আরবইলম ও আত্মশুদ্ধিউসামা মিডিয়াফাতাওয়া-ফারায়েজবই ও রিসালাহমিডিয়াশাইখ ইউসুফ আল উয়াইরী রহিমাহুল্লাহসৌদী আরবহযরত উলামা ও উমারায়ে কেরাম

ইসলামে জিহাদের বিধান : হুকুম ও প্রকারভেদ – শাইখ ইউসুফ আল উয়াইরী রহ.

আলহামদু লিল্লাহ রিলিজ হল…

ইসলামে জিহাদের বিধান
হুকুম ও প্রকারভেদ

মুল
শাইখ ইউসুফ আল উয়াইরী রহ.

অনুবাদ
মুফতি আব্দুল মালেক মুসা হাফিজাহুল্লাহ


PDF

http://www.mediafire.com/file/p20efa…ul%20jihad.pdf

WORD

http://www.mediafire.com/file/4w4wr0…l%20jihad.docx

 

PDF
—-
http://www.mediafire.com/file/6ijnwij949ar7kk/117._hukmul_jihad.pdf/file

https://archive.org/download/U_M_A_04/117.%20hukmul%20jihad.pdf

Word
—–
http://www.mediafire.com/file/phffq2xhubtyj3z/117._hukmul_jihad.docx/file

https://archive.org/download/U_M_A_04/117.%20hukmul%20jihad.docx

====================

ইসলামে জিহাদের বিধান

হুকুম ও প্রকারভেদ

মুল

শাইখ ইউসুফ আল-উয়াইরী রহ.

অনুবাদ

মুফতি আব্দুল মালেক মুসা হাফিজাহুল্লাহ

 

 

(সর্বস্বত্ব সকল মুসলমানের জন্য সংরক্ষিত)

 

 

দৃষ্টিপাত

সম্মানিত পাঠক ও পাঠিকাগণ! শাইখ রহিমাহুল্লাহ এই গ্রন্থে মূলত আক্রমণাত্মক জিহাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফলে আসলে নামটি হওয়া উচিত ছিল “ইসলামে আক্রমণাত্মক জিহাদের বিধান!”। মুহতারাম ভাই ও বোনেরা! আশা করি এই ভুলটা আপনারা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন!

শাইখ রহিমাহুল্লাহর পরিচয় আসলে সংক্ষেপে করলে শাইখের শান অনুযায়ী হবে না, তাই আমরা পড়তে পারি আল হিকমাহ মিডিয়া পরিবেশিত শহীদ শাইখ ঈসা বিন সাদ আল-আসওয়ান রহিমাহুল্লাহ লিখিত “শায়খ ইউসুফ আল-উয়ায়রি রাহিমাহুল্লাহর জীবনী ‘এক মহীরুহ’!”

ডাউনলোড লিংক-

https://www.pdf-archive.com/2017/10/27/sh-uyayri-bio/

 

জিহাদ দুই প্রকার:

প্রথম প্রকার: আক্রমণাত্মক ও প্রারম্ভিক জিহাদ।

সংজ্ঞা: কাফেরদেরকে তাদের এলাকায় তলব করে ইসলামের দাওয়াত দেয়া। যদি ইসলামের হুকুমকে মাথা পেতে গ্রহণ না করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করা। এ হচ্ছে আক্রমনাত্মক জিহাদের পরিচয়।

হুকুম: এ প্রকার জিহাদ সকল মুসলমানের উপর ফরজ।

আয়াতে কারিমায় আক্রমাণাত্মক জিহাদের প্রমাণ:

فإذا انسلخ الأشهر الحرم فاقتلوا المشركين حيث وجدتموهم و خذوهم واحصروهم واقعدوا لهم كل مرصد فإن تابوا وأقاموا الصلاة وآتوا الزكاة فخلوا سبيلهم إن الله غفور رحيم

“অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদের হত্যা করো যেখানে তাদের পাও, তাদের বন্দী করো এবং অবরোধ করো। আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে থাকো। তবে যদি তারা তওবা করে, নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”।  -[সূরা তওবা:৫]

 

فاقتلوا المشركين كافة كما يقاتلونكم كافة واعلموا أن الله مع المتقين

“আর তোমরা মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করো সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে সমবেতভাবে। আর জেনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকিদের সাথে রয়েছেন” -[সূরা তওবা:৩৬]

 

انفروا خفافا وثقالا وجاهدوا بأموالكم وأنفسكم في سبيل الله ذلكم خير لكم إن كنتم تعلمون

“তোমরা বেরিয়ে পড়ো স্বল্প বা প্রচুর সরঞ্জামের সাথে এবং জিহাদ করো আল্লাহর পথে নিজেদের মাল ও জান নিয়ে, এটি তোমাদের জন্যে অতি উত্তম, যদি তোমরা বুঝতে পারো”।  -[সূরা তওবা: ৪১]

ইত্যাদি বিভিন্ন আয়াত এ বিষয়ের উপর প্রমাণ বহন করে।

 

হাদিসে রাসূলে এর প্রমাণ:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

أمرت أن أقاتل الناس حتى يشهدوا أن لا إله إلا الله وأن محمدا رسول الله ويقيموا الصلاة ويؤتوا الزكاة فإذا فعلوا ذلك عصموا مني دماءهم وأموالهم إلا بحق الإسلام وحسابهم على الله .

“আমি লোকদের সাথে কিতাল করতে আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রতিপালক নেই, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল এবং নামাজ কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে। যদি তারা এ কাজ করে তাহলে তাদের জান-মাল আমার থেকে নিরাপদ; তবে ইসলামের কোনো দণ্ডবিধির কারণে হলে ভিন্ন কথা। আর তাদের হিসাব আল্লাহর দরবারে”।  -[সহীহ বুখারী]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইরশাদ,

اغزوا باسم الله في سبيل الله قاتلوا من كفر بالله اغزوا ولا تغلوا ولا تغدروا ولا تمثلوا ولاتقتلوا وليدا وإذا لقيت عدوك من المشركين فادعهم إلى ثلاث خصال أو خلال فأيتهن ما أجابوك فاقبل منهم وكف عنهم ثم ادعهم إلى الإسلام فإن أجابوك فاقبل منهم وكف عنهم ثم ادعهم إلى التحول من دارهم إلى دار المهاجرين وأخبرهم أنهم إن فعلوا ذلك فلهم ما للمهاجرين وعليهم ما على المهاجرين فإن أبوا أن يتحولوا منها فأخبرهم أنهم يكونون كأعراب المسلمين يجري عليهم حكم الله الذي يجري على المؤمنين ولايكون لهم في الغنيمة و الفيء شيء إلا أن يجاهدوا مع المسلمين فإن هم أبوا فسلهم الجزية فإن هم أجابوك فاقبل منهم وكف عنهم فإن هم أبوا فاستعن بالله وقاتلهم

“আল্লাহর নামে আল্লাহর পথে জিহাদ করো, যে আল্লাহকে অস্বীকার করে তাদের সাথে কিতাল করো। জিহাদ করো; বাড়াবাড়ি ও ধোঁকাবাজিতে লিপ্ত হবে না, অঙ্গহানি করবে না, শিশুদের হত্যা করবে না। যখন মুশরিক শত্রুদের মুখোমুখী হবে তখন তাদেরকে তিনটি বিষয়ের প্রস্তাব দেবে। যদি কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করে নেয়, তাহলে তাকে মেনে নেবে এবং তাদের থেকে হাত গুটিয়ে নেবে। অতঃপর তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেবে। যদি মেনে নেয় তাহলে তাদের থেকে তা গ্রহণ করে নেবে এবং অন্য কোনো আচরণ করা থেকে বিরত থাকবে। অতঃপর তাদেরকে তাদের রাষ্ট্র থেকে মুহাজিরগণের রাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান করবে এবং ঘোষণা দিয়ে দেবে, যদি তারা এ প্রস্তাব মেনে নেয় তাহলে তাদের জন্য তাই নির্ধারিত রয়েছে যা রয়েছে মুহাজিরদের জন্য, তাদের উপর তাই আরোপিত হবে যা আরোপিত হয় মুহাজিরদের উপর। আর যদি তারা প্রত্যাবর্তন করতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে ঘোষণা দিয়ে দেবে যে, তারা বেদুঈন মুসলমানদের অন্তর্ভূক্ত। তাদের উপর আল্লাহর সে বিধান আরোপিত হবে যা আরোপিত হয় মুমিনদের উপর। গনিমত ও ফাইয়ের কোনো অংশ তাদের জন্য নির্ধারিত থাকবে না। তবে যদি মুসলমানদের সাথে জিহাদে শরিক হয় (তাহলে তাদের জন্য এসব থাকবে)। আর যদি (ইসলাম গ্রহণ করতে) অস্বীকৃতি জানায় তাহলে তাদের উপর কর আরূপ করবে। যদি তারা স্বাগত জানায় তাহলে তোমরা মেনে নেবে এবং (ভিন্ন আচরণ করা থেকে) বিরত থাকবে। এতেও যদি অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করে কিতালের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে”।  -[মুসলিম]

 

من مات ولم يغز ولم يحدث به نفسه بالغزو مات على شعبة من نفاق

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি জিহাদ না করে মারা গেলো, মনেমনে জিহাদের ইচ্ছাও ছিলো না, তাহলে সে নেফাকের অংশ নিয়ে মারা গেলো”। -মুসলিম

কুরআন-হাদিসে এ ধরণের আরো বিভিন্ন নস রয়েছে, যা মুসলমানদের উপর কাফেরদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক জিহাদকে ফরজ সাব্যস্ত করে।

উলামায়ে ইসলাম এ ব্যাপারে একমত যে, কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা, তাদেরকে ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে চলে আসার আহ্বান করা, ইসলামের দাওয়াত দেয়া; আর যদি দাওয়াত কবুল না করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করা তা না হলে তাদের উপর কর আরূপ করা- একটি ফরজ দায়িত্ব, যা রহিত হবার নয়।

কাফেরদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক জিহাদ করা নফল হওয়ার যে বক্তব্য ইবনে ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান ও ইমাম সাওরী থেকে বর্ণিত আছে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আক্রমণাত্মক জিহাদ সকল মুসলমানের উপর ফরজে আইন নয়; বরং ফরজে কেফায়া। যখন এ ফরজ দায়িত্ব একটি জামাত আদায় করবে তখন অন্য মুসলমানের উপর তা নফল হিসেবে বিবেচিত হবে। তাদের এ বক্তব্যের অন্য কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করা জায়েয হবে না।

ফাতহুল কাদিরের ব্যাখ্যাকার জিহাদ ফরজ হওয়ার বিষয়টি দলীলসহ আলোচনা করার পর বলেন,

وبهذه ينتفي ما نقل عن الثوري وغيره أنه ليس بفرض، ويجب حمله إن صح على أنه ليس بفرض عين

“এর মাধ্যমে ইমাম সাওরী ও অন্যান্যদের থেকে এ প্রকারের জিহাদ ফরজ না হওয়ার ব্যাপারে যে কথা বর্ণিত হয়েছে তা অকার্যকর হয়ে যায়। তাঁদের বক্তব্য যদি সঠিকও হয়ে থাকে তাহলে একে ‘ফরজে আইন’ না হওয়ার উপর প্রয়োগ করা আবশ্যক”।  -[শরহে ফতহুল কাদীর: ৫/৪৩৭]

ইমাম জাসসাস রাহ. বলেন,

إن مذهب ابن عمر في الجهاد أنه فرض على الكفاية وأن الرواية التي رويت عنه في نفي فرض الجهاد إنما هي على الوجه الذي ذكرنا، من أنه غير متعين على كل حال في كل زمان

“জিহাদের ক্ষেত্রে ইবনে ওমর রা. এর মতামত হলো, এটি ফরজে কিফায়া। আর যে বর্ণনায় জিহাদ ফরজ না হওয়ার কথা রয়েছে তার দ্বারা উদ্দেশ্য তাই, যা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। অর্থাৎ- প্রত্যেকের উপর প্রত্যেক জমানায়ই ফরজে আইন নয়”। -[তাফসিরে জাসসাস: ৩/১১৬]

ইবনে কুদামা ও ইবনুল কায়্যিম রহ. জিহাদের হুকুম বর্ণনা করতে গিয়ে ‘ফরজ’ ব্যতীত অন্য কিছু উল্লেখ করেননি। ইবনে ওমর ও সাওরীর দিকে সম্পৃক্ত করে এ ব্যাপারে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, সে দিকে ইশারা করে তারা বলেন, এসব বক্তব্য তাদের থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত নয় অথবা তাদের কথা থেকে ফরজে কেফায়া ছাড়া অন্য কিছু বোঝা যায় না।

[দ্রষ্টব্য- আল-মুগনী:৮/৩৪৬, যাদুল মাআদ:৩/৭১]

ইবনে আতিয়া রহ. তাঁর তাফসিরে আক্রমণাত্মক জিহাদ ফরজ হওয়ার ব্যাপারে ইজমা উল্লেখ করে বলেন,

واستمر الإجماع على أن الجهاد على أمة محمد صلى الله عليه وسلم فرض كفاية، فإذا قام به من قام من المسلمين يسقط عن الباقين إلا أن ينزل العدو بساحة الغسلام فهو حينئذ فرض عينن وذكر المهدوي وغيره عن الثوري أنه قال: الجهاد تطوع. وهذه العبارة عندي إنما هي على سؤال سائل وقد قيم بالجهاد فقيل هذا تطوع .

“এ ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত চলে আসছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উম্মতের উপর জিহাদ করা ফরজে কেফায়া। সুতরাং মুসলমানদের একটি অংশ যদি তা আদায় করে তাহলে অন্যদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। তবে যখন মুসলিম ভূখণ্ডে শত্রুবাহিনী আক্রমণ করে বসবে, তখন সকলের উপর জিহাদ ফরজে আইন। মাহদাওয়ী ও অন্যান্য উলামায়ে কেরাম ইমাম সাওরী রহ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘জিহাদ একটি নফল ইবাদত’। আমার মতে এই উক্তিটি সেসময়ের প্রশ্নকারীর উত্তরে বলা হয়েছে যখন জিহাদের ফরজ দায়িত্ব অন্যদের দ্বারা আদায় হচ্ছে। তখন তাকে উত্তরে বলা হলো, ‘এমুহুর্তে জিহাদ করা নফল’।  -[তাফসীরে ইবনে আতিয়া:২/৪৩]

আমার মতে, ইবনে আতিয়া রহ. এর এ ব্যাখ্যাটি খুবই চমৎকার হয়েছে। স্বর্ণযুগের বড় বড় আলেমগণ ছাড়াও যে ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞান রাখে, সেও জিহাদ ফরজ হওয়া ব্যপারে সন্দেহ পোষণ করতে পারে না। আর ফরজ না হওয়ার ব্যাপারে তাঁদের থেকে যেসব উক্তি পাওয়া যায় তা তিন অবস্থা থেকে মুক্ত নয়:

১. এমনও তো হতে পারে যে, এসব বক্তব্যকে তাঁদের বক্তব্য বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ অনেক বক্তব্য এমন আছে, যার কোনো ভিত্তি নেই। জাল তো হচ্ছে উলামায়ে কেরাম ছাড়া কোনো কথাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা বলে চালিয়ে দেয়া, এমন ব্যক্তির পক্ষ থেকে, যার সাথে সে বিষয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।

২. অথবা তাঁদের পক্ষ থেকে এ বক্তব্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক ফাতওয়া হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, এমন ব্যক্তির জন্য, যে তাঁদের কাছে ফাতওয়া চেয়েছিলো। অথচ সে ছাড়া অন্যদের জন্য জিহাদ ফরজ। সুতরাং তাঁরা যখন তাকে জানালেন যে, এ মুহুর্তে তোমার জন্য জিহাদ নফল, তখন শ্রোতা মনে করলো, এটা মনে হয় জিহাদের ক্ষেত্রে মুফতি সাহেবের সাধারণ ফাতওয়া।

৩. হতে পারে যে, তাঁরা ‘ফরজ নয়’ বলে প্রত্যেকের উপর ফরজে আইন নয়- উদ্দেশ্য নিয়েছেন; বরং তা ফরজে কেফায়া। এ জাতীয় ব্যাখ্যা ছাড়া তাঁদের ব্যাপারে অন্য কোনো ধারণা পোষণ করা কোনোভাবেই ঠিক হবে না।

হাসান আল-বান্না রহ. জিহাদ ফরজ হওয়ার ব্যাপারে ফুকাহায়ে ইসলামের বক্তব্য পর্যালোচনা করার পর বলেন,

ها أنت ذا ترى من ذلك كله كيف أجمع أهل العلم مجتهدين و مقلدين سلفيين و خلفيين على أن الجهاد فرض كفاية

“এসব বক্তব্যের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে আপনিই বলবেন যে, পূর্ববর্তী-পরবর্তী মুজাতাহিদ ও মুকাল্লিদ সকলে কীভাবে দাওয়াত প্রসারের জন্য মুসলিম উম্মাহর উপর জিহাদ ফরজে কেফায়া হওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন!’-[আল-জিহাদ লিল-বান্না:৮৪]

আক্রমাণাত্মক জিহাদ ফরজে কেফায়া হওয়ার ব্যাপারে যে আলোচনা করেছি, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যখন যথেষ্ট পরিমাণ লোক তা পালন করবে তখন অবশিষ্টরা গোনাহমুক্ত হয়ে যাবে। এটাই অধিকাংশ আলেমের বক্তব্য। কিছু কিছু সালাফে সালেহের মত হলো, আক্রমণাত্মক জিহাদ প্রতিরক্ষামূলক জিহাদের মতই ফরজে আইন। এটি কতক সাহাবি ও সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব রহ. এর বক্তব্য।

ইবনে হাজার রহ. বলেন,

قد فهم بعض الصحابة من الأمر في قول الله عز وجل (انفروا خفافا و ثقالا) العموم فلم يكونوا يتخلفون عن الغزو حتى ماتوا، منهم أبو أيوب الأنصاري و المقداد ابن الأسود وغيرهم … رضي الله عنهم.

انفروا خفافا و ثقالا  এ আয়াতের নির্দেশ থেকে কিছু সাহাবি ব্যাপক অর্থ বুঝেছেন। এ জন্য তাঁরা মৃত্যু পর্যন্ত জিহাদ থেকে পেছনে থাকেননি। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আবু আইয়ূব আনসারি, মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ রা. প্রমুখ”।’ -[ফাতহুল বারী:৬/২৮]

انفروا خفافا و ثقالا এ আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে ইবনে কাসির রহ. বলেন,

وقال علي بن زيد عن أنس عن أبي طلحة : “كهولا وشبابا، ما سمع الله عذر أحد” ثم خرج إلى الشام حتى قتل…

وفي رواية: قرأ أبو طلحة سورة براءة فأتى على هذه الآية “انفروا خفافا و ثقالا” فقال: أرى ربنا يستنفرنا شيوخا وشبابا.. جهزوني يا بني.. فقال بنوه : يرحمك الله قد غزوت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم حتى مات، ومع أبي بكر حتى مات، ومع عمر حتى مات،… فنحن نغزو عنك، فأبى، فركب البحر فمات فلم يجدوا له جزيرة يدفنونه فيها إلا بعد تسع أيام، فلم يتغير فدفنوه بها

“আলী ইবনে যায়েদ রহ. আনাস রা. থেকে আবু তালহা রা. এর সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘যুবক-বৃদ্ধ (সবাই বেরিয়ে পড়বে) আল্লাহ তাআলা কারো ওযর শুনবেন না’। এরপর তিনি শামের উদ্দেশ্যে জিহাদে বেরিয়ে পড়লেন এবং শহিদ হয়ে গেলেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবু তালহা রা. সূরা বারাআ তিলাওয়াত করতে করতে যখন انفروا خفافا وثقالا এ আয়াত পর্যন্ত এসে পৌঁছলেন তখন বললেন, আমাদের প্রতিপলককে দেখছি বৃদ্ধ-যুবক সকলকেই জিহাদে বেরিয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন!… তাহলে তোমরা আমাকে প্রস্তুত করো। ছেলেরা বললো, আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন- আপনি তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত জিহাদ করেছেন, আবু বকর-উমরের সাথেও তাঁদের মৃত্যু পর্যন্ত জিহাদ করেছেন…। সুতরাং এখন আমরাই আপনার পক্ষ থেকে জিহাদ করছি। তিনি অস্বীকার করলেন। রওয়ানা হয়ে গেলেন সমুদ্রপথে (জিহাদের উদ্দেশ্যে)। ঘটনাক্রমে সেপথেই মারা গেলেন। তো লোকেরা তাঁকে দাফন করার মতো কোনো দীপ পাচ্ছিলো না। পরিশেষে নয় দিন পর জায়গা মিললো, সেখানে তাঁকে দাফন করা হয়।  তাঁর দেহ কোনো রূপ বিকৃত হয়নি। -[ইবনে কাসির: ৪/৯৭]

‘আল-ইসাবা’ -এ ইবনে হাজার রহ. যে বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন তা আবু তালহা রা. সম্পর্কে বর্ণিত রেওয়াতটির সঠিকতাকে আরো শক্তিশালী করে। তিনি বলেন,

قال ثابت عن أنس مات أبو طلحة غازيا في البحر فما وجدوا جزيرة يدفنونه فيها إلا بعد سبعة ايام و لم يتغير. أخرجه الفسويّ في تارخه وأبو يعلى وإسناده صحيح…

“আনাস থেকে সাবেত রা. বর্ণনা করেন, আবু তালহা রা. সমুদ্রে জিহাদ করতে করতে শহিদ হয়ে গেলেন, তখন লোকেরা তাঁকে দাফন দেয়ার মত কোনো দীপ পাচ্ছিলো না। পরিশেষে নয়দিন পর পাওয়া গেলো। তখনও পর্যন্ত তাঁর লাশ কোনো রকম বিকৃত হয়নি। ফাসাওয়ী রহ. তার তারিখের মধ্যে এ বর্ণনাটি নিয়ে এসেছেন। সেইসাথে এটি বর্ণনা করেছেন আবু ইয়ালা রহ.ও। তাঁর সনদটি সহিহ”। -[আল-ইসাবা: ১/৫৬৭]

ইবনে হাজার রহ. বলেন,

إن جنس جهاد الكفار متعين على كل مسلم، إما بيده وإما بلسانه وإما بماله وإما بقلبه

“কাফেরদের সাথে জিহাদ করার বিষয়টি প্রত্যেক মুসলমানের উপর নির্ধারিত দায়িত্ব। তা হয়তো হাত দিয়ে, যবান দিয়ে, মাল দিয়ে কিংবা অন্তর দিয়ে”।  -[ফতহুল বারী: ৬/২৮]

ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, ‘অতঃপর ব্যাপকভাবে মুশরিকদের সাথে জিহাদকে ফরজ করা হয়েছে। প্রথমতদিকে হারাম ছিলো, অতঃপর অনুমতি দেয়া হয়েছে, তারপর মুশরিকরা যাদের সাথে কিতাল শুরু করে দিয়েছে তাঁদেরকে জিহাদের নির্দেশ প্রদান করা হয়। পরিশেষে সকল মুশরিকদের সাথে জিহাদের ব্যাপক নির্দেশ দেয়া হয়। এক বক্তব্য অনুযায়ী তা ফরজে আইন, অথবা প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী তা ফরজে কেফায়া।

তবে বাস্তব কথা হচ্ছে, জিহাদ ফরজে আইন। তা হয়তো অন্তর দিয়ে, যবান দিয়ে, মাল দিয়ে কিংবা হাত দিয়ে। সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের উপর এ পদ্ধতিসমূহের যে কোনো পদ্ধতিতে জিহাদ করা ফরজ। নিজের জান দিয়ে জিহাদ করা ফরজে কেফায়া। মাল দিয়ে জিহাদ করার ব্যাপারে দুটি মত রয়েছে, সঠিক মত হলো ফরজ; কেননা কুরআনে কারিমে জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করার নির্দেশ একই রকম। আল্লাহ তাআলা বলেন,

انفروا خفافا و ثقالا وجاهدوا بأموالكم وأنفسكم في سبيل الله ذلكم خير لكم إن كنتم تعلمون

“তোমরা বেরিয়ে পড়ো স্বল্প ও প্রচুর সরঞ্জামের সাথে এবং জিহাদ করো আল্লাহর পথে নিজেরদের মাল ও জান দিয়ে। এটি তোমাদের জন্য অতি উত্তম, যদি তোমরা বুঝতে”। -[সূরা তাওবা: ৪১]

জাহান্নাম থেকে মুক্তি, গোনাহের ক্ষমা এবং জান্নাতে প্রবেশ করার বিষয়কে জিহাদের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলার বাণী,

يا أيها الذين آمنوا هل أدلكم على تجارة تنجيكم من عذابب أليم، تؤمنون بالله و رسوله وتجاهدون في سبيل الله بأموالكم وأنفسكم ذلكم خير لكم إن كنتم تعلمون، يغفر لكم ذنوبكم ويدخلكم جنات تجري من تحتها الأنهار ومساكن طيبة في جنات عدن ذلك الفوز العظيم.

“মুমিনগণ, আমি কি তোমাদেরকে এমন এক বানিজ্যের সন্ধান দিবো না, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দেবে? তা এই যে, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর পথে নিজের ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্যে উত্তম, যদি তোমরা বোঝো। তিনি তোমাদের গোনাহ ক্ষমা করবেন এবং এমন জান্নাতে দাখেল করবেন, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত এবং বসবাসের জান্নাতে উত্তম বাসগৃহে। এটাই মহাসাফল্য”।  (সূরা সাফ: ১০-১২) – [যাদুল মাআদ:৩/৭২]

কুরতুবী রহ. কয়েকজন সাহাবী-তাবেয়ী থেকে এমন অনেক বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, যার মাধ্যমে বোঝা যায় যে, তাঁরা জিহাদ করতে সক্ষম এমন মুসলমানের জন্য জিহাদে না যাওয়ার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করেন না। তিনি বলেন, ‘ইমাম তাবারী রহ. ঐ ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেন, যে মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ রা.কে হিমসে একটি কফিনের উপর দেখেছে। তাঁর দেহের স্থূলতার কারণে কফিনের তুলনায় তাঁকে অনেক বড় মনে হচ্ছিলো। তিনি তখন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁকে বলা হলো, আপনাকে তো আল্লাহ তাআলা বেশ ওজর দিয়েছেন। তিনি বললেন, আমাদের উপর সূরা নাযিল হয়েছে انفروا خفافا و ثقالا….  (বেরিয়ে পড়ো হাল্কাভাবে ও ভারি হয়ে….)।

যুহরী রহ. বলেন, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব যুদ্ধে গমন করলেন, অথচ তাঁর একটি চোখ নেই। তাঁকে বলা হলো, আপনি তো অসুস্থ। উত্তরে তিনি বললে, আল্লাহ তাআলা হাল্কা-ভারি সবাইকে জিহাদে বের হতে বলেছেন। যদি আমার পক্ষে যুদ্ধ করা সম্ভব নাও হয়, তবুও তো আমি তোমাদের সংখ্যা বাড়াতে পাড়ি, তোমাদের আসবাবপত্র সংরক্ষণ করতে পারি”। -[তাফসিরে কুরতুবী: ৮/৫১]

কতক সাহাবী-তাবেঈ থেকে বর্ণিত এসব প্রমাণের মাধ্যমে বুঝা যায়, জিহাদের ক্ষেত্রে তাদের মতামত কী? তাঁরা মনে করেন যে, আক্রমনাত্মক জিহাদ তথা- প্রারম্ভিক জিহাদ সক্ষম ব্যক্তির উপর ফরজ।

আর অধমের কাছে যা প্রধান্যযোগ্য মনে হচ্ছে -আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন- তা হলো, অধিকাংশের মত অনুসারে প্রারম্ভিক ও আক্রমনাত্মক জিহাদ ফরজে কিফায়া। যখন মুমিনগণের একটি অংশ তা বাস্তবায়ন করবে, ইসলামের প্রচার-প্রসার ও দাওয়াতের জন্য তারা যথেষ্ট হবে, তখন প্রত্যেক মুসলমানের জন্য তাদের সাথে জিহাদে বের হওয়া জরুরী না। তার প্রমাণ এই,

১. আল্লাহর বাণী,

وما كان المؤمنون لينفروا كافة فلولا نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفقهوا في الدين ولينذروا قومهم إذا رجعوا إليهم لعلهم يحذرون

“আর সকল মুমিনের অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং ভীতি প্রদর্শন করে স্বজাতিকে, যখন তাঁরা তাঁদের কাছে প্রত্যাবর্তন কারবে, যেন তারা সতর্ক হতে পারে”। -(সূরা তাওবা:১২২)

ইমাম কুরতুবী রহ. এ আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বলেন, ‘এ আয়াতের ভাষ্য হলো, জিহাদ ফরজে আইন নয়; বরং ফরজে কিফায়া। যেমনটি ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। কারণ, যদি সকলেই জিহাদে বেরিয়ে পড়ে তাহলে তাদের পশ্চাতে রয়ে যাওয়া পরিবার-পরিজন সংকটে পড়ে যাবে। তাই তাদের একদল জিহাদে বেরিয়ে পড়বে। অপর আরেক দল অবস্থান করবে, দ্বীন শিখবে এবং দেশ রক্ষা করবে; যখন মুজাহিদ বাহিনী জিহাদ থেকে ফিরে আসবে তখন অবস্থানকারী দল যে সব বিধিবিধান শিখেছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর নতুন যে ওয়াহী অবতীর্ণ হয়েছে তাঁদেরকে তা শেখাবে”। -[তাফসীরে কুরতুবী:৮/২৯৩]

২. আল্লাহ তাআলার বাণী,

لا يستوي القاعدين من المؤمنين غير أولي الضرر والمجاهدين في سبيل الله بأموالهم وأنفسهم فضل الله المجاهدين بأموالهم وأنفسهم على القاعدين درجة وكلاّ وعد الله الحسنى وفضل الله المجاهدين على القاعدين أجرا عظيما

“গৃহে উপবিষ্ট মুসলমান- যাদের কোনো সঙ্গত ওযর নেই এবং ঐ মুসলমান যারা জান-মাল দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে, তারা সমান নয়। যারা জান-মাল দ্বারা জিহাদ করে, আল্লাহ তাঁদের পদমর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন গৃহে উপবিষ্টদের তুলনায় এবং প্রত্যেকের সাথেই আল্লাহ কল্যাণের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহ মুজাহিদগণকে উপবিষ্টদের উপর মহান প্রতিদানে শ্রেষ্ঠ করেছেন”।  -(সূরা নিসা:৯৫)

ইবনে কুদামা রহ. জমহুরের মতের সপক্ষে প্রমাণ পেশ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমাদের প্রমাণ لايستوي القاعدون আল্লাহর এ বাণীটি। এই আয়াতটি প্রমাণ বহন করে যে, যখন একটি দল জিহাদ করতে থাকবে তখন উপবিষ্টরা গোনাহগার হিসেবে বিবেচিত হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وما كان المؤمنون لينفروا كافة فلولا نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفقهوا

“আর সকল মুমিনের অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে”।

এই জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিযান প্রেরণ করতেন, আর তিনি নিজ এলাকায় অবস্থান করতেন, তাঁর সাথে অনেক সাহাবীও। কাসানী রহ. বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা মুজাহিদ ও উপবিষ্টদের জন্য কল্যাণের ওয়াদা করেছেন। যদি জিহাদ সব সময়ের জন্য ফরজে আইন হতো তাহলে উপবিষ্টদের জন্য কল্যাণের ওয়াদা করতেন না। বরং বসে থাকা তখন হারাম কাজ হতো।

৩. আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনী লাখয়ানের উদ্দেশ্যে একটি অভিযান প্রেরণ করার সময় বললেন, ‘প্রত্যেক দুই জনের একজন (জিহাদের জন্য) বের হবে। সেইসাথে এও বলে দিলেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সততার সাথে জিহাদে গমনকারী ব্যক্তির পরিবার ও সম্পদের দায়িত্ব গ্রহণ করবে, তার জিহাদে গমনকারী ব্যক্তির অর্ধেক নেকি অর্জিত হবে”।  -[মুসলিম]

যায়েদ ইবনে খালেদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো যোদ্ধাকে আল্লাহর রাস্তার জন্য প্রস্তুত করে দিলো, তাহলে সে যেন নিজেও যুদ্ধ করলো। আর যে সততার সাথে আল্লাহর রাস্তার কোনো যুদ্ধার (পরিবার ও সম্পদের) দেখাশোনা দায়িত্ব নিলো, তাহলে সেও যুদ্ধ কলো”।  -[বুখারী]

৪. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্ম ও অভিযান।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো নিজে অভিযানে বের হতেন, কখনো নিজে বের হতেন না; অন্য একজনকে অভিযানের আমির নিযুক্ত করে পাঠিয়ে দিতেন। আবার সাহাবী সকলেই বের হতেন না; বরং কিছু সাহাবী অভিযানে বের হতেন। আর এটি একটি পরিস্কার বিষয়। গাযওয়ায়ে মুতাসহ আরো অনেক অভিযানে এমনটি হয়েছে। সারাখসী রহ. বলেন, ‘…তার আরেক প্রকার হচ্ছে, ফরজে কিফায়া। যখন কিছু লোক তা বাস্তবায়ন করবে তখন উদ্দেশ্য অর্জিত হয়ে যাওয়ার কারণে অন্যদের পক্ষ থেকেও আদায় হয়ে যাবে। উদ্দেশ্যটি হচ্ছে, মুশরিকদের শক্তি ভেঙ্গে দেয়া, দ্বীনকে উচুঁ করা। তা না করে যদি তা সব সময়ের জন্য সবার উপর ফরজ করে দেয়া হয় তাহলে মূল লক্ষ্যই ব্যাহত হয়ে যাবে। মূল লক্ষ্য হলো, মুসলমানরা যেন নিরাপদে থাকতে পারে এবং দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণকর বিষয়াবলী বাস্তাবায়ন করতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে যখন সকলেই জিহাদে শামিল হয়ে যাবে তখন দুনিয়ার মাসালিহ বাস্তবায়ন করার সুযোগ তাঁদের মিলবে না”। -[আল-মাবসূত লিস-সারাখসী: ৩/১০]

অতএব, আমাদের কাছে স্বীকৃত হয়ে গেলো যে, কাফেরদের সাথে তাদের ভূখণ্ডে যুদ্ধ করা, তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া, যদি গ্রহণ না করে তাহলে তাদের সাথে কিতাল করা অথবা জিযয়া গ্রহণ করা মুসলমানদের উপর ফরজ।

এখন প্রশ্ন হলো, মুসলমানরা এ ফরজ দায়িত্ব কীভাবে আদায় করবে? মুসলমানদের উপর কি কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করা প্রত্যেক মাসেই ফরজ নাকি প্রত্যেক বছরে, নাকি অন্য কোনো ভাবে? এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের দুটি অভিমত রয়েছে,

প্রথম অভিমত:

অধিকাংশের মত হলো, বছরে কমপক্ষে একটি অভিযান পরিচালনা করলে ফরজ আদায় হয়ে যাবে। আর বাকিগুলো নফল হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ব্যাপারে তাঁদের দলীল হলো, জিযয়া ওয়াজিব হয় জিহাদের বদলা হিসেবে, আর জিযয়া বছরে একবারের বেশি ওয়াজিব হয় না। সুতরাং বদলাও এমনই হওয়া চাই।

কুরতুবী রহ. বলেন, ‘ইমামের উপর জিহাদী কাজের দ্বিতীয় আরেকটি ফরজ দায়িত্ব হলো, প্রত্যেক বছর শত্রুর মুকাবেলায় একটি অভিযান প্রেরণ করবে। নিজে সেখানে অংশগ্রহণ করবে অথবা বিশ্বস্ত কাউকে পাঠাবে; যাতে শত্রুদলের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দিতে পারে, তাদেরকে লাঞ্ছিত করতে পারে, তাদের ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিতে পারে এবং আল্লাহর দ্বীনকে তাদের উপর বিজয়ী করতে পারে, যতক্ষণ না তারা ইসলামে দাখিল হয় কিংবা নিজেদের হাতে জিযয়া প্রদান করে। আরেক প্রকার জিহাদ আছে, যার নাম নফল জিহাদ। তা হলো, ইমাম একের পর এক দল পাঠিয়ে সুযোগ বুঝে অভিযান প্রেরণ করবে। স্পর্শকাতর জায়গায় প্রহরার ব্যবস্থা করবে এবং শক্তি প্রদর্শন করবে”।  -[তাফসিরে কুরতুবী: ৮/১৫২]

দ্বিতীয় অভিমত:

সময় নির্ধারণ করা ছাড়া কাফেরভূখণ্ডে কাফেরদের সাথে যখন সম্ভব হয় তখনই যুদ্ধ করা ওয়াজিব। ইবনে হাজার রহ. এ বক্তব্য সম্পর্কে বলেন, وهو قويّ ‘এ অভিমতটি শক্তিশালী”। -[ফাতহুল বারী: ৬/২৮]

কুরতুবী রহ. বলেন,

والتثاقل عن الجهاد مع إظهار الكراهة حرام

“বিতৃষ্ণা প্রকাশের মাধ্যমে জিহাদকে কঠিন মনে করা হারাম”।  -[কুরতুবী:৮/১৪১]

এ বক্তব্যটি যদিও অধিকাংশের বক্তব্য নয়; তথাপি আমার দৃষ্টিতে এর মাধ্যমেই দায়িত্বমুক্ত হওয়া সম্ভব। -আল্লাহ তাআলাই সঠিকতা সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। তার কারণ এই,

১. জিহাদ নির্দেশিত নসগুলো কোনো সময় নির্ধারণ করে দেয়নি। সুতরাং সময় নির্ধারণ নসের উপর অতিরিক্ত করণের অন্তর্ভুক্ত। আর জিযয়ার ব্যাপারে যে বক্তব্যটি উল্লেখ করা হয়েছে যে, তা বছরে একবার ওয়াজিব হয়, যা জিহাদের বদলে নির্ধারিত- যুক্তিটি মেনে নেয়া যায় না। জিযয়া একটি স্বতন্ত্র শরঈ বিধান। যার পেছনে রয়েছে অনেক হেকমত। যেমন, এর মাঝে রয়েছে কাফেরদের অপমান, মুমিনদের সম্মান। কাফেরদেরকে ইসলামের বিধিবিধান অনুযায়ী মসলমানদের সাথে উঠাবসা করার সুযোগ দেয়া হয়; তাদের মধ্যে যে কল্যাণকে বুঝতে চায় সে যেন ইসলামের আদর্শপূর্ণ বিধিবিধান দেখে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং জিযয়া সাধারণভাবে জিহাদের বদলে আবশ্যকীয় বিধান- এ কথা বলা যাবে না। মুসলমানরা নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত কাফেরদের সাথে সন্ধিচুক্তি করতে পারে, সন্ধির সময়ে তাদের সাথে কিতাল করতে পারে না- তাই বলে সন্ধিকে জিহাদের বিকল্প বলা যায় না।

 

২. কাফেরদের সাথে কাফেরভূখণ্ডে জিহাদ করতে হবে যখনই সম্ভব হয়- এটি জিহাদের উদ্দেশ্যের উপযুক্ত একটি মত। কেননা জিহাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্দেশ্য হলো, যমিন থেকে বিশৃঙ্খলা দূর করা এবং গোটা পৃথিবীতে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা। জিহাদের ফরজ দায়িত্ব মুসলমানদের পক্ষ থেকে ততক্ষণ আদায় হবে না, যতক্ষণ না চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত হয়। আর তা হলো, গোটা পৃথিবীর কর্তৃত্ব হাতে নেয়া। এমনকি একজন ব্যক্তিও এমন থাকবে না, যে ইসলামের হুকুমের সামনে মাথা নাত করেনি।

অথবা তাঁরা জিহাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথে তাঁদের চেষ্টা ব্যয় করে যাবে। তখনই কি তাঁদের ওয়াজিব দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে? না; কারণ জিহাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারিত একটি বিষয়। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এ কথা বলা যাবে যে, তাঁরা তাঁদের সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছে। আর আল্লাহ তাআলা কোনো ব্যক্তিকে তার সাধ্যের বাইরে চাপিয়ে দেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

فاتقوا الله ما استطعتم

এই জন্য ইবনে হাজার রহ. ‘জিহাদ যখন সম্ভবপর হয় তখন ওয়াজিব’ এ বক্তব্য সম্পর্কে বলেন, এটিই শক্তিশালী অভিমত, যেমন পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। সেইসাথে বছরে একবার অভিযানে বের হওয়ার দ্বারা ফরজ দায়িত্ব আদায় হয়ে যায়- এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, অনেক সময় মুসলমানদের শাসনভার এমন ব্যক্তির হাতে পড়ে যায়, জিহাদ বিষয়ে শিথিলতা পোষণের কারণে ইসলাম প্রচার কাজে যাদের মাঝে যথেষ্ট পরিমাণ ইখলাস থাকে না। তাছাড়া বছরে মাত্র একটি অভিযান প্রেরণ করাকে ওয়াজিব দায়িত্ব আদায়ের জন্য যথেষ্ট হিসেবে গণ্য করা যায় না। যার প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট ইসলামের কোনো কোনো যুগে কিছু কিছু মুসলিম শাসকের দুর্বল সময়কাল এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ রেখে অনর্থক কাজে তাদের পড়ে থাকা।

 

. কাফেরদের সাথে যুদ্ধের বিষয়টি ‘সম্ভব’ হওয়ার সাথে জুড়ে দেয়া, নির্দিষ্ট সময়ের সাথে জুড়ে দেয়ার চেয়ে উত্তম। কেননা জিহাদের অর্থ হলো, কাফেরদের সঙ্গে জিহাদ করতে গিয়ে নিজের চেষ্টা ও শক্তি ব্যয় করা। জিহাদের সম্পর্ক নির্দিষ্ট কোনো এক পদ্ধতির সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় যে, তাই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে। বরং মুসলমানদের উপর ওয়াজিব হলো, সক্ষমতার সময় তাঁদের পার্শ্ববর্তী কাফেরদের সাথে জিহাদ করা। ইবনে আবিদীন রহ. রদ্দুল মুহতারের টিকায় উল্লেখ করেন,

وإياك أن تتوهم أن فرضيته تسقط عن أهل الهند بقيام أهل الروم مثلا

‘তুমি এসব অলিক ধারণা থেকে বেঁচে থাকো, যেমন ধরো, রোমানদের জিহাদ করার দ্বারা হিন্দবাসীদের পক্ষ থেকে জিহাদের ফরজ দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে”। -[হাশিয়া রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৪]

 

উলামায়ে কেরামের ভাষ্য মতে যেসব অবস্থায় কাফেরদের সাথে তাদের ভূখণ্ডে জিহাদ করা ফরজে আইন- তা এই,

১. যখন মুসলিম বাদশাহ নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে জিহাদের জন্য নির্ধারণ করে দেবেন।

২. যখন জিহাদের ব্যাপক নির্দেশ আসবে। এভাবে যে, বাদশা কোনো গ্রামবাসী বা কোনো এলাকার সকলকে জিহাদে বের হতে বলেন।

৩. যখন মুসলমানদের কোনো ব্যক্তি কাফেরদের হাতে বন্দি হয়, তখন তাদের হাত থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনার আগ পর্যন্ত জিহাদ ফরজ।

৪. কাফেরদের সাথে কিতাল চলাকালে যখন কোনো মুসলমান মুসলিম বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়, তখন তার উপর জিহাদ ফরজ হয়ে যায়।

 

মুসলমানদের উপর আক্রমণাত্মক ও প্রারম্ভিক জিহাদ ওয়াজিব হওয়ার জন্য পাঁচটি শর্ত:

১. মুকাল্লাফ (যার উপর শরীয়তের বিধিবিধান আরূপিত হয়)।

২. ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকা।

৩. পুরুষ হওয়া।

৪. সক্ষমতা।

এসব শতের্র আলোচনা ফিকহী কিতাবগুলোতে ভরপুর রয়েছে।

এতক্ষণ আমরা যে বিষয়টি উলামায়ে কেরাম সুত্র দিয়ে আলোচনা করলাম তা অনেক দীর্ঘ। এখানে শুধু আক্রমণাত্মক জিহাদ ফরজ হওয়ার বিষয়টি তাঁদের কিছু হাওয়ালা এনে প্রমাণ করা হয়েছে। যদিও আক্রমণাত্মক জিহাদ ফরজ হওয়ার ব্যাপারে তাঁদের অনেক বক্তব্য ও বিপুল পরিমাণ দলীল রয়েছে। তারপরও ইলমের দাবিদার কিছু লোককে আল্লাহ তাআলা অন্ধ বানিয়ে রেখেছেন। তারা জিহাদ বলতে প্রতিরক্ষামূলক জিহাদই বুঝে। তারা জিহাদকে প্রতিরক্ষামূলক জিহাদের সাথে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। নসসমূহের গলা চেপে ধরে, উলামায়ে কেরামের বক্তব্যের এদিক সেদিক ব্যাখ্যা দিয়ে আক্রমণাত্মক জিহাদ ও কাফেরদের সাথে কাফেরভূখণ্ডে জিহাদ করা ফরজ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করার চেষ্টা চালিয়েছে। কখনো তারা

وقاتلوا في سبيل الله الذين يقاتلونكم ولا تعتدوا إن الله لا يحب المعتدين

“তোমরা আল্লাহর পথে কিতাল করো তাদের সাথে, যারা তোমাদের সাথে কিতাল করে। আর সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না”।

আল্লাহর এ আয়াত দিয়ে দলীল পেশ করে। কখনো তারা ইসলামের সরলতাকে ব্যবহার করে বলে, আল্লাহর বাণী لاإكراه في الدين ‘দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ী নেই, ইসলাম মানুষদেরকে বাধ্য করেনি সেখানে প্রবেশ করতে। ইসলাম বলেনি, বল প্রয়োগ করে ইসলামে দাখেল করার জন্য কাফেরদের উপর আক্রমণ করতে, তাদের ভূখণ্ডে গিয়ে তাদের সথে যুদ্ধ করতে- এসব উক্ত আয়াত বিরোধী কাজ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মিথ্যা দাবি করে বলে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভিযানগুলো প্রতিরক্ষামূলক ছিলো, আক্রমণাত্মক ছিলো না। ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক দলীল ও অলিক ধারণার মাধ্যমে তারা এমন বিধানকে মিটিয়ে দতে চায়, যে ব্যাপারে রয়েছে মুতাওয়াতির নস, উলামায়ে কেরামের অগণিত বক্তব্য, আর যুগ যুগ ধরে উম্মতের আমল। তার অবস্থা হলো ঐ ব্যক্তির অবস্থার মত, যে সূর্যের আলোকে হাতের তালু দিয়ে ঠেকাতে চায়।

আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য এবং তাদের জন্য হিদায়াত ও সত্য পথের উপর অবিচলতা কামনা করি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen + 20 =

Back to top button