কৌশল অধ্যয়ন – শাইখ আবু উবাইদ আল কুরাইশী
কৌশল অধ্যয়ন
শাইখ আবু উবাইদ আল কুরাইশী
ক্রুসেডার ইহুদী খৃস্টানরা মুসলিমদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। ক্রুসেডারদের লক্ষ্যবস্তু ‘আরব’ অঞ্চলকে ঘিরে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ইসলামী ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে সত্যিকার মুসলিম যুবকগণ দৃঢ়তা, আন্তরিকতা ও তীব্র স্পৃহা সহকারে যে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মুসলিমদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একদিকে ক্রুসেডার খ্রিষ্টান ও ইহুদীবাদী নেতারা, তাদের নতুন বিজয় পরিকল্পনার ছক চূড়ান্ত করছে। অন্যদিকে, বিশ্বাসঘাতক আরব সরকারগুলো একাজে ক্রুসেডারদের প্রায় সকল বাধা-বিপত্তিকে সহজ করে দিচ্ছে। অথচ ক্ষমতা বা শক্তির আপাত ভারসাম্য ক্রুসেডারদেরই পক্ষে।
তবে, সাদা স্লেটের মধ্যকার ছোট কালো দাগটি যেভাবে ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হচ্ছে, তা নিয়ে তারা খুবই চিন্তিত। এ দাগটি খুব শীঘ্রই একটি বৃহৎ দাগে পরিণত হবে। পরবর্তীতে যা পুরো স্লেটে রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করবে। এই কালো দাগটি হল, দুই দশক পূর্বে সংঘর্ষে প্রবেশকারী ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাকারী দল। এ দলটি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পর থেকেই দূর্দান্ত, দাপুটে শক্তিগুলো পরাজয়ের স্বাদ আস্বাদন করছে। এটি এমন এক চেতনা লালনকারী দল যাকে সংঘাত থেকে সরানো কখনোই সম্ভব নয়।
আমার কথার অর্থ এটা নয় যে, মুজাহিদগণ পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি না নিয়েই গন্তব্যহীন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবেন। বারবারই বলা হয়েছে – জিহাদের ময়দানে যেভাবে আধুনিক জাগতিক প্রযুক্তির অনুগামী হয়ে জিহাদ করতে হয়, ঠিক তেমনি তাতে শরয়ী নিয়ম-পদ্ধতির প্রতিও খেয়াল রাখতে হয়।
আল্লাহর অনুগ্রহ যে, এমন জিহাদের কার্যকর প্রয়োগ আফগানিস্তানসহ আমাদের অন্য স্থানসমূহের মুজাহিদ ভাইদের মধ্যে বিদ্যমান। তাই যুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ক্ষেত্রে কোনোরুপ অজ্ঞতাই এখন আর ওজর হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। যেহেতু এ-বিষয়ের আদর্শ আমাদের সামনে রয়েছে।
অবশ্য অনেক মুসলিম যুবক ক্রুসেডারদের এই আক্রমণের বিরুদ্ধে ঈমানী তাবুতে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছুক। তাঁদের অনেককেই ইতিমধ্যে জিহাদের ইসলামি নিয়ম কানুন,পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে এবিষয়ক শরয়ী নিয়ম-পদ্ধতির দিকটিতে বিগত বছরগুলিতে খুব বেশী গুরুত্বসহ আলোকপাত করা হয়েছে। আর আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ইসলামিক কুতুবখানায় বা লাইব্রেরীতে এ-বিষয়ক মূল্যবান কয়েকটি কিতাবও সংযোজন করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
তবে, নতুন মুজাহিদগণ ইসলামিক গ্রন্থাগারে যুদ্ধের জাগতিক নিয়ম-পদ্ধতি বিষয়ক, বিশেষত: সামরিক সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত রণকৌশল সম্পর্কিত গ্রন্থের শূণ্যতা অনুভব করবেন। সম্ভবত সে শূন্যতা পূরণের পথে এই নিবন্ধটি কিছুটা সাহায্য করবে ইনশা আল্লাহ।
এটি সবারই জানা যে, আধুনিক সেনাবাহিনীগুলো তাদের সামরিক তত্ত্বগুলো প্রাচীন ও আধুনিক সমর তত্ত্ববিদদের থেকে আহরণ করে থাকে। প্রাচীনদের মধ্যে সমর বিদ্যায় যেসমস্ত সমরবিদদের সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়া হয়, তাদের মধ্য থেকে একজন হল, জার্মান (প্রুশিয়ান) জেনারেল কার্ল ফন ক্লাউসেভিতস (Clausewitz), যার তত্ত্ব সমস্ত আধুনিক সেনাবাহিনীকে প্রভাবিত করেছে, বিশেষ করে জায়নিস্ট ও আমেরিকান সেনাবাহিনীকে। তারা, তার তত্ত্বগুলো একবাক্যে গ্রহণ করে নিয়েছে।
কিছু লোক একথা জেনে অবাক হতে পারে যে, দুই শতাব্দী পূর্বের এই সমর লেখক বর্তমান সময়েও কীভাবে অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে? একবিংশ শতাব্দীর রণকৌশলের জন্য কীভাবে সে গুরুত্বপর্ণ রেফারেন্স হিসেবে গণ্য হতে পারে? আশ্চর্যজনক হলেও বাস্তবতা এটিই!
তার প্রধান বই “দ্যা ওয়ার” কয়েক ডজন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন একাডেমিতে তা থেকে পাঠদান করানো হয়। এটি এমন এক মূল্যবান বই যা দশ বছর সময় ব্যয় করে ক্লাউসেভিতস রচনা ও সংশোধন করেছে। তারপরেও সে এটিকে সম্পূর্ণ করে যেতে পারেনি। বইটি তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইটি যে বিষয়ের উপর ভিত্তি করে লিখা হয়েছিল তা হল -আমাদের অবশ্যই যুদ্ধকে ভালভাবে বুঝতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে। যুদ্ধের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে, তার লক্ষণগুলো বৈচিত্র্যসহ অনুধাবণ করতে হবে। যুদ্ধকে কখনোই এ দৃষ্টিতে দেখা যাবে না যে, এটা একটি বিশৃঙ্খল বিষয়। যদি তাকে এ দৃষ্টিতে দেখা হয় তাহলে, তা হবে নিরেট হঠকারিতা। যা স্বাভাবিক অবস্থা বিনষ্ট করবে এবং রাজনৈতিক ইতিহাসে অচলাবস্থা সৃষ্টি করবে। তাই আমাদের অবশ্যই যুদ্ধ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান অর্জন করতে হবে, যদি আমরা নিজেদের মত করে যুদ্ধে জয়ী হতে চাই।
ক্লাউসেভিতস এর বিশ্লেষণাত্মক উপলব্ধিটি তার সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্ভব হয়েছে। তার কাজের ক্ষেত্রগুলো ছিল – যুদ্ধের প্রকৃতি নির্ণয়, যুদ্ধের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক নির্ণয়, আক্রমণের তীব্রতা, যুদ্ধ পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের পার্থক্য নিরুপণ ইত্যাদি।
যাইহোক, আমার দৃষ্টিতে তার কাছ থেকে প্রাপ্ত রণকৌশলগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলটি হল – মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের ধারণা। আমি সঠিক সংখ্যাটা বলতে পারছি না, সম্ভবত এই শব্দটি তার গ্রন্থে পঞ্চাশেরও অধিক বার এসেছে।
মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র – এটি পদার্থবিজ্ঞানের একটি থিউরি। পদার্থবিজ্ঞান শরীরের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের পরিচয় দিতে গিয়ে বলে – এটি এমন এক বিন্দু, মহাকর্ষীয় উত্তেজনা (বা ওজন) যার ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে (এটি এমন এক বিন্দু, সমস্ত শরীরের মহাকর্ষীয় ওজন এই একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত থাকে)।
ক্লাউসেভিতস তার যুদ্ধসংক্রান্ত থিওরিকে যৌক্তিক করার প্রয়াসে মহাকর্ষ কেন্দ্রের ধারণাটি গ্রহণ করেছে। সে সফলভাবে রণকৌশলের ক্ষেত্রে এ ধারণাটি প্রয়োগও করেছে। এই জেনারেল ধরে নিয়েছে যে, প্রতিটি একক নিয়ন্ত্রিত নিয়মতান্ত্রিক সেনাবাহিনীর একটি কেন্দ্র থাকে, যা বাহিনী এবং যুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণ করে। এবং যার উপর সবকিছু নির্ভরশীল হয়ে থাকে। এই কেন্দ্রের নাম হল মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র।
ক্লাউসেভিতস তার রচিত “দ্য ওয়ার” বইয়ে উল্লেখ করেছে, ‘প্রতিটি রণকৌশলের পরিকল্পনার পিছনে দুটি মূলনীতি রয়েছে, যে মূলনীতিদ্বয় অন্য সব বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।
প্রথম মূলনীতি হল, যুদ্ধ পরিকল্পনার সময় শত্রুর মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র সম্পর্কে অবগত হওয়া।
দ্বিতীয় মূলনীতি হল, বড় কোনো আক্রমণের সময় সেই মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সমস্ত বাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা।
ক্লাউসেভিতস আবিষ্কৃত এ তত্ত্বটি (কোনো গবেষণা ব্যতীত) শূন্য থেকে উদ্ভব হয়নি। বরং সে কয়েক ডজন যুদ্ধকে যত্নসহকারে অধ্যয়নের পরে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, একটি বাহিনীর অবশ্যই মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র থাকবে। এই মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র খোদ সেনাবাহিনীতেও হতে পারে, আবার হতে পারে নেতাদের ব্যক্তিত্বে। তা রাজধানীতে বা মিত্রজোটের মধ্যেও হতে পারে।
এই সমর তাত্ত্বিকের মতে মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র শক্তির উৎস নয়। তবে মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের দায়িত্ব হল, বাহিনীর ইউনিট বা গ্রুপগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন করা। এমনকি তার মতে সেনাবাহিনীও শক্তির মৌলিক কোনো উৎস নয়। বরং তারা বিভিন্ন উৎস থেকে আগত বাহিনীর জন্য একটি সম্মিলিত ও সংগঠিত হবার ক্ষেত্র – যেখানে কিছু লোক নিয়োগ দেয়া থাকে। এছাড়া থাকে একটি সামরিক গবেষণা কেন্দ্র – যা অস্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহ করে। আরও থাকে একটি কৃষি ব্যবস্থাপনা – যা প্রধানত খাদ্য সরবরাহ করে। একই কথা অন্যান্য মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রগুলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন – নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিবর্গ ও জোট ইত্যাদি।
ক্লাউসেভিতসের তত্ত্বগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কার্যকর হয়েছিল। তবে তারা ভাল করে এ তত্ত্বটি তখন পূর্ণাঙ্গরুপে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ক্লাউসেভিতসের তত্ত্বগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যদিয়ে ময়দানে বিবাদমান পক্ষগুলোর সামরিক ধ্যাণ-ধারণায় সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করে নেয়। বিশেষত, যুদ্ধে প্রবেশকারী নাৎসি সেনাবাহিনী বেশ কয়েকটি সামরিক ধারণা বাস্তবায়নের কারণে অপ্রতিরোধ্য ছিল। বোলগনা এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে নাৎসি জার্মানি পরিচালিত দ্রুত ও সফল অভিযানগুলি নাৎসি সেনাবাহিনীর উপর ক্লাউসেভিতসের প্রভাবের উদাহরণ মাত্র। কিন্তু মিত্রশক্তি তাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আক্রমনের মাধ্যমে এই ধূর্ত চিন্তাধারা থেকে বিশেষত মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের ধারণা থেকে আরও বেশি লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেছিল।
মিত্রশক্তি, হিটলারের ধারাবাহিক জনসমর্থন লাভের সক্ষমতাকে জার্মানির মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করেছিল। তবে, যুদ্ধের শুরুতে অপারেশনাল স্তরে মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র হিসেবে বিশেষ ইউনিট, বিমানচালনা, যান্ত্রিক এবং সাঁজোয়া ইউনিটগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। অথচ, সেসময় জার্মান সেনাবাহিনীর রণ কৌশলের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র ছিল পাল্টা আক্রমনকারী অস্ত্র ও বিমানগুলি।
দুই দশক পরে আমেরিকা ভিয়েতনামে যে পরাজয়ের স্বীকার হয়েছে, তার পেছনে মার্কিন নেতৃত্ব যথোপযুক্ত সামরিক তত্ত্বের অনুপিস্থিতি ব্যতীত অন্য কোনো সন্তোষজনক কারণ খুঁজে পায়নি। যা ক্লাউসেভিতসের তত্ত্ব সম্পর্কে আমেরিকার যথাযথ ধারণা না থাকার প্রমাণ। অথচ, তখন ক্ষমতার ভারসাম্য পুরোপুরি আমেরিকার পক্ষেই ছিল। আমেরিকানরা ভিয়েতনামীদের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র নির্ধারণ করতে না পারায় যুদ্ধক্ষেত্রে এক ধরণের অস্থিরতায় নিমজ্জিত ছিল। এজন্য কখনো তারা উত্তর-দক্ষিণের যোগাযোগ রুট বিচ্ছিন্ন করার জন্য বোমা বর্ষন করেছিল। আবার কখনো নির্মমভাবে বোমা বর্ষন করেছিল উত্তর ভিয়েতনামে।
এই যুদ্ধে মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র কী ছিল? কোথায় ছিল? তা নিয়ে এখনও অবধি মার্কিন সেনাবাহিনীর মধ্যে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে, ভিয়েতনামীরা সম্পূর্ণরুপে অবগত ছিল যে, আমেরিকার মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র আমেরিকার জনগণ আর তাই তাদের জনগণের ক্ষতি করা গেলে, তারা যুদ্ধ থামিয়ে দিতে বাধ্য হবে। এবং বাস্তবে তাই হয়েছিল। ভিয়েতনামীদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সূচনালগ্নে আমেরিকা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের তত্ত্বে বেশি বিশ্বাসী ছিল। এটি তাদের সামরিক বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সামরিক কৌশলগত স্তরে এসে মার্কিন সামরিক মতাদর্শ নির্ধারণকারীরা বলেছিল যে, শত্রুর মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রটি তাদের সামরিক বাহিনী, জোট, জাতীয় ইচ্ছা, জনসমর্থন, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা জাতীয় রণকৌশলের ভিতরে থাকতে পারে। অপারেশনাল এবং কৌশলগত স্তরে এসে বলা হয়েছে যে, শত্রুর মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রটি তার সামরিক শক্তির উৎসের মধ্যে রয়েছে। যেমন- তাদের আধুনিক ডিভাইস এবং তীব্র প্রতিরোধ ক্ষমতা।।
আমেরিকা, ইরাকের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র নির্ধারণ করেছিল – সাদ্দাম হুসাইন, রিপাবলিকান গার্ড, সামরিক নেতাদের আনুগত্য, সুরক্ষা সামগ্রী এবং ইরাকি জাতীয়তাবাদ। তাই আমেরিকা জয়ী না হওয়া পর্যন্ত এই সমস্ত কেন্দ্রকেই লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিল। অন্যদিকে, ইরাকি নেতাদের ধারণা ছিল, আমেরিকার মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র হল তাদের জন সাধারণের মতামত। তবে পর্দার আড়ালে ঘটে যাওয়া দূর্দান্ত প্রতারণা ও এর পরের প্রচন্ড যুদ্ধের ফলে বাগদাদ সরকার কর্তৃক কিছু বন্দী পাইলটকে সবার সামনে চিত্রিত করার চেষ্টা, মার্কিন জনগণের উপর কোনো প্রভাবই ফেলেনি।
যুগোশ্লোভিয়ার যুদ্ধে, আমেরিকা সার্বিয়ার যুদ্ধকৌশলের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র নির্ধারণ করেছিল, সার্বিয়ান রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং বিমান হামলা প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে। তবে, অপারেশনাল মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছিল, তাদের অবকাঠামো (পরিবহন রুট এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিল্প) এবং সার্বিয়ান সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষত কোসোভো অঞ্চলের সেনাবাহিনী এবং পুলিশ)।
হাস্যকর বিষয় হল, মার্কিন সেনাবাহিনীর মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র তত্ত্বটি নিয়ে বিতর্ক এখনো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। এই তত্ত্বের বর্তমান মার্কিন প্রয়োগকে অনেকেই প্রত্যাখান করেছে। প্রত্যাখ্যানকারীদের যুক্তি হল, ক্লাউসেভিতস মোটেই মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রকে রণকৌশলগত, অপারেশনাল এবং টেকনিক্যাল এভাবে বিভক্ত করেনি। বরং সে একটিমাত্র মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের কথা বলেছিল, যা খুঁজে পাওয়া যাবে তখন,যখন বৈরীশক্তি পূর্ণতা লাভ করবে একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রে এবং নিদিষ্ট নেতৃত্বে। এই মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র, শক্তি এবং চলাচল নিয়ন্ত্রণ করবে এবং সমস্ত ক্রিয়াকলাপের উপর প্রভাব সৃষ্টি করবে।
ঘটনা যেটাই হোক এবং সত্য যাই হোক, বাস্তবতা হল আমেরিকা আজ ক্লাউসেভিতসের তত্ত্বগুলো নিয়ে এক বিরাট সমস্যার সম্মুখীন। এ সমস্যাটি সৃষ্টি হওয়ার কারণ একক নিয়ন্ত্রনাধীন এবং বৈরীতাপূর্ণ কেন্দ্রীয় শক্তির অস্তিত্ব বিদ্যমান না থাকা। অবশ্যই মুজাহিদগণ – যাঁদের অগ্রভাগে রয়েছেন আল-কায়েদার মুজাহিদিগণ- তাঁরা (বিকেন্দ্রীয়) কেন্দ্রহীন সংগঠনে বিশ্বাস করেন। যে কারণে মুজাহিদদের উপর প্রচন্ড আক্রমন তো অনেক দূরের বিষয় বরং তাঁদের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র বোঝারও কোনো সুযোগ শত্রুদের নেই। কারণ, মুজাহিদ সেলগুলোর মাঝে পারস্পরিক যোগাযোগ খুবই গোপনীয়তা বজায় রেখে করা হয়। তাছাড়া, তাঁরা পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য শুধুই ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ব্যবহার করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁদের বহু বিষয় কয়েক বছর পূর্বেই সিদ্ধান্ত নেয়া থাকে।
এই সমস্যার মুখোমুখি হয়ে খ্রিষ্টান ও ইহুদীবাদী সমর কৌশলবিদরা মুজাহিদদের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র অনুসন্ধানের চেষ্টা করতে থাকে। যার মাধ্যমে মুজাহিদ বাহিনীর এক অংশের নাগাল পেলে অন্য অংশের নাগাল পাওয়া সহজ হবে। শুরুতেই তারা (তাত্ত্বিকভাবে) শাইখ উসামাকে (রহিমাহুল্লাহ) এবং তাঁর ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্বকে এই বলে বাদ দিয়েছিল যে, তিনি তানজিমের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র নয়। অত:পর, যখন তারা দেখল, মুজাহিদগণ তাঁদের কমান্ডারের যে কোনো নির্দেশকে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতেও পূর্ণতায় পৌঁছাতে প্রস্তুত, তখন থেকে আজ পর্যন্ত মার্কিন পন্ডিতগণ বারবার শুধুমাত্র একটি মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। আর তা হল অজানা মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র বা অভ্যন্তরীণ মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র… !!!
এ মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র কী? তারা তাদের প্রখর মেধাশক্তির (!) মাধ্যমে আবিষ্কার করল যে, আল-কায়েদার মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র হল – কুফরের প্রতি ঘৃণা!
আমার জীবনের কসম, ক্লাউসেভিতস যদি আবার জীবন পেত, তাহলে এটা শুনে সে নিজেই উম্মাদ হয়ে যেত। সে দেখতে পেত যে, তার অনুসারীরা এমন দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যাকে নির্মূল করা একেবারেই অসম্ভব। আর তা হচ্ছে – আল্লাহর দ্বীন।
কুফরের প্রতি ঘৃণাকে – শত্রুপক্ষ আল-কায়েদার মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত করেছে। তাদের মতে, কুফরের প্রতি এই ঘৃণাই হল আল-কায়েদার অর্থ, লোকবল এবং সমর্থন পাবার মূল হাতিয়ার। কারণ, এটিই জিহাদ এবং শাহাদাতের প্রেরণার মূল চালিকাশক্তি। এছাড়া, শত্রুরা এটাও বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, মুজাহিদরা মনে করে- উম্মাহর দারিদ্র্যতা, অবমাননা, অনিষ্ট ও লাঞ্ছনার মূল কারণ হল এই কুফর! তাই, এই সব ইহুদীবাদী ও মার্কিন বিশ্লেষকেরা কূটনৈতিকভাবে এবং মিডিয়ার মাধ্যমে দ্রুত এই চেতনার বিলুপ্তি কামনা করছে (সামরিক আগ্রাসন ও যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমেও তারা এটা কামনা করছে)। যেন এই চিন্তাধারা লালন করে এমন একজন ব্যক্তিও এ পৃথিবীতে অবশিষ্ট না থাকে। আর তাদের ধারণা এমন পদক্ষেপই আল-কায়েদাকে পরাজয়ের দিকে অগ্রসর করবে। সম্ভবত ক্রুসেডার প্রশাসন কর্তৃক আরব দেশগুলিকে সম্মান প্রদর্শনের অন্যতম একটি কারণ – তাদেরকে “গণতন্ত্রের” বিষাক্ত ডোজ গেলানো। যা তাদের নারকীয় পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি পদক্ষেপ।
ক্রসেডার খ্রিষ্টান এবং ইহুদীবাদীদের চিন্তার ফল হল, মুজাহিদদের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র হচ্ছে, কুফরের প্রতি ঘৃণা। এছাড়াও, তাদের গবেষণা অনুসারে পৃথিবীর বুকে যত মুসলিম আছে, প্রতিটি মুসলিম আল-কায়েদার অন্তুর্ভুক্ত। কারণ, কুফরের প্রতি ঘৃণা তাওহীদের অন্যতম একটি ভিত্তি। এ বিষয়ে দু’জন মুসলিম কখনো দ্বিমত পোষণ করতে পারে না। এই আলোচনার ফল দাঁড়ায়, তাহলে শত্রু পক্ষের জন্য এখন, সমস্ত মুসলমানের মোকাবেলা করা ছাড়া কোনো গতি নেই। এমনকি যদি বর্তমানে তাদের উক্ত অভিযানে জয়ী হতে হয়, তাহলে তাদের জন্য আল্লাহর দ্বীন পরিবর্তন করা আবশ্যক। এ দ্বীনই তাদের পথের একমাত্র কাঁটা।
আল্লাহর তায়ালার অনুগ্রহ অন্যদিকে আমরা দেখি যে, মুজাহিগণ আল্লাহর তাওফিকে শত্রু, শত্রুর প্রকৃতি কেমন, এমনকি আমেরিকার মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র কি তাও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। পক্ষান্তরে, ইহুদীবাদী লবিগুলো নিরাপত্তা সামগ্রীর নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি, দীর্ঘদিন থেকে আমেরিকার অভ্যন্তরে, নিজেদের পক্ষে মত তৈরির জন্য – সকল প্রভাবশালী মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
এটি পরিস্কার যে, মার্কিন অর্থনীতিই আমেরিকার মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র। শাইখ উসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহ এ কথাটি স্পষ্টভাবে বলে গিয়েছেন। আমেরিকা তাদের নিজস্ব নাগরিক ও অন্যত্র থেকে আগত ভিন্ন জাতি, জাতীয়তা এবং ভিন্ন বর্ণের নাগরিকদের সমষ্টি মাত্র। এদেরকে কেবলমাত্র ‘আমেরিকার একজন নাগরিক’ হওয়ার স্বপ্নই সেখানে একত্রিত করেছে। আরও সঠিকভাবে বললে, ডলারের পূজা-অর্চনার জন্যই তারা সেখানে একত্রিত হয়েছে। তারা প্রকাশ্যেও ডলারকেই রব বলে স্বীকার করে থাকে। তারা যা বলে মহান আল্লাহর মর্যাদা তা থেকে অনেক অনেক উপরে।
এ ছাড়া আমেরিকার প্রতিটি যুদ্ধ প্রচেষ্টার ভিত্তিমূলে রয়েছে, তাদের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সক্ষমতা। আর এ ‘ডলার’ই তাদের যুদ্ধের মেরুদন্ড।
মার্কিন অর্থনীতির ধ্বংস কোনো আকাশ কুসুম স্বপ্ন নয়।সব তাত্ত্বিক হিসেব উল্টে দিয়ে নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনের আক্রমণগুলো মার্কিন অর্থনীতির দূর্বলতা স্পষ্ট করে দিয়েছে। এটি তাদের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। আমেরিকার সরকারী তথ্যকেন্দ্রও এটা স্বীকার করেছে(তারা যা প্রকাশ করেছে, বাস্তব ক্ষতি তার চেয়ে অনেক বেশি)। অবশ্যই মার্কিন অর্থনীতির কলিজায় আঘাত (তাদের কৌশলগত মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র) অচিরেই তাদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। এরপরে আমেরিকা নিঃসন্দেহে বিলীন হয়ে যাবে, কখনোই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
আমার বক্তব্যের অর্থ এই নয় যে, এসব খ্রিষ্টান ক্রুসেডার ও ইহুদীবাদীদের অপারেশনাল এবং টেকনিক্যাল কেন্দ্রের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে কৌশলগত মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রকেই টার্গেট করতে হবে। বরং মুজাহিদদেরকে অবশ্যই ক্রুসেডারদের নিজেদের দৃষ্টির আওতায় নিয়ে আসার জন্য মনোযোগ দিতে হবে। তাদেরকে ভালভাবে বুঝতে হবে। কারণ, এটিই যুগের তাগুতদের বিরুদ্ধে বিজয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে । তাদের সাথে সংঘাত নিরসনের ব্যাপকতাকে বৃদ্ধি করবে।
পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, শত্রুদল ইতিমধ্যে বর্তমান অভিযানগুলোতে মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র তত্ত্বটি প্রয়োগে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
স্পেন ও রাশিয়ায় নেপোলিয়নের যে দুটি পরাজয় ঘটেছিল, তা বিশ্লেষণ করার পর দেখা যায় যে, উভয় দেশের জনপ্রতিরোধ নেপোলিয়নের শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিল। যা তাকে বলতে বাধ্য করেছিল যে, “সবচেয়ে শক্তিশালী, সেরা প্রশিক্ষিত ও সজ্জিত সেনাবাহিনীও তাদের উপর কর্তৃত্ব করতে সক্ষম হয়না, যারা নিজেদের ভূখণ্ড রক্ষার্থে নিজেরাই এগিয়ে আসে’।
চলবে ইনশা আল্লাহ…
সুত্র- পাক্ষিক আল-আনসার ম্যাগাজিন, ২৩ তম সংখ্যা, ১৫ শাওয়াল ১৪২৩ হিজরি, ১৯ ডিসেম্বর ২০০২ ইংরেজি, পৃষ্ঠা: ১০- ১৬