আল-ফিরদাউস মিডিয়া ফাউন্ডেশননির্বাচিতপিডিএফ ও ওয়ার্ডবই ও রিসালাহ

তরবিয়তি মুযাকারা সিরিজ : ১০ || গোপন নেক আমল আখেরাতের অন্যতম সম্বল || মাওলানা আব্দুল্লাহ হুযাইফা হাফি.


مؤسسة الفردوس
আল ফিরদাউস
Al Firdaws

تـُــقدم
পরিবেশিত
Presents

في اللغة البنغالية
বাংলা ভাষায়
In the Bengali Language

بعنوان:
শিরোনাম:
Titled:

سلسلة المذاكرة التربوية- الحلقة ١٠
عبادة السرأهم زاد الآخرة

তরবিয়তি মুযাকারা সিরিজ : ১০
গোপন নেক আমল আখেরাতের অন্যতম সম্বল

Tarbiyati Muzakara Series-10
The secret good deed is one of the most common in the Hereafter

لمولانا عبد الله حذيفة حفظه الله
মাওলানা আব্দুল্লাহ হুযাইফা হাফিযাহুল্লাহ
By Mawlana Abdullah Huzaifa Hafizahullah

 

 

للقرائة المباشرة والتحميل
সরাসরি পড়ুন ও ডাউনলোড করুন
For Direct Reading and Downloading

লিংক-১ : https://mediagram.me/6cd2b95369d31931
লিংক-২ :  https://archive.ph/UEXuV
লিংক-৩ :  https://noteshare.id/ndME79U
লিংক-৪ : https://archive.ph/pWNPJ
লিংক-৫ :  https://web.archive.org
/web/20210727…ti_muzakara-10

লিংক-৬ :  https://web.archive.org/web/20210727…d2b95369d31931
লিংক-৭ : https://web.archive.org/web/20210727…are.id/ndME79U


روابط بي دي اب
PDF (818 KB)
পিডিএফ ডাউনলোড করুন [৮১৮ কিলোবাইট]

লিংক-১ :  https://banglafiles.net/index.php/s/4XyKQxR4s2JW8WG
লিংক-২ : https://archive.org/download/tarbiya…ponNekAmol.pdf
লিংক-৩ : https://drive.internxt.com/sh/file/26cb5e3a-89cc-4ecf-aa23-e45bb5bd644e/e951ab90b382e35fa1cfa2d8aaee54e0e459e838e7bd2234b2483beb18d9a7fc
লিংক-৪ :  https://workdrive.zohopublic.eu/file/dhoip810590a6a054490e98ee3ff3e0e7888c
লিংক-৫ : https://f004.backblazeb2.com/file/Torbiyoti10/tarbiyati-muzakara-10.pdf


روابط ورد
Word (349 KB)
ওয়ার্ড [৩৪৯ কিলোবাইট]

লিংক-১ : https://banglafiles.net/index.php/s/D7apLQrEd6xndN2
লিংক-২ : https://archive.org/download/tarbiya…onNekAmol.docx
লিংক-৩ : https://drive.internxt.com/sh/file/2f6005fa-5ee8-45d4-ae23-1aa901a5ed0a/fded7e4271e1521cfe76d0edc1d5881048c79c52fa07e32bec46252ec1b10b5e
লিংক-৪ : https://workdrive.zohopublic.eu/file/dhoip8689368dce6447379cdab1006e63d6d5
লিংক-৫ : https://f004.backblazeb2.com/file/Torbiyoti10/tarbiyati-muzakara-10.docx


روابط الغلاف- ١
book Banner [2.23 MB]

বুক ব্যানার ডাউনলোড করুন [২.২৩ মেগাবাইট]

লিংক-১ : https://banglafiles.net/index.php/s/cYcmi85fS8ggosg
লিংক-২ : https://archive.org/download/tarbiya…uzakara-10.jpg
লিংক-৩ : https://drive.internxt.com/sh/file/c374d9ef-e116-4d51-a6f5-cbd69a90a964/e28d50516d249e8b30c8471f0b1a482ee945b3a9bf0f510a3c1e800b62820d53
লিংক-৫ : https://workdrive.zohopublic.eu/file/dhoip343b388baede47459832a8f00e0c3531
লিংক-৫ : https://f004.backblazeb2.com/file/Torbiyoti10/tarbiyati-muzakara-10+Cover.jpg


روابط الغلاف- ٢
Banner [842 KB]

ব্যানার ডাউনলোড করুন [৮৪২ কিলোবাইট]

লিংক-১ : https://banglafiles.net/index.php/s/PQ5QJ3K3ERX7N4s
লিংক-২ : https://drive.internxt.com/sh/file/3cc2676b-5c96-45e2-8c63-196da6418e6d/9d612d07b2f32875f37eca5e4e2e68bc2bf9155d76ca58ac8ccfc4f3c8aed186
লিংক-৩ :  https://workdrive.zohopublic.eu/file/dhoipef3c38c1911b4a7d8299a9de640b692f
লিংক-৪ : https://f004.backblazeb2.com/file/Torbiyoti10/tarbiyati-muzakara-10+Banner.jpg


************

 

عبادة السرأهم زاد الآخرة
তরবিয়তি মুযাকারা সিরিজ : ১০
————————————-
গোপন নেক আমল
আখেরাতের অন্যতম সম্বল

মাওলানা আব্দুল্লাহ হুযাইফা হাফিযাহুল্লাহ

 

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيم
اَلْحَمْدُ لله رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَى أَشْرَفِ الْأَنْبِيَاءِ وَالْمُرْسَلِيْنَ، وَعَلَى آله وَأَصْحَابِهِ وَمَنْ تَبِعَهُمْ بِإِحْسَانٍ إِلَى يَوْمِ الدِّيْنِ، أَمَّا بَعْدُ
فأَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيم، بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيم
تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُور ُ

একটি কথা আমরা সবাই জানি যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের আমলের পরিমাণ দেখেন না। তিনি দেখেন, আমলের মান। কে কত বেশি আমল করল, তা দেখেন না। দেখেন, কে কত সুন্দর আমল করল। হোক তা পরিমাণে অল্প।
আর কোনো আমল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার দৃষ্টিতে মানসম্পন্ন হয় তখনই যখন তাতে দুটি জিনিস একত্রিত হয়। ইখলাস ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর পূর্ণাংগ অনুসরণ। এ দুয়ের কোনো একটিও যদি ছুটে যায় তাহলে সেই আমল বাহ্যত অনেক বড় ও মূল্যবান মনে হলেও আল্লাহর কাছে তার দুই পয়সারও মূল্য নেই।
বান্দার যে আমল সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহই জানেন, অন্য কেউ জানে না, যা সে মাখলুকের দৃষ্টির আড়ালে করে থাকে, এমন আমলে ইখলাসের গুণটি থাকে শতভাগ। ওগুলো একদম নিখুঁত হয়। একমাত্র আল্লাহর জন্যই হয়। এমন আমলকে বলা হয়, গোপন নেক আমল। আরবিতে যাকে বলে,
عبادة السر –  الخبيئة الصالحة  – عبادة الْخَفَاءِ
আজ ভাইদের সাথে এ বিষয়টি নিয়েই কিছু কথা মুযাকারা করার ইচ্ছে করেছি। গত মজলিসে গোপন গুনাহ নিয়ে কিছু কথা মুযাকারা হয়েছিল। আজ আল্লাহ তাওফিক দিলে তার বিপরীত বিষয়টি নিয়ে কিছু কথা মুযাকারা করব ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইখলাস ও ইতকানের সাথে কথাগুলো বলার এবং আমাদের সবাইকে সে মোতাবেক আমল করার তাওফিক দান করুন, আমীন।
গত দুই আড়াই বছর আগে এ বিষয়টি নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু কথা ভাইদের খেদমতে পেশ করেছিলাম। কোনো কোনো ভাইয়ের মনেও থাকতে পারে। ওই কথাগুলোই একটু বিস্তারিত ভাবে মুযাকারা করার ইচ্ছা করেছি যেন কথাগুলো আবার আমাদের স্মরণে এসে যায়।
গোপন নেক আমল আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান থাকার দলিল
প্রিয় ভাই আমার, আমরা আমাদের পরকালীন জীবনের জন্য যত নেক আমল নিজের আমলনামায় সঞ্চয় করে রাখতে পারি তার মধ্যে অন্যতম হল ‘গোপন নেক আমল’। এমন কিছু নেক আমল যা সম্পর্কে আমি ও আমার প্রতিপালক ছাড়া আর কেউ জানবে না। হতে পারে আমলগুলো খুবই ছোট। কিন্তু ওগুলো সম্পর্কে যেহেতু আল্লাহ ছাড়া কেউ জানবে না তাই সেই আমলগুলো অবশ্যই আল্লাহর কাছে ‘মকবুল’ হবে ইনশাআল্লাহ।
হতে পারে তা শেষ রাতের কয়েক রাকাত নামায। কিংবা রাতের একদম শেষ প্রহরের ইস্তেগফার কিংবা কোনো এতিম বা কোনো বিধবা কিংবা কোনো অভাবীকে দেওয়া সামান্য কিছু সাদাকা কিংবা অন্যায়ভাবে বন্দি কোনো মুসলিম ভাইকে করা একটু সহায়তা।
এ ধরণের গোপন নেক আমল আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান থাকার দলিল। কারণ, মুনাফিক কখনো গোপন নেক আমল করতে পারে না। তাই তো এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إن العبد إذا صلى في العلانية فأحسن، وصلى في السر فأحسن، قال الله عزوجل: هذا عبدى حقاً – رواه ابن ماجه
“কোনো বান্দা যখন প্রকাশ্যে নামায পড়লেও সুন্দর ভাবে পড়ে, গোপনে পড়লেও সুন্দর ভাবে পড়ে তখন আল্লাহ বলেন, এ-ই হল আমার সত্যিকার বান্দা”। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪২০০)
সে যে গোপনেও সুন্দর ভাবে নামায পড়ে এটিই হল তার প্রশংসনীয় গুণ। যা তার ঈমানের অন্যতম একটি আলামত।
আমি কি মুনাফিক?
একবার একলোক হযরত হুযাইফা বিন ইয়ামান রাযি.কে জিজ্ঞেস করল,
هل أنا من المنافقين؟
আমি কি মুনাফিক?
তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
أتصلي إذا خلوت، وتستغفرإذا أذنبت؟
তুমি কি একাকী থাকাকালে নামায পড়ো? কোনো গুনাহ হয়ে গেলে কি ইস্তিগফার করো?
সে বলল,  نعم হ্যাঁ
উত্তর শুনে হুযাইফা রাযি. বললেন,
اذهب فما جعلك الله منافقا
যাও, আল্লাহ তোমাকে মুনাফিক বানাননি।
গোপন নেক আমলের পরিমাণ বাড়ান
হযরত যুবায়ের বিন আওয়াম রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ اَنْ يَكُونَ لَهُ خَبِيْئَةٌ مِنْ عَمَلٍ صَالِحٍ فَلْيَفْعَلْ
“তোমাদের কেউ গোপন কিছু নেক আমল সঞ্চয় করে রাখতে পারলে সে যেন তা করে”। (সহীহুল জামে : ৬০১৮)
সহীহ বুখারীতে বর্ণিত গুহায় আটকে পড়া তিন ব্যক্তির ঘটনাটি আমাদের সবারই জানা আছে। গুহায় আটকে পড়ার পর তারা তিনো জন নিজ নিজ নেক আমলের ওসিলা দিয়েই আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলে। আল্লাহ তাআলা তাদের দোয়া কবুলও করেছিলেন। তারা প্রত্যেকেই তাদের দোয়ায় বলেছিল,
اَللَّهُمَّ إنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابِتِغَاءَ وَجْهِكَ فَفَرِّجْ عَنّا مَا نحن فِيهِ
“হে আল্লাহ, আমি যদি ওই আমলটি একমাত্র আপনাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে করে থাকি তাহলে এর ওসিলায় আমাদেরকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করুন”। (সহী বুখারী : ২২৭২)
প্রিয় ভাই আমার, এবার একটু ভেবে দেখুন তো, আমার আপনার এমন কোনো নেক আমল আছে কি না, যা আমরা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য করেছি? যে আমলের উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কোনো বিপদে পড়লে আমরা কি বলতে পারব, হে আল্লাহ, আমাকে অমুক নেক আমলের ওসিলায় এ বিপদ থেকে উদ্ধার করুন, যে আমলটি আমি একমাত্র আপনার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করেছিলাম।
যদি থাকে তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ ছুম্মা আলহামদুলিল্লাহ। এর পরিমাণ আরও বাড়ানোর চেষ্টা করি। আর যদি না থাকে তাহলে এ মুহুর্ত থেকেই আমরা নিজের আমলনামায় এমন কিছু নেক আমল সঞ্চয় করে রাখার চেষ্টা করি ইনশাআল্লাহ।
প্রিয় ভাই আমার, আপনি একটু সচেতন হলে আপনার নফল আমলগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ আমলই গোপন নেক আমলে পরিণত করতে পারেন। মনে রাখবেন, আপনি আপনার নেক আমলগুলোকে যত বেশি গোপন রাখবেন আল্লাহর কাছে তার মূল্যও তত বেশি হবে এবং শয়তানের ঝুঁকি থেকেও তা তত বেশি মুক্ত থাকবে।
কোনো এক সালাফের উক্তি, মানুষ তার গুনাহকে যে ভাবে গোপন রাখে নেক আমলগুলোকেও ওভাবে গোপন রাখা চাই। বরং তা আরও বেশি গোপন রাখা উচিত।
গোপন নেক আমলের চমৎকার একটি উদাহরণ
সৌদি কারাগারে বন্দি শাইখ আব্দুল আযীয তারিফী ফাক্কাল্লাহু আসরাহুকে তো আমরা কম বেশি সবাই চিনি। গোপন নেক আমল সম্পর্কে তাঁর খুবই মূল্যবান একটি বাণী আছে। তিনি বলেন,
فكلما زاد خفاء الطاعات كلما زاد ثباتك، كالوتد المنصوب يثبت ظاهره بقدر خفاء أسفله في الأرض، فيقتلع الوتد العظيم، ويعجزعن قلع الصغير والسر فيما خفي
নেক আমলের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা যত বেশি হবে (এর ওসিলায় দ্বীনের ওপর) দৃঢ়তাও তত বেশি হবে। এর উদাহরণ হল, যেমন পেরেক, পেরেকের নিম্নভাগ মাটি  (বা অন্য কিছুর) গভীরে যত বেশি ঢুকানো হয় তার উপরিভাগ তত বেশি মজবুত হয়। তাই তো কখনো বড় পেরেকও উপড়ে ফেলা যায় আবার ছোট পেরেকও উপড়ানো যায় না। রহস্যটা এখানেই। (প্রথমটি আকারে বড় হলেও তার গোপন অংশের পরিমাণ কম। আর দ্বিতীয়টি আকারে ছোট হলেও তার গোপন অংশের পরিমাণ বেশি)
তিনি রাতের বেলা ঘরের দরজায় খাবারের বস্তা রেখে যেতেন
হযরত আলী রাযি.-এর নাতী হযরত জয়নুল আবেদীন বিন হুসাইন রহ. যখন মারা যান তখন (গোসল দেয়ার সময়) লোকেরা তার পিঠে বোঝা বহনের দাগ দেখতে পায়। অথচ জীবদ্দশায় কেউ তাঁকে কখনো কোনো কিছু বহন করতে দেখেনি। কিছুদিন পর দেখা গেল তার এলাকার বেশ কয়েকটি পরিবারের লোকজন বলাবলি করতে শুরু করে যে, তাঁর মৃত্যুর পূর্বে কে যেন প্রায়ই রাতের বেলা আমাদের ঘরের সামনে খাবার ভর্তি বস্তা রেখে দিয়ে যেত। এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। তখন সবাই বুঝতে পারল যে, এটা হযরত যাইনুল আবেদীন রহ-এরই কাজ। তিনিই রাতের বেলা খাবার ভর্তি বস্তা বহন করে তাদের ঘরের সামনে রেখে আসতেন।
তাঁর রোযা রাখার কথা বাড়ির লোকজনও জানত না
হযরত দাউদ বিন আবূ হিন্দ রহ. এমন ভাবে নফল রোজা রাখতেন যে কেউই বুঝতে পারত না যে, তিনি রোজা রাখেন। বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে বাজারে চলে যেতেন। বাজারে গিয়ে খাবার অন্যদেরকে দিয়ে দিতেন। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি এসে খাবার খেতেন। বাজারের লোকজন ভাবতো, বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছেন। আর বাড়ির লোকজন ভাবতো বাজারে গিয়ে খেয়েছেন।
লক্ষ করুন, কীভাবে নিজের আমল গোপন করতেন। বাড়ির লোকজনকেও বুঝতে দিতেন না। এরই নাম হল ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাত।
যে ব্যক্তি মৃত্যুর যন্ত্রণা ও কেয়ামতের দিনের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে চায়
ইমাম মালেক রহ. বলতেন,
مَن أَحَبَّ أنْ يَنْجُوَ مِنْ غَمَرَاتِ الموتِ وَأَهْوَالِ يومِ القيامَة فليَكُنْ عَمَلُهُ في السِّرِّ أكْثَرَ مِنه في العَلانِيَةِ
“যে ব্যক্তি মৃত্যুর যন্ত্রণা ও কেয়ামতের দিনের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে চায় তার গোপন নেক আমলের পরিমাণ যেন প্রকাশ্য নেক আমলের চেয়ে বেশি হয়”।
লক্ষ করুন, তিনি বলছেন, ‘গোপন নেক আমলের পরিমাণ যেন প্রকাশ্য নেক আমলের চেয়ে বেশি হয়’। সমান সমান না বরং যেন বেশি হয়।
যিনি কথাটি বলছেন তিনি নিজে কেমন ছিলেন?
ইমাম মালেক রহ. সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহ.-এর মন্তব্য
ইমাম মালেক রহ. সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহ. বলেন,
ما رَأَيتُ أحدًا اِرْتَفَعَ مِثْلَ مالِكٍ، ليس له كثيرُ صلاةٍ ولا صيامٍ إلا أنْ تكونَ له سَريرة
“তাঁর মতো এত উঁচু মর্যাদা সম্পন্ন কাউকে আমি দেখিনি। তিনি যে খুব বেশি নামায পড়তেন, রোযা রাখতেন এমন কিন্তু নয় তবে তাঁর প্রচুর গোপন নেক আমল ছিল”।
আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহ. সম্পর্কে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ.-এর মন্তব্য
আমাদের সালাফদের প্রায় সবাই এমন ছিলেন যে, তাঁরা অন্যদের কথা বা অবস্থা শুধু মুখে উচ্চারণ করতেন না। বরং তা নিজের মধ্যেও বাস্তবায়ন করতেন। তাই তো আমরা দেখি, আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহ. সম্পর্কে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. বলেন,
ما رَفَعَ اللهُ ابنَ المباركِ إلا بِخَبِيئةٍ كانَتْ له
গোপন নেক আমলের কারণেই আল্লাহ তাআলা আব্দুল্লাহ বিন মুবারককে এত উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও সেই তাওফিক দান করেন আমীন।
ইমাম ইবনুল জাওযি রহ-এর উক্তি
ইমাম ইবনুল জাওযি রহ. বলেন,
لقد رأيت من يكثر الصلاة والصوم والصمت ويتخشع في نفسه ولباسه والقلوب تنبوعنه، وقدره في الناس ليس بذاك، ورأيت من يلبس فاخر الثياب وليس له كبير نفل ولا تخشع، والقلوب تتهافت على محبته؛ فتدبرت السبب فوجدته السريرة
আমি এমন (বহু) লোক দেখেছি যারা নফল নামাজ, নফল রোজা অনেক করেন। দীর্ঘ সময় চুপচাপ থাকেন। (অন্যান্য আমলও অনেক করেন। দেখে মনে হয়) তারা দৈহিকভাবে এবং পোশাক আশাকে খুব সাদামাটা বা খুব বিনয়ী। কিন্তু মানুষের অন্তরে (তাদের প্রতি) কোনো আকর্ষণ নেই। মানুষের মাঝে তাদের তেমন কোনো কদর নেই। এর বিপরীত এমন কিছু লোকও দেখেছি যারা দামী পোশাক পরেন। খুব বেশি যে নফল পড়েন, সাদামাটা থাকেন এমনও না (বা খুব যে বিনয়ী এমনও না) কিন্তু তাদের প্রতি মানুষের ভালোবাসা সীমাহীন। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে যা পেয়েছি তা হল, তাদের গোপন আমল।
মুহাম্মাদ বিন ওয়াসে’ রহ-এর উক্তি
বিখ্যাত তাবেয়ী মুহাম্মাদ বিন ওয়াসে’ রহ. বলতেন,
من أصلح سريرته أصلح الله علانيته، ومن أصلح آخرته أصلح الله له دنياه، ومن أصلح ما بينه وبين الله أصلح الله ما بينه وبين الناس
যে ব্যক্তি নিজের ভিতরের অবস্থা বা গোপন অবস্থা সংশোধন করে নেয় আল্লাহ তার বাহ্যিক অবস্থা সংশোধন করে দেন।  যে ব্যক্তি তার আখেরাত সংশোধন করে নেয় আল্লাহ তার দুনিয়া সংশোধন করে দেন। এবং যে ব্যক্তি তার মাঝে এবং আল্লাহর মাঝে থাকা সম্পর্ক সংশোধন করে নেয় আল্লাহ তার মাঝে এবং মাখলুকের মাঝে থাকা সম্পর্ক সংশোধন করে দেন।
গোপন আমলের মূল্য প্রকাশ্য আমলের চেয়ে অনেক বেশি
একটি সাধারণ উসূল আমরা সবাই হয়তো জানি যে, যে সকল আমল গোপন ও প্রকাশ্য দুভাবেই করা যায়। সেখানে গোপনে করা আমলটির মূল্য আল্লাহর কাছে প্রকাশ্যে করা আমলের চেয়ে অনেক অনেক বেশি হয়। দেখুন, দান সদকা গোপনে-প্রকাশ্যে দুভাবেই করা যায়। তবে গোপনে করলে দানের মূল্য বেড়ে যায়।
إِن تُبْدُواْ الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِن تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاء فَهُوَ خَيْرٌ لُّكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنكُم مِّن سَيِّئَاتِكُمْ وَاللّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
“যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-সদকা কর, তবে তা উত্তম। আর যদি গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্যে আরও বেশি উত্তম। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের গুনাহ দূর করে দিবেন। আল্লাহ তোমাদের কাজ কর্মের ব্যাপারে অবগত আছেন”। (সূরা বাকারা ০২:২৭১)
দিনের নফলের তুলনায় রাতের নফলের মূল্য বেশি। কারণ, রাতের নফল গোপনে পড়া হয়। এ জন্যই হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রাযি. বলতেন,
لأن أصلي ركعة بالليل أحب إلي من أن أصلي عشرا بالنهار
আমার কাছে দিনের দশ রাকাত নফলের চেয়ে রাতের এক রাকাত নফল বেশি প্রিয়।
সহী বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত প্রসিদ্ধ একটি হাদিস, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা সাত শ্রেণির লোককে তাঁর (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না।
হাদিসে শেষাংশে এসেছে,
وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ، فَأخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ الله خَالِياً فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ
“ওই ব্যক্তি যে এত গোপনে দান করে যে, তার বাম হাত পর্যন্ত জানতে পারে না তার ডান হাত কী দান করল। (অর্থাৎ তার একদম কাছের লোকও তার দান সম্পর্কে জানতে পারে না) এবং ওই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে”। (সহী বুখারী : ৬৬০; সহী মুসলিম : ১০৩১)
এই দুই ব্যক্তির আমল দুটির মূল্য আল্লাহর কাছে এত বেশি হওয়ার কারণ, তারা আমলগুলো গোপনে করেছে।
সদকা তো ভাই কত জনই করে, চোখের অশ্রু তো কত জনই ঝড়ায়। কিন্তু এ দুজনের বিশেষত্ব হল, তারা সদকা করেছে গোপনে, কেউই টের পাইনি। কেঁদেছে এমন ভাবে যে আল্লাহ ছাড়া কেউই দেখেনি। তাদের আমলগুলো আল্লাহর কাছে মূল্যবান হওয়ার এটাই হল মূল কারণ। তাদের আমলে একটুও খুঁত নেই। এক বিন্দু খুঁতও নেই।
গোপন নেক আমলের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত
এবার একটি ঘটনা বলি। ঘটনাটির বিবরণ কয়েক ভাবে এসেছে। তবে মূল বিষয়টি একই। আমি নিজে যেভাবে শুনেছি ওভাবেই বলছি।
ঘটনাটি ইসলামের প্রথম শতাব্দীর। মুসলমানরা তখন ইসলামের বিজয় পতাকা নিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছুটে যাচ্ছিল আর একের পর এক শত্রুদের বিভিন্ন শহরে ইসলামের ঝান্ডা বুলন্দ করছিল। মুসলমানদের এমনই একটি দল তখন রোমানদের সঙ্গে যুদ্ধরত ছিল। সেনাপতি ছিলেন মুহাম্মাদ বিন মাসলামা রহ.।
মুসলমানরা রোমানদের একটি দুর্গ অবরোধ করে রেখেছিল। দুর্গটি ছিল খুবই মজবুত ও দুর্বোধ্য। অবরোধের সময় দীর্ঘ হচ্ছিল। চূড়ান্ত কোনো যুদ্ধও ছিল না। প্রতিদিন সকালবেলা মুসলমানরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে শহরের মূল ফটকের সামনে অপেক্ষা করত। কিন্তু ভিতরের কাফেরদের সাহস হতো না বাইরে বের হয়ে মুসলমানদের মোকাবেলা করার।
এক রাতের ঘটনা। এক মুজাহিদের মাথায় এল অদ্ভুত বুদ্ধি। তিনি হাতে কোদাল নিয়ে একা বের হলেন। শহরের মূল ফটকের কাছাকাছি একটি জায়গা নির্বাচন করে দেয়ালের নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে শুরু করেন। আল্লাহর ইচ্ছায় এক রাতেই তিনি সুরঙ্গ করে ফেলতে সক্ষম হন এবং সেই সুরঙ্গ দিয়ে ভিতরে ঢুকে শহরের কিছু অবস্থাও বুঝে আসতে সক্ষম হন। ভোর হওয়ার আগে আগেই তিনি নিজ তাবুতে ফিরে আসেন। ঘটনাটি সম্পর্কে কেউ টের পায়নি।
পরদিন ভোরবেলা মুসলিম সৈনিকরা অন্যান্য দিনের মতো শহরের মূল ফটকের সামনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ায়। তখন সুরঙ্গখননকারী সেই মুজাহিদ সবার অগোচরে ছোট্ট সেই সুরঙ্গ দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েন এবং চোখের পলকে ফটক খুলে দেন। মুহূর্তেই মুসলমানগণ ভিতর ঢুকে পড়েন। তারা শুধু এটুকু দেখতে পেল যে, তাদেরই এক ভাই কোনো ভাবে ভিতরে ঢুকে দরজা খুলে দিয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে বাহিনীর ভিতরে হারিয়ে গেছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো শহর মুসলমানরা বিজয় করতে সক্ষম হন।
যুদ্ধ শেষ। মুসলিম সেনাপতি সবার সামনে ঘোষণা দিলেন, সুরঙ্গ খননকারী ভাই! আপনি সামনে আসুন। বেশ কয়েকবার ঘোষণা দিলেন। কেউ এলো না। পরদিন আবার ঘোষণা দিলেন। এদিনও কেউ এলো না। তৃতীয় দিন আবার ঘোষণা দিলেন। এ দিনও কেউ এলো না। তখন তিনি বললেন, সুরঙ্গ খননকারী ভাইকে লক্ষ্য করে বলছি, আমি আপনাকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি, দিনে কিংবা রাতে যে কোনো সময় আপনি আমার তাবুতে একটু আসুন।
ওদিন সন্ধ্যাবেলা। সেনাপতি নিজ তাবুতে বসা। হঠাৎ কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা এক ব্যক্তি সালাম দিল। তিনি তার সালামের উত্তর নিলেন এবং তাকে ভিতরে আসতে বললেন। ভিতরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে লক্ষ করে বললেন, আপনিই কি সুরঙ্গ খননকারী? লোকটি বলল, সুরঙ্গ খননকারী আপনার সাথে দেখা করবে তবে তার তিনটি শর্ত আছে। বললেন, কী শর্ত? লোকটি বলল, প্রথম শর্ত হল, সে আপনার সঙ্গে দেখা করবে তবে আপনি তার নাম জিজ্ঞেস করতে পারবেন না? দ্বিতীয় শর্ত হল, তার চেহারা কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকবে আপনি তার চেহারার কাপড় সরাতে বলবেন না। তৃতীয় শর্ত, আপনি তাকে কোনো পুরস্কার দিতে চাইবেন না। সেনাপতি বললেন, ঠিক আছে।
তখন লোকটি বলল, আমিই সেই লোক। অপলক দৃষ্টিতে তিনি কতক্ষণ লোকটির চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। লোকটি আর কোন কথা বলল না। সালাম দিয়ে তাবু থেকে বেরিয়ে গেল। এরপর থেকে সেই সেনাপতি প্রায়ই তাঁর দোয়ায় বলতেন,
اللهم احشرني مع صاحب النقب
হে আল্লাহ! হাশরের ময়দানে আমাকে সুরঙ্গ খননকারী ভাইটির সাথে একত্রিত করুন।
ঘটনা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা
প্রিয় ভাই আমার, ঘটনাটি থেকে আমরা এ শিক্ষা পাই যে, জিহাদের কাজে কেমন ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাত থাকা চাই। কত বড় একটা কাজ করলেন অথচ তিনি নিজেকে প্রকাশই করলেন না। সেনাপতি যে হাশরের ময়দানে তার সাথে মিলিত হওয়ার দোয়া করতেন এর দ্বারা আন্দাজ করা যায়, তিনি ওই ভাইয়ের এই আমলটিকে কত বড় একটি আমল মনে করছিলেন। তিনি নিজের কত কত আমল থাকা সত্ত্বেও ওই মুজাহিদের এই আমলের কারণে তার সাথে হাশরের ময়দানে একত্রিত হওয়ার দোয়া করছেন।
এ থেকে আরও যে শিক্ষা আমরা পাই তা হল, আমাদের অনেক গুমনাম-অপরিচিত ভাই এমন এমন আমল করে ফেলতে পারেন যে আমলের সামনে আমাদের বাহ্যত বড় বড় আমলগুলোর কোনোই মূল্য নেই। তাই আমরা আমাদের প্রতিটি ভাইয়ের কদর করি। কোনো ভাইকেই কখনো ছোট না ভাবি।
এই যে আমাদের কেউ মাসউল আর কেউ মামুর, এগুলো তো হল দুনিয়াবি একটা পরিচয় মাত্র। আল্লাহর কাছে কার দাম যে কত বেশি, তা তো একমাত্র তিনিই জানেন। যা আখেরাতেই বুঝা যাবে।
আপনিও কিছু করুন
ওপরের এ ঘটনার আলোকে আমার প্রাণ প্রিয় ভাইদের খেদমতে আমার আবেদন থাকবে, প্রিয় ভাই আমার, আপনিও নিয়মিত কিছু ‘গোপন নেক আমল’ করুন, যা সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানবে না। হোক তা একদমই সামান্য কোনো আমল। হতে পারে ওই নেক আমলের ওসিলায় আপনি নিজেও নাজাত পাবেন এবং আপনার সঙ্গে আরও অনেকে নাজাত পাবে ইনশাআল্লাহ। এ জাতীয় নেক আমলের ওসিলায় দুনিয়াতেও বান্দা বিপদ আপদ থেকে মুক্তি পায়। গুহায় আটকে পড়া তিন ব্যক্তির ঘটনা থেকে যা সুস্পষ্ট ভাবেই বুঝা যায়।
গোপন ইবাদত দ্বীনের পথে অবিচল থাকার অন্যতম উপায়
গোপন নেক আমলের বিপরীত হলো গোপন গুনাহ। যা বান্দা মানুষের দৃষ্টির আড়ালে করে থাকে। যা সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহই জানেন। অন্য কেউ জানে না। গোপন গুনাহের কারণে যেমন কোনো ব্যক্তি দ্বীনের পথ থেকে ছিটকে পড়তে পারে, তেমনিভাবে কোনো ব্যক্তি তার গোপন নেক আমলের ওলিসায় শত বাধা সত্ত্বেও দ্বীনের পথে অবিচল থাকতে পারে।
ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন,
أجْمَعَ العَارِفُون باللهِ اَنَّ ذُنُوبَ الْخَلَوَاتِ هي أَصْلُ الْاِنْتِكَاسَاتِ، وَأنَّ عِباداتِ الْخَفَاءِ هي أعْظَمُ أسْبابِ الثَّبَات
সকল আউলিয়ায়ে কেরাম একমত যে, বান্দার গোপন গুনাহ দ্বীনের পথ থেকে পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ এবং গোপন ইবাদত দ্বীনের পথে অবিচল থাকার অন্যতম উপায়।
কোনো এক সালাফ বলেছেন,
من أكثرعبادة السرأصلح الله له قلبه شاء العبد أم أبى
যে ব্যক্তি বেশি পরিমাণে গোপন ইবাদত করে (এর ওসিলায়) আল্লাহ তার দিলের ইসলাহ করে দেন, সে চাক, বা না চাক।
من اشتكى ضعفا (أي في إيمانه) فخلوته بربه نادرة
যে ব্যক্তি নিজের (ঈমানের) দূর্বলতার অভিযোগ করে (বুঝতে হবে,) আল্লাহর সাথে তার নির্জন ইবাদতের পরিমাণ কম।
অন্য একজন বলেছেন,
ما ابتلي المؤمن ببلية شرمن المعصية الخفية، ولا أوتي دواءً خيرا من طاعة الخفاء
কোনো মুমিন গোপন গুনাহে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে বড় কোনো মসিবতে পড়তে পারে না। আর এর জন্য গোপন নেক আমলের চেয়ে উত্তম কোনো ঔষধ নেই।
এজন্যই যুবায়ের বিন আওয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, তোমরা বেশি বেশি গোপন নেক আমল করো। কারণ সবারই কিছু না কিছু গোপন গুনাহ থাকে।
আল্লাহ না করুন যদি কখনো শয়তানের ধোকায় পড়ে আমাদের থেকে কোনো গোপন গুনাহ হয়ে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে কোনো না কোনো গোপন নেক আমল করে ফেলব ইনশাআল্লাহ। এর ফলে আশা করা যায়, গোপন গুনাহের কুপ্রভাব থেকে আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করবেন ইনশাআল্লাহ।
হাদিসে এসেছে,
عن أبي ذر جُنْدُب بنِ جُنادَةَ وأبي عبدِ الرحمنِ معاذِ بنِ جبلٍ رضي الله عنهما عن رسولِ الله صلى الله عليه وسلم قَالَ : اتَّقِ الله حَيْثُمَا كُنْتَ وَأتْبعِ السَّيِّئَةَ الحَسَنَةَ تَمْحُهَا، وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ  حَسَنٍ . رواه الترمذي، وَقالَ : حديث حسن.
“হযরত আবূ যর রাযি. ও মুআয বিন জাবাল রাযি. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তুমি যেখানেই থাকো আল্লাহকে ভয় করো এবং গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে কোনো সওয়াবের কাজ করে ফেলো তাহলে তা ওই গুনাহকে মুছে দিবে। আর মানুষের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো”। (জামে তিরমিযী : ১৯৮৭)
হাদীস থেকে যে শিক্ষা আমরা পাই তা হল, আল্লাহ না করুন যদি কখনো কোনো গুনাহ হয়ে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে কোনো সওয়াবের কাজ করে ফেলা চাই।
আর একটি বিষয় আমরা সবাই জানি যে, ময়লা বেশি হলে তা ধোয়ার জন্য পানিও বেশি লাগে তাই গুনাহ বড় ধরনের হলে তার বিপরীতে নেক আমলও বড় ধরনের হতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে ছোট বড় সব ধরনের গুনাহ থেকে হেফাজত করেন, আমীন।
গোপন নেক আমলের কিছু নমুনা
এবার গোপন নেক আমলের কিছু নমুনা বলি। উদ্দেশ্য, এর মধ্যে যেগুলো আমাদের চালু আছে তা যেন আমরা অব্যাহত রাখতে পারি। আর যেগুলো চালু নেই তা যেন চালু করতে পারি। পাশাপাশি গোপন নেক আমলের ধরণগুলো বুঝে এ ধরনের যত আমল আমাদের পক্ষে করা সম্ভব সবই যেন আমরা করতে পারি ইনশাআল্লাহ।
গোপনে সাদাকা করা
গোপনে সাদাকা করা। এমনভাবে সাদাকা করা যেন আল্লাহ ছাড়া কেউ না জানে। বিশেষ করে নিজের দ্বীনদার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে যারা বাহ্যত সচ্ছল কিন্তু বাস্তবে অভাবী, তাদেরকে হাদিয়া দেয়ার কথা বলে আর্থিক ভাবে সহায়তা করা।
প্রসিদ্ধ একটি হাদিস, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
صدقة السر تطفئ غضب الرب
“গোপন সাদাকা আল্লাহর ক্রোধের আগুন নিভিয়ে দেয়”। জামে সাগীর : ৪৯৭৮ (হাদিসটির সনদ সহী)
সহী বুখারী ও মুসলিমের হাদিস থেকে বুঝা যায়, গোপন সাদাকাকারীকে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাঁর (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। এজন্য এ আমলটির আমরা খুব ইহতিমাম করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে যারা অসচ্ছল কিন্তু নিজের সামাজিক মর্যাদার কারণে কারো কাছে হাত পাতে না। যেমন, দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, তরকারি বিক্রেতা, নৌকার মাঝি তাদেরকে হাদিয়ার কথা বলে আর্থিক ভাবে সহায়তা করা যায় বা খাবার জাতীয় কিছু বা অন্য কোনো জিনিস হাদিয়া দেয়া যায়।
একটু ভাবুন তো ভাই, গরমে ঘেমে একাকার হয়ে যাওয়া কোনো রিকশাচালককে আপনি যদি ১০ টাকা দিয়ে একটা ঠান্ডা পানি কিনে হাদিয়া দেন, তিনি কেমন খুশি হবেন? কল্পনা করা যায় ভাই?
মুহতারাম ভাই, আমরা কেউ ইচ্ছা করলে নিজেকে গোপন রেখে এমন সাদাকা প্রচুর পরিমাণে করতে পারি। যার সবটাই হবে গোপন সাদাকা।
এক নেককার ব্যবসায়ীর ঘটনা
ছোট্ট একটি ঘটনা বলি। ঘটনাটি কোথায় যে পড়েছি ঠিক মনে নেই। আমাদের ভাইদের মধ্যে আল্লাহ যাদেরকে বিত্তবান বানিয়েছেন তারা এই আমলটি করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
কোনো এক এলাকায় এক ব্যবসায়ী ছিল। তিনি ছিলেন খুবই নেককার। কিন্তু তাকে খুব বেশি দান সাদাকা করতে দেখা যেত না। যাকাত, সাদাকায়ে ফিতর এবং এজাতীয় ফরয ওয়াজিব সাদাকাগুলো তিনি খুব গুরুত্বের সাথেই দিতেন তবে নফল সাদাকা দিতে তাকে খুব একটা দেখা যেত না।
ওই এলাকায় যে বাজার ছিল সেখানে এক কসাই ছিল। সেও ছিল দ্বীনদার। তবে তার মাঝে চমৎকার একটি গুণ ছিল। সে প্রতিদিনই কিছু গোশত গরিবদের জন্য রাখে দিত। নির্দিষ্ট একটা পরিমাণ গোশত সে প্রতিদিন গবিরদেরকে সাদাকা করত। এতে তার বেশ সুনামও ছড়িয়ে পড়ে।
একদিক ওই ধনী ব্যবসায়ী মারা যান। তার মারা যাওয়ার কিছু দিন পর থেকে ওই কসাই গোশত সাদাকা করা বন্ধ করে দেন। সবাই অবাক। কী ব্যাপার! এত দিন দিয়েছেন। এখন কেন বন্ধ করলেন?
তখন ওই লোকটি জানালো আসল রহস্য। সে বলল, এত দিন আমি যে সাদাকা করেছি তা আসলে আমি করিনি। করেছেন ওই ব্যবসায়ী। তিনিই আমাকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটা পরিমাণ গোশত সাদাকা করতে বলতেন। টাকাটা তিনি আমাকে দিয়ে দিতেন। তিনি এটি কাউকে বলতে নিষেধ করেছেন। এখন তো তিনিই আর বেঁচে নেই, তাই বললাম।
ঘটনাটা এখানেই শেষ। ঘটনাটি আমাদের জন্য অনেক শিক্ষনীয়। আল্লাহ যেন আমাদেরকেও তাওফীক দান করেন। আমাদের বিত্তবান ভাইরা এই আমলটি করতে পারেন ইনশাআল্লাহ। পরিচিত কোনো কসাই, মাছ বিক্রেতা, মুদি দোকানদার বা কোনো হোটেল মালিকের সাথে ওই ব্যবসায়ীর মতো কথা বলে নিজেকে গোপন রেখে গরিব মিসকিনদের মাঝে সাদাকা করতে পারেন। কারো সামর্থ থাকলে দৈনিক করলেন। না হয় সপ্তাহে বা মাসে কিংবা বছরে এক দুবার করলেন। রমজান ও ঈদের মৌসুমে গরিব মিসকিনদের মাঝে এভাবে সাদাকা করতে পারেন।
বর্তমানে দেখা যায়, আমাদের সমাজের কত কত লোক ডাকঢোক পিটিয়ে বিরাট অংকের অর্থ ব্যয় করে বহু মানুষের খাবারের আয়োজন করে থাকে, অথচ ওসব করার চেয়ে নিজেকে গোপন রেখে এভাবে সাকাদা করার মূল্য আল্লাহর কাছে অনেক অনেক বেশি। যা একমাত্র সে-ই করতে পারে যাকে আল্লাহ তাওফিক দান করেন।
বাগানে মেঘমালার পানি দেয়ার ঘটনা
সহী মুসলিমে একটি ঘটনা এসেছে। ঘটনাটি আমাদের জন্য অনেক শিক্ষনীয়।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ بَيْنَا رَجُلٌ بِفَلاَةٍ مِنَ الأَرْضِ فَسَمِعَ صَوْتًا فِي سَحَابَةٍ اسْقِ حَدِيقَةَ فُلاَنٍ ‏‏ فَتَنَحَّى ذَلِكَ السَّحَابُ فَأَفْرَغَ مَاءَهُ فِي حَرَّةٍ فَإِذَا شَرْجَةٌ مِنْ تِلْكَ الشِّرَاجِ قَدِ اسْتَوْعَبَتْ ذَلِكَ الْمَاءَ كُلَّهُ فَتَتَبَّعَ الْمَاءَ فَإِذَا رَجُلٌ قَائِمٌ فِي حَدِيقَتِهِ يُحَوِّلُ الْمَاءَ بِمِسْحَاتِهِ فَقَالَ لَهُ يَا عَبْدَ اللَّهِ مَا اسْمُكَ قَالَ فُلاَنٌ ‏.‏ لِلاِسْمِ الَّذِي سَمِعَ فِي السَّحَابَةِ فَقَالَ لَهُ يَا عَبْدَ اللَّهِ لِمَ تَسْأَلُنِي عَنِ اسْمِي فَقَالَ إِنِّي سَمِعْتُ صَوْتًا فِي السَّحَابِ الَّذِي هَذَا مَاؤُهُ يَقُولُ اسْقِ حَدِيقَةَ فُلاَنٍ لاِسْمِكَ فَمَا تَصْنَعُ فِيهَا قَالَ أَمَّا إِذَا قُلْتَ هَذَا فَإِنِّي أَنْظُرُ إِلَى مَا يَخْرُجُ مِنْهَا فَأَتَصَدَّقُ بِثُلُثِهِ وَآكُلُ أَنَا وَعِيَالِي ثُلُثًا وَأَرُدُّ فِيهَا ثُلُثَهُ‏.‏
“আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক লোক কোনো এক মরুপ্রান্তর দিয়ে সফর করছিল। এমন সময় হঠাৎ সে একটি মেঘের খণ্ডের মাঝে আওয়াজ শুনতে পায় যে, অমুকের বাগানে পানি দাও। সাথে সাথে ওই মেঘের খণ্ডটি একদিকে সরে যায়। এবং একটি প্রস্তরময় ভূমিতে বৃষ্টি বর্ষণ করে। ফলে ওখানে থাকা একটি নালা পানিতে একদম ভরে যায়। (এরপর সেই পানি এক দিকে চলতে থাকে।) তখন সেই লোকটি পানির পিছনে পিছনে চলতে থাকে। এক পর্যায়ে সে দেখতে পায়, এক লোক সেই পানি তার বাগানে ছিটিয়ে দিচ্ছে। সে ওই লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর বান্দা! আপনার নাম কি? লোকটি বলল, আমার নাম অমুক। সে ওই নামটিই বলল যা সে মেঘের খণ্ডের মাঝে শুনতে পেয়েছিলেন। তখন বাগানের মালিক বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আপনি কীজন্য আমার নাম জানতে চাইলেন? উত্তরে সে বলল, এ পানি যে মেঘের, তার মাঝে আমি এ আওয়াজ শুনতে পেয়েছি যে, আপনার নাম নিয়ে বলছে, অমুকের বাগানে পানি দাও। বলুন তো, এ বাগানে আপনি এমন কী আমল করেন? তখন মালিক বলল, যেহেতু আপনি জিজ্ঞেস করছেন তাই বলছি, আমি প্রথমে বাগানে উৎপন্ন সব ফলফলাদির হিসেব করি। এরপর এক তৃতীয়াংশ ফল সাদাকা করে দেই। এক তৃতীয়াংশ ফল আমি ও আমার পরিবার-পরিজন খাই এবং এক তৃতীয়াংশ বাগানের পিছনে খরচ করি”। (সহী মুসলিম : ৭৩৬৩)
মালিকের শেষ কথাটি লক্ষনীয়, তিনি বলছেন, “যেহেতু আপনি জিজ্ঞেস করছেন তাই বলছি, আমি প্রথমে বাগানে উৎপন্ন সব ফলফলাদির হিসেব করি। এরপর এক তৃতীয়াংশ ফল সাদাকা করে দেই।…”
এ থেকে বুঝা যায়, এটি ছিল তার গোপন নেক আমল। এ সম্পর্কে তিনি কাউকে কিছু বলতেন না। এই লোক জিজ্ঞেস করার কারণেই তাকে বলছেন।
আমাদের যে সব ভাইদের বাগান আছে, ক্ষেতখামার আছে, তারা এ আমলটি করতে পারেন। ব্যবসায়ী ভাইরাও আমলটি করতে পারেন। দৈনিক যা লাভ হবে তার একটা অংশ সাদাকা করে দিলেন বা এক সাথে বেশি হলে সাদাকা করবেন, এ উদ্দেশ্যে আলাদা করে রাখলেন। পরে এক সাথে সাদাকা করলেন।
ব্যবসায়ী ভাইরা সাদাকা করার উদ্দেশ্যে মাসের কোনো একটি দিনও ঠিক করে নিতে পারেন। উদাহরণত, মনে মনে ঠিক করে নিলেন, প্রতি মাসের ৩০ তারিখে কিংবা প্রতি মাসের শেষ জুমার দিন যা লাভ হবে সবটা আল্লাহর রাস্তায় সাদাকা করে দেবো। এরপর দেখুন, আপনি আপনার ব্যবসায় কী পরিমাণ বরকত অনুভব করেন ইনশাআল্লাহ।
আমাদের চাকরিজীবী ভাইরাও আমলটি করতে পারেন। মাসিক বেতনের একটা অংশ সাদাকা করে দিতে পারেন। হোক পরিমাণে অল্প। মনে রাখবেন ভাই, আল্লাহ দেখবেন আপনার দিল, আপনি কত টাকা সাদাকা করবেন, তা তিনি দেখবেন না। তাই অল্প সল্প যা-ই হোক তা-ই গোপনে সাদাকা করে দিন এবং নিয়মিত করার চেষ্টা করুন। কারণ, যে আমল নিয়মিত করা হয় তা পরিমাণে অল্প হলেও আল্লাহর কাছে তার মূল্য অনেক বেশি।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে আমলগুলো করার তাওফিক দান করুন আমীন।
পশু-পাখি ও পোকামাকড়কে খাবার দেওয়া
জীব জন্তু, পশু-পাখি, পোকামাকড় ইত্যাদির জন্য খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা করা। তাদের থেকে কষ্ট দূর করা। এটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি গোপন নেক আমল।
কুকুরকে পানি পান করানোর ওসিলায় এক বেশ্যা নারীর জান্নাতে চলে যাওয়ার হাদিসটি কে না জানে?
হাদিসটির শেষে এসেছে,
فشكر الله له فغفر له‏
আল্লাহ তার এই আমলটির কদর করেন এবং (এর ওসিলায়) তাকে ক্ষমা করে দেন।
সাহাবীগণ বললেন,
يارسول الله إن لنا في البهائم أجراً‏؟‏
হে আল্লাহর রসূল! পশুদের (প্রতি দয়া দেখালে সে) ক্ষেত্রেও কি আমাদের সাওয়াব আছে?
তিনি বললেন,
في كل كبدٍ رطبة أجر
প্রতিটি প্রাণীর ক্ষেত্রেই সাওয়াব আছে। (সহী বুখারী : ৬০০৯; সহী মুসলিম : ২২৪৪)
একটু ভাবুন তো, একটি কুকুরকে পানি পান করানোর পুরষ্কার যদি আল্লাহর কাছে এই হয় তাহলে আপনি যদি কোনো মুসলমানকে পানি পান করান, তাকে তার পছন্দের কিছু আহার করান তাহলে এর পুরষ্কার কত বড় হবে?
আর সেই মুসলমান যদি অসহায় কোনো পথশিশু হয়, গরিব এতিম কোনো বালক বা বালিকা হয় বা নেককার অভাবী কোনো নারী বা পুরুষ হয়। কিংবা তিনি যদি অভাবী কোনো হাফেজ হন বা আলেম হন বা আপনারই কোনো নিকটাত্মীয় হন কিংবা আপনার নিজের ভাই হন, বোন হন, মা হন, বাবা হন তাহলে এর পুরষ্কার কত বড় হবে? কল্পনা করা যায় ভাই?
আমাদের সমাজে কত কত মুসলমান আছে, যারা শুধু অভাবের কারণে ঠিকমত দ্বীনের ওপর চলতে পারে না। তাদেরকে যদি একটু সহায়তা করা যায় তারা যে কত খুশি হন! গরিব মানুষের মন উদার হয়, তারা অল্পতেই অনেক খুশি হয়। তাই এ আমলটিরও আমরা ইহতিমাম করার চেষ্টা করি ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফিক দান করেন আমীন।
এক মুহাদ্দিসের ঘটনা
ছোট্ট একটি ঘটনা মনে পড়ল। অনেক আগে পড়েছিলাম।
এক মুহাদ্দিসের ইন্তিকালের পর স্বপ্নে তাঁর এক ছাত্র তাঁর অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দেন, আল্লাহ তাআলা খুবই ছোট্ট একটি আমলের ওসিলায় আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। যা আমি কল্পনাও করিনি। কী সেই আমল, জিজ্ঞেস করলে বললেন, একদিন লিখছিলাম। লিখার মাঝখানে একবার দোয়াত থেকে কলম বের করে যে-ই লিখতে যাব অমনি দেখি, একটি মাছি উড়ে এসে কলমের মাথায় বসল এবং দ্রুত কালি চুসতে শুরু করল। ভাবলাম, মাছিটি হয়তো পিপাসিত। তাই একটু সময় দেরি করলাম। মাছিটি নিজ থেকে চলে গেলে আবার লিখতে শুরু করলাম। ছোট্ট এই আমলটির ওসিলায় আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
মুহতারাম ভাই, আল্লাহর কাছে আসলে সব আমলই সমান। ছোট-বড় নাই। সবই ছোট। আমাদের কাছে কোনো আমল যত বড়ই হোক আল্লাহর কাছে সবই ছোট। আল্লাহর কাছে কোনো আমল বড় হয় তখনই যখন তা একমাত্র তাঁর জন্য করা হয়। বাহ্যত তা ছোট হলেও আল্লাহর কাছে তা ছোট না।
এজন্য ভাই, ছোট আমলগুলোর প্রতি আরও বেশি ইহতিমাম করা উচিত। কারণ, ছোট আমলের মধ্যে শয়তানও শয়তানি করার চেষ্টা করে না। বা করার সুযোগ পায় না। ছোট আমল কেউ দুনিয়াবি স্বার্থে করে না। তাই এমন আমলের কদর আল্লাহর কাছে অনেক বেড়ে যায়।
গোপনে অভাবী ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া
০৩ : বাহ্যত সচ্ছল কিন্তু ঋণগ্রস্ত, গোপনে এমন ভাইদের ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া। এ আমলটিও আমাদের বিত্তবান ভাইয়েরা করতে পারেন। কোনো মুদি দোকানে গিয়ে সেখান থেকে যারা যারা বাকি নেয় তাদের মধ্য হতে অভাবী এক দুজনের ঋণ শোধ করে দিলেন। পুরোটা বা আংশিক। দোকানিকে বললেন, তিনি যেন ওই ব্যক্তিকে না বলেন।
এ আমলগুলো যে কত মূল্যবান, তা এ দুনিয়ায় থেকে আমরা কল্পনাও করতে পারব না। পরকালেই বুঝা যাবে, ছোট ছোট এসব আমলের কত যে মূল্য!
ইমাম ইবনুল মুবারক রহ. এর ঘটনা
ইমাম ইবনুল মুবারক রহ. এর জীবনীতে এমন একটি ঘটনা এসেছে। তাঁর এক ছাত্র নিয়মিত তাঁর দরসে হাজির হত। একবার তিনি ওই ছাত্রকে দরসে না দেখে উপস্থিত লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, সে কোথায়? তারা জানাল, সে এক লোক থেকে ঋণ নিয়েছিল। পরে যথাসময়ে তা দিতে পারেনি। তাই ওই লোক তাকে আটকে রেখেছে।
দরস শেষ হলে তিনি খবর নিয়ে ওই পাওনাদারের কাছে যান। এবং পুরো ঋণ পরিশোধ করে দেন। ওই লোককে বলেন, এটি কাউকে বলবে না।
পর দিন ওই ছাত্র দরসে হাজির। ইমাম ইবনুল মুবারক রহ. জিজ্ঞেস করলেন, এত দিন কোথায় ছিলে? ভাবটা এমন যেন কিছুই জানেন না। সে পুরো ঘটনা বলল। শেষে বলল, আল্লাহর কোন এক বান্দা যেন ঋণগুলো পরিশোধ করে দিয়েছেন। তাই ছুটে আসতে পেরেছি আলহাদুলিল্লাহ।
ঘটনাটিতে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা যেন আমাদেরকেও তাওফিক দান করেন আমীন।
এতিম, বিধবা ও অসহায় বয়স্ক নারী-পুরুষকে সহায়তা করা
০৪ :  সমাজের এতিম, বিধবা এবং অভাবী বয়স্ক লোকদেরকে আর্থিক ভাবে সহায়তা করা। বিশেষ করে এমন বৃদ্ধ নারী-পুরুষকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা যাদেরকে তাদের সন্তানরা তেমন একটা যত্ন করে না। আমাদের সমাজে এমন মানুষের তো অভাব নেই।
বন্দি মুসলমানদেরকে এবং তাদের পরিবার-পরিজনকে সহায়তা করা
০৫ :  অন্যায়ভাবে বন্দি মুসলমান ভাইবোনদের মুক্তির জন্য চেষ্টা করা। এ কাজে অর্থ ব্যয় করা। তাদের পরিবার-পরিজনকে আর্থিক ভাবে সহায়তা করা।
একাকী থাকাকালে নফল নামাজ পড়া
০৬ : নিজের ঘরে কিংবা অন্য কোথাও একাকী থাকাকালে নফল নামাজ পড়া। বিশেষ করে শেষ রাতে।
শেষ রাতে উঠতে না পারলে কমপক্ষে শুয়ে শুয়েই ইস্তেগফার পড়া
০৭ : শেষ রাতে নামায পড়তে না পারলে অন্তত বিছানায় শুয়ে শুয়েই কিছুক্ষণ ইস্তেগফার পড়া।
সব সময় কোনো না কোনো যিকির করতে থাকা
০৮ : সব সময় কোনো না কোনো যিকির করতে থাকা। কখনো ঠোঁট নাড়িয়ে, কখনো ঠোঁট বন্ধ রেখে, মনে মনে। বসা অবস্থায়। হাঁটা অবস্থায়। মসজিদে নামাযের অপেক্ষায় বসে আছেন তখন। কোথাও দাঁড়িয়ে কারো জন্য অপেক্ষা করছেন তখন। গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছেন তখন।
যে কোনো যিকিরই করা যায়। সাধারণভাবে ইস্তিগফার ও দুরুদ বেশি বেশি পড়া যায়। তবে সর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে তাসবীহের বাক্যগুলো বেশি বেশি পড়া চাই। সুবহানাল্লাহ, সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার।
আমাদের আযকার ফাইলের শেষে কিংবা gazwa.net এ প্রকাশিত ‘সকাল সন্ধ্যার মাসনূন যিকির’ [http://gazwah.net/?p=25686] নামের ছোট্ট রেসালাটির শেষে সহজ বারটি যিকির শিরোনামে যে যিকিরগুলো রয়েছে, আমরা যদি রাত দিন মিলিয়ে এ যিকিরগুলো ১০০ বার করে বারশ বার পড়ে নিতে পারি তাহলে এটি আমাদের জন্য অনেক বড় একটি আমল হবে ইনশাআল্লাহ। সবগুলো না পারলে কমপক্ষে যে যিকিরগুলো ১০০ বার পড়ার কথা বলা হয়েছে ওগুলো ১০০ বার আর অন্যগুলো যে কয়বার পারা যায়, পড়ে নিতে পারি ইনশাআল্লাহ।
অন্তরের ইবাদতের পরিমাণ বাড়ান
এখানে অতিরিক্ত একটি কথা বলি ভাই, আমরা আমাদের অন্তরের ইবাদতের পরিমাণ যত পারি, বাড়ানোর চেষ্টা করি। আরবিতে যাকে বলে,  عبادة القلب
সাহাবিদের মর্যাদার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হল, তাদের ইবাদাতুল কালব বা অন্তরের ইবাদতের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল।
ইবাদাতুল কালব বা অন্তরের ইবাদতের তালিকায় আসবে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এবং তাঁদের ছোট বড় প্রতিটি নির্দেশ ও সুন্নাহর প্রতি সীমাহীন মহব্বত ও ভালোবাসা। ছোট বড় প্রতিটি কাজ একমাত্র আল্লাহর জন্য করা। আল্লাহর প্রতিটি ফায়সালার প্রতি তাসলীম ও রেযা-আত্মসমর্পণ ও সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেয়া। সালামাতে কালব বা হৃদয়ের স্বচ্ছতা। শোকর। ইছার বা নিজের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া। যে কোনো নেক আমলের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তা করার নিয়ত করে ফেলা। বাহ্যত তা যত কঠিনই হোক।
এখানে কয়েকটা নমুনা বললাম মাত্র। এমন আরও যা যা কালবের আমল আছে সবই গোপন নেক আমলের তালিকায় আসবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফিক দান করেন। আমীন।
নির্জনে আল্লাহর কথা স্মরণ করে চোখের পানি ফেলা
০৯ :  প্রতিদিন অন্তত একবার নিজের অতীত গুনাহের কথা স্মরণ করে এবং আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতের কথা, পাশাপাশি সেই নেয়ামতের যথাযথ শোকর আদায় করতে না পারার কথা চিন্তা করে চোখ থেকে এক দু’ফোঁটা অশ্রু ফেলা। আল্লাহর কথা মনে করে নির্জনে কাঁদা অনেক বড় একটি আমল।
পরিমাণে অল্প হলেও গভীর মনযোগ সহকারে কুরআন তেলাওয়াত করা
১০ : পরিমাণে অল্প হলেও প্রতিদিন কিছু সময় অর্থের প্রতি লক্ষ্য করে গভীর মনযোগ সহকারে কুরআন তেলাওয়াত করা।
সকল মুসলমানের জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করা
১১ : দোয়া করা। নিজের জন্য এবং দুনিয়ার সকল মুসলমান ভাইবোনদের জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করা।
নফল রোযা রাখা
১২ : নফল রোযা রাখা। প্রতি সোমবার ও বৃহঃপতি বার এবং আরবি মাসের মাঝামাঝি তিন দিন।
এখানে শুধু কিছু নমুনা পেশ করলাম। আমরা নিজেরা এমন আরও অনেক গোপন নেক আমলের তালিকা করে নিতে পারি।
মূল্যবান একটি বাণী এবং একটি দোয়া
সবশেষে হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযি. এর খুবই মূল্যবান একটি বাণী এবং হাদিসে আসা একটি দোয়া বলেই কথা শেষ করছি। দোয়াটি আমরা সব সময় পড়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযি. বলতেন,
المخلص لربه كالماشي على الرمل لا تسمع خطواته ولكن ترى آثاره . جامع العلوم والحكم : ٣٠٢
“ইখলাসের সাথে আমলকারীর দৃষ্টান্ত হল এমন, যেমন কেউ বালির ওপর দিয়ে হেঁটে যায়। তার পায়ের ছাপ তো দেখা যায় কিন্তু আওয়াজ শুনা যায় না”।(জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম : ৩০২)
اَللَّهُمَّ اجْعَلْ سَرِيْرَتِي خَيْراً مِن عَلانِيَتِي، وَاجْعَلَ عَلانِيَتِي صَالِحَةً
“হে আল্লাহ, আমার আভ্যন্তরীণ অবস্থা বাহ্যিক অবস্থার চেয়েও ভালো করে দিন এবং আমার বাহ্যিক অবস্থাও ঠিক করে দিন”। (জামে সাগীর : ৬১৬১)
আজ কথা এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে কথাগুলোর ওপর আমল করার তাওফিক দান করেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাঁর দীনের জন্য কবুল করেন, শাহাদাত পর্যন্ত জিহাদ ও কিতালের পথে অবিচল থাকার তাওফিক দান করেন এবং আমাদের সবাইকে সর্বোচ্চ জান্নাত জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করেন আমীন।
وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله وأصحابه أجمعين
وآخردعوانا أن الحمد لله رب العالمين

**************

 

 


مع تحيّات إخوانكم
في مؤسسة الفردوس للإنتاج الإعلامي
আপনাদের দোয়ায় মুজাহিদ ভাইদের স্মরণ রাখবেন!
আল ফিরদাউস মিডিয়া ফাউন্ডেশন
In your dua remember your brothers of
Al Firdaws Media Foundation

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fifteen − 3 =

Back to top button