মানবাধিকারের বর্তমান রূপ ও আমাদের করণীয়
তারবিয়াহ – ৬
সম্পাদকীয়
মানবাধিকারের বর্তমান রূপ ও আমাদের করণীয়
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ.
সকল প্রশংসা রব্বে জালাল মহান আল্লাহ তা’আলার দরবারে, যিনি আমাদেরকে খোরাসানের বিজয়ী কাফেলার সাথে দ্বীনের সহিহ রাস্তায় এগিয়ে যাওয়ার তাওফিক দান করেছেন। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক শ্রেষ্ঠ সমরবিদ, নবীকুল শিরোমণি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর এবং তার পরিবার-পরিজন, সাথীবর্গ ও কেয়ামত পর্যন্ত আগত দ্বীন ও ইসলামের অনুসারী মুজাহিদিনদের উপর।
প্রিয় মুসলিম উম্মাহ!
‘তারবিয়াহ’ ম্যাগাজিনের ষষ্ঠ সংখ্যা প্রকাশের পথে আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তা’আলা এর সাথে সংশ্লিষ্ট লেখক, পাঠক, প্রস্তুতকারী এবং শুভাকাঙ্ক্ষী সকল ভাইকে উত্তম বিনিময় দান করুন, আমীন। আমাদের এই সংখ্যায় রয়েছ, জিহাদের উদ্দেশ্যসহ পূর্বসূরিদের কিছু স্মৃতিচারণ। এছাড়া হক্বের প্রতি উদ্বুদ্ধকারি আরো কিছু পাথেয়। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে এর থেকে ফায়দা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন, আমীন।
প্রিয় মুসলিম উম্মাহ!
বর্তমানে গোটা বিশ্বে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে চলছে বেহায়াপনার প্রতিষ্ঠা। সেই সাথে চলছে মুসলিম নিধনের প্রতিযোগিতা। কেউ কেউ তো দাবি করছেন, বর্তমান দুনিয়া শিক্ষা, সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাফল্যের চরম শীর্ষে অবস্থান করছে। তবে এ কথা বলা হয়তো সঠিক যে, অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমান দুনিয়া শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান ও বিজ্ঞানে ঈর্ষনীয় অগ্রগতি ও সফলতা লাভ করেছে। আবার সভ্য ও সুশীল বলে দাবিদার এ সভ্যতার মানুষের একাংশ কতটা নিকৃষ্ট ও বর্বর হতে পারে তাও কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করছি।
চলমান ঘটনাপ্রবাহ একটু গভীরভাবে অনুধাবন করলে আমরা ব্যথিত-নির্বাক হয়ে যাই। একদিকে চলছে মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নয়নের অবিশ্রান্ত প্রয়াস, আর অপর দিকে দেখা যাচ্ছে মানবতা দলনের ভয়ানক চিত্র। মানবিক মূল্যবোধ ও মানবতাকে ধ্বংস করার পশ্চিমা পরিকল্পনা ও মারণাস্ত্রের ঝলকানি আমাদের সকল চিন্তা-ভাবনা ও সফলতাকে ম্লান করে দিচ্ছে। মানুষের মৌলিক অধিকারের নামে সারাক্ষণ যারা বক্তৃতার খই ফুটাচ্ছে সেই পশ্চিমা শক্তি যখন গায়ের জোরে অন্যের দেশ ও সম্পদ দখলের প্রয়াস চালাচ্ছে তখন প্রশ্ন জাগে আমরা এ কোন মানবতার কথা বলছি?!!
গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শান্তির পতাকা উড়িয়ে পশ্চিমের দেশগুলো যখন আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, লেবানন, বসনিয়া, কাশ্মীর ও ইরাকসহ দুনিয়ার বিভিন্ন জনপদে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে, লুণ্ঠন চালায়, চালায় ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ, তখন প্রশ্ন জাগে এরা কোন মানবতা ও গণতন্ত্রের কথা বলছে!! সভ্যতার মুখোশধারী এই তথাকথিত দেশগুলো হচ্ছে আমেরিকা, ইসরাইল, ভারত ও ইউরোপভুক্ত দেশসমূহ। মানবতা ও সভ্যতার কথার আড়ালে তারা চালাচ্ছে অসভ্য আচরণ। বিশেষ করে এই উপমহাদেশে মুসলিম নিধনে মাতাল হয়ে উঠেছে গেরুয়া সন্ত্রাসী বাহিনী ভারত সরকার।
আজকের সভ্য দুনিয়ায় মানবতার কল্যাণ ও মানবাধিকার বিকাশের জন্য বহু সংস্থা, এমনকি জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক শয়তানি সংগঠনও নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। প্রায়শই আমরা এসব সংস্থা বা সংগঠনের পক্ষে পক্ষপাতমূলক এবং একপেশে আচরণের অভিযোগ লক্ষ করি। অভিযোগ রয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সবসময় শক্তির পক্ষে কাজ করে এবং বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা ছাড়া মানবতাকে আর কিছুই এই সংস্থা বা ফোরাম দিতে পারেনি। অথচ আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে মানবিক তৎপরতা প্রদর্শন করেছেন তার সামান্যতমও আজ কোথাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না একমাত্র মুজাহিদিনদের অধীনের এলাকাগুলো ছাড়া। বর্তমানে মানুষরূপী হায়েনারা দুনিয়ার দেশে দেশে অকাতরে মানুষ খুন করছে। আধুনিক মারণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর জন্য মানুষকে তার শিকারে পরিণত করছে। বিভিন্ন দেশ দখলের সময় মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে এরা মানুষকে ধরে পশুর মতো খুন করছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এরা নিরপরাধ শিশু-মহিলা ও পুরুষ যুদ্ধবন্দীদের পর্যন্ত নির্বিচারে হত্যা করছে। অথবা হাত-পা চোখ বেঁধে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখছে, কিংবা লোহার ছোট খাঁচায় বন্দী করে অনাহারে দিনের পর দিন ফেলে রাখছে। এ ধরনের আচরণ আমরা লক্ষ্য করছি চীনের উঁইঘুরে, প্রতিদিন লক্ষ্য করছি ফিলিস্তিনে। ইরাক, আফগানিস্তান, আরাকান, কাশ্মীর এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেও আমরা একই চিত্র দেখতে পাচ্ছি। মুসলিম বিশ্বের যেখানেই খ্রিষ্টান-ইহুদি লবির আগ্রাসন ও জবরদখল দেখা যায় সেখানেই মানবতা ও মানবিকতার চরম লঙ্ঘন লক্ষ্য করা যায়। এদের পশুশক্তি গোটা দুনিয়ার মানবিকতা ও সততাকে ছারখার করে দিয়েছে।
সিরিয়ায় লাখ লাখ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা, ফিলিস্তিনে যুগ যুগ ধরে অগণিত মানুষকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেয়া, কাশ্মীর, চেচনিয়া, আলজেরিয়া ও অন্যান্য অনেক দেশে নিরপরাধ মুসলিম শিশু-মহিলা ও অসহায়-নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা ও শোষণ আধুনিক সভ্যতার এক দুর্ভাগ্যজনক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাই মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সর্বত্র আজ প্রশ্ন উঠেছে সভ্যতা ও মানবাধিকার নিয়ে। পশ্চিমাদের এই বক্তৃতাসর্বস্ব মানবাধিকারের নাটক ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে চিন্তাশীল মানুষকে আজ ভাবিয়ে তুলছে। সত্যিকথা বলতে কি, ইসলামিক ইমারাহ ছাড়া প্রকৃত মানবাধিকার এখন কোথাও প্রতিষ্ঠিত নেই। ফলে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ আজ হাঁপিয়ে উঠেছে। তারা বর্তমান সভ্যতার পশুত্ব ও বর্বরতা থেকে মুক্তি পেতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছে। কিন্তু শান্তির পথ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একমাত্র ইসলাম ছাড়া কোন ধর্মমত, আদর্শ কিংবা মতবাদ মানুষকে স্থিতি ও স্বস্তির পথ দেখাতে পারবে না।
প্রিয় মুসলিম উম্মাহ!
আসুন সংক্ষেপে জেনে নিই, জুলুম নির্মূলে ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের নবী কি ভূমিকা পালন করেছেন।
মানবতার অগ্রদূত হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ার মানুষের জন্য পেশ করেছিলেন মানবতার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর ঐশী পথ একটি বর্বর, অজ্ঞ, হানাহানিতে লিপ্ত সমাজকে কিভাবে আলোর পথে পরিচালিত করেছিল তা সবারই জানা। তিনি মানবতা ও সুস্থ মানসিকতার এমন এক সমাজ কায়েম করেছিলেন, যা দুনিয়ার কোনো সময়ে মানুষ কখনও দেখেনি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর মানবতাবোধ ছিল আল্লাহর দেয়া উত্তম আদর্শসমৃদ্ধ।
ইসলামপূর্ব আরবে মনুষ্যত্ব ও মানবতা বলতে কিছুই ছিল না। মানুষে মানুষে মারামারি, হানাহানি ও যুদ্ধকলহ সেই সমাজের স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। সত্যিকথা বলতে কী, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আনীত ইসলাম সেই সমাজের ঘৃণিত ও বর্বর মানুষকে মানবতার উৎকর্ষে আলোকিত করেছিল। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বিরল মানবতাবোধ ও উদারতা দিয়ে একটি অসভ্য ও পশু সমাজকে সুখ-শান্তি, সাম্য ও ন্যায়পরায়ণতার মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে সফল হয়েছিলেন। তাঁর মানবতাবোধ যে কত সুউচ্চ ছিল তা অবলোকন করে এখনও অবিশ্বাসীরা হতবাক হয়ে যায়।
আমরা জানি, তিনি জীবনে বহু কষ্ট ও যন্ত্রণা সহ্য করেছেন, অত্যাচারিত ও অপমানিত হয়েছেন। তবুও তিনি কাউকে কোনো কটু কথা বলেননি। তাঁর চরম শত্রুকে হাতের কাছে পেয়েও তিনি তাকে হাসিমুখে ক্ষমা করে দিয়েছেন। মক্কার কুরাইশদের দ্বারা অত্যাচারিত ও অপমানিত হয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সময় মদিনায় হিজরত করেন। অথচ তিনি যখন মক্কা বিজয় করলেন তখন পলায়নরত শত্রুদের থেকে কোনো প্রতিশোধ নেননি নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ছাড়া, বরং তাদের নিঃশর্ত ক্ষমা করে দেন। মানবতার নবী সেদিন ঘোষণা করলেন, ‘আজকের দিনে তোমাদের কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই’।
মানুষের মর্যাদাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বললেন, ‘মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সে, যে মানুষের উপকার করে’। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষ ও মানুষের কল্যাণ নিয়ে যে কতটা আন্তরিক ও পেরেশান ছিলেন তা তাঁর কিশোর বয়সেও লক্ষ্য করা যায়। আরবের রক্তাক্ত ও খুনঝরা সমাজের অধঃগতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর মনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। তাই মানুষের মধ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি গঠন করেন হিলফুল ফুজুল সংগঠন। এই সংগঠনের মূল কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ:
১. সবাই মিলে দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা।
২. অত্যাচারীর হাত থেকে নিরীহ ও মজলুম মানুষকে রক্ষা করা ও জালিমদের দমন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করা।
৩. দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে যথাসম্ভব সহায়তা করা।
৪. বিদেশী লোকদের জান-মাল ও মান-সম্মান রক্ষার চেষ্টা করা।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর এই কর্মসূচি দুনিয়ার ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। অথচ মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামরিক অভিযানকালে নারী ও শিশুসহ যুদ্ধবন্দীদের সাথে আচরণের যে নজির স্থাপন করেছেন আজকের দুনিয়ায় তা সত্যিই বিরল। তিনি বলেছেন, ‘বন্দীদের সাথে সৌজন্যমূলক ব্যবহার করো।’
ইসলামের প্রথম জিহাদে মুসলমানদের বিজয়ের পর যেসব কাফের সৈন্য যুদ্ধবন্দী হয়েছিল তাদের প্রতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীরা যে অসাধারণ আচরণ করেছিলেন তা দুনিয়ার ইতিহাসে আর কোথাও দেখা যায়নি। সাহাবারা যুদ্ধ শেষ করে যখন মদিনায় ফিরে যাচ্ছিলেন তখন তাঁরা পায়ে হেঁটে গেলেন আর বন্দীদের উটের পিঠে আরোহণ করিয়ে নিয়ে গেলেন। তাঁরা বন্দীদের রুটি খেতে দিলেন আর নিজেরা খেলেন শুকনো খেজুর। কিন্তু আফসোস! আজ মুসলিম বন্ধীদের সাথে কি নির্মম আচরণ করা হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করাও অসম্ভব।
প্রিয় মুসলিম উম্মাহ!
পরিশেষে আমি বলব, জিহাদের মাধ্যমে ইসলামী খিলাফাহ কায়েম হওয়া ছাড়া মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই আসুন আমরা গাযওয়ায়ে হিন্দের কাফেলাভুক্ত হয়ে ইসলামী খিলাফাহ কায়েমের লক্ষ্যে সম্মুখ পানে এগিয়ে যাই। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সর্বক্ষেত্রে বিজয় দান করুন, আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين، وصلى الله على سيدنا محمد وآله وصحبه وسلم.
والسلام عليكم ورحمة الله وبركاته.
**********