মুসলিম হেঁ হাম ওয়াতান হ্যায় সারা জাহাঁ হামারা— ২
যাবত না গোটা পৃথিবী আল্লাহ তাআলার শাসনব্যবস্থার অধীনে আসবে, সে অব্দি পৃথিবী দু’ভাগে বিভক্ত থাকবে— দারুল ইসলাম এবং দারুল হারব। মুসলিম উম্মাহর স্বদেশ প্রকৃত অর্থে হলো এই দারুল ইসলাম। আর রূপক অর্থে গোটা পৃথিবীই হলো তার স্বদেশ। যেহেতু আল্লাহ তাআলা এই উম্মাহর ওপর গোটা পৃথিবীতে ইসলামকে বিজয়ী করা ফরজ করে দিয়েছেন। মুসলিম যেখানেই থাক এবং যে দেশের নাগরিকত্বই বহন করুক, তার প্রকৃত স্বদেশ হলো দারুল ইসলাম।
মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের একমাত্র ভিত্তি হলো আকিদা; জাতিয়তাবাদ বা অন্য কিছু নয়। এজন্যই তো যারা ভূমিকে আকিদার ওপর প্রাধান্য দেয়, তাদের সমালোচনা করে আল্লাহ বলছেন— “আমি যদি তাদের ওপর ফরজ করে দিতাম যে, তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করে ফেলো বা তোমাদের ‘দার’ হতে বেরিয়ে পড়ো, তবে অল্পসংখ্যক লোক ছাড়া তারা তা করতো না। তাদেরকে যে বিষয়ে উপদেশ দেয়া হচ্ছে, তারা যদি তা পালন করতো, তবে তাদের পক্ষে তা বড়ই কল্যাণকর হতো এবং তা তাদে অন্তরে অবিচলতা সৃষ্টিতে অত্যন্ত সহায়ক হতো। {সুরা নিসা: ৬৬}
দারুল হারব দু’ভাগে বিভক্ত—
১. এমন দারুল হারব, যার সঙ্গে মুসলমানদের চুক্তি রয়েছে। এ ধরনের দারুল হারবকে ‘দারুল আহ্দ’ বা ‘দারুল আমান’ও বলা হয়।
২. এমন দারুল হারব, যার সঙ্গে মুসলমানদের কোনো চুক্তি নেই। এমন দারুল হারবকে ‘দারুল খাওফ’ও বলা যায়।
দারুল ইসলাম পাঁচ ভাগে বিভক্ত—
১. দারুল আদ্ল: এমন ভূখণ্ড, যেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত এবং সুন্নাহ সুসংরক্ষিত। যার নেতৃত্বে ও পরিচালনায় রয়েছে মুসলমানদের শরয়ি খলিফা।
২. দারুল বাগ্য়ি: এমন ভূখণ্ড, যেখানে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীদের (খারেজিদের) শাসনক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত, যদিও তারা ইসলামি আইন-কানুন অনুযায়ী শাসনকার্য ও বিচারকার্য পরিচালনা করে।
৩. দারুল বিদআহ: এমন ভূখণ্ড, যেখানে বিদআতিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত এবং যার সর্বত্র বিদআহ প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত।
৪. দারুর রিদ্দাহ: এমন ভূখণ্ড, যেখানকার অধিবাসীরা মুরতাদ হয়ে গেছে অথবা মুরতাদরা যে ভূখণ্ডকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে অথবা যার অধিবাসীরা পূর্ব থেকেই কাফির ছিলো, কিন্তু পরবর্তীতে তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে এবং সেই ভূখণ্ড্র ওপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে।
৫. আদদারুল মাসলুবাহ: দারুল ইসলামের বাইরে অবস্থানকারী কাফিররা আক্রমণ করে দারুল ইসলামের যে ভূখণ্ডকে নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে এবং সেখানে নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতানুযায়ী উপরিউক্ত পাঁচও প্রকারই দারুল ইসলামের অন্তর্ভুক্ত। যতোক্ষণ না তাতে তিনটি শর্ত পাওয়া যাবে, তা দারুল ইসলাম হিসেবেই বিবেচিত হবে। তবে কোনো অবস্থায়ই এর অর্থ এ নয় যে, মুসলমানদের ওপর সেই ভূখণ্ডগুলোকে পুনরুদ্ধার করে পুনরায় তাতে শতভাগ পরিপূর্ণ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা ফরজ নয়। বরং এটা তো কেবল পারিভাষিক নামকরণ নিয়ে মতভিন্নতা; অন্যথায় হুকুমের ক্ষেত্রে এমন ভূখণ্ডে লড়াইয়ের নিষিদ্ধতার কথা তিনি কোথাও বলেননি।
পক্ষান্তরে সাহিবাইন তথা ইমাম আবু ইউসুফ এবং ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর মতে কেবল একটি শর্ত পাওয়া গেলেই দারুল ইসলাম দারুল হারবে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আর তা হলো, কুফরি শাসনের প্রতিষ্ঠা। পরবর্তী অসংখ্য মুহাক্কিক ফকিহ এই মতকেই শক্তিশালী করেছেনে এবং এটাকেই কিয়াসের দাবি বলে অভিহিত করেছেন। শায়খ সাঈদ হাওয়ি বলেন, সাহিবাইনের মতের আলোকে বর্তমান পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রকেই আমরা দারুল ইসলাম হিসেবে বিবেচনা করতে পারি না। হাঁ, অত্যন্ত শিথিলতার ভিত্তিতে কোথাও মুসলিম বিশ্বের সামান্য কোনো অংশকে তার অধীন গণ্য করা হলে তা ভিন্ন কথা।
তবে সর্বাবস্থায় মুসলিম যে ভূখণ্ডকে তার ‘আলওয়ালা’ দেবে এবং যেটাকে সে নিজের স্বদেশ হিসেবে বিবেচনা করবে, তা হলো দারুল ইসলামের প্রথম প্রকার তথা দারুল আদ্ল।
যদি বাস্তবতা এমনই হয় যে, কোথাও দারুল আদ্ল নেই, যেহেতু কোথাও ইসলামি খিলাফাতব্যবস্থা নেই, ইসলামি শরিয়াহর শাসন প্রতিষ্ঠিত নেই, আর মানুষেরাও নিজেদের ওপর রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামি শরিয়াহ অবধারিত করে নেয়নি, তাহলে ইমাম আবু হানিফার ভাষ্যানুযায়ীও গোটা পৃথিবী ‘দারুর রিদ্দাহ’, ‘দারুল বিদআহ’ কিবা ‘দারুল ফিসকে’ পরিণত হয়ে গেছে। আর এমতাবস্থায় সকল মুসলমানের ওপর, বিশেষত ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদে’র ওপর দারুল ইসলামের ভূমিগুলোকে দারুল আদ্লে পরিণত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা-প্রচেষ্টা ব্যয় করা ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিন, এমনকি এক মুহূর্তও গোটা উম্মাহর জন্য এর থেকে উদাসীন হওয়া কোনো অবস্থায়ই বৈধ নয়।
দারুল আদ্ল যখন বিলুপ্ত থাকে, তখন মুসলিম উম্মাহর ওপর ইমানের পর প্রথম ফারিযাই হলো, দারুল আদ্লের প্রতিষ্ঠা, আর খিলাফাতব্যবস্থা ছাড়া কখনো দারুল আদ্ল প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, আর এরপর দারুল ইসলামের অন্যান্য অঞ্চলগুলোকেও দারুল আদ্লের আওতাভুক্ত করার জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম ব্যয় করা। এজন্য সাধ্যানুসারে মুরতাদ, জালিম এবং বিদআতি শাসকদেরকে উৎখাত করা ও কুফফার শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে ‘আদদারুল মাসলুবাহ’কে স্বাধীন করা তাদের দায়িত্ব। এরপর তারা দাওয়াতের বাণী নিয়ে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং দাওয়াতের শেষ বাহন হিসেবে কিতালকেও মানহাজ বানাবে। যাতে গোটা পৃথিবী আল্লাহর আইনের সামনে নতি স্বীকার করে এবং লুণ্ঠনকারীদের হাত থেকে পৃথিবী মুক্তি লাভ করে।