ফাতাওয়া-ফারায়েজবই ও রিসালাহ

সংশয়–৪: খিলাফা আলা মিনহাযিন নুবুওয়া ছাড়া জিহাদ করা যায় কিনা?

সংশয়–৪: খিলাফা আলা মিনহাযিন নুবুওয়া ছাড়া জিহাদ করা যায় কিনা?

—————-
প্রথমতঃ এটা নিশ্চিত যে, কোন শাসন ব্যবস্থাকে খিলাফা আলা মিনহাযিন নুবুওয়া বা নবুয়্যতী আদলের খিলাফত হিসাবে গন্য করতে হলে সেটির বহু সংখক গুণ বর্তমান থাকতে হবে। খুলাফায়ে রাশেদার শাসন আমলে যেসব নীতিমালার আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হতো সেগুলোকে অনুসরণ করতে হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওফাতের পর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিমরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে রাজত্ব করেছে কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ের অতি অল্প অংশকেই সঠিক অর্থে নবুয়্যতী আদলের খিলাফত (خلافة علي منهاج النبوة) হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

الخلافة بعدي ثلاثون سنة ثم تكون ملكا
আমার পর আমার উম্মতের মধ্যে খিলাফত থাকবে ত্রিশ বছর, পরে রাজতন্ত্র শুরু হবে। (ইবনে হিব্বান, শুয়াইব আল-আরনাউত সহীহ বলেছেন, আলবানী জামি’ আস-সগীরে সহীহ বলেছেন/৫৬৫২)
একই ধরনের হাদীস আবু দাউদ ও মিশকাতে বর্ণিত আছে।

এই সকল হাদীসের শেষে উল্লেখ আছে যে রাবী আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী (রাঃ) এই চার খলীফার শাসনকাল গননা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। মুয়াবিয়া (রাঃ) একজন সাহাবী হওয়া সত্বেও তাঁর সময়কে একদিকে যেমন খিলাফা আলা মিনহাজিন নুবুয়্যা বা নবুয়্যতের আদর্শে খিলাফত বলা হয়না তেমনি তাকে খুলাফায়ে রাশেদার মধ্যেও গন্য করা হয়না। তাঁর পরবর্তী উমাইয়া শাসকদের অবস্থা আরো শোচনীয়। তবে উমর ইবনে আব্দুল আজীজকে পঞ্চম খলীফা এ রাশেদা মনে করা হয়। বহু সংখ্যক সাহাবী খুলাফায়ে রাশেদার পরবর্তী যুগ তথা উমাইয়া শাসন আমল পেয়েছেন, তাঁরা সেসময় ঐসকল খলীফাদের অধীনে জিহাদ করেছেন। শুধু এতদূরই নয় বরং স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসান ইবনে আলী (রাঃ) এর উদ্দেশ্যে বলেন,

إن ابني هذا سيد ولعل الله أن يصلح به بين فئتين عظيمتين من المسلمين
আমার এই ছেলে একজন নেতা। আল্লাহ এর মাধ্যমে মুসলিমদের দু’টি বড় দলের মধ্যে সন্ধি ঘটাবেন। (সহীহ বুখারী)

এই কথাটি একটি লম্বা হাদীসের অংশ যেখানে বলা হয়েছে আলী (রাঃ) এর মৃত্যুর পর যখন হাসান (রাঃ) খলীফা হলেন তখন এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর সাথে যুদ্ধের জন্য রওনা হলেন। মুয়াবিয়া (রাঃ) যুদ্ধের পরিনাম অনুভব করতে পারলেন। তিনি হাসান (রাঃ) এর নিকট সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে দু’জন লোক পাঠালেন। হাসান (রাঃ) সন্ধিতে রাজি হয়েছিলেন। হাদীসে এই ঘটনা সম্পর্কেই ভবিষ্যৎ বানী করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ঘটনাকে প্রশংসা করেছেন অথচ এই ঘটনার মাধ্যমে সমগ্র মুসলিম জাহানে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, পরিপূর্ণ নবুয়্যতী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত না হলেও কোনো শাসনব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে কল্যাণকর হতে পারে। যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসান (রাঃ) এর পক্ষ থেকে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর হাতে বায়াত হওয়াকে (إصلاح) বা সংশোধন ও কল্যাণ হিসাবে গণ্য করেছেন। অথচ সহীহ হাদীস দ্বারাই প্রমানিত যে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর শাসনকাল খিলাফত আলা মিনহাযিন নুবুওয়া বা পরিপূর্ণভাবে নবুয়্যতী আদর্শের খিলাফত নয়। আমাদের উদ্দেশ্য হলো এটা দেখানো যে, কোনো শাসন ব্যবস্থা পরিপূর্ণ নবুয়্যতী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত না হলেও তুলনামূলকভাবে উত্তম ও কল্যাণময় হিসাবে গন্য হতে পারে, যদি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয় এবং উক্ত শাসকের নেতৃত্বে কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করে মুসলিম উম্মাহকে নিরাপত্তা দেওয়া যায়।

দ্বিতীয়তঃ সহীহ মুসলিম থেকে জানা যায়,

أَرَأَيْتَ إِنْ قَامَتْ عَلَيْنَا أُمَرَاءُ يَسْأَلُونَا حَقَّهُمْ وَيَمْنَعُونَا حَقَّنَا، فَمَا تَأْمُرُنَا؟ فَأَعْرَضَ عَنْهُ، ثُمَّ سَأَلَهُ، فَأَعْرَضَ عَنْهُ، ثُمَّ سَأَلَهُ فِي الثَّانِيَةِ أَوْ فِي الثَّالِثَةِ، فَجَذَبَهُ الْأَشْعَثُ بْنُ قَيْسٍ، وَقَالَ: «اسْمَعُوا وَأَطِيعُوا، فَإِنَّمَا عَلَيْهِمْ مَا حُمِّلُوا، وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُمْ
যদি আমাদের উপর এমন নেতারা কর্তৃত্ব পায় যারা আমাদের থেকে তাদের পাওনা আদায় করে কিন্তু আমাদের হক আদায় করে না, তবে আপনি আমাদের কি করতে আদেশ করেন? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুখ ফিরিয়ে নিলেন। প্রশ্নটি দুইবার বা তিনবার করা হলে তিনি বললেন, তাদের কথা শোনো এবং তাদের আনুগত্য করো, কেননা তাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে তাদের প্রশ্ন করা হবে এবং তোমাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে তোমাদের প্রশ্ন করা হবে। (সহীহ মুসলিম)

এখানে জালিম আমীর ওমারাদের কথা বলা হচ্ছে। এরা কখনও খুলাফায়ে রাশেদা খেতাব পেতে পারে না, এদের শাসন পদ্ধতিকে নবুয়্যতী আদলের খিলাফত বা খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নুবুওয়া বলা যায় না, তবু এদের আনুগত্য করতে বলা হচ্ছে। আর এখানে আনুগত্য অর্থ হলো শুধুমাত্র ভাল কাজে আনুগত্য যেহেতু অন্য হাদীসে বলা হয়েছে,

لا طاعة لمخلوق في معصية الخالق
স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোনো আনুগত্য নেই। (মিশকাত)

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) যখন আমীরের আনুগত্য সংক্রান্ত – হাদীসটি বললেন তখন একজন বলল,

هَذَا ابْنُ عَمِّكَ مُعَاوِيَةُ، يَأْمُرُنَا أَنْ نَأْكُلَ أَمْوَالَنَا بَيْنَنَا بِالْبَاطِلِ، وَنَقْتُلَ أَنْفُسَنَا، وَاللهُ يَقُولُ: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا}
এই যে তোমার চাচাতো ভাই মুয়াবিয়া আমাদের একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষন করতে এবং পরস্পরকে হত্যা করতে আদেশ করে, অথচ আল্লাহ বলেনঃ ‘হে ঈমানদাররা তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষন করো না তবে উভয়ের সম্পত্তিতে বেচা-কেনা হলে ভিন্ন কথা। আর নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর দয়ালু।’

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বললেন,

أَطِعْهُ فِي طَاعَةِ اللهِ، وَاعْصِهِ فِي مَعْصِيَةِ اللهِ
আল্লাহর আনুগত্যের বিষয়ে তার আনুগত্য করো, আর সে আল্লাহর অবাধ্য হবার আদেশ দিলে তার অবাধ্য হও। (সহীহ মুসলিম)

সুতরাং জালিম আমীর ওমারাদের সঠিক অর্থে খলীফা বা অন্তত খলীফা এ রাশেদ বলা যায়না, তাদের শাসন ব্যবস্থাকে নবুয়্যতী আদলের খিলাফত বলা যায়না, কিন্তু তবু সৎকাজে তাদের আনুগত্য করে যেতে হবে। যেহেতু জিহাদ একটি সৎকাজ, সে কারণে এসকল নেতার নেতৃত্বে জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে। অন্য একটি হাদীসে এসেছে,

وَالْجِهَادُ مَاضٍ مُنْذُ بَعَثَنِي اللَّهُ إِلَى أَنْ يُقَاتِلَ آخِرُ أُمَّتِي الدَّجَّالَ لَا يُبْطِلُهُ جَوْرُ جَائِرٍ، وَلَا عَدْلُ عَادِل
যেদিন থেকে আল্লাহ আমাকে প্রেরণ করেছেন সেদিন থেকে আমার উম্মতের শেষ দলটি দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ না করা পর্যন্ত জিহাদ চলতে থাকবে। কোনো জালিমের জুলুম বা কোনো নেক ব্যক্তির ন্যায়-নিষ্ঠতা একে বন্ধ করতে পারবে না। (আবু দাউদ, মিশকাত)

হাদীসটি সনদের দিক হতে দূর্বল কিন্তু এর অর্থ অন্যান্য হাদীস দ্বারা সমর্থিত সে কারণে ইমাম বুখারী এই কথাটিকে সহীহ বুখারীর তরজমাতে উল্লেখ করেছেন। (সহীহ বুখারী/ كتاب الجهاد والسير/ باب الجهاد ماض مع البر والفاجر)

সুতরাং জিহাদ বৈধ বা ফরজ হওয়ার জন্য নবুয়্যতী আদর্শের খিলাফত বা পরিপূর্ণ সত্য পথের উপর প্রতিষ্ঠিত খলীফা বিদ্যমান থাকতে হবে এটা শর্ত নয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight − three =

Back to top button