পিডিএফ/ওয়ার্ড ||পূর্ব তুর্কিস্তান থেকে খোরাসান – শাইখ আব্দুল হক তুর্কিস্তানীর দুর্লভ জীবনকাহিনী
পূর্ব তুর্কিস্তান থেকে খোরাসান
মাওলানা হামিদুর রহমান অনুদিত
রবিউল আওয়াল ১৪৩৮ হিজরী — ডিসেম্বর ২০১৬ ঈসায়ী তে আরবি থেকে বাংলায় অনূদিত
===============
پی ڈی ایف
PDF (1.1 MB)
পিডিএফ ডাউনলোড করুন [১.১ মেগাবাইট]
লিংক-১ : https://archive.org/download/purbo-turkistaner-amir/PurboTurkistanerAmir.pdf
লিংক-২ : https://workdrive.zohopublic.eu/file/db7hya972e49ad04549b2bd377e90f95e16bc
লিংক-৩ : https://drive.internxt.com/sh/file/0c465e20-6256-4a5e-b0e0-e3041216cefb/aefb751ad3b2769f87fff881c40b757cde1c526e4fb07d20015010f0ae3ce641
লিংক-৪ : https://f005.backblazeb2.com/file/PurboTurkistanthekeKhorasan/PurboTurkistanerAmir.pdf
লিংক-৫ : https://www.idrive.com/idrive/sh/sh?k=q4j5h6m7m5
ورڈ
WORD (897 KB)
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন [৮৯৭ কিলোবাইট]
লিংক-১ : https://archive.org/download/purbo-turkistaner-amir/PurboTurkistanerAmir.doc
লিংক-২ : https://workdrive.zohopublic.eu/file/db7hy427d79c6570242a4a3c71c949181e80a
লিংক-৩ : https://drive.internxt.com/sh/file/12c8ca58-f2ad-4214-bb62-d29aa1696198/6e6649a31703e269d2e11fe0faa56b6e9556aa85b71b9a2d4d6baff6ed26e4dc
লিংক-৪ : https://f005.backblazeb2.com/file/PurboTurkistanthekeKhorasan/PurboTurkistanerAmir.doc
লিংক-৫ : https://www.idrive.com/idrive/sh/sh?k=a5d4v3u9z0
غلاف
book cover [2.2 MB]
বুক কভার [২.২ মেগাবাইট]
লিংক-১ : https://archive.org/download/purbo-turkistaner-amir/PurboTurkistanerAmir%20Cover.jpg
লিংক-২ : https://workdrive.zohopublic.eu/file/db7hyb60e48e41c7c438d9b47e09c31d8f789
লিংক-৩ : https://drive.internxt.com/sh/file/6ef8f340-75bf-4d47-ac10-3b8baf818ced/8a94ee1bea21e71166481d7783ae78f486bb984d8bd7448e3722eb5f15360240
লিংক-৪ : https://f005.backblazeb2.com/file/PurboTurkistanthekeKhorasan/PurboTurkistanerAmir+Cover.jpg
লিংক-৫ : https://www.idrive.com/idrive/sh/sh?k=v4o7v4q6o8
******
উইঘুর স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টির আমীর শাইখ আব্দুক হক তুর্কিস্তানীর দুর্লভ জীবনকাহিনী
পূর্ব তুর্কিস্তান থেকে খোরাসান
মাওলানা হামিদুর রহমান অনুদিত
সাড়াজাগানো অনলাইন ভিত্তিক আরবি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নুখবাতুল ফিকর কর্তৃক
রবিউল আওয়াল ১৪৩৮ হিজরী — ডিসেম্বর ২০১৬ ঈসায়ী তে আরবি থেকে বাংলায় অনূদিত
بسم الله الرحمٰن الرحيم
জন্ম ও শৈশব
আমি আপনাদের ভাই আব্দুল হক্ব তুর্কিস্তানী৷ আমি ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের দশ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছি৷ আমার ছয় ভাইবোন রয়েছে৷ ভাইবোনদের মধ্যে আমিই সবচে বড়৷ আমি একটি দ্বীনি পরিবারে জন্মগ্রহণ করি৷ আমার বাবা একজন কৃষক ছিলেন৷ আমি শহরতলীতে জন্মগ্রহণ করেছি৷
চার বৎসর বয়সে আমি কুরআনুল কারীম মুখস্থ করার জন্য মাদরাসায় যাই৷ আমার দাদা আমাকে দ্বীনি ইলম শিক্ষাদানের জন্য তাঁর ছোট ভাইয়ের নিকট প্রেরণ করেন৷ আমার বয়সের স্বল্পতার দরুণ তিনি আমাকে পূনরায় আমার বাবার নিকট প্রেরণ করেন৷ ১৯৭৫ সালে আমি জোরজবরদস্তির স্বীকার হয়ে সরকারি শিক্ষাঙ্গনে যাই এবং সেখানে আমি ১৯৮০ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করি৷ আমি দিনের বেলা সরকারি শিক্ষাঙ্গনে এবং রাতের বেলা দ্বীনি শিক্ষাঙ্গনে পড়াশোনা করতাম৷
ইলম হাসিলের উদ্দেশ্যে সফর
প্রথম পর্যায়ে আমি আমার উস্তাদগণের নিকট আমাদের কতিপয় প্রসিদ্ধ শরয়ী কিতাব অধ্যায়ন করি৷ যেমনঃ “মুহিম্মাতুল মুসলিমিন, মুবিনুল ইসলাম, কিতাবুন ফিস্ সরফ, আহকামু ক্বিরাআতিল কুরআন ও রিসালাতুন ফিল উযু”৷
১৯৮০ সালে আমি সরকারি শিক্ষাঙ্গন থেকে “ক্বরক্বাশ” প্রদেশের “যাবী” অঞ্চলের “জাই তুর্ক” গ্রামে পলায়ন করি এবং মাওলানা আব্দুল্লাহ্ মাখদুম হাজীর নিকট ইলম অন্বেষণ করি৷ তাঁর নিকট আমি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সরফ ও নাহুর কিতাবগুলো এবং ‘মুখতাসারুল বিক্বায়া’ হতে ‘হিদায়া’ পর্যন্ত হানাফী মাজহাবের ফিকহের কতিপয় কিতাব ও আরবি সাহিত্যের ‘আশ শিফা’ কিতাব অধ্যায়ন করি৷ এরপর মাওলানা আব্দুল্লাহ্ মাখদুম হাজী হজ্বে চলে যাওয়ার কারণে আমি আমার গ্রামে ফিরে আসি এবং আমার প্রথম উস্তাদ ‘সাঈদ মাহমুদ খান মাখদুম হাজীর’ অভিমুখে রওয়ানা হই৷ তাঁর নিকট আমি ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ‘আল লু-লু- ওয়াল মারজান’ ও ‘মিশকাতুল মাসাবীহ্’ কিতাবদ্বয় অধ্যায়ন করি৷ ‘সাঈদ মাহমুদ খান মাখদুম হাজী’ যখন হজ্বে যাওয়ার ইচ্ছে করলেন, তখন তিনি আমাকে ‘মাওলানা মুহাম্মাদ তুখতী আখন্দ খলিফার’ হাতে সোপর্দ করেন৷ তাঁর কাছে আমি ‘কারইয়া’ প্রদেশের ‘মুগালা’ শহরে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত নিম্নোক্ত কিতাবগুলো অধ্যায়ন করি: “তাকমিলাতু মিশকাতিল মাসাবীহ্, তাফসীরুল জালালাইন, সাফওয়াতুত তাফাসীর, তাফসীরুল বাইদাবী, হিদায়াতুন নাহু, আল কাফী, আলফিয়াতু ইবনে মালিক” এবং মানতেক শাস্ত্রের “ইসা গুজী, ক্বালা আক্বুলু” ও বালাগাত শাস্ত্রের “তালখীসুল মিফতাহ্”৷ পাশাপাশি ইতিপূর্বে আমি যে সকল কিতাবাদি অধ্যায়ন করেছিলাম সেগুলোও পুনরায় পাঠ করি এবং অনেক উপকারিতা লাভ করি৷ অতপর আমি প্রায় পনের জন ছাত্রকে পাঠদান করা শুরু করি৷ এই বিদগ্ধ মাওলানা সাহেব থেকে আমি অনেক উপকারিতা লাভ করি যেমনঃ
১-ইতিপূর্বে আমি যে সকল কিতাবাদি অধ্যায়ন করেছিলাম সেগুলো তার নিকট পুনরায় পাঠ করা এবং পাশাপাশি আমি তার নিকট যে সকল কিতাব অধ্যায়ন করেছি, সেগুলোও তিনি অত্যন্ত পরিশ্রম করে পাঠদান করিয়েছেন৷
২-তিনি আমাকে হিজরত এবং জিহাদের পথে পথনির্দেশ করেছেন ও হাঁটতে শিখিয়েছেন৷
৩-আমি তার নিকট সুরা তাওবা ও আনফাল এর ব্যাখ্যা অধ্যায়ন করেছি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণের সাথে৷
আমরা যুবকদের একটি দল জিহাদ ও সামরিক বিজ্ঞানে অত্যন্ত উৎসুক ও আগ্রহী ছিলাম৷ তখন আমি আমার এক সহপাঠীর সাথে পায়ে হেঁটে স্থলপথে পর্বত বেয়ে পাকিস্তান অভিমুখে হিজরত করার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম৷ কিন্তু এ কাজটি তখন আমাদের পক্ষে সহজসাধ্য হয়ে ওঠেনি৷
৪-এই বিদগ্ধ আলেমের নিকট আমি “আল ওয়ালা ওয়াল বারার” আকিদা শিক্ষালাভ করেছি৷ এ আকিদার দৃষ্টান্তমূলক তার একটি ঘটনা রয়েছে, যা নিম্নরূপঃ
মাও সেতুং যখন চীনের কমিউনিস্ট সরকার নিযুক্ত হল, তখন চীনা সরকার পূর্ববর্তী তুর্কিস্তানের প্রেসিডেন্ট সাইফুদ্দীন আযীয তুর্কিস্তানের বড়বড় ওলামায়ে কেরামকে মাও সেতুংয়ের সাথে সাক্ষাৎ করা ও প্রেসিডেন্টর পদে ক্ষমতাসীন হওয়ায় তাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ডাকলেন৷ তখন অন্যান্য আলেমদের সাথে মাওলানা মুহাম্মাদ তুখতী আখন্দও বেইজিং শহরে গেলেন৷ তারা বেইজিংয়ে পৌছার পর মাও সেতুং এর সাথে সাক্ষাৎ করার পূর্বে তাদেরকে আসা যাওয়া ও সালাম-কালামের নিয়ম-নীতি শিক্ষাদান করা হয়৷ যেন এই জালিমের সাথে শিষ্টাচার পরিপন্থী কোন আচরণ প্রকাশ না পায়৷ সে সময় এই আলেমের অবস্থান এই ছিল যে, তিনি তাকে অভিবাদন জানানোর জন্য হাত বাড়ানো থেকে বিরত থাকেন এবং ফিরে আসার সময় তাকে তুচ্ছজ্ঞান করে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে চলেন৷ তাকে যখন এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হল: আপনি এমনটি কেন করলেন? তখন তিনি লোকদের থেকে এর উত্তর গোপন রাখলেন৷ অতঃপর তিনি তুর্কিস্তানে ফিরে আসার পর তার কতক বন্ধুর নিকট বিষয়টি বর্ণনা করলে ধীরে ধীরে বিষয়টি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে৷ এমনকি অনেকেই বিষয়টি জেনে ফেলে৷ তখন তাকে তলব করা হলে ও সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি সেই ঘটনাকে অস্বীকার করলেন না৷ তখন সেই জালিম শাসক তাকে বিভিন্ন প্রকার শাস্তি প্রদান, অবমাননা করা ও তার দাড়ি উপড়ে ফেলা শুরু করে৷
অতঃপর এই বিদগ্ধ আলেম হিজরত করা ও দেশ থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিলেন৷ কিন্তু গ্রেফতার হয়ে যান ও তাকে পনের বৎসরের জেল প্রদান করা হয়৷
এই ঘটনাটি আল ওয়ালা ওয়াল বারার একটি বাস্তবিক ঘটনা৷ যা আমরা তার ক্লাসে থাকাবস্থায় তিনি আমাদের নিকট বর্ণনা করেছিলেন৷
৫- তার নিকট থেকে আমি দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি, খোদাভীরুতা ও তাক্বওয়া শিক্ষালাভ করি৷ আমরা প্রতি সপ্তাহে দুইবার কুরআন খতম করতাম; একবার মাদরাসায় আরেকবার জুমআর দিন মসজিদে৷ কুরআন খতম করার পর তিনি আল্লাহর দরবারে দোআর ভেতর কান্নাকাটি-রোনাজারী শুরু করে দিতেন৷ ছাত্রদের মধ্যে কেউ যখন কান্না না করতো তখন তিনি তার প্রতি রাগ হয়ে যেতেন এবং বলতেন, “আল্লাহর দরবারে কি তোমার কিছুই চাওয়ার নেই?!” তিনি সংযমী ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন ভালবাসতেন এবং ছাত্রদেরকে তার উপর উদ্বুদ্ধ করতেন৷
১৯৯০ সালে যখন আমার বয়স ১৯ বৎসর, তখন আমি কৃষিকাজে আমার বাবাকে সাহায্য করার জন্য বাড়িতে ফিরে আসি এবং গ্রামের ছাত্রদের পাঠদানে মশগুল হয়ে যাই৷ সে সময়ে আমি আমার কতক পাকিস্তানস্থ বন্ধুর নিকট আবেদন জানাই আমার জন্য পাকিস্তান সফরের একটি ভিসা পাঠাতে৷ সেই ভিসা এসে পৌছে এবং আমিও পাসপোর্ট করার জন্য পুলিশের নিকট যাই৷ কিন্তু পুলিশ আমার ভিসার কোন গুরুত্ব দেয়নি; বরং সে আমার নিকট অনেক টাকা দাবী করে৷ যা আদায় করতে আমি সক্ষম হইনি ও ভিসা ছেড়ে দিয়েছি৷
সে বৎসরের শেষের দিকে আমি ‘জাওমা’ প্রদেশে ‘উস্তাদ মুহাম্মাদ আমিন জান দামুল্লাহ’র নিকট যাই৷ যিনি পাঠদানের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ‘আব্দুল হাকীম মাখদুম হাজীর’ সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছাত্র ছিলেন৷ আর দা’ওয়াতের ক্ষেত্রে ‘শহীদ আবু মুহাম্মাদ হাসান মখদুম’ তারচে’ বেশি প্রসিদ্ধ ছিলেন৷ এবং ‘উস্তাদ মুহাম্মাদ আমিন জান দামুল্লাহ’ ‘শহীদ আবু মুহাম্মাদ হাসান মখদুমের’ সহপাঠী ছিলেন৷
তাঁর নিকট আমি নিম্নোক্ত কিতাবগুলো পড়েছি:
বালাগাত শাস্ত্রের মুখতাসারুল মাআ’নী৷
মানতেক শাস্ত্রের মিরক্বাত, শামসিয়্যাহ্, শামসিয়্যাহর শরাহ হাশিয়াতুল ক্বুতবী৷
উসূলুল ফিক্বহ শাস্ত্রের উসূলুশ শাশী, নূরুল আনওয়ার, তালবীহের শরাহ তাওযীহ৷
হাদীস শাস্ত্রের সহীহ্ বুখারী, ইমাম নববীর শরাহ সহকারে সহীহ্ মুসলিম৷
তাফসীর শাস্ত্রের তাফসীরুল জালালাইন, বাইদাবী৷
আমি ১৯৯৫ সালের শুরুর দিকে কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে ‘জাওমা’ প্রদেশের পরিস্থিতি জটিল হওয়ার কারণে ‘উস্তাদ মাওলানা জাকির আখন্দ খলীফার’ নিকট চলে যাই এবং তার নিকট ‘আল ফরায়েজ ওয়াল মাওয়ারীস’ কিতাবটি অধ্যায়ন করি৷ ইনি একজন সালাফি আকিদা বিশিষ্ট লোক ছিলেন৷ লোকেরা তাকে ‘ওয়াহাবী’ বলে ডাকতো৷
আমি তার একটি ঘটনা বলছি: আমি ও আমার একজন সহপাঠী যখন তার নিকট গেলাম, তখন তিনি আমাদের নিকট আমাদের পরিচয়পত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন৷ তার এই প্রশ্নের কারণে আমি হতচকিত হয়ে গেলাম৷ আমার নিকট তখন কোন পরিচয়পত্র ছিল না এবং ওলামায়ে কেরাম এতে অভ্যস্ত ছিলেন না যে, ছাত্রদেরকে তাদের পরিচয়পত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন৷ কিন্তু আমার সহপাঠীর নিকট তার পরিচয়পত্র ছিল৷ সে তা বের করে দেখালো ও আমার ব্যাপারে চুপ থাকলো৷ আমরা যখন তার নিকট এর কারণ জানতে চাইলাম তখন তিনি আমাদেরকে একটি ঘটনা শুনালেন৷ একবার পুলিশদের থেকে পালিয়ে আসা খুনী আসামীদের একজন তালিবুল ইলমের ছদ্মাবরণে তার নিকট এসে আশ্রয় নিয়েছিল৷ পরে পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে ও সেই আলেমের প্রতি এই অভিযোগ তুলে যে, তার নিকট আসামীরা আশ্রয় পায়৷ সেই ঘটনার পর থেকে তিনি তার কাছে আসা ছাত্রদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করেন ও তাদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন৷
ফরায়েজ পড়া শেষ হওয়া ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি আমাদেরকে বলেন যে, আমরা যদি তার নিকট কমপ্লিট করি, তাহলে আমরা কাজী (বিচারপতি) হবো এবং মানুষদের মাঝে এ বিষয়ে ফয়সালা করবো৷ অতঃপর আমি আমার গ্রামে ফিরে আসি এবং আব্দুল হাকীম মাখদুম হাজীর সহপাঠী প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ‘মুহাম্মাদ সাঈদ দামুল্লাহ’র নিকট যাই৷ তিনি (তুর্কী ভাষার) “জামিয়ায়ে খানলাক মাদরাসা” তথা তুর্কীস্তানের কাশগর প্রদেশের সুলতানদের দিকে সম্পৃক্ত একটি সুলতানি মাদরাসা থেকে ফারেগ হয়েছেন৷ তার নিকট আমি আরবি সাহিত্যের মাক্বামাতে হারীরী অধ্যায়ন করি এবং তার ওখানে আমি ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বড় ছাত্রদের মাঝে পাঠদানে ব্যস্ত থাকি৷
এ বছরের রমজান মাসে সরকার একশো দিন ব্যাপি ব্যাপকভাবে গ্রেফতার অভিযান শুরু করে এবং অনেক ভাইদেরকে গ্রেফতার করে৷ তন্মধ্যে আমার চাচাতো ভাই আব্দুর রহীম মাখদুমও রয়েছে৷ তাকে সরকারের অনুমতি ব্যতিত মানুষদেরকে আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দেয়ার অভিযোগে দেড় বছরের কারাগারের রায় দেওয়া হয়৷ এই গ্রেফতার অভিযানের কারণ হল, ‘কোরলা’ প্রদেশে পুলিশদের কয়েকটি অস্ত্র চুরি হয়ে যায়৷ এ ঘটনার দুদিন পর
আমার এক ছাত্রের বাবা আমার নিকট এসে আমাকে সংবাদ দিল যে, পুলিশ আমাকে খুঁজছে এবং আজ রাতে আমাকে গ্রেফতার করতে চাচ্ছে৷ সে আমাকে পরামর্শ দেয় যে, আমি যেন বাড়িতে না যাই৷ বাস্তবিকই মাগরিবের পর পুলিশ আমাকে খুঁজতে আসে এবং আমার মাকে আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে৷ তিনি তাদেরকে জওয়াব দেন যে, আমি রাগ করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেছি এবং আমি কোথায় গেছি তা তারা জানেন না৷ পুলিশ একই উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনও আসে৷ আমি তখন আমার বাড়ি থেকে দূরে অন্যত্র সরে গিয়েছিলাম৷
অতঃপর আমি পাসপোর্ট সংগ্রহ করার জন্য রাজধানী “উরুমছি” শহরে সফর করি৷ সরকারের অস্ত্র চুরি হওয়ার কারণে তখন শহরগুলির প্রবেশ ও প্রস্থান দ্বারগুলোতে নিরাপত্তা শর্তগুলি কঠোর ছিল৷ অতঃপর আমি “উরতুশ” শহরে যাই এবং সেখানে আমি আমার এক ছাত্রের বাড়িতে এক সপ্তাহ অবস্থান করি৷ এরপর আমি “তুরফান” প্রদেশে আমার এক সহপাঠীর নিকট যাই এবং তার ওখানে প্রায় দুই সপ্তাহ অবস্থান করি৷ তার কাছে আমি আবদার জানিয়েছিলাম আমার পাসপোর্ট সংগ্রহে সাহায্য করতে; কেননা তার বড়ভাই পুলিশে চাকুরী করতো৷ কিন্তু সে আমাকে কোন সহায়তা করেনি৷ কেননা সে এটা পছন্দ করতো না যে, আমি এ দেশে শিক্ষকতা করা ছেড়ে দিয়ে হিজরত করে চলে যাই৷ সে বলতো, “জাতির শিক্ষাদানে তোর মতন লোকের আমাদের প্রয়োজন”৷
অতঃপর আমি “উরুমছি” শহরে একই উদ্দেশ্য আবার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই৷ এমতাবস্থায় আমি এমন একজনের সাথে সাক্ষাৎ করি, যারা পাসপোর্ট তৈরীর কাজ করে৷ সে আমাকে চীন থেকে প্রথমে রাশিয়া, অতপর কাজাকীস্তান, অতপর পশ্চিম জার্মানে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়৷ তখন আমি এই চিন্তাধারা প্রত্যাখ্যান করি এবং বলি যে, “আমি কুফরী রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিকদের নিকট যেতে চাই না”৷ অতঃপর আমি সিদ্ধান্ত নেই যে, আমি “উরুমছি” শহর থেকেই পাসপোর্ট সংগ্রহ করবো এবং খুব চেষ্টাও চালিয়ে যাই৷ পরিশেষে আমি জানতে পারি যে, পাসপোর্ট পেতে হলে “উরুমছি” শহরে আমাকে আগে নিবন্ধিত হতে হবে এবং এরপর ১৯৯৭ সালে আমি তা সংগ্রহ করি৷
কারাগারে
সেখানে কিছু সংখ্যক পর্দানশিন মেয়েরা আমার নিকট অধ্যায়ন করতো৷ তখন একটি ঘটনা ঘটে৷ তাদের একজনের ভাই এক কমিউনিস্ট কর্মচারীকে প্রহার করে তাকে গুরুতর যখম করেছিল৷ পুলিশ মনে করেছিল তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে এবং আমি তাঁকে এ কাজে উদ্ভুদ্ধ করেছি৷ ফলে তারা আমাকে গ্রেফতার করে৷ আমি কারাগারে প্রায় দুইমাস অবস্থান করি৷ অতপর ২০০০ ইয়োন জরিমানা দিয়ে (যা সে সময় ৩০০ ডলারের সমান ছিল) গৃহবন্দির শর্তে জামিনে বের হয়ে আসি৷ এর এক সপ্তাহ পরই আমি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে অন্য প্রদেশ “কিরইয়া”য় যাওয়ার কারণে পূণরায় গ্রেফতার হই এবং তারা আমাকে প্রায় পাঁচ দিন বন্দি করে রাখে৷ বেড়িয়ে আসার পর আমি বুঝতে পারি যে, তারা আমাকে কখনোই ছাড়বে না৷ তাই আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়া পর্যন্ত আত্মগোপন করে থাকবো এবং এরপর হিজরত করবো৷
আমি “খুতান” শহরে যাই এবং বের হওয়ার ছাড়পত্র পাই৷ এ সময়ে পুলিশ আমাকে সর্বদাই খুঁজে বেড়িয়েছে; কিন্তু কোথাও পায়নি৷ ফলে আমার কারণে আমার বোন ও তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়৷ অতঃপর আমি উরুমছি শহরে যাই৷ সেখানে আমাকে ঐ সকল ব্যবসায়ী ভাইদের একজন স্বাগত জানায়, যারা আমার পার্টনার ছিল৷ সে আমার জন্য হোটেলে একটি জাঁকজমকপূর্ণ রুম ভাড়া করেছিল যেন, পুলিশ আমাকে না খুঁজে৷
ওখানে পৌছে আমি সেই ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করি, যিনি নয় বৎসর পূর্বে আমার হিজরতের সঙ্গী হয়েছিল৷ তিনি সেই শহরেই বসবাস করতেন৷ তিনি যখন আমার পৌছানোর কথা জানতে পারলেন তখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন৷ আমি তাকে অবহিত করলাম যে, আমি হিজরত করতে চাচ্ছি৷ সে তাঁর কতিপয় উস্তাদদের নিকট আমার হিজরতের কথা জানালে তারা এই যুক্তিতে তা প্রত্যাখ্যান করে দিল যে, দাওয়াতের স্বার্থে আমার দেশে থাকার প্রয়োজন৷ তখন আমি তার সাথে বিতর্কে জড়িয়ে গেলাম ও তাকে প্রশ্ন করলাম যে, আমরা উভয়ে নয় বৎসর পূর্বে একসঙ্গে কিসের ওপর সম্মত হয়েছিলাম!? সে এক মসজিদের খতিব ছিল আমি তাকে বললাম, তুমি কিছুতেই এ দেশে হক্বের আওয়াজ বুলন্দ করতে পারবে না৷ তারা তোমাকে কখনোই ছাড়বে না৷ তারা নিঃসন্দেহে তোমাকে কারাবন্দী করবে৷ এবং আমি তাকে সংবাদ দেই যে, আমি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে ও সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চাচ্ছি৷
হিজরতের সূচনা
মার্চ মাসে আমরা বাজারে গেলাম ও সফরের বিশেষ পোষাক ‘ট্রাউজার্স ও শার্ট’ খরিদ করলাম৷ এর একদিন পর এই দুই ভাই আমাকে উরুমছি শহরের এয়ারপোর্ট থেকে বিদায় জানালো এবং ব্যবসায়ী ভাইটি আমাকে ১১০০ ডলার দিল ও বিমানের টিকিট ক্রয় করে দিল৷ বিমানবন্দরের ওয়েটিং রুমে আমি পাকিস্তান ও তুর্কীস্তানের যাত্রীদেরকে বিমানের জন্য অপেক্ষা করতে দেখলাম৷ এবং তাদের মাঝে আনুমানিক ত্রিশ বৎসর বয়সী এক যুবককে দেখতে পেলাম৷ তার সাথে পরিচয় বিনিময় করার জন্য আমি তার কাছে গেলাম৷ আমি তাকে পথের বিভিন্ন তথ্য জিজ্ঞাসা করলাম এবং জানতে পারলাম যে, সে ‘খুতান’ শহরে আমার উস্তাদ ‘মুহাম্মাদ জাকির আখন্দের’ নিকট পড়েছে৷ এরপর সে ইসলামাবাদের ‘জামিআ ফয়সাল’ এ পড়াশুনা করেছে৷ তার নিকট এ সকল তথ্য পেয়ে আমার হৃদয় প্রশান্ত হয়ে যায়৷ তখন আমি সে স্থান ত্যাগ করে তার থেকে দূরে অবস্থান করি, যেন কমিউনিস্ট গোয়েন্দারা আমাদের ব্যাপারে কোন সন্দেহ করে না বসে৷ বিমানে আরোহণের পর আমি তার থেকে বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য তার আসনে গেলাম ও তাকে জানালাম যে, আমি পড়াশুনার জন্য পাকিস্তানে যাচ্ছি৷
পাকিস্তানে
আমরা যোহর নামাযের পূর্বে ইসলামাবাদের বিমানবন্দরে পৌছার পর আমি এক তুর্কীস্তানী ছাত্রের সাথে সাক্ষাৎ করি৷ সে আমাকে স্বাগত জানায়৷ আমি তার নিকট আমার পরিচয় তুলে ধরলে সে আমাকে আমার পাকিস্তানে আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করে৷ আমি বললাম যে, আমি আল্লাহর রাস্তায় ই’দাদ গ্রহণ ও জিহাদ করার জন্য বের হয়েছি৷ তখন সে আমাকে মুচকি হেসে বলল, আমরা ইসলামাবাদের ‘জামিআ ইসলামিয়া’ তে যাব, আপনি তৈরী হয়ে নিন৷
আমরা জামিআর ছাত্রাবাসে তুর্কীস্তানী ভাইদের নিকট গেলাম৷ সেখানে প্রায় পঞ্চাশ জন ভাই পড়াশুনা করতেন৷ নাস্তার পর আমরা ‘মসজিদে ফয়সালে’ গেলাম৷ সেখানে জামিআর প্রিন্সিপাল ও উস্তাদদের সাথে ছাত্রদের এক বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল৷ আমি সভাকক্ষে কোনরকম ইন্টারভিউ ও জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই প্রবেশ করি৷ জামিআয়ে ইসলামিয়ার প্রিন্সিপাল ডঃ শাইখ আহমাদ আল আসসালের বক্তৃতা শুরু হয় এবং তাতে তিনি বিশুদ্ধতর আরবি ভাষায় কথা বলেন, যার সবটাই আমি বুঝেছিলাম৷ সেখানে তিনি একপর্যায়ে সাইয়্যেদুনা হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিম্নোক্ত শ্লোকটি পাঠ করেছিলেন:
ولست أبالي حين أقتل مسلما # علي أي جنب كان في الله مصرعي
অর্থাৎঃ আমাকে যখন মুসলিম হওয়ার অপরাধে হত্যা করা হচ্ছে, তখন আল্লাহর ওয়াস্তে আমার মৃত্যুবরণ যে পার্শ্বেই হোক না কেন, এতে আমার কোন পরোয়া নেই৷
তখন আমি ভীষণ আনন্দ অনুভব করি যে, আমি একটি ইসলামী ভূখন্ডে রয়েছি৷ তার বক্তৃতা প্রায় দুই ঘন্টা যাবৎ দীর্ঘায়িত হয়৷ এরপর একজন তালিবে ইলম আমাকে বাইরে ডেকে নিয়ে যায়৷ কেমন যেন আমি যে ই’দাদ ও জিহাদের জন্য এসেছি, তা সে জানে৷ সে আমার নিকট প্রশিক্ষণ শিবিরের কিছু প্রশিক্ষণের বিবরণ দেয়৷ সে আমাকে প্রশিক্ষণ শিবিরের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী করে তেলে; কিন্তু সে আমাকে এ সংবাদ দেয়নি যে, এ সকল সেনা ক্যাম্প কোথায় পাওয়া যাবে; পাকিস্তানে নাকি আফগানিস্তানে?
এক সপ্তাহ পর আমার পাকিস্তানী পোষাক ক্রয় করার জন্য দু’জন ছাত্র আমার সাথে বাজারে যায়৷ সেদিনই মাগরিবের পর তারা আমার সাথে কাশগরীদের ‘কাশগর রিবাত’ সরাইখানায় যায়৷ আমি একটি রুমে প্রবেশ করি৷ সেখানে লম্বা চুল ঘন দাড়ি বিশিষ্ট এক ব্যক্তি বসা ছিলেন৷ তিনি মূলত ‘তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি’র এক ভাই ও পাকিস্তানস্থ জিম্মাদার ছিলেন৷ সালাম মুসাফাহা ও অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের পর তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি এখন ইসলামের মুজাহিদ হয়ে গিয়েছো’৷ এ কথা শুনে আমি আনন্দিত ও অনুপ্রাণিত হই৷
ফজরের পর তিনি আমাকে এক তুর্কীস্তানী ভাইয়ের সাথে আফগানিস্তানে পাঠান৷ আমরা গাড়ি যোগে ‘মিযান শাহ্’ রোড দিয়ে আছরের পর মাগরিবের কিছুক্ষণ পূর্বে আফগানিস্তানের খোস্তে পৌছি৷ আমরা যখন খোস্ত স্টেশনে পৌছেছিলাম তখন আমাদের সামনে একটি লাল পিকআপ গাড়ি দাড়িয়েছিল এবং তা থেকে একজন নেমে আমাদেরকে স্বাগত জানিয়েছিল ও আমাদের সাথে মুআ’নাক্বা করেছিল, যেন সে আমাদেরকে পূর্ব থেকেই চিনে৷ ইনি ছিলেন ‘শাইখ আবু মুহাম্মাদ রহঃ’ এর ড্রাইভার ‘যবীহুল্লাহ’৷ তিনি আমাদেরকে খোস্ত শহরের ভাইদের ঘাঁটিতে নিয়ে যান এবং আমরা ভাই ‘বিলাল রহঃ’ এর সাথে সাক্ষাৎ করি৷ তিনি সাবেক আমির ভাই ‘আবু মুহাম্মাদ হাসান মাখদুমের’ পক্ষ থেকে খোস্তের জিম্মাদার ছিলেন৷ তারা সকলেই আমাকে অভ্যর্থনা জানায়৷ এগুলো হয়েছিল ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে৷
আমি যখন খোস্তে পৌছি এবং ভাই বিলাল রহঃ আমাকে অভ্যর্থনা জানায় তখন ভাই আবু মুহাম্মাদ সেখানে বিদ্যমান ছিলেন না৷ তিনি তার স্থানে ভাই বিলালকে নিযুক্ত করে দিয়েছিলেন৷ তিনি সে সময় ‘স্বাধীন পূর্ব তুর্কীস্তান’ সংগঠনকে ‘তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি’র সাথে যুক্ত করা ও একাত্বতা পোষণ করার আহবান জানাতে মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে গিয়েছিলেন৷ ভাই বিলালের রহঃ সাথে সাক্ষাৎ করার পর আমি ঘুমিয়েছিলাম৷ তিনি আমাকে জাগ্রত করার সময় ‘আব্দুল হক্ব’ বলে ডাকলেন৷ তাই সে নামকেই আমি এখন পর্যন্ত আমার ডাকনাম হিসেবে গ্রহণ করেছি৷ অতঃপর তিনি আমার নিকট প্রথমে বিভিন্ন তথ্যাবলী সম্বলিত প্রশ্নে পরিপূর্ণ একটি ফরম পেশ করেন যেন আমি তা ফিলাপ করে দেই৷ এরপর ইসলামী দলের সদস্যপদে যোগদান করার আবেদনপত্র পেশ করেন৷
অতঃপর তিনজন আরব ভাই এসে উপস্থিত হন৷ তাদের একজন আমাকে পূর্ব তুর্কিস্তানের মুসলমানদের অবস্থা ও আল্লাহর পথের হিজরত জিহাদের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন৷ আমি তাকে জবাব দিলাম যে, সেখানকার মুসলমানরা আল্লাহর পথের হিজরত ও জিহাদের প্রতি আগ্রহান্বিত হয়ে আছে৷ তারা তুর্কিস্তান থেকে আফগানিস্তানে আসার পথ অন্বেষণ করছে৷
অতঃপর আমাদের নাস্তা খাওয়ার পর ভাই বিলাল রহঃ ক্যাম্পের জিম্মাদার ভাইয়ের সাথে মাশওয়ারা করেন যে, আমাকে যেন তিনি তাদের ক্যাম্পে প্রেরণ করেন৷ খোস্ত শহরে ঈদুল আযহার জামাতে শরীক হওয়ার সময় আমি ধবধবে সাদা পাগরীধারী তালেবানদের দেখি যে, তারা অস্ত্র নিয়ে গাড়ীতে চড়ে ঈদগাহের আশপাশে টহল দিচ্ছে৷
আমি কিছু সংখ্যক আরব ভাইদের সাথে ক্যাম্পে গেলাম৷ তন্মধ্যে ক্যাম্পের শরয়ী বিভাগের জিম্মাদার শাইখ আবু আব্দুল্লাহ মুহাজিরও ছিলেন৷ আমাদের অভ্যর্থনায় ক্যাম্পের আমীর ছিলেন৷ সেখানে আমার ভিত্তি কোর্স শুরু হয়ে যায়৷ আমি লক্ষ্য করি যে, ক্যাম্পের ভাইদের মধ্যে যারা জামাতে পিছে পড়ে যায় তাদেরকে শাস্তি প্রদান করা হয়৷ একবার আমার তাকবিরে তাহরিমা ছুটে গেলে জিম্মাদার ভাই আমাকে ‘যাকীবীক পাহাড়ে’ আরোহণ করিয়ে শাস্তি প্রদান করেন৷ নামাযের জামাতের প্রতি তাদের গুরুত্বের কারণে এই শাস্তিতে আমি আনন্দিত হই৷
প্রশিক্ষণের দু’মাস পর ভাই আবু মুহাম্মাদ হাসান মাখদুম রহঃ ক্যাম্পে আসেন এবং এবার-ই প্রথমবারের মত আমি তার সাথে পরিচিত হই৷ তার সাথে ভাই আব্দুল কাদের আহমাদ, মুখতার আফিন্দী ও ক্বারী ইউসুফ ছিলেন৷ ক্যাম্পের ভেতর আমরা প্রায় দশজন ছিলাম৷ তিনি আমাদেরকে বাহিরের ভাইদের অবস্থা ও তার সফর কতদূর পর্যন্ত হয়েছিল সে সম্পর্কে অবগত করেন৷
ভিত্তি কোর্স শেষ করার পর আমরা ‘যুদ্ধকৌশল কোর্স’ শুরু করি৷ তখন আমি তুর্কিস্তানে অবস্থিত ভাইদেরকে হিজরতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি; কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার কোর্সের নির্ধারিত সময় শেষ না হওয়ার কারণে খোস্ত ঘাঁটির জিম্মাদার ভাই আমাকে নিষেধ করেন৷
তিনি আমাকে তিন ভাইয়ের সাথে কাবুলে প্রেরণ করেন৷ আমরা যখন কাবুলে আমাদের ঘাঁটিতে পৌছি তখন সেখানে তালেবানদের সাথে একটি ঘটনা ঘটে যায়৷ আর তা হল, আমরা মধ্য এশিয়ায় জিহাদী আন্দোলনের ভিডিও দেখতে বসেছিলাম৷ আমাদের ভিডিও দেখাবস্থায় ‘আমর বিল মা’রুফ নাহি আনিল মুনকার জামাত’ দরজায় কড়া নেড়ে ভিতরে প্রবেশ করে এবং আমাদের ভিডিও সেট ও টেলিভিশন জব্দ করে নিয়ে যায়৷ আমরা তাদেরকে খুলে বলতে চাইলাম যে, এটি একটি রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ভিডিও, এটি কোন মিউজিকাল ভিডিও নয় এবং এতে কোন মহিলাদেরও চিত্র নেই; কিন্তু তারা আমাদের কথাই শুনলো না; বরং তা নিয়ে তারা বেরিয়ে চলে গেল৷ তালেবানদের এই অবস্থান দেখে আমি বিস্মিত হয়ে যাই এবং মনে মনে আনন্দিত হই৷ আমার স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো আমাদের দেশের কমিউনিস্ট সরকারের জুলুম ও রাতের বেলা বাড়ীতে হানা দিয়ে অর্থকড়ি সামানা-পত্র হাতিয়ে নেয়ার কথা, তালেবান ও তাদের মধ্যে কত বিরাট পার্থক্য! কমিউনিস্টরা বাড়ীর আসবাবপত্র ও সামগ্রী চুরি-ডাকাতি করে নিয়ে যায়, বাড়ীর লোকদের ইজ্জত নষ্ট করে এবং কুরআনুল কারীম ও দ্বীনি কিতাবাদি ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলে৷ আর তালেবানরা বিনোদনের আসবাবপত্রকে ধ্বংস করার প্রতি আগ্রহী থাকে, যদিও তা মুবাহ কোন বিষয় হোক না কেন!
সেদিন-ই আমরা আবু মুহাম্মাদ ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করি৷ তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দেন আমরা যেন আমাদের ওসিয়ত লেখে দেই৷ আমাদের ওসিয়ত লেখার পর আমরা আরব ভাইদের ঘাঁটিতে যাই এবং তাদের আমিরের সাথে সাক্ষাৎ করি ও তার সাথে আমরা বাগরাম শহরের আরব ভাইদের ফ্রন্টে যাই৷ তাদের আমির ছিলেন একজন ইরাকি ভাই৷ আমরা সেই প্রহরা ঘাঁটিতে দিনরাত ২৪ ঘন্টা টহল দিতাম এবং দিনের বেলা সামরিক দূরবীনের মাধ্যমে শত্রু ও শত্রুদের গাড়ীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতাম৷ সেখানে আমাদের ও শত্রুদের কারো পক্ষ থেকেই কোন আক্রমণ নিক্ষেপণ না থাকার কারণে আমরা বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম৷ ফলে আমার সঙ্গীরা কাবুলে ফিরে চলে যায়৷
এ সময়ের ভেতর আমরা তত্ত্বগতভাবে ট্যাংক চালনায় প্রশিক্ষণ লাভ করি এবং সেখানে প্রায়োগিকভাবে গোলা নিক্ষেপের অনুমতি ছিলনা৷ এই সময়কালে খোস্ত শহরে শাইখ উসামা বিন লাদেন রহঃ এর ক্যাম্পে বোম্বিং করা হয় এবং এই বোম্বিংয়ের দরুন আমরা ভাই আবু বকর তুর্কীস্তানীর শাহাদাতের সংবাদ পাই৷ এই ভাই আমার বন্ধু ছিলেন৷ তাঁর সাথে অন্যান্যরাও আহত হয়েছেন৷
সামরিক অপারেশনে অংশগ্রহণ
তুর্কী ভাইদের চলে যাওয়ার প্রায় দশদিন পর কতিপয় ভাইয়ের সাথে ফ্রন্টের আমির ভাই এসে উপস্থিত হন এবং একই ঘাঁটিতে আমাদের সাথে রাত্রিযাপন করেন৷ রাত দুইটা বাজে আমরা ‘সকলেই জেগে উঠুন’ ঘোষকের এই আওয়াজে ঘুম থেকে উঠি৷ পরিখা থেকে আমরা বের হওয়ার পর শত্রুদের কামানগুলো আমাদের ঘাঁটিতে বুলেট ছুড়ছিল আর আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম৷ তখন আমাদের মধ্যে একজন আওয়াজ দিয়ে উঠলো: ‘তোমরা কি শাহাদাত চাওনা? তাহলে তোমরা দাঁড়িয়ে কেন?’
তখন আমি অনুপ্রাণিত হয়ে সামনে অগ্রসর হই৷ ট্যাংক গোলাগুলো ট্যাংকের কাছেই রাখা ছিল এবং ট্যাংকের গোলা ৭৫ টি ছিল৷ আমরা তখন খুব দৃঢ়ভাবে তাদের জবাব দেওয়া শুরু করি; কিন্তু শত্রুরা পিছু হটেনি৷ অবশেষে আমরা জানতে পারলাম যে, শত্রুরা পর্বতের শীর্ষে তালেবানদের একটি ঘাঁটি দখলে নিয়ে নিয়েছে। সেখান থেকে আমাদের ঘাঁটিকে পর্যবেক্ষণ করা যায়৷ সকালবেলা অত্যাধিক গোলা বর্ষণের কারণে আমরা মাথা তুলতে পারছিলাম না৷ আছরের পর আমির ভাই আমাদেরকে একত্রিত করে উপদেশ ও নসিহত করলেন যে, আমরা কেবলমাত্র আল্লাহ তা’আলার দ্বীনেরই প্রতিরক্ষা করিনা; বরং আমরা ভূমিরও প্রতিরক্ষা করি৷ আমরা যদি আমাদের স্থান ছেড়ে দেই এবং পিছনে সরে আসি তাহলে শত্রুরা কাবুলে পৌছে যাবে৷ এজন্যে আমরা কিছুতেই এ জায়গা ছাড়বো না৷ আমরা যদি একান্তই সরে যেতে বাধ্য হই তাহলে আমরা নিম্নাংশে সামান্য পিছু হটবো এবং পূনরায় সেখানে ফিরে আসবো এবং আল্লাহর ইচ্ছায় কখনোই তা শত্রুর জন্য ছেড়ে আসবো না৷
আমরা আমাদের অস্ত্রশস্ত্র বন্টন করে নিলাম এবং আমি যাকীবীক তোপ নিক্ষেপণকারীর সাহায্যকারী হিসেবে ছিলাম৷ মাগরিবের নামাযের পর আমরা ট্যাংক, BM তোপ ও যাকীবীক তোপ দ্বারা শত্রুদের ওপর আক্রমণ করা শুরু করি এবং তালেবানরা পর্বতের পাদদেশ থেকে শত্রুদের ওপর আক্রমণ করতে থাকেন৷ অপারেশন প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী অব্যাহত থাকে৷ অতপর আমরা ঘাঁটির ওপর থেকে আলোকময় বুলেট উদ্ভাসিত হতে দেখলাম৷ তখন সকল ভাইয়েরা তাকবীর দিয়ে উঠলো৷ আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম যে, কি হয়েছে? তারা বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, ঘাঁটি বিজয় হয়ে গিয়েছে৷
তখন আমি প্রথমবারের মত আমি জানতে পারলাম যে, তালেবানরা যখন কোন ঘাঁটি বিজয় লাভ করেন তখন তারা আলোকময় বুলেট নিক্ষেপণ করেন৷ ফলে আমি খুবই আনন্দিত হলাম৷ এটিই ছিল আমার জীবনের প্রথম সামরিক অপারেশন৷ আর এ বারই প্রথম আমি তালেবানদের একজনকে পর্বতের উপর শহীদ হতে দেখলাম এবং সেখানে গিয়ে আমি তাকে আমাদের ঘাঁটিগামী আহতদের এম্বুলেন্সে তালেবানদের সাথে তুলে দেই৷
ঘাঁটি বিজয় লাভ করার একদিন পর রবিবার ‘মুরাদ বুক ঘাঁটি’র কিছু সংখ্যক আরব ভাই শাহাদাত বরণ করেন৷ তাদের মধ্যে খোস্ত ক্যাম্পের আমির কমান্ডার আবুল আ’তা তিউনিশী ভাইও ছিলেন৷ তাই ফ্রন্টের জিম্মাদার ভাই ‘মুরাদ বুক ঘাঁটি’তে যান৷ আমি তার নিকট যোগাযোগের স্বার্থে কাবুল যাওয়ার অনুমতি নিতে চাইলাম; কিন্তু তিনি আমাকে অনুমতি দেননি এবং বললেন, আমাদের সাথে যারা অপারেশনে অংশগ্রহণ করে তারা ঘাঁটিতেই থেকে যায়৷ আমার যোগাযোগ করার দ্বারা উদ্দেশ্য ছিল, আমার শাহাদাতের পূর্বেই তুর্কিস্তান থেকে ভাইদেরকে জিহাদের জন্য আফগানিস্তানে উপস্থিত করা৷
পরিশেষে আমি অনুমতি গ্রহণ করি এবং কাবুলে যাই৷ ভাইয়েরা আমাকে কাবুল ঘাঁটির জিম্মাদার নিযুক্ত করেন৷ দু’মাস পর আমি যোগাযোগ করার জন্য পাকিস্তানে যাই এবং যোগাযোগ কর্ম শেষে ভাইয়েরা আমাকে আফগানিস্তানগামী একজন নতুন ভাইকে আমার সফরসঙ্গী বানিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন৷ আমরা যখন জালালাবাদের দিক দিয়ে ‘ত্বরখম’ প্রবেশদ্বারের নিকট পৌছি তখন সে ভাইকে পাকিস্তানী পুলিশ গ্রেফতার করে৷ আর আমি নিরাপদে কাবুলে তালেবানদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চলে যাই; তাদের কাছ থেকে ঐ সকল কাগজপত্র সংগ্রহ করার জন্য, যা দ্বারা প্রমাণিত করা যায় যে, তিনি আফগানিস্তানের অধিবাসী এক আফগানী৷ আমি যখন কাবুলে পৌছলাম তখন আবু মুহাম্মাদ আমাকে ভাই বিলাল রহঃ এর মত নতুন ভাইদের মুখপাত্র স্বরুপ ক্যাম্পের শরয়ী বিভাগে যেতে নির্দেশ দিলেন৷
ক্যাম্পের জিম্মাদার ভাইয়েরা আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং সে বিভাগে আমি চার মাস পর্যন্ত বাকি থাকি৷ এ সময়ে আমি ক্যাম্পের শরয়ী বিভাগের জিম্মাদার শাইখ আবু আব্দুল্লাহ মুহাজিরের (উল্লেখ্য এই আত্মজীবনী লেখার সময় শাইখ সম্ভবত ইরানের কারাগারে বন্দী ছিলেন, তবে অনুবাদক যখন অনুবাদ করছেন, তার অন্তত দেড় বছর আগেই শাইখ সিরিয়ায় মার্কিন বিমান হামলায় শাহাদাত বরণ করেছেন।) নিকট জিহাদের মাসআলা-মাসায়েল ও আহলুস্ সুন্নাহ্ ওয়াল জামাত অনুযায়ী ঈমানের মূলনীতিগুলো অধ্যায়ন করি এবং সামরিক জ্ঞানের মধ্য থেকে ট্যাংক সম্পর্কিত কোর্সটি পূনরায় সম্পন্ন করি৷
আমি যখন কাবুলে গেলাম তখন ভাই ইবনে ওমর রহঃ এর নিকট আমাকে দাওরাতুত তাসনি’ বা উৎপাদন কোর্সে শরীক করার জন্য আবেদন জানালে তিনি বললেন, তোমাদের মত তালিবে ইলমদের জন্য এ সকল কোর্সের প্রয়োজন নেই৷ তখন আমি পরিহাস করে উত্তর দিলাম যে, আমাদের মত লোকদের এ সকল বিষয়ে অজ্ঞ থাকার দরুণই তো আজ আমরা এই বশ্যতা ও লাঞ্ছনার স্বীকার হতে হচ্ছে৷ তখন তিনি আমার কোর্সে যোগদান করার ব্যাপারে একমত হলেন৷ সেই কোর্সটি দুইমাসের ছিল৷
১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে তালেবানরা উত্তরাঞ্চলের আহমাদ শাহ্ মাসউদের লোকদের উপর ব্যাপক আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন৷ এবং দলের আমির সিদ্ধান্ত নেন যে, কমান্ডার সাইফুর রহমান মানসুর ভাইয়ের নেতৃত্বে পঁচিশজন তুর্কিস্তানী ভাইকে এই হামলায় শরীক করবেন৷ ভাইয়েরা ট্যাংকে চড়ে রওয়ানা হন এবং ইবনে ওমর ভাই আমাকে সেনা শিবিরের জিম্মাদার নির্বাচিত করেন৷ এতে আমি বিষণ্ন হই; কেননা তাদের সাথে আমি কোন অপারেশনে অংশগ্রহণ করিনি৷
আমাদেরকে জানানো হয়েছে যে, তালেবানরা শত্রুদের বিশাল এলাকা জয় করেছেন ও সেগুলো দখলে নিয়েছেন৷ আর আমাদের তিনজন আহত হয়েছেন৷ তারা হচ্ছেনঃ ইবনে ওমর, ছদরুদ্দীন ও অন্য আরেক ভাই৷ তাদেরকে চিকিৎসার জন্য কাবুলের হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং বাকিদেরকে ফ্রন্টেই রেখে দেওয়া হয়৷ এ সকল জয়ের খবর শুনে আমরা প্রফুল্ল হই৷
দু’দিন পর শত্রুরা তালেবানদের বাধার সৃষ্টি করে এবং অনেক সংখ্যক তালেবান ও মুহাজিরদের হত্যা করে৷ বাকিরা পিছু হটে এবং আমাদের বারো জন মুজাহিদ ভাই হারিয়ে যায়৷ হারিয়ে যাওয়াদের মধ্যে ভাইদের সামরিক জিম্মাদার ভাইও ছিলেন৷ দুইমাস পর আমাদের নিকট সংবাদ পৌছে যে, জিম্মাদার ভাই ও তার সাথে থাকা অন্যান্য ভাইয়েরা মাসউদীদের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন৷ যাদের মধ্যে দশজন নিরাপদে ফিরে এসেছেন ও বাকিরা শাহাদাত বরণ করেছেন৷ এই বাধার সম্মুখীন হওয়ার পর ক্যাম্প জনাকীর্ণ হয়ে যায়৷ ক্যাম্পের ভেতর শরয়ী ও সামরিক বিষয়ে পাঠদান করা হয় এবং আমি ভাইদেরকে শরয়ী শিক্ষা পাঠদান করতাম৷
শুরার সদস্য হলাম।
১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে আবু মুহাম্মাদ ভাই শুরার সকল সদস্য ভাইদের ডাকলেন এবং তাঁদের সাথে আমাকেও ডাকলেন ও বললেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আপনাকে শুরার সদস্যপদে অন্তর্ভুক্ত করবো৷ আমি এই সংবাদে হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম ও বললাম, আমি এ জিম্মাদারীর বোঝা বহন করতে পারবো না, আমি এর যোগ্য নই৷ তখন তিনি আমার এ ওজর প্রত্যাখ্যান করলেন ও আমাকে মজলিসে শুরায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করলেন৷
আমার উত্তরাঞ্চলে সফর
যেসব ভাইয়েরা মে মাসে উত্তর আফগানিস্তানে গিয়েছিল তাদেরকে সামরিক ও শরয়ী বিষয়ে পাঠদান করতে আমি, ইবনে ওমর, আব্দুল জাব্বার ও আরো দুই ভাই ডিসেম্বর মাসে সেখানে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হই এবং ‘বামিয়া প্রদেশে’ রাত্রিযাপন করি৷ দুইদিন পর আমরা মাজার শরীফের ‘কেল্লা জঙ্গী’ এলাকায় পৌছে সেখানে আমাদের ভাইদের সাথে সাক্ষাৎ করি৷ আমি তাদেরকে মুজাহিদ শাইখ আব্দুল্লাহ্ আজ্জামের রহঃ ‘ফিক্বহুল জিহাদ ওয়া আদাবুহু’ কিতাবটি পাঠদান করি ও অন্যান্য ভাইয়েরা তাদেরকে সামরিক বিষয়ে পাঠদান করা শুরু করেন৷
ঈদুল ফিতরের দু’দিন পূর্বে আমরা মাজার শরীফ থেকে ‘সারবাল প্রদেশে’ তালেবানদের ‘দুস্তম বাহিনী’ বিরোধী ফ্রন্টে যোগদান করা আমাদের সেখানকার ভাইদের সাথে দেখা করার জন্য যাই এবং মোল্লা আব্দুস সাত্তার আখন্দ রহঃ এর সাথে সাক্ষাৎ করি৷ তিনি উত্তরাঞ্চলের তালেবানদের একজন কমান্ডার ছিলেন ও সেই ফ্রন্টের জিম্মাদার ছিলেন৷ তিনি অত্যন্ত উত্তম আখলাক বিশিষ্ট ও নীতিবান লোক ছিলেন৷ আমরা তাকে বলেছিলাম, আমরা আমাদের তুর্কিস্তানী ভাইদের সাথে দেখা করতে চাই৷ তিনি আমাদের বললেন, আপনারা এখন তাদের কাছে যেতে পারবেন না, রাস্তা খুবই খারাপ৷ আজ আব্দুর রাজ্জাক আখন্দ আসবেন৷ তিনি যখন সেখানে যাবেন তখন তার সাথে আমরা ব্যবস্থা করে দিবো৷ আমরা আব্দুর রাজ্জাক আখন্দকে পূর্ব থেকেই চিনতাম৷ তিনি কেল্লা জঙ্গীর কমান্ডার ছিলেন৷ আমাদের ভাইয়েরা তার সাথেই ফ্রন্টে গিয়েছিলেন৷
যোহরের নামাযের সময় একটি হেলিকপ্টার ঘাঁটির আশপাশে চক্কর দিতে থাকে এবং মোল্লা আব্দুস সাত্তারের ঘাঁটিতে অবতরণ করে৷ হেলিকপ্টার হতে মোল্লা দাদুল্লাহ্ আখন্দ রহঃ নেমে আসেন৷ আমরা তখন তাকে চিনতাম না৷ মোল্লা আব্দুস সাত্তার আমাদেরকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন৷ যোহরের নামাযের পর আমরা মোল্লা আব্দুস সাত্তার ও মোল্লা দাদুল্লাহ্ আখন্দের সাথে গাড়ী যোগে ফ্রন্টে পৌছি এবং পর্বতের অসমতলতা ও সেখানে গাড়ী চলাচলর যোগ্য রাস্তা না থাকার দরুণ মুজাহিদদেরকে অস্ত্র হাতে অশ্বারোহী অবস্থায় দেখতে পেলাম৷ সুতরাং সেখানে প্রতিটি মুজাহিদই ঘোড়ায় আরোহণ করে চলফেরা করছিলেন৷ সেখানে মোল্লা দাদুল্লাহ্ শত্রুদের লক্ষ্য করে পিকা ছুড়েন৷ অতঃপর আমরা ঘাঁটিতে ফিরে এলাম এবং মাজার শরীফ অভিমুখে রওয়ানা হলাম এবং দীর্ঘ সময় পর আমাদের ঘাঁটিতে ফিরে এলাম৷
সকালবেলা ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের জন্য আমরা আমাদের ঘাঁটি থেকে মাজার শরীফের মধ্যখানে জামে’ মসজিদে গেলাম৷ তালেবানদের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করার জন্য সেখানে একটি জেট বিমান এলো৷ নামাযের পর গভর্নর ও তার ডেপুটিরা একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ শোভাযাত্রায় বের হন এবং তার চারপাশে রক্ষীবাহিনী তাকে মোটরসাইকেলে এমন চমৎকারভাবে ঘিরে রেখেছিল, যা ইতিপূর্বে আমি কখনো দেখিনি৷ ঘাঁটিতে ফিরে গিয়ে ভাইদের সাথে ঈদ উদযাপন করার পর আমি ভাইদের নিকট আমার কাবুলে ফিরে আসার জন্য অনুমতি চাইলাম৷ কাবুলে আমি হজ্বে যাওয়ার নিয়ত করেছিলাম ও ভাই আবু মুহাম্মাদের নিকট যাওয়ার অনুমতি চাইলাম৷ অতঃপর আমরা প্রায় দশজন পাকিস্তানে গেলাম এবং হজ্বের মৌসুমে মিনাতে তুর্কিস্তানী ছাত্রদের সাথে সাক্ষাৎ করি ও তাদেরকে আফগানিস্তানে হিজরত ও জিহাদের দাওয়াত দেই৷ হজ্বের ফরজসমূহ আদায় করার পর আমারা মক্কার একটি হোটেলে একত্রিত হই৷ অতঃপর আফগানিস্তানে চলে আসি৷
অতঃপর ভাইদেরকে শরয়ী শিক্ষা পাঠদান করার জন্য আমি এবং সদরুদ্দীন ভাই ক্যাম্পে ফিরে যাই৷ এক সপ্তাহ পর আমি শুরা সভার জন্য আবার কাবুলে ফিরে আসি৷ শুরা সভা শেষে আমি ভাইদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কাবুলে স্থানান্তরকৃত ক্যাম্পে যাই এবং প্রশিক্ষণ প্রায় দু’মাস যাবৎ চলতে থাকে৷ তখন তালেবানদের পক্ষ থেকে শাইখ উসামা রহঃ এর ক্যাম্প ব্যতিত বাকি সকল ক্যাম্প বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ আসে৷ আমাদের নিকট ক্যাম্পের কিছু উদ্দেশ্য বাকি রয়ে গিয়েছিল৷ আর তা হচ্ছে, ফ্রন্টে কিভাবে গোলা নিক্ষেপ করতে হয়? তাই কতিপয় ভাইকে আমি তার প্রশিক্ষণ দিয়ে দেই৷
হেরাত সফর
অত:পর আমি ভাইদের সাথে হেরাত প্রদেশের গভর্নর মৌলভী আব্দুল হান্নান রহঃ এর নিকট যাই৷ তিনি প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য আমাদেরকে একটি ক্যাম্প জয় করে দেন৷ আমি সেই ক্যাম্পের আমির ছিলাম৷ মৌলভী আব্দুল হান্নান একজন অত্যন্ত বিনয়ী লোক ছিলেন৷ এমনকি তিনি যখন আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন তখন সেখানে কোন শৌচাগার না থাকায় তিনি আস্তিন গুছিয়ে নিজ হাতে টয়লেট তৈরী করা শুরু করেন এবং তার সাথে তার গার্ডরা ছিল৷ আল্লাহ্ তাআলা তাঁর উপর বিস্তর রহমত বর্ষণ করুন৷
এক মাস পর ভাই আবু মুহাম্মাদ আমাকে শুরা সভার জন্য কাবুলে ডেকে পাঠান এবং শুরা সভা শেষে তিনি সামরিক জিম্মাদার ভাই আব্দুল জাব্বারকে প্রশিক্ষিত ভাইদেরকে বিশেষ কোর্স প্রদান করার জন্য হেরাত ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য নির্ধারিত করেন৷ এবং আমাকে ক্যাম্পের জিম্মাদারীর পাশাপাশি নিরাপত্তা বিষয়ক জিম্মাদারদের তদারকি ও জিম্মাদারদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের পক্ষ থেকে উথ্বাপিত অভিযোগের তদন্ত করার দায়িত্বভার ন্যস্ত করা হয়৷
আমরা হেরাতে ফিরে গেলাম এবং ভাই আব্দুল জাব্বার তার বিশেষ কোর্স প্রদান করা শুরু করেন৷ কোর্সটি শেষ হওয়ার পর তিনি নতুন আরেকটি কোর্স শুরু করার পূর্বে একটি দুর্ঘটনা ঘটে যায়৷ তিনি যখন যাকীবীক তোপের ধাক্কাময়ী অবিস্ফোরিত গোলা খুলতে নেন তখন তা বিস্ফোরিত হয়ে তার গায়ে এসে লাগে৷ এতে তিনি গুরুতর আহত হন৷ বিষাক্ত ভাঙ্গা টুকরাগুলো তার বুকে ও পেটে ঢুকে পড়েছিলো৷ অতঃপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়৷ কিন্তু সে রাত্রেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন৷ আল্লাহ্ তাআলা তাঁর উপর বিস্তর রহমত বর্ষণ করুন৷ সকালবেলা আমরা তার দাফন কার্য সম্পাদন করি৷
২০০১ সালের শুরুর দিকে আমিরুল মুমিনীনের পক্ষ থেকে বামিয়া প্রদেশের বুদ্ধ মূর্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ করার ব্যাপারে নির্দেশ আসে৷ তখন হেরাতের গভর্নর মৌলভী আব্দুল হান্নান তাঁর প্রদেশের কিছু ছোট ছোট মূর্তি ধ্বংস করেন ও কমিউনিস্টদের যে সকল বইপুস্তক পেয়েছিলেন, সেগুলোকে জালিয়ে দেন৷ তার কামড়া আমাদের পাশেই ছিল৷ আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, আপনি আমাদেরকে এ মহৎ কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য কেন ডাকেন না? তিনি আমার সাথে আলোচনা করেন যে, “আমিরুল মুমিনীন একজন সত্যনিষ্ঠ মুখলিস মানুষ৷ আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে তাঁর মত লোক দান করেছেন৷ এ জন্য আমাদের উচিত আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করা”৷ তিনি আব্দুল জাব্বার রহঃ এর পরিবর্তে ইবনে ওমরকে সামরিক জিম্মাদার হিসেবে নিয়োগ দান করেন এবং আমাকে সংবাদ দেন যে, আমিরুল মুমিনীন জালালাবাদে আমাদের জন্যে একটি ক্যাম্প জয় করেছেন৷ এও সংবাদ দেন যে, আমাকে অচিরেই সেই ক্যাম্পে জিম্মাদার হিসেবে স্থানান্তরিত করা হবে৷
দুইদিন পর আমি আমাদের তিনজন ভাইয়ের সাথে কাবুলে যাই৷ অতঃপর ভাই আবু মুহাম্মাদ আমাকে কান্দাহারে ডেকে পাঠান৷ সেখানে আমরা কমান্ডার জুমআ’ বাই রহঃ এর সাথে সাক্ষাৎ করি, যাকে আমিরুল মুমিনীন মুজাহিদদের ফ্রন্টের আমির নিযুক্ত করেছেন৷ তিনি আমাদেরকে বললেন, আপনারা কাবুলে যান এবং আপনাদের ঐ সমস্ত ভাইদের নাম রেজিষ্ট্রি করুন, যারা অচিরেই ফ্রন্টে যাবেন৷ আমরা কাবুলে গিয়ে প্রায় ত্রিশটি নাম রেজিষ্ট্রি করলাম এবং তাঁদেরকে মুজাহিদদের ‘দারুল আমান ঘাঁটি’তে নিয়ে এলাম৷
এই দারুল আমান ঘাঁটিটি মূলতঃ ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজা আমানুল্লাহ খাঁনের প্রাসাদ ছিল৷ আমিরুল মুমিনীন সেটিকে মুহাজির মুজাহিদদের স্বাগত জানানোর আবাসস্থল বানিয়েছেন৷ সেখান থেকে মুজাহিদদেরকে পতাকাবন্দী করা হয় এবং তাদের সারিয়াগুলোকে ফ্রন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷ সেখানে আরব আজম বিভিন্ন শ্রেণীর প্রায় চার হাজার মুহাজির মুজাহিদীন একসাথে জমায়েত হতে পারেন৷
আমরা এই ঘাঁটিটিতে প্রায় বিশ দিন ধরে নিজেদেরকে সজ্জিত করতে থাকলাম যতক্ষণ না আমাদেরকে উত্তরাঞ্চলের প্রথম সারিগুলোতে ভাগ করে দেওয়া হয়৷ আমরা প্রায় চারশো পাকিস্তানি মুজাহিদ ভাইদের নিয়ে কাবুল এয়ারপোর্টে যাই এবং কুন্দুয প্রদেশের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া বিমানে আরোহণ করি৷ অতঃপর আমরা তুর্কিস্তানীরা ও উজবেকিস্তানের ভাইয়েরা বামিয়া প্রদেশের পথ দিয়ে স্থলপথে তুখাড় প্রদেশের দিকে রওয়ানা করি৷ এবং দুইদিন পর তুখাড় প্রদেশে কমান্ডার জুমআ’ বাই রহঃ এর ঘাঁটিতে পৌছি৷ সে সময় কমান্ডার জুমআ’ বাই রহঃ ফ্রন্টের পরিখাগুলোর খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ‘খওজাগরে’ গিয়েছিলেন৷ আমরা সেই রাত্রটি সেখানেই কাটাই৷
সকালবেলা আমি এবং ভাই ইবনে ওমর জুমআ’ বাই রহঃ এর সহযোগী ভাই ইলহাম উজবেকিস্তানীর সাথে বের হই এবং দুই ঘন্টা চলার পর আমরা পাকিস্তানি মুজাহিদদের দ্বারা পরিপূর্ণ একটি ট্রাকের দেখা পাই৷ অত্যাধিক ভীড়ের দরুণ ট্রাকের ভেতর কেউ সামান্য পরিমানও ফাঁকা দেখতে পাচ্ছিল না৷ এমনকি ট্রাকের চারপাশেই মুজাহিদদের ঝুলে থাকতে দেখা যাচ্ছিল৷ আমাদের পিকআপের ড্রাইভার ট্রাকটিকে ওভারটেক করতে চাইলে ভাই ইলহাম উজবেকিস্তানী তাকে নিষেধ করে বললেন, “এমনটি করো না! কেননা এর দ্বারা তাঁরা ধূলায় কষ্ট পাবেন”৷ ফলে আমরা আমাদের ও তাদের মাঝে প্রায় ত্রিশ মিটার দুরত্ব বজায় রেখে চলতে থাকি৷ আমরাও তাঁদের দেখছিলাম, তাঁরাও আমাদেরকে দেখছিল৷ হঠাৎ ট্রাকটি এক পার্শ্বে কাত হয়ে যায় এবং তার নীচে প্রায় সাত আটজন মুজাহিদ পড়ে যান৷ তখন আমরা তাঁদের উদ্ধারে দ্রুত ছুটে যাই এবং ক্রেন এনে তাদেরকে প্রচন্ড ক্লান্তি ও সংজ্ঞাহীন অবস্থায় বের করে নিয়ে আসি৷ তাদের অনেকে তীব্র আহত হয়েছিলেন৷
আমি আহতদের সেবা করার জন্য তাদের নিকট বারবার আসা যাওয়া করতাম৷ একজন আহতকে দেখলাম যে, তিনি গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন৷ ফলে আমি তার নিকট বসে সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করলাম এবং আল্লাহর নিকট তার সুস্থতার জন্য দোয়া করলাম৷ তার মুখ দিয়ে তখন ফেনা বের হচ্ছিল৷ এমতাবস্থায় একটি ‘দাতসুন’ পিকআপ গাড়ী আসলো ও তা হতে কালো পাগরীধারী একজন লোক নামলেন৷ আমরা জানতে পারলাম যে, ইনি তালেবানদের প্রতিরক্ষা সচিবের সহযোগী ‘মোল্লা ফাজিল’৷ তিনি যখন এই দৃশ্য দেখলেন তখন তিনি ওয়ারলেস যোগে অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য একটি হেলিকপ্টার ডাকলেন ও হেলিকপ্টার পৌছার পূর্বেই তিনি চলে গেলেন৷ সেই স্থানে কমান্ডার জুমআ’ বাইও এসে উপস্থিত হলেন৷
সেখানে এক পাকিস্তানি ভাইয়ের একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল৷ আর তিনিই ছিলেন সেই ভাই, যার নিকট আমি সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করেছিলাম৷ তিনি ভীষণ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলেন৷ আমি তাকে দেখলাম যে, তিনি পিঠের ওপর হেলান দিয়ে বসা থেকে মুচকি মুচকি হাসাবস্থায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন, বসে পড়ছেন ও দোয়ার ন্যায় দু’হাত আসমানের দিকে তুলে ধরছেন এবং এমনটি কয়েকবার করলেন৷ তার এহেন কর্মকাণ্ড দেখে আমি বিস্ময়াভিভূত হচ্ছিলাম এবং উদ্বিগ্ন হচ্ছিলাম ও মনে মনে বলেছিলাম, আল্লাহ্ তাআলা যদি তাকে সুস্থ করে দেন, তাহলে আমি অবশ্যই তাঁকে তাঁর হাসির ও আসমানের দিকে হাত উত্তোলনের কারণ জিজ্ঞাসা করবো৷ ডাক্তার আমাদেরকে নিষেধ করে দিয়েছিলো যে, আমরা যেন আহতদের পানি পান না করাই৷ পরবর্তীতে আমি জানতে পারি যে, তিনি সুস্থতা লাভ করেছেন এবং ভাইয়েরা তাকে তার সে সকল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন যে, তোমরা যখন আমাকে পানি পান করতে বাঁধা দিয়েছিলে তখন আমাকে আসমান থেকে হুর এসে পান করিয়েছে৷ এ ঘটনাটি ২০০১ সালের জুন মাসের শেষের দিকে সংঘটিত হয়৷
তুখাড়ে ফিরে যাওয়ার পর আমরা তুর্কিস্তানী ভাইদেরকে ফ্রন্টে নিয়ে যাই৷ আর সেটি ছিল খাবিয়া গ্রামে৷ সেই গ্রামের অনেকে তালেবানদের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে আহমাদ শাহ্ মাসউদের এক নেতার নিকট আশ্রয় নিয়েছিল৷ তার নাম হচ্ছে ‘ফিরামক্বল’৷ এ গ্রামের পশ্চিমেই আমু দরিয়া অবস্থিত৷ আর আমু দরিয়াই আফগানিস্তানকে তাজিকিস্তান থেকে আলাদা করে দেয়৷ আমরা তাজিকিস্তান সীমান্তে রুশ সেনাদের দেখতে পাচ্ছিলাম৷ তিন দিন পর আমরা ফ্রন্টের ঘাঁটির সন্ধান পাই৷ তখন ইবনে ওমর ভাই আব্দুল গনিকে তাদের আমির নিযুক্ত করেন এবং আমি ও তিনি অবশিষ্ট তারবিয়াত পূরণ করতে কমান্ডার জুমআ’ বাই রহঃ এর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য চলে আসি৷
রাতে আমি এক মুজাহিদের চিৎকারে ঘুম থেকে উঠে যাই৷ তিনি আমাকে বলেন, ফ্রন্টের ভাইয়েরা পানি চাচ্ছেন৷ অথচ পথ অত্যন্ত দুর্গম ও বিপজ্জনক ছিল এবং পথে অনেক গর্ত ছিল, যার ভেতর সাধারণতঃ গাড়ী পড়ে যায় এবং অনেক সময় তা অকেজো হয়ে পড়ে৷ সকালবেলা এক ভাই আমাকে ঘুম থেকে জাগ্রত করে বললেন, ইবনে ওমর আপনাকে ডাকছেন৷ তিনি রাস্তায় গাড়ীতে আমার অপেক্ষা করছিলেন৷ আমি গাড়ীর পিছনের বক্সে সামরিক চাদরে আবৃত এক ভাইয়ের মৃতদেহ দেখতে পাই৷ আমি চিনতে পারছিলাম না যে, তিনি কে৷ আমি এ ব্যপারে ইবনে ওমরকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে লজ্জাবোধ করছিলাম৷ তিনি তখন অত্যন্ত শোকসন্তপ্ত ছিলেন৷
গাড়ী চলে যাওয়ার পর আমি গ্রামের একটি বাড়ীর সামনে দাঁড়ালাম এবং তাতে প্রবেশ করে আমাদের ভাই আব্দুল ওয়াহহাবকে দেখতে পেলাম যে, তার পায়ের নলা টাখনু থেকে আলাদা হয়ে আছে৷ আব্দুল ওয়াহহাব আমাকে বললেন যে, আল্লাহ্ তাআলা ভাই কামালকে পছন্দ করেছেন, তাঁকে আমাদের মাঝ থেকে তুলে নিয়ে গেছেন ও শাহাদাত নসিব করেছেন৷ আর আমি তা থেকে বঞ্চিত হয়েছি – এ কথা বলেই সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন৷ আমি তাঁকে বললাম, আপনার শরীর-স্বাস্থ্য ইনশাআল্লাহ্ ঠিক হয়ে যাবে এবং আপনি পূর্বের ন্যয় আবার প্রশিক্ষণে ফিরে যাবেন৷
অতঃপর আমরা তাকে কুন্দুয হসপিটালে প্রেরণ করলাম এবং আমরা ভাই কামালকে দাফন করার জন্য তার নিকট ফিরে এলাম৷ আমি তাঁর চেহারাকে হাস্যোজ্জ্বল দেখতে পেলাম, যেন সে জীবিত, ঘুমোচ্ছে৷ এবং জানতে পারি যে, ভাইদের আঘাতটি দুটি গোলা বিস্ফোরণের কারণে সংঘঠিত হয়েছিল৷ একটির ওপর কামাল বসেছিলো এবং অপরটি আব্দুল ওয়াহহাবকে এম্বুলেন্সে তোলার সময় তাঁর পায়ের নীচে বিস্ফোরিত হয়েছিল৷ বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনার সময় ভাইয়েরা মনে করেছিলেন যে, শত্রুরা হয়তো তাঁদের প্রতি সেগুলো ছুড়েছিল৷ কিন্তু পরবর্তীতে জানতে পারেন যে, ভাই কামাল রহঃ না জেনে বিস্ফোরকের উপর বসার কারণে তা বিস্ফোরিত হয়৷
দুই দিন পর আমরা জানতে পারলাম যে, জখমের প্রতি ডাক্তারদের অবহেলা ও চিকিৎসায় তাদের অকৃতকার্যতার দরুণ ভাই আব্দুল ওয়াহহাবও শাহাদাত বরণ করেছেন৷ সে সময় আমি গাড়ী সার্ভিসিং করার জন্য দশত আরতশী গ্রামে গিয়েছিলাম৷ ফিরে আসার সময় আমি এবং ভাই জাফর তুর্কিস্তানী প্রচন্ড গরম অনুভব করি৷ তাই আমরা উপত্যকায় পানির প্রবাহের কাছে গিয়ে নীচে নেমে গোসল করি৷ তখন আমাদের পাশ দিয়ে কমান্ডার জুমআ’ বাই রহঃ অতিক্রম করেন৷ তিনি আমাদিগকে আমাদের ভাইদের মধ্যে আজ কে নিহত হয়েছেন, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন৷ আমরা বললাম, কেউই না৷ তিনি বললেন, না; আমি আজ তোমাদের একজনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছি৷ তখন আমরা পানি থেকে উঠে এসে ঘাঁটিতে গেলাম এবং জানতে পারলাম যে, যিনি নিহত হয়েছেন তিনি হচ্ছেন, ক্বারী আব্দুর রহীম ভাই৷ তিনি পরিখায় পাহারা দেওয়ার সময় আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করা অবস্থায় ট্যাংকের একটি গোলা তার গাঁয়ে এসে লাগে এবং কুরআনুল কারীমের পাতা তার নিরপরাধ রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়৷ আমি কুরআনুল কারীমটি কাবুলের তথ্য-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দেই, যেন তারা তা দেখেন ও এর ধারকের ঘটনা রেকর্ড করেন৷
অতঃপর আবু মুহাম্মাদ (হাসান মাখদুম রহঃ) আমাকে ও ইবনে ওমরকে শুরা সভায় অংশগ্রহণ করার জন্য ডেকে পাঠান৷ ইবনে ওমর সেখানে যান এবং আমাকে তাঁর ফিরে আসার আগপর্যন্ত ভাইদের সাথে রেখে যান তাদের সামরিক জিম্মাদার বানিয়ে৷ ইবনে ওমরের ফিরে আসার পূর্বে শত্রুরা আমাদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করে৷ তখন আমরা তোপ-কামান দিয়ে তাদের প্রতি গোলাবর্ষণ করি, ফলে তারা নিরাশ হয়ে ফিরে যায়৷
২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের চার তারিখে ভাইয়েরা আমাকে তোড়াবোড়া পর্বতের ঘাঁটিতে সেখানকার ভাইদের মনোভাব চাঙ্গা করে রাখার জন্য প্রেরণ করতে চাইলেন৷ চাশতের সময় আমরা কুন্দুযে পৌছি৷ দুই ঘন্টা পর আমরা ফ্রন্টের আহতদের কুন্দুযে পৌছা ও কুন্দুযের হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ পাই৷ যোহরের পর আমরা আহতদের দেখতে যাই এবং আহতদের ভেতর (শীশানের মুজাহিদীন ভাইদের আফগানিস্তানস্থ প্রতিনিধি) ভাই আব্দুল ওয়াহেদ শীশানীও ছিলেন৷ আমরা জানতে পারলাম যে, শত্রুরা মুজাহিদদের সকল ফ্রন্টেই ব্যাপকভাবে হামলা চালিয়েছে এবং কিছু সংখ্যক মুহাজির ভাইদেরকে নিহত করেছে ও অন্যান্যদের আহত করেছে৷ শুহাদা ও আহতদের কারণে বিমানে গাদাগাদি থাকায় আমরা কুন্দুযে তিনদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করি৷
সেপ্টেম্বর মাসের আট তারিখে আমরা কুন্দুয এয়ারপোর্ট থেকে বিমানে চড়ে কাবুলে পৌছি এবং সেদিনই আমি আবু মুহাম্মাদ (হাসান মাখদুম রহঃ) -এর সাথে সাক্ষাৎ করি ও তাঁকে বলি, আমি তোড়াবোড়ার ক্যাম্প সাজানোর জন্য সেখানে যেতে এসেছি৷ তিনি বললেন, সেখানে আমিও যেতে চেয়েছিলাম৷ তাহলে তুমি বিলম্ব কর, আগামীকাল আমরা একসাথে যাবো৷ আমরা যোহরের নামাজের পূর্বে আমাদের জালালাবাদের ঘাঁটিতে পৌছি এবং বেতারযন্ত্রে আহমাদ শাহ্ মাসউদের মৃত্যুর সংবাদ শুনতে পাই৷ ফলে আমরা আনন্দিত হয়ে তাকবীর দেই৷ হাসান মাখদুম রহঃ সেখানেই থেকে যান এবং আমি ক্যাম্পে চলে যাই৷ অতঃপর আছরের নামাযের পর ভাইদের সামনে কিছু আলোচনা করি এবং জিম্মাদার ভাইদের নিয়ে বসি৷
পরের দিন আমরা ক্যাম্প সাজানো, রান্নাঘর ও টয়লেট নির্মাণ এবং পানির ভান্ডার তৈরী করা শুরু করি৷ এবং দুই দিন পর আমরা ১১ সেপ্টেম্বরের আনন্দদায়ক ও প্রফুল্লকর সংবাদ শুনে তাকবীর দিয়ে উঠি এবং আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেক ওপরে উন্নীত হয়৷
সকালবেলা হাসান মাখদুম রহঃ ক্যাম্পে এসে তাদেরকে ধৈর্য্য ধারণ ও অটল অবিচল থাকার ব্যপারে ওয়াজ নসিহত করে একটি ভাষণ দিলেন এবং একদিন পর আমাকে সংবাদ দিলেন যে, তোমরা এই ক্যাম্পের পেছনে একটি টাকাও ব্যয় করোনা; কেননা আমেরিকানরা এর অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত রয়েছে৷ ফলে আমরা ক্যাম্পের কাজ বন্ধ করে দিলাম৷ তুর্কিস্তানের নতুন ভাইয়েরা এসে উপস্থিত হন এবং আমাদের সাথে যোগদান করেন৷ আমি তাদেরকে স্বাগত জানাতে কাবুলের দারুল আমানে যাই৷ পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হওয়া শুরু করে এবং মার্কিন বিমান বাহিনী কাবুলের আকাশে চক্কর লাগাতে থাকে৷
অক্টোবর মাসের সাত তারিখে তালেবানরা শত্রুবাহিনীর প্রতি এশার নামাজের পর সকল দিক থেকে গোলা নিক্ষেপণ করা শুরু করে৷ বিমান তালেবানদের কামানের আওতা থেকে অনেক দূরে থাকতো৷ অতঃপর বিমান ঐ সমস্ত স্থানে বোম্বিং করা শুরু করে যেখান থেকে তাদের প্রতি কামান দ্বারা নিক্ষেপণ করা হয়৷ অতঃপর তালেবানদের প্রতিরোধ বন্ধ হয়ে যায় এবং শত্রুবাহিনীর গোলাবর্ষণ আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ পরদিন আমি সদলবলে তোরাবোরা ক্যাম্প হতে প্রস্থান করি৷ আমরা জালালাবাদ প্রদেশে পৌছার পর ভাইদের ক্যাম্পের সংবাদ জানার জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি৷ প্রথমদিকে যোগাযোগ করতে পারিনা৷ কিন্তু চেষ্টা করার পর আমরা তাদের সাথে কথা বলি এবং জানতে পারি যে, গতকাল আমাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করা হয়েছে এবং কয়েক ভাই শহীদ হয়েছেন ও কিছু সংখ্যক ভাই আহত হয়েছেন৷
আমি এ সংবাদ শোনার পর আমাদের আমির হাসান মাখদুমের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলাম এবং আরব ভাইদের ঘাঁটিতে গিয়ে তাদের ওয়ারলেস দিয়ে যোগাযোগ করলাম ও তাদেরকে গোলাবর্ষণের ব্যাপার সংবাদ দিলাম৷ আমরা সেদিন ক্যাম্পে পৌছতে পারিনি৷ ফলে মরুভূমিতেই আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাত কাটাই৷ সেই রাতে আমরা দেখি যে, মার্কিনি বিমান তালেবানদের সামরিক ঘাঁটিতে গোলাবর্ষণ করছে, তাহলে কি আমাদের ঘাঁটিতেও এমনটি করা হচ্ছে? সকালবেলা সেই জামাত এসে পৌছে, যাদেরকে আবু মুহাম্মাদ দূরদূরান্তে সংবাদ পাঠানোর জন্য প্রেরণ করেছেন৷ তাদের সাথে সাক্ষাৎ করার পর আমরা একসাথে ক্যাম্পে যাই এবং ক্যাম্পে গিয়ে দেখি যে, বোমা হামলার তীব্রতায় তা প্রাচীন নিদর্শনে পরিণত হয়ে গিয়েছে৷ সেখানে আমরা এক সামরিক জিম্মাদার ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করি ও তার কাছ থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করি৷ সেখানে আব্দুল মুহসিন নামে এক নতুন ভাই শহীদ হয়ছিলেন এবং অন্যান্য আরো চারজন আহত হয়েছেন৷ আহতদের দেখার জন্য আমরা হসপিটালে গেলাম এবং যে সকল ভাইদেরকে আবু মুহাম্মাদ কাবুলে প্রেরণ করেছেন তারা ফিরে চলে যায়৷ বাকি ভাইয়েরা আহতদের দেখার জন্য রয়ে যায় এবং তাদেরকে তিন জামাতে বিভক্ত করা হয়৷ ভাই ইবনে ওমরও ক্যাম্পের গোলাবর্ষণের সংবাদ শুনে তুখাড় থেকে চলে আসেন৷ আমরা একসাথেই ক্যাম্পের জায়গায় যাই এবং যুবকদের কাকে কাকে আমরা ফেরৎ পাঠিয়ে দিব ও কাকে কাকে এখানে রাখবো সে ব্যাপারে মাশওয়ারা করলাম৷ যাদের কোর্স সম্পন্ন হয়ে গেছে আমরা তাদের নাম উত্তরাঞ্চলের ফ্রন্টের জন্য রেজিষ্ট্রি করলাম৷ ক্যাম্পে যারা বাকি রয়ে গিয়েছিলেন, তাদের ভেতর ভাই আব্দুস সালাম তুর্কিস্তানীও ছিলেন৷ তাঁর বয়স তখন মাত্র ষোল বৎসর ছিল৷
আমি ও ইবনে ওমর কাবুলে ফিরে এসে যুবকদের সাথে সাক্ষাৎ করি এবং যারা উত্তরাঞ্চলের ফ্রন্টে যেতে আগ্রহী, তাদের নাম রেজিষ্ট্রি করি৷ আর যে সমস্ত যুবকদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়নি, তারা অবশিষ্ট রয়ে যায় এবং তাদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করার জন্য কাবুলের কুরাবাগে আমিও তাঁদের সাথে রয়ে যাই৷ আমরা প্রায় পঞ্চাশজন ভাই কুরা বাগের এক মসজিদে এশার নামাজ পর্যন্ত বসেছিলাম৷ অতঃপর আমরা মসজিদের পাশে এক বিরাট বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পেলাম, যার ধূলো মসজিদের পরিচ্ছন্নতাকে নোংরা করে দেয়৷ এবং ধারাবাহিকভাবে মসজিদের আশপাশের বাড়ীগুলোর ওপর বোম্বিং হতে থাকে, যে বাড়ীগুলোতে যুবকরা রাত্রিযাপন করতো৷ কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেই রাত্রে এশার নামাজ দেরী হয়ে যায় ও ভাইয়েরা মসজিদে রয়ে যান৷ ফলে তারা সকলেই রক্ষা পেয়ে যায়৷
অতঃপর আমরা মসজিদের বাইরে ছড়িয়ে পড়লাম এবং অত্যাধিক ধূলো ও ধুয়ার দরুণ আমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না৷ এমনকি আমরা যখন মসজিদ থেকে প্রায় একশো মিটার দূরে আসি তখন আকাশ দেখতে পাই এবং এক আরবি ভাইকে, যিনি রুটি বন্টন করছিলেন বলতে শুনিঃ রুটি লাগবে কার? এতে আমরা পুলকিত হই ও সেই রুটি খাই৷ সেই রাত্রটি আমরা মরুভূমিতেই কাটিয়ে দিলাম এবং মার্কিনি বিমান আমাদের সামনের ফ্রন্টে লাগাতার গোলাবর্ষণ করতে থাকে৷
এরপর থেকে আমরা ভাইদেরকে দিনের বেলা প্রশিক্ষণ দিতাম এবং রাতের বেলা গাছের নীচে ছড়িয়ে পড়তাম৷ সোমবার দিন যোহরের নামাজের পর আমি তালেবানদের পাবলিক নম্বরে ওয়ারলেস চালু করি এবং এক ভাইকে আরবি ভাষায় বলতে শুনি তিনি বলছেন, “মুরতাদরা কামান নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে”৷ তখন আমি আমিরের নির্দেশের অপেক্ষা করি৷ তারপর প্রয়োজনীয় সামানাপত্র গুছিয়ে কাবুলে যাওয়ার নির্দেশ আসে৷ ফলে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম এবং রাস্তার পাশে এক ছোট বাজারে পৌছি৷ সেখানে মাগরিবের নামাজের কিছুক্ষণ পূর্বে ফ্রন্টের জিম্মাদারের সাথে সাক্ষাৎ হয়৷ নামাজের পর আমরা ওপর থেকে হেলিকপ্টারের আওয়াজ ও নীচ থেকে ট্যাংকের আওয়াজ শুনতে পাই৷ ফলে আমরা মুরাদ বুক পর্বতে আরোহণ করি এবং কমান্ডারের সহযোগী হামজা যুবাইরকে দেখতে পাই যে, তিনি পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছেন ও বলছেন, “আমরা এখানে শত্রুর মোকাবেলা করবো এবং তাদেরকে কাবুলে প্রবেশ করতে দিবো না”৷
আমরা মুরাদ বুক পর্বতে চড়ে নিজেদের অবস্থান গাড়ার পর জানতে পারলাম যে, আমাদের তিন তুর্কিস্তানী ভাই আমাদের পিছনে শত্রুদের ওখানে রয়ে গেছে, প্রত্যাগমন করতে পারেনি৷ তাঁদের পিছনে রয়ে যাওয়ার কারণ হল, তাঁরা পদব্রজে আমাদের আগে চলে গিয়েছিল৷ এরপর আমরা গাড়ীতে চড়েছিলাম, কিন্তু তাদেরকে দেখিনি৷ কিন্তু মুরতাদ শত্রুরা পিচ রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে আর ভাইয়েরা খেতের আল দিয়ে চলে আসে এবং তিন ঘন্টা পর আমাদের সাথে এসে মিলিত হয়৷ সে সময়ও গোলাবর্ষণ চলতে থাকে এবং মুরতাদরা স্থলপথে কাবুল অভিমুখে এগোতে থাকে৷ মার্কিনীরা যেন আহমাদ শাহ্ মাসউদের লোকদের চিনতে পারে ও তাদের প্রতি বোম্বিং না করে সে জন্য তারা সঙ্কেত পাঠাতো কিংবা বিশেষ আলো জালাতো৷ আমি রাত এগারোটায় পাহারা দেওয়ার সময় পর্বতের চূড়ায় থাকতাম এবং শত্রুরা মুরাদ বুক রোডে প্রভাব বিস্তার করতো ও মার্কিন বিমান বাহিনী তালেবানদের ট্যাংক ও গাড়ীতে বোম্বিং করতে থাকতো৷
আমরা তালেবানদের সাথে প্রত্যাগমন করার ব্যাপারে আরব ভাইদের সাথে মাশওয়ারা করে একমত হই৷ তখন বিমান হামলার আশঙ্কায় আমাদের গাড়ী আলো বন্ধ করে সামনে চলতে থাকতো এবং পিছনে ভাইয়েরা আমাদের গাড়ীর ছাপ নষ্ট করে দিত, যেন আমাদের অবস্থান শত্রুর নিকট অস্পষ্ট থাকে৷ বিমান তখনও বোম্বিং করতে থাকতো কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ্ তা আমাদের গাড়ীতে লাগতো না৷
আমরা মেইন রোড অভিমুখে চলা শুরু করি৷ ভয় ও আতঙ্কের কারণে লোকেরা কাবুলের দিকে ছুটতে থাকে৷ তাঁরা অনুরোধ করছিল আমরা যেন তাদেরকে আমাদের গাড়ীতে উঠাই৷ কিন্তু তাদের আবদার রক্ষা করা আমাদের জন্য অসম্ভব ছিল; কেননা আমাদের গাড়ী মুজাহিদদের দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল৷ আমরা কাবুলে পৌছে কাবুলকে তালেবানশূন্য পেলাম৷ ফলে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হই সে সকল ভাইদের জন্য, যারা কাবুলের ঘাঁটিগুলোতে রয়ে গিয়েছিলো৷ ফলে আমরা তাদেরকে তালাশ করতে ও নিজেদের সাথে নিয়ে যেতে পারিনি৷ আমাদের গাড়ী লাগাতার চলতে থাকে৷ একপর্যায়ে আমরা রাত দুইটা বাজে লোগাড় প্রদেশের কিনারায় পৌছি ও এক বিস্ময়কর অবস্থা পরিলক্ষণ করি৷ আমরা দেখি যে, কিছু মানুষ অত্যাধিক ক্লান্তির দরুণ রাস্তার পাশে শুয়ে রয়েছে এবং অন্যান্যরা পায়ে হেঁটে নিজেদের সামানাপত্র ও গবাদিপশু টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ আর মুজাহিদদের অবস্থা এই ছিল যে, তাঁরা কাধে অস্ত্র বহন করছিল ও তাঁদের চোখেমুখে অনুশোচনা, পরিতাপ, বিষণ্নতা ও শোকের ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছিল, যা ছিল অত্যন্ত ভীতিপ্রদ ও বেদনাদায়ক দৃশ্য…!
আমিও খুব শোকাহত ছিলাম এবং আমার চোখ থেকে পানি ঝরছিল ও নিজেকে আমি প্রশ্ন করছিলাম যে, ইমারতে ইসলামিয়া আমাদের চোখের সামনে কিভাবে ভেঙ্গে যাবে, অথচ আমরা সকলে একযোগে চলে যাইনি; এটা কি কোন বোধগম্য কথা?!
অবশেষে আমাদের গাড়ী লোগাড় প্রদেশের কাছাকাছি একটি বাড়ীর সামনে থামে এবং আমরা আমাদের সামানাপত্র সেই বাড়ীতে রাখি৷ সকালবেলা আমরা ঈদগাহের দিকে গেলাম৷ সেখানে দেড় হাজারের বেশি মুজাহিদ অবস্থান করছিলেন, যাদের সকলেই ছিলেন মুহাজির৷ আমরা সেখানে একত্রিত হয়েছিলাম লোগাড় প্রদেশের পর্বত থেকে পাকতিকা ও পাকতিয়া প্রদেশ প্রতিরক্ষা করার পদ্ধতির ব্যাপারে মাশওয়ারা করা ও একমত হওয়ার জন্যে৷ যোহরের নামাজের পর আমাদের তিনজন নতুন তুর্কিস্তানী ভাই আমাদেরকে হারিয়ে ফেলে৷ তাঁরা সেই এলাকাও চিনতেন না এবং সেই এলাকার লোকদের ভাষাও জানতেন না৷ ফলে আমি যুরমাত শহরের দিকে রওয়ানা করি আবু মুহাম্মাদের নিকট তাঁরা পৌছেছে কিনা তা জানার জন্য৷
গারদীয শহরে পৌছার পর আমি যুরমাত শহরের গাড়ী পাইনা৷ মাগরিবের নামাজের পর আমি একটি হোটেলে বসা ছিলাম৷ তখন আমি ওয়ারলেস চালু করলাম ও তাতে আমাদের আরব ভাইদের কন্ঠ শুনতে পাই৷ আমি মনে মনে বললাম, সুবহানাল্লাহ্ লোগাড় থেকে আওয়াজ এই পর্যন্ত কিভাবে পৌছে? অথচ কত দূরের সফর! পাঁচ মিনিট পর আমি হোটেলের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আরব ভাইয়েরা সড়কে দাঁড়িয়ে আছে৷ তখন আমি হোটেল থেকে দ্রুত নেমে তাদের জিম্মাদার ভাইদের সাথে সাক্ষাৎ করলাম ও তাদেরকে লোগাড় ছেড়ে এখানে চলে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম৷ তারা আমাকে জানাল, লোগাড়বাসীরা কিতাল করতে চায় না৷
অতঃপর তাদের সাথে মিলে আমি খোস্ত প্রদেশের দিকে রওয়ানা করি এবং পথেই রাত্রিযাপন করি ও সকালবেলা আমরা খোস্তে পৌছি৷ আমরা যখন খোস্তের কাছাকাছি পৌছেছিলাম তখন কতিপয় নেকাব পরিহিত পীকা অস্ত্রধারী লোক, যাদের দেখতে ডাকাতের মত মনে হচ্ছিল তারা আমাদেরকে শহরে প্রবেশ করতে বাধার সৃষ্টি করে৷ ফলে জনসাধারণের সাথে আমরাও পিছনে ফিরে যেতে বাধ্য হই৷ আমরা অস্পষ্ট, বিভ্রান্ত খবর শুনছিলাম৷ অবশেষে আমরা পাহাড়ের উপত্যকায় গিয়ে জায়গাটি নিয়ন্ত্রণ করি এবং আমরা তখন আরব-আজমের প্রায় পাঁচশো মুজাহিদ ছিলাম৷
দুই দিন পর রমজান মাস চলে আসে৷ বিমান সার্বক্ষনিক আমাদের কাছাকাছি জায়গাগুলোতে বোম্বিং করতে থাকতো এবং আমরা গাছের ছায়ায় বসতাম ও মার্কিনিদের প্রতারিত করার জন্য গাড়ীগুলোকে মাটি দ্বারা ঢেকে দিতাম, যেন তারা বুঝতে না পারে৷
এক সপ্তাহ পর যখন আমি বুঝতে পারলাম যে, তাদের হামলা করার ইচ্ছা নেই তখন আমরা আবু মুহাম্মাদের নিকট যুরমাত শহরের দিকে যাওয়ার ইচ্ছা করলাম ও সে উদ্দেশ্যে একটি ট্রাক ভাড়া করলাম৷ অর্ধেক রাস্তায় যাওয়ার পর আমরা আমাদের আরব ভাইদেরকে যুরমাত শহরের দিকে যেতে দেখি৷ ফলে আমরা তাঁদের গাড়ীতে আরোহণ করে যুরমাত শহরে গেলাম এবং আমি ভাই আবু মুহাম্মাদের সাথে সাক্ষাৎ করে তার সাথে একটি ঘাঁটিতে রয়ে গেলাম ও ভাইদের জন্য অন্য জায়গার ব্যাবস্থা করলাম৷
এ সময়ে আমরা তোরাবোরার ভাইদের ও উত্তরাঞ্চলের ফ্রন্টে যে সকল ভাইয়েরা রয়ে গিয়েছিল তাদের খোঁজখবর শুনতাম৷ এ সময়ের ভেতর মূল মূল প্রদেশগুলোর যথা কাবুল, মাজার শরীফ এরপর কান্দাহার ও জালালাবাদের পতন হয়ে গিয়েছিলো৷ আমার সাথে আমাদের তোরাবোরা ক্যাম্পের জিম্মাদার যোগাযোগ করে আমার নিকট মাশওয়ারা চেয়েছিলো যে, এখন তাঁরা কি করবে? ও কার অধীনে করবে? আমি ভাই আবু মুহাম্মাদের সাথে মাশওয়ারা করি; কিন্তু অত্যান্ত আফসোসের বিষয় যে, আমাদের মধ্যকার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে আমি তাঁর কাছে কিছু উপস্থাপন করতে পারিনি৷
আর উত্তরাঞ্চলের ভাইয়েরা কুন্দুজ প্রদেশের দিকে প্রত্যাগমণ করার সময় তাদের নয়জন ভাই শাহাদাত বরণ করেন ও দুইজন ভাই বন্দি হন এবং তাঁদের তেইশ জনের এক জামাত মাজার শরীফের দিকে যায়৷ তাঁদের সাথে ইবনে ওমর ও শাইখ বিলালও ছিলেন৷ অন্যান্য ত্রিশজন উজবেকিস্তানের মুজাহিদদের সাথে তুখাড় প্রদেশেই রয়ে যান৷ কয়েকদিন পর আমরা শুনতে পেরেছিলাম যে, যে সকল ভাইয়েরা মাজার শরীফের দিকে গিয়েছেন দুষ্কর্মা দোস্তম তাঁদের সাথে গাদ্দারী করেছে ও তাদেরকে হত্যা করেছে৷ তাদের বিভাজনে আমরা চরমভাবে শোকাহত হই এবং আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি যে, তিনি তাদের শাহাদাতকে কবুল করুন৷
কোন এক রাতে আমি জিম্মাদার মালি ও শামসুদ্দিনের সাথে এবং প্রহরার জিম্মাদারের সাথে ভাই আবু মুহাম্মাদের আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানের দিকে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মশওয়ারা করি৷ যুরমাত শহরের পরিস্থিতি দিনদিন খারাপের দিকেই যাচ্ছিল এবং মার্কিন বিমান যুরমাতের আকাশে চক্কর দিতে থাকতো৷ ভাইয়েরা সকলেই তাঁকে রক্ষণাবেক্ষণ করা ও তার বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উৎকন্ঠা ছিল৷ আমি বললাম যে, এমতাবস্থায় যদি আফগানিস্তানকে ছেড়ে যাওয়া ময়দান থেকে পলায়ন বলে গণ্য না হয় তাহলে আমরা তাকে আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিব, অন্যথায় রক্ষণাবেক্ষণের দোহাই দিয়ে আমরা তাকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিতে পারি না৷ কেননা আমি শাইখ হামূদ বিন উক্বলা ও শাইখ নেযামুদ্দিন শামযায়ীর ফতোয়া গভীর মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করেছি৷ মার্কিনীরা যখন আফগানিস্তানের ওপর আক্রমণ করার ইচ্ছা করেছিল তখন তাঁরা উভয়ে বলেছিলেন, “যে কেউ এ সময় আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে যাবে, সে ময়দান থেকে পলায়নকারী বলে গণ্য হবে এবং যে কেউ তালেবানদের বিপক্ষে মার্কিনিদের সাহায্য করবে সে মুরতাদ বলে গণ্য হবে”৷ তাই আমাদের উচিত এ মাসআলার ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম ও মুফতিয়ানে ইযামের নিকট ফতোয়া তলব করা৷
সকালবেলা প্রহরার জিম্মাদার ও আমি শাইখ আবুল মুনজির লিবীর নিকট গিয়ে এ অবস্থায় আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বিধান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম ও তার নিকট শাইখ হামূদ বিন উক্বলা ও শাইখ নেযামুদ্দিন শামযায়ীর ফতোয়া উল্লেখ করলাম৷ তখন তিনি বললেন, “বর্তমানে আফগানিস্তানের অবস্থা বদলে গিয়েছে এবং প্রধান প্রধান প্রদেশগুলোর পতন হয়ে গেছে৷ এ কারণে যে ব্যক্তি বর্তমানে পাকিস্তান সীমান্তে ক্বিতাল করার নিয়তে আফগানিস্তান ছেড়ে যাবে তাঁর এ কাজ ময়দান থেকে পলায়ন বলে গণ্য হবে না”৷
এই ফতোয়া শুনার পর আমরা ভাই আবু মুহাম্মাদকে পাকিস্তানে প্রেরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রে সজ্জিত করে দিলাম ও জামাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল নথি যেমন কাগজপত্র, টেপ ইত্যাদি সকল কিছু জ্বালিয়ে দিলাম৷ অতঃপর ভাই আবু মুহাম্মাদ তাঁর গার্ড নিয়ে ঈদুল ফিতরের একদিন পূর্বে পাকিস্তান অভিমুখে যাত্রা করেন৷ এবং ফারুক, হিযবুল্লাহ্, আব্দুল আহাদ রহঃ, আব্দুল গফুর ক্বারশায়ী, আব্দুল কারীম ও আমি ভাই আব্দুল ওয়াকিল রহঃ এর নেতৃত্বে আরব ভাইদের সাথে ক্বিতাল করার নিয়তে থেকে যাই৷
ঈদুল ফিতরের পর আমরা ভাইদের সাথে দেখা করার জন্য কখনো কখনো “শাহী কোটে” যেতাম৷ কয়েকদিন পর কিছু সংখ্যক আরব ভাই আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে গেলেন৷ তখন আমি ও ভাই আব্দুল কারীম ভাই আব্দুল ওয়াকিল রহঃ এর কাছে গেলাম এবং তাঁকে বললাম, “আমরা আফগানিস্তানে রয়ে গেলাম আরব ভাইদের সাথে মিলে ক্বিতাল করার জন্য৷ আর আরব ভাইয়েরা এখন চলে যাচ্ছেন, তাঁরা এমনটি কেন করছেন?” তিনি বললেনঃ “হ্যাঁ, আমরাও বিষয়টি নিয়ে আবু মুহাম্মাদের সাথে কথা বলেছি; কিন্তু সাধারণ জনগণ আমাদের সাথে ক্বিতাল করতে চায় না৷ আমার সাথে এক হাজারেরও বেশী মুজাহিদ ছিল; কিন্তু জনগণ থাকতে চায় না৷ এখন আমাদের আর কি করার? তাই আমি তাঁদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছি৷ এ কারণে বর্তমানে স্বল্পসংখ্যক মুজাহিদ অবশিষ্ট রয়েছে৷ আপনি ভাই আবু মুহাম্মাদের সাথে মাশওয়ারা করে আপনার পদক্ষেপ গ্রহণ করুন৷
সন্ধা বেলা আব্দুল কারীম ভাই শাইখ আবু মুহাম্মাদের সাথে যোগাযোগ করলেন ও তাঁকে আব্দুল ওয়াকিলের কথা জানাল৷ ভাই আবু মুহাম্মাদ বললেন, “আপনি ও আব্দুল হক্ব অবিলম্বে আমার কাছে চলে আসুন”৷ আমরা অন্যান্য ভাইদের সাথে মাশওয়ারা করলাম৷ তখন ফারুক বলল, “আমি কয়েক বছর যাবৎ কোন অপারেশনে অংশগ্রহণ করিনি এবং এখন অপারেশনে অংশগ্রহণ করতে চাচ্ছি”৷ তাই ফারুক ও তার সাথে হিযবুল্লাহ্ অবশিষ্ট রয়ে গেল৷ আর আমি আব্দুল কারীম ও অন্য আরো ভাইদের সাথে একই ট্রাকে আমাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রওয়ানা করি ও মাগরিবের নামাজের সময় ‘নাওয়া আদা’ পর্যন্ত পৌছি৷ আমরা এক আনসারের বাড়ীতে রাত্রিযাপন করে সকালবেলা আবার রওয়ানা করি ও পাকিস্তানের ওয়ানা শহরের শেন ওয়ারস্কে পৌছি৷ এটি ছিল ২০০২ সালের জানুয়ারির দুই তারিখে৷
সম্পাদকের কথা
আমার মুহতারাম পাঠক ও পাঠিকাগণ! শাইখ আব্দুল হক তুর্কিস্তানী হাফিজাহুল্লাহর আত্মজীবনীর মূল আরবি বইতে এখানে এসে শেষ করা হয়েছে। এবং লেখা রয়েছে “বিশেষ পরিস্থিতির কারণে পূর্ণ করা হলো না, এখানেই সমাপ্তি ঘোষণা করা হল”৷ তবে আমরা আরও দুটি পরিশিষ্ট প্রকাশ করবো ইনশা আল্লাহ, তাহলে আপনারা শাইখ আব্দুল হক ও তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি সম্পর্কে পর্যাপ্ত একটা ধারণা পাবেন ইনশা আল্লাহ। প্রথম পরিশিষ্ট শাইখের সংক্ষিপ্ত একটি পরিচিতি নিয়ে ও দ্বিতীয় পরিশিষ্ট দুই বছর আগে প্রদত্ত “সউতুল ইসলাম”কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের অনুবাদ, যাতে উইঘুর মুসলিমদের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা থাকবে ইনশা আল্লাহ।
সম্ভত শাইখের নিরাপত্তা বিবেচনায় আরবি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আত্মজীবনীর বাকি অংশ প্রকাশ করেনি। সিরিয়া থেকে পরিচালিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নুখবাতুল ফিকর রবিউল আওয়াল ১৪৩৮ হিজরী — ডিসেম্বর ২০১৬ ঈসায়ীতে আত্মজীবনীটি প্রথম প্রকাশ করে। উল্লেখ্য উইঘুর যোদ্ধারা আফগানিস্তানে তালেবানের অধিনে এবং সিরিয়ায় হাইআত তাহরির আশ শামের পরামর্শে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।
পাঠক! ইতিহাসের দুর্লভ নথিগুলো যেন হারিয়ে না যায়, তাই খুঁজে খুঁজে আপনাদের সামনে পেশ করছি, আর এই কাজে আমাকে সহযোগিতা করছেন আমার নির্লোভ কিছু বন্ধু, যারা নিজেদেরকে আত্মপ্রকাশ করতে চান না। তাই আপনারা অনুবাদকের নাম পাননি। আমি আমার জন্য ও আমার সেই বন্ধুদের জন্য খাস করে আপনাদের কাছে দুয়া চাই।
পরিশেষে বলবো কমিউনিস্ট চীন কর্তৃক দখলকৃত পূর্ব তুর্কিস্তানের (বর্তমানে জিঞ্জিয়াং) উইঘুর মুসলিমদের আমরা যেন ভুলে না যাই। তাঁদের বহুদিনের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের একটি লেখাও যদি সহযোগিতা করে, তাহলে অন্তত পরকালে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার দরবারে আমরা ওজর পেশ করতে পারবো। আল্লাহ আমাদের ও আমাদের কাজকে কবুল করে নিন। আমিন।
ـــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــ
বিশেষ পরিস্থিতির কারণে জীবনি লিখন পূর্ণ করা হলো না, এখানেই সমাপ্তি ঘোষণা করা হল৷