি সংশোধিত ব্যক্তির থেকে বয়সে বড়? নাকি জ্ঞানে বড়? জিহাদের ময়দানে কে আগে এসেছে? ইত্যাদি দেখে তারপর সংশোধনের চেষ্টা করা চাই। আর তা নাহলে সংশ্লিষ্ট কোন জিম্মাদার অথবা কোন হিতাকাঙ্খী ব্যক্তিকে জ্ঞাত করানো। এখানেও দোষচর্চা বা গিবতের নিয়তে না হওয়া চাই বরং আমার বা আমাদের এই ভাই সংশোধন হয়ে যাক এই নিয়ত থাকা চাই। এভাবে একটা একটা করে প্রতিটি বিষয়ের উপর আলোচনা করে বোঝাতে লাগলেন। আল্লাহ্ তা’আলা যেন কোন কথা যদি আমাদের বুঝে আসে তার দ্বারা সংশোধন করে দেন।
আমাদের কেমন আচরণ থাকা চাই!
রমজানের শেষ তারিখ ছিলো। সেদিন এক শহিদ সাথীর ভাই পাকিস্তান থেকে সাক্ষাতের জন্য আসে। এ ব্যক্তি মুজাহিদীনদের দাওয়াতের প্রতি মুয়াফিক ছিলো না, বরং মুখালিফ ছিলো। যখন ইফতারির সময় হলো তখন হযরত এবং আবু আয়্যূব ভাই (আল্লাহ্ তাকে হেফাজত করুন) যিনি উত্তর ওয়াজিরিস্তানের উক্ত দু’জন (উস্তাদজী (রহ.) এর মাজমুয়া) এর পক্ষ থেকে জিম্মাদার ছিলেন। তারা মেহমানের সম্মানার্থে দু’চার প্রকারের খানা দস্তরখানে হাজির করলেন। যখন খানার সামনে বসলো এবং ইফতারের কয়েক মিনিট বাকি ছিলো তখন ঐ মেহমান বলতে লাগলো যে, এ খানার টাকা কোথা হতে আসে? তার কথায় তোহমত ও অপবাদ ছিলো যে, মুজাহিদরা ভিন্ন দেশের কোন এজেন্সির এজেন্ট। চিন্তা করুন কোন মুহূর্তে কি ধরনের প্রশ্ন তুলছে! অন্য কেউ হলে ভড়কে যেত। উস্তাদজী (রহ.) অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সাথে জবাব দিলেন এভাবে যে, জিহাদের কিছু আনসার আছে…… অনেক লোক আছে যারা তাদের সম্পদের কিছু অংশ এ পথে ব্যয় করে থাকে…. সেখান থেকেই এসবের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঐ শহিদ ভাইয়ের আগত ভাই আর কিছু বললেন না। যে বস্তু তাকে স্তব্ধ করে দেয় তাহলো উস্তাদজী (রহ.) এর সবর, ধৈর্য ও কৌশল। পরে কি কথা হলো সে খবর আমার জানা নেই। এ বিষয়টি আবু আয়্যূব ভাই আমাদেরকে শোনালেন। আবু আয়্যূব ভাই আমাদেরকে এটাও বললেন যে, উস্তাদজী (রহ.) মেহমানের প্রতিটি প্রশ্নের জবাব খুবই বিনয়ের সাথে দিতে থাকেন। ঐ ব্যক্তির বুঝ শক্তি তেমন ছিলো না। কিন্তু উস্তাদজী (রহ.) তা সত্ত্বেও বোঝাতেই ছিলেন এবং কখনো আওয়াজকে উঁচু হতে দেননি। আল্লাহ্ পাক তার উক্ত আখলাক আমাদের দান করুন।
হযরতের সোহবতেই রমজানের শেষদিন পার হয়ে ঈদ চলে আসে। ঈদের অবস্থাসমূহের আলোচনা করা খুবই জরুরী। যার আলোচনা উস্তাদজী (রহ.) এর আগামী মজলিসে হবে। ইনশা আল্লাহ্!
ঈদুল ফিতর ১৪৩২ হিজরী/২০১০ ঈসায়ী
রমজান শেষ হয়ে গেছে। আমি তরিক ভাইয়ের সাথে (আল্লাহ্ তাকে দ্রুত মুক্তি দান করেন!) তাদের বাড়িতে অবস্থান করছিলাম। সেখান থেকে প্রতিবেশি মূসা ভাইয়ের সাথে তার টয়োটা করোলা গাড়িতে করে উত্তর ওয়াজিস্তানের মিরান শাহ এলাকা সংলগ্ন একটা স্থানে অবস্থিত উস্তাদজী (রহ.) এর বাড়িতে যাই। হযরত উস্তাদজী (রহ.) আমাদের দেখে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসলেন এবং বড়ই মহব্বতের সাথে আমাদেরকে জড়িয়ে ধরলেন। সেদিন উস্তাদজী (রহ.) সাদা কাপড় পরিধান করেছিলেন। মাথায় সাদা জালি টুপি পরিধান করছিলেন। পায়ে সবসময়কার মতো হালকা বাদামি রঙের চামড়ার স্যান্ডেল পরেছিলেন। উস্তাদজী (রহ.) ঘরে ফিরে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর নিজের ক্লাশিনকোভ কাঁধে ঝুলিয়ে জুব্বা পরিধান করে ফিরে আসেন। তারপর গাড়িতে উঠে আমরা চারজন মিরান শাহ্ শহরে অবস্থিত হযরত উস্তাদজী (রহ.) এর মাজমুয়ার সাথীদের মেহমানখানায় উপস্থিত হয়।
মেহমানখানায় ঈদের দিন
লেখক সাহেব উস্তাদজী (রহ.) এর অতিবাহিত দিনগুলির কার্যাবলী লিখছিলেন। তখন লেখকের অবস্থা এমন ছিলো যে, কেমন যেন কোন ছেলে তার পিতা সম্পর্কে লিখছে। এমন এক পিতা যার শৈশব ছেলেবেলাতেই শেষ হয়ে যায় এবং বাচ্চা নিজেই পিতার জিন্দেগীর অনেক অধ্যায় প্রকাশিত হতে দেখেছে। অবশ্য এ দেখাটা প্রথমত: অনেক অল্প এবং দ্বিতীয়ত: লেখক নিজেও ‘বাচ্চা’ অবস্থায় দেখেছেন। সুতরাং একটি শিশু তার শিশুবেলার অবস্থানুযায়ী এবং প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে যে কথাগুলোকে ব্যক্ত করতে পারে, এ লেখায় সে রকম একটি দৃশ্য ফুটে উঠেছে।
আলোচনা চলছিলো যে, আমরা চারজনেই মেহমান খানায় পৌঁছাই। এ দিন মেহমান খানায় চৌদ্দ-পনেরো জন সাথী উপস্থিত ছিলো। যাদের মধ্যে অনেকেরই জীবন যায় যায় অবস্থা আর যারা জীবিত তাদের অবস্থাতো দুশমনের জেলখানার মতো। আর উস্তাদজী (রহ.) এর মতো কিছু ‘এমন ব্যক্তি যারা আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত অনুগ্রহের প্রতি অত্যন্ত খুশি’ দলের মধ্যে গণ্য ইনশা আল্লাহ্। তাদের জন্য শুভেচ্ছা ও সু-সংবাদ। হযরত এক একজন সাথীর সাথে সাক্ষাত করতে লাগলেন এবং মুয়া’নাকা করলেন। তাদের হালাত জিজ্ঞেস করলেন। এভাবে প্রায় আধা ঘণ্টা বা পৌনে এক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর পনেরো জন বা তার চেয়ে বেশি সাথী মেহমানখানায় চলে আসেন। আগত উক্ত নতুন সাথীদের অনেকেই তার পূর্বের দিন জিহাদের ময়দানে পৌঁছেছিলেন। সেসকল ভাইদের মধ্যে যারা ইতিমধ্যেই শহিদ হয়েছেন তারা হলেন – ক্বারী আসেম ভাই, সিদ্দীক (সায়্যেদ কাসেম হাশেমী) ভাই, ঈসা (সা’দ সুলতান) ভাই, আরিফ (আমজাদ আহমাদ) ভাই, ফুরক্বন (ফয়সাল) ভাই, জাহিদ আব্দুল ওয়াদুদ (আব্দুর র’ফি) ভাই, আব্দুল মাজিদ ভাই এবং আফতাব ভাই। আল্লাহ্ তা’আলা তাদের সকলকে প্রশস্ত রহমতের চাদরে ঢেকে নিন। এ সকল শুহাদাদের প্রত্যেকের বিষয়ে লেখার হক্ব রয়েছে। যদি চলতি সংখ্যায় সুযোগ না হয় তবে আল্লাহ্ চাহেন তো সামনের সংখ্যায় অবশ্যই তাদের বিষয়ে কিছু লিখার চেষ্টা করবো ইনশা আল্লাহ।
মেহমানদারী
নবাগত ‘মেহমান’দেরকে মিষ্টান্ন দেওয়া হলো। যদিও আমাদের বীর্রে সগীরের প্রথা অনুসারে ঈদের দিন ‘দুধ দিয়ে তৈরি খেজুর আকৃতির মিষ্টি’ দেওয়া হয়, কিন্তু পরিস্থিতি অনুযায়ী ‘আহত’ সাথীদের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে ‘ত্রিফল’ (যার মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের ফল, কেক, জেলি ইত্যাদি দুধের পায়েশের সাথে মিশিয়ে করে খাওয়া হয়) তৈরি করা হয়েছিলো। সুতরাং সেই ত্রিফল দিয়েই আমাদেরকে মেহমানদারী করানো হলো। আমাদেরকে যে পাত্রে খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল তা ছিলো অতিশয় পূর্ণ।
চমৎকারঃ আমীরের আনুগত্য!
কিছু সাথীদের সাথে একাকিত্বে সাক্ষাতের জন্য উস্তাদজী (রহ.) রুমের এক প্রান্তে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। এখানে একটা বড় ঘটনাও ঘটে যায়, যা আমি উস্তাদজী (রহ.) এর কাছে একদিন বা দু’দিন পর শুনেছিলাম। একবার এক সাথীকে উস্তাদজী (রহ.) এমন একটি স্থানে ডাকলেন যেখানে বড় বড় কারখানা রয়েছে। ঐ সাথীর জন্য উস্তাদজীর সাথে এটাই প্রথম সাক্ষাত ছিলো। তাই উক্ত সাথী উস্তাদজী (রহ.) কে চিনতেন না। উস্তাদজী (রহ.) তার সাথে দেখা করে তার হাল-হাকিক্বত শুনলেন। এরপর তার আসল নাম ও এলাকার নাম ইত্যাদি বিষয়ে কথাবার্তা বলছিলেন।
উস্তাদজী (রহ.) যখন ঐ সাথীকে কোন প্রশ্ন করছিলেন তখন উক্ত সাথী ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এবং আমতা আমতা করে উত্তর দিচ্ছিলেন। তখন উস্তাদজী (রহ.) এর অনুভব হলো যে, উক্ত সাথীর মধ্যে এমন কোন বিষয় আছে যার কারণে আমার সাথে এভাবে কথা বলছে।
যাইহোক কথা চলছিলো। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে উস্তাদজী (রহ.) উক্ত সাথীকে প্রশ্ন করলে ঐ সাথী রেগে যায় এবং বলতে থাকে যে, ‘ভাই আপনি কে? আমাকে কেন এ ধরনের প্রশ্ন করছেন? আমাকে তো আমার জিম্মাদার বলেছেন যে, এমন কথা মাজমুয়া’র আমীরে মুহতারাম ছাড়া অন্য কাউকে বলা যাবে না!”। তখন উস্তাদজী (রহ.) বুঝতে পারলেন যে, সে কেন কথার মধ্যে জড়তা রেখে চলছে। এ কারণে উস্তাদজী (রহ.) নিজের পরিচয় দিলেন যে, আমার নাম আব্দুর রহীম। আর সাথীরা হযরতকে আব্দুর রহীম নামেই চিনতেন।
এ কথা শুনে ঐ ভাই আরো জড়সড় হয়ে বলতে লাগলো যে, ‘উপর থেকে আপনার নাম “আব্দুর রহীম” রেখেছে যা কি-না মাজমুয়া’র আমীরে মুহতারামের নাম যাতে করে সাথীরা ধোঁকা খেতে পারে!। এ কথা শুনে উস্তাদজী (রহ.) থমকে গেলেন এবং বিনয়ের সাথে বললেন যে, ভাই! আমিই আব্দুর রহীম, ফারুক অর্থাৎ আমীরে মাজমুয়া’। এটা শুনে ঐ বেচারা খুবই লজ্জিত হলো এবং ওযর পেশ করলো।
জিহাদি বিনোদন!
উস্তাদজী (রহ.) এর সাক্ষাত পর্ব শেষ হবার পর মুজাহিদীনদের ইশক্ সম্বলিত তারানার মাহফিল জমে উঠলো। সেখানে সকল সাথীই খুব তাৎপর্যপূর্ণ তারানা পড়তে বা শুনাতে লাগলেন। এরই মাঝে সা’দ সুলতান ভাই তাকবির ধ্বনি দিয়ে মাহফিল গরম করে তুললেন। প্রথমবার যখন তিনি আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিলেন তখনই সকলে আশ্চর্য হয়ে তাকে দেখতে লাগলেন। এদিন তিনি পরিপূর্ণ তৃপ্তির সাথে তাকবীর দিয়েছিলেন।
মুজাহিদ বাবুর্চীঃ আরিফ ভাই!
একদিকে তারানা গাওয়া চলছে সেই সাথে কামরার ভিতরের ‘রান্নার অংশে’ আরিফ ভাই এক দু’জন সাথী নিয়ে বিরিয়ানী রান্না করেছিলেন। আরিফ ভাই (রহ.) এর বিরিয়ানী পাকানো খুবই প্রসিদ্ধ ছিলো। তার রান্না করা খাবার খুবই মজাদার ছিলো। আমরা যখন তার চিকেন বিরিয়ানীর স্মৃতিচারণ করছি তখন তিনি জান্নাতের অসংখ্য নিয়ামত নানান প্রকার ‘পাখির’ মাংস, দামি দামি খুশবু এবং হাজারো উন্নত মসলা দ্বারা পাকানো এবং তৈরিকৃত বিরিয়ানী খেয়ে পরিতৃপ্ত হচ্ছেন, ইনশা আল্লাহ্।
সংগীতানুষ্ঠানঃ শিল্পী কে?
হযরত উস্তাদজী (রহ.) তার সব সময়ের প্রিয় না’তে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) “মাওলায়্যা সল্লি ওয়া সাল্লিম দাঈমান আবাদান”…….. শোনান। এরই মাঝে সম্মানিত শায়েখ আমীরে মুহতারাম মাওলানা আসেম ওমর (আল্লাহ্ তাকে হেফাজত করুন) আসেন। তিনি আসার সাথে সাথেই উস্তাদজী নিজের স্থান ছেড়ে মাওলানাকে বসতে দিয়ে তার ডান পার্শ্বে বসে পড়েন। আমরা মাওলানাকে তখনো চিনতাম না যে, তিনি কে। হযরত মাওলানা খুবই বিনয়ের সাথে বসে পড়লেন। বেশ কিছুক্ষণ পর তারানা চলাবস্থায় সাথীদেরকে উস্তাদজী মুজাহিদদের প্রিয় আরবি সংগীত ‘গুরাবা’ শোনানোর জন্য বললেন। তারপর উস্তাদজী হযরত মাওলানাকে সংগীত শোনাতে দাওয়াত দিলেন। ফলে হযরত মাওলানা “মাওলানা যাকি (রহ.) এর কবিতা ‘যামানায়ে মুনক্বলেব হ্যায়, ইনক্বিলাব আয়্যাহি করতে হে’ শোনালেন।
তারপর বেশকিছুক্ষণ অতিবাহিত হয়ে গেলে সম্মানিত শায়েখ হাফেজ সুহাইব গুরী তাশরীফ নিয়ে আসেন। কিছুক্ষণ পরে তার থেকেও সংগীত শোনানোর আহ্বান করলে তিনি আল্লামা ইকবালের প্রসিদ্ধ কবিতা ‘খোদ-ই কাছের নেহাল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ শোনান।
বড়দের স্মৃতিচারণ!
সংগীত শোনা এবং শোনানোর মাঝেই খুব ক্ষুধা পেয়ে বসে। এদিকে আরিফ ভাইয়ের পাকানো ‘বিরিয়ানী’ প্রস্তুত ছিলো। সেগুলোকে প্লেট ও গামলায় করে রাখা হলো। সাথে সালাদ এবং পান করার জন্য ঠাণ্ডা শরবত ছিলো। এ ধরনের উচ্চমানের খানা সামনে আসায় মুজাহিদ ও আলেম, জাহেদ ও আবেদ হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনুল মুবারক (রহ.) এর একটা কথা মনে পড়ে গেলো।
কোনো এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুবারক (রহ.) কে (উচ্চমানের খানা এবং অনেক পরিমাণে) খেতে দেখে বলতে লাগলো যে, মুজাহিদ হয়ে কি-না এমন (উন্নত) খাবার খাচ্ছেন? ইবনে মুবারক (রহ.) বললেন: ‘যখন খাওয়ার এমন সুযোগ হয় তখন (বীর) পুরুষের মতো খেতে থাকি, আর যখন সুযোগ না পাই তখন (ধৈর্যশীল) পুরুষের মতোই সবর করতে থাকি!’।
এ সব কিছুই আল্লাহর নেয়ামত বা অনুগ্রহ। হযরত হাজী সাহেব ইমদাদুল্লাহ্ মুহাজেরে মক্কী (রহ.) স্বীয় শাগরিদ হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ.) কে পানি পান করতে দেখে বলেছিলেন, ‘আশরাফ আলী! যখন পানি পান করো তখন খুব ঠাণ্ডা পানি পান করবে। যাতে করে যখন পানি পান করো সে পানি যে যে স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয় তার প্রত্যেক অঙ্গই আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ে করে থাকে’।
বুজুর্গ উলামাগণ বলেন, বর্তমানে কঠিন সাধনা করা লোকদের জন্য অসম্ভব হয়ে গেছে। তাই কেউ যদি নেয়ামত দ্বারা পরিতৃপ্ত হয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে, হারাম থেকে বেঁচে থাকে এবং ওয়াজিব কাজগুলোর আঞ্জাম দেয় তাহলেই সে আল্লাহর ওলী বলে গণ্য হবে।
মুজাহিদীনদের জীবনে হাজারো রকমের চিন্তা-ফিকির এবং ঝুঁকি রয়েছে। শুধু তাই নয়, নিজেদের পেরেশানির সাথে সাথে উম্মাহর পেরেশানি ও দু:খ কষ্টকে নিজেদের কাধে তুলে নেয় এবং সুযোগ পেলেই আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে লিপ্ত হয়ে যায়। তাদের জন্য আল্লাহর নেয়ামতের দ্বারা পরিতৃপ্ত হওয়াতে কোনো অসুবিধা নেই। বরং বাস্তবে আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখেছি যে, যখন মুজাহিদীনদের কোনো নেয়ামত অর্জিত হয় তখন তারা যারপরনাই আনন্দিত হন। তারা আল্লাহর তারীফ ও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে সে নেয়ামতকে ভোগ করেন এবং যখন সে নেয়ামত খতম হয়ে যায় তখনও হামদ ও সানা দ্বারাই শেষ করে থাকেন। আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকেও এমন হওয়ার তাওফিক দান করুন- আমীন।
অতিথীদের আরামের ব্যবস্থা করা কর্তব্যঃ
এখানে এ কথা উল্লেখ করা খুবই জরুরী যে, হযরত উস্তাদজী (রহ.) সবসময় সাথীদের এবং অন্য সকল লোকদের জন্য আরামের ব্যবস্থা করতেন। তবে নিজের ক্ষেত্রে অল্পে তুষ্ট, দুনিয়া ত্যাগী এবং গরিব ছিলেন। হযরত উস্তাদজী (রহ.) এর গরিব অবস্থা সম্পর্কে প্রথম দিকের সংখ্যাগুলোতে কিছু আলোচনা করা হয়েছে।
উস্তাদজী (রহ.) নিজেই তার জীবন চলার পথে দুনিয়া ত্যাগের বিষয়ে ‘ওহ দিয়ে চলে যাহা-মে তাওহীদ কী গাওয়াহী’ ‘শায়ী করদাহ্’ ‘এদারায়ে হিত্ত্বীন’ রিসালাগুলিতে উল্লেখ করেছেন। এটাও লিখেছেন যে, উস্তাদজী (রহ.) তার উস্তাদ ও শায়েখ, ফক্বীহ ও মারাবেতে শায়েখ আবু ইয়াহইয়া আল-লিব্বী শহিদ (রহ.) এর সাথে ‘জুহদ’ বা দুনিয়া ত্যাগের উপর অনেক বেশি আলোচনা করতেন এবং শায়েখ আবু ইয়াহইয়ার থেকে অনেক ফায়দা গ্রহণ করতেন।
বাবুর্চিই যখন ক্ষুধার্ত!
আমরা বিরিয়ানী খাচ্ছিলাম। আরিফ ভাই এবং অন্যান্য নির্ধারিত খেদমতের সাথীরা বিরিয়ানী দিচ্ছিলেন। রান্না খুব ভালো হওয়াই সকলেই তৃপ্তি সহকারে খানা খাচ্ছিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা আরিফ ভাই ও খেদমতের সাথীদেরকে রহমতের চাদরে ঢেকে নিন। কেননা তখন পর্যন্ত তারা নিজেরা এক লোকমা খাবারও খাননি। এদিকে মেহমানদের বিরিয়ানী দিতে দিতে সম্পূর্ণ শেষ করে ফেললেন।
খানা শেষ হয়ে যাবার এই বিষয়টি সামান্য কিছু সাথীই জানতে পারেন। আমি নিজেও বিষয়টা জানতাম না। খানার মজলিশ শেষ হয়ে যাবার পর স্থানীয় মুজাহিদ মেহমান এবং উস্তাদজী (রহ.) এর মাজমুয়া এবং অন্যান্য মাজমুয়ার সাথী ও মেহমানসহ উস্তাদজীও চলে যান। পিছনে পাঁচ-ছয় জন সাথী থেকে যান – যার মধ্যে লেখকও ছিলো। উক্ত সাথীরা পুনরায় রান্না শুরু করে এবং এবারও আরিফ ভাই পাকাতে থাকেন। তারপর অনেকক্ষণ বাদে সকলেই একসাথে খানা খান।
ঈদের দিনের এ মজলিশ এখানেই শেষ হয়ে যায়। আল্লাহ্ চাহেন তো আগামী সংখ্যায় উপরোল্লিখিত শুহাদাগণ যাদের সম্পর্কে আমার জানা-শোনা আছে তাদের বিষয়ে লিখবো। আল্লাহই একমাত্র তাওফীক দানকারী।
৩য়+ ৪থ পর্ব সমাপ্ত
[চলবে- ইনশাআল্লাহ্]
*****************