বিদ্রোহকারী দল ও শরীয়াহ পালনে বাঁধা প্রদানকারী দলের বিধান – শাইখ হারেস বিন গাযী নাযারী রহ.
তারবিয়াহ
ইস্যু-৫ | ১৪৪১ হিজরি | ২০২০ ইংরেজি
বিষয়ঃ শরিয়তের আহকাম
বিদ্রোহকারী দল ও শরীয়াহ পালনে বাঁধা প্রদানকারী দলের বিধান – শাইখ হারেস বিন গাযী নাযারী রহ.
অনুবাদঃ মাওলানা জাকির আহমাদ
(তাওহীদ ও কিতাল দরস সিরিজ থেকে)
প্রকাশনায় : আল মালাহিম ফাউন্ডেশন
بسم الله الرحمن الرحيم
(فلولا نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفقهوا في الدين ولينذروا قومهم إذا رجعوا إليهم لعلهم يحذرون)
তাদের প্রত্যেক দলের এক অংশ কেন বের হয়না যাতে তারা দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং স্বীয় সম্প্রদায়কে ভীতিপ্রদর্শন করতে পারে, যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে, যাতে তারা সতর্ক হয়৷
(সূরা তাওবা, আয়াত ১২২)
(বিদ্রোহকারী দল ও শরীয়াহ পরিত্যাগকারী বা তা পালনে বিরত দলের বিধান)
السلام عليكم ورحمة الله وبركاته،
الحمد لله رب العالمين، اللهم صلّ على محمد وعلى آل محمد كما صليت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم، وبارك على محمد وعلى آل محمد كما باركت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم في العالمين إنك حميد مجيد. أما بعد،
গত দরসের আলোচনা ছিল মুসলমানদের এমন দল বা গোষ্ঠী সম্পর্কে যারা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলে এবং ঈমান ও ইসলামের কথা স্বীকার করে। তা সত্ত্বেও তাদের হত্যা বৈধ। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের হত্যা করা এবং তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা ওয়াজিব৷
এই দলটি যাদের সম্পর্কে আমরা গত দরসে কথা বললাম, তা ছিল – ‘যুদ্ধরত দল’৷
আজকের আলোচনা আরেকটি দল সম্পর্কে। এমন একটি দল যারা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলে, অথচ তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করা ওয়াজিব৷ এই দলটিই হল “বাগী” তথা বিদ্রোহী দল৷ বাগী শব্দটি “বাগয়ুন” শব্দমূল থেকে গঠিত৷ যার অর্থ, সীমালঙ্ঘন করা৷
বিদ্রোহকারী দল বলতে কী বুঝায়? কারা এই বিদ্রোহকারী?
ফকীহদের পরিভাষায় তারা হল ঐ সকল লোক যারা কোন শরয়ী শাসকের বিরুদ্ধে মনগড়া ব্যাখ্যার অজুহাতে বিদ্রোহ করে। সেইসাথে তাদের রয়েছে বিশেষ দাপট। অর্থাৎ সেখানে আমীরুল মু’মিনীন আছেন। শরয়ী আমীরুল মু’মিনীন। যিনি আল্লাহর আইন ও শাসন বাস্তবায়ন করেন। কুরআন ও সুন্নাহর বিধানাবলী বাস্তবায়নের দায়িত্বশীল যিনি। এমতাবস্থায় যে দল বা গোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চায়, তাঁকে হটাতে চায় কিংবা তাঁর শাসন ও আনুগত্য থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। শুধু তাই নয়, বরং এমন শরয়ী শাসককে হটানোর জন্য কিংবা তাঁর আনুগত্য থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য লড়াই করে। এমন দলকেই বিদ্রোহী দল বা বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করা হয়।
বিদ্রোহকারী দল ও যুদ্ধরত দলের মাঝে পার্থক্য কী?
যুদ্ধরত ব্যক্তি কোনরকম ব্যাখ্যাহীনভাবেই নিছক অবাধ্যতার বশবর্তী হয়ে শাসকের বিরুদ্ধে বের হয়ে আসে। যে পার্থিব স্বার্থে ধন-সম্পদের লিপ্সায় বের হয়। যে সম্পদ লুট করতে ও নিরপরাধ লোকজনকে খুন করতে চায়।
পক্ষান্তরে বিদ্রোহকারী হল ঐ ব্যক্তি, যে কোন যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যার আলোকে লড়াই করতে বের হয়। এভাবে সে কখনো খুন করে এবং সম্পদ লুট করে। কিন্তু যুদ্ধবাজ ব্যক্তি শুধুই দুনিয়াবী স্বার্থে বের হয়, অথচ বিদ্রোহী বের হয় শরয়ী বিভিন্ন বিধানাবলীর আলোকে যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যার ভিত্তিতে। যদিও সেসব ব্যাখ্যা সঠিক নয়, কিন্তু তার ধারণায় তা সঠিক। এবং এ ব্যাপারে তার কাছে নানা শরয়ী যুক্তিপ্রমাণও থাকে। একারণেই সে লড়াই করে। তো এমন লোক হল বিদ্রোহী। এমন লোকদের প্রসঙ্গেই আমরা এখন আলোচনা করবো।
এই বিদ্রোহকারী দলই শরয়ী শাসকের বিরুদ্ধে তাকে অপসারণ করতে নিরস্ত্র বা সশস্ত্র অবস্থায় বের হয়।
এই বিদ্রোহীদের বিধান কী?
যদি বিদ্রোহীদের কোনরকম প্রভাব প্রতিপত্তি, শক্তিমত্তা, দাপট এবং অস্ত্র-সস্ত্র না থাকে তবে শাসনকর্তার কর্তব্য হল তাদের গ্রেফতার করে বন্দি করে রাখা, যতক্ষণ না তারা তাওবা করে।
পক্ষান্তরে যদি তারা যুদ্ধ বা লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেয়, সেইসাথে যদি তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি ও অস্ত্র-সস্ত্র থাকে তাহলে শাসনকর্তা তাদেরকে তার আনুগত্য আঁকড়ে থাকার আহ্বান জানাবেন, তাদেরকে আদালতের ইনসাফ ও মুসলমানদের জামাতের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার আহ্বান জানাবেন। এরপর যদি তারা তা প্রত্যাখ্যান করে, তখন তিনি তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করতে থাকবেন যতক্ষণ না তাদের পরাস্ত করেন। তবে তারা যুদ্ধ শুরু করা পর্যন্ত ইমাম বা শাসনকর্তা প্রথমে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করবেন না। কেননা তাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা হল শুধু তাদের অনিষ্টতা দমনের স্বার্থে। এজন্য তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ভেগে পিছু হটবে তাকে হত্যা করা জায়েয হবেনা। এমনকি বিদ্রোহী দলের কেউ যদি বন্দী হয়ে আসে তবে তাদের বন্দীদের হত্যা করা যাবেনা। এবং তাদের কোন আহত ব্যক্তির উপর হামলে পড়ে তাকে হত্যা করা যাবেনা। এমনটাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকীহদের অভিমত।
এসকল বিধানের দলীল কী?
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-
وإن طائفتان من المؤمنين اقتتلوا فأصلحوا بينهما فإن بغت إحداهما على الأخرى فقاتلوا التي تبغي حتى تفيئ إلى أمر الله، فإن فاءت فأصلحوا بينهما بالعدل وأقسطوا إن الله يحب المقسطين
যদি মুমিনদের দু’দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর চড়াও হয়, তবে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করবে; যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি ফিরে আসে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়ানুগ পন্থায় মীমাংসা করে দিবে এবং ইনসাফ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন। (সূরা হুজরাত – ৯)
তো আল্লাহপাক এখানে তাদেরকে দু’টি মুমিন দল হিসেবে অভিহিত করেছেন। এটিও মুমিন দল, সেটিও মুমিন দল। কিন্তু এরা শরয়ী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। পক্ষান্তরে মুরতাদ শাসক, সে তো মূলত শাসকই নয়; বরং তাকে কতল করা ওয়াজিব। তাকে শাসনক্ষমতা থেকে অপসারণ করা এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ওয়াজিব।
কিন্তু আমরা কার সম্পর্কে কথা বলছি?
আমরা কথা বলছি শরয়ী শাসকের ব্যাপারে। তো কোথাও যদি কোন শরয়ী শাসক থাকে আর সেখানে কোন দল বা গোষ্ঠী তাঁকে অপসারণ করতে বা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে আসে তাহলে এই বিদ্রোহী দলের সাথে আমরা আপোষ মীমাংসা করার চেষ্টা করবো। কিন্তু তারা যদি মীমাংসা করতে, কল্যাণের আহ্বানে সাড়া দিতে এবং মুসলিমদের জামাতে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায় তবে আমরা বিদ্রোহকারী দলটির বিরুদ্ধে কিতাল করবো, যতক্ষণ না তারা শরয়ী শাসনকে আবশ্যকীয়ভাবে মেনে নেয়।
বিদ্রোহকারী দল যেহেতু অনেক মানুষ হত্যা করে এবং তাদের ধনসম্পদ লুটপাট করে, তো তাদের উপর কর্তৃত্ব লাভ হবার পর এবং পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবার পর কি আমরা তাদের বিরুদ্ধে নিহতদের প্রাণের কিসাসের ফায়সালা করবো? এবং আত্মসাৎকৃত ধনসম্পদের জরিমানা আরোপ করবো? এই ব্যাপারে আমরা বলবো, তোমরা যেহেতু অমুকের অমুকের এত এত সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছো, তাই আমরা তোমাদের থেকে সেই সকল আত্মসাৎকৃত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানাবো। এবং তোমরা যেহেতু অমুক অমুককে খুন করেছো, তাই আমরা এখন তাদের ব্যাপারে কিসাসের দাবি করবো, এবং ঐ সকল নিরপরাধ লোকদের খুন করার বদলায় আমরা তোমাদের হত্যা করবো।
তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকীহদের মতে ব্যাখ্যা অবলম্বনকারী বিদ্রোহকারীরা তাদের লড়াইয়ে জানমালের যে ক্ষতিসাধন করেছে এতে তাদের কোন জরিমানা হবেনা।
এর দলিল হল, ইমাম যুহরী রহ.যা বর্ণনা করেছেন-তিনি বলেন, মানুষের মাঝে বিরাট এক ফিতনা হয়েছিল। যাতে বদরী সাহাবীগণও ছিলেন। তখন সাহাবাদের মাঝে এই বিষয়ে ইজমা বা ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, যে ব্যক্তি কুরআনের আয়াতে তাবীল করে বা ব্যাখ্যাসাপেক্ষে হারাম যৌনাঙ্গকে হালাল করে তার উপর হদ (যিনার অপরাধে শরয়ী দণ্ড) কায়েম করা হবেনা। এবং যে ব্যক্তি কুরআনের আয়াতে তাবীল করে হারাম রক্ত (যা প্রবাহিত করা হারাম) প্রবাহিত করে তাকে হত্যা করা হবেনা। একইভাবে যে ব্যক্তি কুরআনের আয়াতে তাবীল করে ধনসম্পদের ক্ষতিসাধন করে তার জরিমানা হবেনা। এটি ইমাম যুহরী রহ.বর্ণনা করেছেন। আর এটাই ইজমাঈ’ তথা সর্বসম্মত মাসআলা যে, তারা জানমালের যে ক্ষয়ক্ষতি করবে তাতে তাদের কোন জরিমানা হবেনা।
এই বিদ্রোহীদের সাথে লড়াই আর মুশরিকদের সাথে লড়াইয়ের মাঝে পার্থক্য কী?
ইমাম কারাফী রহ.তাঁর “মাজমূ’আতুল ফুরূক” গ্রন্থে বিদ্রোহকারীদের সাথে লড়াই এবং কাফের-মুশরিকদের সাথে লড়াইয়ের মধ্যকার এগারোটি পার্থক্যের কথা তুলে ধরেছেন।
তন্মধ্যে একটি হলো, বিদ্রোহকারীদের সাথে লড়াইয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের ভড়কে দেয়া; তাদের নির্মূল বা হত্যা করা নয়।
দ্বিতীয়টি হলো, তাদের মধ্য হতে যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়নকারী ব্যক্তিকে ছাড় দেয়া হবে, তার পিছু লাগা যাবেনা।
তৃতীয়, তাদের আহত ব্যক্তির উপর হামলে পড়ে তাকে হত্যা করা যাবেনা।
চতুর্থ, তাদের বন্দীদের হত্যা করা হবেনা।
পঞ্চম, তাদের ধনসম্পদ গনীমত হিসেবে গ্রহণ করা যাবেনা। সুতরাং বুঝা গেল, তাদের ধনসম্পদের মধ্যে থেকে যা আমাদের হাতে আসবে সব তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে, এগুলো গনীমত নয়।
ষষ্ঠ, তাদের স্ত্রী, পরিবার-পরিজনদের দাসদাসী হিসেবে গ্রহণ করা হবেনা।
সপ্তম, তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোন মুশরিকের সহায়তা গ্রহণ করা যাবেনা। অর্থাৎ আমরা কাফের-মুশরিকদের কাছে গিয়ে একথা বলতে পারবোনা যে, এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী আমাদের শরয়ী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, সুতরাং এসো, আমাদের সাথে এই মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করো। এটা জায়েয নেই।
অষ্টম, তাদের সাথে অর্থের বিনিময়ে কোন চুক্তি করবোনা। মৌখিকভাবে যা কথা হবে তাই যথেষ্ট। তাদের আর আমাদের মাঝে সন্ধি হবে। কোন সম্পদের মুকাবেলায় তদ্রূপ সম্পদ।
নবম, তাদের বিরুদ্ধে কোন ক্ষেপণাস্ত্র ইত্যাদি স্থাপন করা যাবেনা।
দশম, তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা যাবেনা। এবং তাদের গাছপালা কাটা যাবেনা।
এই হল ইমাম কারাফী তাঁর “ফুরূক” কিতাবে ‘বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধ এবং মুশরিকদের সাথে যুদ্ধের মাঝে পার্থক্য’ অনুচ্ছেদে যা উল্লেখ করেছেন তার সারসংক্ষেপ।
শেষোক্ত দলঃ কিছু দল এমন আছে যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা ওয়াজিব, অথচ তারা মুসলমান। তারা লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ বলে। সেগুলো হল- যুদ্ধরত দল, বিদ্রোহীদের দল। এখন আলোচনা হবে তৃতীয় দলটির, আর তা হল, শরীয়াহ পালনে বিরত বা তা পরিত্যাগকারী দল।
শরীয়াহ পরিত্যাগকারী বা তা পালনে বিরত দল লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা হবে।
বিরত থাকা বলতে কী বুঝায়?
আলোচনার শুরুদিকে এর ব্যাখ্যা হয়ে গেছে যে, বিরত থাকা বলতে দু’টি বিষয় বুঝায়ঃ
প্রথম অর্থঃ আংশিকভাবে বা সামগ্রিকভাবে শরীয়াহ অনুযায়ী আমল করতে বিরত থাকা।
দ্বিতীয় অর্থঃ মুসলমানদের শাসকের ক্ষমতা প্রয়োগে বিরত থাকা। অর্থাৎ তিনি অন্যায় কাজ বন্ধ করতে বা সেই বিষয়ে কৈফিয়ত তলবে বিরত থাকা।
গতবার আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম তা ছিল শাসকের এই ক্ষমতা প্রয়োগে বিরত থাকা নিয়ে। এবারের আলোচনা হলো প্রথম দলটি সম্পর্কে। অর্থাৎ যে দলটি আংশিক বা সামগ্রিকভাবে শরীয়াহ অনুযায়ী আমল থেকে বিরত থাকে।
এই দলের বিরুদ্ধে কিতালের ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম সর্বসম্মতিক্রমে একমত। এটি একটি ইজমায়ী’ মাসআলা বা সর্বসম্মতিক্রমে ঐক্যমত্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত যে, শরীয়াহ পালনে বিরত দল- যারা শরীয়তের বিধান পালনে এবং শরীয়তের সিদ্ধান্ত আংশিকভাবে কিংবা সামগ্রিকভাবে মেনে নিতে বিরত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সর্বসম্মতিক্রমে জিহাদ-কিতাল ওয়াজিব।
এই ব্যাপারে ইজমা’ (তথা সাহাবায়ে কেরামের ঐক্যমত্য সিদ্ধান্ত) যারা বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ. অন্যতম। যেমনটি তাঁর ফতওয়া সমগ্র ২৮ তম খণ্ডে আছে- “শরীয়তের ধারাবাহিক সূত্রে বর্ণিত সুস্পষ্ট বিধানাবলীর মধ্য থেকে কোন বিধান আবশ্যকীয়ভাবে পালনে বিরত যেকোন দলের বিরুদ্ধে কিতাল করা ওয়াজিব, যতক্ষণ না তারা শরীয়তকে আবশ্যকীয়ভাবে গ্রহণ করে। যদিও তারা শাহাদাতাইন স্বীকার করে ( তবুও তাদের বিরুদ্ধে কিতাল ওয়াজিব। অর্থাৎ অনেক সময়ে মানুষ কালেমা স্বীকার করে নেয়ার পরও যাকাত, জিহাদ কিংবা অন্যকোন শরয়ী বিধান পালনে বিরত থাকে, তো সেক্ষেত্রে তার কালেমা পড়ে নেয়াটা তাকে হত্যা থেকে সুরক্ষা দিতে পারেনা। ) যদিও তারা কালেমা পড়ে, যদিও তারা শরীয়তের কিছু কিছু বিধান আবশ্যকীয়ভাবে পালন করে। যেমন, হযরত আবু বকর রা. এবং সাহাবায়ে কেরাম রা. যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারীদের বিরুদ্ধে কিতাল করেছিলেন। এ ঘটনার ভিত্তিতে ফুকাহায়ে কেরাম এ বিধানের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। এবং হযরত উমর রা. হযরত আবু বকর রা. এর সাথে এ বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের পর সাহাবায়ে কেরাম রা. কুরআন-সুন্নাহর দলিলের ভিত্তিতে ইসলামের বিধিবিধান পালন না করার ক্ষেত্রেও কিতালের ব্যাপারে একমত হয়েছেন”।
অতঃপর ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বলেন, এভাবে খারেজীদের ব্যাপারে নবী করীম সা. এর বিভিন্ন হাদিস দ্বারা এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়। তিনি তাদের ব্যাপারে বলেছেন, তারা সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব, সেইসাথে এও বলেছেন যে, তাদের নামাযের সামনে তোমরা নিজেদের নামাযকে তুচ্ছ মনে করবে এবং তাদের রোযার সামনে তোমরা নিজেদের রোযাকে তুচ্ছ মনে করবে।
অতএব বুঝা গেল, ইসলামী শরীয়তের বিধানাবলী আবশ্যকীয়ভাবে গ্রহণ করা ছাড়া শুধু ইসলাম আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে হত্যা থেকে ক্ষমা পাওয়া যাবেনা। বরং এমন ব্যক্তিকে হত্যা করা হবে এবং তার বিরুদ্ধে কিতাল করা হবে। সুতরাং কিতাল ওয়াজিব যতক্ষণ না দ্বীন পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত হয় এবং যতক্ষণ না আর কোন ফিতনা না থাকে। অতএব যখন দ্বীন গাইরুল্লাহর জন্য হবে তখন কিতাল ওয়াজিব হবে। যেকোন দল ও গোষ্ঠী যদি কিছু ফরয নামায, রোযা অথবা হজ্ব থেকে বিরত থাকে কিংবা অন্যের ধনসম্পদ, মদ, যিনা এবং জুয়া কিংবা রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজনদের সাথে বিবাহে আবদ্ধ হওয়া আবশ্যকীয়ভাবে হারাম মনে না করে অথবা কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা বা আহলে কিতাবের উপর জিযিয়া কর আরোপ করা ইত্যাদি দ্বীনের এমন অপরিহার্য বিধান সমূহকে এবং তার এমন হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর হারাম হওয়াটা আবশ্যকীয়ভাবে গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে যেগুলো অস্বীকারের বা বর্জনের ব্যাপারে কারো কোনরূপ ওজর চলেনা, যেগুলো ওয়াজিব হওয়া অস্বীকারকারীকে কাফের সাব্যস্ত করা হয় তো এ রকম দল ও গোষ্ঠী শরীয়ত পরিত্যাগকারী বা তা পালনে বিরত দলের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর শরীয়াহ পরিত্যাগকারী দলের বিরুদ্ধে তাদের এ অপরাধের দায়ে কিতাল করা হবে, যদিও তারা সেসকল বিধানাবলী স্বীকার করুক এবং বিশ্বাস করুক।
তিনি (ইবনে তাইমিয়াহ রহ.) বলেন, এটা এমন মাসআলা যে ব্যাপারে আমি উলামাদের মাঝে কোন রকম মতভেদ দেখিনি। -মাজমূউল ফাতাওয়া, ২৮ তম খণ্ড
তিনি আরো বলেন, এমন যেকোন দল যা ইসলামের ধারাবাহিক পরম্পরায় বর্ণিত সুস্পষ্ট বিধানাবলীর মধ্য থেকে কোন একটি বিধান থেকে বেরিয়ে যায় তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সকল ইমামদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কিতাল ওয়াজিব। যদিও তারা কালেমা স্বীকার করুক।
তিনি বলেন, যদিও সেই দল কালেমা স্বীকার করুক, যদি তারা কালেমার কথা স্বীকার করে এরপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায থেকে বিরত থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কিতাল ওয়াজিব যতক্ষণ না তারা নামায পড়া শুরু করে। যদি তারা যাকাত থেকে বিরত থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে কিতাল ওয়াজিব যতক্ষণ না তারা যাকাত আদায় করে। এভাবে যদি তারা রমযানের রোযা অথবা বাইতুল্লাহর হজ্ব থেকে বিরত থাকে, কিংবা তারা যদি অশ্লীল কাজকর্ম হারাম মনে করা থেকে বিরত থাকে, অথবা যিনা-ব্যভিচার কিংবা জুয়া বা মদ অথবা শরীয়তের অন্যান্য হারাম জিনিস হারাম মনে করা থেকে বিরত থাকে, এভাবে যদি তারা মানুষের জানমাল, রক্ত, সম্পদ এবং ইজ্জত-আব্রুর ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী ফায়সালা করা থেকে বিরত থাকে (যেমন তারা এসব ক্ষেত্রে যদি সাধারণ আইন ইত্যাদি দ্বারা ফায়সালার প্রবক্তা হয়) এমনিভাবে যদি তারা সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ থেকে এবং এসব ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকে, অথবা তারা যদি কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা থেকে বিরত থাকে- যতক্ষণ না তারা বশ্যতা স্বীকার করে স্বহস্তে অপদস্থতার সাথে জিজিয়া প্রদান করে, এভাবে যদি তারা কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফে সালেহীন এবং মুজতাহিদ ইমামদের রায় বিরোধী বিদ’আত চালু করে তাহলেও এদের সকলের বিরুদ্ধে কিতাল ওয়াজিব। অতঃপর তিনি (ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ.) আল্লাহপাকের এই আয়াত দ্বারা তার উপরোক্ত বক্তব্যের দলীল পেশ করেন-
وقاتلوهم حتى لا تكون فتنة ويكون الدين كله لله
অর্থাৎ তোমরা তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করতে থাকো, যাতে কোন ফিতনা আর না থাকে এবং দ্বীন পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। (সূরা আনফাল আয়াত ৩৯)
অতএব যদি দ্বীন আংশিক হয় আল্লাহর জন্য, আর আংশিক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য তাহলেই কিতাল ওয়াজিব হবে যতক্ষণ না পুরো দ্বীন আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। (মাজমূউল ফাতাওয়া দ্রষ্টব্য)
অর্থাৎ অবস্থা যদি এই হয় যে, কিছু বিষয়ে শরীয়ত কার্যকর হয় আর কিছু বিষয়ে অকার্যকর। যেমন, সুদের বৈধতা দেয়া কিংবা উপরোল্লিখিত কোন হারাম বিষয়ের বৈধতা দেয়া তাহলেই সেখানে কিতাল ওয়াজিব হবে, যতক্ষণ না যাবতীয় বিষয়াদি এক আল্লাহর শরীয়তের অধীনে হয়ে যায়। অতএব, কিতাল হলো শরীয়তের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য।
এই যে শরীয়ত পালনে বিরত দলটির বিরুদ্ধে কিতাল করা হবে যদিও তারা কালেমা স্বীকার করুক, এটা কেন? এটা এজন্য যাতে আল্লাহর কালেমা-ই হয় চির উন্নত।
আমরা আল্লাহর কাছে কামনা করি, তিনি যেন আমাদের তাঁর হুকুম মেনে চলার তাওফিক দান করেন এবং তার নাফরমানীর কাজগুলোকে আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশক্তিমান।
ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
পরিশেষে আল মালাহিম মিডিয়া প্রকাশনা সংস্থায় দায়িত্বরত আপনাদের ভাইদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন।
****************