আল-ফিরদাউস মিডিয়া ফাউন্ডেশনপ্রবন্ধ-নিবন্ধ

উস্তাদ আহমাদ ফারুক রহ. এর সাথে কিছুক্ষণ (পর্ব – ৫)

তারবিয়াহ – ৬
বিষয়ঃ স্মৃতিচারণ
উস্তাদ আহমাদ ফারুক রহ. এর সাথে কিছুক্ষণ (পর্ব – ৫)
মুঈনুদ্দিন শামী
অনুবাদঃ মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান

 

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম

সকল প্রশংসা নিঃসন্দেহে কেবলমাত্র আল্লাহ্ তা’য়ালার জন্যই, যিনি আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরই আল্লাহ্। তিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই আমাদের মরণ দান করেন। নিঃসন্দেহে তিনি জীবন ও মরণ এজন্যই সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে তিনি দেখে নিতে পারেন যে আমাদের মধ্যে থেকে কে উত্তম আমল করে?

নোট: উক্ত আলোচনায় যেখানেই ‘উস্তাদ’ বা ‘উস্তাদজী’ শব্দটির ব্যবহার হয়েছে, তার দ্বারা উদ্দেশ্য হলোঃ ‘শহীদ আলেমে রব্বানী উস্তাদ আহমাদ ফারুক (রহমাতু্ল্লাহি আলাইহি)।

তাদের দৃষ্টিতে মরণ সর্বনাশী নয়!

পূর্বের ওয়াদা অনুযায়ী আজকে উস্তাদজীর মজলিশে এমন কিছু শহীদদের ব্যাপারে আলোচনা হলো যারা উস্তাদজীর সাথী ছিলেন। ইয়েমেনে আল কায়েদার নায়েবে আমীর শহীদ শায়েখ সাঈদ আশ-শহরী (রহ.) শাহাদাত এবং শুহাদাদের আলোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ
সে (শুহাদাদের কোন একজন) জান্নাতের মধ্যে অবস্থান করছে এখন তার একটা প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, সে সাধারন একটা বিষয়ের জন্য খুবই চিন্তিত। সে তার প্রয়োজন মিটানোর জন্য বলতে আরম্ভ করলো যে, এমন কেউ কি আছে? যে আমাদের বার্তাগুলোকে আমাদের ঐ সকল ভাইদের নিকট পৌছিয়ে দিবেন যারা দুনিয়াতে জীবিত আছে। যাতে করে তারা জিহাদের পথ থেকে দূরে না থেকে জিহাদ করতে করতে আমাদের সাথে মিলিত হয়ে যায়। তাদের কাছে আমাদের পয়গাম কে পৌছাবে? যারা আমাদের প্রিয় ও মহব্বতের পাত্র, যারা আমাদের সাথে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্” এর ভিত্তিতে একত্রিত হয়েছিলাম এবং একই সাথে জীবন অতিবাহিত করতেছিলাম! কে আছে? যে তাদের নিকট আমাদের আকুতিকে নিবেদন করবে, যারা আমাদের সাথে দুশমনের খপ্পর থেকে বেঁচে পালাতেছিলাম, একত্রিত হয়ে দুশমনকে আঘাত হেনেছিলাম শুধুমাত্র “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্” এর জন্য। এমন কে আছে? তাদের নিকট এই সংবাদ পৌছাবে যে, আমরা জীবিত! জান্নাতের মাঝে যেখানে মন চায় সেখানে ঘোরাফেরা করতে পারি! আমাদের এমন শুভাকাংখী আছে কি? যারা আমাদের ভাইদেরকে আমাদের পক্ষ থেকে খবর দিবে, তারা যেন জিহাদকে ছেড়ে না দেয়!।

মোটকথা যদি তোমরা জিহাদ ছেড়ে দাও এবং একাত্ববাদে বিশ্বাসী (তাওহীদের উপর বিশ্বাস রেখে অথবা আল্লাহর ইবাদকারী ) হয়ে মৃত্যুবরণ করো, তবুও নিজের রূহ বা আত্মার সাথে কবর নামক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে যেতে হবে। কিন্তু আমরা চাচ্ছি যে, মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গন করতেই আমাদের নিকট জান্নাতে চলে আসুক। তাহলে তাদেরকে কে পয়গাম পৌছাবে?

আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেন: “আমিই তোমাদের এ পয়গামকে তাদের নিকট পৌছিয়ে দিবো” অতপর রব্বে কারীম এ আয়াত নাযিল করেন:
وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ ……..
“এবং (হে নবী! স.) যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত এবং জীবিকাপ্রাপ্ত। আল্লাহ্ স্বীয় অনুগ্রহে যা দান করেছেন তার প্রেক্ষিতে তারা আনন্দ উদযাপন করছে। আর যারা এখনো তাদের কাছে এসে পৌঁছেনি তাদের পেছনে তাদের জন্যে আনন্দ প্রকাশ করে। কারণ, তাদের কোন ভয়-ভীতিও নেই এবং কোন চিন্তা-ভাবনাও নেই”।
[সূরাঃ আলে ইমরান-১৬৯,১৭০]

জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া পাওয়া হলো ‘শাহাদাত’!

শায়েখ সাঈদ আশ-শহরী (রহ.) এর এ শব্দের তরঙ্গমালা দীলের গভীরে আন্দোলিত হয়ে উঠে এবং বিবেককে এ কথার উপর দৃঢ় বিশ্বাসের মজবুত ইমারত বিনির্মাণ করে চলছে যে, মৃত্যুর সময় ‘শাহাদাতের পিয়ালা’ পান করা কত বড় জরুরী বিষয়। জীবনের বাস্তবতা, হাজারো পেরেশানী, প্রিয়জন ও নিকট আত্মীয়দের বিচ্ছেদে, এবং তাদের পাগলামী দেখে এমনটাই মনে হচ্ছে যে, এ জীবনে শাহাদাতের থেকে বড় কোনো ঔষধ নেই। একটুখানি সময় নিয়ে কবরের স্মৃতিচারণ করে দেখো তো- অন্ধকার, নির্জনতা, শ্মশানের মতো কবরস্থান….। ঐ অন্ধকারের মধ্যেই মুনকার-নাকীরের মতো দু’জন ভয়ঙ্কর আকৃতির ফেরেস্তার আগমন, তারপর আবার কিয়ামতের কঠিন বিশৃঙ্খল অবস্থা যা দেখে বাচ্চারা বৃদ্ধ হয়ে যাবে, মা তার প্রিয় সন্তানকে ভুলে যাবে………। এসব থেকে বাচার মূল্যবান পন্থা হলো শাহাদাত। যদি শুধুমাত্র এ সকল মুশকিল তথা কবর, হাশরের বিপদ থেকে শাহাদাতের দ্বারা পার পাওয়া যায় তাতেই বা কম কিসের? কিন্তু শাহাদাত তো অগণিত ও অতিরিক্ত প্রশান্তির কারণও বটে। কারোর যদি গুলশান বনানীতে সুউচ্চ ভবন থাকে, সুদর্শন বাগান এবং উন্নত ও দ্রুতগামী হাইব্রিড গাড়ি থাকে…….. এ সব কিছু থেকে আরশের নিকটস্থ সুশীতল কাননে আশ্রয় পাওয়া হাজারো লক্ষ কোটি গুন উত্তম। সেখানে যেমন উন্নততর ঘর, জান্নাতের শরাব, ঝর্নাতে অবগাহন এবং নয়নাভিরাম কুঞ্জনে ঘোরাফেরা আর বোরাকের মতো তেজদীপ্ত ও ক্ষিপ্র বাহন যেমন ঘোড়া……. এখানেই ইতি নয়। এগুলো তো আধুনিক দুনিয়াতে জীবন যাপনকারীদের জন্য শুধুমাত্র উদাহারণ সরূপ……..। আল্লাহ্ তা’য়ালা এরশাদ করেন:
وَفِيهَا مَا تَشْتَهِيهِ الْأَنفُسُ وَتَلَذُّ الْأَعْيُنُ ۖ وَأَنتُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
“এবং জান্নাতে প্রত্যেক ঐ জিনিস পাওয়া যাবে, যা জান্নাতীদের অন্তরের চাহিদা হবে এবং যার দ্বারা চক্ষুসমূহ শীতলতা অনুভব করবে, (তাদেরকে বলা হবে যে) তোমরা এ জান্নাতে চিরকাল অবস্থান করবে”। [সূরাঃ যুখরূফ-৭১] সুবহানাল্লাহ্! আল্লাহর রাস্তায় নিহত হওয়ায় কত বড় প্রতিদান।

আমাদের সমাজে এ কথার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে যে, নিহত হওয়ার দ্বারা অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায় এবং নিহত হওয়াটাই অনেক বড় ক্ষতিকর বিষয়। কিন্তু এ রাস্তায় নিহত হওয়া, আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হওয়া এমন একট প্রশান্তি ও তৃপ্তিকর বিষয়, যা না আছে দুনিয়ায় আর না আছে জান্নাতে। এ জন্যই তো শহীদ জান্নাতে গিয়েও শাহাদাতের পিয়ালার জন্য পুনরায় আকুতি জানাতে থাকে। আল্লাহ্ তা’য়ালা আমাদের কাউকে যেন, এ শাহাদাতের পিয়ালা থেকে বঞ্চিত না করেন। আল্লাহ্ পাক আমাদের সকল নিকট আত্মীয়, প্রিয়জন, পিতা-মাতা এবং সন্তানদেরকে শাহাদাতের মরণ দান করেন। আমিন- ইয়া রব্বাল আ’লামিন।

পূর্বের সংখ্যায় যে সকল শুহাদাদের উল্লেখ করা হয়েছিলো তার মধ্যে থেকে ধারাবাহিক ভাবে সাইয়্যেদ কাসেম হাশেমী, রাজা আব্দুর রাফী’ এবং আমজাদ আহমাদ ভাইদের শাহাদাতের আলোচনা করা হবে। শুহাদাদের মধ্য থেকে এ কয়েক জনের উল্লেখ করা কোন বিশেষত্বের কারণে নয়, বরং এদের কিছু স্মৃতি ও কথাগুলো এমন যে, যার উল্লেখ করা খুবই জরুরী। মোটকথাঃ এরা উস্তাদজী (রহ.) এর সুযোগ্য শিষ্যদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

জিহাদের ময়দানে ছুটে চলা এক ছোট ভাই!

সায়্যেদ কাসেম হাশেমী রণাঙ্গনে ‘সাঈদ, এবং ‘সিদ্দীক’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট কাসেম হাশেমী ভাই লাহোরের জিন্দা দিলান এলাকার সাথে বেশ পরিচিত ছিলেন। তার সম্মানিত পিতা সায়্যেদ রাফী’ উদ্দিন হাশেমী সাহেব উর্দূ ভাষার স্বীকৃত সাহিত্যিক ছিলেন, শিক্ষক ছিলেন। তিনি আল্লামা ইকবালের জীবনীর উপর ডক্টরেট করেন এবং সাথে সাথে তিনি লেখনীর ময়দানেও কলম চালিয়েছেন অবিরাম গতিতে। সায়্যেদ কাসেম হাশেমী ভাইয়ের কানে যখন জিহাদের আওয়াজ ভেসে আসে এবং তিনি এ কথা বুঝতে পারলেন ঠিক তখনই রণাঙ্গনে ছুটে যান। আমার মুর্শিদ হযরত উসামা ইব্রাহীম গুরী (রহ.) কাসেম হাশেমী ভাই জিহাদের ময়দানে আসার পূর্বে তাকে খুব ভালোভাবে চিনতেন। তিনি বলেন- “আমরা কখনো কাসেম হাশেমী ভাইকে গভীরভাবে দেখিনি, বরং আমরা মনে করতাম যে, সে-তো অনেক ছোট। কিন্তু এই ছোট-ই সবার আগে জিহাদের জন্য বের হয়ে যায়”।

কাসেম ভাই জিহাদের ময়দানে পৌছে যুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং গ্রহন করে, যাকে তা’সিসী তাদরীব বলা হয়ে থাকে। তিনি উক্ত ট্রেনিং গ্রহনের জন্য উত্তর ওয়াজিস্তান এলাকার আঙ্গুরাডা সংলগ্ন স্থান গিরলামাতে পৌছায়। ট্রেনিং সমাপ্তির পরে হযরত উস্তাদজী (রহ.) এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আঙ্গুরাডার প্রধান মারকাযে অবস্থান নেন। ঐ সময় লেখকও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নিরব প্রকৃতির স্বভাব, হাসি-খুশি মেজাজের লোক হওয়ায় কাসেম ভাই উপস্থিত সকল সাথীদের খিদমতে প্রচুর সময় ব্যয় করতেন অথবা কুরআনুল কারীমের তেলাওয়াতে মগ্ন থাকতেন। আঙ্গুরাডার মারকাযে উস্তাদজীর যে মাজমুয়া’ ছিলো তার পক্ষ থেকে আব্দুল হাসিব ভাই আমিরের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। ভাই আব্দুল হাসিব দু’একবার কাসেম ভাইকে কাজের জন্য কোথাও পাঠান। ভাই কাসেম গিয়ে সে কাজ শেষ করেন এবং সেখানে অনেক কষ্ট-মুজাহাদাও করেছেন পরে আবার ফিরে এসেছেন। আব্দুল হাসিব ভাইয়ের মনে হলো যে, কাসেম ভাই কাজের প্রতি তেমন আগ্রহী নয়। তাই আব্দুল হাসিব ভাই বিষয়টিকে কাসেম ভাইয়ের ট্রেনিং এর উস্তাদ সাজিদ ভাইকে অবগত করেন, যখন দু’জনেই আঙ্গুরাডায় যান। সাজিদ ভাই আঙ্গুরাডা থেকে যখন গিরলামায় ফিরে যান, তখন কাসেম ভাইকেও সাথে নিয়ে যান। পুনরায় যখন সাজিদ ভাই আঙ্গুরাডায় আসেন, তখনও কাসেম ভাই তার সাথেই ছিলেন। আব্দুল হাসিব ভাই কাসেম ভাই সম্পর্কে প্রথমবার আঙ্গুরাডায় এসে উৎফুল্লতার সাথে কাজ না করার বিষয়টি জানিয়েছেন, সে বিষয়টি যখন সাজিদ ভাই কাসেম ভাইকে জানালেন তখন উত্তরে কাসেম ভাই বললেন যে, আসলে বিষয়টি এমন নয় যে আমি কাজের মধ্যে অংশগ্রহন করতে চাইনি। বরং আমি এমন মুজাহিদ হতে চাচ্ছিলাম যার সম্পর্কে সহিহ বুখারীতে নবী স. এবং বাণী এসেছে এভাবে যে, “সুসংবাদ ঐ ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহর রাস্তায় তার ঘোড়ার লাগাম ধরে রাখে। তার মাথার ঘাম পায়ে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করেনা, যখন আমিরের পক্ষ থেকে কোন কিছু সংরক্ষণ বা পালনের জন্য আদেশ করে তখন তার হেফাজতে পুরোপুরি ভাবে লেগে যায়। যদি তাকে লশকর বা সৈন্যদের পিছনে থেকে হেফাজতের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন সে সৈন্যদের পিছনে থেকে তাদের সংরক্ষণের কাজে আঞ্জাম দিতে থাকে। ‍যদি কোন মজলিশ বা অন্দর মহলে প্রবেশের অনুমতি চায় অনুমতি পায় না এবং কারোর জন্য সুপারিশ করলে তার সুপারিশকে গ্রহণ করা হয় না”। এ কারণে আমাকে আব্দুল হাসিব ভাই যেখানে পাঠাতেন সেখানে চলে যেতাম এবং বসে থাকতে বললে বসে থাকতাম।

এখানে এ কথার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, কোন মুজাহিদ অগ্রগামী হয়ে জিহাদ এবং ক্বিতালের কাজে অংশগ্রহনের জন্য নিজেকে পেশ করলে সে কোন মন্দ কাজে পতিত হয়ে যায়। তবে হ্যা যদি রিয়া (লোক দেখানো) উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে তো সকল ইবাদত-ই বরবাদ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে আসলে এ ধরনের উৎফুল্লতা, অগ্রগামী হওয়াটা মুজাহিদের জন্য এক অনন্য বৈশিষ্টের ব্যাপার এবং এটাও বলা হয়েছে যে, এ ধরনের উৎফুল্লতা ও অগ্রগামী হওয়া আল্লাহর নিকট প্রশংসার বিষয়।

তারপরে বাস্তবেও এটা দেখা যায়। কাসেম হাশেমী ভাইকে যেখানেই পাঠানো হতো, যে দলের জন্য তাশকীল করা হতো ততক্ষণাৎ পুরোদমে সেখানেই নিজের জিহাদকে অব্যাহত রাখতেন। কখনো মারকাযে থাকতেন আবার কখনো তিনি মুজাহিদদের মেহমান খানায় থালা-বাটি পরিষ্কার করতে থাকতেন, খানা পাকাতেন আবার তা পরিবেশন করতেন আবার কখনো কখনো বাজার করতেন। তাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য একটি দলের জন্য তাশকীল করা হলো, সেখানে চিঠিপত্র আদান-প্রদান করা, সেগুলোকে সংরক্ষণ করা (ইনক্রিপ্ট করা/ডিক্রিপ্ট করা) এবং সেগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি কাজ গুলোকে তিনি অতি যত্নের সাথে সুন্দরভাবে আঞ্জাম দিতেন।

একদা এক ভাই কাউকে বললো যে, ইদানিং কাসেম ভাই কি করেন? জবাবে বলা হলো যে, ‘মাসয়াব ভাইয়ের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন’। মাসয়াব ভাই আমাদের এমন এক প্রিয় সাথী ছিলেন, উস্তাদজীর মাহফিলে যার অবাদ চলাফেরা ছিলো। মাসয়াব ভাই গুনাবলীতে উস্তাদজীর মাজমুয়ায় এক উজ্জল নক্ষত্র ছিলেন। [টিকা থেকে সংগৃহীত > গত সংখ্যায় লেখক যে সকল শহীদদের আলোচনা করবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন তার মধ্যে মাসয়াব ভাইও ছিলেন। তার আলোচনার সময় বিস্তারিত বর্ণনা করা হবে- ইংশা আল্লাহ্]। মোটকথা মাসয়াব ভাই এবং তার পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্টতার সূত্র ধরে তার খান্দানের থেকে যারা শহীদদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন তাদের জন্য কিছু লেখার জন্য মনের মধ্যে প্রবল আগ্রহ রয়েছে। মাসয়াব ভাইয়ের সম্মানিত পিতা ও দু’বোন জিহাদের জন্য হিজরত করেন, এবং তাদের বিবাহ জিহাদের ময়দানেই হয়েছে। এমনকি তার এক বোনের বিবাহ তিন তিনবার হয়েছে। মাসয়াব ভায়ের মোট চার বোন এবং পিতাজী শাহাদতের পিয়ালা পান করে ধন্য হয়েছেন। প্রথমে হাফেজ সা’দ (খুর্রম হাফিজ), কাতাদাহ্ ভাই, হিশাম ভাই (আলী সালমান), রায়হান ভাই (আফফান গনী) শাহাদাত বরণ করেন। সুবহানাল্লাহ্! এ পরিবার থেকে ছয়জন শাহাদাতের মর্যাদা অর্জন করেন- আল্লাহ্ তা’য়ালা তাদের সকলের প্রতি রহমতের বারি বর্ষণ করেন। এবং আমাদের পরিবারকেও যেন আল্লাহ্ পাক আরশে আজীমের সাথে ঝুলে থাকার তাওফিক দান করেন- আমীন।]

জিহাদের ময়দানে কুরআনের প্রেমিক!

ভাই কাসেম হাশেমী প্রচুর পরিমাণে কুরআনুল কারীমের তেলাওয়াত করতেন। তার এক জিম্মাদার সাথী বলেন যে, কাসেম ভাই আমার সাথেই বেশি সময় থাকতেন। অনেক সময় সফরের মাঝে ‍যদি কোন সাথীর সাথে দেখা সাক্ষাৎ হতো এবং তার সাথে কথা বলার প্রয়োজন হতো, তখন যদি দু’চার মিনিটের বেশি সময় লেগে যেতো তাহলে কাসেম ভাই এক পাশে বসে গিয়ে পকেট থেকে কুরআনুল কারীমের একটা নুসখা বের করে তেলাওয়াতে মশগুল হয়ে যেতেন।

এই জিম্মাদার সাথীই বলেন যে, কাসেম হাশেমী ভাইয়ের শাহাদাতের পর তার পরিচিত এক বুযুর্গ আনসারীর ঘরে গেলেন। তখন ঐ আনসারী সাথী জিজ্ঞেস করলেন যে, তোমাদের এক সাথী ছিলো যে কি-না খুব বেশি তেলাওয়াত করতেন সে কোথায়? প্রথমে এ জিম্মাদার সাথীর তো বুঝে আসে নি যে আনসারী সাথী কি জিজ্ঞেস করছেন। কিন্তু পুনরায় স্মরনে আসলো যে, এখানে তো কাসেম হাশেমী ভায়ের যাতায়াত ছিলো!। সুবহানাল্লাহ্! কুরআনের কেমন প্রেমিক ছিলেন যে, তার পরিচয় বহনের জন্য এ কথা বলা হয় যে, “ঐ সাথী যে কি-না বেশী পরিমাণে কুরআনের তেলাওয়াত করতেন”।

খোদা ভীতি ও সৎ-কাজের সাক্ষ্য!

ভাই কাসেম হাশেমীর সৎ কাজ ও তাক্বওয়ার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ক্বারী আব্দুল আযীয সাহেব শহীদের আহলিয়া জানান যে, কাসেম হাশেমী ভাই যখনই তাদের বাড়িতে আসতেন তখনই বাড়ির বৈঠক খানায় অবস্থান করতেন। যেহেতু ক্বারী আব্দুল আযীয সাহেবের কামরা এবং বৈঠক খানার মাঝে শুধুমাত্র একটি দেওয়ালের ব্যবধান ছিলো, তাই পাশের ঘরের অবস্থা সহজেই জানা যেত। ক্বারী সাহেবের সম্মানিতা আহলিয়া বলেন যে, একবার আনুমানিক রাত দুইটার সময় অনুভূত হলো যে, পাশের ঘর থেকে নড়াচড়ার আওয়াজ ভেসে এসো। তার কিছুক্ষণ পরেই তেলাওয়াতে কুরআন এবং যিকির আযকারের আওয়াজ আসতে লাগলো। কাসেম হাশেমী ভাই এত রাতে উঠে তেলাওয়াতে কুরআন ও তাহাজ্জুদের মাঝে মশগুল হয়ে যেতেন।

শুহাদার কাননে আনুগত্যশীল মুজাহিদ!

কাসেম হাশেমী ভাইয়ের সকল আমীর ও জিম্মাদার সাথীরা তার প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন এবং এমন কোন মুজাহিদ সাথী খুজে পাওয়া ‍যাবে না যে, কাসেম ভাইয়ের কাছ থেকে কোন কষ্ট পেয়েছেন। কাসেম ভাই ২০১২ ঈসায়ীতে ওয়াজিস্তানে মাহসুদ কওমের এলাকায় ‘ছাপান্ন কামরায়’ এক প্রোগ্রামে উপস্থিত ছিলেন। ঈদুল ফিতরের দিন যখন পাকিস্তানী সেনাদের গুপ্তচরবৃত্তির সূত্র ধরে আমেরিকার ড্রোন বিমানের দ্বারা কিছু সাথীদেরকে নিশানা বানায়। ঐ বোম্বিংয়ে যারা শাহাদাতের অমীয় সূধা পানে ধন্য হন তার মধ্যে কাসেম হাশেমী ভাইও অন্তর্ভূক্ত ছিলেন এবং এ হামলাতেই আমাদের বন্ধুবর ও ভাই মুহাম্মাদ আসকারীও শাহাদাত বরণ করেন, যার আলোচনা শুরুর দিকের সংখ্যাতে উল্লেখ করা হয়েছে। আমেরিকার নিক্ষিপ্ত মিসাইলের একটা অংশ কাসেম হাশেমী ভাইয়ের টাকনুতে লাগলে বড় একটা রগ কেটে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসা করে মারকাযে নিয়ে যাওয়া হয়, কাসেম ভায়ের রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে এবং সে কারনে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে শাহাদাতের পিয়ালায় চুমুক দিয়ে শহীদি কাননে পৌছে যান। আল্লাহ্ তার প্রতি প্রশস্থ রহমতের বারিধারা বর্ষণ করেন।

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য!

যে ডাক্তারগণ উম্মাহর ক্ষতচিহ্নের চিকিৎসার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলেন, তারা কাসেম ভাইয়ের শাহাদাতের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, সে ‘ঈমানের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফরযে আঈন’ থেকে বেখবর ছিলেন। একজন মুজাহিদকে যুদ্ধের ময়দানে শুধুমাত্র এ জন্যই জীবনের ইতি টানতে হচ্চে যে, সামান্য যখমের জন্য ‘প্রাথমিক চিকিৎসা’ দেওয়ার মতো কোন ডাক্তারের ব্যবস্থা নেই।
আমি তো খুজেফিরি শহরের চিকিৎসা বিদ্যার গুরুজন

ছটফটরত মুজাহিদের যখমে পট্টি বাধিবে যে জন!

চিকিৎসক, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ঐ সকল স্থানে যাওয়া এবং তাদের ক্ষতস্থানে মলম লাগানোর ব্যবস্থা করা, যারা নিজেদের শিরার শেষ রক্ত ফোটাও নিংড়িয়ে দিয়ে উম্মাহর শরীরকে সুস্থ্য রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু এ সকল ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা দুনিয়াকে অর্জন করতে নিজেকে সর্বদা ব্যস্ত রেখে চলছেন। এ কথাগুলো সমালোচনার জন্য বা বদ দোয়ার জন্যও নয়….. বরং এটা অন্তরের ব্যথা। আমরা প্রতিদিন আমাদের উম্মাহর বাচ্চা, বুড়া, মহিলা ও নওজোয়ান পুরুষ মুজাহিদদের শুধুমাত্র প্রাথমিক চিকিৎসা এবং ডাক্তারের অভাবে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটতে দেখতেছি। এ অভিযোগ আমার একার নয়। অথচ উম্মাহর লক্ষ লক্ষ তরতাজা জীবনের আত্মচিৎকার শোনা যায়। আফসোস! আফগানস্তানে চলমান বিশ বছরের যুদ্ধে যে সকল চিকিৎসক অংশগ্রহণ করেছেন তাদের সংখ্যা হাতে গোনার মতো। কিন্তু যে ডাক্তার আমাদের শহরগুলোতে দুনিয়া অর্জনের লক্ষে উপার্জন করতে করতে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন তাদের সরকারী চিকৎসকের সংখ্যা হয়তোবা জরিপ করার প্রয়োজন পড়বে এবং বেসরকারীদের সংখ্যা অগনিত। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য খুবই প্রয়োজন হলো তারা যেন নিজেদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসহ ঐ সকল ময়দানে পৌছান এবং জীবন উৎসর্গকারী তাওহীদে বিশ্বাসী ভাইদের জীবন বাচান….. এবং তাদের জন্য আরো কর্তব্য হলো যে, তারা মুজাহিদের জীবনকে রক্ষা করে নিজের জীবনকে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের মুশকিল থেকে নিরাপত্তা লাভ করেন। এ সকল ডাক্তার/স্বাস্থ্যকর্মীরা নিশ্চিতভাবে মুজাহিদ এবং উম্মাহর নিপীড়িত ও আহত মুসলিমদেরকে অনেক কিছুই দিতে পারেন। কিন্তু এ খেদমত দেওয়ার বিনিময়ে সে ঈমানী ও অন্তরের দৌলতও পেতে পারেন, ‍যে প্রশান্তি দুনিয়ার অন্য কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়।

জিহাদী কবি শায়েখ আহসান আজিজ (রহ.) একটি – ‘মুজাহিদের প্রয়োজন হলো ডাক্তারের’ পঙ্তির দ্বারা শুরু করেছেন কিন্তু শেষ পঙ্তি হলো ‘ডাক্তারের প্রয়োজন হলো মুজাহিদের’ কবিতাটি কি ছিলো। ডাক্তারের উপকারিতা ব্যাপক যেমন সে ক্ষতস্থানে মলম লাগাবে কেটে যাওয়া স্থানে সেলাই করবে, অন্তরের ব্যথা প্রশমিত ও হায়াতের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে।

ইলম পিপাসু শহীদ রাজা আব্দুর রাফী’/যাহেদ/আব্দুল ওয়াদুদ!

আমাদের আগের উস্তাদজীর মাহফিলে আলোচিত শুহাদা কাননের দ্বিতীয় শহীদ রাজা আব্দুর রাফী’। জিহাদের ময়দানে তাকে প্রথমে যাহেদ এবং শেষ দিকে আব্দুল ওয়াদুদ নামে সুপরিচিত ছিলেন। যাহেদ ভাই পাকিস্তানের মারগলা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত নগরী ইসলামাবাদের সাথে সম্পর্ক ছিলো। তিনি আর্মি মেডিক্যাল কলেজ রাওয়ালপিন্ডিতে লেখাপড়া করেন। এখানেই সুমহান জিহাদের আহ্বান শুনতে পান এবং নিজের পিপাসিত আত্মাকে জিহাদের সুশীতল পানি দ্বারা পরিতৃপ্ত করতে ২০০৯ ঈসায়ীতে ওয়াজিস্তানে গমন করেন। যাহেদ ভাই নিজের নামের মতোই যাহেদ তথা দুনিয়া বিমুখ ও আবেদ ছিলেন। নীরব প্রকৃতির লোক ছিলেন এবং চিন্তা ফিকিরে ডুবে থাকতেন বরং চিন্তাবিদ ছিলেন। কিন্তু যখনই কেউ তাকে দেখতেন তো তিনি চিন্তাযুক্ত চেহারা নিয়ে ইস্পিত হেসে দিতেন। যাহেদ ভাই একজন উত্তম মিমাংসাকারী ও নসিহতকারী ছিলেন যার জন্য আমার অভিধানে সবচেয়ে উত্তম শব্দ হলো ‘Counsellor’ বা পরামর্শদাতা। যাহেদ ভাইকে যদি আপনার কথা শুনাতে থাকলে সে শুনতেই থাকতেন এবং আপনার সমাধান দিতে থাকতেন চাই তার যত কাজই পড়ে থাকুক।

শেখা এবং শেখানোর কাজে তার প্রচুর আকাঙ্ক্ষা ছিলো। সাথে সাথে দ্বীনি জ্ঞান অর্জনে খুব বেশী আগ্রহী ছিলেন। যাহেদ ভাইতো একটা সমুদ্র ছিলেন, যার গভীরতা অল্প সংখ্যক লোকই জানতেন। আমি নিজেও তার গভীরতা সম্পর্কে জানতাম না। তবে কিছু সাথী তাকে বলতে থাকতেন যে, নিজের মধ্যে লুকায়িত ভান্ডারের কিছু হলেও বের করেন। যে ইলম ও বিষয়ে তার গভীরতা ছিলো তিনি সর্বদা অন্যকে শিখানোর জন্য তৈরি ছিলেন। নমনীয়তা ও তাওয়াজু এতটাই ছিলো যে ছোট থেকে ছোটকেও শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করে নিতেন। স্বয়ং আমি নিজেও এ কথার সাক্ষী যে, যাহেদ ভাই অনেকবার নিজের থেকে বয়সে ছোটদের সামনে বসে যেতেন এবং কয়েক দিন পর্যন্ত তার কাছে পড়তে থাকতেন। নিজে নিজে চেষ্টা করে তিনি আরবী ভাষা শিখেছেন, ইসলামী আঈন ও ইসলামী আঈনের মূলনীতি শেখার জন্য আলেম সাথীদের কাছে লেখা পড়া করতেন। এভাবে হাদীস ও তাফসীর বিষয়ের জ্ঞানও শিখতে ছিলেন বরং তা’লিমী তারতীব দ্বারা তিনি দরসে নিযামীর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সিলেবাস পড়েছেন। তাফসীরের বিষয়ে তিনি খুব চিন্তা ফিকির ও যযবার সাথে মুফতী মুহাম্মাদ শফী উসমানী সাহেবের ‘মায়া’রিফুল কুরআন’, সায়্যেদ কুতুব শহীদ রহ. এর তাফসীর ‘ফি যিলালিল কুরআন’ এবং ‘তাফসীরে সায়’দী’ পড়তেন। আত্মশুদ্ধির জন্য তিনি হযরত মাওলানা হাকিম আখতার সাহেবের মাওয়ায়েজ দ্বারা উপকার লাভ করতেন। আক্বিদার বিষয়ের কিছু ক্লাস তিনি মাওলানা ডাক্তার উবাইদুর রহমান আল মারাবিত (হাফিজাহুল্লাহ্) থেকে পড়েছেন। এমনকি তিনি কিছু সবক আমাদের শহীদ আযীয আলী ত্বরীক ভাইয়ের কাছ থেকে শিক্ষা করেছেন, আলী ত্বরীক ভাইয়ের সাথে তার খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিলো এবং দু’জনে একই সাথে শাহাদাত বরণ করেন।

নামে ও কাজে অভিন্ন ছিলেন ভাই যাহেদ!

নিজের অস্তিত্বের জন্য মোটেও চিন্তা করতেন না। যেমন নাম ছিলো যাহেদ, তেমনী খানা-পিনা, উঠা-বসা দেখে লোকেরা বলতেছিলো যে সে তো সব কিছু থেকে অমুখাপেক্ষী ছিলেন এবং ইবাদত গোজার ছিলেন। তিনি নিজের জীবনের বড় একটা সময় বিভিন্ন অবস্থায় অনেক সফর ও জিহাদের কাজে ব্যয় করেছেন কিন্তু ফরয সালাতের আগে পরের সুন্নাত এবং নফল সমূহের খুবই ইহতেমাম করতেন। সালাতুল ইশরাক্ব ও চাশতের মতো নফলেরও নিয়মিত পাবন্দ ছিলেন। আমি একটা দীর্ঘ সময় তার সাথে কাটিয়েছি যার মধ্যে তাহাজ্জুদের সালাত ছুটে গেছে এমন দিন খুবই নগন্য। কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত সহ সকল ভালো কাজ সমূহ এবং মাসনূন দুয়া’র নিয়মিত পাবন্দ ছিলেন। অধিকাংশ মুয়ামালাতের ক্ষেত্রে এসতেখারা তথা আল্লাহর সাথে পরামর্শ করে আঞ্জাম দেওয়ায় অভ্যস্ত ছিলেন। কুরআনের মধ্যে গভীর চিন্তা-ফিকিরের ক্ষেত্রেও তার ভিন্ন একটা শান ছিলো, তাফসীর এবং উলামাদের তত্তাবধানে সকল ইবাদত করতেন। কুরআনের যে আয়াতের মধ্যে তিনি চিন্তা-ফিকির করতেন নিজের প্রিয় মানুষের কাছে তার আলোচনা করতেন।

মাযহাব প্রীতি তাকে স্পর্শও করতে পারেনি। এর থেকে তিনি উর্ধ্বে থাকতেন। শুধুমাত্র দূরেই থাকতেন না বরং উপস্থিত সাথীদের মাঝেও এগুলোর সুযোগ দিতেন না। নিজে এবং অন্যান্য সাথীদের অবস্থা ইসলাহের জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। সৎ কাজের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের ক্ষেত্রে তিনি একজন আদর্শবান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ভুলকে বন্ধ ও সংশোধন করতে খুবই তৎপর ছিলেন, কিন্তু যদি সংশোধন না হতো তাহলে তার উপর কোন গালমন্দ না করেই ঐ ভুলের দ্বারা যারা প্রভাবিত হতেন তাদেরকে সতর্ক করতেন। যাতে করে সর্বদা গলদ ব্যক্তির থেকে দূরে সরে থাকতে পারে।

ধোকা না খাওয়া মু’মিন!

যাহেদ ভাই খুব সাদা-সিদে ছিলেন, কিন্তু তাকে ধোকা দেওয়া সহজ ছিলো না। বাস্তবে যদিও তিনি সাদা-সিধে ও অন্যের চালাকি অথবা নিজের ভালো ধারনার বশবর্তী হয়ে কোন মুয়ামালায় ধোকার শিকার হতেন তবুও খুব দ্রুতই হাক্বিকত বা আসল অবস্থা জেনে ফেলতেন এবং তারপর নিশ্চুপভাবে আলাদা পথে গ্রহণ করতেন।

যে হাদিস শরীফ কাসেম হাশেমী ভাইয়ের আলোচনার মাঝে উল্লেখ করেছেন যাহেদ ভায়ের অবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে উক্ত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, “সুসংবাদ ঐ ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহর রাস্তায় তার ঘোড়ার লাগাম ধরে রাখে। তার মাথার ঘাম পায়ে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করেনা, যখন আমিরের পক্ষ থেকে কোন কিছু সংরক্ষণ বা পালনের জন্য আদেশ করে তখন তার হেফাজতে পুরোপুরি ভাবে লেগে যায়। যদি তাকে লশকর বা সৈন্যদের পিছনে থেকে হেফাজতের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন সে সৈন্যদের পিছনে থেকে তাদের সংরক্ষণের কাজে আঞ্জাম দিতে থাকে। ‍যদি কোন মজলিশ বা অন্দর মহলে প্রবেশের অনুমতি চাইলে অনুমতি পায় না এবং কারোর জন্য সুপারিশ করলে তার সুপারিশকে গ্রহণ করা হয় না”।

যাহেদ ভাই বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রেশিয়ান বিভাগে কাজ করতেন সাথে সাথে অন্যদের জিম্মাদারীও পালন করতেন। কিছুদিন পরে তিনি উস্তাদজীর মাজমুয়া এর অর্থ বিভাগের সদস্য নির্বাচিত হন। সেই উস্তাদজীর ‘প্রচার সম্পাদক’ এর দায়িত্বও পালন করতে থাকেন। মোটকথা যাহেদ ভাইয়ের দু’জন জিম্মাদার-ই তার পরিপূর্ণ দ্বীনদারী ও আমানতদারীর প্রতক্ষ্য সাক্ষী।

মুজাহিদের আত্মত্যাগ!

বাইতুল মালের ব্যাপারে এবং সেই সাথে মুজাহিদ সাথীদেরও খুবই খেয়াল রাখতেন। একদিন আমাকে বলতে ছিলেন যে, ‘আমাদের প্রিয় সাথীদেরকে মারকায থেকে যে মাসিক খরচ বাবদ টাকা দেওয়া হয়, তা দিয়ে কি সাথীরা চলতে পারেন? যদি আপনি অনুভব করেন যে, কম হয়ে যাচ্ছে তাহলে আমার সংশ্লিষ্ট জিম্মাদারের নিকট এ ব্যাপারে সুপারিশ করবো’। মারকায থেকে ঐ সময় প্রত্যেক সাথীর জন্য প্রতি মাসে অর্থ বিষয়ক জিম্মাদারের নিকট তিন হাজার রুপি দেওয়া হতো। চারশত সাথীর টাকা একত্রিত হতে হতে একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দাড়াতো, যার মাধ্যমে জীবনের অধিকাংশ প্রয়োজন মিটানো সম্ভব হতো। কিন্তু যাহেদ ভাই মারকাযের বাজার করেন এমন এক সাথীকে বলে রাখলেন যে, আমাকে একা থাকতে দিন অর্থাৎ সবার সাথে খানায় শরীক হবেন না। তিনি সাথীদের ফিকির করতেন কিন্তু নিজের অবস্থা এই ছিলো যে, অন্য সাথীদের মতো তিনিও তিন হাজার রুপী পেতেন। যাহেদ ভাই বাজার থেকে খানা কিনে খেতেন। যাহেদ ভাইয়ের একজন দফতরী সাথী তায়্যিব ভাই যার আসল নাম ওয়াক্কাস ছিলো, যিনি অধিকাংশ সময় যাহেদ ভায়ের কাছে আসা যাওয়া করতেন তিনি যাহেদ ভায়ের আমল সম্পর্কে বলেন, এটা বলা সম্ভব নয় যে, যাহেদ ভাই কিভাবে জীবন অতিবাহিত করতেছেন! তিন হাজার টাকাকে ত্রিশ দিনে ভাগ করলে প্রতিদিন একশত টাকা হয়, আবার প্রতিদিন তিন বেলা বা দু বেলায় একশত টাকায় বাজার থেকে কিনে খাওয়া কি সম্ভব? বিষয়টি এমন ছিলো না, সে প্রতিদিন সকালে চায়ের সাথে রুটি অথবা সস্তা বিস্কুট খেতেন। অনেক সময় দুপুরে খেতেন-ই না এবং সন্ধ্যার সময় সবচে সস্তা রেস্টুরেন্ট থেকে ছোলার ডাল অথবা কোন সবজী দিয়ে রুটি খেতেন। উপরে বর্ণিত ছোলার ডালের অবস্থা ছিলো যে, শুধু লবণ দিয়ে সিদ্ধ করা ডাল এবং এমন কোন তরকারী যা রুগীদের জন্য প্রযোজ্য। একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত যাহেদ ভাইয়ের খানার অবস্থা ছিলো এটাই। আমি নিজে যখন তার সাথে ছিলাম তখন আমার জন্য স্বাভাবিক খাবার আনতেন আর নিজে অধিকাংশ সময় ঐ ছোলার ডাল-ই নিয়ে আসতেন।

টেকনোলজি সম্পর্কে মুজাহিদের অভিজ্ঞতা-

উস্তাদজীর সকল প্রকারের চিঠিপত্র প্রথমে যাহেদ ভাইয়ের কাছে আসতো। উস্তাদজী যেহেতু দূরে কোথাও থাকতেন এবং তার গোপনীয়তার বিষয়টিও অনুভব করতেন তাই প্রথমে কাগজে লিখে অথবা কোন পার্সেলের মাধ্যমে পাঠানো পত্রকে যাহেদ ভাই খুলতেন এবং স্ক্যানার দিয়ে উল্টিয়ে উস্তাদের নিকট পাঠাতেন। তারপরেও সকল কাজগুলো সুন্দরভাবে আঞ্জাম দিতেন। মনে পড়ে গেলো যে, উক্ত কাজের সাথে তার অধীনের মাজমুয়া’র উপস্থিত সাথীদেরকে ডাটা বা তথ্যগুলোকে একত্রিত করতে বলেন এবং নিজেও এখলাসের সাথে খুজতে থাকেন। শুধুমাত্র দ্বীনি বিষয়-ই নয় বরং জিম্মাদার সাথীদের জন্য দ্বীনি বিষয়ের সাথে সাথে অর্থনৈতিক বিষয়েও বিশ্বস্ত হওয়া খুবই জরুরী। চিঠিপত্র ও ডাটাকে প্রতিদিন অতি যত্ম সহকারে সংরক্ষণ করতেন। এ জন্য বুঝে শুনে সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। যেহেতু বর্তমানে দুনিয়ার অধিকাংশ দাপ্তরিক কাজ ‘কম্পিউটার’ এর উপর নির্ভর করে এ জন্য তিনি কম্পিউটারের সিকিউরিটি ও ইনক্রিপশনের ব্যাপারে খুবই গুরুত্ব দিতেন এবং কোন নতুন কিছুর বিষয়ে জিজ্ঞেস করে জেনে বা শিখে নিতেন। আর যদি কোন সমস্যা বা ক্ষতির চিহ্ন অনুভব করতেন তাহলে সাথে সাথে তা দূর করে নিতেন। আল্লাহ্ তা’য়ালার নিকট আশা রাখি যে, যখন উস্তাদ আহমাদ ফারুক ওয়াজিস্তানের জিহাদে ২০১২ ঈসায়ী থেকে ২০১৪ ঈসায়ী পর্যন্ত যে ফিতনা হয়েছিলো তার আলোচনার সময়ে যাহেদ ভাইয়ের কিছু কথা প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করবো। ইংশা আল্লাহ্-

আল্লাহ্ তা’য়ালার সন্তুষ্টিই হোক জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য!

যাহেদ ভাইয়ের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিলো আল্লাহ তা’য়ালা সন্তুষ্টি অর্জনে সর্বদা চেষ্টা ফিকিরে লিপ্ত থাকা। সে চেষ্টার মাঝেই তার যৌবনকে জিহাদের ময়দানে ব্যয় করা, দুনিয়া বিমুখতা, ইবাদত ও ময়দানে অবস্থান করা ইত্যাদি। স্বীয় মাতৃভূমি থেকে হাজার মাইল দূরে থেকে নিজের পালনকর্তাকে রাজি করানোর জন্য কান্দাহারে অবস্থান করছিলেন। ২০১৫ ঈসায়ীর অক্টোবরের প্রথম দিকে আমেরিকা, পাকিস্তান ও আফগানী অপারেশনে যাহেদ ভাই শাহাদাত বরণ করেন এবং তার লাশও খুজে পাওয়া যায়নি। তার সাথে আরো দু ডজনেরও বেশি উন্নত ও মূল্যবান মুজাহিদ শাহাদাতের পিয়ালা মুখে নিয়ে সোজা জান্নাতে চলে যান।

যারা আল্লাহ্ তা’য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জিহাদের সফরে জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে থেকে কয়েক জনের নাম এখনো স্মৃতিতে ভেসে বেড়ায়, তারা হলেন- মাওলানা মুফতী আবু মুহাম্মাদ ইশতিয়াক আ’জমী, মাওলানা ক্বারী আব্দুল আযীয, মৌলভী মুহাম্মাদ সা’দ (সুরাকা), কমান্ডার (সুহাইল) ত্বরিক বাঙ্গালী, (সাদ্দাম হুসাইন) ইয়াকুব বাঙ্গালী, আনওয়ার বাঙ্গালী, সিদ্দীক বাঙ্গালী, তুরাব, উস্তাদ বেলাল, ক্বারী তুফাইল, তাজ, মুয়াজ জাকরানী, সাজ্জাদ বেলুচ, ছবের বেলুচ, মৌলভী মুহাম্মাদী বেলুচ, আলী ত্বরিক গোন্ডল, মুহাম্মাদ যুহাইব (সালেহ), আম্মার টিপু (হুযাইফাহ্)…… আল্লাহ্ তাদের সকলের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন।
হে বখীল! শক্তি ফিরে পাই যদি মাটিতে মিশে * তুমি কেন চেঁচিয়ে বেড়াও অলি-গলিতে?

আমজাদ আহমাদ ভাই!

এখন আমজাদ আহমাদ ভাই সম্পর্কে কিছু কথা আলোচনা করবো। আমজাদ আহমাদ ভাই জিহাদের ময়দানে ‘আরিফ’ নামে পরিচিত ছিলেন আর আমি তাকে ‘আরিফ বিল্লাহ্’ বলে ডাকতাম। তার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ২০১১ ঈসায়ীর মাঝামাঝিতে যখন আমি ক্বারী আব্দুল আযীয সাহেবের বাড়ির নিকটবর্তী এলাকায় ‘কোরী কোট’ (উত্তর ওয়াজিরিস্তান, পাকিস্তান) আমার মূল আবাসস্থল ছিলো যার আলোচনা পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে। কোন একটা কাজের জন্য ক্বারী আব্দুল আযীয সাহেবের বাড়িতে গিয়ে তার বৈঠক খানায় আরিফ ভাইকে অবস্থান করতে দেখি। আরিফ ভাই বড়ই মহব্বতের সাথে আমার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। সেখানে যা দিয়ে সম্ভব তার দ্বারা মেহমানদারী করলেন। মেহমানদারীর জন্য যা দিয়েছিলেন তা স্মরণ নেই, কিন্তু মোটামুটি মনে আছে। আরিফ ভাইয়ের সাথে বেশি কথাবার্তা হয়নি তারপর আমি উঠে নিজের মারকাযে চলে আসি। কিছুদিন বাদে আরিফ ভাইয়ের শুভেচ্ছা পত্র আসে। সামান্য কথাবার্তা হলো, আরিফ ভাই আমার হালত জিজ্ঞেস করলেন ও ভালোবাসা প্রকাশ এবং উপদেশের সম্পর্ক উক্ত আরিফ নামের মাধ্যমেই স্থাপন হলো। পুনরায় তার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় ‘মিরান শাহ্’ এলাকায়। আমরা একসাথে হযরত উস্তাদজীর থেকে ‘দাওরায়ে শরইয়্যাহ্’ করি। আরিফ ভাই ও আমার অবস্থা সামান্য সময়ের ব্যবধানে এমন হয়ে যায় যেমন ফারুক ভাইয়ের সাথে দোস্তী ও ভালোবাসা ‘বদর মানসূর’ ভাইয়ের ছিলো। অনেক দাওরার মাঝে ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে এবং সংশোধনের জন্য অংশগ্রহন করতেন। পরে দাওরার অন্যান্য সাথীরা বলতেন যে, আমাদের সাথে ‘বদর মানসূর’ ভাই দাওরায় অংশগ্রহন করেছেন। সুতরাং আসল কথা হলো যে দাওরার মাঝে আরিফ ভাইয়ের মতো মূল্যবান সাথী অংশগ্রহন করেছেন সেখানে আমিও শরীক ছিলাম। এ দাওরার শেষে উস্তাদজী যখন সাথীদেরকে তার মান ও কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে ক্রমবিন্যাস বা ‘নম্বর’ দিয়ে তার একটা তালিকা সাথীদের হাতে তুলে দেন, তার মধ্যে যার নাম প্রথমে ছিলো সে হলো আরিফ ভাই। আরিফ ভাই জিহাদের ময়দানে অংশ নেওয়ার পূর্বে ‘ইসলামী জমইয়্যাতে ত্বলাবা’ এর সম্মানিত সক্রিয় ব্যবস্থাপক ছিলেন। বরং তিনিই কাজকে সক্রিয় রাখতেন, তিনি অনেকগুলো কাজের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন। তার চলাফেরা ছিলো করাচীতে। যারা জানেন তারা বুঝবেন যে, ‘ইসলামী জমইয়্যাতে ত্বলাবা’ এবং বিশেষ করে করাচীর মধ্যে এ সংগঠনের কোন ব্যবস্থাপক কত বড় উন্নত ও যোগ্যতা সম্পন্ন জিম্মাদার হতে পারেন। কিন্তু আরিফ ভাই এতটাই বিনয়ী ও নমনীয় ছিলেন যে, তার কোন কথা বা কাজের দ্বারা এটা কখনো প্রকাশ পায়নি। বরং জিহাদের ময়দানেও কত জিম্মাদারদের অধীনস্ত হয়ে কাজ করেছেন কিন্তু কখনো কোন কাজে গাফলতি বা অবহেলার নাম গন্ধও পাওয়া যায়নি।

দাওয়াতে জিহাদের ময়দানে মুজাহিদ আরিফ ভাই!

আরিফ ভাই শত শত নওজোয়ানের জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে বিসর্জন দিতে দাওয়াত দিয়েছেন। তার দাওয়াতে দশটি কাফেলা জিহাদের অংশ হয়ে যায় এবং আল্লাহকে রাজী করতে শাহাদাতের জন্য গর্দান দিয়েছেন তা কি পরিমাণ আল্লাহই ভালো জানেন। আরিফ ভাই নিরব স্বভাবের লোক ছিলেন। চোখ থেকে মেধা ও চিন্তা ফিকির টপকে পড়তো। কথা বলার সময় সতর্কতার সাথে বলতেন। অন্য কাউকে চালানোর যোগ্যতা আল্লাহ্ তা’য়ালা তাকে যথেষ্ট পরিমাণ দিয়েছিলেন। পবিত্র শরীয়াতের উপর দৃঢ়ভাবে আমলের পাবন্দ ছিলো। আমি নিজে দেখেছি যে, শরীয়াতের এমন কিছু বিধান ও মাসয়ালা আমার উপস্থিতিতে উস্তাদজীকে জিজ্ঞেস করলেন যার উপর শরীয়ত সম্মতভাবে আমল করতেন না। কিন্তু সে সকল বিষয়ের উত্তর পাওয়ার পর থেকে শাহাদাত পর্যন্ত ঐ ভাবে আমল করতেন যেভাবে উস্তাদজী বলেছিলেন।

একটা কঠিন মূহুর্তে, সেই ফেৎনার মধ্যে যার আলোচনা সামনে আসতেছে- ইংশা আল্লাহ্। তিনি মুজাহিদদেরকে বিভক্তির হাত থেকে বাচালেন। ঐক্য বজায় রেখে লড়াইয়ের পাবন্দ করতেন, আমিরের আনুগত্যের উপর দৃঢ় থাকতেন, কথা ও কাজের মাধ্যমে ফিৎনার মোকাবেলা করতেন। তারপরে সকল এবং প্রসংশা ও ফলাফলকে আমিরদের উপর ন্যস্ত করতেন। তিনি সর্বদাই জাতিগত গর্বকে চূর্ণ করে দিতেন বরং জাতিগত গর্ব করার সুযোগ-ই দিতেন না।

মুজাহিদ আরিফ ভাইয়ের দু’টি গুন- বিনয় ও বিভক্তি থেকে বাচাঁনো!

যখন-ই আমি কোথাও আরিফ ভাইয়ের নাম শুনতাম অথবা আমার স্মৃতিতে তার অবয়ব ভেসে উঠতো, তখন-ই আমার সামনে তার দুটি গুন ভেসে উঠতোঃ ১। বিনয় ২। বিভক্তি থেকে বাচাঁনো। আরিফ ভাই সত্যিকারের আরিফ বিল্লাহ্ তথা আল্লাহর পরিচয় লাভকারী ছিলেন। তার মাঝে আরো অনেক উত্তম গুনাবলির সমাবেশ ছিলো, কিন্তু উল্লেখিত গুন দু’টি আমার দৃষ্টিতে খুবই উত্তম ও উন্নততর ছিলো। তিনি ফেৎনা বা ঝগড়ার কথাকে চেপে রাখতেন, গীবত থেকে দূরে থাকতেন। বরং কোথাও কোন গীবত বা পরনিন্দা হতে শুনলে গীবতকারীর সামনে তার চেহারায় অপমানের এমন ভাব ফুটিয়ে তুলতেন এবং অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন যে, গীবতকারী অপমানিত হয়ে যেতো।

অবশেষে সেই শাহাদাতের পিয়ালা!

আরিফ ভাই আল-কায়েদার বীর্রে সগীরের পক্ষ থেকে করাচীতে কয়েকটি কাজের সংশ্লিষ্টতায় জিম্মাদার ছিলেন। যখন গোয়েন্দাদের মধ্যে বিশেষ করে ‘রও আনওয়ার’ খুজতে গিয়ে আরিফ ভাইয়ের পিছনে অনুসন্ধান করে এবং তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ২০১৭ ঈসায়ীতে আইএস.আইএস.পি. ‘রও আনওয়ার’ আরিফ ভাইকে হ্যান্ডকাপ লাগানো অবস্থায় জেলখানার পুলিশ তাকে শহীদ করে দেয়। হত্যাকারী ভেবেছিলো, তার জীবনকে শেষ করে দিতে, কিন্তু মু’মিন বা বিশ্বাসীদের ভাগ্যতো এমন-ই হয়।

আজকে উস্তাদজীর মাহফিলকে আল্লামা ইকবালের এই তিনটি শের বা কবিতার দ্বারা শেষ করছি, তাহলো:
দু’আলম থেকে ছিন্ন করে তারা দিলকে
প্রিয় বস্তু বানায় যারা মিলনের স্বাদকে,
শাহাদাত হলো মাকসাদে মু’মিন জীবনের
গনিমত নয়-তো, নয়-তো দেশ দখলের
দিলের প্রমোদ বুঝে নেয় সে উহাকে (শাহাদাতকে)
ধ্বংশ নয় তো মরণ মু’মিনের নজরে!

[চলবে- ইনশা আল্লাহ্]

**********

Related Articles

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × 5 =

Back to top button