ইলম ও আত্মশুদ্ধিবই ও রিসালাহবাংলাদেশশাইখুল হাদীস মুফতি আবু ইমরান হাফিযাহুল্লাহহযরত উলামা ও উমারায়ে কেরাম

প্রশ্ন-২: হিজবুত তাহরীর এর সদস্যরা মনে করেন খিলাফত কায়েমের আগে কোন জিহাদ নেই, দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য নুসরাহ খুঁজতে হবে এবং তারা এটাকেই একমাত্র পথ মনে করেন। এ ব্যাপারে ইসলামের ভাষ্য কি?

উত্তরঃ

ইন্নাল হামদা লিল্লাহ, ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা রাসুলিল্লাহ।

আল্লাহ আপনাকে অনেক কল্যাণ দান করুন, দ্বীনের বিজয়ের জন্য আপনি চিন্তা করছেন এবং কোন পদ্ধতিতে দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করা যায়, এই ব্যাপারে আপনি পড়ালেখা করছেন। আল্লাহ আপনাকে ও আমাদের সবাইকে সঠিক পদ্ধতিতে দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজে শরীক থাকার তৌফিক দান করুন।

হিজবুত তাহরীর একটি ইসলামী জামায়াত যারা আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য কাজ করছেন। আলহামদুলিল্লাহ, তারা অন্যান্য অনেক দলের মতো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শিরকে জড়িত হননি। এবং তারা কোন মানবরচিত কুফরী পদ্ধতি থেকে নয় বরং ইসলামী শরীয়াত থেকে দ্বীনকে বিজয়ী করার পদ্ধতি আহরণ করার চেষ্টা করেন।

যা হোক তাদের এই দাবী, ‘খিলাফত কায়েমের আগে কোন জিহাদ নেই’ – এটা সঠিক নয়। তাদের পূর্বে সলফে সালেহীনদের কেউ এমন দাবী করেছেন, এর প্রমাণ তারা দেখাতে পারবেন না।

জিহাদ দুই প্রকারঃ আক্রমণাত্বক ও প্রতিরক্ষামূলক। আক্রমণাত্বক জিহাদের জন্য একজন খলিফা থাকার কথা আলেমরা আলোচনা করেছেন, কিন্তু প্রতিরক্ষামূলক জিহাদে খলিফার কোন শর্ত সলফে সালেহীন ও পূর্ববর্তী আলিমদের কেউ আলোচনা করেন নি। কারণ যখন একটি মুসলিম এলাকা কাফিরদের আগ্রাসনে মুখে পড়ে, যখন কাফিররা তা দখল করে নেয়, সেখানে জিহাদ করা ফরজে আইন হয়ে যায়। সেখানে খলিফার উপস্থিতিকে শর্ত করা একটা অযৌক্তিক দাবী।

তাদের এই যুক্তি মূলতঃ একটা বিষয়ের উপরে দাঁড়িয়ে আছে, তা হলোঃ রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কায় থাকতে জিহাদ করেন নি। কিন্তু তাদের এই যুক্তি বাতিল, কারণঃ

–   যখন রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কায় ছিলেন, তখনো শরীয়াত পূর্ণতা পায় নি। যেমনঃ তখনো মদ কিংবা সুদ হারাম হয়ে যায় নি।

–   তখনো জিহাদের আদেশ নাজিল হয় নি। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কায় থাকতে জিহাদ ফরজ হয় নি।

আর তারা যদি এই কথার মাধ্যমে এই দাবী করে থাকেন যে, মুরতাদ শাসকের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধে যাওয়া যাবে না খলিফা ছাড়া, তাহলে সেটাও বাতিল। কারণ সেটা পূর্ববর্তী উলামাদের ইজমার পরিপন্থী, যে ইজমা আমরা ‘আমাদের দাওয়াহ’ পাতায় উল্লেখ করেছি।

আর তাদের দাবী ‘নুসরাহ খোঁজা বর্তমানে দ্বীনকে বিজয়ী করার একমাত্র পদ্ধতি’ – এটার পক্ষে কোন দলীল-প্রমাণ নেই। এটা তাদের ধারনা মাত্র। আর ধারনা-অনুমান সত্যের বিপরীতে কোন কাজে আসে না। তারা এমন কোন দলীল-প্রমাণ দেখাতে পারবেন না যেখান থেকে প্রমাণ হয় নুসরাহ খোঁজা হচ্ছে দ্বীনকে বিজয়ী করার একমাত্র পদ্ধতি। বরং এই ব্যাপারে তাদের মাঝে বেশ কিছু ভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয় যা আমরা সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করছি ইনশাআল্লাহ। তারা দাবী করেন, আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির মিল রয়েছে শুধুমাত্র রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মক্কী যুগের সাথে। তাই দ্বীনকে বিজয়ী করার প্রচেষ্টা করতে হবে শুধুমাত্র রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে পদ্ধতিতে বিভিন্ন গোত্রের কাছে নুসরাহ খুঁজেছিলেন, সেই পদ্ধতিতে। কিন্তু তারা এটা লক্ষ্য রাখতে ভুলে যান যে, আমাদের পরিস্থিত এবং মক্কী যুগের  পরিস্থিতির মধ্যে অনেক ব্যবধান রয়েছে। যেমনঃ

–   এখন দ্বীন এবং শরীয়াত পূর্ণতা লাভ করেছে, আর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মক্কী যুগে যখন তিনি নুসরাহ খুঁজেছিলেন, তখনো দ্বীন পূর্ণতা লাভ করেনি। তাই ঐ সময়ের হুকুম আর আমাদের সময়ের হুকুম এক হবে না।

–   রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মক্কী যুগে তখনো জিহাদের অনুমতি আসেনি, আর সকল ফিতনাহ দূর করার আগ পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে যাওয়ার হুকুমের কথাতো প্রশ্নই আসেনা। আর এখন এসব হুকুম আমাদের সামনে রয়েছে। ঠিক যেমনভাবে মক্কী যুগে সুদ হারাম হয় নি, বরং তা মাদানী যুগে হারাম হয়। যখন সুদ হারাম হয়েছিলো, সেটা এমন এক অবস্থা ছিলো যখন রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছিলেন,

من ترك مالا فلأهله ومن ترك ‏ ‏ضياعا ‏ ‏ فإلي

“যে ব্যক্তি কোন সম্পদ রেখে মারা যাবে, সেটা তার পরিবারের, আর যে ব্যক্তি ঋণ রেখে মারা যাবে, তার দায়িত্ব আমার উপর”

কিন্তু এখন আমাদের কাছে সকল হুকুম মজুদ আছে, তাই সুদ আমাদের উপর হারাম যদিও এখন ইসুলামী হুকুমত প্রতিষ্টিত নেই, যদিও আমাদের অবস্থা মক্কী যুগের সাথে অধিক সামঞ্জস্য রাখে।

–   রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিভিন্ন কাফির গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন এবং ইসলাম গ্রহন করার মাধ্যমে তাদের কাছে নুসরাহ খুঁজেছিলেন। আর এই ভাইরা নুসরাহ খুঁজছেন বিভিন্ন মুরতাদ সেনাবাহিনীর কাছে।

–   রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সময় উনি এবং সাহাবাগণ (রাঃ) ছিলেন, একমাত্র মুসলমান। কিন্তু এখন হিজবুত তাহরীর ছাড়াও আরো অনেক মুসলিম দল আছে। তারা ছাড়াও আরো অনেকে দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য চেষ্টা করছেন। বরং সত্য কথা হলো, পৃথিবীর অনেক এলাকা এখন মুজাহিদীনরা ইসলামী শরীয়াত অনুযায়ী পরিচালনা করেছেন। যেমনঃ মালির অংশ বিশেষ, ইয়েমেনের কিছু কিছু এলাকা, আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকা, সোমালিয়ার অধিকাংশ এলাকা ইত্যাদি। এইসব মুজাহিদীনরা জিহাদের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করে চলেছেন। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে এই রকম পরিস্থিত থাকলে নিশ্চয়ই তিনি কাফিরদের কাছে নুসরাহ না খুঁজে ইতিমধ্যে মুসলিমদের করায়ত্বে আসা এলাকায় চলে যেতেন।

–   রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সময় পরিস্থিতি এমন ছিলো না যে, একবার একটা ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্টিত হবার পর তা আবার কাফির কর্তৃক দখল অথবা মুরতাদ শাসক কর্তৃক শরীয়াহ বিহীনভাবে শাসিত হচ্ছিলো। কিন্তু আমাদের সময়ে তা হয়েছে। আর এই কারণে আলেমদের ইজমা মতে আমাদের উপর জিহাদ ফরজ হয়ে আছে, যা রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সময় ছিলো না।

এসব পার্থ্যক্যের কারণে এই কথা বলা যায় না যে, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্য মক্কী যুগে যা করণীয় ছিলো, প্রথম খেলাফত প্রতিষ্টিত হবার আগে, আমাদের জন্যও একই হুকুম প্রযোজ্য। বরং আমাদের সময় এখন শরীয়াহ পরিপূর্ণ এবং পরিস্থিতিও অনেক আলাদা। এ কারণে কি করণীয় এই ফাতওয়াতেও পার্থক্য হবে। আর আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের সময়ে যা করণীয় তা হলোঃ

ক।  যে সব মুসলিম এলাকা বিদেশী কাফিরদের দ্বারা আক্রান্তঃ সে সব এলাকায় দখলদার কাফিরদের বিরুদ্ধে সর্বাত্বক জিহাদ ও ক্বিতাল করা। আর এই ব্যাপারে আলেমদের ইজমা রয়েছে।

ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বলেনঃ

إذا دخل العدو بلاد الإسلام فلا ريب أنه يجب دفعه على الأقرب فالأقرب، إذ بلاد الإسلام كلها بمترلة البلدة الواحدة، وأنه يجب النفير اليه بلا إذن والد ولاغريم

এতে কোন সন্দেহ নেই যে শত্রু কোন কোন মুসলিম দেশে প্রবেশ করে, তাহলে ঐ দেশের বাসিন্দাদের, ক্রমান্বয়ে তাদের নিকটবর্তী দেশের বাসিন্দাদের উপর তাদেরকে বহিস্কার করা ফরজে আইন হয়ে যায়, কারণ মুসলিমদের দেশ সমূহ হলো একটি দেশের মতো। তাই এক্ষেত্রে পিতা-মাতা অথবা ঋণদাতার নিকট থেকে অনুমতি ছাড়াই (জিহাদে) বের হয়ে যাওয়া ফরজ। (ফাতাওয়া আল কুবরা, ৪/৬০৮)

একই রকম বক্তব্য রয়েছে প্রায় সকল মুজতাহিদিন ফুকাহার এবং ফতোয়া ও ফিকহের কিতাবগুলোতে তা মজুদ আছে।

বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুনঃ মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষা, আব্দুল্লাহ আজ্জাম (রঃ), পৃষ্টাঃ ২০-২২।

ডাউনলোড লিংকঃ  archive.org/download/dawah_book/DefenceOfTheMuslimLandInBangla.pdf

 

খ। যে সব এলাকা দখলদার বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত নয় কিন্তু মুরতাদ শাসক কর্তৃক শাসিত হচ্ছেঃ  সুষ্পষ্ট কুফর (কুফরুন বাওয়াহ) প্রকাশ করার কারণে আলেমদের ইজমা মতে তাদেরকে অপসারণ করা, তাদের সাথে জিহাদ করা ফরজে আইন, যা আমরা ‘আমাদের দাওয়াহ’ পাতায় উল্লেখ করেছি।

আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাপারে এটাই পূর্ববর্তী সম্মানিত আলিমদের মতামত।

আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

—————————

উত্তর প্রদানেঃ

– শাইখুল হাদিস আবু ইমরান।

– মুফতী আইনান।

– মাওলানা আবু আনিকা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

12 − two =

Back to top button