গোত্রপ্রেম ও গোত্রীয় জাত্যাভিমান -মুহাম্মাদ আবদুস সালাম ফারাজ
গোত্রপ্রেম ও গোত্রীয় জাত্যাভিমান
মুহাম্মাদ আবদুস সালাম ফারাজ
জাহেলি যুগে আরবের লোকদের গোত্রপ্রেম, গোত্রীয় জাত্যাভিমান ছিল কিংবন্দীতুল্য। এটি ছিল এমন এক বিষয় যা দিয়ে তাদের উত্তেজিত ও উদ্বুদ্ধ করা ছিল খুব সহজ। ভালোখারাপ উভয় দিকে একে প্রবাহিত করা যেতো। এটি ছিল তাদের পরিচয়, আত্মমর্যাদাবোধ, কালচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলাম গ্রহণের পরও সাহাবায়ে কেরাম রা. এর অনেকের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে এই বোধ কাজ করতো। সীরাতের কিতাবাদিতে এমন বহু উদাহরণ আছে। একটি উদাহরণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
.
ইসলাম গ্রহনের আগে মদীনার আওস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই ছিল। এ ছিল এক জাতী দুশমনি, যা চলছিল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। নবী সা. এর দাওয়াত শুরু হবার কিছুদিন পূর্বে এই দুই গোত্রের মধ্যে বুআসের যুদ্ধ নামে এক চরম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দুই গোত্রের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এ যুদ্ধে মারা যায়। তবে ইসলাম গ্রহণের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। আল্লাহ তাঁদের অন্তরগুলোকে একসাথে জুড়ে দেন। আনসারী গোত্র আওস ও খাযরাজের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও মিলমোহাব্বত দেখে মদীনার ইহুদীরা ঈর্ষান্বিত হয়। এই বন্ধন নষ্ট করার জন্য শাশা বিন কায়েস নামের এক বুড়ো ইহুদী চক্রান্ত করে। সে এক ইহুদী যুবককে আওস ও খাযরাজের মজলিসে পাঠায়। সেই ইহুদী আওস ও খাযরাজের অভিজাত ব্যক্তিদের সামনে বুআস যুদ্ধ ও তার আগের কথা নিয়ে আলোচনা শুরু করে। ঐসময়ে যেসব কবিতা আবৃত্তি করা হয়েছিল তা আবৃত্তি করতে শুরু করে।
.
আরবীয় গোত্রপ্রেম ও জাত্যাভিমান মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। আওস ও খাযরাজে গোত্রের লোকের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। শুরু হয় ঝগড়া। এক পর্যায়ে দুই গোত্রের পক্ষ থেকে একজন করে প্রতিনিধি হাঁটু গেড়ে বসে নিজেদের গোত্রীয় সাফল্য বর্ণনা করতে শুরু করে। শেষমেষ একজন বলে বসে, যদি চাও, তাহলে আমরা সেই যুদ্ধ আবার তাজা করে দিতে পারি। এরপর দুই গোত্র ক্ষেপে গিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। হাবরা নামক জায়গায় গিয়ে যুদ্ধ হবে এমন তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। অস্ত্র নিয়ে চলে হাবরার দিকে যাত্রা। পথিমধ্যে নবী করীম সা. এসে তাঁদের নিরস্ত করেন। তিনি সা. বলেন, তোমরা কি আমার জীবদ্দশাতেই জাহেলিয়াতে ফিরে যাচ্ছো? এভাবে তিনি সা. তাঁদেরকে বুঝাতে সক্ষম হন। আনসারীরা সাহাবীগণ রা. তাঁদের ভুল বুঝতে পেরে আফসোস করেন। একে অপরকে জড়িয়ে কান্না শুরু করেন। মহান আল্লাহ তাঁদের অন্তরগুলোকে আবারো এক করে দেন। এবং তাঁরা সীসাঢালা প্রাচীরের মতো ইসলামের জন্য দাঁড়িয়ে যান।
.
সুবহানাল্লাহিল আযীম! চিন্তা করে দেখুন, পুরো বিষয়ের শুরু ইতিহাস আর কবিতা নিয়ে আলোচনা থাকে। কতো ছোট, এবং আপাত নির্দোষ বিষয় থেকে এমন পরিস্থিতির তৈরি হল। আমার কাছে মনে হয়, আকিদাহ এবং মাসলাকগত যে তর্ক আহলে সুন্নাহর ভিতরে চালু আছে তার তুলনা অনেকটা আরবের এই গোত্রপ্রেম আর জাত্যাভিমানের মতো। এটি ভালো নাকি খারাপ, প্রশংসনীয় নাকি নিন্দনীয়, আমি তা নিয়ে মন্তব্য করছি না। আমি কেবল বলছি যে নিজ দলের প্রতি এই জযবা, এই গায়রত বাস্তব। এটিই হল মোদ্দা কথা। গোত্রের বিরুদ্ধে বলে, গোত্রকে ছোট করে কিংবা যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কারণে আনসারীদের মধ্যেও জাত্যাভিমান জেগে উঠেছিল। সেই জায়গায় আমরা কারা। গোত্রের জায়গায় যেমন অনেক বুঝ, অনেক সুবিবেচনাবোধ, অনেক জ্ঞান অকার্যকর হয়ে যেতো তেমনটি আমাদের এসব তর্কের ক্ষেত্রেও ঘটে। অনেক বুঝদার এই সকল বিষয়ে অবুঝ হয়ে যান।
.
যখন নিজের মাসলাক, নিজের অবস্থানের ব্যাপারে কথা উঠে তখন মানুষ একটি সীমা পর্যন্ত ধৈর্য্য ধারণ করে। কিন্তু এক পর্যায়ে সে আর সবর করতে পারে না। তার যতোই বুঝ থাকুক, সে যতোই এ ব্যাপারগুলোর নাজুকতা বুঝুক না কেন, সেগুলো বিস্মৃত হয়। জযবাতি হয়ে উঠে। মানুষের মুখ ছুটে যায়। এতোদিন যাকে অন্তর দিয়ে মুহাব্বাত করেছে, হঠাৎ দেখা যায় তার ব্যাপারে এমন কিছু সে বলে বসেছে যা আগে অচিন্তনীয় ছিল। দুইজনের কেউ কখনো হয়তো আগে ভাবেইনি যে আমি তার ব্যাপারে এমন বলবো বা সে আমার ব্যাপারে এমন বলবো। কিন্তু ঐ মাসলাকী আত্মমর্যাদাবোধ, জাত্যাভিমানের জযবা আগের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আমার বিশ্বাস, ফেবুতে আকিদাহগত যে বিতর্ক চলছে তা যদি ভালো করে কেউ খেয়াল করেন তাহলে বিষয়টির সত্যতা তারা অনুধাবন করতে পারবেন। এই অবস্থায় এমন দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলার উপায় হল এই বিষয়ে পাবলিকভাবে তর্কে না জড়ানো। এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকা যা তর্ক জন্ম দিতে পারে। আমি অনেক ভেবে দেখেছি, এই দ্বন্দ্ব এড়ানোর আর কোন উপায় আমার জেহেনে আসেনি। কারণ একবার এই তর্ক শুরু হলে, কেউ আর এটিকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না।
.
এখন দুইটি কথা আসে। প্রথম কথা হল, গোত্রপ্রেম বা আসাবিয়াত ইসলামে নিন্দনীয় বিষয়। আর আকিদাহর জ্ঞান প্রশংসনীয় বিষয়। দুইটির তুলনা হয় না। জি, একথা সত্য। আমি স্বীকার করি। তবে আমি দুইটি বিষয়ের মধ্য তুলনা করছি না। আমি দুইটির সাথে যুক্ত আবেগের তুলনা করছি। দুইটি বিষয় একরকম নয়। কিন্তু দুইটির সাথে যুক্ত আবেগ ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ অনেকাংশে একরকম। উভয় ক্ষেত্রেই শেষ কথা হল এই জযবা, এই গায়রত বাস্তব। এবং এটি মাথা চাড়া দিবেই। কাজেই আমি যদি এই দ্বন্দ্ব এড়িয়ে যেতে চাই তাহলে আমাকে এটি সত্য জেনেই কাজ করতে হবে যে এই বিষয়টি নাজুক এবং বেশি নাড়াচাড়া করলে এটি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবে।
.
দ্বিতীয় কথা হল, তাহলে কি মানুষ আকিদাহর আলোচনা করবে না? নিজের আকিদাহর চর্চা করবে না? এই ক্ষেত্রে আমার উত্তর হল, জি তারা করবে। যারা তাওহিদ ও জি(হা)দের মানহাজের তারা যদি নাও করেন, তবুও কেউ না কেউ অবশ্যই করবে। তাই এক্ষেত্রে করণীয় হল এই আলোচনাগুলো পাবলিকভাবে না করা। কেউ এটা গ্রুপে করতে পারে। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে করতে পারে। কেউ নিজের আকিদাহ নিয়ে হয়তো একটি পর্যায় পর্যন্ত লিখতেও পারে। কিন্তু এর বেশি অগ্রসর না হওয়া। এবং সকল এটি মাথায় রাখা যে দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ না দেওয়া। যারা এই মানহাজকে ধারণ করেন, এর পক্ষে প্রচারণা চালান এবং মোটামুটি পরিচিত, তাঁদের উচিত এই বিষয়গুলো শক্তভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। দায়িত্বশীল আচরণ করা। আর এটিও সত্য যে আসমা ওয়াস সিফাত নিয়ে ফেবুর লেখকরা এমন কোন খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন না যা এর আগে উলামায়ে কেরাম করেননি। এই বিষয়ে মৌলিক কিছু কিন্তু কেউ যুক্ত করছে না।
.
আকিদাহর আলোচনা জরুরী, আকিদাহর চর্চা জরুরী, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই অংশগুলো পুরো পাবলিক প্লাটফর্মে না আনা। বিষয়টি দয়া করে ভুল বুঝবেন না। আমি আকিদাহর মতো বিষয়ে আলোচনার বিরোধিতা করছি না। আমি কেবল বলছি যে উম্মাহর অবস্থা, পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী এই বিবেচনা, কিংবা সেক্রিফাইস আমাদের উভয়পক্ষকে করতে হবে। কখনো কোন একদিকে সেক্রিফাইস বেশি হবে, কখনো আরেক দিকে। এইটুক ছাড় দিতে হবে। এইটুকু বুঝতে হবে। নইলে অনেক মেহেনত করে তৈরি করা অনেক রাস্তা ভেঙ্গে যাবে। যা উভয়পক্ষের কেউই চায়না। তবে যারা সকল ইস্যুকে মাসলাকের স্কোরকার্ড হিসাবে দেখে তাদের কথা আলাদা। যারা একদিকে তাওহিদ ও জি(হা)দের মানহাজ সমর্থনের কথা বলে অন্যদিকে তর্ক দেখে আত্মতৃপ্তি অনুভব করে, সন্তুষ্ট হয়, ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তাদের কথা আলাদা। যারা মনে করে, ‘গতকাল আমরা শুনেছি, আজ ওরা শুনুক। আগে আমার মন জ্বলেছে এখন ওদের জ্বলুক। এমন হোক, আরও হওয়া উচিত’, তাদের কথা আলাদা। এইসব ভাইয়েরা সিলেবাসের বাইরে থাকুক।
.
আমি আবারো বলছি আমার কথাগুলো ঢালাওভাবে সবার জন্য নয়। আমি সকলকে উদ্দেশ্য করে এটি বলছি না, কারণ সর্বদাই এমন কেউ না কেউ থাকবে যারা কোন না কোন ইখতেলাফ নিয়ে তর্ক করবেই। তাই মেহেরবানি করে এই যুক্তি দিবেন না যে, ‘অমুক তো এতো বছর ধরে এসব বলছে আপনি তাকে কিছু বলেন না কেনো? আমি শুধু শুধু ঐসকল ভাইদের উদ্দেশ্য করে বলছি, যারা মনে করেন যে আকিদাহর এই পার্থক্য সত্ত্বেও আমরা কুফফার ও মুরতাদ্দীনের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে লড়াই করতে পারি। যারা মনে করে আসারি-মাতুরিদি ইখতেলাফ আছে, এ ইখতিলাফে আমি আমার অবস্থান সঠিক মনে করি, কিন্তু আমি একে জি(হা)দের কাজের প্রতিবন্ধক মনে করি না। আমার এই কথাগুলো ঐ সালাফি ভাইদের জন্য যারা মনে করেন যে আমার মাতুরিদি ভাইয়ের রক্ত আমারই রক্ত, আমার আশআরী ভাইয়ের সম্মান আমারই সম্মান। যখন শাহবাগীরা দ্বীনের বিধান বর্ণনা করার কারনে দেওবন্দি আলিমদের অসম্মান করেন তখন সেটি আমার পিতাকে অসম্মান করার মতোই। আমার এই কথাগুলো ঐসব ঐ মাতুরিদি ভাইদের জন্য যারা বিশ্বাস করেন যে সকল মতপার্থক্যের পরও আমার সালাফি ভাই আর আমি একই কাফেলার। তাঁর জীবন আর আমার জীবনে কোন পার্থক্য নেই। যখন কুফফার সালাফি উলামায়ে কেরামকে খাসভাবে টার্গেট করে প্রচারণা চালায়, তখন সেটা আমার গায়ে এসেই লাগে। এই বিশ্বাস ও এই চেতনা যাদের আছে এই কথা তাদের জন্য।
.
কেউ একে ‘চৌকস’ মানহাজ মনে করতে পারেন। কেউ ‘কসমেটিক ঐক্য’ বলতে পারেন। তবে এই বিষয় নিয়ে গত প্রায় এক দশক যাবত বিভিন্ন তর্কবিতর্ক দেখার পর এটি আমার উপলব্ধি। পাঠক অবশ্যই দ্বিমত করতে পারেন।