আমীর খাত্তাব (সামির সালেহ আব্দুল্লাহ) রহিমাহুল্লাহইতিহাস- ঐতিহ্যনির্বাচিতপ্রবন্ধ-নিবন্ধ

আরেক খাত্তাব (!)

আরেক খাত্তাব (!)

আমীর খাত্তাব সম্পর্কে কী বলা যায়! যত বলা যায় ততই যেন কম।
(১) জন্মের আগে মা স্বপ্ন দেখলেন বিস্তির্ণ এলাকাজুড়ে পানি আর পানি। সেই পানির চারপাশজুড়ে লোক জড়ো হয়ে আছে। যারা আকাশের দিকে তাকিয়ে নতুন চাঁদের জন্য অপেক্ষা করছেন। মায়ের ধারণা হলো, নতুন চাঁদের জন্য অপেক্ষমাণ লোকগুলির চেহারা ককেশাস অঞ্চল থেকে হজ্বে আসা মানুষদের মতো।
(২) জন্মেছিলেন সৌদী আরবে। মূল নাম ছিলো সামীর। কিন্ত হযরত ওমর (রা.) এর খুব ভক্ত ছিলেন। তাকে নিয়ে পড়তেন খুব। কাকতালীয়ভাবে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তেন তার নামও ছিলো ওমর ইবনুল খাত্তাব।
(২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি হলেই বাবা তাদের ভাই-বোনদের শহরের কোলাহল থেকে দূরে নিয়ে যেতেন। পাহাড়ি অঞ্চলে নিয়ে যেতেন। সেখানে তাদেরকে জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে দীক্ষা দিতেন।
(৩) ইচ্ছা ছিলো আমেরিকায় গিয়ে ডাক্তার হবেন, কিন্তু হঠাৎ করেই সব বাদ দিয়ে চলে গেলেন আফগানিস্তানে। আফগানিস্তানে তখন রাশিয়ান দখলদারিত্ব চলে নিপীড়ন নির্যাতনে জর্জরিত মুসলিম জনগণ। খাত্তাবের পক্ষে আর ঘরে থাকা সম্ভব নাই। প্রচন্ড মেধাবী আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষ হওয়াতে খুব দ্রুত সবার নজর কাড়েন। হয়ে ওঠেন কমান্ডার। যুদ্ধে হাতের আঙুল হারান। মারাত্মক জখম হন। যুদ্ধের একপর্যায়ে আফগানিস্তান থেকে রাশিয়া পরাজিত হয়ে চলে যায়। কিন্তু খাত্তাবের মিশন শেষ হয় না। তিনি আফগানিস্তান থেকে তাজিকিস্তান চলে আসেন। সেখানকার মুসলমানদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করলেন, ট্রেইনিং দিলেন। তাজিকিস্তান থেকেও রাশিয়ান ফোর্স বিদায় নিলো।
(৪) এবার তার মায়ের স্বপ্ন পূরণ হবার পালা। খাত্তাব লক্ষ করলেন, আফগানিস্তান নিপীড়িত হলেও সবাই জানে, তাই কিছু হলেও সাহায্য সে পায়। কিন্তু নিপীড়িত অথচ মানুষ অতটা জানে না-এরকম এলাকা হচ্ছে ককেশাস অঞ্চলের দেশ চেচনিয়া।
(৫) চেচনিয়া গিয়ে এক বৃদ্ধার সাথে তার দেখা হলো। বৃদ্ধা জানালেন তারা যুদ্ধ করতে চান। খাত্তাব জিজ্ঞাসা করলেন, যুদ্ধ করার মতো কি আছে তাদের কাছে। বৃদ্ধা বললেন, কিছুই নেই। সব হারিয়ে তার গায়ে একটা কোট আছে। তবে এটাও তিনি দিয়ে দেবেন স্বাধীনতার স্বার্থে। এবার চেচনিয়াতে তিনি সংগঠন তৈরী করলেন। অংশগ্রহণ করলেন প্রথম ও দ্বিতীয় চেচেন স্বাধীনতা যুদ্ধে।
(৬) পরিবার সূত্রে জানা যায়, খাত্তাব প্রতিবার কোনো যুদ্ধে যাওয়ার আগে মায়ের সাথে একবার কথা বলার চেষ্টা করতেন। চিঠির আদান প্রদানও চলতো। একবার মায়ের কাছ থেকে একটা চিঠি আসলো। চিঠিটা খুলতেই রাসায়নিক বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেলো। কয়েক ঘন্টা পরে মারা গেলেন খাত্তাব। চিঠি আদান প্রদানের দায়িত্বে ছিলেন খাত্তাবের খুব কাছের লোক। এই লোকটা ছিলো মুসলিম কিন্তু রাশিয়ান এজেন্ট।
(৭) অনেকগুলি ভাষা জানতেন। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় গড়ে ৯৪ নম্বর পেয়েছিলেন। চেচনিয়া যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে তার একটা দিনলিপিও পাওয়া যায়।
ভাবতে অবাক লাগে এত বড় একটা মানুষ আমাদের শতাব্দীতেও ছিলেন। আমাদের সাথেই পৃথিবীর মাটিতে হেঁটেছিলেন।
তার ছোট ভাই মানসুর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, খাত্তাব ১৪ বছর ধরে শহীদ হওয়ার আশায় ছিলেন। আফগানিস্তানে গেলেন, যুদ্ধ করলেন, কিন্তু শহীদ হতে পারলেন না, তাজিকিস্তানে যুদ্ধ করলেন, তাও শহীদ হলেন না। অবশেষে চেচনিয়াতে আল্লাহ্ তাকে কবুল করলেন।
আমার কাছে খুব আশ্চর্যজনক লাগে, প্রথমে নিজের দেশ ছেড়ে দিলেন। জিহাদে জড়ালেন। কোনো এক ভূখণ্ডে নিজেকে আবদ্ধ করলেন না। একদেশ ছেড়ে আরেকদেশ, তারপর আরেকদেশ। তারপর শাহাদাত। যেন থামতেই জানতেন না। কী আশ্চর্য ঈমান! কী আশ্চর্য জীবন! শাহাদাত বরণ করেছেন ২০০২ সালে। এইত কিছুদিন আগে। অথচ তার ঈমানী জযবা দেখলে সাহাবীদের কথা মনে পড়ে যায়।
আমির খাত্তাব বলতেন, “মুসলিম সমাজের এই দুর্দশার পেছনে তরুণরাই দায়ি। এরা আসল কাজ বাদ দিয়ে মিছে-মিছি তর্কে ব্যস্ত থাকে। অথচ বেদুঈন সাহাবীরা (রা.), যাদের পায়ে ঠিকমত জুতাও থাকতো না, তারা আল্লাহ্’র দেয়া বিজয়ের স্বাদ আস্বাদন করতেন।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen + 11 =

Back to top button