আল-ফিরদাউস মিডিয়া ফাউন্ডেশনইলম ও আত্মশুদ্ধিনির্বাচিতবই ও রিসালাহমিডিয়া

পিডিএফ/ওয়ার্ডঃ ‘দ্বীনের সঠিক বুঝ কিভাবে অর্জন করবো?’ – মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ

‘আল ফিরদাউস’ পরিবেশিত
মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ এর তাযকিয়া ক্লাস এর লিখিত সংস্করণ
আত্মশুদ্ধি – ০৩
‘দ্বীনের সঠিক বুঝ কিভাবে অর্জন করবো?’
মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ
পিডিএফ/ওয়ার্ডঃ ‘দ্বীনের সঠিক বুঝ কিভাবে অর্জন করবো?’ – মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ
ডাউনলোড করুন
PDF
WORD
======================

মাওলানা সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহঃ আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা সাইয়িদিল আম্বিয়া-ই ওয়াল-মুরসালীন, ওয়া আলা আলিহী, ওয়া আসহাবিহী, ওয়ামান তাবিয়াহুম বি ইহসানিন ইলা ইয়াওমিদ্দীন, মিনাল উলামা ওয়াল মুজাহিদীন ওয়া আম্মাতিল মুসলিমীন। আমীন ইয়া রাব্বাল আ’লামীন।

ভাই ! আমরা সকলেই প্রথমে দুরূদ শরীফ পড়ে নিই।

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ

আলহামদুলিল্লাহ বেশ কিছুদিন পর আবার আমরা তাযকিয়া মজলিসে হাজির হতে পেরেছি, এ জন্য আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করি আলহামদুলিল্লাহ।

উপস্থিত এক ভাইঃ আলহামদুলিল্লাহ।

উস্তাদ সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহঃ ভাইয়েরা আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় – ‘দ্বীনের সঠিক বুঝ কিভাবে অর্জন করবো?’। আল্লাহ্‌ তাআলা তাওফিক দিলে এ বিষয়ে কিছু কথা বলবো ইনশাআল্লাহ্‌।

মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে তথা মানব জাতিকে তিনটি বিশেষ উপাদান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। দেহ, জ্ঞান এবং আত্মা। এর মধ্যে দেহের কল্যাণ সাধন করে ইসলাম, জ্ঞানকে দিকনির্দেশনা দেয় ঈমান আর আত্মার পরিশুদ্ধি নিশ্চিত করে ইহসান। একজন মানুষের পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠা এ উপাদানগুলোর সঠিক সমন্বয়ের উপর নির্ভরশীল। এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক কঠিন বিষয় হলো ইহসান, যা আত্মার পবিত্রতা অর্জনের সাথেই সম্পৃক্ত। আত্মার পবিত্রতা অর্জনের কিছু দিক নিয়ে গত দুই মজলিসে আলোচনা হয়েছে। মনে আছে ভাই?

উপস্থিত এক ভাইঃ জি ভাই।

উস্তাদ সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহঃ ইসলাম, ঈমান ও ইহসান এই তিনটি বিষয় ঠিক হয়ে গেলে একজন ব্যক্তির মাঝে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন চলে আসবে। তাছাড়া হাদীসে জিবরাঈল থেকেও বুঝা যায় যে, এই তিন জিনিসের নামই হচ্ছে দ্বীন। হাদীসটি আমি এখানে পেশ করছি, আপনারা গভীরভাবে লক্ষ্য করুন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম, ঈমান ও ইহসানের পরিচয় কীভাবে তুলে ধরেছেন।

ইসলাম, ঈমান  ইহসানের পরিচয়

عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه قَالَ : بَيْنَما نَحْنُ جُلُوسٌ عِنْدَ رَسُول الله صلى الله عليه وسلم ذَاتَ يَومٍ، إذْ طَلَعَ عَلَينا رَجُلٌ شَديدُ بَياضِ الثِّيابِ، شَديدُ سَوَادِ الشَّعْرِ، لا يُرَى عَلَيهِ أثَرُ السَّفَرِ، وَلا يَعْرِفُهُ مِنَّا أحَدٌ، حَتَّى جَلَسَ إِلَى النَّبيّ صلى الله عليه وسلم، فَأَسْنَدَ رُكْبَتَيهِ إِلَى رُكْبتَيهِ، وَوَضعَ كَفَّيهِ عَلَى فَخِذَيهِ، وَقالَ : يَا مُحَمَّدُ، أخْبرني عَنِ الإسلامِ، فَقَالَ رَسُول الله صلى الله عليه وسلم : الإسلامُ أنْ تَشْهدَ أنْ لاَّ إلهَ إلاَّ الله وَأنَّ مُحمَّدًا رسولُ الله، وتُقيمَ الصَّلاةَ، وَتُؤتِيَ الزَّكَاةَ، وَتَصومَ رَمَضَانَ، وَتَحُجَّ البَيتَ إن اسْتَطَعْتَ إِلَيْهِ سَبيلًا، قَالَ : صَدَقْتَ، فَعَجِبْنَا لَهُ يَسْأَلُهُ وَيُصَدِّقهُ! قَالَ : فَأَخْبرنِي عَنِ الإِيمَانِ، قَالَ : أنْ تُؤمِنَ باللهِ، وَمَلائِكَتِهِ، وَكُتُبهِ، وَرُسُلِهِ، وَاليَوْمِ الآخِر، وتُؤْمِنَ بالقَدَرِ خَيرِهِ وَشَرِّهِ، قَالَ : صَدقت، قَالَ : فأَخْبرني عَنِ الإحْسَانِ، قَالَ : أنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأنَّكَ تَرَاهُ فإنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فإنَّهُ يَرَاكَ، قَالَ : فَأَخْبِرني عَنِ السَّاعَةِ، قَالَ : مَا المَسْؤُولُ عَنْهَا بأعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ، قَالَ : فأخبِرني عَنْ أمَاراتِهَا، قَالَ :  أنْ تَلِدَ الأَمَةُ رَبَّتَهَا، وأنْ تَرَى الحُفَاةَ العُرَاةَ العَالَةَ رِعَاءَ الشَّاءِ يَتَطَاوَلُونَ في البُنْيَانِ ثُمَّ انْطَلقَ فَلَبِثْتُ مَلِيًّا، ثُمَّ قَالَ : يَا عُمَرُ، أَتَدْري مَنِ السَّائِلُ؟ قُلْتُ : اللهُ ورسُولُهُ أعْلَمُ، قَالَ : فإنَّهُ  جِبْريلُ أَتَاكُمْ يعْلِّمُكُمْ دِينَكُمْ . رواه مسلم.

হযরত ওমর বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদিন আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বসা ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ এক লোক আমাদের কাছে এল। লোকটির পোশাক ছিল ধবধবে সাদা এবং চুলগুলো ছিল কুচকুচে কালো। তার শরীরে সফরের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না। (তাতে মনে হচ্ছিল, লোকটি মদিনারই কেউ হবে) কিন্তু আমাদের কেউ তাকে চিনতেও পারছিল না। (এর দ্বারা মনে হচ্ছিল, সে দূরের কোনো এলাকার হবে) সে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বসল এবং তার হাঁটু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাঁটুর সঙ্গে মিলিয়ে দুহাত নিজের উরুর ওপরে রেখে বলল, হে মুহাম্মদ! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন।

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইসলাম হল, তুমি সাক্ষ্য দেবে, আল্লাহ ছাড়া কোনও ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রসূল। নামায কায়েম করবে। যাকাত আদায় করবে। রমযানের রোযা রাখবে এবং সামর্থ থাকলে কাবা ঘরের হজ্জ করবে।

সে বলল, আপনি ঠিক বলেছেন। আমরা তার আচরণে আশ্চর্য হলাম, সে জিজ্ঞাসাও করছে আবার সমর্থনও করছে।

সে (আবার) বলল, আপনি আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন।

তিনি বললেন, তুমি আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রসূলগণ, পরকাল ও তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস রাখবে। সে বলল, আপনি ঠিক বলেছেন।

সে (আবার) বলল, আমাকে ইহসান সম্পর্কে বলুন। তিনি বললেন, ইহসান হল, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো। যদি তাঁকে দেখতে না পাও, তাহলে তিনি তো তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন।

সে বলল, আপনি আমাকে কেয়ামত সম্পর্কে বলুন (যে, তা কবে হবে?) তিনি বললেন, এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি জিজ্ঞাসাকারীর চেয়ে বেশি অবহিত নয়। সে বলল, তাহলে কেয়ামতের নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে বলুন।

তিনি বললেন, (কেয়ামতের নিদর্শন হল) কৃতদাসী তার মনিবকে প্রসব করবে। তুমি নগ্নপদ, বস্ত্রহীন ও দরিদ্র ছাগলের রাখালদেরকে অট্টালিকা (নির্মাণে) র ব্যাপারে একে অপরের ওপর গর্ব করতে দেখবে। এরপর লোকটি চলে গেল। (হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,) আমি বেশ কদিন অপেক্ষা করার পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে ওমর! তুমি কি জান, প্রশ্নকারী কে ছিল? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, তিনি ছিলেন জিবরাঈল। তিনি তোমাদেরকে দ্বীন শিখাতে এসেছিলেন। (সহী মুসলিম : ৮)

দেখুন ভাই, এ হাদীস থেকে বুঝা যাচ্ছে, ইসলামের সম্পর্ক হল, বাহ্যিক আনুগত্যের সাথে আর ঈমানের সম্পর্ক হল, আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে।

ইসলাম  ঈমান কি একই, না ভিন্ন ভিন্ন?

ইসলাম ও ঈমান কি একই জিনিস, না ভিন্ন ভিন্ন দুটি জিনিস? এ নিয়ে আকীদার কিতাবাদিতে বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে, সে দিকে আমি যাচ্ছি না। এ বিষয়ে আমি শুধু শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ.র কথাটাই উল্লেখ করছি।

তিনি বলেন, ঈমানকে কখনো ইসলাম ও নেক আমল থেকে আলাদা করে উল্লেখ করা হয়। আবার কখনো ঈমান ও ইসলাম দুটোকে একসাথে উল্লেখ করা হয়, যেমন হাদীসে জিবরাঈলে একত্রে এসেছে :

(ما الإسلام … وما الإيمان)

ইসলাম কী, ঈমান কী?

অনুরূপভাবে সূরা আহযাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنَّ ٱلۡمُسۡلِمِينَ وَٱلۡمُسۡلِمَٰتِ وَٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ

নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও নারী, মুমিন পুরুষ ও নারী। [সূরা আহযাব : ৩৫]

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন,

 

قَالَتِ ٱلۡأَعۡرَابُ ءَامَنَّاۖ قُل لَّمۡ تُؤۡمِنُواْ وَلَٰكِن قُولُوٓاْ أَسۡلَمۡنَا وَلَمَّا يَدۡخُلِ ٱلۡإِيمَٰنُ فِي قُلُوبِكُمۡۖ

বেদুঈনরা বলল, ‘আমরা ঈমান আনলাম’। আপনি বলুন, ‘তোমরা ঈমান আন নি’; বরং তোমরা বল, ‘আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি’। এখনও পর্যন্ত ঈমান তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি [সূরা হুজুরাত : ১৪]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

 

فَأَخۡرَجۡنَا مَن كَانَ فِيهَا مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ  فَمَا وَجَدۡنَا فِيهَا غَيۡرَ بَيۡتٖ مِّنَ ٱلۡمُسۡلِمِينَ

অতঃপর সেখানে যারা মুমিন ছিল, আমি তাদেরকে বের করে নিয়ে এসেছি, তবে আমি সেখানে একটি ঘর ব্যতীত আর কোন মুসলিম ঘর পাইনি। [সূরা যারিয়াত : ৩৫-৩৬]

উপরোক্ত আয়াতগুলোতে ঈমান ও ইসলাম একসাথে উল্লেখ করা হয়েছে তাই ইসলাম অর্থ হবে বাহ্যিক আমল। যেমন, কালিমার সাক্ষ্যদান, সালাত, যাকাত, সিয়াম ও হজ্জ ইত্যাদি। আর ঈমান অর্থ হবে অভ্যন্তরীণ আমল। যেমন, আল্লাহর ওপর ঈমান, তাঁর ফেরেশতা, কিতাবসমূহ ও নবী-রাসূলগণের ওপর ঈমান এবং আখেরাতের ওপর ঈমান।

পক্ষান্তরে কোথাও যখন শুধু ঈমান শব্দটি উল্লেখ করা হয়, ইসলাম উল্লেখ করা হয় না তখন ঈমান শব্দটি বাহ্যিক আমল ও অভ্যন্তরীণ আমল দুটোকেই শামিল করবে। যেমন, ঈমানের শাখা-প্রশাখা সংক্রান্ত এক হাদীসে এসেছে,

«الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ أَوْ، بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً، فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الأَذَى عَنِ الطَّرِيقِ، وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيمَانِ»

ঈমানের সত্তর বা ষাটের চেয়েও বেশি শাখা রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোচ্চ শাখা হল ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা আর সর্ব নিম্ন শাখা হল, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়া এবং লজ্জা ঈমানের (একটি বিশেষ) শাখা। (সহী মুসলিম : ৩৭)

অনুরূপভাবে যেসব হাদীসে নেক আমলকে ঈমানের অংশ সাব্যস্ত করা হয়েছে সেখানে ঈমান অর্থ ইসলাম ও ঈমান উভয়টা, অর্থাৎ পুরো দ্বীনে ইসলাম। (মাজমুউল ফতোয়া : ৭/১৩-১৫, সংক্ষিপ্ত)।

মোটকথা, মুমিন বললে আমরা যেমন বুঝি, যার মধ্যে ইসলাম আছে আবার মুসলিম বললেও আমরা বুঝি, যার মধ্যে ঈমান আছে। আল্লাহ তা’আলা কুরআনুল কারীমে অনেক জায়গায় সম্বোধন করার ক্ষেত্রে বলেছেন, হে মুমিনগণ। ওসব জায়গাতে পুরো দ্বীনই উদ্দেশ্য। উদাহরণ হিসেবে সূরা মায়েদার একটি আয়াত এখানে উল্লেখ করছি। আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ وَابْتَغُواْ إِلَيهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُواْ فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ কর এবং তাঁর পথে জেহাদ কর যাতে তোমরা সফলকাম হও। [সুরা মায়েদা : ৩৫]

উদাহরণ হিসেবে এ আয়াতটি পেশ করার একটি বিশেষ কারণ আছে। একবার আমি এক ভাইয়ের সাথে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হই, যার সূচনা হয়েছিল এই আয়াতকে কেন্দ্র করে। ঘটনাটি বলবো ভাই?

উপস্থিত এক ভাইঃ জি ভাই বলুন।

আত্মশুদ্ধির জন্য কি পীর ধরা জরুরি?

উস্তাদ সালেহ মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহঃ ঘটনাটি হল, ওই ভাই আমাকে বলছিলেন, আত্মশুদ্ধির জন্য আপনি কার কছে বাই’আত হয়েছেন? আপনার পীর কে? আমি প্রথমে উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, কেন ভাই, আত্মশুদ্ধির জন্য কি পীর ধরা জরুরি? যদিও আমার নিজেরও একজন মুরব্বি আছে, কিন্তু সেটা না বলে, আমি তাকে প্রশ্নটা করলাম, তার মনোভাবটা কী, তা বুঝার জন্য।

ওই ভাই বললেন, আত্মশুদ্ধি করা ফরজ, এর জন্য কোনও পীরের কাছে যেতে হবে, সুতরাং পীর ধরা ফরজ। আমি বললাম, ফরজ, ওয়াজিব তো ভাই দলিলের মাধ্যমে প্রমাণিত হতে হয়, এটা কোন দলিলের মাধ্যমে প্রমাণিত হল?

তখন ওই ভাই দলিল হিসেবে সূরা মায়েদার এই আয়াতটি পেশ করে আয়াতের অনুবাদ এভাবে করেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং (আত্মশুদ্ধির জন্য) ওসিলা বা মাধ্যম তালাশ করো।

তিনি বললেন, এখানে ওসীলাহ বা মাধ্যম বলে পীর ধরাকে বুঝানো হয়েছে।

আমি বললাম, যদি এটাই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে আযানের দোয়ায় যে আমরা বলি, ‘আ-তি মুহাম্মাদানিল ওয়াসীলাহ’ – এর অর্থ করতে হবে এভাবে যে, হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে (আত্মশুদ্ধির জন্য) ওসীলাহ বা মাধ্যম তথা পীর দান করুন। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক।

এরপর বললাম, ভাই আয়াত তো এখানেই শেষ নয়, পরের অংশটুকুও দেখুন, আল্লাহ তা’আলা কী বলছেন, ‘তাঁর পথে জেহাদ কর যাতে তোমরা সফলকাম হও’

তখন ওই ভাই একদম চুপ হয়ে যান।

ওসীলাহশব্দের ব্যাখ্যা কী?

এখানে আমাদের দু’টি বিষয় পরিষ্কার হওয়া জরুরি,

এক। আয়াতে উল্লেখিত ‘ওসীলাহ’ শব্দের ব্যাখ্যা কী?

দুই। আযানের দোয়ায় উল্লেখিত ‘ওসীলাহ’ শব্দের ব্যাখ্যা কী?

এক তাফসীরে ইবনে কাছীরসহ অধিকাংশ তাফসীরের কিতাবে ‘ওসীলাহ’ শব্দের ব্যাখ্যায় এসেছে,

وابتغوا إليه الوسيلة : أي القربة

তোমরা আল্লাহর নৈকট্য তালাশ করো। এটি হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাখ্যা।

হযরত কাতাদাহ রহ. থেকে এর ব্যাখ্যা এসেছে এভাবে,

وقال قتادة : أي تقربوا إليه بطاعته والعمل بما يرضيه

তোমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করো তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে এবং এমন আমলের মাধ্যমে যা দ্বারা তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।

দুই মুসলিম শরীফে বর্ণিত একটি হাদীসে আযানের দোয়ায় উল্লেখিত ‘ওসীলাহ’ শব্দের ব্যাখ্যা এসেছে।

عن عبد الله بن عمرو بن العاص رضي الله عنهما أنه سمع النبي صلى الله عليه وسلم يقول إذا سمعتم المؤذن فقولوا مثل ما يقول ثم صلوا علي فإنه من صلى علي صلاة صلى الله عليه بها عشرا ثم سلوا الله لي الوسيلة فإنها منزلة في الجنة لا تنبغي إلا لعبد من عباد الله وأرجو أن أكون أنا هو فمن سأل لي الوسيلة حلت له الشفاعة رواه مسلم(577).

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন, তোমরা যখন মুআজ্জিনকে আযান দিতে শোন, তখন তোমরাও তা-ই বলো যা সে বলে। অতঃপর আমার উপড় দুরুদ পড়। কারণ, যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দুরুদ পড়ে, আল্লাহ তা’আলা তার ওপর দশটি রহমত নাযিল করেন। এরপর আল্লাহর কাছে আমার জন্য ‘ওসীলাহ’র দোয়া করো, ‘ওসীলাহ’ হল, জান্নাতের একটি বিশেষ স্তর বা মর্যাদা। যা শুধু আল্লাহর একজন বান্দার জন্য নির্ধারিত। আমি আশাবাদি, আমিই হবো সেই বান্দা। সুতরাং যে কেউ আমার জন্য ‘ওসীলাহ’র দোয়া করবে, তার জন্য আমার সুপারিশ অবধারিত হয়ে যাবে। (সহী মুসলিম : ৫৭৭)

এ হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে, ওসীলাহ হল জান্নাতের বিশেষ একটি স্তর বা মর্যাদা।

পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল, কুরআন-হাদীসের ক্ষেত্রে তাহকীক ছাড়া নিজের ধারণা প্রসূত কোন ব্যাখ্যা চালিয়ে দেয়া যাবে না।

মুহতারাম ভাইয়েরা! আজকের আলোচনা এখানে শেষ করছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের জন্য কবুল করুন।

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার এবং আমলের দিক দিয়ে আরও অগ্রসর হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমিন।

আমাদের মুজাহিদ ভাইদেরকে বিশ্বের সব জায়গায় শত্রুর ওপর বিজয় দান করুন। আমিন।

আমাদের সবাইকে ইখলাসের সাথে জিহাদ ও শাহাদাতের পথে অবিচল থাকার তাওফীক দান করুন এবং পরকালে আমাদেরকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন, আমীন ইয়া আরহামার রাহিমীন।

আমরা সকলে মজলিস থেকে উঠার দোয়াটা পড়ে নিই।

سبحانك اللهم وبحمدك، أشهد أن لا إله إلا أنت، أستغفرك وأتوب إليك

وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله واصحابه اجمعين

وآخر دعوانا ان الحمد لله رب العالمين

 

*****************

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × five =

Back to top button