প্রবন্ধ-নিবন্ধ

তাবলীগ জামাত কিংবা ছাত্র শিবির ছেড়ে জংগীবাদে কিভাবে জড়ালেন?

 

আরেক প্রশ্নঃ আপনি তাবলীগ জামাত কিংবা ছাত্র শিবির ছেড়ে জংগীবাদে কিভাবে জড়ালেন? একটু জানান।

উত্তরঃ

তাবলীগ জামাতের কাজটা খুব বেসিক। আলহামদুলিল্লাহ। এর মাধ্যমে আমি নিয়মিত নামাজ পড়া, ইবাদত করা ইত্যাদি শিখেছি। পাশাপাশি ইলম অর্জন করার কথা জেনেছি। কিন্তু ইলম অর্জন করতে গিয়ে দেখলামঃ ফাজায়েলে আ’মল, ফাজায়েলে সাদাকাত ছাড়া তাদের তেমন কোন সিলেবাস নেই।

তখনো আমি ইসলামী সমাজ, রাষ্ট্র এই ধারনাগুলোর সাথে পরিচিত ছিলাম না। তখন পর্যন্ত ব্যক্তিগত ইবাদত পর্যন্তই আমার জানার গন্ডি সীমাবদ্ধ ছিল।
আমার বাহ্যিক ইবাদতের খোরাক তখন যথেষ্টই ছিল কিন্তু অন্তরের / জ্ঞানের তেমন কোন খোরাক পাচ্ছিলাম না।

আর অনেকটা একই বই পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। কেবল পবিত্র কুরআন বারংবার পড়লেও মানুষের বিরক্তি আসবে না, কারণ এটা আল্লাহর কিতাব। এটা একটা মুযেযা। কিন্তু অন্য কোন বই এর ব্যাপার এমন না।
তখন আমি অন্যান্য ইসলামী বই পড়ার ইচ্ছা করলাম।

আল্লাহর শুকরিয়া, সৌভাগ্যক্রমে কলেজের লাইব্রেরীতে ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর কিছু বই এর পাশাপাশি সাইয়েদ কুতুব (রঃ) এর ‘ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা’ বইটা পেলাম। এই বই এর আলোচনার বিষয়গুলো ছিলঃ সাহাবাদের মতো মানূষ এখন দেখা যাচ্ছে না কেন? কিভাবে একটা ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা হতে পারে? ইত্যাদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এই বইটা আমার সামনে চিন্তার একটা নতুন জগৎ খুলে দিল। আমি দেখলাম, আমি একটা কুয়ার মধ্যে আটকে আছি। ইসলাম আসলে আরো অনেক বড়, আমার কাছেও দ্বীন ইসলামের চাওয়া আরো অনেক বেশী।

ছুটিতে বাংলাবাজারে ‘আধুনিক প্রকাশনী’তে গেলাম আরো বই কিনতে। কিন্তু ঐখানে অধ্যাপক গোলাম আজম, মাওলানা মওদুদী এর বই দেখে তো আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তখন পর্যন্ত উনাদেরকে আমি দেশ ও ইসলামের শত্রু হিসেবে ধারণা করতাম। (মিডিয়া প্রপাগান্ডা এর কারণে)

যাইহোক, পরিচিত জামাতী লেখকদের বই কিনলাম না। অন্য লেখকদের বই কিনলাম। ইসলাম প্রতিষ্ঠার উপায় কি? ইসলামী সংগঠন কীভাবে চলতে পারে? ইত্যাদি অনেক বিষয়। এই বইগুলো যতই পড়তে থাকলাম, ভাল লাগত।

পরে বুঝলাম, অন্য লেখকরা আসলে জামাতেরই মানুষ, কিন্তু আমি উনাদেরকে চিনতাম না। যেমনঃ আব্দুস শহীদ নাসিম, আব্দুল খালেক সাহেব ও অন্যান্যরা।

এরপর অনেক চিন্তায় পড়ে গেলাম। তাহলে কোন পথ সঠিক? আমার এক নিকটাত্বীয়কে দিয়ে ইস্তিখারা করালাম – যে আমার সামনে দুইটি দল আছে। একটাতে আমি আগে থেকে আছি। আরেকটাকে বই পড়ে ভাল মনে হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে আমি জানি তারা ভাল না। আসলে কোন দল উত্তম হবে? উনি একাধিকবার ইস্তিখারা করে জানালেন, ২য়টা বেটার।

আমি মানলাম না। কিভাবে এরা বেটার হয়? বললাম আমাকে ইস্তিখারা শিখিয়ে দেন। আল্লাহর ইচ্ছায় অনেক বার ইস্তিখারা করলাম। ইস্তিখারা করে স্বপ্নেও অনেক কিছু দেখলাম। যা দেখতাম সেটা একটা খাতায় লিখে রাখতাম। ১৫/২০ বার ইস্তিখারা করে একই ইশারা দেখতে দেখতে একদিন দেখলামঃ আমি একটা ফরমে সাক্ষর করে শিবিরে শরীক হচ্ছি। যিনি সাক্ষর নিচ্ছেন, উনার গালে চাপ দাড়ি। শিবিরের ভাইদের মতো।

এখন আমি শিওর হয়ে পরিচিত এক আত্মীয় যিনি জামাত সাপোর্ট করতেন, তার সাথে শিবিরের অফিসে যাই। এরপর থেকে শিবির ও জামাতের অনেক ভাইদের সাথে পরিচয় হয়েছে। বিভিন্ন বই উনাদের পড়েছি। আলহামদুলিল্লাহ। তাফসীর ও ইসলামী অর্থনীতি, ইসলামী সমাজব্যবস্থা ইত্যাদির ব্যাপারে জানতে পারলাম।

বেশ কয়েক বছর উনাদের সাথে উঠা-বসা করেছি।

এরপর একসময় জাকির নায়েকের সন্ধান পেলাম। উনার ভিডিও আলোচনাগুলো দেখে মুগ্ধ। পিস টিভি চ্যানেলটাকে যথাসম্ভব ছড়িয়ে দেওয়াই তখন আমার একটা জিহাদে পরিণত হল। নিজ শহরে ও আশেপাশের শহরে পিস টিভি চালু করার জন্য কেবল অপারেটরদের অফিসে যেতে থাকলাম। পরিচিত প্রভাবশালী আত্মীয়-স্বজনদেরকে এই কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করলাম।

জাকির নায়েকের থেকে যে ব্যাপারটা শিখলামঃ সেটা হচ্ছে ইসলামের সকল ব্যাপারে রেফারেন্স থাকতে হবে। তখনো শিবিরের সাথে সম্পর্ক আছে।

একসময় ঢাকায় সালাফী মতাদর্শের এক দায়ী এর সাক্ষাত পেলাম। সেটা জামাতী ঘরানার এক ভাই এর মাধ্যমে। ঐ দায়ী এর ২/১ টা ক্লাসে গিয়ে তো আমি মুগ্ধ। মনে হলঃ এতদিন কী শিখেছি আর কী করেছি!! সময় নষ্ট হয়েছে।

কারণ সালাফী দায়ীরা সকল ব্যাপারে কুরআন-হাদিসের রেফারেন্স তো দিচ্ছেনই কিন্তু সেখানেই শেষ না। ঐ রেফারেন্সের আন্ডারষ্ট্যান্ডিং আবার তারা নিচ্ছেন সাহাবী (রাঃ) ও প্রথম তিন যুগ থেকে। এটা আমার জন্য একটা বিশাল ব্যাপার!! আগে জামাতী ঘরানার কোন বইয়ে আমি এ রকম পাইনি।

ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, জামাতের থিংক ট্যাংক যে সকল লেখকদের এতদিন অনেক বড় কিছু মনে করে এসেছি সেই তুলনায় সৌদি সালাফী আলেমরা অনেক এগিয়ে। অনেক উঁচু পর্যায়ের। তখন থেকে সালাফী ঘরানার আলেম ও দায়ীদের সাথে সময় দিতে থাকলাম। তাদের কাছ থেকে শিখতে থাকলাম।

এভাবে এক সময় কিছু কিছু ইস্যুতে জামাত / শিবিরের অবস্থানগুলো ভুল বলে বুঝতে পারলাম। যেমনঃ কুফির বিত তাগুত, গণতন্ত্র, আল ওয়ালা ওয়াল বা’রা ইত্যাদি। এছাড়া আক্বীদার আরো কিছু ইস্যু। ধীরে ধীরে জামাতী থেকে সালাফী হয়ে গেলাম।

জামাত / শিবিরের পরিচিত ভাইদের কাছে এসকল বিষয় নিয়ে যেতাম। কিন্তু উনাদের কোন সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। উনারা বিরক্ত হতেন কিংবা এড়িয়ে যেতেন। এমন কি সিনিয়ার নেতাদের সাথে বসলাম। দেখা গেল, উনারা রেফারেন্স দিয়ে আমাকে উত্তর দিয়ে বুঝাতে না পেরে আবছা, আবছা কিছু একটা বুঝানোর চেষ্টা করছেন। অনেকটা আমাকে সাময়িকভাবে একটা কিছু বুঝানোর চেষ্টা।

আস্তে আস্তে জামাত-শিবিরের মানহাজের ব্যাপারে আমার ধারণা পাল্টে গেল। বুঝলাম, এর থেকে বেশী উনাদের থেকে আশা করা উচিত হবে না।
আমি উনাদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকলাম। উনারাও আমার থেকে (বিভিন্ন প্রশ্নের চাপ) হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।

প্রথম দিকে মনে কিছুুটা তিক্ততা সৃষ্টি হলেও এখন তাবলীগ জামাত আর জামাত-শিবিরের ভাইদের জন্য আমার মনে ভালবাসা আছে। আল্লাহর কাছে দুয়া করি যেন, তিনি সবাইকে তাঁর পছন্দনীয় পথে চলার তৌফিক দান করেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

7 + 12 =

Back to top button