জিহাদ বিষয়ক মৌলিক আলোচনা- শাইখ আব্দুল কাদির ইবনে আব্দুল আযিয
জিহাদ বিষয়ক মৌলিক আলোচনা
http://www.mediafire.com/file/1f19xp5m36w4dtc/Fundamental+.pdf
https://www.mediafire.com/file/5be6avg6l9vy6lt/jihad_bishoyek_moulik_alocona_.pdf/file
জিহাদ বিষয়ক মৌলিক আলোচনা
শাইখ আব্দুল কাদীর বিন আব্দুল আজিজ
[আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকে ত্বরিত তাওয়াগীতদের কারাগার থেকে মুক্ত করে দিন]
আত্–তিবয়ান পাবলিকেশন্স – এর পক্ষ হতে বিতরণ সংক্রান্ত বিশেষ অনুরোধঃ প্রকাশকের টীকাসহ এই গ্রন্থের সকল অংশে যে কোন প্রকার – যোগ-বিয়োগ, বাড়ানো – কমানো অথবা পরিবর্তন করা যাবে না, এই শর্তে, যে কোন ব্যক্তি এই প্রকাশনা প্রচার বা বিতরণ করার অধিকার রাখেন।
সূচীপত্র
প্রথম অধ্যায়ঃ সৃষ্টির উদ্দেশ্য.. 8
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ আল্লাহর সৃষ্টি দুই ভাগে বিভক্ত – মু’মিন ও কাফির. 10
তৃতীয় অধ্যায়ঃ মু’মিন ও কাফিরের এই পৃথকীকরণের মাধ্যমেই তাদের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি হয়. 14
ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ জিহাদ দুই প্রকারেরঃ ‘জিহাদ আত-তালাব’ এবং ‘জিহাদ আদ-দিফা’য়’ 32
সপ্তম অধ্যায়ঃ জিহাদ একটি ফরযে কিফায়া ইবাদত, তবে ক্ষেত্রবিশেষে এটি প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য.. 41
অষ্টম অধ্যায়ঃ প্রত্যেক মুসলিমের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক.. 44
নবম অধ্যায়ঃ মুসলিম জাতি একটি মুজাহিদ জাতি; সুতরাং এর নীতিসমূহও সেভাবেই গৃহীত হবে… 46
একাদশ অধ্যায়ঃ হিজরত বন্ধ হবে না যতদিন না সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হয়. 54
ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ সবচেয়ে নিকটবর্তী শত্রুর সাথে যুদ্ধ শুরু করা আবশ্যক.. 64
ষোড়শ অধ্যায়ঃ নির্জীব তাওয়াগীতের৮ চেয়ে জীবন্ত তাওয়াগীত অনেক বেশী ক্ষতিকর. 87
সপ্তদশ অধ্যায়ঃ আর ইসলামের শক্তি সুসংহত হবে ঈমানভিত্তিক ঐক্যের দ্বারা.. 90
অষ্টাদশ অধ্যায়ঃ যুদ্ধ হলো (শত্রুকে) ধোঁকা দেয়া.. 98
বিংশতম অধ্যায়ঃ এবং বিজয় তো শুধুমাত্র আল্লাহর থেকেই আসে… 131
অনুবাদকের কথা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার জন্য কারণ তিনিই আমাদের এই বইটি অনুবাদের সুযোগ দিয়েছেন এবং অনুবাদটি সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছেন। তাঁর সাহায্য ব্যতীত এই কাজ সম্পন্ন করা ছিল অসম্ভব।
শুরুতেই যে কথাগুলি বলতে চাই তা হলো; এক. বইটি অনুবাদের সময় কোন আরবী শব্দের যথার্থ বাংলা সমার্থক না পাওয়া গেলে সেক্ষেত্রে আরবী শব্দই ব্যবহার করা হয়েছে। দুই. কুরআনের আয়াতের ক্ষেত্রে একটি মনে রাখতে হবে যে, এটি আল্লাহর বাণী, কোন ভাষাতেই একে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এর অর্থ অনুবাদ করতে সক্ষম। এই অনুবাদের জন্য আমরা মূলত ইসলামী ফাউন্ডেশনের আল কুরআনুল কারীমের বঙ্গানুবাদ ব্যবহার করেছি। তিন. হাদীসের ক্ষেত্রেও সরাসরি আরবী ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী অটুট রাখা সম্ভব নয়। সুতরাং পাঠকদের মনে রাখতে হবে যে, হাদীসের অনুবাদ হাদীস নয়, এটি শুধুমাত্র হাদীসের অর্থ। এক্ষেত্রেও আমরা অধিকাংশ হাদীস ইসলামী ফাউন্ডেশনের অনুবাদকৃত সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম থেকে ব্যবহার করেছি, যেসব ক্ষেত্রে অনুবাদকৃত হাদীস পাওয়া সম্ভব হয়নি, সেসব ক্ষেত্রে আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি হাদীসের অর্থের সাথে সঙ্গতি রাখতে। তাই আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের নিকট আমাদের দু’আ তিনি যেন আমাদের আন্তরিকতা কবুল করেন এবং আমাদের ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করেন, তিনি ছাড়া আমাদের আর কোন ক্ষমাকারী নেই ।
লেখকের এই বইটি লেখার উদ্দেশ্য ছিল, আল্লাহ্ তা’আলার একটি হুকুম পালন করা, “এবং মু’মিনদেরকে (জিহাদের জন্য) উদ্বুদ্ধ কর”। আল্লাহ্ তার প্রচেষ্টা কবুল করুন এবং তাকে হিফাজত করুন। লেখকের তুলনায় আমাদের প্রচেষ্টা তো নগণ্য, তারপরও আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার আয়াত আমাদের প্রেরণা দেয়,
مَا كَانَ لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ وَمَنْ حَوْلَهُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ وَلا يَرْغَبُوا بِأَنْفُسِهِمْ عَنْ نَفْسِهِ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ لا يُصِيبُهُمْ ظَمَأٌ وَلا نَصَبٌ وَلا مَخْمَصَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلا يَطَئُونَ مَوْطِئًا يَغِيظُ الْكُفَّارَ وَلا يَنَالُونَ مِنْ عَدُوٍّ نَيْلًا إِلا كُتِبَ لَهُمْ بِهِ عَمَلٌ صَالِحٌ إِنَّ اللَّهَ لا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ
وَلا يُنْفِقُونَ نَفَقَةً صَغِيرَةً وَلا كَبِيرَةً وَلا يَقْطَعُونَ وَادِيًا إِلا كُتِبَ لَهُمْ لِيَجْزِيَهُمُ اللَّهُ أَحْسَنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“…এটা এজন্য যে আল্লাহর পথে যে তৃষ্ণা, ক্লান্তি এবং ক্ষুধা তাদের স্পর্শ করে এবং তাদের এমন পদক্ষেপ যা কাফিরদের ক্রোধের উদ্রেক করে এবং শত্রুদের নিকট থেকে তারা যা কিছু প্রাপ্ত হয়- তার প্রত্যেকটির বিনিময়ে তাদের জন্য লিখিত হয় নেক আমল। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করেন না। আর তারা অল্পবিস্তর যা কিছু ব্যয় করে, যত প্রান্তর তারা অতিক্রম করে, তা সবই তাদের নামে লেখা হয়, যেন আল্লাহ্ তাদের সৎকর্মসমূহের উত্তম বিনিময় প্রদান করেন।” [1]
ইয়া রাব্বুল ‘আলামীন আপনি আমাদের এই প্রচেষ্টা কবুল করুন, যা আপনারই সহায়তায় সম্পন্ন হয়েছে; আমাদের নিয়্যতকে বিশুদ্ধ করুন এবং আমাদেরকে মুজাহিদদের অন্তর্ভুক্ত করুন। হে গাফুরুর রাহীম! এই অনুবাদ করতে গিয়ে আমরা যে গাফিলতি ও সময় ক্ষেপণ করেছি তার জন্য আমাদের ক্ষমা করুন এবং যে সকল ভুল ভ্রান্তি আমাদের গাফিলতিতে এবং শয়তানের প্ররোচনায় হয়েছে, সেগুলো ক্ষমা করুন; আপনি ছাড়া ক্ষমা করার আর কেউ নাই। আমীন।
প্রথম অধ্যায়ঃ সৃষ্টির উদ্দেশ্য
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেনঃ
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلا لِيَعْبُدُونِ
“আমি জ্বীন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র এজন্য যে, যেন তারা আমারই ইবাদত করে।” [2]
আল্লাহর রাসূলগণ যে দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন তারই বহিঃপ্রকাশ হলো ইবাদত। এই দুনিয়ার বুকে এমন কোন জাতি নেই যাদের কাছে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা রাসূল পাঠাননি। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
“আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই কোন না কোন রাসূল প্রেরণ করেছি, এ নির্দেশ প্রচারের জন্য যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে দূরে থাক…”[3]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেনঃ
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا
“…আর এমন কোন উম্মত ছিল না যাদের মধ্যে কোন সতর্ককারী আসেনি।” [4]
এর দ্বারা আল্লাহ্, সুবহানাহু ওয়া তা’আলা, তাঁর হুজ্জাহ (প্রমাণ) প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন, আদম (আঃ) থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ
“সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে রাসূলদের আমি এজন্য প্রেরণ করেছি যাতে রাসূলদের আগমনের পর মানুষের কোন ওজর আপত্তি না থাকে। আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, হিকমাত সম্পন্ন।” [5]
নাবীগণকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাদের সমসাময়িক বংশসমূহের মধ্য থেকেই আবির্ভূত করেছেন। তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের অনুসারীগণ এই কার্যক্রম চালিয়ে যান। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
وَمَا كَانَ رَبُّكَ مُهْلِكَ الْقُرَى حَتَّى يَبْعَثَ فِي أُمِّهَا رَسُولًا يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِنَا
“আর আপনার রব জনপদসমূহ ধ্বংস করেন না, যে পর্যন্ত না তিনি তার কেন্দ্রস্থলে রাসূল প্রেরণ করেন, যিনি তাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন।” [6]
সুতরাং রাসূলগণের মৃত্যুর পর তাদের অনুসারীগণ এই দাওয়াত অব্যাহত রাখেন যাতে সৃষ্টিকুল আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার হুজ্জাহ থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়। আর এজন্যই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা যারা উপস্থিত আছো তারা পৌঁছে দাও (এই বাণী) তাদের কাছে যারা (এখানে) অনুপস্থিত”। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “আমার তরফ থেকে যদি একটি আয়াতও হয় পৌঁছে দাও”। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “আলেমগণ নাবীদের উত্তরাধিকারী”। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেনঃ “আমার উম্মতের একটি দল (তা’ইফাহ) নিরন্তর আল্লাহর হুকুমের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে”। উল্লেখিত সকল হাদীসই সহীহ।
ইবাদতের হুকুম হলো শারীয়াহ ভিত্তিক। অর্থাৎ নাবীদের জবান দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলা এসব হুকুম প্রণয়ন করেছেন। আর এই শারীয়াহ গ্রহণ করা না করার সিদ্ধান্ত মানুষের। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার শারীয়াহ, যা তাঁর রাসূলগণের জবান দ্বারা বিবৃত, সকল সৃষ্টই মানবে এমনটি আবশ্যক নয়। কেউ চাইলে শারীয়াহ মানবে আর না চাইলে মানবে না।
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ আল্লাহর সৃষ্টি দুই ভাগে বিভক্ত – মু’মিন ও কাফির
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেনঃ
وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَجَعَلَ النَّاسَ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلا يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَ
إِلا مَنْ رَحِمَ رَبُّكَ وَلِذَلِكَ خَلَقَهُمْ
“তোমার রব ইচ্ছা করলে সমস্ত মানুষকে এক উম্মত করতে পারতেন, কিন্তু তারা মতভেদ করতেই থাকবে। তবে তারা নয়, যাদেরকে তোমার রব দয়া করেন এবং তিনি তাদেরকে এজন্যই সৃষ্টি করেছেন।” [7]
ইবনে কাসীর (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর প্রসিদ্ধ তাফসীরে এই আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন; আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষকে এমনভাবেই সৃষ্টি করেছেন যাতে তাদের মাঝে ধর্ম ও বিশ্বাসের মতভেদ থাকবে।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ حَقَّتْ عَلَيْهِمْ كَلِمَةُ رَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ
وَلَوْ جَاءَتْهُمْ كُلُّ آَيَةٍ
“নিশ্চয়ই যাদের ব্যাপারে তোমার রবের বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছে, তারা ঈমান আনবে না, যদিও তাদের কাছে প্রত্যেকটি নিদর্শন আসে…”[8]
এরপরই তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেনঃ
وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لامَنَ مَنْ فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا أَفَأَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّى يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ
“তোমার রব ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সকলে অবশ্যই ঈমান আনতো; তবে কি তুমি মু’মিন হওয়ার জন্য মানুষের উপর জবরদস্তি করবে?”[9]
সুতরাং আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার ইচ্ছায় তাঁর সৃষ্টিসমূহ দু’টি ভাগে বিভক্ত: মু’মিন এবং কাফির। এটি তাঁর বিশেষ ইচ্ছা; এ বিষয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ
“তাঁর ব্যাপার শুধু এই, তিনি যখন কোন কিছু ইচ্ছা করেন, তিনি সেটাকে বলেনঃ ‘হও’, ফলে সেটা হয়ে যায়।” [10]
তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ قَدَرًا مَقْدُورًا
“…আল্লাহর বিধান সুনির্ধারিত।” [11]
সুতরাং আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টি মু’মিন আর কাফির এই দু’টি ভাগে বিভক্ত। যেমন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ
“তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ হয় কাফের এবং তোমাদের মধ্যে কেউ হয় মু’মিন।” [12]
তবে প্রাথমিক অবস্থায়, আদম (আঃ) এর সময় থেকে, সম্পূর্ণ মানবজাতি মু’মিন ছিল। পরবর্তীতে তার বংশধরদের মাঝে শিরকের আবির্ভাব ঘটে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা জানিয়েছেনঃ
وَمَا كَانَ النَّاسُ إِلا أُمَّةً وَاحِدَةً فَاخْتَلَفُوا
“মানুষ ছিল একই উম্মত, পরে তারা মতভেদ সৃষ্টি করে।” [13]
ইবনে কাসীর থেকে বর্ণিত, “ইবনে আব্বাস (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, ‘আদম এবং নূহ (আঃ) এর মধ্যবর্তী সময়ে ১০টি প্রজন্ম ছিল যারা সকলেই ছিল ইসলামের উপর। এরপর মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হয় এবং মূর্তি, মধ্যস্থতাকারী (মাধ্যম) এবং দেব-দেবীর পূজা শুরু হয়। যার প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর আয়াত, তাঁর ব্যাখ্যা, তাঁর প্রমাণ ও অকাট্য দলীলসহ রাসূলগণকে প্রেরণ করেনঃ
إِذْ أَنْتُمْ بِالْعُدْوَةِ الدُّنْيَا وَهُمْ بِالْعُدْوَةِ الْقُصْوَى وَالرَّكْبُ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلَوْ تَوَاعَدْتُمْ لاخْتَلَفْتُمْ فِي الْمِيعَادِ وَلَكِنْ لِيَقْضِيَ اللَّهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولًا لِيَهْلِكَ مَنْ هَلَكَ عَنْ بَيِّنَةٍ وَيَحْيَا مَنْ حَيَّ عَنْ بَيِّنَةٍ وَإِنَّ اللَّهَ لَسَمِيعٌ عَلِيمٌ
“…যাতে যারা ধ্বংস হবে তারা যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট প্রকাশের পর ধ্বংস হয় এবং যারা জীবিত থাকবে তারা যেন সত্যাসত্য প্রকাশের পর জীবিত থাকে।” [14]
আমার বক্তব্য: আদম (আঃ)-এর বংশধরগণ যখন কুফরিতে লিপ্ত হয়েছে তখন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। একথা তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেনঃ
كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ
“সমস্ত মানুষ ছিল একই উম্মত। অতঃপর আল্লাহ্ নাবীগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেন। মানুষেরা যে বিষয়ে মতভেদ করত তাদের মধ্যে সে বিষয়ে মীমাংসার জন্য তিনি তাদের সাথে সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেন।” [15]
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা স্পষ্ট দলীল প্রমাণসহ রাসূলগণকে প্রেরণ করার পরও মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষ মু’মিন ও কাফির এ বিভক্ত হয়েছে এবং উভয় দলের মাঝে সংঘর্ষ হয়েছে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেনঃ
تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ …… وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلَ الَّذِينَ مِنْ بَعْدِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَلَكِنِ اخْتَلَفُوا فَمِنْهُمْ مَنْ آَمَنَ وَمِنْهُمْ مَنْ كَفَرَ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا وَلَكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ
“এই রাসূলগণ, তাদের মধ্যে কাউকে কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি ….. আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে তাদের পরবর্তীরা তাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণ সমাগত হওয়ার পরেও পারস্পরিক যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হত না; কিন্তু তাদের মধ্যে মতভেদ ঘটল। ফলে তাদের মধ্যে কতক ঈমান আনল এবং কতক কুফরি করল। আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে তারা পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হত না; কিন্তু আল্লাহ্ তাই করেন যা তাঁর ইচ্ছা।” [16]
এমন কোন নাবী ছিলেন না যাদের কেউ অস্বীকার করেনি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), কিয়ামতের দিনে এমনও কিছু নাবীর উপস্থিতির কথা বলেছেন, “এবং একজন নাবী আসবে যার সাথে (উম্মাত) কেউ থাকবে না”।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এমনই কিছু দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য বর্ণনা করেছেনঃ
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا إِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ فَإِذَا هُمْ فَرِيقَانِ يَخْتَصِمُونَ
“আমি অবশ্যই সামুদ সম্প্রদায়ের নিকট তাহাদের ভ্রাতা সালিহকে পাঠিয়েছিলাম এই আদেশসহ, ‘তোমরা আল্লাহর ‘ইবাদত কর,’ কিন্তু তারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বিতর্কে লিপ্ত হল।” [17]
সুতরাং যখনই তিনি তাদেরকে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকলেন তখনই তারা দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে গেল এবং তাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হলো। এটি অব্যাহত থাকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বারা (নবুয়্যতের) সীলমোহর এঁটে দেয়া পর্যন্ত। তিনি আসার পর তাকে কেন্দ্র করে মানুষ মু’মিন ও কাফির এ বিভক্ত হয়, হাদীসে রয়েছে, “এবং মুহাম্মাদ হলো মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিকারী।” এই বিভক্তিই কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত বিরাজ করবে। যদিও আল্লাহর ইচ্ছাতেই মানুষ মু’মিন ও কাফির এ বিভক্ত হয় এবং এটিই ঘটবে; আমরা বিশ্বাস করি যে, প্রতিটি সৃষ্টি তার কর্মের জন্য জবাবদিহি করবে যা সে স্বয়ং করেছে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেনঃ
وَمَا تُجْزَوْنَ إِلا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
“এবং তোমরা যা কর তারই প্রতিফল পাবে।” [18]
আমরা এটাও বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ্ কারো প্রতি অবিচার করেন না। তিনি, সুবহানাহু ওয়া তা’আলা, বলেনঃ
إِنَّ اللَّهَ لا يَظْلِمُ النَّاسَ شَيْئًا وَلَكِنَّ النَّاسَ أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মানুষের প্রতি কোন যুলুম করেন না, বরং মানুষই নিজেদের প্রতি যুলুম করে থাকে।” [19]
হাদীস কুদসীতে পাওয়া যায়ঃ আল্লাহ্ বলেনঃ “হে আমার বান্দাগণ! আমি যুলুমকে আমার জন্য হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও এটি হারাম করেছি; সুতরাং তোমরা যুলুম কর না।” [20]
তৃতীয় অধ্যায়ঃ মু’মিন ও কাফিরের এই পৃথকীকরণের মাধ্যমেই তাদের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি হয়
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا إِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ فَإِذَا هُمْ فَرِيقَانِ يَخْتَصِمُونَ
“আমি অবশ্যই সামুদ সম্প্রদায়ের নিকট তাদের ভাই সালিহকে পাঠিয়েছিলাম এই আদেশসহঃ ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর’। কিন্তু তারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বিতর্কে লিপ্ত হলো।” [21]
هَذَانِ خَصْمَانِ اخْتَصَمُوا فِي رَبِّهِمْ
“এরা দুই বিবদমান পক্ষ, তারা তাদের রব সম্বন্ধে বিতর্ক করে…”[22]
إِنَّ الْكَافِرِينَ كَانُوا لَكُمْ عَدُوًّا مُبِينًا
“নিশ্চয়ই কাফেরগণ তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” [23]
আর এই শত্রুতার দ্বারা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা উভয় দলকেই পরীক্ষা করেন,
ذَلِكَ وَلَوْ يَشَاءُ اللَّهُ لانْتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَكِنْ لِيَبْلُوَ بَعْضَكُمْ بِبَعْضٍ
“ইহা এজন্য যে, আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে তাহাদেরকে শাস্তি দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি চান তোমাদের একজনকে অন্যের দ্বারা পরীক্ষা করতে।” [24]
তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ
“এবং আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব, যতক্ষণ না আমি প্রকাশ করি তোমাদের মধ্যে কারা মুজাহিদীন ও ধৈর্যশীল এবং আমি তোমাদের অবস্থা যাচাই করি।” [25]
সৃষ্টির পরীক্ষা নেয়া আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার একটি সুন্নাত এবং এ ব্যাপারে বহু আয়াত রয়েছে যা আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। এ ব্যাপারে হাদিসেও স্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায়। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলেছেনঃ “নিশ্চয় আমি তোমাকে পাঠিয়েছি শুধুমাত্র, তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য এবং তোমার সাথে অন্যান্যদের পরীক্ষা করার জন্য।” [26]। ইমাম আন নববী (রহিমাহুল্লাহ) তার ব্যাখ্যায় বলেছেন, “তাঁর (মহিমান্বিত তিনি) বাণীঃ
“নিশ্চয় আমি তোমাকে পাঠিয়েছি শুধুমাত্র, তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য এবং তোমার সাথে অন্যান্যদের পরীক্ষা করার জন্য।” এর অর্থ হলো, “আমি তোমাকে ঐসব বিষয়ে পরীক্ষা করব যা তোমাদের দ্বারা প্রকাশ হয়ে পড়ে; আমার প্রেরিত হুকুম বাস্তবায়নের মাধ্যমে যা আমি রিসালাতের দ্বারা পাঠিয়েছি এবং এছাড়া আল্লাহর জন্য জিহাদের মাধ্যমে যেমন জিহাদ তাঁর প্রাপ্য এবং আল্লাহ্ তা’আলার জন্য সবর করার মাধ্যমে অথবা অন্য কোন উপায়ে।”
আমি তোমার সাথে তাদের পরীক্ষা করব যাদের প্রতি তোমাকে পাঠানো হয়েছে। এরপর তাদের মধ্যে কিছু লোক হবে যাদের ঈমান প্রকাশিত হবে এবং তাদের ঈমান হবে একনিষ্ঠ আল্লাহ্ ও তাঁর আনুগত্যের প্রতি এবং কিছু (মানুষ) পেছনে পড়ে থাকবে এবং স্থায়ীভাবে শত্রুতা করবে এবং কুফরী করবে এবং কিছু (মানুষ) যারা মুনাফিকে পরিণত হবে।” সুতরাং এর অর্থ হলো আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাদের পরীক্ষা করবেন যাতে এটি যথার্থভাবে প্রকাশিত হয় যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বান্দাদের শুধুমাত্র ঐ জিনিসের জন্য শাস্তি দিবেন যা তাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে; তার ভিত্তিতে নয় যা সংঘটনের পূর্বেই তিনি অবহিত। আসলে তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সবকিছু সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অবগত, তাঁর আয়াতঃ
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ
“এবং আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব, যতক্ষণ না আমি প্রকাশ করি তোমাদের মধ্যে কারা মুজাহিদীন ও ধৈর্যশীল এবং আমি তোমাদের অবস্থা যাচাই করি।” [27]
অর্থাৎ আমি তাদেরকে চিনি যারা এটি করে এবং যাদের পরিচিতি এভাবে দেয়া হয়েছে।
চতুর্থ অধ্যায়ঃ আল্লাহ্, মহিমান্বিত তাঁর সত্তা, তাক্বদিরের মাধ্যমে মু’মিনদের ওপর কাফিরদেরকে শক্তিশালী করেন
মু’মিনদের সাথে শত্রুতা পোষণ ও যুদ্ধ করার ব্যাপারে কাফিরদেরকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা শারীয়াহর মাধ্যমে বা কোন নবীর যবান এর মাধ্যমে আদেশ পাঠাননি; এটি ‘তাকদীর দ্বারা নির্ধারিত’। তিনি বরং তাদেরকে আদেশ দিয়েছেন ইবাদত এবং আনুগত্যের। সুতরাং মু’মিনদের উপর কাফিরদের শক্তি অর্জন হলো ‘তাকদীর’ আর কাফিরদের উপর মু’মিনদের শক্তি অর্জন হলো ‘শরয়ী হুকুম’ এবং ‘তাকদীর’।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا مِنَ الْمُجْرِمِينَ
“আমি এভাবেই প্রত্যেক নবীর শত্রু করেছিলাম অপরাধীদের মধ্য থেকে।” [28]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ
“এইরূপে আমি মানুষ ও জ্বীনের মধ্যে শয়তানদেরকে নবীদের শত্রু করেছি।” [29]
তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا فِي كُلِّ قَرْيَةٍ أَكَابِرَ مُجْرِمِيهَا لِيَمْكُرُوا فِيهَا
“এইরূপে আমি প্রত্যেক জনপদে সেখানকার অপরাধী প্রধানদেরকে চক্রান্ত করার অবকাশ দিয়েছি।” [30]
উপরোক্ত তিনটি আয়াতেই আল্লাহ্, সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেনঃ
‘আমি … করেছি’ বা ‘আমি … দিয়েছি’ ….অর্থাৎ এগুলো তাকদীর দ্বারা নির্ধারিত।
যুগ, জাতি, নাবী রাসূল অনেক কিছু পাল্টালেও তাদের এই শত্রুতার ধরণ কখনোই পাল্টায়নি। আর একারণেই আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
مَا يُقَالُ لَكَ إِلا مَا قَدْ قِيلَ لِلرُّسُلِ مِنْ قَبْلِكَ
“তোমার সম্বন্ধে তো তাই বলা হয় যা বলা হত তোমার পূর্ববর্তী রাসূলগণ সম্পর্কে।” [31]
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
كَذَلِكَ مَا أَتَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ مِنْ رَسُولٍ إِلا قَالُوا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ
أَتَوَاصَوْا بِهِ بَلْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُونَ
“এভাবেই তাদের পূর্ববর্তীদের নিকট যখনই কোন রাসূল এসেছে তারা তাকে বলেছে, ‘তুমি তো এক যাদুকর না হয় উন্মাদ’। তারা কি একে অপরকে এই মন্ত্রণাই দিয়েছে (বংশানুক্রমে শিখিয়েছে)? বস্তুত তারা সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।” [32]
তাদের এই শত্রুতার রয়েছে নানান রূপ: অন্তরের কুফরী (তাকযিব); আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوا
“নিশ্চয় তোমার পূর্বে অনেক রাসূলকে মিথ্যাবাদী বলা হয়েছিল; কিন্তু তারা ধৈর্যধারণ করেন…”[33]
- ঠাট্টা (সুখরিয়াহ) এবং বিদ্রূপ (ইসতিহজা) করা; আল্লাহ্ তাবারাক ওয়া তা’আলা বলেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ أَجْرَمُوا كَانُوا مِنَ الَّذِينَ آَمَنُوا يَضْحَكُونَ
“যারা অপরাধী তারা তো মু’মিনদেরকে উপহাস করত।” [34]
- এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরও বলেনঃ
يَا حَسْرَةً عَلَى الْعِبَادِ مَا يَأْتِيهِمْ مِنْ رَسُولٍ إِلا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ
“পরিতাপ বান্দাদের জন্য; তাদের নিকট যখনই কোন রাসূল এসেছে তখনই তারা তাকে বিদ্রূপ করেছে।” [35]
- মু’মিনদেরকে পাগল (জুনুন) বলে অপবাদ দেয়া; আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
وَقَالُوا يَا أَيُّهَا الَّذِي نُزِّلَ عَلَيْهِ الذِّكْرُ إِنَّكَ لَمَجْنُونٌ
“তারা বলে, ‘ওহে যার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে! তুমি তো নিশ্চয় উন্মাদ।” [36]
- মু’মিনরা কর্তৃত্ব (হুকুম) ও ক্ষমতালোভী (রিয়াসাহ) বলে অপবাদ দেয়া, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
قَالُوا أَجِئْتَنَا لِتَلْفِتَنَا عَمَّا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آَبَاءَنَا وَتَكُونَ لَكُمَا الْكِبْرِيَاءُ فِي الْأَرْضِ
“তারা বলতে লাগলোঃ তুমি কি আমাদের নিকট এইজন্য এসেছ যে, আমাদেরকে সরিয়ে দাও সেই তরিকা থেকে, যাতে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের পেয়েছি, আর পৃথিবীতে তোমাদের দুইজনের আধিপত্য স্থাপিত হয়ে যায়?”[37]
- মু’মিনদের ধর্মত্যাগ ও বিশৃঙ্খলা (ফাসাদ) সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত করা, আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَقَالَ فِرْعَوْنُ ذَرُونِي أَقْتُلْ مُوسَى وَلْيَدْعُ رَبَّهُ إِنِّي أَخَافُ أَنْ يُبَدِّلَ دِينَكُمْ أَوْ أَنْ يُظْهِرَ فِي الْأَرْضِ الْفَسَادَ
“ফিরাউন বলল, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মূসাকে হত্যা করি এবং সে তার প্রতিপালকের শরণাপন্ন হোক। আমি আশংকা করি যে, সে তোমাদের দ্বীনের পরিবর্তন ঘটাবে অথবা সে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।” [38]
- মু’মিনদের দারিদ্র ও অসহায়ত্বের সুযোগে গালমন্দ করা, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
قَالُوا أَنُؤْمِنُ لَكَ وَاتَّبَعَكَ الْأَرْذَلُونَ
“তারা বললঃ আমরা কি তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব অথচ নিচু শ্রেণীর লোকেরা তোমার অনুসরণ করছে।” [39]
- তারা এটি করত যাতে অন্য মানুষেরা মু’মিনদের নিকটে না আসেঃ
قَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِلَّذِينَ آَمَنُوا أَيُّ الْفَرِيقَيْنِ خَيْرٌ مَقَامًا وَأَحْسَنُ نَدِيًّا
“…কাফিররা মু’মিনদের বলেঃ দু’দলের মধ্যে কোনটি মর্যাদায় শ্রেষ্ঠতর ও মজলিস হিসেবে কোনটি উত্তম।” [40]
- মু’মিনরা অভিশপ্ত এবং মু’মিনদের কারণে তাদের উপর গযব আসবে এমন অভিযোগঃ
قَالُوا إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ لَئِنْ لَمْ تَنْتَهُوا لَنَرْجُمَنَّكُمْ
“তারা বললঃ আমরা তোমাদেরকে অমঙ্গলের কারণ মনে করি এবং যদি তোমরা বিরত না হও তবে অবশ্যই তোমাদেরকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করব; …”[41]
- সত্য প্রত্যাখ্যান এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা যুক্তি প্রদর্শন; আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
وَيُجَادِلُ الَّذِينَ كَفَرُوا بِالْبَاطِلِ لِيُدْحِضُوا بِهِ الْحَقَّ وَاتَّخَذُوا آَيَاتِي وَمَا أُنْذِرُوا هُزُوًا
“… কিন্তু কাফিররা মিথ্যা অবলম্বনে বিতণ্ডা করে, এর দ্বারা সত্যকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য এবং আমার নিদর্শনাবলী ও যা দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে সেই সমস্তকে তারা বিদ্রূপের বিষয়বস্তুরূপে গ্রহণ করে থাকে।” [42]
এগুলোর মাঝে লুকিয়ে ছিল তাদের বিভ্রান্তিসমূহ যা দ্বারা তারা আল্লাহর পথে বাঁধা সৃষ্টি করত।
- সাধারণ মানুষকে মু’মিনদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
وَقَالَ الْمَلا الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَوْمِهِ لَئِنِ اتَّبَعْتُمْ شُعَيْبًا إِنَّكُمْ إِذًا لَخَاسِرُونَ
“তার সম্প্রদায়ের কাফির প্রধানরা বললঃ ‘তোমরা যদি শুআ’ইবকে অনুসরণ কর তবে তোমরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে’।” [43]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
إِنِّي أَخَافُ أَنْ يُبَدِّلَ دِينَكُمْ أَوْ أَنْ يُظْهِرَ فِي الْأَرْضِ الْفَسَادَ
“ফিরাউন বলল, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মূসাকে হত্যা করি এবং সে তার প্রতিপালকের শরণাপন্ন হোক। আমি আশংকা করি যে, সে তোমাদের দ্বীনের পরিবর্তন ঘটাবে অথবা সে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।” [44]
- মু’মিনরা মুষ্টিমেয় হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ জনগণের উপর তাদের মতবাদ চাপিয়ে দিচ্ছে এমন অভিযোগ উত্থাপন। এর উদাহরণস্বরূপ আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেনঃ
فَأَرْسَلَ فِرْعَوْنُ فِي الْمَدَائِنِ حَاشِرِينَ
إِنَّ هَؤُلاءِ لَشِرْذِمَةٌ قَلِيلُونَ
وَإِنَّهُمْ لَنَا لَغَائِظُونَ
وَإِنَّا لَجَمِيعٌ حَاذِرُونَ
“এরপর ফিরাউন শহরে শহরে লোক সংগ্রহকারী পাঠালো এই বলেঃ ‘ইহারা তো ক্ষুদ্র একটি দল। ইহারা তো আমাদের ক্রোধ উদ্রেক করেছে এবং আমরা তো সকলেই সদা শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সদা সতর্ক’।” [45]
- তারা দাবী করে যে, সত্য দ্বীনের ব্যাপারে তাদের অবস্থান মু’মিনদের চেয়ে উত্তম। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
قَالَ فِرْعَوْنُ مَا أُرِيكُمْ إِلا مَا أَرَى وَمَا أَهْدِيكُمْ إِلا سَبِيلَ الرَّشَادِ
“ফিরাউন বললঃ আমি যা বুঝি, আমি তোমাদেরকে তাই বলছি। আমি তোমাদেরকে কেবল সৎপথই দেখিয়ে থাকি।” [46]
তিনি, (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা), বলেনঃ
إِنْ هَذَانِ لَسَاحِرَانِ يُرِيدَانِ أَنْ يُخْرِجَاكُمْ مِنْ أَرْضِكُمْ بِسِحْرِهِمَا وَيَذْهَبَا بِطَرِيقَتِكُمُ الْمُثْلَى
“তারা বললঃ নিশ্চয় এরা দুইজন যাদুকর, তারা চায় তাদের যাদু দিয়ে তোমাদেরকে দেশ থেকে বের করতে এবং তোমাদের উৎকৃষ্ট জীবন ব্যবস্থা ধ্বংস করতে।” [47]
তিনি, (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা), বলেনঃ
فَلَمَّا جَاءَتْهُمْ رُسُلُهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَرِحُوا بِمَا عِنْدَهُمْ مِنَ الْعِلْمِ
“তাদের কাছে যখন স্পষ্ট নিদর্শনসহ তাদের রাসূল আসত তখন তারা নিজেদের জ্ঞানের দম্ভ করত।” [48]
- নানাবিধ চক্রান্ত ও পরিকল্পনা করে সাধারণ মানুষকে মু’মিনদের অনুসরণ থেকে বিরত রাখা।
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَقَالَ الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا لِلَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا بَلْ مَكْرُ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ إِذْ تَأْمُرُونَنَا أَنْ نَكْفُرَ بِاللَّهِ وَنَجْعَلَ لَهُ أَنْدَادًا وَأَسَرُّوا النَّدَامَةَ لَمَّا رَأَوُا الْعَذَابَ وَجَعَلْنَا الْأَغْلالَ فِي أَعْنَاقِ الَّذِينَ كَفَرُوا هَلْ يُجْزَوْنَ إِلا مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“যাদেরকে দুর্বল বলা হত তারা ক্ষমতাদর্পীদেরকে বলবেঃ ‘প্রকৃতপক্ষে তোমরাই তো দিবারাত্র চক্রান্তে লিপ্ত ছিলে, আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলে যেন আমরা আল্লাহকে অমান্য করি এবং তাঁর শরীক স্থাপন করি। যখন তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন তারা অনুতাপ গোপন রাখবে এবং আমি কাফিরদের গলায় শৃঙ্খল পরাব। তাদেরকে তারা যা করত তারই প্রতিফল দেয়া হবে।” [49]
- মু’মিনদেরকে সুবিধাবঞ্চিত করে দ্বীন থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
هُمُ الَّذِينَ يَقُولُونَ لا تُنْفِقُوا عَلَى مَنْ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ حَتَّى يَنْفَضُّوا وَلِلَّهِ خَزَائِنُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لا يَفْقَهُونَ
“তারা বলেঃ আল্লাহর রাসূলের সহচরদের জন্য ব্যয় কর না যতক্ষণ না তারা তার থেকে সরে পড়ে। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর ধনভান্ডার তো আল্লাহরই কিন্তু মুনাফিকরা তা বুঝে না।” [50]
- মু’মিনদেরকে নানাবিধ সমস্যায় ফেলে দ্বীন থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَدُّوا لَوْ تُدْهِنُ فَيُدْهِنُونَ
“তারা চায় তুমি নমনীয় হও; তাহলে তারাও নমনীয় হবে।” [51]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ
“…তাদের সম্পর্কে সতর্ক হও যাতে আল্লাহ্ যা তোমাদের প্রতি নাযিল করেছেন তা থেকে তারা তোমাকে বিচ্যুত করতে না পারে।” [52]
কাফিররা কখনো মু’মিনদের এমন আহবান করে না যাতে তারা সত্য থেকে কিছু সরে আসে। কিছু সময়ের জন্য এমনটি চাইলেও, তাদের পরিপূর্ণ তৃপ্তি ততক্ষণ পর্যন্ত আসে না যতক্ষণ না মু’মিনগণ সত্য থেকে পুরোপুরি সরে আসে। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَلَنْ تَرْضَى عَنْكَ الْيَهُودُ وَلا النَّصَارَى حَتَّى تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ
“ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা তোমার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর।” [53]
- মু’মিনরা যদি তাদের দ্বীন থেকে না সরে অথবা কাফিরদের সাহায্য সহযোগীতা না করে তবে তাদেরকে জেল ও মৃত্যুদন্ডের ভয় দেখানো। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِرُسُلِهِمْ لَنُخْرِجَنَّكُمْ مِنْ أَرْضِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا
“কাফিররা তাদের রাসূলগণকে বলেছিলঃ আমরা তোমাদেরকে অবশ্যই আমাদের দেশ থেকে বহিষ্কৃত করব।” [54]
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
إِنَّهُمْ إِنْ يَظْهَرُوا عَلَيْكُمْ يَرْجُمُوكُمْ أَوْ يُعِيدُوكُمْ فِي مِلَّتِهِمْ وَلَنْ تُفْلِحُوا إِذًا أَبَدًا
“তারা যদি তোমাদের ব্যাপারে জানতে পারে তাহলে তোমাদেরকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করবে অথবা তোমাদেরকে তাদের ধর্মে ফিরিয়ে নিবে এবং সেক্ষেত্রে তোমরা কখনোই সফলকাম হবে না।” [55]
- মু’মিনদের উপর অত্যাচার, হত্যা এবং সংঘাত চাপিয়ে দেয়া। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
قَالُوا حَرِّقُوهُ وَانْصُرُوا آَلِهَتَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ فَاعِلِينَ
“তারা বললঃ তাকে পুড়িয়ে দাও; সাহায্য কর তোমাদের দেবতাদেরকে…।” [56]
তিনি, (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা), বলেনঃ
وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِيُثْبِتُوكَ أَوْ يَقْتُلُوكَ أَوْ يُخْرِجُوكَ
“আর স্মরণ কর যখন কাফিররা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যে, তোমাকে বন্দী করবে অথবা হত্যা করবে অথবা নির্বাসিত করবে…”[57]
তিনি, (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা), বলেনঃ
وَلا يَزَالُونَ يُقَاتِلُونَكُمْ حَتَّى يَرُدُّوكُمْ عَنْ دِينِكُمْ إِنِ اسْتَطَاعُوا
“তারা সর্বদা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে যে পর্যন্ত না তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দেয়।” [58]
তাই মু’মিন ভাইদের উদ্দেশ্যে বলছি, কাফিরদের শত্রুতা ও বিরোধিতার কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে যা কখনো বদলাবে না।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
أَتَوَاصَوْا بِهِ
“তারা কি একে অপরকে এই মন্ত্রণাই দিয়েছে (বংশানুক্রমে শিখিয়েছে)?”[59]
আর সবচেয়ে বড় কথা হলো মু’মিনদের ঈমানের কারণেই কাফিররা মু’মিনদের সাথে যুদ্ধ করে এবং শত্রুতা পোষণ করে।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَهُمْ عَلَى مَا يَفْعَلُونَ بِالْمُؤْمِنِينَ شُهُودٌ
وَمَا نَقَمُوا مِنْهُمْ إِلا أَنْ يُؤْمِنُوا بِاللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ
“তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধু এই কারণে যে তারা বিশ্বাস করত পরাক্রমশালী ও প্রশংসার্হ আল্লাহতে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যার সর্বময় কর্তৃত্ব; আর আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বদ্রষ্টা।” [60]
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَدُّوا لَوْ تَكْفُرُونَ كَمَا كَفَرُوا فَتَكُونُونَ سَوَاءً
“তারা এটাই কামনা করে যে, তারা যেমন কুফরী করেছে তোমরা সেরকম কুফরী কর; যাতে তোমরা তাদের সমান হয়ে যাও।” [61]
সুতরাং কাফিরগণ মু’মিনগণকে শত্রু হিসেবে নেয় তাদের ঈমানের জন্য। একজন মুমিনের ঈমান যত বৃদ্ধি পায় তাঁর প্রতি কাফিরদের শত্রুতা ততই বৃদ্ধি পায়। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “সবচাইতে বেশী পরীক্ষা করা হয় নাবীদেরকে, এরপর তাদের নিকটবর্তীদেরকে (ঈমানের স্তর ভেদে), তারপর তাদের নিকটবর্তীদেরকে (ঈমানের স্তর ভেদে) মানুষ তার ঈমানের অনুযায়ী পরীক্ষিত হবে…”।[62]
আর এটি বান্দা নিজেও বুঝতে পারে যে, তার ঈমান বৃদ্ধির সাথে সাথে তার প্রতি কাফির ও ফাসিকদের শত্রুতাও বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং সে তাদেরকে ভালো কাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজে নিষেধ করে, এতে শত্রুতা আরো বৃদ্ধি পায়। আর তার ঈমান যত হ্রাস পায় তাদের শত্রুতাও ততই হ্রাস পায়।
তবে মু’মিনরা যতদিন ঈমানের উপর থাকবে তাদের প্রতি কাফিরদের শত্রুতা ততদিন পর্যন্ত শেষ হবে না; যদিও এতে কিছু থাকে তবুও। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَلَنْ تَرْضَى عَنْكَ الْيَهُودُ وَلا النَّصَارَى حَتَّى تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ
“ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা তোমার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর।” [63]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَلا يَزَالُونَ يُقَاتِلُونَكُمْ حَتَّى يَرُدُّوكُمْ عَنْ دِينِكُمْ إِنِ اسْتَطَاعُوا
“তারা সর্বদা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে যে পর্যন্ত না তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দেয়।” [64]
পঞ্চম অধ্যায়ঃ আর আল্লাহ্ (সুমহান তাঁর মর্যাদা) তাঁর কিতাবে ঈমানদারদের হুকুম করেছেন যেন সেইসব কাফিরদের নির্মূল করা হয়, যারা আল্লাহরই ইচ্ছায় মু’মিনদের উপর ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছে
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَلَوْلا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ
“আল্লাহ্ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তাহলে বিধ্বস্ত হয়ে যেত খ্রিষ্টান সংসার বিরাগীদের উপাসনা স্থল (গির্জা), ইয়াহুদীদের উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ যাতে অধিক ম্মরণ করা হয় আল্লাহর নাম। আল্লাহ্ নিশ্চয় তাকে সাহায্য করেন যে তাঁকে সাহায্য করে; আল্লাহ্ নিশ্চয় শক্তিমান, পরাক্রমশালী।” [65]
মু’মিনদের দ্বারা কাফিরদের নির্মূল করার কার্যক্রমে কয়েকটি স্তর রয়েছে
প্রথম স্তরঃ ইসলামের দাওয়াত দেয়া
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَقُلْ لِلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوْا
“এবং যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে ও যারা নিরক্ষর তাদেরকে বলঃ ‘তোমারও কি আত্মসমর্পণ করেছো?’ যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তবে নিশ্চয় তারা সুপথ পেয়ে যাবে।” [66]
আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুআয (রদিয়াল্লাহু আনহু)-কে ইয়েমেন যাবার প্রাক্কালে বলেছিলেনঃ “নিশ্চয় তোমাকে এমন কওমের কাছে পাঠানো হচ্ছে যারা আহলে কিতাবের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তুমি তাদেরকে প্রথম যে জিনিসের দিকে ডাকবে সেটা হবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর শাহাদাহ।”
আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এই বাণীকে যদি আমরা সার্বজনীনরূপে গ্রহণ করি তবে একথা বলা যায় যে, সম্পূর্ণ সৃষ্টি এই দাওয়া এর মাধ্যমেই দু’টি বিভাগে বিভক্ত হয়েছে – কাফির ও মু’মিন। আর একারণেই মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে হাদীসে বলা হয়েছে ‘আর মুহাম্মাদ হলো মানুষের মধ্যে বিভাজনকারী [67] দাওয়া এর পর মু’মিন ও কাফিরদের সম্পর্ক নতুন মোড় নেয়। আর তা হলোঃ
দ্বিতীয় স্তরঃ মৃত অথবা জীবিত কাফিরদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা
এই বারা’আ বা সম্পর্কচ্ছেদ মানে হলো জীবিত কাফিরদের প্রতি এবং তাদের কুফরের প্রতি প্রকাশ্য শত্রুতা ও ঘৃণা পোষণ করা তাদের ধ্যান-ধারণার অনুসরণ না করা এবং তাদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা, তাদের সাথে মেলামেশা না করা। এ ব্যাপারে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, ইনশাআল্লাহ্। আ র মৃত কাফিরদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের মানে হলো তা দের জন্য ক্ষমা চাওয়া থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ
مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ
“আত্মীয়স্বজন হলেও নাবী ও অন্যান্য মু’মিনদের জন্য জায়েয নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে,এটা প্রকাশ হওয়ার পর যে তারা জাহান্নামের অধিবাসী।” [68]
এছাড়াও কোন মৃত কাফিরকে মুসলিমদের মাঝে কবর না দেয়া। তাদেরকে উত্তরাধিকার দেয়াও যাবে না আর তাদের থেকে উত্তরাধিকার নেয়াও যাবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “মুসলিম কোন কাফির থেকে উত্তরাধিকার পায় না এবং কাফির কোন মুসলিমের উত্তরাধিকার পায় না।” [69]
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ
“তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ; তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিলঃ তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর তার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের মানি না, তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হলো শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য, যদি না তোমরা এক আল্লাহর উপর ঈমান আন।” [70]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরো বলেনঃ
ثُمَّ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ أَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا
“অতঃপর আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, তুমি একনিষ্ঠ ইব্রাহীমের মিল্লাত অনুসরণ কর এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।” [71]
সুতরাং আত্মীয়তার কারণে বারা’আ বন্ধ হতে পারে না; কারণ ইব্রাহীম (আঃ) তার কওমের সাথে বারা’আ করেছেন, যখন তারা তাদের কওমকে বললেন উপরোক্ত কথাগুলো। শেখ হামাদ বিন আতিক আন নাজদী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ “আর এখানে একটি চমৎকার লক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, তার বক্তব্য – “নিশ্চয় তোমাদের সঙ্গে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ইবাদত কর তাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।” লক্ষণীয় বিষয়টি এই যে, আল্লাহ্ কাফিরদের উপাস্যদের সাথে বারা’আর কথা বলার আগে কাফিরদের সাথে বারা’আ করার কথা বলেছেন। কারণ, প্রথমটি (কাফিরদের সাথে বারা’আ) দ্বিতীয়টির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সে তার উপর আসা হুকুমকে মানতে ব্যর্থ হতো যদি সে শুধুমাত্র কাফিরদের উপাস্য সমূহের সাথে বারা’আ করতো আর কাফিরদের সাথে বারাআ করা থেকে বিরত থাকতো। উপরন্তু, মুশরিকদের সাথে তার কৃত বারাআ স্বাভাবিক ভাবেই তাদের উপাস্য সমূহের সাথে বারাআর পথ খুলে দেয়। আর এভাবেই আল্লাহ্ তাঁর বাণীতে বলেনঃ
وَأَعْتَزِلُكُمْ وَمَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَأَدْعُو رَبِّي عَسَى أَلا أَكُونَ بِدُعَاءِ رَبِّي شَقِيًّا
“আর আমি তোমাদের থেকে এবং তোমরা আল্লাহ্ ব্যতীত যাদের ইবাদত কর তাদের নিকট থেকে পৃথক হচ্ছি, আর আমি তো আমার রবেরই নিকট আহবান করতে থাকব; আশা করি আমার রবের নিকট আহবান করে আমি ব্যর্থকাম হবো না।” [72]
সুতরাং তিনি কাফিরদের থেকে পৃথক হওয়াকে তাদের উপাস্য সমূহ থেকে পৃথক হওয়ার পূর্বে স্থান দিয়েছেন, পরবর্তী আয়াতে তিনি বলেছেন,
فَلَمَّا اعْتَزَلَهُمْ وَمَا يَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَكُلًّا جَعَلْنَا نَبِيًّا
“অতঃপর সে যখন তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহ্ ছাড়া যাদের ইবাদত করে সেসব হতে পৃথক হয়ে গেলো তখন …”[73]
এছাড়াও আল্লাহ্ বলেনঃ
وَإِذِ اعْتَزَلْتُمُوهُمْ وَمَا يَعْبُدُونَ إِلا اللَّهَ
“তোমরা যখন বিচ্ছিন্ন হলে তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করে তাদের থেকে…”[74]
এ পুরো বিষয়টি তোমার জন্য একটি কারণ, যেটি আল্লাহর শত্রুদের সাথে তোমার শত্রুতার দরজা খুলে দেয়। অনেক মানুষ শিরকে পতিত না হওয়া সত্ত্বেও তারা মুশরিকদের সাথে শত্রুতাও করে না? তারা এইভাবে মুসলিম হতে পারবে না, কারণ তারা সকল নাবীর দ্বীনকে ত্যাগ করেছে।
এরপর তিনি (শাইখ) বলেনঃ আল্লাহ্ বলেছেনঃ
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ
“আমরা তোমাদের মানি না, তোমাদের ও আমাদের মধ্যে প্রকাশ হয়ে পড়েছে শত্রুতা ও ঘৃণা চিরকালের জন্য, যতদিন না তোমরা এক আল্লাহর উপর ঈমান আন।” [75]
এখানে প্রকাশ হয়ে পড়া বলতে স্পষ্ট ও প্রকাশ্য হওয়া বোঝানো হয়েছে। আরো চিন্তা করে দেখুন যে, শত্রুতাকে ঘৃণার পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা এটি বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একজন মানুষ মুশরিকদের ঘৃণা করতে পারে কিন্তু তার সাথে শত্রুতা নাও করতে পারে- তবে এক্ষেত্রে সে ততক্ষণ পর্যন্ত হুকুম পালনে ব্যর্থ, যতক্ষণ না সে একই সাথে শত্রুতা ও ঘৃণা পোষণ করে। সেই সাথে এই শত্রুতা ও ঘৃণা প্রকাশ্য হওয়াও আবশ্যক। আর এটাও জেনে রাখুন যে, যদি ঘৃণা অন্তরের মাঝে বদ্ধমূল হয় তারপরও এর কল্যাণ লাভ সম্ভব নয় যতক্ষণ না এর স্বরূপ প্রকাশ করা হয়, আর তার লক্ষণসমূহ স্পষ্ট হয়, আর এটি কখনও সম্ভব হবে না যদি শত্রুতা ও ঘৃণা একসাথে না থাকে। তখনই কেবল শত্রুতা ও ঘৃণা স্পষ্টত প্রকাশ হয়ে পড়বে। কিন্তু এর বদলে যদি আনুগত্য ও অনুসরণ থাকে, তবে তা ঘৃণার অনুপস্থিতিকেই প্রমাণ করবে। এ বিষয়ে ভেবে দেখার দায়িত্ব আপনার, কেননা এটি আপনার অনেক সন্দেহ দূর করবে।” [76]
আমার বক্তব্য হলোঃ আপনারা এ বিষয়গুলো নিয়ে ভেবে দেখুন আর সেইসব মুসলিমের অবস্থা চিন্তা করুন যারা বর্তমান সময়ে হক আর বাতিলের পার্থক্য দেখতে পায় না। আপনি তাদেরকে মুসলিম দাবী করতে দেখবেন, আবার পরক্ষণেই তারা কুফর ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে কথা বলবে, যেমনঃ কমিউনিজম, গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ সে তাদের থেকে এবং তাদের অনুসারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য যারা প্রকাশ্যে এসব কুফরের ঘোষণা দিয়ে থাকে। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ وَلَكِنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ فَاسِقُونَ
“আর তারা যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতো এবং নাবীর প্রতি [মুসা (আঃ)] এবং ঐ কিতাবের (তাওরাত) প্রতি যা তার নিকট প্রেরিত হয়েছিল, তবে তাদেরকে (মুশরিকদের) কখনও বন্ধুরূপে গ্রহণ করতো না, কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোকই নাফরমান।” [77]
তৃতীয় স্তরঃ পৃথক হওয়া ও হিজরত করা
কাফিরদের দাও’য়াহ দেবার পর তাদের থেকে পৃথক হওয়া এবং হিজরত করা আবশ্যক হয়ে পড়ে, যদি তা সম্ভব হয়। একাদশ অধ্যায়ে এ ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَإِذِ اعْتَزَلْتُمُوهُمْ وَمَا يَعْبُدُونَ إِلا اللَّهَ
“তোমরা যখন বিচ্ছিন্ন হলে তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের উপাসনা করে তাদের থেকে…”[78]
তিনি আরো বলেনঃ
وَأَعْتَزِلُكُمْ وَمَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَأَدْعُو رَبِّي
“আর আমি তোমাদের থেকে এবং তোমরা আল্লাহ্ ব্যতীত যাদের ইবাদত কর তাদের নিকট থেকে পৃথক হচ্ছি। আর আমি আল্লাহকে আহবান করি।” [79]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “সেইসব মুসলিমদের কারো সাথে আমার সম্পর্ক নেই যারা মুশরিকদের ভেতরে অবস্থান করে।” [80]
চতুর্থ স্তর: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা
এটা তার ক্ষেত্রে যে অনমনীয় এবং ইসলামের দাওয়া গ্রহণে অনিচ্ছুক। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ
“অতঃপর মুশরিকদের হত্যা কর যেখানে তাদের পাও….।” [81]
আর হাদিসে আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “আমি তোমাকে পাঠিয়েছি শুধুমাত্র তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য এবং তোমার দ্বারা অন্যদেরকেও পরীক্ষা করার জন্য…”এরপর তিনি বলেনঃ “…তাদেরকে বহিষ্কার করুন যেভাবে তারা আপনাকে বহিষ্কার করেছিল। (তাদের বিরূদ্ধে) যুদ্ধ করুন, আমি আপনাকে সাহায্য করব এবং ব্যয় করুন (আল্লাহর পথে), আমিও আপনার জন্য ব্যয় করা হবে। আর সেনাবাহিনী পাঠান, আমিও অনুরূপ পাঁচটি (বাহিনী) প্রেরণ করবো। এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে যুদ্ধ করুন যারা আপনার আনুগত্য করেছে, তাদের বিরূদ্ধে যারা আপনার বিরুদ্ধাচরণ করেছে।” [82]
আর একারণেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আমি মানুষের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ আর তারা সালাত কায়েম করে এবং দরিদ্রের পাওনা পরিশোধ করে (যাকাত), অতঃপর তারা যদি এটি করে, তাহলে তারা তাদের রক্ত ও তাদের সম্পদ আমার থেকে নিরাপদ করলো; তবে ইসলামের (শরিয়াতের) হক ব্যতীত, তাদের হিসাব আল্লাহ্ তা’আলার সাথে।” [83]
এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো, তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমগ্র মানবজাতির বিরূদ্ধে যুদ্ধ করার হুকুম দেয়া হয়েছে; কেননা তিনি সার্বজনীনভাবে সকল সৃষ্টির জন্য প্রেরিত হয়েছেন।
নূহ (আঃ) এর সময় থেকে মুসা (আঃ) এর সময় পর্যন্ত আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ও তাঁর রাসূলগণ কাফিরদের ধ্বংস করার দায়িত্ব নিতেন। বনী ইসরাঈলদেরকে মুক্তিদান ও ফিরাঊনকে ধ্বংস করার পর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মূসা (আঃ) এর শরীয়াহ-য় জিহাদের হুকুম নাযিল করেন। তিনি আদেশ করেনঃ
يَا قَوْمِ ادْخُلُوا الْأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ
“হে আমার জাতি; পবিত্র নগরীতে প্রবেশ কর…”[84]
এরপর তিনি বলেনঃ
فَاذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلا
“তারা বললোঃ আপনি ও আপনার রব যান এবং উভয়ে যুদ্ধ করুন…”[85]
এটাই ছিল প্রথম জিহাদের হুকুম নাযিল হওয়ার ঘটনা। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَلَقَدْ آَتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ مِنْ بَعْدِ مَا أَهْلَكْنَا الْقُرُونَ الْأُولَى
“আমি তো পূর্ববর্তীর বহু মানবগোষ্ঠীকে বিনাশ করার পর মূসা (আঃ) কে কিতাব দিয়েছিলাম…।” [86]
ইবনে কাসীর (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ “আল্লাহর আয়াত ‘পূর্ববর্তীর বহু মানবগোষ্ঠীকে বিনাশ করার পর…’ এর অর্থ হলো বিধান নাযিল হবার পর আর কোন জাতিকে তিনি সর্বব্যাপী শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করেননি। বরং তিনি মু’মিনদের যুদ্ধ করতে দিয়েছেন, মুশরিকদের মধ্যে হতে তাঁর শত্রুদের বিরূদ্ধে। তিনি বলেনঃ
وَجَاءَ فِرْعَوْنُ وَمَنْ قَبْلَهُ وَالْمُؤْتَفِكَاتُ بِالْخَاطِئَةِ
فَعَصَوْا رَسُولَ رَبِّهِمْ فَأَخَذَهُمْ أَخْذَةً رَابِيَةً
“আর ফিরাঊন ও তার পূর্ববর্তীরা এবং উল্টে যাওয়া বস্তীর অধিবাসীরা (লুত সম্প্রদায়) পাপাচারে লিপ্ত ছিল। তারা তাদের রবের প্রেরিত রাসূলকে অমান্য করেছিল, ফলে তিনি তাদেরকে শাস্তি দিলেন, কঠিন শাস্তি।” [87]
আল কুরতুবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ “আল্লাহর আয়াত, ‘এর দরুন সত্য অঙ্গীকার করা হয়েছে, তাওরাতে, ইঞ্জিলে এবং কুরআনে’ [88] এর মাঝে আল্লাহ্ তা’আলা তথ্য দিয়েছেন যে, এটি (জিহাদ) পূর্বের কিতাবগুলোতেও ছিল; আর এই জিহাদ ও শত্রুদের বিরূদ্ধে প্রতিরোধ-এসবের শুরু হয় মূসা (আঃ) এর পর থেকে।” [89]
এই জিহাদ হতে পারে জান, মাল অথবা বাক্যের দ্বারা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের নাফস দ্বারা মুশরিকদের বিরূদ্ধে জিহাদ কর।” [90]
জিহাদ দুই প্রকারের হতে পারেঃ
- জিহাদ আত তালাব, যখন শত্রুকে তারই দেশে আক্রমণ করা হয়
- জিহাদ আদ দিফা’য় যখন নিজ দেশে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা হয়।
জিহাদ অবস্থা ভেদে ‘ফরযে আইন’ অথবা ‘ফরযে কিফায়া’ হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। জিহাদের মাধ্যমে সবসময় মুসলিমদের মাঝে পার্থক্য সূচিত হয়। সত্যিকার মু’মিন এবং বিশ্বাসঘাতক ভীরু মুনাফিক এই দুইভাগে তারা ভাগ হয়ে যায়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَمَا أَصَابَكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ فَبِإِذْنِ اللَّهِ وَلِيَعْلَمَ الْمُؤْمِنِينَ
“এ দু’দলের সম্মুখীন হওয়ার দিবস যা তোমাদের উপর উপনীত হয়েছিল, তা আল্লাহরই ইচ্ছাক্রমে এবং এর দ্বারা আল্লাহ্ ঈমানদারদের বাস্তবে জেনে নেন।” [91]
এরপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
مَا كَانَ اللَّهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ حَتَّى يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلَى الْغَيْبِ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَجْتَبِي مِنْ رُسُلِهِ مَنْ يَشَاءُ فَآَمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَإِنْ تُؤْمِنُوا وَتَتَّقُوا فَلَكُمْ أَجْرٌ عَظِيمٌ
“অসৎকে সৎ হতে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় আছ, আল্লাহ্ মু’মিনগণকে সে অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না।” [92]
এ বিষয়টি কখনও পরিবর্তন হবে না। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেছেন, মুসলিম বাহিনী এভাবেই বিভক্ত হয়েছিল যখন তাঁতার শত্রুরা আশ্-শামের দিকে এগিয়ে আসে। এটি তিনি বহুস্থানেই উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এ বিষয়টির প্রতি সকলের দৃষ্টি দেয়া উচিৎ, কারণ এরূপ অবস্থায় মুনাফিকদের ব্যাপারে মুসলিমদের সাবধান হতে হবে।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ
هُمُ الْعَدُوُّ فَاحْذَرْهُمْ
“তারাই শত্রু, অতএব তাদের সম্পর্কে সতর্ক হও।” [93]
মুনাফিকরা যাতে মুসলিম বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। আল্লাহ্ বলেনঃ
لَوْ خَرَجُوا فِيكُمْ مَا زَادُوكُمْ إِلا خَبَالًا وَلاوْضَعُوا خِلالَكُمْ يَبْغُونَكُمُ الْفِتْنَةَ وَفِيكُمْ سَمَّاعُونَ لَهُمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ
“যদি তারা তোমাদের সাথে বের হতো, তবে দ্বিগুণ বিভ্রাট সৃষ্টি করা ব্যতীত আর কি হতো? তারা তোমাদের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে দৌড়াদৌড়ি করে ফিরতো, আর তোমাদের মধ্যে তাদের কতিপয় গুপ্তচর বিদ্যমান রয়েছে। আল্লাহ্ এই যালিমদের ব্যাপারে খুব অবগত আছেন।” [94]
ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ জিহাদ দুই প্রকারেরঃ ‘জিহাদ আত-তালাব’ এবং ‘জিহাদ আদ-দিফা’য়’
যখন শত্রুকে তাঁড়া করে তাদেরই দেশে তাদের সাথে যুদ্ধ করা হয় তখন সেই জিহাদকে বলা হয় ‘জিহাদ আত-তালাব’। ‘জিহাদ আদ-দিফা’য়’ হলো সেই জিহাদ যেখানে শত্রুরা আগে মুসলিমদের আক্রমণ করেছে।
জিহাদ আত-তালাবের দলিল সমূহ:
আল্লাহ্ তা’আলার বাণীঃ
فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“…মুশরিকদের যেখানে পাবে হত্যা করবে, তাদের বন্দী করবে, অবরোধ করবে এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওঁৎ পেতে থাকবে। কিন্তু তারা যদি তওবা করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয় তবে তাদের পথ ছেড়ে দেবে; নিশ্চয় আল্লাহ্ অতিশয় ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।” [95]
তিনি আরও বলেনঃ
قَاتِلُوا الَّذِينَ لا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلا بِالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَلا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ
“যাদের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে না আল্লাহর উপর এবং শেষ দিনের উপর এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম গণ্য করে না এবং সত্য দ্বীন অনুসরণ করে না; তাদের সাথে যুদ্ধ করবে, যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে স্বহস্তে জিযিয়া দেয়।” [96]
মহিমাময় ও সুমহান আল্লাহ্ (আল হাক্ক) তাদের খুঁজে খুঁজে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে বলেছেনঃ তাদেরকে অবরোধ করতে বলেছেন। আর এই আয়াতগুলো জিহাদের আয়াতসমূহের সবচেয়ে স্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত। আর এগুলো ‘মানসুখ’ (বাতিল) করা হয়নি। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর সাহাবাগণ এবং তাদের পরবর্তীগণ এই আয়াতসমূহ অনুসরণ করেছেন যতক্ষণ না আল্লাহ্ এই দুনিয়ার পূর্ব ও পশ্চিম তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “আমি ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের সাথে সংগ্রাম (ক্বিতাল) করতে আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয়,’লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাল্লাহ’ এবং সালাত কায়েম করে এবং গরীবদের পাওনা দিয়ে দেয় (যাকাত) অতঃপর তারা যদি এটি করে, তবে তারা তাদের রক্ত ও সম্পদ আমার থেকে নিরাপদ করে নিল; ইসলামের (শারীয়াহ এর) দাবী ব্যতীত যা আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) থেকে নির্ধারিত। আর তাদের হিসাব সুমহান আল্লাহর সাথে।” [97]
মুসলিমে বর্ণিত বুরাইদা (রদিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীস, “রাসূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখনই কোন বাহিনী বা প্লাটুনের (বাহিনীর অংশ) জন্য একজন আমীর নিয়োগ করতেন, তিনি তাকে একান্তভাবে উপদেশ দিতেন, আল্লাহকে ভয় করার এবং তার অন্যান্য মুসলিমদের মধ্য থেকে যারা থাকতো তাদেরকে উত্তম (উপদেশ) দিতেনঃ তাদের সাথে যুদ্ধ কর যারা আল্লাহকে অস্বীকার করেছে। যুদ্ধ কর কিন্তু (গণীমত) আত্মসাৎ করো না। আর বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং মুশরিকদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করো না (লাশ বিকৃতকরণ) এবং শিশুদের হত্যা করো না। আর তোমরা যদি মুশরিকদের মধ্য থেকে তোমাদের শত্রুদের মুখোমুখি হও, তবে তাদের তিনটি বিষয়ের দিকে ডাকবে….।” এসব দলীল স্পষ্টভাবে সেই জিহাদের কথা বলে যেখানে শত্রুর উদ্দেশ্যে বের হয়ে তার দেশে তার সাথে যুদ্ধ করা হয়। আর এটাই হলো ‘জিহাদ আত-তালাব’।
জিহাদ আদ-দিফা’য়র দলীলসমূহঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا زَحْفًا فَلا تُوَلُّوهُمُ الْأَدْبَارَ
“হে মু’মিনগণ! তোমরা যখন যুদ্ধ ক্ষেত্রে কাফির বাহিনীর সম্মুখীন হবে তখন তোমরা তাদের পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে না।” [98]
আল্লাহ্ বলেনঃ
وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ
“যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরাও তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর..।” [99]
তিনি আরো বলেনঃ
فَمَنِ اعْتَدَى عَلَيْكُمْ
“যে কেউ তোমাদের আক্রমণ করবে তোমরাও তাকে অনুরূপ আক্রমণ করবে।” [100]
এখানে সেই জিহাদের কথা বলা হয় যেখানে সীমালংঘনকারী শত্রুকে আক্রমণ করা হয়- যে আগে (মুসলিমদের) আক্রমণ করে। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ “আত্মরক্ষার জন্য জিহাদ এটি হলো সবচেয়ে জরুরী যাতে আগ্রাসনকারীকে পবিত্র স্থান ও দ্বীন থেকে হটিয়ে দেয়া হয়। আর ইজমা অনুযায়ী এটি ওয়াজিব। ঈমান আনার পর সবচেয়ে বড় ওয়াজিব হলো- আগ্রাসী শত্রু যে এই দ্বীন ও জীবনকে কলুষিত করে তাকে প্রতিহত করা। এক্ষেত্রে কোন শর্ত নেই। বরং একে যেকোন উপায়ে প্রতিহত করতে হবে।” [101]
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে আমি যা বলতে চাই তা আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে কেউ যদি বলে ‘জিহাদ আত তালাব’ ইসলামের অন্তর্ভুক্ত নয়, তবে সে উপরে উল্লেখিত আয়াত ও হাদীসসমূহ অস্বীকার করলো। আর আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَمَا يَجْحَدُ بِآَيَاتِنَا إِلا الْكَافِرُونَ
“….কাফির ব্যতীত আর কেউই আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করে না।” [102]
আর যে কেউ অন্যায়ভাবে এই অপব্যাখ্যা দেয় যে,’জিহাদ আত-তালাব হলো আগ্রাসন দমনের জন্য তবে সে বিভ্রান্তিতে অনেক দূর পৌঁছে গেছে, সে এসব আয়াত সম্পর্কে জেনে বুঝে এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং অন্যায়ভাবে এর অপব্যাখ্যা দেয়। এমন মানুষ সালাফ আস সালিহীনের সময়েও ছিল।
একটি ভ্রান্ত ধারণা
‘জিহাদ আত তালাব’-কে অস্বীকার করার জন্য কেউ কেউ আল্লাহর আয়াত ব্যবহার করে থাকে-
وَإِنْ جَنَحُوا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا
“তারা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে তুমিও সন্ধির দিকে ঝুঁকবে…।” [103]
তাদের মতে, যতক্ষণ পর্যন্ত কাফিররা মুসলিমদের সাথে শান্তি বজায় রাখবে ততক্ষণ কোন জিহাদ নেই। এর দলীল হিসেবে তারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণী ব্যবহার করে থাকে, “শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করো না….।” [104]
এটা তাদেরই অবস্থা যারা কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস করে আর কিছু অংশ অবিশ্বাস করে। তারা একটি দলীল গ্রহণ আর অন্য দলীল গুলো এড়িয়ে যায়। তাদের জবাব আমি কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছিঃ
প্রথমতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আর তার সাহাবাগণ (রদিয়াল্লাহু আনহু); যারা ছিলেন এই উম্মতের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ; তারা কখনো এ বিষয়টি সেভাবে দেখেননি যেভাবে তারা (বিভ্রান্তের দল) বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করছে। তারা বলতে চায় ‘জিহাদ আত-তালাব’ ইসলামের অন্তর্ভুক্ত নয়; অথচ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরবদের বিরুদ্ধে জেহাদ শেষে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তাবুকের দিকে যাত্রা করেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ১৯টি জিহাদে অংশ গ্রহণ করেন আর তার মাঝে ৮টিতে স্বয়ং অংশ নেন, আর যেসব বাহিনী বা প্রতিনিধি দলে তিনি নিজে অংশ নেননি তার সংখ্যা ৩৬[105], কেউ কেউ বলেন এ সংখ্যা আরো বেশী। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওফাতের পর তার সাহাবাগণ যুদ্ধ করেন পারস্য, রোমান, তুর্কী, মিশরীয়, বর্বর এবং আরো অনেকের সাথে। সুতরাং যারা ঐ আয়াত দ্বারা জিহাদ আত-তালাবকে অস্বীকার করতে চান তাদেরকে আমরা বলতে চাইঃ “তোমরা যা বুঝতে পেরেছ, তা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আর তার সাহাবাগণও বুঝেছিলেন নাকি বুঝেন নি?” তারা যদি স্বীকার করে যে তারা (সাহাবাগণ) এভাবে বুঝেন নি, তাহলে বলতে হয়ঃ
“তোমরা এমন কিছু বুঝে ফেলেছ যা তাঁরা বুঝেননি; সুতরাং তোমরা নিজে থেকেই বিভ্রান্তিমূলক এই ব্যাখ্যা সৃষ্টি করেছ যা আমাদের দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়।” কারণ, এই দ্বীন তো পরিপূর্ণতা লাভ করেছেঃ
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ
“…আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম….।” [106]
আর তোমাদের এই ব্যাখ্যা অসমর্থিত এবং বর্জনীয়, “কেউ যদি এমন কোন কাজ করে, যা আমাদের কার্যাবলীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তাহলে তা বর্জন করা হবে।”[107] আর এই ভ্রান্ত ধারণা দ্বারা তোমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আর তার সাহাবাগণের পথ থেকে সরে গিয়েছ।” আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
“কারো নিকট সত্য পথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দিব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করবো, আর উহা কত মন্দ আবাস।” [108]
আর যদি তারা বলতে চায় যে সাহাবাগণও বিষয়টি এভাবেই বুঝেছিলেন যেমনটি তারা বুঝেছে। তাহলে আমরা বলবোঃ
“তাদের (সাহাবাদের) ইতিহাস এই ধারণার বিরুদ্ধে যায়। সুতরাং হয় এটি (ভ্রান্ত ব্যাখ্যাটি) সত্য আর তারা এর বিরুদ্ধে গেছেন – যা কেউ বলার সাহস করবে না একমাত্র ‘জিনদিগ’ ছাড়া – অথবা এটি মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিমূলক, সুতরাং এটি তাদের (সাহাবাদের) বুঝ ছিল না আর তারা এমনটি আসলেও করেননি।”
দ্বিতীয়তঃ
وَإِنْ جَنَحُوا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا
“তারা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে তুমিও সন্ধির দিকে ঝুঁকবে…।” [109]
সুরা আনফালের ৬১নং আয়াতটির প্রকৃত ব্যাখ্যা তাদের বক্তব্যের বিরুদ্ধে যায়। এ ব্যাপারে দশম অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
তৃতীয়তঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস, “শত্রুর মুখোমুখি হবার আকাঙ্ক্ষা করো না..”যার পরিপূর্ণ বর্ণনা এখানে তুলে ধরা হলো।
আব্দুল্লাহ ইবনে আবু আওফা (রদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে আল বুখারী বর্ণনা করেছেনঃ “একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুশমনদের মোকাবিলার কোন একদিন দুপুরের সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। এরপর লোকদের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে বললেন, হে লোক সকল! শত্রুর মোকাবিলার আকাঙ্ক্ষা কর না বরং আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাও, তবে শত্রুর সঙ্গে যদি যুদ্ধ বেঁধে যায় তবে ধৈর্যের সাথে জিহাদ চালিয়ে যাবে, জেনে রাখ,’তরবারীর ছায়ার নিচেই জান্নাত এরপর নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিম্নের দু’আটি করলেন, “হে আল্লাহ্! কিতাব অবতীর্ণকারী, মেঘমালা সঞ্চালনকারী, দুশমনদের পরাস্তকারী। তাদেরকে পরাজিত ও তছনছ করে দাও এবং তাদের উপর আমাদের বিজয় দান কর।” এই হাদীসের বক্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট যে এটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি নির্দিষ্ট যুদ্ধে বলেছেনঃ “একদা….মোকাবিলার কোন একদিন…।” আর যে হাদীস রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর কাছাকাছি থাকা অবস্থায় বলেছেন, সেটি কি করে জিহাদ বর্জন করার দলীল হয়? তিনি বলেছেন, “অতঃপর শত্রুর সঙ্গে যদি যুদ্ধ বেঁধে যায়, তবে তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে..।” তিনি দু’আ করেছেন, “….শত্রুকে পরাভূত কর এবং তাদের উপর আমাদের বিজয় দান কর।” একই সাথে এই হাদীসটিতে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবাদের জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন, “….জেনে রাখ, তরবারীর ছায়ার নিচেই জান্নাত।” আর একজন মানুষ শুধুমাত্র যুদ্ধ ক্ষেত্রেই তরবারীর ছায়ার নিচে থাকে যখন সে তার শত্রুকে উন্মুক্ত তরবারী নিয়ে মোকাবেলা করে। [110]
সুতরাং লক্ষণীয় বিষয় হলো, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই হাদীসটি বলেছেন এমন সময় যখন তিনি যুদ্ধের সম্মুখীন। আর তাছাড়া একই হাদীসে জিহাদের জন্য তাঁর উদ্বুদ্ধকরণ থেকে এও বোঝা যায় যে, শত্রু মোকাবিলার আকাঙ্ক্ষা না করার বিষয়টি একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। আর তা হলো, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও আত্মগর্ব থেকে সতর্ক থাকা। ইবনে হাযার (রহিমাহুল্লাহ) তার ব্যাখ্যায় একথাই বলেছেন, “তিনি শত্রুর মোকাবিলা করা আকাঙ্ক্ষা করতে নিষেধ করেছেন শুধুমাত্র এই কারণে যাতে কারো মাঝে সন্তুষ্টি ও নিজের উপর আস্থা বা নিজের শক্তির আতিশয্য বা কাফিরদের দুর্বল গণ্য করার প্রবণতা আসে। এগুলো সবই হলো সর্তক ও প্রত্যয়ী থাকার বিপরীত। আর এও বলা হয় যে,’কল্যাণের ব্যাপারে সন্দেহ বা ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে এই নিষেধ কার্যকর হয় অন্যথায় জিহাদ একটি উত্তম কাজ এবং আনুগত্য।’ [111]
ইমাম নববী (রহিমাহুল্লাহ)-এর ব্যাখ্যাও একই, “আমার বক্তব্য হলোঃ শত্রুর মোকাবেলার আকাঙ্ক্ষা না করার বিষয়টি আসলে এমন নয় কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপস্থিতিতে আনাস বিন নাদর (রদিয়াল্লাহু আনহু) যখন শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন তখন তাকে নিষেধ করেননি।”[112]
এই ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় আনাস বিন মালিক (রদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হাদীসে, “আমার মামা আনাস বিন নাদর (রদিয়াল্লাহু আনহু) বদরের দিনের যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন, সুতরাং তিনি বললেনঃ“ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি প্রথম যুদ্ধে যা আপনি মুশরিকদের সাথে লড়েছেন- তাতে অনুপস্থিত ছিলাম। আল্লাহ্ যদি আমাকে মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ (পরবর্তী) করার সুযোগ দেয়, তাহলে আল্লাহ্ দেখবেন আমি কি করি।” অতঃপর উহুদের দিন এলে মুসলিমরা সংকটের মুখে পড়ে। তিনি বললেন, “হে আল্লাহ্, আমি এই সব মানুষ যা করেছে তার থেকে তোমার কাছে পানাহ চাই- অর্থাৎ ‘সাহাবাগণ’….আর আমি নিজেকে মুক্ত করছি তা থেকে যা এইসব লোক করেছে অর্থাৎ ‘মুশরিকগণ। অতঃপর তিনি এগিয়ে গেলেন এবং সাদ বিন মুআয (রদিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে সাক্ষাৎ হলো, তিনি বললেনঃ “হে সাদ বিন মুআয, আল-জান্নাত, আল নাদরের রবের কসম, আমি উহুদের ওপার থেকে জান্নাতের সুবাস পাচ্ছি।’ সাদ বলেনঃ “ইয়া রাসূলুল্লাহ, সে যা করেছিল আমি তা করতে পারিনি। আনাস বলেনঃ পরবর্তীতে আমরা তার শরীরে বর্শা, তীর ও তলোয়ারের আশিটি আঘাত দেখতে পাই, আমরা দেখি যে তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং মুশরিকরা তাকে দিয়ে দৃষ্টান্ত রেখে গেছে (বিকৃত করেছে) তাই কেউ তাকে সনাক্ত করতে পারেনি তার বোন ছাড়া, তিনি তাকে সনাক্ত করেন তার আঙ্গুলের অগ্রভাগ দেখে। আমরা মনে করতাম যে এই আয়াত তার ও তার মতো অন্যান্যদের জন্য নাযিল হয়েছেঃ
مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّهَ عَلَيْهِ فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَى نَحْبَهُ وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْتَظِرُ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلًا
“মু’মিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করেছে….।” [113]
আমার বক্তব্য হলোঃ এই মহান সাহাবী শত্রুর মুখোমুখি হতে চেয়েছিলেন এবং আল্লাহর প্রতি তার সত্যতা প্রমাণ করেছেন। সুতরাং এর দ্বারা আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, আত্মবিশ্বাসের আতিশয্য বা গর্ব থেকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যেই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শত্রুর মোকাবেলা করার আকাঙ্ক্ষা করাকে নিষেধ করেছেন; আর এই দু’টি বিষয়ই (গর্ব ও আত্মবিশ্বাস) নিন্দনীয়। আর একই সাথে ঐ বিভ্রান্তদের সন্দেহকেও দূর করে দেয় যা দ্বারা তারা ‘জিহাদ আত তালাব’ অস্বীকার করে থাকে। অথচ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা একে তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তিনি বলেনঃ
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ
“এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিৎনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দ্বীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়…।” [114]
لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
“…সকল দ্বীনের ওপর একে (ইসলাম) শ্রেষ্ঠত্ব দানের জন্য, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” [115]
তিনি আরো বলেনঃ
حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ
“…তাদের সাথে যুদ্ধ করবে, যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে স্বহস্তে জিযিয়া দেয়।” [116]
ইবনুল কাইয়্যিম (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ “আল জিহাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র এটাই যে, আল্লাহর কালিমা সুউচ্চ হবে এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হবে।” তিনি বলেন,’দ্বীন সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ হলো- কাফিররা নত হবে এবং তাদের নেতাদের উপর জিযিয়া কার্যকর হবে এবং তাদের উপর দাসত্ব চাপানো হবে- এটাই আল্লাহর দ্বীনের দাবী। এর একেবারে বিপরীত হলো, কাফিরদের তাদের ক্ষমতা বজায় রেখে যেভাবে খুশী তাদের দ্বীন প্রচারের সুবিধা করে দেয়া যাতে তারা ক্ষমতাশীল এবং দৃঢ়পদ হয়।” [117] আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) যা বলেছেন তার সাথে এর কোন পার্থক্য নেই,
لا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ
“দ্বীনের ব্যাপারে জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় সত্যপথ ভ্রান্ত পথ থেকে স্পষ্ট (পৃথক) হয়ে গেছে….।” [118]
কারণ, জিহাদকে ফরয করা হয়েছে এবং আল্লাহর কালিমা সুউচ্চ হয়েছে। এমন অবস্থা কখনোই আসবে না যতদিন না মুসলিমরা শত্রুকে পরাভূত করে এবং দখলকৃত দেশসমূহে শরীয়ত বাস্তবায়ন করে। এসকল দেশে যদি কেউ ইসলাম গ্রহণ করে তবে উত্তম এবং কেউ যদি কুফরে পড়ে থাকে তবে তাকে জোর করা হবে না। বরং সে কুফরে থাকতে পারবে তবে মুসলিম শাসনের মাঝে। সুতরাং জবরদস্তি নিষেধ করা মানে হলো ঈমানের ব্যাপারে জবরদস্তি না করা। যার কথা সুরা তওবায় বলা হয়েছে,
“…সকল দ্বীনের উপর একে শ্রেষ্ঠত্ব দানের জন্য”- তা হলোঃ জবরদস্তি চলবে যতদিন না আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়।
আহলে কিতাব ও তার অনুসারীদের নিকট থেকে জিযিয়া নেয়ার অনুমতি শরীয়াহ-তে পাওয়া যায়- ‘যতক্ষণ না তারা জিযিয়া দেয়’। তবে যারা মূর্তি পূজা করে তাদের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করার ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে। “দ্বীনের ব্যাপারে জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় সত্যপথ ভ্রান্ত পথ থেকে স্পষ্ট (পৃথক) হয়ে গেছে….।” [119]
‘জিহাদ আত তালাব’-এর বৈধতার উপর মুসলিমদের বিশ্বাস বর্তমান আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী- যেখানে একটি দেশের বিরুদ্ধে অপর দেশের আগ্রাসন এবং অন্যের ভূমি জোর করে দখল করা নিষিদ্ধ। এই আইন তারাই ভাঙ্গে যারা তাদের মধ্যে শক্তিশালী।
আল্লাহ্ বলেছেনঃ
فَلا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ
“…সুতরাং মানুষকে ভয় করো না, আমাকে ভয় কর…।” [120]
আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেনঃ
وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ
“…আল্লাহ্ নিশ্চয় তাকে সাহায্য করেন, যে তাকে সাহায্য করে…।” [121]
এ সকল হুকুমই ক্ষমতা ও সামর্থ্যের শর্তাধীন, আর ক্ষমতা বা সামর্থ্য অর্জন করার প্রচেষ্টাও ফরয, যতক্ষণ অক্ষমতা বিরাজ করে। আল্লাহ্ বলেনঃ
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآَخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ لا تَعْلَمُونَهُمُ اللَّهُ يَعْلَمُهُمْ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لا تُظْلَمُونَ
“তোমরা তাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে, এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে এবং এছাড়া অন্যদিগকে যাদেরকে তোমরা জানো না, আল্লাহ্ তাদেরকে জানেন। আল্লাহর পথে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদের দেয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি যুলুম করা হবে না।” [122]
সপ্তম অধ্যায়ঃ জিহাদ একটি ফরযে কিফায়া ইবাদত, তবে ক্ষেত্রবিশেষে এটি প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য
ফরয হতে পারে ইবনে কুদামাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ “ফরযে কিফায়ার অর্থ হলো, যখন কোন কিছু প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কিছু সংখ্যক মানুষও নিযুক্ত হয় না, তখন সকলেই এর জন্য গুনাহগার হয়। আর যদি নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ এটি প্রতিষ্ঠিত করে তবে বাকিরা দায়মুক্ত হয়। সুতরাং ফরযে আইনের মতো এই নির্দেশটিও সকলের প্রতি। পার্থক্য হলো, কিছু সংখ্যক ব্যক্তি পালন করলেই সকলের ফরযে কিফায়া আদায় হয়ে যায়, কিন্তু ফরযে আইনের ক্ষেত্রে অন্য কেউ আদায় করলে সকলেই দায় থেকে মুক্ত হয় না (যতক্ষণ না সে নিজে তা আদায় করে)”
এরপর তিনি দলীল দিয়ে বলেছেন যে জিহাদ ফরযে কিফায়া,”আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)র বাণীঃ
لا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى وَفَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ أَجْرًا عَظِيمًا
“মু’মিনদের মধ্যে যারা অক্ষম নয় অথচ ঘরে বসে থাকে ও যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে তারা সমান নয়। যারা স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে আল্লাহ্ তাদেরকে, যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন; আল্লাহ্ সকলকেই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। …”[123]
সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যরা জিহাদ করছে ততক্ষণ পর্যন্ত বসে থাকা ব্যক্তি গুনাহগার নন। আর আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
“মু’মিনদের সকলের একসঙ্গে অভিযানে বের হওয়া সংগত নয়, তাদের প্রত্যেক দলের এক অংশ বহির্গত হয় না কেন, যাতে তারা দ্বীন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অনুশীলন করতে পারে …”[124]
আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনেক সময় বিভিন্ন স্থানে বাহিনী পাঠিয়ে অন্যান্য সাহাবাদের সাথে (মদীনায়) অবস্থান করতেন।” [125]
ইবনে কুদামাহ বলেনঃ “তিনটি ক্ষেত্রে জিহাদ নির্দিষ্টভাবে (ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর) ফরয হয়ঃ
প্রথমতঃ যখন দুইটি বাহিনী পরস্পর মিলিত হয় এবং মুখোমুখি অবস্থান করে। ঐ বিশেষ মুহূর্তের সেখানে অবস্থানকারী প্রত্যেকের জন্য পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা হারাম। কারণ আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেনঃ “হে মু’মিনগণ! যখন তোমরা কোন বাহিনীর সম্মুখীন হবে তখন অবিচলিত থাকবে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে…”
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُوا إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
এরপর তিনি বলেছেন, “…তোমরা ধৈর্যধারণ কর; নিশ্চয় আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।” [126]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেছেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا زَحْفًا فَلا تُوَلُّوهُمُ الْأَدْبَارَ
وَمَنْ يُوَلِّهِمْ يَوْمَئِذٍ دُبُرَهُ إِلا مُتَحَرِّفًا لِقِتَالٍ أَوْ مُتَحَيِّزًا إِلَى فِئَةٍ فَقَدْ بَاءَ بِغَضَبٍ مِنَ اللَّهِ وَمَأْوَاهُ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ
“হে মু’মিনগণ! যখন তোমরা কাফির বাহিনীর সম্মুখীন হবে তখন তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে না। যে ব্যক্তি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে সে অবশ্যই আল্লাহর গযবে পতিত হবে,…”[127]
দ্বিতীয়তঃ কাফিররা কোন দেশ আক্রমণ করলে ঐ দেশে অবস্থানকারী সকলের উপর জিহাদ ফরয।
তৃতীয়তঃ ইমাম যদি সকলকে জিহাদের ডাক দেয় তবে সকলের জন্য এতে অংশ নেয়া বাধ্যতামূলক। কারণ আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেনঃ
إِنَّمَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ لا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَارْتَابَتْ قُلُوبُهُمْ فَهُمْ فِي رَيْبِهِمْ يَتَرَدَّدُونَ
“হে মু’মিনগণ! তোমাদের কি হলো যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে অভিযানে বের হতে বলা হয় তখন তোমরা ভারাক্রান্ত হয়ে জমীনকে আঁকড়ে ধর?”[128]
এই আয়াত এবং এর পরবর্তী আয়াত উভয়েই একই বক্তব্য পেশ করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের যদি ডাক দেয়া হয়, তবে তোমরা (ডাকে) সাড়া দাও.. [129]
আমার (ইবনে কুদামাহ) বক্তব্য হলোঃ দ্বিতীয় পরিস্থিতিটির দলীল প্রথমটির মাঝেই রয়েছে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে মু’মিনগণ! যখন তোমরা কোন বাহিনীর সম্মুখীন হবে তখন অবিচলিত থাকবে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে …”এরপর তিনি বলেছেন, “…তোমরা ধৈর্যধারণ কর; নিশ্চয় আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।” [130]
কারণ, মুসলিম রাষ্ট্রের দিকে কাফিরদের এগিয়ে আসার মানে হলো দুই দল পরস্পর মুখোমুখি হওয়া এবং সংঘর্ষ।
আমার (ইবনে কুদামাহ) বক্তব্য হলোঃ ফরযে কিফায়া জিহাদের জন্য নয়টি শর্ত রয়েছে। এগুলো হলোঃ “ইসলাম, সাবালক, মানসিকভাবে সুস্থ, মুক্ত, পুরুষ, শারীরিকভাবে সক্ষম, (জিহাদের) খরচ বহনে সক্ষম, অভিভাবকের অনুমতি এবং পাওনাদারের অনুমতি।” [131]
এর মধ্যে ফরযে আইন জিহাদের জন্য শর্ত হলো শুধু প্রথম পাঁচটি।
অষ্টম অধ্যায়ঃ প্রত্যেক মুসলিমের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক
প্রত্যেক মুসলিমের উপর, শরীয়ত সম্মত ওজর ছাড়া, সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক হওয়ার কারণ হলো, জিহাদ যেকোন সময় যে কারো উপর ফরযে আইন হয়ে যেতে পারে। শুধু উন্নত অস্ত্র থাকলেই জিহাদ হবে না, এর প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আর কোন একটি ফরয পালন করা যদি অন্য কোন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল হয় তবে ঐ বিষয়টিও বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। আর তাছাড়া আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) নিজে প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতির আদেশ করেছেনঃ
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ
“তোমরা প্রস্তুত রাখবে তাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য ‘শক্তি’ (কুউওয়া)…”[132]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘শক্তি’-র ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “নিশ্চয়ই শক্তি (কুউওয়া) রয়েছে নিক্ষেপ করার মাঝে” একথা তিনি তিনবার বলেছেন। কারো জন্য এটি যথেষ্ট নয় যে সে জীবনে একবার প্রশিক্ষণ নিয়ে বসে থাকবে। বরং তাকে এই প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে যাতে সে তার সামরিক যোগ্যতা বজায় রাখতে পারে। আর এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুশিয়ার করে দিয়েছেন, “যে ব্যক্তি নিক্ষেপণ (শুটিং) শিখে তা ছেড়ে দিল, সে আমাদের থেকে নয়”। এই হাদীস দ্বারা সার্বক্ষনিকভাবে জিহাদের প্রস্তুতিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেনঃ
وَدَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ تَغْفُلُونَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ وَأَمْتِعَتِكُمْ فَيَمِيلُونَ عَلَيْكُمْ مَيْلَةً وَاحِدَةً
“কাফেররা কামনা করে যেন তোমরা তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাবপত্র সম্বন্ধে অসতর্ক হও যেন তারা তোমাদের উপর একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে…”[133]
আর এখানে উল্লেখ্য যে, শত্রু যখন মুসলিম রাষ্ট্রে প্রবেশ করে তখন জিহাদের জন্য প্রশিক্ষণ কোন শর্ত নয়। ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ “আত্মরক্ষামূলক জিহাদ, যেখানে আগ্রাসনকারীকে পবিত্র ভূমি ও দ্বীন থেকে বিতাড়িত করাটাই জরুরী; সুতরাং এটি বাধ্যতামূলক এবং এব্যাপারে ইজমা রয়েছে। সুতরাং আগ্রাসী শত্রু যে এই দ্বীন ও জীবনকে কলুষিত করছে তাকে দমনের চেয়ে বড় কোন দায়িত্ব নেই। আর এর জন্য কোন শর্ত নেই এবং যে কোন উপায়ে একে অবশ্যই দমন করতে হবে।” [134] আমার (লেখক) বক্তব্য হলো, যদি সকল ব্যক্তির উপর জিহাদ ফরয হয়ে যায়, প্রশিক্ষণ না থাকলেও তাকে এতে অংশ নিতে হবে; অবশ্য যদি তার শরীয়ত সম্মত ওজর থাকে অথবা যদি তার অস্ত্র চালনার দরুন তার এবং অন্য ভাইদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশংকা থাকে তবে ভিন্ন কথা। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,”কোন প্রকারের ক্ষতিসাধন করা যাবে না এবং (প্রতিশোধস্বরূপ) ক্ষতিও করা যাবে না।” আর জিহাদে প্রত্যেক মুসলিমের জন্য তার আমির কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব সাধ্যমত পালন করা বাধ্যতামূলক।
নবম অধ্যায়ঃ মুসলিম জাতি একটি মুজাহিদ জাতি; সুতরাং এর নীতিসমূহও সেভাবেই গৃহীত হবে
উপরোক্ত আলোচনা থেকে কয়েকটি বিষয় জানা গেছে; মুসলিমদের জিহাদ আত তালাব এবং জিহাদ আদ দিফা’য় এই দুই প্রকারের জিহাদ করতে হবে; জিহাদ ফরযে কিফায়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে ফরযে আইন হয়ে থাকে এবং সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা এবং তা অব্যাহত রাখা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক।
আমরা জিহাদ আত তালাব অর্থাৎ শত্রুর দেশে গিয়ে তাকে আক্রমণ করার কথাও বিবেচনা করি; অধিকাংশ আলেমের মতে এটিও বছরে কমপক্ষে একবার পরিচালনা করা ফরয। আর যদি মুসলিমরা অক্ষম না হয় বা শত্রুর সাথে কোন চুক্তি না থাকে তবে এটিই হলো সর্বনিম্ন আবশ্যকতা। অন্যরা বিষয়টিকে এভাবে বলেছেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলিমরা সক্ষম ততক্ষণ পর্যন্ত এটি চালিয়ে যেতে হবে এবং এর কোন (বাৎসরিক) নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই।
আর যারা একে বছরে একবার বাধ্যতামূলক বলেছেন-তাদের সংখ্যাই বেশী- তারা প্রমাণ পেশ করেছেন যে, ইসলামী রাষ্ট্রেও অমুসলিমদের উপর জিযিয়া বাধ্যতামূলক এবং এটি জিহাদের পরিবর্তে আদায় হয় বছরে একবার। সুতরাং জিহাদের বিকল্প জিযিয়া যেহেতু বছরে একবার তাই জিহাদও বছরে কমপক্ষে একবার করতে হবে। [135]
আমার (লেখক) বক্তব্য হলোঃ এ বিষয়টি আল্লাহর আয়াতে স্পষ্ট,
أَوَلا يَرَوْنَ أَنَّهُمْ يُفْتَنُونَ فِي كُلِّ عَامٍ مَرَّةً أَوْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ لا يَتُوبُونَ وَلا هُمْ يَذَّكَّرُونَ
“তারা কি দেখতে পায় না, প্রতি বছর তাদের কিভাবে একবার কিংবা দুবার বিপর্যস্ত করা হচ্ছে? এরপরও তারা তওবা করে না এবং তারা কোন শিক্ষা গ্রহণ করে না।” [136]
ইবনে কাসীর (রহিমাহুল্লাহ) তার তাফসীরে কাতাদাহ (রহিমাহুল্লাহ) থেকে ব্যাখ্যা করেছেন, “তারা বছরে একবার অথবা দুইবার যুদ্ধের দ্বারা পরীক্ষিত হয়।” আল্ কুরতুবী (রহিমাহুল্লাহ) জিহাদ আত তালাব সংক্রান্ত আলোচনায় বলেছেন, “আর দ্বিতীয় এক প্রকারের ফরয জিহাদ হলো শত্রুর মোকাবেলার জন্য প্রতি বছর একটি বাহিনী প্রেরণ করা; যা নেতার (ইমাম) উপরে ফরয। তিনি হয় নিজে এতে অংশ নিবেন অথবা বিশ্বস্ত কাউকে এই দায়িত্ব দিয়ে পাঠাবেন যাতে সে তাদেরকে ইসলামের দিকে ডাকে; তাদেরকে আক্রমণ করে অপকারগুলো দূর করে এবং তাদের উপর আল্লাহর দ্বীনের প্রাধান্য নিশ্চিত করে; যতক্ষণ না তারা ইসলামে প্রবেশ করে অথবা স্বেচ্ছায় জিযিয়া দেয়। এবং আরো একটি জিহাদ বাধ্যতামূলক। আর তা হলো ইমাম বাহিনীর পর বাহিনী পাঠাতে থাকবে এবং যখন সম্ভব বা যখন তারা অন্যমনস্ক থাকবে তখন প্লাটুন নামাবে। এবং প্রহরার মাধ্যমে তাদের উপর নজরদারী করবে এবং শক্তির প্রদর্শনী করবে।” [137]
আমি (লেখক) বলিঃ সুতরাং ইমাম কুরতুবীও, অধিকাংশের মত অনুযায়ী বছরে একবার জিহাদের সমর্থক ছিলেন; এর চেয়ে বেশী (সংখ্যক জিহাদ) ইমামের ইচ্ছাধীন। সুতরাং আমরা যদি এই জিহাদ ও এর প্রস্তুতির আবশ্যকতার দিকে তাকাই যা আল্লাহ্ তাঁর আয়াতে উল্লেখ করেছেনঃ
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ
“তোমরা প্রস্তুত রাখবে তাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য ‘শক্তি’ (কুউওয়া)..”[138]
… এ থেকেই আমরা জানতে পারি যে মুসলিম জাতি সর্বাগ্রে একটি মুজাহিদ জাতি। আর এই দায়িত্ব পালন করে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র উভয় ক্ষেত্রেই এসকল দায়িত্ব পালন করতে হবে। সুতরাং শিক্ষা, অবকাঠামো, বাণিজ্য, জনসংখ্যার এলাকাভিত্তিক বন্টন; এ সকল নীতিই হবে জিহাদ কেন্দ্রিক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,”একজন মুসলিম অন্য মুসলিমের জন্য ইটের (গাঁথুনি) স্বরূপ, প্রত্যেকেই অন্যদেরকে সহায়তা (শক্তিশালী) করে।”[139] তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেনঃ “পারস্পরিক ভালোবাসা, প্রেম-প্রীতি ও বন্ধুবৎসলতা মু’মিনদের উদাহরণ একটি শরীরের ন্যায়; যখন একটি অঙ্গ ব্যথা অনুভব করে, তখন জ্বর ও নিদ্রাহীনতার কারণে সমগ্র শরীরই ব্যথা অনুভব করে।” [140]
দশম অধ্যায়ঃ আর অক্ষমতা ছাড়া কোন কিছুই মুসলিমদের জিহাদ থেকে বিরত রাখতে পারে না। এবং সেই মুহূর্ত থেকে প্রস্তুতি ওয়াজিব হয়ে পড়ে
কারণ, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেনঃ
فَلا تَهِنُوا وَتَدْعُوا إِلَى السَّلْمِ وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ وَاللَّهُ مَعَكُمْ وَلَنْ يَتِرَكُمْ أَعْمَالَكُمْ
“সুতরাং তোমরা হীনবল হয়ো না এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না, যখন তোমরাই প্রবল…”[141]
অতএব, মুসলিমরা ততদিন তাদের শত্রুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ থাকবে যতদিন শক্তিশালী থাকবে, সেখানে কোন সন্ধি বা ‘হুদনাহ’ অথবা কোন চুক্তি থাকবে না। বরং যুদ্ধ চলতে থাকবে যতক্ষণ না ফিৎনা দূরীভূত হয় আর দ্বীন শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত হয়। কারণ জিহাদের ব্যাপারে নাযিলকৃত সর্বশেষ আয়াতে তিনি বলেছেনঃ
فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“…. মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা করো, তাদেরকে ধরে ফেল, তাদেরকে অবরোধ করে রাখো এবং ঘাঁটিস্থল সমূহে তাদের সন্ধানে অবস্থান কর। অতঃপর যদি তারা তওবা করে, সালাত আদায় করে এবং যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ্ অতিশয় ক্ষমাপরায়ণ, পরম করুণাময়।” [142]
সুতরাং এই আয়াত এবং একই সূরার জিযিয়া সংক্রান্ত আয়াত সাধারণ কিতালের হুকুম সম্বলিত এবং এগুলো কুরআনের সর্বশেষে নাযিলকৃত অর্থাৎ এগুলোকে মানসুখ করা হয়নি। আল বুখারী (রহিমাহুল্লাহ) আল বারা (রদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, “সর্বশেষ নাযিলকৃত সূরা হলো আল বারা’আহ [143]
আর এভাবেই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর অনুসরণকারীগণ মুশরিক ও আহলে কিতাবীদের সাথে ক্বিতাল চালিয়ে যান। এ ব্যাপারে ত্রয়োদশ অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে। আর অক্ষমতা ছাড়া কোন কিছুই এ থেকে বিরত রাখতে পারে না। আর কাফিররা প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিল যাতে মুসলিমরা অস্ত্র না পায়। আল্লাহ্ বলেছেন,
وَدَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ تَغْفُلُونَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ وَأَمْتِعَتِكُمْ فَيَمِيلُونَ عَلَيْكُمْ مَيْلَةً وَاحِدَةً
“কাফিররা কামনা করে যেন তোমরা তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাবপত্র সম্পর্কে অসতর্ক হও, যাতে তারা তোমাদের ওপর একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।” [144]
এবং এই গ্রন্থে আমি উল্লেখ করেছি যে, যদি কেউ অক্ষমতার কারণে জিহাদ থেকে বিরত থাকে, তবে প্রস্তুতি তার উপর ফরয হবে। কারণ ঐ আয়াত যেখানে বলা হয়েছে, ‘…আর তাদের বিরুদ্ধে প্রস্তুত রাখো…’। ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) ও একই কথা ব্যক্ত করেছেন।
পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে, কাফিরদের সাথে মুসলিমদের সম্পর্ক শুধুমাত্র যুদ্ধের মাঝে সীমাবদ্ধ এবং এক্ষেত্রে একটিই ব্যতিক্রম রয়েছে; আর তা হলো ‘হুদনাহ’ বা চুক্তির মাধ্যমে শান্তি। আর এই ব্যতিক্রম পন্থার আশ্রয় গ্রহণেরও প্রয়োজন নেই যদি অক্ষমতা বা এরকম কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। এটি আল্লাহর আয়াতে স্পষ্ট বর্ণিত আছে,
فَلا تَهِنُوا وَتَدْعُوا إِلَى السَّلْمِ وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ
“সুতরাং তোমরা হীনবল হয়ো না এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না, যখন তোমরাই প্রবল…”[145]
ইবনে কুদামাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ “আর ‘হুদনাহ’ এর অর্থ হলো এমন চুক্তি যা যুদ্ধরত মানুষদের সাথে যুদ্ধ বিরতির ব্যাপারে করা হয়, কোন কিছুর বিনিময়ে বা বিনিময় ছাড়া। আর একে বলা হয় ‘মুহাদানাহ’ এবং ‘মুওয়াদাতাহ’ এবং ‘মুওয়াহাদাহ’ এবং এটি আল্লাহর আয়াতের দ্বারা জায়েয। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ “এটি সম্পর্কচ্ছেদ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সেই সমস্ত মুশরিকদের সাথে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলে।” [146]
তিনি আরো বলেনঃ
وَإِنْ جَنَحُوا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا وَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ
“যদি তারা সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে তোমরাও সন্ধি করতে আগ্রহী হও…”[147]
মারওয়ান এবং মিশওয়ার ইবনে মাকরামাহ (রদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হুদাইবিয়ায় সুহাইল বিন আমরের সাথে দশ বছরের যুদ্ধ বিরতির ব্যাপারে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। কারণ মুসলিমদের ভেতরে দুর্বলতা থাকতে পারে, আর ‘হুদনাহ’ করার মাধ্যমে তারা (ঐ সময়) শক্তিশালী হতে পারে। তবে এটি জায়েয নয়, যদি মুসলিমদের পরিস্থিতি (এর জন্য) উপযুক্ত না হয়। যেমন, মুসলিমদের মাঝে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা থাকতে পারে, অথবা ‘হুদনাহ’ এর মাধ্যমে তারা ইসলামে প্রবেশ করবে এমন আশা অথবা তারা জিযিয়া দেবে এবং দ্বীনের হুকুমসমূহ অনুসরণ করবে অথবা অন্য কোন সুবিধা লাভের আশা থাকলে। আর যদি (এমন পরিস্থিতি) নিশ্চিত হয় তার পরও ‘হুদনাহ’- এর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বেধে দিতে হবে নতুবা এটি হবে চিরতরে জিহাদ ছেড়ে দেয়ার শামিল।” আর ইবনে কুদামাহ (রহিমাহুল্লাহ) ‘হুদনাহ’ সম্পর্কে বলেনঃ “(সুনির্দিষ্ট) পরিস্থিতি (উদ্ভব হওয়া) ছাড়া এটি জায়েজ নয়।” অর্থাৎ এর থেকে সুবিধা পাওয়া গেলেই কেবল এটি জায়েয।
‘আল মাজমু’ গ্রন্থের লেখক বলেনঃ “(একজন ব্যক্তির জন্য) কোন অঞ্চল বা এলাকার সাথে ‘হুদনাহ’ চুক্তি করা জায়েয নয় যদি না সে হয় ইমাম বা তার প্রতিনিধি। কারণ, এটি যদি প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য (জায়েয) হতো তবে কোন কিছুই একজন ব্যক্তিকে কোন এলাকার মানুষের সাথে ‘হুদনাহ’ করা থেকে বিরত রাখতে পারত না, যদিও উপকার থাকত যুদ্ধের মাঝে, সুতরাং এর দ্বারা ক্ষতিই বৃদ্ধি পেত। আর একারণেই ইমাম বা তার প্রতিনিধি ছাড়া (কারো জন্য) এটি জায়েয নয়। কিন্তু যদি ইমাম অনুপস্থিত থাকে তবে এটি ভেবে দেখবার বিষয়। সেক্ষেত্রে এই হুদনাহ-এর মাঝে যদি কোন উপকার না থাকে তবে এ চুক্তি সম্পাদন জায়েয নয়।
আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)র বাণীঃ
فَلا تَهِنُوا وَتَدْعُوا إِلَى السَّلْمِ وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ
“সুতরাং তোমরা হীনবল হয়ো না এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না যখন তোমরাই প্রবল। আল্লাহ্ তোমাদের সাথে আছেন….।” [148]
ইবনে কাসীর (রহিমাহুল্লাহ) এই আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ “…এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না।” অর্থাৎ ‘মুহাদানাহ’ বা ‘মুসালামাহ’,- কাফিরদের সাথে যুদ্ধ বিরতি করা যখন তোমরা সংখ্যা ও অস্ত্রের দিক দিয়ে শক্তিশালী। আর একারণেই তিনি (আল্লাহ্) বলেছেনঃ “সুতরাং তোমরা হীনবল হয়ো না এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না যখন তোমরাই প্রবল।” অর্থাৎ এমন পরিস্থিতিতে যখন (তোমরা) শত্রুর চেয়ে শ্রেয়। তবে কাফিররা যদি শক্তিশালী হয় এবং মুসলিমদের তুলনায় অধিক সংখ্যক হয়, আর ইমাম যদি মনে করেন যে ‘মুহাদানাহ’ বা ‘মুওয়াহাদা’র মাঝে কল্যাণ রয়েছে তবে এটি তার জন্য জায়েয হবে, যেভাবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চুক্তি করেছিলেন তাদের সাথে তাঁর দশ বছরের জন্য যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে যখন কুরাইশরা তাকে মক্কায় প্রবেশে বাধা দেয় এবং চুক্তির আহবান জানায়। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটি গ্রহণ করেন। এবং আল্লাহ্ আ’জ্জা ওয়াজাল্লা বলেনঃ ‘আল্লাহ্ তোমাদের সাথে আছেন…’ এর মাঝে শত্রুর উপর বড় বিজয়ের সুসংবাদ রয়েছে।”
তবে কিছু মানুষ আছে, বিশেষ করে বিদ’আতীদের মাঝে, যারা মনে করে যে কাফিরদের সাথে মুসলিমদের সম্পর্ক মূলতঃ শান্তি ও সম্প্রীতি যার ব্যতিক্রম হলো যুদ্ধ, যা বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে সংঘটিত হয়। তারা এর প্রমাণ হিসেবে পেশ করে,
وَإِنْ جَنَحُوا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا وَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ
“তারা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে তোমরাও সন্ধি করতে আগ্রহী হও,…”[149]
এই রায় জিহাদ আত তালাবকে শেষ করে দেয় এবং জিহাদকে শুধুমাত্র জিহাদ আদ দিফা’য় এর মাঝে সীমাবদ্ধ করে দেয়। এই ভুলটির ব্যাপারে আমরা ষষ্ট অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। আর সে আয়াতটিকে দলীল হিসেবে পেশ করা হয়েছে, তাতে আসলে এর কোন দলীল নেই; কারণ, এই আয়াতের বর্ণিত শান্তি হলো তখনকার জন্য যখন মুসলিমদের জন্য তা আবশ্যক। আর উক্ত আয়াতে এ বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছেঃ সুতরাং তোমরা হীনবল হইও না এবং সন্ধির প্রস্তাব করিও না, যখন তোমরাই প্রবল;[150] সুতরাং সূরা আনফালের আয়াতটি একটি শর্ত দ্বারা সীমাবদ্ধ আর তা হলো, যখন মুসলিমদের জন্য এই চুক্তি প্রয়োজন হবে এবং তা কল্যাণকর হবে তখনই কেবল শান্তি প্রস্তাব করা যাবে। আর সূরা মুহাম্মাদের বর্ণিত পরিস্থিতিতে (শক্তিশালী অবস্থায়) শান্তি স্থাপন কল্যাণকর নয়। আর তা হলো যখন কাফিরদের পরাভূত করার মতো শক্তি মুসলিমদের হাতে থাকবে তখন, কাফিরদের সাথে শান্তি স্থাপন করার অনুমতি নেই, যা এই আয়াত থেকে স্পষ্ট। আর যদি তা করা হয় তবে তা পরিপূর্ণরূপে দ্বীন কায়েম করার উদ্দেশ্য থেকে সরে যাওয়ার শামিল হবে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ
“এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিৎনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দ্বীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।” [151]
তিনি আরও বলেনঃ
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
“তিনিই তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হুদা (হেদায়েত) ও সত্য দ্বীনসহ সকল দ্বীনের উপর তাকে বিজয়ী করার জন্য, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” [152]
এটাই হলো মৌলিক লক্ষ্যঃ মুশরিকদের সাথে যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা কর যাতে তারা, হয় আল্লাহর ইবাদতের দিকে ফিরে ইসলামে প্রবেশ করবে, অথবা ইসলামী শাসন মেনে নিয়ে জিযিয়া প্রদান করে কুফরী অবস্থায় অনড় থাকবে এবং তাদের উপর দমন ও নিগ্রহ চাপিয়ে রাখা হবে। আর এটাই তার জন্য আবশ্যকীয় প্রতিফল যে আল্লাহর ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ
“তাদের সাথে যুদ্ধ করবে যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে জিযিয়া দেয়।”[153]
তিনি আরো বলেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ يُحَادُّونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ فِي الْأَذَلِّينَ
“যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের বিরোধিতা করে তারা হবে চরম লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত।” [154]
ইবনে কাসীর (রহিমাহুল্লাহ) সূরা আনফালের উক্ত আয়াতের (তারা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে….) ব্যাখ্যায় বলেনঃ “ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, যাইদ ইবনে আসলাম, আতা আল খুরাসানী, ইশরামাহ, আল হাছান এবং কাতাদাহ বলেনঃ এই আয়াতটি সূরা তাওবার ‘তরবারীর আয়াত’টি (আয়াত ২৯) দ্বারা মানসুখ হয়েছে, যেখানে আল্লাহ্ বলেনঃ “তাদের সাথে যুদ্ধ কর, যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনে না এবং শেষ দিনের উপর….”। আর এটি অবশ্য একটি অস্পষ্ট বিষয় কারণ সূরা তাওবায় শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুকুম রয়েছে যদি তা সম্ভব হয়। কিন্তু শত্রু যদি খুবই শক্তিশালী হয়, তাহলে তাদের সাথে ‘হুদনাহ’ করা জায়েয হবে, যা সূরা আনফালে (৬১ নং আয়াতে) বলা হয়েছে এবং হুদায়বিয়ার দিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা করেছিলেন। সুতরাং এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত বা মানসুখ হওয়া বা শর্ত আরোপের ব্যাপার নেই। আল্লাহ্ ই সবচেয়ে ভাল জানেন।”
আর ইবনে হাজার (রহিমাহুল্লাহ) এই একই আয়াতের ব্যাপারে বলেছেনঃ “তারা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে তোমরাও সন্ধি করতে আগ্রহী হও”, এতে মুশরিকদের সাথে মুসলাহাহ্ স্থাপনের কথা তোলা হয়েছে। তিনি বলেনঃ “এ আয়াত যে শর্তাধীনে রয়েছে তার অর্থ হলো- শান্তি স্থাপনের হুকুম সে পর্যন্তই সীমাবদ্ধ যে পর্যন্ত ইসলামের কল্যাণ হবে, তবে ইসলাম যদি কুফরের উপর শক্তিশালী হয় আর ‘মুসালাহাহ’-তে কোন কল্যাণ না থাকে তবে (এ হুকুম কার্যকর) নয়। [155]
সুতরাং যে আয়াতটি তারা দলীল হিসেবে ব্যবহার করে তা থেকেই একথা স্পষ্ট যে, শান্তি স্থাপন করার অনুমতি রয়েছে শুধুমাত্র প্রয়োজনের সময়। কিন্তু শান্তি স্থাপন করা আবশ্যক কোন বিষয় নয় অর্থাৎ সবসময় তাদের সাথে শান্তি স্থাপন করতে হবে এমন কোন ইঙ্গিত এই আয়াতে নেই। আমার বক্তব্য হলোঃ কেউ যেন এমন ব্যাখ্যা না নেন যে, ইসলাম কখনও শান্তির দিকে ডাকে না। ইসলাম শান্তির দিকে ডাকে- তবে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এটি সকল সৃষ্ট জীবের জন্য শান্তি চায়।
আল্লাহ্ বলেনঃ
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ
“আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের (‘আলামীন) জন্য কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।” [156]
তিনি বলেনঃ
اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آَمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ
“যারা ঈমান আনে আল্লাহ্ তাদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনেন।” [157]
তিনি বলেনঃ
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ
“আল্লাহ্ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয় স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎকার্য ও সীমালঙ্ঘন….।” [158]
আর ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে এটাই শান্তি সৃষ্টির প্রতি রহম করা এবং তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে প্রবেশ করিয়ে উত্তম আমল করার উৎসাহ দান।
আল্লাহ্ বলেনঃ
وَلا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ
“….যেন আমরা আল্লাহ্ ব্যতীত কারও ইবাদত না করি।” [159]
সেই সাথে বিশৃঙ্খলা নিষেধ করা। যতক্ষণ না এসব হবে ততক্ষণ জিহাদ চালাতে হবে।
حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ
“….যতক্ষণ না ফিৎনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দ্বীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।” [160]
একাদশ অধ্যায়ঃ হিজরত বন্ধ হবে না যতদিন না সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হয়
রাসূলূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “আর আমি তোমাদের পাঁচটি জিনিসের আদেশ দিচ্ছি, যা আল্লাহ্ আমাকে আদেশ করেছেনঃ আল-জামা’আ (ঐক্য), শোনা, মানা, হিজরত এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।” [161] এবং তিনি আরো বলেন, “হিজরত বন্ধ হবে না যতদিন না তওবা বন্ধ হয়। আর তওবা বন্ধ হবে না যতদিন না সূর্য তাঁর অস্ত যাওয়ার দিক দিয়ে উদিত হয়।” [162]
বেশ কয়েকটি কারণে হিজরত ওয়াজিব হয়, তন্মধ্যেঃ
১. দ্বীন রক্ষা করে মুশরিকদের থেকে নিরাপদে প্রস্থান করা যখন দ্বীনের ওপর ফিতনার আশংকা থাকে। আর এটাই হল ‘দারুল কুফর’ থেকে ‘দারুল ইসলাম’ অথবা ‘দারুল আমান’-এ হিজরত করা, যার পক্ষে সম্ভবপর।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “সেইসব মুসলিমদের কারো সাথে আমার সম্পর্ক নেই যারা মুশরিকদের ভেতরে অবস্থান করে।” [163]
আতা ইবনে আবি বারাহ (রহিমাহুল্লাহ) থেকে বুখারী (রহিমাহুল্লাহ) বর্ণনা করেনঃ আমি উবাইদ ইবনে উমাইর আল লাইছিকে সাথে নিয়ে আয়েশা (রদিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে দেখা করি। এরপর আমরা তাদের হিজরতের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি। তখন তিনি বললেনঃ “আজ আর হিজরত নেই, – মু’মিনগণের ভেতরে যে ব্যক্তির দ্বীনের উপর ফিৎনা আসবে সে যেখানে খুশী আল্লাহর ইবাদত করতে পারে; তবে জিহাদ এবং এর নিয়্যত ব্যতীত ।”
আমার বক্তব্য হলোঃ এখানে সায়্যিদা আয়েশা (রদিয়াল্লাহু আনহু) যে হিজরতের কথা বলেছেন তা হলো ‘দারুল ইসলাম’ থেকে হিজরত। কারণ তিনি বলেছেন, “আজ আর হিজরত নেই।” যখন তিনি ‘দারুল ইসলামে’ ছিলেন। এরপর তিনি হিজরতের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, তা হলো ফিৎনা থেকে দ্বীনকে রক্ষা করার জন্য পলায়ন করা।
২. হিজরত আল্লাহর পথে জিহাদের সূচনা স্বরূপ।
হারিছ আল আশআরী (রদিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীস – রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি। যা আল্লাহ্ আমাকে আদেশ করেছেনঃ আল জামা’আ, শোনা, মানা, হিজরত এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।[164]
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
ثُمَّ إِنَّ رَبَّكَ لِلَّذِينَ هَاجَرُوا مِنْ بَعْدِ مَا فُتِنُوا ثُمَّ جَاهَدُوا وَصَبَرُوا إِنَّ رَبَّكَ مِنْ بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَحِيمٌ
“যারা নির্যাতিত হবার পর হিজরত করে, পরে জিহাদ করে এবং ধৈর্য্যধারণ করে; তোমার রব এই সবের পরে, তাদের প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।” [165]
সুতরাং হিজরতই সর্বশেষ স্তর নয়। বরং এটি জিহাদের একটি সূচনা স্বরূপ। আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “হিজরত বন্ধ হবে না যতদিন পর্যন্ত শত্রুদের সাথে যুদ্ধ চলবে।” [166]
এই গ্রন্থের শুরুতেই আমি আলোচনা করেছি যে, ঈসা ইবনে মারিয়াম (আঃ) এসে দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করার পূর্ব পর্যন্ত জিহাদ বলবৎ থাকবে। আর এ ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ আছে যে এটাই হবে আল্লাহর রাস্তায় সর্বশেষ জিহাদ। এই হিজরত হবে জিহাদের সূচনা স্বরূপ যা অন্য কোন দেশের জিহাদরত মুসলিম মুজাহিদীনদের সহায়তা করতে পারে অথবা মুসলিমদের জিহাদে প্রস্তুতি নেয়ার নিয়্যতে এবং লোক সমাগমের উদ্দেশ্যে যেন মুসলিমরা তাদের দেশে ফিরতে পারে জিহাদের জন্য তৈরী হয়ে। অন্য এলাকায় হিজরতের হুকুম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ইবনে কুদামাহ (রহিমাহুল্লাহ) “হিজরত সংক্রান্ত অধ্যায়ে বলেনঃ আর এটি হলো ‘দারুল কুফর’ ত্যাগ করে ‘দারুল ইসলামে’ আসা”- আল্লাহ্ বলেছেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ تَوَفَّاهُمُ الْمَلائِكَةُ ظَالِمِي أَنْفُسِهِمْ قَالُوا فِيمَ كُنْتُمْ قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِي الْأَرْضِ قَالُوا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيهَا فَأُولَئِكَ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
“নিশ্চয়ই যারা নিজেদের জীবনের প্রতি যুলুম করেছিল, ফেরেশতাগণ তাদের প্রাণ হরণ করতে গিয়ে বলবেঃ তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলবে, আমরা দুনিয়ায় অসহায় ছিলাম। তারা বলবেঃ আল্লাহর দুনিয়া কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তন্মধ্যে হিজরত করতে? অতএব তাদেরই বাসস্থান জাহান্নাম এবং ওটা কত নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থান।” [167]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন যে, “সেইসব মুসলিমদের কারো সাথে আমার সম্পর্ক নেই যারা মুশরিকদের ভেতরে অবস্থান করে।”[168] আর এগুলো ছাড়াও আরো যেসব আয়াত ও হাদীস রয়েছে তা অনেক। এটি বন্ধ হবে না। কিছু লোক বলে যে, হিজরত আর নেই কারণ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ফাতহে মক্কার (মক্কা বিজয়ের) পর আর হিজরত নেই।” এবং তিনি বলেনঃ “জিহাদ ও নিয়্যত ছাড়া অন্য সকল হিজরত বন্ধ হয়ে গেছে। বর্ণিত আছে যে, যখন মারওয়ান ইবনে উমাইয়্যাহ (রদিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম কবুল করেন, তাকে বলা হয়েছিল, তার জন্য কোন দ্বীন নেই যে হিজরত করে না। সুতরাং তিনি মদীনায় চলে যান। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,“কিসে তোমাকে এখানে আনলো, হে আবু ওহাব।’ সে বলল, “একথা বলা হয়েছে যে তার জন্য কোন দ্বীন নেই যে হিজরত করে না।” তিনি বললেন, “ফিরে যাও আবু ওহাব, মক্কার বিস্তৃত উপত্যকায়, এবং তোমার গৃহেই থাকো, কারণ হিজরত তো শেষ হয়ে গেছে শুধুমাত্র জিহাদ ও নিয়্যত ছাড়া।” এই পুরোটাই সাঈদ থেকে বর্ণিত। আর মুআবিয়া (রদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছেঃ আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, “হিজরত বন্ধ হবে না যতক্ষণ না সূর্য তার অস্ত যাওয়ার দিক থেকে উদিত হয়”- আবু দাউদের বর্ণিত। আরো বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
“হিজরত বন্ধ হবে না যতদিন জিহাদ থাকবে।” [169]। আর এসকল আয়াত ও হাদীসের সার্বজনীনতা থেকে বোঝা যায় যে, হিজরতের কারণ সমূহের মতো, সকল সময়েই হিজরত আবশ্যক। পূর্বের হাদিসটি যেখানে তিনি মক্কা বিজয়ের পরে হিজরত না থাকার কথা বলেছেন যে, বিজিত দেশ থেকে হিজরত নেই। আর সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যাকে তিনি যে হিজরত শেষ হওয়ার কথা বলেছেন, তা হলো মক্কা থেকে হিজরত, কারণ (সাধারণভাবে) হিজরত হলো কাফিরদের দেশ থেকে বাহির হওয়া। সুতরাং এটি যদি (ইসলাম দ্বারা) বিজিত হয়, তাহলে তা আর কাফিরদের দেশ থাকে না, সুতরাং এটি থেকে হিজরত করার কোন প্রয়োজন নেই। আর একইভাবে প্রত্যেকটি দেশ যেটি দখল করা হয়েছে, তা থেকে আর কোন হিজরত নেই, বরং তার দিকেই হিজরত করতে হয়। এটাই যদি সত্য হয় তবে মুহাজির তিন প্রকারেরঃ
প্রথমতঃ যার ওপর হিজরত ওয়াজিব এবং সে এ ব্যাপারে সক্ষম। যখন সে তার দ্বীন প্রকাশ করতে পারে না, বা যখন সে দ্বীনের হুকুম মানতে পারে না অথবা যখন সে কাফিরদের মধ্যে অবস্থান করে। সুতরাং এই ব্যক্তির ওপর হিজরত ওয়াজিব। কারণ আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ تَوَفَّاهُمُ الْمَلائِكَةُ ظَالِمِي أَنْفُسِهِمْ قَالُوا فِيمَ كُنْتُمْ قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِي الْأَرْضِ قَالُوا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيهَا فَأُولَئِكَ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
“নিশ্চয়ই যারা নিজেদের জীবনের প্রতি যুলুম করেছিল, ফেরেশতাগণ তাদের প্রাণ হরণ করতে গিয়ে বলবেঃ তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলবে, আমরা দুনিয়ায় অসহায় ছিলাম। তারা বলবেঃ আল্লাহর দুনিয়া কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তন্মধ্যে হিজরত করতে? অতএব তাদেরই বাসস্থান জাহান্নাম এবং ওটা কত নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থান।” [170]
আর এটা সত্যিই একটি ভয়াবহ হুমকি, যা হিজরত এর আবশ্যকতা তুলে ধরে। এটা এই কারণেই যে প্রতিটি সক্ষম ব্যক্তির জন্য ‘দারুল কুফর’ থেকে হিজরত করা অবশ্যকরণীয়। আর হিজরত হলো এসব আবশ্যক প্রয়োজনসমূহের একটি, যা এগুলোকে পরিপূর্ণতা দেয়, এবং যা ছাড়া হুকুমসমূহ পালন করা সম্ভব নয়; সুতরাং এ বিষয়টিও ওয়াজিব।
দ্বিতীয়তঃ যার ওপর হিজরত ওয়াজিব নয়। যে হিজরত করতে সক্ষম নয়- অসুস্থতার কারণে, অথবা সেখানে থাকতে বাধ্য হলে অথবা তার স্ত্রী সন্তানদের বা অনুরূপের (শারীরিক) দুর্বলতার কারণে। আল্লাহর আয়াতঃ
إِلا الْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ لا يَسْتَطِيعُونَ حِيلَةً وَلا يَهْتَدُونَ سَبِيلًا
فَأُولَئِكَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَعْفُوَ عَنْهُمْ وَكَانَ اللَّهُ عَفُوًّا غَفُورًا
“কিন্তু পুরুষ নারী ও শিশুদের মধ্যে অসহায়গণ ব্যতীত। যারা কোন উপায় করতে পারে না বা কোন পথ প্রাপ্ত হয় না। ফলতঃ তাদেরই আশা আছে যে, আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমা করবেন এবং আল্লাহ্ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল।” [171]
আর এক্ষেত্রে হিজরতকে উত্তম বা সুপারিশমূলকও বলা যাবে না কারণ, এটি সম্ভব নয়।
এবং তৃতীয়তঃ সেই ব্যক্তি যার জন্য এটি প্রশংসনীয় কিন্তু ওয়াজিব নয়। ইনি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি হিজরত করতে সক্ষম আবার প্রকাশ্যে তার দ্বীন পালনেও সক্ষম। সুতরাং দারুল কুফরে তার বসবাসে ইতি টানা প্রশংসনীয় হবে যাতে সে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে সক্ষম হয় এবং মুসলিমদের সংখ্যা বাড়াতে পারে এবং তাদের সাহায্য করতে পারে। সেই সাথে কাফিরদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং তাদের কুকর্মের সাক্ষী হওয়া থেকেও রেহাই পায়। কিন্তু এটি তার ওয়াজিব নয় কারণ সে হিজরত না করেই সেখানে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ করতে সক্ষম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চাচা আল আব্বাস (রদিয়াল্লাহু আনহু) তার ইসলামে থাকাকালীন মক্কায় অবস্থান করেছেন। নু’আইম আন নুহাম যখন হিজরত করতে চান তখন তার কওম বনু আদি তার কাছে এসে বলে, আমাদের সাথে থাকুন, আপনি আপনার দ্বীনের ওপর থাকবেন এবং তাদের থেকে আপনাকে রক্ষা করবো যারা আপনার দ্বীনের ওপর থাকবে না এবং তাদের থেকে আপনাকে রক্ষা করব যারা আপনার ক্ষতি করতে চায়। আমাদের জন্য দায়িত্বশীল থাকুন যেভাবে আপনি (বর্তমানে) আমাদের প্রতি দায়িত্বশীল আছেন।’ আর তিনি বনু আদির ইয়াতিম ও বিধবাদের দেখাশোনা করতেন। সুতরাং তিনি কিছুদিন হিজরত থেকে বিরত থেকে পরবর্তী সময়ে হিজরত করেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বলেনঃ “তোমার কওম তোমার প্রতি তার চেয়ে উত্তম যেমনটি ছিল আমার কওম আমার প্রতি। আমার কওম আমাকে বহিষ্কার করে এবং আমাকে হত্যা করতে চায় এবং তোমার কওম তোমাকে রক্ষা করে এবং (ক্ষতি থেকে) বাচায়। তখন তিনি বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ’, আপনার কওম তো আপনাকে আল্লাহর আনুগত্য ও তার শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদের দিকে বহিষ্কার করেছে। আর আমার কওম আমাকে হিজরত ও আল্লাহর আনুগত্য থেকে আটকে রেখেছে। অথবা এর কাছাকাছি কোন বক্তব্য।” [172]
অধ্যায়ঃ ১২ – এবং মুসলিমরা হলো একই জাতি এবং এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। এমনকি তারা যদি অনেক দূরেও থাকে, তাহলেও তারা অন্যদের কাছ থেকে সাহায্যের দাবীদার
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেনঃ
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
“ঈমানদারগণ পরস্পর ভাই ভাই; সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন কর। এবং আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও।” [173]
এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “মুসলিম মুসলিমের ভাই।”[174] এবং তিনি আরো বলেছেনঃ “মুমিনরা একটি দেহের মতো। যদি তার মাথা ব্যথা হয় তাহলে তার বাকি শরীরও জ্বরাক্রান্ত হয় ও ঘুমাতে পারে না।”[175]
এক মুসলিম থেকে অন্য মুসলিমের মধ্যে একমাত্র তাকওয়া ও সৎ আমল ছাড়া আর কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেনঃ
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
“… তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানী, যে অধিক মুত্তাক্বী (তাক্বওয়াশীল)”[176]
এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “একজন আরব একজন অনারবের চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ নয় বা একজন অনারব একজন আরবের চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ নয়, সাদার চেয়ে কালো অথবা কালোর চেয়ে সাদা বেশি সম্মানিত নয়, কেবলমাত্র তাকওয়া ছাড়া। সব মানুষই আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে।” [177]
এবং অপর মুসলিমের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া প্রত্যেক মুসলিমের অধিকার, তাদের আবাসস্থল যতো দূরেই হোক না কেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার কোন ক্ষতি করে না বা তাকে বিসর্জনও দেয় না। আর যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজনে সাহায্য করে, আল্লাহ্ তার প্রয়োজনে সাহায্য করবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলিমকে বিপদ থেকে বাঁচাবে, আল্লাহ্ তাকে কিয়ামতের দিনের বিপদগুলোর একটি বিপদ থেকে বাঁচাবেন। এবং যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের ত্রুটি গোপন রাখবে, আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন তার ত্রুটি গোপন রাখবেন।” [178]
আবু হুরায়রা থেকে মারফু হিসেবে বর্ণিতঃ “মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার কোন ক্ষতি করে না বা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতাও করে না।” [179]
সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের উপরই তার সাধ্য মতো মুসলিম মুজাহিদদের সাহায্য করা ফরয, তাদের দেশ যতো দূরেই হোক না কেন। এবং সে কখনও তার ভাইকে শত্রুর সামনে উন্মোচিত করে দিতে বা শত্রুর হাতে ধরিয়ে দিতে পারবে না। যেমন আল কুরতুবী বলেছেন,“প্রত্যেকের জন্য জিহাদ ফরয। যখন জিহাদ সুনির্দিষ্ট এবং প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে অর্থাৎ যখন শত্রু মুসলিমদের এলাকাগুলোর কোন এলাকা দখল করে ফেলে বা কোন এলাকায় প্রবেশ করে। যদি এমনটা ঘটে, তাহলে প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য তাদের মুখোমুখি হওয়া; হালকাভাবে বা অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে, যুবক বা বৃদ্ধ; প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ সাধ্যমতো। যার বাবা আছে সেও তার বাবার অনুমতি ছাড়াই যুদ্ধে যাবে। এবং যারই যাবার সামর্থ্য আছে, সে বসে থাকতে পারবে না- তাকে যেতেই হবে, যোদ্ধা হিসেবেই হোক বা নিছকই সংখ্যা বাড়ানোর জন্যই হোক। এবং যে এলাকা আক্রান্ত, সেই এলাকার লোকেরা যদি শত্রুকে পরাস্ত করতে না পারে, তাহলে নিকটস্থ এলাকার লোকেরা তাদের সাহায্যে যাবে। যদি তারা শত্রুকে পরাস্ত করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে থাকে তাহলে তারা যেমন যাবে, তেমনি তারা যদি দুর্বল হয়ে থাকে এবং পরাজয়ের আশঙ্কা করে তাহলেও তারা যাবে- যাতে তারা ঐ আক্রান্ত এলাকার মুসলিমদের মতো একই কষ্ট ভোগ করতে পারে।” [180]
ইবন আবিদীন বলেছেন, “ইসলামের বন্দরগুলোর যে কোন একটি বন্দর যদি শত্রুরা আক্রমণ করে তাহলে এটা (জিহাদ) ফরযে আইন হয়ে যায়। ঐ এলাকার কাছে যারা থাকে তাদের জন্য এটা প্রথমেই ফরযে আইন। যারা দূরে থাকে তাদের জন্য এটা ফরযে কিফায়া, যদি শত্রুকে প্রতিহত করতে তাদের সাহায্য জরুরী না হয়। তবে যদি দেখা যায় যে শত্রুকে পরাজিত করার জন্য দূরবর্তীদের সাহায্য জরুরী হয়ে পড়েছে তাহলে ঐ দূরবর্তীদের উপরও এটা সালাত বা সিয়ামের মতোই ফরযে আইন হয়ে পড়ে। এরকম পরিস্থিতি তখন হতে পারে যখন নিকটবর্তীরা শত্রুকে হারানোর মতো শক্তিশালী না হয় অথবা সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোন কারণে জিহাদ থেকে বিরত থাকে ইত্যাদি। এইরকম পরিস্থিতিতে কেউই এই কর্তব্য থেকে অব্যাহতি পাবে না। এভাবে ক্রমাগত পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সব মুসলিমের উপরই এটা ফরয হয়ে যাবে, যতক্ষণ না শত্রুকে বিতাড়িত করা যাচ্ছে।” [181]
এবং এই মতের উপরই চারটি প্রধান মাযহাবের ফুকাহারা একমত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শরীয়া মোতাবেক প্রত্যেক মুসলিমই যে বাঁধনে আবদ্ধ তা হলো ইসলামের বাঁধন। এবং এই বাঁধনের কিছু দায়িত্ব আছে, যেমন – সাহায্য করা, অপরের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, অন্যের পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি। এই সুদৃঢ় বাঁধনকে ধ্বংস করার জন্য কাফিররা সবসময় তৎপর। তাই তারা মুসলিমদের মধ্যে অন্যান্য কিছু ভ্রান্ত বাঁধনের চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের মন থেকে এই ইসলামের বাঁধন মুছে ফেলতে চেষ্টা করছে। যেমনঃ দেশের প্রতি বন্ধন বা “জাতীয়তা”। অর্থাৎ তারা বলে যে মানুষের একটি পরিচয় হলো তার দেশ এবং শুধু তাই না, একটি দেশের সব অধিবাসীই সমান – তাদের ধর্ম যাই হোক না কেন। এবং এই মতবাদের মূল কথা হলো, অন্য সব বন্ধন বা দায়িত্বের উপর স্থান পাবে জাতীয়তার বন্ধন এবং দেশের প্রতি দায়িত্ব। অথচ, ইসলামী শারীয়াহ মোতাবেক এই ধরনের বন্ধন সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ মুসলিমের আনুগত্য কখনও একখণ্ড ভৌগোলিক এলাকার প্রতি হতে পারে না। কারণ, যে কোন মুসলিমকেই একদিন হিজরত করতে হতে পারে। যে তার নিজের দেশকে আল্লাহ্ ও রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুশির চেয়ে উপরে স্থান দেয়, তাকে হুশিয়ার করে দিয়ে আল্লাহ্ বলেছেনঃ
قُلْ إِنْ كَانَ آَبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
“বল, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ্, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা প্রিয় হয়, তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভ্রাতা, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের স্বজন, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা – বাণিজ্য; যার ক্ষতির আশঙ্কা কর, এবং তোমাদের বাসস্থান, যা তোমরা ভালবাস; তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে আল্লাহ্ সৎপথ প্রদর্শন করেন না।” [182]
এই আয়াতে “….তোমাদের আবাসস্থল যাকে তোমরা পছন্দ করো….।” বলতে স্বদেশের প্রতি টানকেই বোঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যেসব মুসলিম মুশরিকদের মাঝে বসবাস করে, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”[183] এছাড়া জাতীয়তাবাদ একটি অঞ্চলের মুসলিম ও অমুসলিম উভয়কে সমান মনে করে, যেটা খুবই ভয়ংকর অপরাধ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ইসলামই কর্তৃত্ব করে এবং এর উপর কেউ কর্তৃত্ব করতে পারে না।” [184]
একইভাবে জাতীয়তাবাদ দাবী করে যে, একজন মুসলিম যদি অপর এক মুসলিমের মতো একই দেশে জন্মগ্রহণ না করে, তাহলে সে হলো ভিন্ন জাতি। এটাও ইসলাম বিরোধী বক্তব্য। কারণ, দুইজন মুসলিম ভাই-ভাই, তাদের দেশ যত দূরেই হোক না কেন।
জাহিলিয়াতের এসব বন্ধনের মাঝে জাতীয়তাবাদ ছাড়াও আছে গোত্রবাদ বা ক্বওমিয়্যাহ অর্থাৎ, নিজেকে কোন নির্দিষ্ট গোত্র বা নির্দিষ্ট জাতের কিছু মানুষের সাথে সম্পর্কিত মনে করা। যারা এই ভ্রান্তির মাঝে আছে তারা এটাকে অন্য সব বন্ধনের উপরে স্থান দেয় এবং এই গোত্রের স্বার্থেই যুদ্ধ করে। এটা হলো ইসলাম-পূর্ব যুগের জাহিলিয়াত যার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ “এটা ছেড়ে দাও, কারণ এটা নোংরা।” [185] এবং যে এই গোত্রবাদের জন্য যুদ্ধ করে তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “তার মৃত্যু হলো জাহিলিয়াতের মৃত্যু।[186]
এবং পূর্বের আয়াতে “… তোমার আত্মীয়স্বজন …”বলতে এই গোত্রবাদের বাঁধনের কথাই বলা হয়েছে, এবং আল্লাহ্ আমাদের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন নাবীদের কথা যারা তাদের মুশরিক স্বজনদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন,আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ
قَالَ يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ فَلا تَسْأَلْنِ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنِّي أَعِظُكَ أَنْ تَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ
“তিনি (আল্লাহ্) বললেন, হে নূহ, নিশ্চয় সে তোমার পরিজনের অন্তর্ভুক্ত নয়, নিশ্চয় সে অসৎকর্মপরায়ণ। অতএব, যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করো না, আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি – তুমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” [187]
এবং তিনি বলেনঃ
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ
“তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ আছে, তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল – তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর তার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই, আমরা তোমাদের মানি না। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে চিরশত্রুতা ও বিদ্ধেষ সৃষ্টি হবে, যদি না তোমরা এক আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন কর। ….”[188]
এই আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে শারীয়াহ অনুযায়ী একমাত্র বাঁধন হলো ইসলামের বাঁধন এবং আল্লাহর প্রতি ঈমানের বাঁধন। এবং এ ছাড়া অন্য কোন বাঁধনের কথা চিন্তাও করা যাবে না। সুতরাং ভালবাসা এবং শত্রুতা শুধু ঈমানের উপরই নির্ভর করে: “….যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো।”
জাহিলিয়াহর বন্ধনের মাঝে আরো আছে ভাষা, বর্ণ, বা সুযোগ-সুবিধা ভিত্তিক বন্ধন। এগুলোর সবই নিষিদ্ধ, এর প্রমাণ হলো আল্লাহর বাণীঃ
وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا
“…. যে সম্পদ তোমরা অর্জন করেছ, তোমাদের ব্যবসা যার ক্ষতি তোমরা আশংকা কর….।” [189]
এসব কোন বন্ধনই মুসলিমদের চিন্তায় আসতে পারে না, বিশেষতঃ এগুলো যখন ইসলামী শারীয়াহর বিরুদ্ধে যায়। এবং এইসব বন্ধনের ধারণা তৈরী করেছে কাফিররা যাতে তারা মুসলিমদের বিভক্ত করতে পারে এবং মুসলিমদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা তৈরি করে দিতে পারে। আল্লাহ আমাদেরকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنْ تُطِيعُوا فَرِيقًا مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ يَرُدُّوكُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ كَافِرِينَ
وَكَيْفَ تَكْفُرُونَ وَأَنْتُمْ تُتْلَى عَلَيْكُمْ آَيَاتُ اللَّهِ وَفِيكُمْ رَسُولُهُ وَمَنْ يَعْتَصِمْ بِاللَّهِ فَقَدْ هُدِيَ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلا تَمُوتُنَّ إِلا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آَيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
“হে ঈমানদারগণ! যাদের কিতাব দেয়া হয়েছে, যদি তোমরা তাদের এক দলের অনুসরণ কর, তবে তারা তোমাদেরকে তোমাদের বিশ্বাসের পর আবার কাফিরে পরিণত করবে। কিরূপে তোমরা কুফরী করতে পার – যখন আল্লাহর নিদর্শনাবলী তোমাদের নিকট পঠিত হয়, এবং তোমাদের মধ্যে তাঁর রাসূল বিদ্যমান আছেন। এবং যে কেউ আল্লাহর পথ অবলম্বন করবে, সে সরল পথে পরিচালিত হবে। হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় কর, এবং তোমরা মুসলমান না হয়ে মরো না। এবং তোমরা সকলে আল্লাহর রশি দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতি-সঞ্চার করেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হলে। তোমরা অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে ছিলে, অনন্তর তিনিই তোমাদের তা হতে উদ্ধার করেন; এরূপে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য স্বীয় নিদর্শনাবলী ব্যক্ত করেন। যেন তোমরা সুপথ প্রাপ্ত হও। তোমাদের মধ্যে এরূপ একদল হওয়া উচিত- যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে; এরাই সফলকাম। তোমরা তাদের মতো হবে না, যাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও বিচ্ছিন্ন হয়েছে, ও নিজেদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করেছে, তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে।” [190]
এতক্ষণ যা যা বলা হয়েছে, তার সারমর্ম হলো যে, মুসলিমদের বুঝতে হবে যে তাদের আনুগত্য, তাদের প্রচেষ্টা, তাদের সাহায্য- সহযোগিতা এই সবকিছুরই ভিত্তি হলো তাদের ঈমানের বাঁধন। এবং এটা ছাড়া একজন মুসলিমের জন্য আর কোন বন্ধন নেই, কারণ অন্য সব বন্ধনই হলো জাহিলিয়াহ। সুতরাং অন্যসব বন্ধনের উপর ভিত্তি করে বন্ধুত্ব করা বা ঐসব বন্ধনের জন্য যুদ্ধ করা হারাম। এবং সবচেয়ে পূর্বে অবস্থানকারী মুসলিমও সবচেয়ে পশ্চিমে অবস্থানকারী মুসলিমের ভাই, তাদের গায়ের রং, তাদের ভাষা, তাদের গোত্র যতো ভিন্নই হোক না কেন। এবং এই ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানো, দ্বীনের খাতিরে তাকে সাহায্য করা প্রত্যেক মুসলিমের উপরই তার নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ফরয।
ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ সবচেয়ে নিকটবর্তী শত্রুর সাথে যুদ্ধ শুরু করা আবশ্যক
আল্লাহ্ বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُمْ مِنَ الْكُفَّارِ
“হে মু’মিনগণ! কাফিরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সাথে যুদ্ধ কর…”[191]
ইবনে কুদামাহ (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর গ্রন্থে আলোচনা করেছেন, “.. ‘আলোচ্য বিষয়ঃ প্রত্যেক জাতি তার নিকটবর্তী শত্রুর সাথে যুদ্ধ করবে’ – আর এই নীতির ভিত্তি রয়েছে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)-র কিতাবে, “হে মু’মিনগণ! কাফিরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সাথে যুদ্ধ কর…”… কারণ সবচেয়ে নিকটবর্তী শত্রুই সবচেয়ে বিপদজনক। এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ফলে তাদের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত হবে ঐ জাতি যারা তাদের সম্মুখে অবস্থান করছিল এবং ঐ জাতিও যারা তাদের পেছনে অবস্থান করছে। একে বাদ দিয়ে দূরবর্তী শত্রুকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে সে এই সুযোগে মুসলিমদের উপর চড়াও হতে পারে কারণ মুসলিমরা অন্য শত্রু নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে।” তিনি আরো বলেনঃ “তবে যদি দূরবর্তী শত্রুকে আক্রমণ করার কোন বিশেষ কারণ থাকে, অর্থাৎ সে যদি অধিক বিপদজনক হয় এবং তাকে আক্রমণ করার মাঝে কোন বিশেষ সুবিধা থাকে, কারণ সে তার (নিকটবর্তী শত্রু) খুব কাছে এমন যেকোন সময় তাকে পরাভূত করে ফেলতে পারে; অথবা যদি নিকটবর্তী শত্রু ‘হুদনাহ্’ বা চুক্তিতে আবদ্ধ থাকে; অথবা অন্য কোন বিশেষ কারণে তাকে আক্রমণ করা থেকে সংযত থাকা লাগে; তাহলে দূরবর্তী শক্তিকে আক্রমণ করতে কোন সমস্যা নেই, কারণ এটাই পরিস্থিতির দাবী।” [192]
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসীর (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ “আল্লাহ্ তা’আলা মু’মিনদের হুকুম করেছেন একের পর এক কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য; সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং এরপর তার পরবর্তী। আর একারণেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বপ্রথম আরব উপদ্বীপের (জাজিরা) মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তিনি যখন এই কাজ শেষ করলেন এবং আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাকে মক্কা, আল মদীনা, আত তাইফ, ইয়েমেন, ইয়ামামাহ্, হাজর, খায়বার, হাদরামাউত, আরবের অন্যান্য এলাকার উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে দিলেন এবং আরবের বিভিন্ন গোত্র থেকে মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে থাকলো; তখন তিনি আহলে কিতাবদের সাথে যুদ্ধ শুরু করলেন। সুতরাং তিনি রোমানদের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন কারণ তারাই ছিল জাজিরাতুল আরবের সবচেয়ে নিকটবর্তী…”, এরপর তিনি (ইবনে কাসীর) বলেনঃ “… রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তেকালের পর আবু বাকর রদিআল্লাহু আনহু মুসলিমদের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন; যিনি ছিলেন একাধারে তার উজির, তার বন্ধু এবং তার খলিফা। এই সময় ইসলামের অস্তিত্ব এক মহাসংকটে পতিত হয়।
আল্লাহ্ তা’আলা তাকে দিয়ে এই দ্বীনে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনেন; তিনি এই দ্বীনের ভিত্তিসমূহ মজবুত ও সুসংহত করেন; তিনি তাদেরকে ফিরিয়ে আনেন যারা দ্বীন ত্যাগ করেছিল, তিনি মানুষকে রিদ্দাহ্ (ধর্মত্যাগ) থেকে ইসলামে প্রবেশ করান; যাকাত প্রদানে অস্বীকারকারী মানুষের কাছ থেকে যাকাত আদায় করেন এবং যারা জাহেল ছিল তাদের কাছে তিনি সত্যকে তুলে ধরেন। আর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া কাজগুলো সম্পাদন করেন। তিনি মুসলিম বাহিনীকে ক্রসের উপাসক রোমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত করেন। আর আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাঁর রহমতের গুনে কিসরা ও কায়সারকে তাদের অনুসারীসহ দমন করেন। আর তিনি এদের সম্পদসমূহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশমতো আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেন। আর এসকল কাজের পরিপূর্ণতা দেয়ার দায়িত্ব পড়ে তারই স্থলাভিষিক্ত একান্ত সহচর আল ফারুক (পার্থক্যকারী), আল আউওয়াব (ক্ষমা প্রার্থনাকারী), শহীদ আল মিহরাব, আবি আল হাফস, উমার ইবনুল খাত্তাব রদিআল্লাহু আনহুর উপর। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাকে দিয়ে কাফির নাস্তিকদের আঘাত করেন; সীমালংঘনকারী ও মুনাফিকদের দমন করেন এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমের রাজত্বসমূহ দখল করেন…”, তিনি (ইবনে কাসীর) আরো বলেনঃ
“… যখনই তারা একটি জাতিকে জয় করত, তারা তার পরবর্তী জাতিকে আক্রমণ করতে এগিয়ে যেত, তারপর তাদের নিকটবর্তী অহংকারী অনৈতিক জাতির দিকে অগ্রসর হত। আর এভাবেই তারা আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)র ঐ আদেশের অনুসরণ করত,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُمْ مِنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوا فِيكُمْ غِلْظَةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ
“হে মু’মিনগণ! কাফিরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সাথে যুদ্ধ কর…”[193]
চতুর্দশ অধ্যায়ঃ অবাধ্য মুরতাদদের সাথে যুদ্ধ করা স্বভাবজাত কাফিরদের সাথে যুদ্ধের চেয়ে বেশী জরুরী
কারণ ধর্মত্যাগীরা বড় অপরাধী এবং তারা খুব বড় হুমকিস্বরূপ। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ্ (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ
“ভিন্ন ভিন্ন কারণে এ বিষয়টি সুন্নাহ্ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যে, ধর্মত্যাগী মুরতাদের শাস্তি স্বভাবজাত কাফিরের শাস্তির চেয়ে গুরুতর। যার মাঝে একটি কারণ বা প্রমাণ হলো, মুরতাদকে সকল পরিস্থিতিতে হত্যা করার হুকুম রয়েছে, তার জন্য জিযিয়ার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি, তাকে কোন প্রকার নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়নি; যেগুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বভাবজাত কাফিরদের দেয়া হয়েছে। এছাড়াও একটি মুরতাদকে যুদ্ধে অপারগ হওয়া সত্ত্বেও হত্যার হুকুম রয়েছে, যেখানে একজন কাফির যদি যুদ্ধরত গোষ্ঠীর না হয় তবে তার জন্য শিথিলতা রয়েছে; আবু হানিফা, মালিক, আহমাদ (রহিমাহুল্লাহ)-সহ অধিকাংশ আলেম তাদের হত্যা না করার পক্ষে বলেছেন। আর অধিকাংশ মাযহাবের মতে মুরতাদদের হত্যা করতে হবে, যার মাঝে রয়েছে মালিক, আশ শাফেয়ী, ও আহমাদের (রহিমাহুল্লাহ) মাযহাব।” [194]
“আর ইজমা অনুযায়ী স্বভাবজাত কুফরের চেয়ে ধর্মত্যাগের কুফর বেশী গুরুতর।”[195]
ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) অন্যত্র বলেনঃ “এবং আস্ সিদ্দিক (আবু বাকর (রদিয়াল্লাহু আনহু)) এবং অন্যান্য সাহাবাগণ কাফির আহলে কিতাবীদের সাথে যুদ্ধ করার আগে মুরতাদদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। কারণ এই জিহাদ ছিল ইসলামী ভূখণ্ডের অস্তিত্ব রক্ষার জিহাদ এবং এর কারণে, যারা ইসলাম ত্যাগ করতে চেয়েছিল তারা ইসলামে প্রবেশ করবে। আর মুশরিক ও কাফিরদের মধ্যে যারা আমাদের সাথে যুদ্ধে জড়ায়নি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ হলো ইসলামী ভূখণ্ড সম্প্রসারণের জন্য জিহাদ। অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটির তুলনা হলো, আগে ব্যবসার মূলধন রক্ষা এবং তারপর মুনাফার চিন্তা।” [196]
আমার (লেখক) বক্তব্য হলোঃ এ ব্যাপারে সাহাবাগণ একমত ছিলেন যে, যুদ্ধ প্রথমে হবে মুরতাদদের বিরুদ্ধে। আবু বাকর (রদিয়াল্লাহু আনহু)-এর খিলাফতের শুরুতে রোমানদের উদ্দেশ্যে উসামা বিন যায়িদের (রদিয়াল্লাহু আনহু) বাহিনী প্রেরণের ঘটনাটি যেন এ ব্যাপারে কাউকে বিভ্রান্ত না করে। কারণ, এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ পালনই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। আর তাছাড়া এর দ্বারা ঐসব ব্যক্তিদের ভয় দেখানোর একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল যারা ধর্মত্যাগের পরিকল্পনা করছিল।
পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ শাসক যদি কুফরী করে এবং এতে অনড় থাকে, তাহলে তার সাথে যুদ্ধ করা আবশ্যক, এটি ফারদুল আইন। আর অন্য সকল বিষয়ের উপর এটি প্রাধান্য পাবে
১) এই হুকুমটি ঐসব শাসকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে শারীয়াহ ব্যতীত অন্য আইন প্রয়োগ করে। তারা আল্লাহ্ তা’আলার বক্তব্য অনুযায়ী কাফিরঃ
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
“আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিচার ফয়সালা করে না, তারাই কাফির।” [197]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরো বলেছেন,
ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ
“এতদসত্ত্বেও কাফিররা তাদের রবের সমকক্ষ দাঁড় করায়।” [198]
এছাড়াও আরো অনেক দলীল দ্বারা তারা কাফির প্রতিপন্ন। কিন্তু এদের অধিকাংশই নিজেদের মুসলিম বলে দাবী করে। সুতরাং তাদের কুফরীর কারণে তারা মুরতাদে পরিণত হয়। আর বাস্তব অবস্থা হলো এইসব শাসক যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান বাদ দিয়ে অন্য বিধানে শাসন করে, তারা তাদের ইচ্ছামত যেকোন আইন দিয়ে মানুষদের শাসন করে। অর্থাৎ তারা নিজেদের আল্লাহর পাশাপাশি মানুষের প্রভু ও দেবতা হিসেবে স্থাপন করেছে, যেমনটি আল্লাহ্ বলেছেন,
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ
“তাদের কি এমন কতক শরীক দেবতা আছে যারা তাদের জন্য বিধান দিয়েছে এমন দ্বীনের যার অনুমতি আল্লাহ্ দেননি।” [199]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ
“তারা (ইহুদী এবং খ্রিষ্টানরা) আল্লাহ্ ব্যতীত তাদের পন্ডিত ও সংসার বিরাগীগণকে তাদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে…”[200]
আর তাদের কুফরের মাত্রা আরো বর্ধিত ও দৃঢ় হয় যখন তারা আল্লা হর রাস্তায় বাঁধা প্রদান করে। আর এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিত আলোচনা করে ‘আদ দাওয়াহ আত তাওহীদ’ নামক অন্য একটি গ্রন্থে, যেটা মূলত সূরা মায়িদাহ এর ঐ আয়াত সংক্রান্ত কিছু বিভ্রান্তির জবাব দেয়ার জন্য লিখেছি, যেখানে আল্লাহ্ বলেছেনঃ “আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিচার ফয়সালা করে না, তারাই কাফির।” আর এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছি যে এ আয়াতটি যেকোন দৃষ্টিকোণ থেকেই একটি স্পষ্ট আয়াত এবং এতে বর্ণিত কুফরটি ‘বড় কুফর’ বা কুফর আল আকবার। আরও ব্যাখ্যা করেছি যে ফিকহের উসূল অনুযায়ী, যখন একজন সাহাবার বক্তব্য কোরআনের ব্যাখ্যার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তখন আমরা সেই বক্তব্যকে গ্রহণ করি যেটি কিতাব আর সুন্নাহ দ্বারা অধিক সমর্থিত। আর তাছাড়া এ বিষয়টিও স্পষ্ট করেছি যে, বিভিন্ন মুসলিম দেশে বিরাজমান বর্তমান পরিস্থিতি এবং এই আয়াত নাযিলের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ এক। যা হলো আল্লাহর শারীয়াহ বাদ দেয়া এবং এর পরিবর্তে নতুন ব্যবস্থা তৈরী করা ও সেগুলোকে আইনে রূপান্তর করে মানুষের উপর তা চাপিয়ে দেয়া, ঠিক যেভাবে ইহুদীরা যেনার শাস্তি পাথর নিক্ষেপকে বাদ দিয়ে নিজেরা পাল্টা আইন দিয়েছিল। আর আমার বইতে আমি এও বলেছি যে, ফিকহের উসূল অনুযায়ী, এই আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ সম্পূর্ণরূপে এই আলোচনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইসমাঈল আল কাযী একথাই বলেছেন। ইবনে হাযার আল আসকালানীর বর্ণনায় পাওয়া যায়, “আর ইসমাঈল আল কাযী তার আহকাম ‘আল কুরআন’ গ্রন্থে এই আয়াতের বাহ্যিক অর্থ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘ এই আয়াতের বাহ্যিক অর্থ হলো যে ব্যক্তি ঐ কাজ করবে যা তারা (ইহুদীরাঃ যাদের ব্যাপারে এই আয়াত নাযিল হয়েছে) করেছিল এবং নতুন আইন উদ্ভাবন করবে যা আল্লাহর আইনের বিরোধী এবং এটিকে দ্বীনের একটি অত্যাবশ্যক রূপে পরিণত করবে; সে শাসক হোক আর নাই হোক; তার ব্যাপারে সেই একই রায় যে রায় বা হুমকি রয়েছে তাদের (ইহুদী) জন্য।” [201] সুতরাং যারা তাদের সাথে এই বানোয়াট আইনকে আরো পরিবর্ধনের কাজে অংশ নেয় সে একটি কাফির যে কুফর আল আকবার করেছে, যা একজন ব্যক্তিকে ইসলামের মিল্লাত থেকে বের করে দেয়, যদিও বা সে ইসলামের পাঁচটি ভিত্তি এবং আরো অন্যান্য কর্মকাণ্ড পালন করে। আর এটি বর্তমান সময়ের অধিকাংশ আলেম সমর্থন করেছেন, যা আমি এই বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে আহমাদ শাকির, মুহাম্মাদ হামিদ আল ফিক্কি ও মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহীম আল আশ শাইখ প্রমুখের উক্তি দিয়ে আলোচনা করেছি। আর উপরোক্ত গ্রন্থে আমি ব্যাখ্যা করেছি – ইসলামী শারীয়াহ অনুযায়ী কাদেরকে ‘শাসক’ বলে আখ্যা দেয়া যায়।
২) আর এই মুরতাদ শাসকের পক্ষে যদি কোন ব্যাখ্যা না থাকে; তাহলে তাকে সত্ত্বর অপসারণ করা অত্যাবশ্যক। আর তাকে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে, এতে যদি সে তাওবা করে তাহলে ছেড়ে দেয়া হবে অন্যথায় তাকে হত্যা করতে হবে।
আর যদি সে তওবা করে, তারপর তাকে আবার শাসনভার দেয়া যাবে না, এটাই ছিল আবু বাকর ও উমার (রদিয়াল্লাহু আনহু) এর সুন্নাত। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের উপর (অনুসরণের জন্য ন্যস্ত) হলো আমার সুন্নাহ এবং আমার পরবর্তী খুলাফায়ে রাশিদীন-এর সুন্নাহ। এগুলোকে আঁকড়ে ধর মাড়ির দাঁত দ্বারা।” [202] শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “আর না উমার না আবু বাকর কেউই কোনদিন কোন মুনাফিককে মুসলিমদের উপর (আমীর) নিযুক্ত করেননি এবং তাদের কোন আত্মীয়কেও নিয়োগ দেননি।
আর তারা কোন দিনই সমালোচকদের সমালোচনার ভয়ে আল্লাহর অধিকারে হাত দেননি। বরং তারা যখন মুরতাদদের সাথে যুদ্ধ করলেন এবং তাদের দ্বীনে ফিরিয়ে আনলেন তখন তারা তাদের ঘোড়ায় চড়া ও অস্ত্র বহন করা নিষিদ্ধ করেছিলেন যতদিন না তাদের তাওবার প্রমাণ প্রকাশিত হয়েছিল। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রদিয়াল্লাহু আনহু) যখন ইরাকের আমীর ছিলেন তখন উমার (রদিয়াল্লাহু আনহু) তাকে বলতেন, ‘তাদের কাউকে নিয়োগ দিও না এবং যুদ্ধের (বিষয়াদির) ব্যাপারে তাদের পরামর্শ নিও না।’ অথচ কিছু বিখ্যাত নেতা ছিলেন তালহা আল আসাদী, আল আকরা ইবনে হাবিস, উওয়াইনা ইবনে হিছন এবং আল আস’আত ইবনে কায়স আল-কিন্দী এবং তাদের মত আরো অনেকে। সুতরাং তাদের ব্যাপারে যখন আবু বাকর ও উমার (রদিয়াল্লাহু আনহু) কোন প্রকারের নিফাকের আশংকা করতেন তখন তারা তাদেরকে মুসলিমদের উপরে দায়িত্ব দিতেন না।” [203]
৩) আর যদি মুরতাদ শাসক একটি বাহিনীকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে; তাহলে তাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করা আবশ্যক এবং তার পক্ষে যে যুদ্ধ করবে সেও তার মতই একজন কাফির। কারণ আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেনঃ
وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ
“তোমাদের কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন হবে।” [204]
এখানে ‘তোমাদের কেউ’ শব্দটি শর্তসূচক (ইসমে শাত্তর্), সুতরাং এর দ্বারা তাদের সকলকেই বোঝায় যারা কাফিরদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে, এবং তাদেরকে কথায় ও কাজে সমর্থন দেয়। শায়খুল ইসলাম ইমাম আব্দুল ওয়াহ্হাব ও অন্যান্যরা বলেছেন যে ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়াবলীর মাঝে একটি হলোঃ “মুশরিকদের পক্ষ নেয়া এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের সহায়তা করা। এর প্রমাণ হলো আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)-র বাণীঃ তোমাদের কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন হবে। নিশ্চয় আল্লাহ্ যালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।” [205] সুতরাং মুরতাদদের সাথে জিহাদের সাথে সাথে এদের সকলের বিরুদ্ধে জিহাদ চালাতে হবে; যদিও তারা দুই কালেমা উচ্চারণ করে এবং ইসলামের প্রকাশ্য কিছু আমল করে;কারণ তারা এমন কাজ করেছে যা তাদের ইসলামের ভিত্তিকেই নষ্ট করে দিয়েছে। আর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
الَّذِينَ آَمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ
“যারা মু’মিন তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে এবং যারা কাফির তারা তাগুতের পথে যুদ্ধ করে।” [206]
অতএব যে কেউ কাফিরকে তার কুফরীতে কথায় ও কাজে সমর্থন দেবে সেও তাদের মতই কাফির। আর এটাই এই দুনিয়ায় তার ব্যাপারে ফয়সালা কারণ সে ঈমানদার মানুষ ও জিহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। হয়তোবা সে ভেতরে ভেতরে মুসলিম; এমন কোন বিশেষ কারণ (জোরজবরদস্তি বা জানের হুমকি) থাকতে পারে যা তাকে তাকফিরের পর্যায়ে ফেলে না। আর এটাই হচ্ছে তাদের ব্যাপারে ফয়সালার সুন্নাহ যারা বাঁধা দেয়। অন্য একটি গ্রন্থে আমি এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রেখেছি। আর জ্ঞানের এ বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া উচিৎ যাতে, ধ্বংসপ্রাপ্তরা সত্য প্রকাশের পর ধ্বংস হয় আর যারা টিকে থাকার তারা সত্যের উপর টিকে থাকে।
৪) শাসক যখন কুফরী করে তখন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অনুমতির দলীল হলো উবাদা ইবনুস সামিত রদিআল্লাহু আনহুর হাদীস।
তিনি বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে ডাকলেন এবং আমরা বাইয়াত হলাম। তিনি তখন আমাদেরকে যে শপথ গ্রহণ করান তার মধ্যে ছিল- ‘আমরা শুনবো ও মানবো, আমাদের অনুরাগে ও বিরাগে, আমাদের সংকটে ও স্বাচ্ছন্দ্যে এবং আমাদের উপর অন্যকে প্রাধান্য দিলেও যোগ্য ব্যক্তির সাথে আমরা নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল করবো না।’ তিনি বলেন, যে যাবৎ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলীল থাকবে।’”[207]
আন নববী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “আল কাযী আইয়াদ বলেন, ‘আলেমগণ এব্যাপারে ইজমা করেছেন যে, কাফিরের হাতে নেতৃত্ব দেয়া যাবে না; সুতরাং তার (নেতা) থেকে যদি কুফরী প্রকাশ পায়, তাহলে তাকে অপসারণ করতে হবে।’”তিনি আরো বলেন,“সুতরাং তার থেকে কোন কুফরী বা শারীয়াহ পরিবর্তন বা বিদয়াত প্রকাশ পেলে, তাহলে সে তার দায়িত্ব থেকে খারিজ হয়ে গেল এবং তার আনুগত্যের হক সে হারালো; আর এ অবস্থায় মুসলিমদের জন্য আবশ্যক যে তারা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, তাকে অপসারণ করবে এবং একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক নিয়োগ করবে যদি তাদের পক্ষে সম্ভব হয়। আর যদি একদল মানুষ ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এটি সম্ভব না হয় তবে ঐ দলটিকে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং ঐ কাফিরকে অপসারণ করতে হবে। তবে বিদ’আতীর ক্ষেত্রে এটি আবশ্যক নয় যদি না তারা মনে করে যে তারা এটি করতে সক্ষম। অর্থাৎ যদি সত্যিই অক্ষমতা বিরাজ করে তাহলে বিদ্রোহ করা আবশ্যক নয়, তবে মুসলিমদের ঐ ভূমি থেকে অন্য কোথাও তাদের দ্বীন নিয়ে হিজরত করতে হবে।” [208]
লেখকের বক্তব্যঃ আর এই ইজমা, যার কথা ইবনাল কাযী উল্লেখ করেছেন; তার ব্যাপারে ইবনে হাজার বর্ণনা করেছেন যিনি ইবনে বাত্তাল, ইবনে আত তীন, আদ দাউদী প্রমুখের ইজমা রয়েছে এবং ইবনে হাজার স্বয়ং তাতে সমর্থন দিয়েছেন।
আর ইবনে হাজার বলেন, যদি শাসক কুফরী করেঃ “আর এ ব্যাপারে ইজমার সারমর্ম হলো তাকে তার কুফরীর কারণে অপসারণ করতে হবে। সুতরাং প্রতিটি মুসলিমকে এই উদ্দেশ্যে রুখে দাঁড়াতে হবে।” [209]
৫) আর মুসলিমরা যদি এটি করতে অক্ষম হয় তাহলে অন্তত এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা আবশ্যক।
ঠিক এ কথাটিই বলেছেন ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ), “জিহাদে যাবার জন্য অস্ত্র শস্ত্র প্রস্তুত করা যেমন আবশ্যক; তেমনি অক্ষমতার কারণে জিহাদ বন্ধ থাকলে (এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা আবশ্যক), কারণ যখন কোন (আবশ্যিক) কাজ অন্য একটি কাজ সম্পাদনের উপর নির্ভরশীল হয়, তখন সেই কাজটিও আবশ্যক হয়ে পড়ে।” [210]
আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন,
وَلا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا سَبَقُوا إِنَّهُمْ لا يُعْجِزُونَ
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ
“কাফিররা যেন কখনো মনে না করে যে তারা পরিত্রাণ পেয়েছে; নিশ্চয় তারা আমাদের অক্ষম করতে পারবে না। তোমরা তাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি প্রস্তুত রাখবে।” [211]
আর নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনবার বলেন, “নিশ্চয় শক্তি হলো নিক্ষেপ করার মধ্যে।” [212]
লেখকের বক্তব্যঃ পূর্বের আলোচনা থেকে আপনারা জানতে পেরেছেন তাগুতদের বিরূদ্ধে মুসলিমদের করণীয় কি এবং এ বিষয়গুলো শারীয়াহসিদ্ধ দলীল থেকে প্রমাণিত; কোন মুসলিমের এই বিষয়গুলোকে প্রত্যাখ্যান করার এখতিয়ার নেই। মূল বক্তব্য হলোঃ “… আমরা নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল করবো না।’ তিনি বলেন, যে যাবৎ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলীল থাকবে।” আর আমি আগেই উল্লেখ করেছি যাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আবশ্যকতার ব্যাপারে ইজমা হয়েছে। আর একারণেই এ ব্যাপারে ইজতিহাদ (পর্যালোচনা) করার কোন অবকাশ নেই যে, তাগুতের সাথে কেমনভাবে আচরণ করতে হবে, কারণ যেখানে কিতাবের দলীল আছে এবং ইজমা হয়েছে সেখানে ইজতিহাদের কোন স্থান নেই। আর কিতাবের স্পষ্ট দলীল ও ইজমা থাকার পরও যে এ নিয়ে ইজতিহাদ করবে সে চরম পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত। এরাই সেই দল যারা পালার্মেন্ট বা শিরক বা এমনই অন্যান্য পন্থায় ইসলাম কায়েম করতে চায়। আর যদি কেউ বলে যে অক্ষমতার কারণে তারা জিহাদ করছে না তাহলে আমরা বলব যে, এ অবস্থায় তোমার জন্য জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করার আদেশ রয়েছে শিরকের পার্লামেন্টে যাওয়ার কোন অনুমতি নেই। আর যদি সত্যিই অক্ষমতা থাকে তাহলে হিজরাত করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। আর সে যদি হিজরত করতেও অক্ষম হয় তাহলে সে একজন দুর্বল মুসলিমরূপে আল্লাহর কাছে দু’আ করতে পারে; যাদের ব্যাপারে আল্লাহ্ বলেছেন,
الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَل لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَل لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا
“…যারা বলে, ‘হে আমাদের রব! এই জনপদ যাদের অধিবাসীরা যালিম, তা হতে আমাদের বের করে (অন্যত্র) নিয়ে যাও; এবং তোমার নিকট থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার নিকট থেকে কাউকে আমাদের সহায় কর।’”[213]
আর যে পার্লামেন্টে যোগ দেয় তার ব্যাপারে বক্তব্য হলোঃ কোন মুসলিম এটি করতে পারে না কারণ এর দ্বারা গণতন্ত্রের মাঝে তার সন্তুষ্ট প্রকাশ পায়; যেখানে মানুষের হাতে নেতৃত্ব দেয়া হয় এই উদ্দেশ্যে যে এসব প্রতিনিধির সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাই আইন যা ঐ দেশে কার্যকর হবে। আর এটাই সেই কুফর যার ব্যাপারে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেনঃ
وَلا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ
“…আমরা কেউ কাউকে আল্লাহ্ ব্যতীত রব হিসেবে গ্রহণ না করি।” [214]
পার্লামেন্টের সদস্যরাই এই আয়াতে বর্ণিত রব (হিসেবে নেয়া হয়) আর এটাই হলো কুফরের মূল বা গোঁড়া। আর কেউ যদি এ ব্যাপারে অজ্ঞ থাকে তাহলে তাকে এটি জানানো আবশ্যক। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ آَيَاتِ اللَّهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلا تَقْعُدُوا مَعَهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ
“কিতাবে তিনি তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর আয়াত প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে এবং একে বিদ্রূপ করা হচ্ছে, তখন যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত না হবে তোমরা তাদের সাথে বসবে না, অন্যথায় তোমরাও তাদের মত হবে।” [215]
সুতরাং তাদের সাথে বসবে এবং তাদের কুফরের সাক্ষী হবে সেও তাদের মত কাফির।
৬) আর এসব মুরতাদ শাসক ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে জিহাদ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফারদুল আইন, শুধুমাত্র তারাই অব্যাহতি পাবে যাদের পক্ষে শারীয়াহ সম্মত ওযর আছে।
জিহাদ যে তিনটি ক্ষেত্রে ফারদুল আইন হয় সে ব্যাপারে ইতিপূর্বেই আলোচনা হয়েছে। এর মাঝে একটি হলো যখন কাফির বাহিনী মুসলিম রাষ্ট্র আক্রমণ করে। আর এই পরিস্থিতিরই উদয় হয় যখন এসব মুরতাদরা মুসলিমদের উপর শাসন করে। সুতরাং তারাই হলো কাফির বাহিনী যারা মুসলিমদের জমীনে আক্রমণ চালিয়েছে, সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফারদুল আইন। এ সম্পর্কে আল কাযী আইয়াদ বলেন, “.. আর এ অবস্থায় মুসলিমদের জন্য আবশ্যক যে তারা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।” আর এই বক্তব্যটি আরো স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় আল হাফিয ইবনে হাযারের উক্তিতে, “আর এ ব্যাপারে ইজমার সারমর্ম হলো তাকে তার কুফরীর কারণে অপসারণ করতে হবে। সুতরাং প্রতিটি মুসলিমকে এই উদ্দেশ্যে রুখে দাঁড়াতে হবে।” আর এটাই হলো উবাদা ইবনুস সামিত রদিআল্লাহু আনহুর হাদীসের প্রকৃত শিক্ষা।
লেখকের বক্তব্যঃ আর এসব তাওয়াগীতের বিরুদ্ধে জিহাদ করা যে ফারদুল আইন এই জ্ঞানটি এমন একটি জ্ঞান যা প্রতিটি মুসলিমের নিকট পৌঁছে দেয়া কর্তব্য, যাতে তারা জানতে পারে তাদের প্রত্যেকের উপর আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) (এসব শাসকের বিরুদ্ধে) জিহাদের হুকুম দিয়েছেন। কারণ এসব তাওয়াগীত সাধারণ মুসলিম ও মুজাহিদীন মুসলিমদের মাঝে ব্যবধানের এক বিরাট প্রাচীর তৈরী করে রাখে, যাতে সাধারণ মানুষের জাহিলিয়াত ও নিস্তব্ধতার আড়ালে তারা ঐসব দৃঢ়পদ মুসলিমদের উপর খুব সহজে আঘাত হানতে পারে। আর এই হুকুমটি যেভাবে এসেছে তা সকল মুসলিমের দিকেই ইঙ্গিত দেয় হোক সে ফাসিক যার উপরে শাস্তি অবধার্য হয়ে পড়েছে, কারণ কোন পাপের কারণে কেউ জিহাদের হুকুম থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে না। সুতরাং যারা দ্বীনের জন্য জিহাদ করছেন তাদের দায়িত্ব হলো সাধারণ মানুষকে জানানোর উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগতভাবে এবং ব্যাপক আকারে দাওয়াহ কার্যক্রমের মাধ্যমে এইসব ব্যবধান সৃষ্টিকারী প্রাচীরগুলো ভেঙ্গে ফেলা যাতে জিহাদ এমন অল্পকিছু মানুষ; যাদের একদিনে বা একরাতে শেষ করে দেয়া সম্ভব; তাদের ব্যাপার না হয়ে সকল মুসলিমের সাথে সম্পৃক্ত একটি বিষয়ে পরিণত হয়। সেইসাথে জিহাদ যেন মানুষের একটি গোষ্ঠীর বিষয় না হয়ে সকল মানুষের সাথে সম্পৃক্ত একটি বিষয়ে রূপলাভ করে। আর এভাবেই পুরো পরিস্থিতি তাওয়াগীত ও তার বাহিনীর বিপক্ষে চলে যাবে। আর এরপর তাদের কুফর প্রকাশ হয়ে গেলে তারাই জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
وَأَخْرِجُوهُمْ مِنْ حَيْثُ أَخْرَجُوكُمْ
“..তোমরাও সেই স্থান থেকে তাদের বহিষ্কার কর যে স্থান থেকে তারা তোমাদের বহিষ্কার করেছে।” [216]
আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাঁর নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলেছেনঃ “..আর তাদের বহিষ্কার কর যেভাবে তারা তোমাকে বহিষ্কার করেছিল।” [217] সুতরাং তাওয়াগীত যেমন মিথ্যা দাবী ও জাহিলিয়াত বিস্তারের মাধ্যমে সাধারণ মুসলিমদের থেকে মুজাহিদীন মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে ঠিক একইভাবে জিহাদের আবশ্যকতা সংক্রান্ত শারীয়াহ এর জ্ঞান মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে তাদেরকেও জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন করা মুসলিমদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। আর তারা যেভাবে দৃঢ়পদ মুসলিমদের সম্পদ কেড়ে নিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করেছে, যে কথা আল্লাহ্ কোরআনে উল্লেখ করেছেন,
لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ
“এই সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি থেকে উৎখাত হয়েছে।” [218]
সুতরাং একইভাবে মুজাহিদীন মুসলিমদের কর্তব্য হলো তাওয়াগীতকে তার সম্পত্তি থেকে উৎখাত করা যা দিয়ে সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করার জন্য সৈন্যবাহিনী পুষতো। এই উদ্দেশ্যেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরাইশদের উপর দুর্ভিক্ষ দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোআ করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, “যখন কুরাইশরা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দমন করেছিল এবং (মানুষকে) আহবান করছিল তাকে অস্বীকার করার জন্য, তিনি বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ্, আমাকে তাদের বিরুদ্ধে ইউসুফের সাতের মতো সাত (বছরব্যাপী দুর্ভিক্ষ) দ্বারা সাহায্য করো।’ অতঃপর তারা এমন এক বছর দ্বারা আক্রান্ত হলো যখন তারা অভাবের কারণে হাড়গোড় ও মৃত (জানোয়ার) খেয়েছিল।” [219]
আর তাগুতকে কোনভাবে টাকাপয়সা দেয়া মুসলিমদের জন্য হারাম, কর বা শুল্ক বা অন্য কোনভাবে; ব্যতিক্রম শুধু একান্ত প্রয়োজন অথবা জোর-জবরদস্তির ক্ষেত্রে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
وَلا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ
“…এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অপরকে সাহায্য করবে না।” [220]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরো বলেছেন,
وَلا تُؤْتُوا السُّفَهَاءَ أَمْوَالَكُمُ
“তোমাদের সম্পদ যা আল্লাহ্ তোমাদের জন্য উপজীবিকা করেছেন তা নির্বোধদের হাতে অর্পণ করো না।” [221]
এ কথা জেনে রাখা দরকার যে, এইসব তাগুত সরকারকে শারীয়াহ কখনোই অনুমোদন দেয় না। কারণ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “কেউ যদি এমন কাজ করে যা আমাদের এই ধর্মে (দ্বীনে) নেই তাহলে তা প্রত্যাখ্যান করা হবে।” [222] আমি আমার ‘কিতাব ও সুন্নাহর উপর কায়েম থাকার মূলনীতি’ গ্রন্থে ‘ষষ্ঠ নীতি’-তে এ বিষয়ে বর্ণনা করেছি। আর মুসলিমদের কর্তব্য হলো শক্তি প্রয়োগ করে এদের সম্পত্তি দখলের জন্য চেষ্টা করা, যেক্ষেত্রে এটি গণীমত বলে গণ্য হবে; আর চালাকী করে বা অন্য কোন উপায়ে এটি দখল করলে সেটি হবে ‘ফায়’। আমাদের নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসলিমদের উপকারের জন্য কুরাইশদের সম্পদের দখল নেয়ার উদ্দেশ্যে বাহিনী প্রেরণ করেন যার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বদরের যুদ্ধ শুরু হয়। সারকথা হলো জিহাদ অল্পকিছু মানুষের বিষয় হিসেবে না রেখে এক সার্বজনীন একটি বিষয়ে রূপান্তর করতে হবে। কারণ এটিকে অল্প কিছু মানুষের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখলে প্রতীক্ষিত পরিবর্তন সুফল পাওয়া যাবে না। আর এটা এই কারণে যে পরিবর্তনের একটি নিয়ম আছে, যা হলো,
إِنَّ اللَّهَ لا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ
“আল্লাহ্ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।” [223]
এর মানে এই নয় যে কোন এলাকার সকল জনগণ এতে অংশগ্রহণ করবে, কারণ এটি অসম্ভব ব্যাপার। এই কথা বলার উদ্দেশ্য হলো যাতে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ যাতে ইসলাম কায়েমের জন্য প্রচেষ্টা চালায় এবং এটি কায়েমের পর এক আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শত্রুদের থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। আর মানুষ যতক্ষণ না এ বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে ততদিন এই জিহাদের পক্ষে অথবা নিরপেক্ষ থাকলেই যথেষ্ট হবে। সাধারণ মানুষকে এই শিক্ষা দিতে হবে যে, কেউ তাগুতের মোকাবিলায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে না পারলেও তারা যেন এই জিহাদের বিপক্ষে অবস্থান না নেয়, তাওয়াগীতকে সাহায্য না করা ইমানের দাবী। আর যখনই তাওয়াগীতের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হবে তখন মুসলিমদের উপর আক্রমণ ও তাদের ক্ষতি করার চেষ্টা বৃদ্ধি পাবে। এবং এর মাধ্যমেই প্রতিদিন মুসলিমদের ঘর থেকে ঘরে জিহাদের বাতাস বইতে থাকবে, আর আল্লাহ্ প্রতিশ্রুত সাহায্য আসার পূর্ব পর্যন্ত এই দাওয়াহর সমর্থক বাড়তে থাকবে। নিশ্চয় তিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَنُرِيدُ أَنْ نَمُنَّ عَلَى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِي الْأَرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِينَ
وَنُمَكِّنَ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَنُرِيَ فِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَجُنُودَهُمَا مِنْهُمْ مَا كَانُوا يَحْذَرُونَ
“আমি ইচ্ছা করলাম সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে এবং উত্তরাধিকারী করতে; এবং তাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে, আর ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে সেই (জিনিস) দেখিয়ে দিতে যা তাদের নিকট তারা আশংকা করত।” [224]
৭) স্বভাবজাত অন্যান্য কাফিরদের সাথে যুদ্ধের চেয়ে, এসকল মুরতাদ শাসকদের সাথে যুদ্ধ করা অগ্রাধিকার পাবে।
প্রথমতঃ এই যুদ্ধ জিহাদ ‘আদ দিফা’য়র’ শ্রেণীভুক্ত; আর এটি ‘জিহাদ আত তালাবের’ উপর অগ্রাধিকার পায়। একে জিহাদ আদ দিফা’য়র শ্রেণীভুক্ত করার কারণ হলো যে, এসব শাসকরা হলো কাফির শত্রু যারা মুসলিম রাষ্ট্রের দখল নিয়ে রেখেছে। আর ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “আত্মরক্ষার জন্য যে জিহাদ তা হলো সবচেয়ে জরুরী, যেখানে আগ্রাসী বাহিনীকে পবিত্র ভূমি ও দ্বীন থেকে দূরে বিতাড়িত করা হয়। সুতরাং ইজমা অনুযায়ী এটি অবশ্য কর্তব্য। সুতরাং যেই আগ্রাসী শত্রু এই দ্বীন ও এই জীবনকে কলুষিত করে; ঈমান আনার পর তাদেরকে দমন করার চেয়ে অধিক আবশ্যক আর কিছু নেই। অতএব এক্ষেত্রে কোন শর্ত নেই, সম্ভব যে কোন উপায়ে তাদেরকে দমন করা অত্যাবশ্যক।[225] আর সপ্তম অধ্যায়ের আলোচনায় আমরা জেনেছি, জিহাদ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে যখন শত্রুরা মুসলিমদের কোন রাষ্ট্রে ঢুকে পড়ে।
দ্বিতীয়তঃ মূল বিষয় হলো যে, তারা মুরতাদ। আর চতুর্দশ অধ্যায়ে এ ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে যে স্বভাবজাত কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের চেয়ে মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়।
তৃতীয়তঃ আর তাছাড়া এরা মুসলিমদের সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং অধিক ফিৎনা ও হুমকিস্বরূপ। আর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُمْ مِنَ الْكُفَّارِ
“হে মু’মিনগণ কাফিরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তীর তাদের সাথে যুদ্ধ কর।…”[226]
ত্রয়োদশ অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
একটি ভুল ধারণাঃ মুরতাদরা ঐ রাষ্ট্রের নিকট বিদেশী নয়; সুতরাং বৈদেশিক আগ্রাসী শক্তির ব্যাপারে যে রায় রয়েছে তা এক্ষেত্রে অকার্যকর।
উপরে আলোচিত তিনটি বিষয়ের মধ্যে প্রথমটি নিয়ে অনেকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। কিছু কিছু ব্যক্তির মতে মুসলিম রাষ্ট্রের এসব মুরতাদদের শাসকদের সাথে বৈদেশিক আগ্রাসী কাফির তুলনা করা সঠিক নয় যে মুসলিম রাষ্ট্র দখল করেছে; যারা মুসলিম দেশ শাসন করছে তারা তো সেই দেশেরই অধিবাসী; সুতরাং এ দু’য়ের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। আসলে এসব বক্তব্যের উদ্দেশ্য হলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহর সেই ফাতওয়াকে অকেজো প্রমাণ করা, যা তিনি শারীয়াহ বিরোধী তাতারদের ব্যাপারে দিয়েছিলেন যারা নিজেদেরকে মুসলিম দাবী করত। [227] বলা হয়ে থাকে যে এই ফাতওয়াটি এক্ষেত্রে দলীল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, কারণ তাতাররা মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের কাছে ছিল ভিনদেশী। আমি আমার ‘দাওয়াহ আত তাওহীদ’ গ্রন্থে এই ফাতওয়ার ব্যবহারিক দিক নিয়ে আলোচনা করেছি।
এই ভ্রান্তির জবাবে আমরা বলতে চাইঃ মুরতাদ শাসকের আলোচনাটি একটি ভিন্ন আলোচনায় উঠে এসেছে, আর তা হলো উবাদা ইবনুস সামিতের (রদিয়াল্লাহু আনহু) হাদীস যাতে বলা হয়েছেঃ “আমরা যেন আমাদের দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে না যাই”। তিনি বলেছেন, “যাবৎ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলীল থাকবে।” আর আমি এ হাদীস সংক্রান্ত আলোচনায় বলেছি যে, এই হাদীসের দ্বারা অন্য সকল হাদীস শর্তাধীন হয়ে যায় যেসব স্থানে অত্যাচারী নেতৃত্বের সাথে সবর করতে বলা হয়েছে। যেমন ইবনে আব্বাস (রদিয়াল্লাহু আনহু) এর বর্ণিত হাদীস যেখানে তিনি বলেছেন, “কেউ যদি সুলতানের মাঝে এমন কিছু দেখে যা সে ঘৃণা করে, তাহলে সে যেন সবর করে।” আউফ বিন মালিকের (রদিয়াল্লাহু আনহু) হাদীস, “না, যতদিন পর্যন্ত তারা তোমাদের মাঝে সালাত কায়েম রাখে।” আর একারণেই ইমাম বুখারী তার সহীহ গ্রন্থের ‘কিতাব আল-ফিতান’ অধ্যায়ে ইবনে আব্বাস (রদিয়াল্লাহু আনহু) এর হাদীসের পর উবাদা ইবনুস সামিতের (রদিয়াল্লাহু আনহু) হাদীস উল্লেখ করেছেন, যাতে তার পক্ষ থেকে এই বর্ণিত সীমারেখাটি দৃশ্যমান হয়। আর এইসব শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আবশ্যকতা স্পষ্ট করতে একজন বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষের জন্য এটাই যথেষ্ট।
আর আমরা উপরোক্ত তিনটি বিষয়ের উপর আলোকপাত এই কারণে করিনি যাতে ইসলামী শারীয়াহ এর সাথে এই বিদ্রোহের সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা হয়, কারণ উবাদা ইবনুস সামিতের হাদীসে এটি স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে; আমাদের উদ্দেশ্য বরং ছিল এই হাদীসের বক্তব্যের ব্যাপকতা বোঝানো, যেমন এই জিহাদের উপর গুরুত্ব আরোপ এবং অন্য সকল প্রকারের জিহাদের উপর একে অগ্রাধিকার দেয়া।
এই ভ্রান্তির জবাবে আমরা আরো বলতে চাইঃ হুকুমাতের কুফরের ক্ষেত্রে শারীয়াহ এমন কোন দিকনির্দেশনা দেয়নি যাতে দেশী কাফির আর বিদেশী কাফিরের মাঝে পার্থক্য করা যায়।
قَالَ يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ
“তিনি বললেনঃ হে নূহ! সে তো তোমার পরিবারভুক্ত নয়; সে অবশ্যই অসৎকর্মপরায়ণ।“ [228]
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ إِلا قَوْلَ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ لاسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ رَبَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ
“তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিলঃ নিশ্চয় তোমাদের সঙ্গে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যার ইবাদত কর তার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নাই; আমরা তোমাদের মানি না; তোমাদের ও আমাদের মাঝে সৃষ্টি হলো শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যতদিন না তোমরা এক আল্লাহতে ঈমান আনো।” [229]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরো বলেছেন,
إِنَّ الْكَافِرِينَ كَانُوا لَكُمْ عَدُوًّا مُبِينًا
“কাফিররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” [230]
এসব আয়াত থেকে একথা স্পষ্ট যে, মু’মিন ও কাফিরের মধ্যে শত্রুতার একমাত্র ভিত্তি বা কারণ হলো কুফর। আর এটাই এই হুকুমের ভিত্তি, দেশী বা বিদেশী কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। কারণ কাফির যদি তোমার গোত্রের কেউ বা সন্তানও হয় তার পরও তার প্রতি শত্রুতা পোষণ করা অত্যাবশ্যক। সুতরাং এই হুকুমের ভিত্তি কুফর ছাড়া আর কিছুই নয়। আর শত্রুতার মতো শাস্তির বিধানও একই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত আর তা হলো তাদের কুফর। অর্থাৎ কুফরের বৈশিষ্ট্য তার মাঝে বিদ্যমান থাকার কারণেই তার উপর শাস্তির বিধান হয়েছে, অন্য কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে নয়।
আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও এই ভিত্তির কথাই বলেছেন, “যেকেউ তার দ্বীনকে পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা কর।” [231] অর্থাৎ তিনি দ্বীন ত্যাগ করার কারণেই তাকে (মুরতাদ) হত্যা করতে বলেছেন; অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণের পর কুফরে প্রবেশ করা। আর এটাই এই হুকুমের ভিত্তি। এ বিষয়টি পরিষ্কার হবার পর আমরা বলতে চাই, যে কুফরের কারণে এসব শাস্তির বিধান দেয় হয়েছে- হোক সেটা বন্দীকে হত্যা করা অথবা অবাধ্যদের সাথে যুদ্ধ করা- এই বৈশিষ্ট্য (কুফর) দেশী বিদেশী যে কারো মাঝেই সমানভাবে বিদ্যমান থাকতে পারে। এবং সে যদি কোন রাষ্ট্রে মুসলিমদের কর্তৃত্ব করে, তাহলে সে বিদেশ থেকে আক্রমণ করেছে নাকি সেই দেশের নাগরিক হয়ে শাসন করেছে ও পরবর্তীতে কুফর করেছে সেটি কোন বিবেচ্য বিষয় হবে না, কারণ এই যে বিশেষ কারণে (কুফর) এই হুকুম এসেছে তা প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। আর কোন মুসলিম শাসক যদি দায়িত্বে থাকাকালীন কুফর করে তাহলে এই কুফরের সাথে সাথে মুসলিমদের মধ্য থেকে বের হয়ে যায়; এমতাবস্থায় সে মুসলিমদের নিকট পরদেশী। কারণ আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
وَنَادَى نُوحٌ رَبَّهُ فَقَالَ رَبِّ إِنَّ ابْنِي مِنْ أَهْلِي وَإِنَّ وَعْدَكَ الْحَقُّ وَأَنْتَ أَحْكَمُ الْحَاكِمِينَ
قَالَ يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ
“আর নূহ তার প্রতিপালককে সম্বোধন করে বলল, ‘হে আমার রব! আমার পুত্র আমার পরিবারভুক্ত এবং আপনার প্রতিশ্রুতি সত্য, আর আপনি তো বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক।’ তিনি বললেন, ‘হে নূহ! সে তো তোমার পরিবারভুক্ত নয়। সে অবশ্যই অসৎকর্মপরায়ণ।” [232]
সুতরাং সে কুফরের কারণে তার জাতি থেকে বের হয়ে যায় এবং তাদের কাছে সে পরদেশী হয়ে যায়।
যদিও কিছু কিছু ঐচ্ছিক বৈশিষ্ট্যের কারণে শাস্তির তারতম্য হতে পারে; সেক্ষেত্রে আদি কাফির ও ধর্মত্যাগী কাফিরের মধ্যে পার্থক্য করা হয়ে থাকে, কারণ ধর্মত্যাগী কাফিরের শাস্তি গুরুতর, যা চতুর্দশ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। প্রধান তিন ইমামের মতে আরো পার্থক্য করা হয় মুহারিব (যুদ্ধরত) কাফির ও শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ কাফিরের মাঝে, যদিও ইমাম শাফে’য়ী এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছেন। এছাড়াও জিহাদের ক্ষেত্রে নিকটবর্তীর ও দূরবর্তীর কাফিরের মাঝে পার্থক্য করা হয়েছে, ত্রয়োদশ অধ্যায়ের আলোচনায় এ বিষয়টি উঠে এসেছে।
আর এই ক্ষেত্রের দিকেই যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যায়, মুরতাদ শাসকেরা তিনটি ক্ষেত্রেই তুলনায় গুরুতর শাস্তির যোগ্য – ধর্মত্যাগ, যুদ্ধরত থাকা এবং নিকটবর্তীর অবস্থান। অপর দিকে আদি কাফির, চুক্তিবদ্ধ কাফির ও দূরবর্তীর কাফির কিছুটা দয়া আশা করতে পারে। আর আগেই বলা হয়েছে সকল প্রকার মদই হারাম সেটাকে মদ বলুন, এলকোহল বলুন আর নাবিথ বলুন; আর হোক সেটা আমদানিকৃত বা দেশী; সাদা কিংবা লাল। এসকল কোন বৈশিষ্ট্যই মূল হুকুমকে প্রভাবিত করে না কারণ, এটি একটি মূল কারণকে ভিত্তি করে প্রণীত; সেটা হলো এগুলো সবই নেশার বস্তু। যতক্ষণ পর্যন্ত এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই হুকুম বলবৎ থাকবে, সেক্ষেত্রে অন্য কোন বৈশিষ্ট্য গুরুত্ব পাবে না। আর এখানেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে শাস্তির তারতম্য হতে পারে, যে রমযান মাসে দিনের বেলা মদ্যপান। সেক্ষেত্রে তার উপর সাধারণ শাস্তির সাথে সাথে অতিরিক্ত তা’যির যোগ করা হবে, কারণ রমযান একটি পবিত্র মাস। তবে তার মাঝে মূল কারণটিই অনুপস্থিত থাকতো অর্থাৎ সে যদি নেশাই না করত, তবে তার উপর কোন শাস্তিই বলবৎ হতো না।
সুতরাং কেউ যদি পরদেশী কাফির ও স্বদেশী কাফিরের জন্য হুকুমের তারতম্য দাবী করে, সে তো তারই মতো যে আমদানিকৃত মদের সাথে দেশী মদের পার্থক্য করে। সুতরাং ভেবে দেখুন।
৮) আর এক্ষেত্রে এমন কোন শর্ত নেই যে, মুসলিম মুজাহিদদের একটি ভিন্ন রাষ্ট্র থাকতে হবে।
কেউ কেউ এটা দাবী করে থাকে যে ঐ মুরতাদ শাসক ও তার বাহিনীর রাষ্ট্র থেকে আলাদা রাষ্ট্র থাকতে হবে। আসলে এই শর্তটিকে অকেজো করতে ইবনে তাইমিয়্যার (রহিমাহুল্লাহ) সেই ইজমা ভিত্তিক ফাতওয়াটিই যথেষ্ট, যা তিনি মুসলিম রাষ্ট্রে আক্রমণকারী আগ্রাসী শত্রুর সাথে যুদ্ধ করার আবশ্যকতার ব্যাপারে দিয়েছিলেন। অতএব ভেবে দেখুন (ফাতওয়ায় উল্লেখিত) এই অবস্থায় আলাদা রাষ্ট্র কোত্থেকে আসবে? উপরন্তু এটা এমন এক সময় জিহাদ ফরয হয়ে পড়ে, যা আমি সপ্তম অধ্যায়ে বলেছি। আর এই শর্তটির কোন শরীয়া ভিত্তিক দলীল নেই। আর কোন শর্ত যদি আল্লাহর কিতাবে খুঁজে না পাওয়া যায় তবে তা বানোয়াট। সম্মানিত আলেমগণের মধ্যে কেউই এই শর্তের কথা বলেননি। বলার মধ্যে ইবনে কুদামাহ বলেছেন যে, যদি আক্রমণকারী কাফিররা মুসলিম রাষ্ট্রের খুব কাছে চলে আসে, তাহলে ঐ এলাকার মানুষদের সেখান থেকে সরে এসে একটি দূর্গে অবস্থান নেয়ার অনুমতি আছে। আর মুরতাদ শাসকের ক্ষেত্রে স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট দলীল আছে। আর তা হলো উবাদা ইবনুস সামিতের (রদিয়াল্লাহু আনহু) হাদীসঃ “… আমরা নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল করবো না।’ তিনি বলেন,’যাবৎ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলীল থাকবে।” আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই হাদীসে বা অন্য কোথাও এমন কোন শর্ত জুড়ে দেননি; আর আহলুল ইলমেরও কেউ এই শর্তের কথা বলেননি; আমি এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আল কাযী আল আইয়াদ ও ইবনে হাযারের বক্তব্য উল্লেখ করেছি। এরপরও যদি কেউ এই শর্ত যোগ করেন- “দু’টি ভিন্ন রাষ্ট্র থাকতে হবে”- এবং বলেন যে, ‘এটি আকল (বিবেক বুদ্ধি) ও ইসলামী শারীয়াহ দ্বারা প্রমাণিত’; তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা বলব আকল কোন কিছুকে হুকুমে পরিণত করতে পারে না যা আমি আমার ‘কিতাব ও সুন্নাহর উপর কায়েম থাকার মূলনীতি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছি। আর তারা যদি বলে যে এটি ইজতিহাদ, তবে আমরা বলব, এটা যদি ইজতিহাদই হয় তবে এই ইজতিহাদ করার দায়িত্ব তাদের উপর ন্যস্ত হবে যাদের সামরিক অভিজ্ঞতা আছে। কারণ আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
“নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন গচ্ছিত বিষয় তার হকদারকে প্রত্যর্পণ করতে..।” [233]
আর ইসলামী শারীয়াহ এর দৃষ্টিতে সংখ্যা বা প্রস্তুতিতে অক্ষমতা ছাড়া এক্ষেত্রে অন্য কোন শর্ত নেই। আর এই সিদ্ধান্তও মুজাহিদদের যে কখন তারা ঐ পর্যায়ে পৌঁছাবে। আর কেউ যদি ঝুঁকি নিয়ে একাই জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে সেটাও জায়েয এবং আল্লাহ্ চাইলে সেও পুরস্কৃত হবে, অবশ্য যদি সে কোন মুজাহিদ বাহিনীতে থাকে; তবে সেক্ষেত্রে তাকে আমীরের অনুমতি নিয়ে যেতে হবে। আর একলা জিহাদে বের হবার দলীল হলো আল্লাহর বাণী,
فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لا تُكَلَّفُ إِلا نَفْسَكَ وَحَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ
“সুতরাং আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো, তোমাকে শুধু তোমার নিজের জন্যই দায়ী করা হবে;…।” [234]
এবং ইবনে হাযম বলেন, “আর কুফ্ফারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে ফাসিক (গুনাহগার) আমীর অথবা সৎকর্মপরায়ণ আমীরের সাথে; আর একজন বিজয়ী ও গাযীর সাথে যেভাবে যুদ্ধ করা হয়ে থাকে একজন ইমামের অধীনে এবং কোন ব্যক্তি যদি সক্ষম হয় তাহলে সে একাও যুদ্ধ করে।” [235]
লেখকের বক্তব্যঃ তাওয়াগীতের বিরুদ্ধে এই জিহাদ হলো ফারদুল আইন, সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি চায় তবে সে একাও এটি করতে, বিশেষত যদি সে তাদের কারো বিরুদ্ধে (যুদ্ধ করার) সুযোগ পায়। অধিক সংখ্যক কাফিরের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করা তার জন্য আবশ্যক নয়। বরং অধিক সংখ্যক কাফিরের ক্ষেত্রে তার পালানোরও অনুমতি আছে। তখন তার প্রত্যয় যদি দৃঢ় হয় এবং শাহাদাতের নিয়্যত থাকে তবে এটা তার জন্য জায়েয এবং এটাই উত্তমঃ
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاةِ اللَّهِ
“মানুষের মধ্যে এমন লোক আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্ট লাভের উদ্দেশ্যে নিজেকে বিক্রি করে দেয়…।” [236]
তবে ফারদ হুকুম হলো একত্রে দলবদ্ধভাবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, কারণ এর মূল উদ্দেশ্য হলো দ্বীন কায়েম করা- “… এবং আল্লাহর দ্বীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।”
আর ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধ করে এটি অর্জন করা সম্ভব নয়। আর কেউ যখন একটি মুজাহিদ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে অংশ নেবে, তখন তার আমীরের অনুমতি ছাড়া সে যুদ্ধে যেতে পারবে না; কারণ আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَإِذَا كَانُوا مَعَهُ عَلَى أَمْرٍ جَامِعٍ لَمْ يَذْهَبُوا حَتَّى يَسْتَأْذِنُوهُ
“… মু’মিন তো তারাই যারা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলে ঈমান আনে এবং রাসূলের সঙ্গে সমষ্টিগত ব্যাপারে একত্র হওয়ার পর তার অনুমতি ছাড়া বের হয় না।” [237]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় অথবা তার ইন্তেকালের পর একদল (জামা’আহ) মুসলিম মুরতাদ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তারা কোন আলাদা রাষ্ট্র খোঁজেনি বা সে স্থান ত্যাগ করেনি। উদাহরণস্বরূপ যখন মিথ্যুক আল আসওয়াদ আল আনসি নবুয়্যতের দাবী নিয়ে আবির্ভূত হয়, ইয়েমেন দখল করে ও এর কর্তৃত্ব নেয়, সেই মুহূর্তে ফায়রুয আল দায়লামী তাকে ধোঁকা দেয় যেন সে তারই সমর্থক এবং এই সুযোগে তাকে হত্যা করে। আর এই ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় ঘটেছিল। [238]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা কোন সাহাবা (রদিয়াল্লাহু আনহু) এর প্রতিবাদ করেননি। কেউ বলেননি, “অন্য একটি রাষ্ট্রে আলাদা না হয়ে ফায়রুয কিভাবে আসওয়াদকে হত্যা করল?” এছাড়াও ইয়াজিদ ইবনে আল ওয়ালিদ এবং একটি বাহিনী, যখন খলীফা আল ওয়ালিদ ইবনে ইয়াজিদের দ্বীনের মাঝে গলদ দেখতে পেয়েছিল তখন তারা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং তাকে হত্যা করেছিল; তারা কোন আলাদা রাষ্ট্র তৈরী করে নেয়নি। [239]
আলোচনা সংক্ষিপ্ত রাখার স্বার্থে আমরা শুধু এই দুইটি উদাহরণের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই।
যারা এই ভ্রান্তির পক্ষে কথা বলেন তারা দলীল দিয়ে থাকেন যে, রাসূল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরত করে শত্রু থেকে দূরে মদীনায় আলাদা রাষ্ট্রে যাবার আগে যুদ্ধ শুরু করেননি। কিন্তু এই বক্তব্যের দ্বারা শারীয়া তে এমন কোন শর্ত আরোপিত হয় না যে, এরকম অবস্থা আসার আগে যুদ্ধ করা যাবে না এবং এ বিষয়ে কোন অস্পষ্টতা নেই। আর তাছাড়া ঐ সময়ে শারীয়াহ নাযিল হয়েছে; আর বর্তমানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর শারীয়াহ ও এর হুকুমসমূহ পরিপূর্ণতাপ্রাপ্ত অবস্থায় আছেঃ
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ
“আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম..”[240]
আর ইজমা হয়েছে যে, যখন শত্রুরা কোন মুসলিম রাষ্ট্রে প্রবেশ করে তখন ঐ জনগণের উপর জিহাদ আবশ্যক হয়ে পড়ে – অর্থাৎ শত্রুকে দমন করা ঐ রাষ্ট্রের মুসলিমদের উপর ফারদুল আইন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে কাফির ও মুসলিম একই ভূমিতে অবস্থান করছে কারণ মুসলিম পরাজিত হয়ে আলাদা রাষ্ট্রটি হারিয়েছে। কিন্তু তারপরও ইজমা অনুযায়ী মুসলিমের জন্য ফারদ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। মুরতাদ শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ করা একটি হুকুম যা সক্ষমতার উপর নির্ভর করে। আর এই সক্ষমতার হিসাব বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন হতে পারে। যাদের এ ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে তারাই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে। আল্লাহ্ তাবারাক ওয়া তা’আলা মুজাহিদ বাহিনীর বিশুদ্ধ নিয়্যতের কথা জানলেই তিনি তাদেরকে পরিচালিত করবেন এবং তাদের সেই কাজগুলো সহজ করে দিবেন যাতে তিনি সন্তুষ্ট হন। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ
“…তাদের অন্তরে যা ছিল তা তিনি অবগত ছিলেন; তাদেরকে দান করলেন প্রশান্তি…।” [241]
তিনি আরোও বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ يَهْدِيهِمْ رَبُّهُمْ بِإِيمَانِهِمْ
“…নিশ্চয় যারা মু’মিন ও সৎকর্মপরায়ণ তাদের রব তাদেরকে ঈমানের দ্বারা পথনির্দেশ করবেন।” [242]
আর যারা এই ফরয জিহাদ থেকে দূরে থাকে, তাদের এই পশ্চাদপদতা তাদের কোন কাজে আসবে না। বরং তারা অন্যদেরকে জিহাদে যাবার পথে বাঁধা দেয় এবং এসব ভ্রান্তির দ্বারা তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এটাই তাদের পশ্চাদপদতার শাস্তি; আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
رَضُوا بِأَنْ يَكُونُوا مَعَ الْخَوَالِفِ وَطُبِعَ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لا يَفْقَهُونَ
“তারা অন্তঃপূরবাসিনীদের সঙ্গে অবস্থান করাই পছন্দ করেছে এবং তাদের অন্তরে মোহর এঁটে দেয়া হয়েছে; ফলে তারা বুঝতে পারে না।” [243]
সুতরাং তারা যখন পেছনে পড়ে থাকে তখন আল্লাহ্ তাদের অন্তরকে সন্দেহের দ্বারা মোহর মেরে দেন। অতএব তারা বিভ্রান্তি খুঁজতে থাকে যাতে তারা তাদের পশ্চাদপদতার স্বপক্ষে যুক্তি দিতে পারে এবং অন্যদেরকেও তাদের সাথে পেছনে ফেলে রাখতে পারে; এভাবে তারা তাদের দায়বদ্ধতার সাথে অন্যদেরও দায়ী করতে চায়। আর এমনিভাবেই একটি পাপ থেকে অন্য পাপের জন্ম হয়। আল্লাহ্ তাবারাক ওয়া তা’আলা বলেন,
إِلا تَنْفِرُوا يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيمًا وَيَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلا تَضُرُّوهُ شَيْئًا وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
إِلا تَنْصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
“যদি তোমরা অভিযানে বের না হও তবে আল্লাহ্ তোমাদের মর্মন্তুদ শাস্তি দিবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন; এবং তোমরা তার কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর তবে আল্লাহ্ তো তাকে সাহায্য করেছিলেন…।” [244]
আর জিহাদের ক্ষেত্রে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র থাকতে হবে এমন বক্তব্য এক অর্থে জিহাদকেই বাধাগ্রস্ত করে; বিশেষত ‘জিহাদ আদ দিফা’য়’। এর দ্বিরাষ্ট্র তত্ত্বের অর্থ হলো বর্তমান পরিস্থিতির কাছে নতি স্বীকার করা এবং এইসব তাগুতের শাসনের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকা যারা মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ শাসন করছে। সেইসাথে এটি ঐ রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের উপর জিহাদের আবশ্যকতাকেও অস্বীকার করে থাকে। এবং এর দ্বারা কিছু সময়ের জন্য একটি বিশেষ এলাকায় ইসলাম অনুপস্থিত হয়ে পড়ে। আমরা এমন পরিস্থিতি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই- তবে এটি অবাস্তব নয়- কত স্থানেই তো ইসলামের হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আর আজ অধিকাংশ স্থানেই কুফরের শাসন চলছে। সেসব স্থানে ইসলাম আজ স্মৃতিচিহ্ন হয়ে রয়েছে অথচ একদিন এসব স্থানে ইসলামই ছিল বাস্তব; যেমন আন্দালুসিয়া, তুর্কিস্তান, বুখারা, সমরখন্দ এবং বলকান ও অন্যান্য অঞ্চল। আর কত দেশই না এসব গাদ্দারদের হাতে তাদের ধোঁকাবাজিতে ধ্বংস হয়েছে, যেমন ভারত যেখানে ইসলামী সাম্রাজ্য ছিল যা পরবর্তীতে ইংরেজরা দখল করে নেয়। অসৎ আলেমরা জিহাদকে অস্বীকার করেছিল এই বলে যে, এসব ইংরেজরা উলীল আমর নয়, তাদের মানতে কেউ বাধ্য নয়; কারণ আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
“তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর তাঁর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা দায়িত্বশীল তাদের।” [245]
এসব ভ্রান্তির ব্যাপারে মুহাম্মাদ রশীদ রিদা তার তাফসীর ‘আল মানার’-এ আলোচনা করেছেন, আর আল্লাহর কাছেই আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সমস্ত কর্তৃত্ব। এটি উমার রদিআল্লাহু আনহুর বক্তব্যের একটি জ্বলন্ত প্রমাণ যেখানে তিনি বলেছেন কিসের দ্বারা ইসলাম ধ্বংস হবে, “… সেই মুনাফিকের যুক্তি দ্বারা যে কুরআন ব্যবহার করে।” আর আলেমদের মধ্যে যে কেউ এসব কাফের শাসকদের প্রতি সহমর্মিতার স্বার্থে এমন বিভ্রান্তির দ্বারা মুসলিমদের জিহাদ থেকে বিরত রাখবে, তার কুফরের ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সে দ্বীনের বাইরে, একজন মুরতাদ, এবং তার রায় আর তার কর্তৃত্বকারী শাসকের রায় একই। আল্লাহ্ আ’আলা বলেন,
وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ
“তোমাদের মধ্যে কেউ তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।” [246]
৯) অনেকে বলে থাকেন যে, কাফেরদের বাহিনীর মধ্যে নানা কারণে অনেক মুসলিম মিশে আছে; তাদেরকে পৃথক করতে হবে। আর এমনটি ঘটে থাকে কারণ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কাফেরদের বাহিনীকে আলাদা করে চেনা যায়; তাদের পোষাক আলাদা থাকে বা তাদের নির্দিষ্ট এলাকা বা ঘাঁটি থাকে যা সহজে চেনা যায়। কিন্তু যদি মুসলিমরা তাদের মধ্যে মিশে থাকে তাহলে প্রথমত তারা ঐ কাফের বাহিনীর অন্তর্গত ছিল না কিন্তু যুদ্ধের ভেতর তারা কোনভাবে তাদের মাঝে মিশে গেছে; অথবা তারা কাফেরদের দলেই ছিল কিন্তু তাদের অন্তরে তারা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত, যেমন কেউ যদি গুপ্তচরবৃত্তির জন্য তার দ্বীন গোপন করে তাদের মাঝে অবস্থান করে। তাদের অবস্থা নিচের যেকোন দু’টি অবস্থার মাঝে যেকোন একটি হতে পারেঃ
প্রথমতঃ তাদেরকে বাইরে থেকে দেখে কাফিরদের থেকে আলাদা করা যায় না; এরকম অবস্থায় যুদ্ধ বন্ধ রাখার কোন অনুমতি নেই। এ ব্যাপারে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেছেন, “এবং যাকে তারা (কাফেররা) জোর করে তাদের সাথে নিয়ে আসে, তার হিসাব গ্রহণ করা হবে তার নিয়্যতের উপর ভিত্তি করে। আর আমাদের দায়িত্ব হলো পুরো বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা কারণ যাকে বাধ্য করা হয়েছে তাকে আলাদা করা, সে নিজে (বলা) ছাড়া (অন্য কারো পক্ষে) সম্ভব নয়। আর এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহীহ হাদীস থেকে, যেখানে তিনি বলেছেন,
‘An army from the people will wage war against this house. So while they are in a barren region from the land, they will be swallowed up.’ So it was asked, ‘O Messenger of Allāh, within them is a compelled one?’ So he said, ‘They will be resurrected upon their intentions.’”–until he said – “And in the phrasing of Al-Bukhārī, from ‘Ā’ishah, she said, ‘The Messenger of Allaah (saws) said, ‘An army will battle the Ka’bah. Then when they are in a barren region from the land, their first and their last shall be swallowed up.’ So she said, ‘I said, ‘O Messenger of Allāh, how will their first and their last be swallowed up, while there are their markets and those who are not from them, within them?!’ He said, ‘Their first and their last shall be swallowed up. Then they shall be resurrected upon their intentions.’”– until he said – “So Allāh, the Most High, destroys the army, which intended to violate His sanctities; both the compelled one within them as well as the one who was not compelled, despite His ability to differentiate between them, while He resurrects them upon their intentions. So how can it be obligatory upon the Mujāhidīn believers to differentiate between the compelled one and those besides them, while they do not know that?! Rather, if a claimer claims that he went out, due to compulsion, then that would not benefit him by his claim alone, as it is narrated that Al- ‘Abbās Ibn ‘Abdul-Muttalib said to the Prophet (saws) , when the Muslims took him prisoner on the Day of Badr, ‘O Messenger of Allāh, verily I was compelled.’ So he said, ‘As for your outside, then it was against us, as for your inside, then it is for Allāh (to decide).’”
এবং তিনি (রহিমাহুল্লাহ) আরেক স্থানে বলেছেন, “আমরা জানি না যে কাকে বাধ্য করা হয়েছে বা হয়নি, তাই আমরা পার্থক্য করার সামর্থ্য রাখি না। সুতরাং আমরা যদি আল্লাহর হুকুম পালন করি এবং তাদের হত্যা করি তাহলে আমরা পুরস্কৃত ও দায়মুক্ত হবো আর আল্লাহ্ তাদেরকে নিয়্যত অনুযায়ী বিচার করবেন। অর্থাৎ কেউ যদি বাধ্য হয়ে (তাদের সাথে) আসে এবং প্রতিরোধ করতে অক্ষম হয়, তাহলে কিয়ামতের দিন তাদেরকে তাদের নিয়্যত অনুযায়ীই প্রতিফল দেয়া হবে। তাই দ্বীন প্রতিষ্ঠার জিহাদেই যদি তার মৃত্যু হয়, তাহলে তার মৃত্যু আর মুসলিম বাহিনীর কারো মৃত্যুর মাঝে কোন বিভেদ নাই।” [247]
আমাদের বক্তব্য হলোঃ অন্যান্য অধ্যায়ে আমরা বর্ণনা করেছি যে, ইসলামী শরীয়া অনুসারে কোন কোন শর্ত পূরণ হলে ধরা যাবে একজন মুসলিম বাধ্য হয়ে কাফিরদের কথা অনুযায়ী কাজ করেছে- এবং আমি এটাও বর্ণনা করেছি যে, বর্তমান শাসকপক্ষীয় সাঙ্গপাঙ্গদের প্রায় কারো ক্ষেত্রেই এসব শর্ত প্রযোজ্য হয় না। এবং আমি এটাও উল্লেখ করেছি যে, আলেমদের ইজমা হলো- এসব বাধ্য অবস্থায়ও কোন মুসলিমকে হত্যা করা যাবে না। তাহলে তার ব্যাপারে কি বলা যায় যে কাফিরদের পক্ষ হয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তি করে এবং মুসলিমদের হত্যা করে?
দ্বিতীয়তঃ যদি শত্রুদের কাতারে এমন কোন মুসলিম দেখা যায় যাকে মুসলিম বাহিনী চিনতে পারে, তাহলে এই অবস্থাকে বলে তাতাররুস [248]। ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “বরং মানবজাতির মধ্যে যারা সৎকর্মশীল ও উত্তম , তারাও যদি ঐ কাফিরদের মধ্যে থাকে, এবং তাদেরকে হত্যা করার ঝুঁকি না নিয়ে কাফিরদের আক্রমণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে তাদের হত্যা করে হলেও যুদ্ধ করতে হবে। কারণ ইমামদের ইজমা হলো, কাফিররা যদি তাতাররুস করে, তাহলে যুদ্ধ না করাটা হবে মুসলিমদের জন্য ক্ষতিকর।
সুতরাং কাফিরদের মারতে গিয়ে তাদেরকে আঘাত করে ফেলা আমাদের জন্য জায়েয। এবং এই দুইটি বিশেষণের যেকোন একটি অনুসারে আমরা এমনকি সরাসরি ঐ মুসলিমের দিক থেকেও আঘাত হানতে পারি। কারণ, জিহাদের জন্য যেই মৃত্যুবরণ করবে, এমনকি যখন সে কাফিরদের মধ্যে থেকেও মনে মনে এটাকে ঘৃণা করবে, তাহলেও সে শহীদের মর্যাদা পাবে এবং তাকে তার নিয়্যত অনুযায়ী পুনরুত্থিত করা হবে। এবং একজন মুজাহিদের মৃত্যু থেকে তার মৃত্যু কখনই বেশী ক্ষতিকর হতে পারে না। এবং আল্লাহর ইচ্ছায় জিহাদ করতে গিয়ে মুজাহিদরা মৃত্যুবরণ করতে পারে, অথচ এর পরও জিহাদ যেহেতু ফরয- সেহেতু এই জিহাদে কাফিরদের কাতারে দাঁড়ানো মুসলিমরা মারা গেলে সেটা কিছুতেই আরো বড় কোন ব্যাপার না। এমনকি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফিতনার সময়ও যাকে এরকম বাধ্য অবস্থায় যুদ্ধে আনা হয় তাকে তার তরবারী ভেঙ্গে ফেলতে বলেছেন, যাতে তার মৃত্যু হলেও সে যেন যুদ্ধ না করে।
আর এই তাতাররুস সংক্রান্ত আরো আলোচনা পাওয়া যাবে ‘আল মুগনি ওয়াশ শারহ্ আল কাবির’ এবং ‘আল মাজমু শারহ আল মুহাথাব’ গ্রন্থে।
ষোড়শ অধ্যায়ঃ নির্জীব তাওয়াগীতের[তাগুত–এর বহুবচন] চেয়ে জীবন্ত তাওয়াগীত অনেক বেশী ক্ষতিকর
এখানে জীবিত তাওয়াগীত বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি সেই সব নেতৃস্থানীয় কাফির ও মুরতাদ শাসকদের কথা যারা প্রতিস্থাপিত আইন দ্বারা মুসলিম ভূখণ্ড শাসন করছে এবং মুসলিমদের মাঝে কুফর ও অশ্লীলতা ছড়াচ্ছে। আর জড় বা অচল তাওয়াগীত বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি কবর, পাথর, গাছ বা অন্যান্য জড়বস্তুর কথা আল্লাহ্ তা’আলা ব্যতিত যাদের কাছে দো’আ করা হয়, সাহায্য চাওয়া হয় অথবা যাদের জন্য কোরবানী করা, শপথ করা ইত্যাদি নানা প্রকারের ইবাদত যাদেরকে দেয়া হয় তাদের কথা। সুতরাং এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, জীবিত তাওয়াগীত জড় তাওয়াগীতের চেয়ে বড় ফিৎনা এবং ফাসাদ সৃষ্টিকারী; কারণ তাদের কাছে রয়েছে ক্ষমতা, হুমকি এবং দাপট যা ব্যবহার করে তারা মানুষের ওপর নানা যুলুম চাপিয়ে দেয়। আর একারণেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবিত তাওয়াগীতদের সাথেই আগে যুদ্ধ করেছেন আর মূর্তি ভেঙেছেন মক্কা বিজয়ের পর। আল-বুখারী, ইবনে মাসউদ রদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, “রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিজয়ের দিন মক্কায় প্রবেশ করেন যখন সেই গৃহের আশেপাশে তিনশত ষাটটি মূর্তি ছিল। অতঃপর তিনি তাঁর হাতের লাঠি দ্বারা সেগুলোকে আঘাত করতে শুরু করেন এবং বলতে থাকেন, ‘সত্য এসে গেছে এবং মিথ্যা দূরীভূত হয়েছে’, ‘সত্য এসে গেছে এবং মিথ্যা শুরু হবে না আর (এটি) ফিরেও আসবে না।’”[249] এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন স্থানে সাহাবাদের প্রেরণ করে সকল মূর্তি ধ্বংস করেন; কিন্তু এসবই ছিল জীবিত তাওয়াগীতের ক্ষমতাকে চূর্ণ করার পর। কারণ তিনি তার সংগ্রামের শুরু থেকেই তাদের ও তাদের মূর্তিগুলোর বিরোধিতা করেছেন এবং সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন।
আর এটাই হলো মিল্লাতে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম সবার আগে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন কাফিরদের সাথে এমনকি মূর্তিদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদেরও আগে। তিনি সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ إِلا قَوْلَ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ لاسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ رَبَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ
“তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে যাদের ইবাদত কর তাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।…”[250]
এই আয়াতের ব্যাপারে শেখ হামাদ বিন আতিকের বক্তব্য পঞ্চম অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
ثُمَّ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ أَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
“এখন আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, ‘তুমি একনিষ্ঠ ইব্রাহীমের মিল্লাতের অনুসরণ কর; এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।” [251]
তবে এই আলোচনার উদ্দেশ্য কোন একটি অপরটির আগে বা পরে পাঠানো নয় বরং গুরুত্বের দিক থেকে তাদের তুলনা করা মাত্র। অর্থাৎ ব্যাপারটি এমন নয় যে, জীবিত কাফির শেষ করার আগে নির্জীব তাওয়াগীতের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকতে হবে। কারণ শারীয়াহ পূর্ণতা লাভ করেছে; সুতরাং যে কেউ একটি অন্যায় দেখবে সে তার সাধ্য অনুযায়ী তার প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ করবে। গুরুত্বের ক্ষেত্রে আমি যে বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করছি তা হলো এই যে, অনেক মুসলিম জীবিত কাফিরদের ফিৎনায় পড়ে আর মুরতাদ হওয়ার হুমকির মুখে পড়েছে; তারা কখনোবা ভয় দেখিয়ে আবার কখনোবা চক্রান্ত ও কূটকৌশলে এসকল বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেই তুলনায় নির্জীব তাওয়াগীত এদের চাইতে অনেক কম বিপদজনক।
ভাবতে অবাক লাগে সেইসব মানুষ যারা দ্বীন ও ইলমের ধারক; তারা এসব নির্জীব তাওয়াগীতের বিরুদ্ধে লিখতে লিখতে তাদের কলমের কালি শুকিয়ে ফেলেছেন, অথচ জীবিত তাওয়াগীতের কথা তারা ভুলে গেছেন বা এব্যাপারে নিজেদের ভুলিয়ে রেখেছেন। এরাই কিন্তু বসবাস করছে এমন সব দেশে যেখানে কাফিরদের তৈরী আইন আর গণতন্ত্রের শাসন চলছে, তারা যেন ইচ্ছা করেই এ ব্যাপারে অজ্ঞতায় ডুবে আছেন বা এ বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। সেই কিনা তার সমস্ত আক্রোশ নিয়ে তার ধারালো তরবারী দিয়ে গ্রন্থের পর গ্রন্থে আঘাত করে চলেছেন এইসব নির্জীব নিরস্ত্র তাওয়াগীতদের উপর। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللَّهُ إِحْدَى الطَّائِفَتَيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّونَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُونُ لَكُمْ وَيُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُحِقَّ الْحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِينَ
“… তোমরা চাচ্ছিলে যে নিরস্ত্র দলটি তোমাদের আয়ত্বাধীন হোক। আল্লাহ্ চাচ্ছিলেন সত্যকে তাঁর বাণী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করতে এবং কাফিরদের নির্মূল করতে।” [252]
সুতরাং এ বিষয়ে ভেবে দেখ তাহলে তুমি কিছু কারণ খুঁজে পাবে যে, কেন আজকে আমরা এমন বিশৃঙ্খলা ও ফিৎনার মাঝে পড়ে আছি। কারণ দ্বীন ও ইলমের ব্যাপারে যাদের আমরা বিশ্বাস করেছি তারা এই দাওয়াত ও সতর্কবাণী পৌঁছে দেয়ার কাজে ব্যর্থ হয়েছেন। সুতরাং তাদের কি হবে যারা তাওয়াগীতের উপর সন্তুষ্ট এবং তাদের অনুসরণ করছে? আর তাদেরই বা কি হবে যারা তাওয়াগীতকে শারীয়াহর মোড়কে আবৃত করে থাকে? কাজেই যখনই তারা জিহাদ নিয়ে বক্তব্য দেয় তখন তারা শুধু ফিলিস্তিন আর আফগানিস্তানের কথা বলে, কারণ ঐসব দেশে এতটুকুই অনুমোদিত। কিন্তু মুরতাদ শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ তো ইহুদীদের সাথে জিহাদের চেয়েও বেশী জরুরী; কারণ তারা উভয়ে কাফির শত্রু এবং তারা মুসলিম ভূখণ্ড দখল করে আছে। মুরতাদ দু’দিক দিয়ে ইহুদীদের চেয়ে এগিয়ে- নিকটবর্তীর হওয়ার কারণে এবং ধর্মত্যাগের কারণে। আর এই দু’টি কারণই আমাদেরকে আগে মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলে।[253]
তারা যতটা গুরুত্বের সাথে ফিলিস্তিন ও আফগানিস্তানের মুজাহিদকে একজন নায়ক ও শহীদ বলছে এবং তাদের জন্য টাকা পয়সা ও রসদ পাঠাচ্ছে; এ দু’টি স্থান ছাড়া অন্যত্র যারা তাদের শারীয়াহর বিরুদ্ধে (কুফর শারীয়াহ) যুদ্ধ করছে তাদেরকে ঠিক ততটাই ঘৃণা সহকারে সন্ত্রাসী ও ক্রিমিনাল বলে অপমান করা হচ্ছে। সুতরাং ভেবে দেখুন!
আরো ভেবে দেখুন ঐ হাদীসটির কথা যা আল-বুখারী কায়স ইবনে আবি হাযম রদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন; তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন জীবিত তাওয়াগীত কতটা বিপদজনক। হাদীসটিতে তিনি বলেছেন, “আহমাসের (গোত্র) একজন মহিলা আবু বাকরকে (রদিয়াল্লাহু আনহু) প্রশ্ন করল, ‘কতদিন পর্যন্ত আমাদের এই উত্তম বিষয়ের উপর থাকব; যা আল্লাহ্ জাহিলিয়াতের পর এনেছেন?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা এর উপরে থাকবে ততদিন পর্যন্ত যতদিন তোমাদের মধ্যকার নেতারা সঠিক (পথে) থাকে।’ তিনি (মহিলা) বললেন, ‘আর এই নেতারা কারা?’ তিনি বললেন, ‘তোমাদের গোত্রে কি নেতা বা গণ্যমান্য ব্যক্তি নেই যারা তাদের আদেশ দিবে আর তারা তাদের মানবে।’ তিনি (মহিলা) বললেন, ‘নিশ্চয় (আছে)’ তিনি বললেন, ‘তাহলে এরাই ঐসব ব্যক্তি যারা মানুষের উপর (ক্ষমতাপ্রাপ্ত)[254] ইবনে হাযার এই বর্ণনার ব্যাখ্যায় বলেছেন, “‘কতদিন পর্যন্ত আমাদের এই উত্তম বিষয়ের উপর থাকবো..’ বলতে দ্বীন ইসলাম এবং এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়াদির কথা বোঝানো হয়েছে; যেমন ন্যায়বিচার, ঐক্যমত, যার বিরুদ্ধে অন্যায় করা হয়েছে তাকে সাহায্য করা এবং সবকিছুকে তার যথার্থ স্থানে রাখা। ‘…. তোমরা এর উপরে থাকবে ততদিন পর্যন্ত যতদিন তোমাদের মধ্যকার নেতারা সঠিক (পথে) থাকে ।’ অর্থাৎ এটা এই কারণে যে, মানুষ তার শাসকের দ্বীন অনুসরণ করে থাকে। কাজেই তাদের যে কেউ এটি থেকে বিভ্রান্ত হলে, তারা নিজেরাও (ভুলের দিকে) ঝুঁকে পড়ে এবং অন্যদেরও ঝুঁকিয়ে দেয়।[255] আর আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক রহিমাহুল্লাহ বলেন,
আর শাসক ছাড়া আর কিসেই বা দ্বীনকে করেছে কলুষিত? সেই সাথে কপট আলেম আর মন্দ পীর।।
লেখকের বক্তব্যঃ দুঃখের বিষয় হলো জীবিত তাগুতের ব্যাপারে আলেমদের নীরবতাকে; আজকের যুবসমাজ তাদের নীরবতা ও ফরয জিহাদ থেকে বিরত থাকার অযুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে। আর তাদের কাছে জিহাদ শুধুমাত্র কবরপূজারী আর সূফীদের বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এইসব কবরপূজারী ও সূফীরা কি কখনো জীবিত তাওয়াগীতের আশ্রয় ছাড়া টিকে থাকতে পারে?
সপ্তদশ অধ্যায়ঃ আর ইসলামের শক্তি সুসংহত হবে ঈমানভিত্তিক ঐক্যের দ্বারা
* তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَعَدَ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
“মু’মিন নর ও মু’মিন নারী একে অপরের বন্ধু, তারা সৎকাজের নির্দেশ দেয় এবং অসৎ কাজ নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে; এদেরকেই আল্লাহ ক্ষমা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [256]
* তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ
“যে কেউ আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও মু’মিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে আল্লাহর দলই তো বিজয়ী হবে।” [257]
প্রথম আয়াতের দ্বারা ঈমানভিত্তিক কর্তব্য পালনের জন্য মু’মিনদের পারস্পরিক আনুগত্যের গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। আর এর (এই আয়াত) প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধের কথা; যার চুড়ান্ত ফল পাওয়া বলপ্রয়োগ বা শক্তি খাঁটানো ছাড়া সম্ভব নয়। আর এই শক্তি সৃষ্টি হয় মু’মিনদের একে অন্যের প্রতি ঈমানের বন্ধন দ্বারা। আর এভাবেই মুসলিমদের সংগঠন (আল জামা’আহ) গঠিত হয় যার ব্যাপারে আল্লাহ্ রহমতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেনঃ “আল্লাহ্ তাদের উপর রহম করবেন”। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আল জামা’আহ হলো রহমত আর বিভক্তি হলো বিপর্যয়।” আল্লাহর কিতাবেও একই ধরণের বক্তব্য পাওয়া যায়,
وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
“তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।।” [258]
সুতরাং রহমত হলো ঐক্যের পুরস্কার আর আযাব হলো বিভক্তির শাস্তি।
আর দ্বিতীয় আয়াতে দেয়া হয়েছে বিজয়ের সুসংবাদঃ … বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে আল্লাহর দলই তো বিজয়ী হবে। ঐক্যের আবশ্যকতার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে এই আয়াতে ঐক্যকে বিজয়ের শর্তসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ এই আয়াত শুরু করা হয়েছে একটি শর্তসূচক শব্দ দ্বারা – ‘যে কেউ’। আর শর্তটি হলো ঈমানভিত্তিক ঐক্য – ‘আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও মু’মিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে…’ আর এই শর্ত পূরণের বিনিময়ে রয়েছে বিজয়ের সুসংবাদ- ‘আল্লাহর দলই তো বিজয়ী হবে।’ এই আয়াতের বর্ণনায় যে পর্যায় বা ধারা রয়েছে তার দিকে লক্ষ্য করুন- “‘যে কেউ আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও মু’মিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে’- কারণ এর মাঝেই ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য ছাড়া মু’মিনদের ঐক্যের বা পারস্পরিক আনুগত্যের কোন মূল্য নেই। আর এটা শুধু কিতাব ও সুন্নাহর অনুসরণের মাধ্যমেই সম্ভব।
জামা’আহর হুকুমকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসে, “আর আমি তোমাদের পাঁচটি বিষয়ের হুকুম দিচ্ছি; যা আল্লাহ্ আমাকে হুকুম করেছেনঃ আল জামা’আহ এবং শোনা এবং মানা এবং হিজরত ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ।[259] আর আমাদের আলোচ্য বিষয়ের জন্য এটি একটি ব্যাপক অর্থবোধক হাদীস, কারণ এই হাদীস ‘আল জামা’আহ’- র কথা দিয়ে শুরু করে ‘আল জিহাদ’-এ শেষ করেছে। সুতরাং জিহাদের রাস্তা শুরু হয় জামা’আহ গঠন করার মাধ্যমে; যা নিশ্চিতভাবে ঈমানের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে। আর একটি জামা’আহর জন্য একজন আমীর থাকা আবশ্যক। আমরা এ ব্যাপারে এই গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। আল হারিছের বর্ণিত এই হাদীসে সরাসরি আমীরের কথা না বলা থাকলেও এর দ্বারা পরোক্ষভাবে আমীরের কথা উঠে এসেছে। এই হাদীসে বলা হয়েছে ‘..শোনা এবং মানা’-র কথা অর্থাৎ জামা’আর আমীরকে শোনা এবং মানা। আর এই জামা’আর ঐক্য, সংহতি ও শক্তির সবচেয়ে বড় কারণসমূহের মধ্যে ‘শোনা ও মানা’ অন্যতম। আর এর পরই তিনি বলেছেন হিজরতের কথা; ইতিমধ্যেই আমি ১১শ অধ্যায়ের আলোচনা বলেছি যে, এটি হলো আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের সূচনাকারী ও সহায়ক একটি বিষয়। এরপরই তিনি হাদীসটির ইতি টেনেছেন জিহাদের কথা বলে, আর এর দ্বারা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে এটি মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ; এবং ৯ম অধ্যায়ের আলোচনায় এসেছে- এটি এর পূর্বের সকল কাজের একটি উপসংহারস্বরূপ। সুতরাং এই জামা’আহ এবং শোনা ও মানার মাধ্যমেই জিহাদের প্রয়োজনীয় বাহিনী গঠিত হবে। আর হিজরত থেকেই জিহাদের জন্য তৈরী হওয়া বা প্রস্তুত হওয়ার সূচনা।
আর ঈমানভিত্তিক ঐক্যের দ্বারা সুসংহত হবার ব্যাপারে প্রচুর আয়াত ও হাদীস রয়েছে। যেমন আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)-র বাণী,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ حَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى الْقِتَالِ إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُونَ صَابِرُونَ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِئَةٌ يَغْلِبُوا أَلْفًا مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لا يَفْقَهُونَ
“হে নাবী! আপনি মু’মিনদের জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করুন।” [260]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরো বলেছেন,
فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لا تُكَلَّفُ إِلا نَفْسَكَ وَحَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَكُفَّ بَأْسَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَاللَّهُ أَشَدُّ بَأْسًا وَأَشَدُّ تَنْكِيلًا
“সুতরাং আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর; তোমাকে শুধু তোমার নিজের জন্যই দায়ী করা হবে এবং মু’মিনগণকে উদ্বুদ্ধ কর, হয়ত আল্লাহ্ কাফেরদের শক্তিকে সংযত করবেন। আল্লাহ্ শক্তিতে প্রবলতর এবং শাস্তিদানে কঠোরতর।” [261]
সুতরাং কাফেরদের অনিষ্ট থেকে মু’মিনদেরকে রক্ষা করার কাজ শক্তি প্রয়োগ ছাড়া অপূর্ণ থেকে যাবে, আর এটি মু’মিনদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে সম্ভব হবে। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা), তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বলেছেন, “এবং তাদের সাথে নিয়ে যুদ্ধ কর যারা তোমার আনুগত্য করেছে, তাদের বিরুদ্ধে যারা তোমাকে অস্বীকার করেছে।”[262]
পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে জেনেছেন যে, জিহাদের জন্য আল জামা’আর গুরুত্ব এবং এর ফল- বিজয় যা এটি (জামাআহ) ছাড়া সম্ভব নয়ঃ
وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ
“যে কেউ আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও মু’মিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে আল্লাহর দলই তো বিজয়ী হবে।” [263]
অপর দিকে বিভক্তি ও বিভেদ হলো পরাজয় ও হতাশার প্রথম ও প্রধান কারণ। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেনঃ
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُوا إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
“তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। তোমরা ধৈর্যধারণ কর, নিশ্চয় আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।” [264]
আর এই পরাজয় একটি শাস্তি, যা তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আয়াতে স্পষ্ট বর্ণিত রয়েছে,
وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
“তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।[265]
আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
وَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَى دُونَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
“গুরু শাস্তির পূর্বে আমি অবশ্যই তাদের লঘু শাস্তি আস্বাদন করাবো, যাতে তারা ফিরে আসে।” [266]
সুতরাং কাফির শত্রুদের হাতে মুসলিমদের পরাজয় একটি লঘু শাস্তি যা আল্লাহ্ বিভেদ ও অন্ত:কোন্দলের কারণে ভোগ করিয়ে থাকেন। আর আমি সাওবান রদিআল্লাহ্ আনহুর হাদীস থেকে বলেছি যে, মুসলিমরা যদি একে অন্যের সাথে যুদ্ধ বিবাদ না করে তাহলে কাফিররা কখনোই মুসলিমদের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারবে না।
শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব তার “মাসাইল আল জাহিলিয়্যাত” গ্রন্থে বলেছেন, “দ্বিতীয়তঃ তারা বিভক্ত এবং তাদের দৃষ্টিতে শোনা এবং মানা একটি অপমানজনক ও মন্দ কাজ। সুতরাং আল্লাহ্ তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আদেশ দেন এবং বিভক্তিকে হারাম করে দেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ “তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করঃ তোমার ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতিরসঞ্চার করেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা তো অগ্নিকুন্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ্ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন।” – এই আয়াত।”
দুঃখজনক বিষয় হলো এই যে, আমরা যদি বিভিন্ন দেশের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যারা ইসলামের নামে আন্দোলন সংগ্রাম করছে তারা দলে দলে বিভক্ত এবং তাদের মাঝে মতভেদ বিদ্যমান। আর এটি জাহিলিয়াতের একটি চিহ্ন। আর আমি এই রোগের চিকিৎসার কথা ইতিপূর্বেই আলোচনা করেছি; তা হলো অগ্রবর্তীর (আগে প্রতিষ্ঠিত) জামা’আর সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, যারা সঠিক পন্থা অবলম্বন করছে। আর বর্তমান সময়ের সঠিক পন্থা হলো জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহি তা’আলা। আর ১৬শ অধ্যায়ের আলোচনায় আমি বলেছি, ইসলামের প্রতি এখন সবচেয়ে বড় হুমকি হলো জীবিত তাগুত। আর ১৫শ অধ্যায়ে আমি বলেছি, তাদের মোকাবিলা করার সঠিক উপায়ের ব্যাপারে স্পষ্ট দলীল ও সকলের ইজমা রয়েছে এবং এ ব্যাপারে ইজতিহাদের অবকাশ নেই। এবং তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার আবশ্যকতা প্রমাণিত, আর যদি অক্ষমতা থাকে তবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা আবশ্যক।
আর এটিও আমি আলোচনায় রেখেছি যে, কিভাবে এই অগ্রবর্তীর জামা’আর সাথে লেগে থাকতে হবে; আর সেটি হলো আবু হুরাইরা রদিআল্লাহু আনহুর বর্ণিত মারফু হাদীস, “আনুগত্যের অঙ্গীকার (বাইয়াত) পূর্ণ কর প্রথমজনের এবং তার পরবর্তীর প্রথমজনের।” [267] আর দলীল হিসেবে এই হাদীসের ব্যবহার সম্পর্কে আমি তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। আর কুরতুবী তার তাফসীরে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)-র আয়াত তুলে ধরেছেনঃ
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ مَنَعَ مَسَاجِدَ اللَّهِ أَنْ يُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ وَسَعَى فِي خَرَابِهَا أُولَئِكَ مَا كَانَ لَهُمْ أَنْ يَدْخُلُوهَا إِلا خَائِفِينَ لَهُمْ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَلَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ
“যে কেউ আল্লাহর মসজিদসমূহে তার নাম স্মরণ করতে বাঁধা দেয় এবং তার বিনাশ সাধনে সচেষ্ট হয় তার অপেক্ষা অধিক জালিম আর কে আছে?”[268]
তিনি (কুরতুবী) বলেনঃ “যদি বিভেদ বা দ্বন্দ্বের আশংকা থাকে, তবে মসজিদের স্থাপনা (ধ্বংস করা বা বাঁধা দেয়া) হারাম নয়; যেমন কেউ যদি একটি মসজিদের পাশে আরেকটি মসজিদ স্থাপন করে এই উদ্দেশ্যে যে, এর দ্বারা পূর্বোক্ত মসজিদের মুসলিমরা বিভক্ত হয়ে যাবে বা সেটি ধ্বংস হবে বা মতভেদের সৃষ্টি হবে। এমন ক্ষেত্রে দ্বিতীয় মসজিদটি নিষিদ্ধ হবে এবং এটি তৈরী করতে বাঁধা প্রদান করতে হবে। আর একারণেই আমরা বলেছি, ‘একই শহরে দু’টি প্রধান জামে মসজিদ থাকা অনুমোদিত নয়; তেমনিভাবে একই মসজিদে দুই ঈমাম থাকা এবং একই মসজিদে দুইটি (একই ওয়াক্তে) জামায়াত সালাত হওয়া অনুমোদিত নয়।’[269] লেখকের বক্তব্যঃ এবং তেমনিভাবে একই স্থানে দু’টি জামা’আহ প্রতিষ্ঠা করাও হারাম, কারণ এটি মুসলিমদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করবে, এবং তাদের সংগ্রামে বিভক্তি আসবে এবং তাদের উপর ক্ষতি নেমে আসবে।
আর যদি তাগুত একটি সংগঠিত জামা’আর ক্রমোন্নতি দেখে এবং আক্রমণের আশংকা করে, তাহলে তারা স্বাভাবিকভাবেই ঐ জামা’আহকে বিভক্ত করার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালাতে থাকে, যাতে তারা তাদের অন্ত:কোন্দল মেটাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু মুসলিমরা যদি নিজেরাই বিভেদে লিপ্ত হয়ে পড়ে তাহলে সেখানে কিই বা বলার থাকে?
আর একারণেই আমরা অগ্রবর্তীর জামা’আর সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়াকে আবশ্যক মনে করি; যারা সঠিক পন্থার ওপর রয়েছে। আর আমাদের দৃষ্টিতে যারা পরবর্তীতে নতুন জামা’আহ সৃষ্টি করতে চেয়েছে তারা গুনাহগার, কারণ এটি বিভক্তি ও মতভেদের কারণ সৃষ্টি করেছে এবং সার্বিকভাবে ইসলামী আন্দোলনকে ব্যাহত করছে। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لا تُحِلُّوا شَعَائِرَ اللَّهِ وَلا الشَّهْرَ الْحَرَامَ وَلا الْهَدْيَ وَلا الْقَلائِدَ وَلا آَمِّينَ الْبَيْتَ الْحَرَامَ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنْ رَبِّهِمْ وَرِضْوَانًا وَإِذَا حَلَلْتُمْ فَاصْطَادُوا وَلا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآَنُ قَوْمٍ أَنْ صَدُّوكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَنْ تَعْتَدُوا وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
“সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে এক অপরকে সাহায্য করবে না।” [270]
আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “কোন ক্ষতিসাধন থাকবে না আর না কোন (প্রতিশোধমূলক) ক্ষতি।” আর এ বিষয়টি প্রযোজ্য হবে তার জন্য যে পূর্বের ও পরের উভয় জামা’আহকে চিনত।
একইভাবে আমরা মনে করি, বর্তমান প্রেক্ষিতে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ছাড়া মুসলিমদের (কোন দলের) অন্য কোন কাজে নিয়োজিত থাকার মানে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বেঈমানী করা; তাঁর দ্বীনের সাথে বেঈমানী করা এবং দ্বীন হারানোর শামিল। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
“হে মু’মিনগণ! জেনেশুনে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসভঙ্গ করবে না এবং তোমাদের পরস্পরের আমানত সম্পর্কেও বিশ্বাসভঙ্গ করবে না।” [271]
নিশ্চয় জিহাদ আজ দুনিয়ার অধিকাংশ স্থানের মুসলিমদের ওপর ফারদুল আইন। সুতরাং মুসলিমদের অবশ্যই তার দেশে জিহাদ করতে হবে নতুবা অন্য দেশে গিয়ে তার মুজাহিদ ভাইদের সাহায্য করতে হবে। আর যে কেউ শারীয়াহ অনুযায়ী (গ্রহণযোগ্য কোন কারণে) এ দু’টির যেকোন একটি করতে অক্ষম; তাকে অবশ্যই আল্লাহর রাস্তায় খরচ করতে হবে; মু’মীনদের জিহাদের প্রেরণা দিতে হবে এবং সর্ব শক্তিমান, মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর কাছে প্রাণভরে দোআ করতে হবে যেন, তিনি কাফিরদের ধ্বংস করেন এবং মুসলিমদের পথ সহজ করে দেন ও শীঘ্র বিজয় দান করেন। নিশ্চয় জিহাদ ছাড়া অন্য কোন কাজে যে শ্রম ব্যয় করা হয় তা ব্যর্থ। আর জিহাদ ছাড়া অন্য কিছুর পেছনে অর্থ ব্যয় করা, সেই অর্থ নষ্ট করার নামান্তর। তাই জিহাদের চাকাকে সচল রাখার জন্য নিজেদের শ্রম ও সম্পদ ব্যয় করা আজ আবশ্যক; বর্তমান যুগের এই অপমান থেকেই মুক্ত হবার এই একটি পথই শরীয়াহতে খুঁজে পাওয়া যায়।
আর অবশ্যই এ অধ্যায়ের শুরুতে যেই ঈমানভিত্তিক ঐক্যের কথা বলা হয়েছে তা ভুলে গেলে চলবে না। কারণ মুসলিমদের ব্যর্থতার কারণগুলো প্রথম ব্যক্তিগত ও অভ্যন্তরীণ। কারণ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
مَا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللَّهِ وَمَا أَصَابَكَ مِنْ سَيِّئَةٍ فَمِنْ نَفْسِكَ وَأَرْسَلْنَاكَ لِلنَّاسِ رَسُولًا وَكَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا
“… অকল্যাণ যা তোমার হয় তা তোমার নিজের কারণে।” [272]
এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরো বলেন,
وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ
“তোমাদের যে বিপদ আপদ ঘটে তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল।” [273]
আর সার্বিক পরিশুদ্ধির কোন সম্ভাবনা নেই যতদিন না এইসব ব্যক্তিগত ও আভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধি ও পরিবর্তন সূচিত হয়। কারণ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,
لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلا مَرَدَّ لَهُ وَمَا لَهُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَالٍ
“নিশ্চয় আল্লাহ্ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না; যতদিন না তারা নিজ অবস্থা পরিবর্তন করে।” [274]
আর এর ভিত্তিতে আমরা একথা বলতে পারি যে, মুসলিমদের উপর কাফিরদের এই আধিপত্য ও অপমান তাদের নিজেদের মতভেদ আর বিভক্তির কারণে টিকে আছে। ছাওবান রদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত মারফু হাদীসে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা, তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বলেছেন, And that I will not prevail over them, an enemy from other than themselves, which will permit their community, even if it unites against them from its regions so that each of them would destroy one another.”[275] আর মূল কারণের প্রতিকার ব্যতিরেকে এই অপমানজনক পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না; আর এই প্রতিকার হলো মুসলিমদের একতা। আর এই বিভক্তি যেমন আমাদের উপর কাফিরদের আধিপত্যের কারণ; একই এই বিভক্তিরও কিছু কারণ আছে যার নিরাময় প্রয়োজন। আর এর কারণগুলো হলো, ইসলামের হুকুমসমূহ হাল্কাভাবে নেয়া এবং কিছু হুকুমের আমলকে গুরুত্ব না দেয়া। আর এটিই আমাদের মতভেদ ও বিভক্তির শাস্তির দিকে ধাবিত করে। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَمِنَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّا نَصَارَى أَخَذْنَا مِيثَاقَهُمْ فَنَسُوا حَظًّا مِمَّا ذُكِّرُوا بِهِ فَأَغْرَيْنَا بَيْنَهُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَسَوْفَ يُنَبِّئُهُمُ اللَّهُ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ
“তারা যা উপদিষ্ট হয়েছিল তার এক অংশ ভুলে গেছে। সুতরাং আমি কিয়ামত পর্যন্ত তাদের মাঝে স্থায়ী শত্রুতা ও বিদ্বেষ জাগরূক রেখেছি।” [276]
এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরো বলেন,
فَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ زُبُرًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ
“কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে তাদের দীনকে বহুধা বিভক্ত করেছে। প্রত্যেক দলই তাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত।” [277]
আর এর প্রতিকার করা যাবে যদি কিতাব ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা হয়; এবং আমি পূর্বের একটি অধ্যায়ে এ ব্যাপারে মূল নীতিসমূহ আলোচনা করেছি। আর এই আঁকড়ে ধরার ফলেই আল্লাহ্ হৃদয়গুলো এক করে দেনঃ
وَإِنْ يُرِيدُوا أَنْ يَخْدَعُوكَ فَإِنَّ حَسْبَكَ اللَّهُ هُوَ الَّذِي أَيَّدَكَ بِنَصْرِهِ وَبِالْمُؤْمِنِينَ
وَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ لَوْ أَنْفَقْتَ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا مَا أَلَّفْتَ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ أَلَّفَ بَيْنَهُمْ إِنَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
“তিনি তোমাকে স্বীয় সাহায্য এবং মু’মীনদের দ্বারা শক্তিশালী করেছেন। এবং তিনি তাদের পরস্পরের হৃদয়ের মাঝে প্রীতি স্থাপন করে দিয়েছেন। পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করলেও তুমি তাদের হৃদয়ে প্রীতি স্থাপন করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ্ তাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন; নিশ্চয় তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” [278]
আর ঈমানভিত্তিক ঐক্যের ফলস্বরূপ এই একটি মাত্র বিষয় দ্বারাই ইসলামের শক্তি সুসংহত হবে ।
অষ্টাদশ অধ্যায়ঃ যুদ্ধ হলো (শত্রুকে) ধোঁকা দেয়া
মু’মিন ও কাফির নির্বিশেষে সকলেই যুদ্ধের দুইটি নীতির ব্যাপারে একমত – ‘গোপনীয়তা’ এবং ‘ধোঁকা বা প্রতারণা’; তবে এক্ষেত্রে ব্যাখ্যার কিছু ভিন্নতা থাকতে পারে। তবে মু’মিনদের ক্ষেত্রে যুদ্ধের চুক্তি ভঙ্গ করা জায়েজ নয়, যা কাফিররা করতে পারে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যুদ্ধ হলো ধোঁকা দেয়া”[279]। এর দ্বারা উদ্দেশ্যকে- ‘যুদ্ধ…’ ; বিধেয়- ‘ধোঁকা…’ দ্বারা নির্দিষ্টতা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যুদ্ধের অন্যতম কৌশল ও এর ভিত্তি হলো ধোঁকা; এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঐ হাদীসের মতো যেখানে তিনি বলেছেন- “হাজ্জ হলো আরাফাহ”। অর্থাৎ হাজ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আহকাম হলো আরাফাহ, যদিও হাজ্জের আরো অনেক আহকাম রয়েছে। একই রকম বর্ণনার আরেকটি হাদীস হলোঃ “দ্বীন হচ্ছে নাসীহা ( একে অন্যের মঙ্গল কামনা করা)”।
আন নববী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “যুদ্ধে কাফিরদের ধোঁকা দেয়া এবং ধোঁকার যেকোন পন্থা ব্যবহার করার ব্যাপারে আলেমগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন; যতক্ষণ না এর দ্বারা কোন চুক্তি বা নিরাপত্তার আশ্বাস ভঙ্গ হয়। সেক্ষেত্রে (চুক্তিভঙ্গ) এটি জায়েজ হবে না।” [280]
এবং ইবনে হাযার রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “আর এই ধোঁকার ভিত্তি হলো কোন একটি জিনিষ দেখিয়ে তার বিপরীতটি গোপন করা। এবং এর মাঝে যুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বনের উৎসাহ ও ধোঁকা দেয়ার পরামর্শ রয়েছে; আর যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে সচেতন থাকবে না, তাহলে এই বিষয়টিই তার উপর চেপে বসবে (কাফিররা এই কৌশল অবলম্বন করবে) ইমাম আন নববী বলেছেনঃ ‘যুদ্ধে কাফিরদের ধোঁকা দেয়া এবং ধোঁকার যেকোন পন্থা ব্যবহার করার ব্যাপারে আলেমগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন; যতক্ষণ না এর দ্বারা কোন চুক্তি বা নিরাপত্তার আশ্বাস ভঙ্গ হয়। সেক্ষেত্রে (চুক্তিভঙ্গ) এটি জায়েজ হবে না।’ ইবনুল আরাবী বলেছেনঃ ‘যুদ্ধে ধোঁকা দেয়া হয় (শত্রুর) দুর্বলতা প্রকাশ করা, ফাঁদ পাতা এবং এমনই কিছু কৌশল বাস্তবায়নের জন্য। আর এই হাদীসে এটি (ধোঁকা) ব্যবহারের ইঙ্গিত রয়েছে; সেই সাথে এর প্রয়োজনীয়তাকে সাহসিকতার চাইতে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আর একারণেই হাদীসটিতে এই বিষয়ের উপর নির্দিষ্টতা আরোপ করা হয়েছে। এটা ঐ হাদীসটির মতঃ ‘হাজ্জ হলো আরাফাহ’।’ ইবনুল মুনির বলেন, ‘ ‘যুদ্ধ হলো ধোঁকা দেয়া’ এর অর্থ হলো, যে যুদ্ধ একজন ব্যক্তির জন্য উত্তম এবং উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে যথার্থ; তা শুধুমাত্র ধোঁকার মাঝেই রয়েছে; সম্মুখ মোকাবিলায় নেই। এবং এর কারণ হলো এই যে, সম্মুখ মোকাবিলায় ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে আর ধোঁকা দিয়ে যে বিজয় লাভ করা যায় তার মাঝে কোন বিপদ নেই।” [281]
আমার (লেখক) বক্তব্য হলোঃ এই হাদীসের মাধ্যমে যুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বনের আবশ্যকতা তুলে ধরা হয়েছে, কারণ তোমার শত্রু সবসময় চাইবে তোমাকে ধোঁকা দিতে ঠিক যেমনি তুমিও চাও (তাকে ধোঁকা দিতে)[282] তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا خُذُوا حِذْرَكُمْ فَانْفِرُوا ثُبَاتٍ أَوِ انْفِرُوا جَمِيعًا
“হে যারা ঈমান এনেছ! সতর্কতা অবলম্বন কর।”
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরো এক স্থানে বলেছেন,[283]
وَإِذَا كُنْتَ فِيهِمْ فَأَقَمْتَ لَهُمُ الصَّلاةَ فَلْتَقُمْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ مَعَكَ وَلْيَأْخُذُوا أَسْلِحَتَهُمْ فَإِذَا سَجَدُوا فَلْيَكُونُوا مِنْ وَرَائِكُمْ وَلْتَأْتِ طَائِفَةٌ أُخْرَى لَمْ يُصَلُّوا فَلْيُصَلُّوا مَعَكَ وَلْيَأْخُذُوا حِذْرَهُمْ وَأَسْلِحَتَهُمْ وَدَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ تَغْفُلُونَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ وَأَمْتِعَتِكُمْ فَيَمِيلُونَ عَلَيْكُمْ مَيْلَةً وَاحِدَةً وَلا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِنْ كَانَ بِكُمْ أَذًى مِنْ مَطَرٍ أَوْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَنْ تَضَعُوا أَسْلِحَتَكُمْ وَخُذُوا حِذْرَكُمْ إِنَّ اللَّهَ أَعَدَّ لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُهِينًا
“…এবং সতর্কতা অবলম্বন কর।” [284]
আর এই কৌশল যদি সংগঠিত সেনাবাহিনীওয়ালা রাষ্ট্রসমূহ ব্যবহার করতে পারে, তাহলে দুর্বল ও সংখ্যালঘু হবার কারণে মুসলিমদের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার কতই না বেশী হওয়া উচিৎ? এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, ধোঁকা, কৌশল এবং নিত্য নতুন পদ্ধতির ব্যবহার মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত জরুরী।
আর ধোঁকার কিছু কৌশলগত পরিস্থিতি রয়েছে, যা কেবল বিশেষজ্ঞরাই বুঝতে পারে; যেমন ছদ্মবেশ ধরা বা ক্যামোফ্লাজ (চোখে ধূলা দেয়া); প্রতারণা এবং এর উপযুক্ত সময় এবং এরূপ আরো অন্যান্য বিষয়। তবে আমরা এসব কৌশলের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করব না কারণ এই গ্রন্থটি শারীয়াহ সংক্রান্ত বিষয়ের আলোচনার জন্য; কৌশলগত আলোচনা নয়। আমরা এখানে শারীয়াহ এর দৃষ্টিভঙ্গিতে ধোঁকা এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য কৌশলের আলোচনা করব। আর শারীয়াহ সংক্রান্ত বিষয় দু’টি হলো- মিথ্যা বলা এবং গুপ্তহত্যা (আততায়ী হামলা) এরপর আমরা গোপনীয়তা ও ধোঁকার ব্যাপারে কিছু সাধারণ আলোচনার পাশাপাশি বিশেষ আলোচনাও পেশ করব।
প্রথমতঃ শত্রুর নিকট মিথ্যা কথা বলা।
আমি বলিনি, ‘… যুদ্ধের সময় মিথ্যা কথা বলা’, কারণ শত্রুর কাছে যুদ্ধের সময়ও যেমন মিথ্যা বলা যায় তেমনি যুদ্ধাবস্থা ছাড়াও মিথ্যা বলা যায়, এর প্রমাণ আমি পেশ করব ইনশা-আল্লাহু তা’আলা।
ক. যুদ্ধাবস্থায় মিথ্যা বলার দলীল রয়েছে উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা রদিআল্লাহু আনহার হাদীসে। তিনি বলেন, “আমি কখনো রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে মিথ্যা অবলম্বন করার অনুমতি দিতে শুনি নাই। তবে তিনটি ক্ষেত্রে অনুমতি দিয়েছেন, যুদ্ধের ব্যাপারে, মানুষের মাঝে বিবাদ মিটিয়ে সন্ধি ও শান্তি স্থাপনে এবং স্বামী স্ত্রীর সাথে ও স্ত্রী স্বামীর সাথে কথোপকথনে।” [285]
আন নববী রহিমাহুল্লাহ বলেন, “তিনটি ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার অনুমতি এই হাদীস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে একটি হলো যুদ্ধ। আত তাবারী বলেনঃ ‘যুদ্ধে যত মিথ্যার অনুমতি রয়েছে তাসবই হলো তাউরিয়া (বক্রোক্তি বা ঘুরিয়ে বলা), মিথ্যা নয়; কারণ এর অনুমতি নেই।’ কিšুÍ এটা শুধু তার নিজস্ব বক্তব্য, কারণ প্রকাশ্যভাবে এটি (হাদীস) তিনটি বিষয়ে মিথ্যার অনুমতি দিয়েছে, তবে একে তাউরিয়ার মাঝে সীমাবদ্ধ রাখা উত্তম, ওয়াল্লাহু আলিম (আল্লাহ্ এ ব্যাপারে ভালো জানেন)”[286]
এবং ইবনে হাযার রহিমাহুল্লাহ বলেন, “আন নববী বলেনঃ ‘ প্রকাশ্যভাবে এটি (হাদীস) তিনটি বিষয়ে মিথ্যার অনুমতি দিয়েছে, তবে একে তাউরিয়ার মাঝে সীমাবদ্ধ রাখা উত্তম।’ এবং ইবনুল আরাবী বলেনঃ ‘এবং যুদ্ধে মিথ্যা কথা বলা সেইসব ব্যতিক্রমসমূহের অন্তর্ভুক্ত, যা মুসলিমদের প্রতি রহমত স্বরূপ হাদীসের মাধ্যমে অনুমোদন করা হয়েছে, যা তাদের প্রয়োজন রয়েছে; এব্যাপারে কোন বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগের কোন অবকাশ নেই। আর মিথ্যা কথা বলা যদি বিবেকের কারণে হারাম করা হতো তাহলে এর অনুমতি দেয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না।” [287]
খ. আর যুদ্ধাবস্থা ছাড়া শত্রুর সাথে মিথ্যা অবলম্বনের অনুমতি রয়েছে নানা কারণে। এর মাঝে একটি হলো দুনিয়ায় মুমিনের জন্য কিছু সুবিধা অর্জন এবং কাফিরদের অনিষ্ঠ থেকে তাকে রক্ষা করা। এর দলীল হলোঃ
* ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের ঘটনা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তিনবার ব্যতীত কখনো মিথ্যা বলেননি; তন্মধ্যে দু’বার ছিল আল্লাহ্ আ’জ্জা ওয়া জ্বাল্লের পছন্দে। যেমন তার বক্তব্যঃ নিশ্চয় আমি অসুস্থ.. এবং তার বক্তব্যঃ না! এইটি, এদের সবচেয়ে বড়টি এই কাজ করেছে। এবং তিনি বলেন, ‘একদা ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এবং তার পত্নী অত্যাচারী শাসকদের মধ্যে কোন এক শাসকের এলাকায় এসে পৌঁছালেন (তা ছিল মিসর) তখন তাকে (শাসককে) সংবাদ দেয়া হলো যে, এ এলাকায় একজন লোক এসেছে। তার সাথে একজন সর্বাপেক্ষা সুন্দরী স্ত্রী রয়েছে। তখন সে (রাজা) তার (ইব্রাহীম) কাছে লোক পাঠালো। সে তাকে মহিলাটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল, এ মহিলাটি কে? তিনি উত্তর দিলেন মহিলাটি আমার বোন। তারপর তিনি সারার কাছে আসলেন এবং বললেন, হে সারা আমি ছাড়া পৃথিবীর উপর আর কোন মু’মিন নেই। এ লোকটি আমাকে তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল। তখন আমি তাকে জানিয়েছি যে, তুমি আমার বোন। কাজেই তুমি আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন কর না।” ইবনে হাযার রহিমাহুল্লাহ তার ব্যাখ্যায় বলেন, “অন্যথায় এমন পরিস্থিতিতে প্রকাশ্য মিথ্যা বলা জায়েজ, এমনকি এটা কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে যখন একটি ছোট অন্যায়ের দ্বারা অনেক বড় অন্যায় দমন করা যায়। আর এগুলোকে মিথ্যা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি এটাকে অন্য মিথ্যার মতো নিন্দনীয় বলতে চাননি, যদিও এটা অপমানজনক এবং অনৈতিক; কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে এটি উত্তম, এই ঘটনাটি তারই একটি উদাহরণ। তিনি বলেছেনঃ ‘…তন্মধ্যে দু’বার ছিল আল্লাহ্ আ’জ্জা ওয়া জ্বাল্লের পছন্দে’। তিনি এই দুটোকে সারার কাহিনী থেকে পৃথক করেছেন, কারণ যদিও সেটি আল্লাহরই পছন্দে ছিল, তারপরও এরমাঝে তার নিজেরও কিছুটা স্বার্থ ছিল; আর বাকি দু’টির পুরোটাই ছিল আল্লাহর জন্য। এবং হাসসান রদিআল্লাহু আনহুর বর্ণনায় এসেছে, “ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তিনবার ব্যতীত কখনো মিথ্যা বলেননি; প্রত্যেকবারই ছিল আল্লাহ্ আ’জ্জা ওয়া জ্বাল্লের পছন্দে।” [288]
আমার বক্তব্য হলোঃ সুতরাং এই মিথ্যা, যার মাঝে দ্বীনি সুবিধা রয়েছে এবং এর মাঝেই রয়েছে কাফিরদের অনিষ্ট থেকে পালাবার সুযোগ।
* ‘আসহাবুল উখদুদের’ ঘটনা- শুআইব রদিআল্লাহু আনহু হতে মুসলিম বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “পূর্বকালে এক বাদশাহ ছিল। তার দরবারে ছিল এক যাদুকর। সে বৃদ্ধ হয়ে গেলে বাদশাহকে বলেঃ আমি তো এখন বৃদ্ধ হয়ে পড়েছি এবং আমার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। সুতরাং আমাকে এমন একটি ছেলে দিন যাকে আমি ভালোভাবে যাদুবিদ্যা শিখাতে পারি। তারপর সে একটি মেধাবী বালককে যাদুবিদ্যা শিখাতে শুরু করে। বালকটি তার গুরুর কাছে যাবার পথে এক আবেদের ঘরের পাশ দিয়ে যেত। সেই আবেদও কখনো ঘরে বসে ইবাদত করতেন, আবার কখনো জনগণের উদ্দেশ্যে ওয়াজ নসীহত করতেন। বালকটিও পথের পাশে দাঁড়িয়ে ইবাদতের পদ্ধতি দেখতো এবং ওয়াজ নসীহত শুনতো। এ কারণে যাদুকরের কাছেও মার খেত এবং বাড়িতে বাপমায়ের কাছেও মার খেত। কারণ যাদুকরের কাছেও যেমন দেরীতে পৌঁছাতো তেমনি বাড়িতেও দেরী করে ফিরতো। একদিন সে আবেদের কাছে তার দুরবস্থার কথা বর্ণনা করলো। আবেদ তাকে বলে দিলেনঃ যাদুকর দেরীর কারণ জিজ্ঞেস করলে বলবে যে, মা দেরী করে বাড়ি থেকে আসতে দিয়েছেন, কাজ ছিল। আবার মার কাছে গিয়ে বলবে যে, যাদুকর দেরী করে ছুটি দিয়েছেন।”
আন নববী রহিমাহুল্লাহ তার ব্যাখ্যায় বলেন, “এর মাঝে যুদ্ধের সময় ও সেরকম পরিস্থিতিতে মিথ্যা বলার অনুমতি রয়েছে এবং সেইসাথে কাউকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্যও এই অনুমতি রয়েছে, হতে পারে তার নিজের জন্য অথবা অন্য কাউকে বাঁচাবার জন্য যার পবিত্রতা রয়েছে।” [289]
লেখকের বক্তব্যঃ আর এটি কোন যুদ্ধের পরিস্থিতি নয়। বরং আমার বিশ্বাস যে আন নববী এটাই ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন যে, যুদ্ধাবস্থা ছাড়াই কাফিরদের নিকট মিথ্যা বলা যদি জায়েজ হয় তাহলে যুদ্ধাবস্থায় এটি আরো গ্রহণযোগ্য হবে। এবং উপরোক্ত হাদীস ও ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের হাদীসের মাঝে , কাফিরদের অনিষ্ট থেকে মুক্তি লাভের জন্য মিথ্যা বলার অনুমতি রয়েছে। এবং আন নববী অন্যত্র বলেনঃ “তারা বলেছিল, ‘এবং এক্ষেত্রে কোন মতভেদ নেই যে, যদি একজন যালিম এমন কোন মানুষকে হত্যা করতে যায় যে আরেক ব্যক্তির আশ্রয়ে ছিল তবে ঐ ব্যক্তির (আশ্রয়দাতা) কর্তব্য হলো মিথ্যা বলা যে, সে (আশ্রিত) কোথায় আছে সে জানে না।
* এবং এই দুনিয়ার সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে কোন কাফিরকে মিথ্যা বলারও অনুমতি রয়েছে। এবং এ ব্যাপারে আল হাজ্জাজ ইবনে ইলাতের ঘটনা উল্লেখযোগ্য যা ইবনে হাযার ‘যুদ্ধাবস্থায় মিথ্যা বলা’ সংক্রান্ত অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “আর এ বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত হয় আহমাদ এবং ইবনে হিব্বান কর্তৃক বর্ণিত আনাস রদিআল্লাহু আনহুর হাদীস থেকে; এটি আল হাজ্জাজ ইবনে ইলাতের ঘটনা সংক্রান্ত যা আন নাসাঈও বর্ণনা করেছেন এবং আল হাকিম একে সহীহ বলেছেন। সে (আল হাজ্জাজ) যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অনুমতি চেয়েছিল যে, সে মক্কাবাসীর কাছ থেকে তার সম্পদ নেয়ার জন্য তার ব্যাপারে যা ইচ্ছা তাই বলবে; এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে অনুমতি দিয়েছিলেন যে, সে যেন মক্কাবাসীকে জানায় যে, খায়বারবাসী মুসলিমদের পরাজিত করেছে এবং এ ব্যাপারে আরো যা কিছু প্রচলিত আছে।” – এরপর তিনি (ইবনে হাযার) বলেন- “আল হাজ্জাজ ইবনে ইলাতের ঘটনাও যুদ্ধের সময়কার নয়।” [290]
ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহও তার গ্রন্থ ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ -তে আল হাজ্জাজের ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।[291]
লেখকের বক্তব্যঃ এটাই ছিল যুদ্ধাবস্থায় অথবা যুদ্ধাবস্থা ছাড়া শত্রুর কাছে মিথ্যা বলার ব্যাপারে আলোচনা। আর এসবই ধোঁকার অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয়তঃ একজন মুহারিব (যুদ্ধরত) কাফিরকে আততায়ী আক্রমণে হত্যা করার অনুমতি।
‘মুহারিব’ অর্থ হলো, যুদ্ধরত বা যার সাথে কোন শান্তি চুক্তি নেই এবং হাদীসের বর্ণনায় এই বিষয়টি (গুপ্তহত্যা) তাদের ক্ষেত্রে ব্যবহারের কথা এসেছে, আল্লাহ্ তা’আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি যাদের অনিষ্ট সবচেয়ে বেশী। এ ব্যাপারে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাঁর কিতাবে ইঙ্গিত দিয়েছেনঃ
فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“…তখন মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা করো, তাদের পাঁকড়াও করো, তাদেরকে ঘেরাও করো এবং প্রতিটি ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওঁত পেতে বসে থাকো।” [292]
আল কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, “… এবং প্রতিটি ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওঁত পেতে বসে থাকো”অর্থাৎ তাদের জন্য ঐসব গোপন স্থানে অপেক্ষা করো যেখানে নজরদারী রাখে। এটি দাওয়াহ দেয়ার পূর্বে তাদেরকে গুপ্ত আক্রমণে হত্যা করার অনুমতির দলীল ।” লেখকের বক্তব্যঃ কুরতুবীর উক্তি, “…দাওয়াহ দেয়ার পূর্বে..”-এর মানে হলো, যার কাছে দাওয়াহ আগেই পৌঁছে গেছে। এবং এই আয়াতঃ “… এবং প্রতিটি ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওঁত পেতে বসে থাকো”- এর মাঝে শত্রুর ওপর নজরদারী, গোয়েন্দাগিরি এবং গুপ্তচরবৃত্তির অনুমোদন রয়েছে।
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহতে আমরা কাব ইবনে আল আশরাফ এবং আবু রাফি ইবনে আবু আল হুকাইকের এর ঘটনাদ্বয় দেখতে পাই, যারা উভয়েই ছিল ইয়াহুদী।
* কাব মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের অনুপ্রেরণা যোগাত এবং সে তার কবিতার দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবমাননা করতো এবং মুসলিম নারীদের নিয়ে কুৎসিত ভাষায় কবিতা লিখত। তাকে হত্যার কাহিনী বুখারী ও মুসলিম উভয়েই বর্ণনা করেছেন।
জাবির রদিআল্লাহু আনহুর সূত্রে বুখারী বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘কাব ইবনে আল আশরাফের (সাথে বোঝাপড়ার) জন্য কে আছো? এই লোকটি আল্লাহ্ তা’আলা এবং তাঁর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছে।’ অতঃপর মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ দাঁড়ালেন এবং বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি কি চান যে, আমি তাকে হত্যা করি?’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘হ্যাঁ’। তিনি (মাসলামাহ) বললেন, ‘তবে আপনি আমাকে কিছু কথা বলার অনুমতি দিন।’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘বলতে পারো’। সুতরাং মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ তার কাছে গেলেন।” [293] এবং এই হাদীসে রয়েছে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ এবং তার সঙ্গীরা কাবকে এই বলে ধোঁকা দিয়েছিলেন যে, তারা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কারণে অতিষ্ঠ এবং তারা তাকে হত্যা করার পূর্ব পর্যন্ত ধোঁকার মাঝে রেখেছিলেন, অথচ তখন সে ছিল এক সুরক্ষিত দূর্গের অভ্যন্তরে।
ইবনে হাযার রহিমাহুল্লাহ বলেন, “এবং ইকরিমাহ রদিআল্লাহু আনহুর বর্ণনায় রয়েছে, ‘সুতরাং ইয়াহুদীরা ভীত হয়ে পড়লো, সুতরাং তারা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আসলো এবং বলল, ‘আমাদের নেতা আততায়ী হামলায় নিহত হয়েছেন’। অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে তার(কাব) কৃতকর্মের কথা স্মরণ করালেন, সে কিসের দ্বারা তার বিরোধিতা করতো এবং মুসলিমদের অবমাননা করতো।’ ইবনে সাদ তার বর্ণনায় যোগ করেছেন, ‘সুতরাং তারা ভয় পেয়ে গেল এবং এরপর আর কিছুই বলল না।’-”ইবনে হাযার আরো বলেছেন, “এবং এতে একজন মুশরিককে দাওয়াহ দেয়ার আগে হত্যা করার অনুমতি আছে, যতক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ দাওয়াহ তার কাছে পৌঁছেছে। এবং এর মাঝে যুদ্ধের সময় প্রয়োজনীয় যেকোন কথা বলার অনুমতি অনুমতি আছে, যদিও সে আসলে ঐ কথাটি বলতে চায়নি।” [294] এবং বুখারী এই হাদীসটি ‘যুদ্ধে মিথ্যা বলা’ এবং ‘মুহারিবকে আততায়ী আক্রমণে হত্যা করা’ – উভয় অধ্যায়েই আলোচনা করেছেন।
লেখকের বক্তব্যঃ কেউ যদি বলে যে, আল্লাহ্ তা’আলা এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত কাফিরকে আততায়ী আক্রমণে হত্যা করা একরকম বেঈমানী অথবা ইসলামে নিষিদ্ধ; তাহলে সেই ব্যক্তি বিভ্রান্ত এবং যার মাঝে কিতাব ও সুন্নাহর প্রতি ‘তাকছিব’ (সত্যতা গ্রহণ না করা) রয়েছে। আন নববী রহিমাহুল্লাহ বলেন, “তিনি- আল কাযী আইয়াদ- বলেন, ‘তার হত্যাকাণ্ড বেঈমানী ছিল এমনটি বলা জায়েজ নয়। এবং একজন ব্যক্তি একটি মজলিসে একথা বলেছিল এবং আলী ইবনে আবু তালিব রদিআল্লাহু আনহু সেখানে উপস্থিত ছিলেন; সুতরাং তার গর্দান উড়িয়ে দেয়ার আদেশ দিলেন।” [295] এবং (আলীর) এই ঘটনাটি আল কুরতুবী আল্লাহ্ তা’আলার ঐ আয়াতের তাফসীরে উল্লেখ করেছেন,
وَإِنْ نَكَثُوا أَيْمَانَهُمْ مِنْ بَعْدِ عَهْدِهِمْ وَطَعَنُوا فِي دِينِكُمْ فَقَاتِلُوا أَئِمَّةَ الْكُفْرِ إِنَّهُمْ لا أَيْمَانَ لَهُمْ لَعَلَّهُمْ يَنْتَهُونَ
“… কাফিরদের প্রধানদের সাথে যুদ্ধ করো।” [296]
ইবনে তাইমিয়্যাহ এটি তার গ্রন্থ ‘আস সারাম আল মাসলুল আলা শাতিম আর রাসূল’-এ উল্লেখ করেছেন। এবং তিনি মুআবিয়া এবং মাসলামাহ রদিআল্লাহু আনহুমের মধ্যে সংঘটিত একটি ঘটনা বর্ণনা করেন।
* আবু রাফি ইবনে আবু আল হুকাইক ছিল খায়বারে একজন ইয়াহুদী এবং সে ছিল আরবের একজন ব্যবসায়ী। সে মক্কায় যায় এবং কুরাইশদের মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে, ফলে তারা আল আহযাব (মিত্র বাহিনী) জড়ো করে এবং আহযাবের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সে-ই ছিল এই আগুনের ইন্ধনদাতা। আল বুখারী, আল বারা ইবনে আযিব রদিআল্লাহু আনহুর সূত্রে বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু রাফে আল ইয়াহুদের নিকট আনসারদের কিছু লোক পাঠালেন, এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আতিককে তাদের ওপর নেতৃত্ব দিলেন। আর আবু রাফে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে অপমান করতো এবং তাঁর বিরুদ্ধে অন্যদের সাহায্য করতো। এবং সে আল হিযাজের ভূখণ্ডে তার একটি দূর্গে থাকতো।” একই সূত্রে বর্ণিত আরো একটি হাদীসে রয়েছে, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু রাফের নিকট একটি দল পাঠালেন। রাতে সে যখন ঘুমিয়ে ছিল, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে আতিক তার ঘরে প্রবেশ করেন এবং তাকে হত্যা করেন।” [297] ইবনে আতিক রদিআল্লাহু আনহু ঐ দূর্গে ঢোকার পর থেকে তাকে হত্যা করার আগ পর্যন্ত নানা প্রকার ধোঁকার আশ্রয় নিয়েছিল। সে ইয়াহুদীদের দরজাগুলো বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল। এরপর তিনি আবু রাফের নিকট যান এবং তিনি যে ঘরেই প্রবেশ করেছেন, সেটাই তিনি ভেতর থেকে বন্ধ করেছেন এবং তিনি তার কণ্ঠস্বর বিকৃত করে আবু রাফেকে ডেকেছেন, যাতে সে তাকে চিনতে না পারে।
ইবনে হাযার রহিমাহুল্লাহ বলেন, “এই হাদীসে বেশ কয়েকটি উত্তম জিনিষ রয়েছে; তার মধ্যে অন্যতম হলো সেই মুশরিককে হত্যা করার অনুমতি যার কাছে দাওয়াহ পৌঁছেছে এবং সে এর বিরোধিতায় লিপ্ত থেকেছে; এবং তাকে হত্যার অনুমতি যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে অন্যদের সহযোগিতা করে তার হাত দিয়ে (শারীরিকভাবে) অথবা তার অর্থ দিয়ে অথবা তার জিহ্বা দিয়ে; এবং যুদ্ধরত শত্রুর উপর গুপ্তচরবৃত্তি করার এবং তাদের অসতর্ক অবস্থার সন্ধান করার অনুমতি; মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিষ্ঠার সাথে নিয়োজিত থাকার গুরুত্ব এবং কোন সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে অথবা বিপুল সংখ্যক মুশরিকদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের স্বল্প সংখ্যার কারণে তাদের সাথে অস্পষ্ট কথা বলার অনুমতি।” [298] আল বুখারী এই ঘটনাটি তার কিতাবুল জিহাদে ‘ঘুমন্ত মুশরিককে হত্যা করা’ আলোচনা করেছেন।
* আর শেখ আব্দুর রহমান আদ দাওসারী রহিমাহুল্লাহ আল্লাহর আয়াতের তাফসীরে ইবাদতের বিভিন্ন স্তরের বর্ণনা দিতে গিয়ে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। আয়াতটি হলো,
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
“আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি।” [299]
তিনি বলেন, “সুতরাং কারো সাধ্যানুযায়ী শক্তি সঞ্চয় করা দ্বীনি দায়িত্ব এবং এটি প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয়তার মাঝে পড়ে। সুতরাং যে সঠিকভাবে আল্লাহর ইবাদত করে, সে কখনোই এটি ত্যাগ করা বা স্থগিত করা বা একে হাল্কাভাবে নেয়ার মতো অন্যায় করতে পারে না। এবং আল্লাহর যে ইবাদতকারী জিহাদের ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সে কাফিরদের নেতা, নাস্তিকতার দিকে আহ্বানকারী এবং সর্বত্র আপোষকারী (Liberal) নেতাদের এবং প্রতিটি কাফির যে আল্লাহর আয়াতকে আক্রমণ করে এবং যে তার কলমে ও তার প্রচারণায় এই সত্য ধর্মের বিরোধিতা করে এমন সবাইকে হত্যা করার জন্য অভিযান চালাবে, কারণ তারা আল্লাহ্ তা’আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অপমানকারী। দুনিয়ার কোন প্রান্তে কোন বিশেষ (আলেম বা মুজাহিদ) বা কোন সাধারণ মুসলিমের জন্য ঐ ব্যক্তিকে বাঁচতে দেয়া জায়েজ নয়, কারণ সে ইবনে আবু হাকাইক বা অন্যান্যদের চেয়েও বেশী অনিষ্টসাধনকারী, যাদেরকে হত্যা করার জন্য আল্লাহ্ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বয়ং হুকুম দিয়েছেন। সুতরাং বর্তমান সময়ে তাদের উত্তরাধিকারীদের হত্যা পরিকল্পনা বাদ দেয়ার অর্থ হলো আল মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রত্যাদেশ প্রত্যাখ্যান করা এবং আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদতে চরম ব্যতিক্রম করা, আল্লাহর দ্বীনের ধ্বংসকারীদের ভয়াবহ ও ঘৃণ্য উপায়ে বৈধতা দান করা। এই পরিস্থিতিকে শুধুমাত্র আল্লাহর দ্বীন রক্ষার প্রতি অন্তরের আকাঙ্ক্ষার অভাব (আল ঘিরাহ) এবং আল্লাহর গযব আনয়ন করার শামিলরূপেই ব্যাখ্যা করা যায়। আর এটা আল্লাহ্ তা’আলা এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ও তাদের প্রতি সম্মানের অভাবেই হয়ে থাকে, যা কখনোই তার কাছ থেকে আসবে না যে সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে আল্লাহর ইবাদত প্রতিষ্ঠিত করেছে।” [300]
লেখকের বক্তব্যঃ এখানে একটি লক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, আর তা হলো, যদি কখনো কোন কাফিরকে মারার জন্য নারী ও শিশুকে হত্যা করা আবশ্যক হয়ে পড়ে (অর্থাৎ তাদের হত্যা না করে ঐ কাফিরকে হত্যা করা সম্ভব না হয়) তাহলে এই পরিস্থিতিতে নারী ও শিশু হত্যা করা যাবে কি যাবে না? এর উত্তর হলোঃ যদিও তারা কোনরূপ যুদ্ধ করেনি তারপরও তাদেরকে হত্যা করা যাবে যদি তাদেরকে হত্যা না করে ঐ কাফিরকে হত্যা করা অসম্ভব হয়; এক্ষেত্রে তাদেরকে হত্যার কোন নিয়্যত থাকতে পারবে না। এ ব্যাপারে দুইটি হাদীস পাওয়া যায়ঃ
* ইবনে উমর রদিআল্লাহু আনহুর হাদীস, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন এক যুদ্ধে জনৈকা মহিলাকে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহিলা ও শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করেন।” [301]
* আস সাব ইবনে জাছামাহ রদিআল্লাহু আনহু বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবওয়া অথবা ওয়াদ্দান নামক স্থানে আমার কাছ দিয়ে পথ অতিক্রম করেন। তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, যেসকল মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ হচ্ছে, যদি রাত্রিকালীন আক্রমণে তাদের মহিলা ও শিশুগণ নিহত হয় তাহলে কি হবে? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তারা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।” [302] অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে জিজ্ঞাসা করা হলো, যদি অশ্বারোহীগণ রাতের আধারে আক্রমণ চালায় এবং তাতে মুশরিকদের শিশুসন্তান মারা যায়, (তবে কি হবে)? তিনি বললেন, তারাও তাদের পিতাদের অন্তর্গত।” [303]
আন নববী রহিমাহুল্লাহ বলেন, “‘ তারাও তাদের পিতাদের অন্তর্গত’- অর্থাৎ, এতে কোন সমস্যা নেই কারণ তাদের পিতাদের ব্যাপারে হুকুম তাদের ওপর বর্তায় যেমন, উত্তরাধিকার, বিবাহ, কিসাস, দিয়াত (রক্তপণ) এবং আরো অন্যান্য বিষয়। আর এক্ষেত্রে এটাই বোঝানো হয়েছে যে, জরুরী অবস্থায় পড়া ছাড়া তাদেরকে হত্যা করার কোন উদ্দেশ্য ছিল না; আর যে হাদীসে নারী ও শিশুদের হত্যা করাকে নিষিদ্ধ হয়েছে সেটা তখনই প্রযোজ্য যখন তাদেরকে পৃথক করা সম্ভব (যাকে হত্যা করা প্রয়োজন তার থেকে উপস্থিত নারী ও শিশুকে পৃথক করা) রাত্রিকালীন আক্রমণ এবং রাত্রিকালীন আক্রমণে নারী ও শিশুহত্যার অনুমতি সংক্রান্ত হাদীসের ব্যাপারে আমাদের বিশেষজ্ঞ অভিমত (মাযহাব); সেই সাথে মালিক ও আবু হানিফার এবং অধিকাংশের অভিমত। আর রাত্রিকালীন আক্রমণের মানে হলো তাদের বিরুদ্ধে রাতের আক্রমণ করা যাতে পুরুষদেরকে নারী ও শিশুদের থেকে আলাদা কেও চেনা সম্ভব হয় না।”[304]
আর ইবনে কুদামাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন, “এবং রাতে তাদেরকে আক্রমণ করা জায়েজ এবং এর মানে হলো রাতে তাদেরকে অতর্কিতে আক্রমণ করা এবং তাদেরকে হত্যা করা যখন তারা অপ্রস্তুত থাকে। আহমাদ বলেন, ‘রাতে আক্রমণ করার মধ্যে কোন সমস্যা নেই। আর তারা (সাহাবাগণ) কি রোমানদের রাতে ছাড়া (অন্য সময়ে) আক্রমণ করেছিল?’ এবং তিনি বলেন, “আমরা এমন কারো ব্যাপারে জানিনা যে, রাতে কাফিরদের আক্রমণ করাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন?”এবং সুফিয়ান উল্লেখ করেন, আয যুহরী থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে, তিনি আস সাব ইবনে জাছামাহ থেকে, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবওয়া অথবা ওয়াদ্দান নামক স্থানে আমার কাছ দিয়ে পথ অতিক্রম করেন। তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, যেসকল মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ হচ্ছে, যদি রাত্রিকালীন আক্রমণে তাদের মহিলা ও শিশুগণ নিহত হয় তাহলে কি হবে? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তারা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এর রিওয়ায়াত (বর্ণনাসূত্র) উত্তম।’ সুতরাং যদি বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নারী ও শিশুদের হত্যা করতে বারণ করেছেন, তবে আমরা বলব, সেটি তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যার ব্যাপারে প্রযোজ্য। আহমাদ বলেন, ‘যদি তাদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যার ব্যাপার হয়, তবে (তা জায়েজ) না।’ তিনি বলেন, আস সাবের হাদীসটি এসেছে নারী ও শিশু হত্যা নিষিদ্ধ হবার পরে, নারী ও শিশু হত্যার ব্যাপারে তার নিষেধ এসেছে যখন তিনি ইবনে আবু হুকাইককে হত্যার জন্য লোক পাঠান আর এজন্যই এই দু’টির মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব; ইচ্ছাকৃতভাবে (তাদের হত্যা) করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এবং এ অন্যক্ষেত্রে বিশেষ অনুমতি।” [305]
এবং আবু বাকর আল হাযিমি এই দু’টি হাদীস উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, একদলের (আলেম) অভিমত হলো যে, প্রথম হাদীছটি দ্বারা দ্বিতীয়টি রহিত হয়েছে এবং অপরদলের অভিমত হলো এর বিপরীত, এবং অপর দলটি এই দু’টি হাদীসের মধ্যে সমন্বয় করার অভিমত গ্রহণ করেছেন। এরপর তিনি আশ শাফিঈর বক্তব্য পেশ করেন, যা সমন্বয়ের মতটি সমর্থন করে, “আশ শাফিঈ বলেন, আস সাবের হাদীসটি হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উমরাহকালীন সময়ের; সুতরাং এটি যদি প্রথম উমরাহ্ এর সময় হয় তবে আবু হুকাইক তো তার আগেই নিহত হয়েছে এবং বলা হয়ে থাকে এটি একই বছরে সংঘটিত হয়। আর যদি এটি দ্বিতীয় উমরাহ্ এর সময় হয় তবে সন্দেহাতীতভাবে এটি আবু হুকাইকের ঘটনার পরে। ওয়াল্লাহু আলেম।’ আশ শাফিঈ রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আর এই অভিমত নেই না যে, তিনি নারী ও শিশুদের হত্যার ব্যাপারে ছাড় দিয়েছেন এবং পরবর্তীতে তা নিষিদ্ধ করেছেন। আমাদের মতে, নারী ও শিশু হত্যার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা হলো তাদেরকে ইচ্ছাকৃত হত্যা করার ক্ষেত্রে এবং যেসব পরিস্থিতিতে তাদেরকে ঐসব ব্যক্তি (টার্গেট) থেকে সনাক্ত ও আলাদা করা সম্ভব সেসব পরিস্থিতির জন্য। ‘… তারা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত’- এই বক্তব্যের অর্থ দ্বারা তাদের দু’টি বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঙ্গিত করা হয়; প্রথমত তারা ঈমানের পরিধিতে নেই, থাকলে তাদের রক্ত ঝরানো (মুসলিমদের জন্য) হারাম হতো এবং দ্বিতীয়ত, তারা দারুল ঈমানে বসবাসকারীদের মধ্যেও গণ্য নয়, নতুবা তাদের ঘরে আক্রমণ করা নিষিদ্ধ হতো। আর একারণেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাত্রিকালীন আক্রমণ ও তাদের ঘরে আক্রমণ করার অনুমতি দিয়েছেন এবং তিনি বনু মুসতালিকের উপর আক্রমণ করেছেন যখন তারা অপ্রস্তুত ছিল। আর এ কথা সবারই জানা যে, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমতি সাপেক্ষে কেউ রাত্রিকালে আক্রমণ চালালে নারী ও শিশুদের আক্রান্ত না করে তা সম্পন্ন করতে পারবে না। … এবং তাদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা ঠিক নয় যখন তাদেরকে আলাদা করা এবং চেনা সম্ভব হয়। শিশুদের হত্যার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণ হলো তারা এখনো কুফরের উপর বয়:প্রাপ্ত হয়নি যার জন্য তাদেরকে হত্যা যায়; আর নারীদের হত্যা করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণ হলো যে, তাদের মধ্যে যুদ্ধে জড়াবার কোন আগ্রহ বা ইচ্ছা নেই; আর তাছাড়া তারা এবং তাদের সন্তানেরা তো এক প্রকারের দান, যা দ্বারা মহিমান্বিত পরাক্রমশালী আল্লাহর দ্বীনের অনুসারীরা আরো শক্তিশালী হয়।” [306]
লেখকের বক্তব্যঃ আশ শাফিঈর বক্তব্য এবং আন নববীর বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হলোঃ কাফিরদের মধ্যে যাদের হত্যার উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালিত হয় তাদের থেকে ঐসব নারী ও শিশুদের আলাদা করা বা চেনা সম্ভব না হলে, তাদেরকে (নারী ও শিশু) হত্যার মাঝে কোন পাপ নেই- যতক্ষণ না তাদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এবং আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) এব্যাপারে ভালো জানেন।
তৃতীয়তঃ ইসলামে গোপনীয়তা রক্ষার গুরুত্ব
ইসলামে গোপনীয়তা হতে পারে দাওয়াহর ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে এবং যুদ্ধাভিযানের ক্ষেত্রে। এবং প্রত্যেকটির ব্যাপারে দলীল আছেঃ
ক. দাওয়াহর ক্ষেত্রে গোপনীয়তাঃ
ইসলামে দাওয়াহর মূলনীতি হলো যে, এটি ঘোষণা করতে হবে প্রকাশ্যে। কারণ এই দাওয়াহ সমগ্র সৃষ্টির জন্য। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ
“হে রাসূল! যা কিছু আপনার রবের পক্ষ থেকে আপনার উপর নাযিল করা হয়েছে তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিন। যদি তা না করেন তাহলে তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পালন করলেন না।” [307]
তারপরও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই দাওয়াহকে ততদিন পর্যন্ত গোপন রেখেছিলেন যতদিন পর্যন্ত আল্লাহ্ অনুমতি দিয়েছেন।
“আপনার সালাত অনেক উঁচু আওয়াজেও পড়বেন না আবার খুব নিচু আওয়াজেও পড়বেন না।” এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস রদিআল্লাহু আনহু বলেছেন[308], এটি তখন নাযিল হয় যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কায় নিজেকে গোপন রেখেছিলেন। ইবনে হাযার বলেন, “‘মক্কায় নিজেকে গোপন রাখার’ অর্থ হলো ইসলামের প্রাথমিক সময়।” [309]
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
“তাই হে নাবী! যে বিষয়ে আপনাকে হুকুম দেয়া হচ্ছে, তা জোরে শোরে বলে দিন এবং যারা শিরক করে তাদের মোটেও পরওয়া করবেন না।” [310]
আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)র এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “এবং আবু উবাইদা, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গোপন ছিলেন যতদিন না এই আয়াতঃ ‘যে বিষয়ে আপনাকে হুকুম দেয়া হচ্ছে, তা জোরে শোরে বলে দিন’ নাযিল হয়।” [311]
খ. ঈমানের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গোপনীয়তাঃ ‘ঈমান গোপন করা’ আর এর দলীল হলোঃ
* আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)র আয়াত,
وَقَالَ رَجُلٌ مُؤْمِنٌ مِنْ آَلِ فِرْعَوْنَ يَكْتُمُ إِيمَانَهُ أَتَقْتُلُونَ رَجُلًا أَنْ يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ أَتَقْتُلُونَ رَجُلًا أَنْ يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَبِّكُمْ وَإِنْ يَكُ كَاذِبًا فَعَلَيْهِ كَذِبُهُ وَإِنْ يَكُ صَادِقًا يُصِبْكُمْ بَعْضُ الَّذِي يَعِدُكُمْ إِنَّ اللَّهَ لا يَهْدِي مَنْ هُوَ مُسْرِفٌ كَذَّابٌ
“এ সময় ফিরাউনের বংশের এক মু’মিন ব্যক্তি যে তার ঈমান গোপন করে রেখেছিলো সে বলে উঠলো,..”[312]
* আসহাবে কাহাফের ব্যাপারে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَكَذَلِكَ بَعَثْنَاهُمْ لِيَتَسَاءَلُوا بَيْنَهُمْ قَالَ قَائِلٌ مِنْهُمْ كَمْ لَبِثْتُمْ قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ قَالُوا رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثْتُمْ فَابْعَثُوا أَحَدَكُمْ بِوَرِقِكُمْ هَذِهِ إِلَى الْمَدِينَةِ فَلْيَنْظُرْ أَيُّهَا أَزْكَى طَعَامًا فَلْيَأْتِكُمْ بِرِزْقٍ مِنْهُ وَلْيَتَلَطَّفْ وَلا يُشْعِرَنَّ بِكُمْ أَحَدًا
إِنَّهُمْ إِنْ يَظْهَرُوا عَلَيْكُمْ يَرْجُمُوكُمْ أَوْ يُعِيدُوكُمْ فِي مِلَّتِهِمْ وَلَنْ تُفْلِحُوا إِذًا أَبَدًا
“এখন চলো তোমাদের নিজেদের মধ্যে কোন একজনকে রূপার এই মুদ্রাটি দিয়ে শহরে পাঠাও। সে দেখুক সবচেয়ে ভালো খাবার কোথায় পাওয়া যায়। সেখান থেকে সে কিছু খাবার নিয়ে আসুক। সে যেন সাবধান থাকে, যাতে কেউ তোমাদের এখানে থাকার কথা টের না পায়। যদি তোমাদের কথা তাদের কাছে প্রকাশ পায় তাহলে অবশ্যই তারা তোমাদেরকে পাথর মেরে শেষ করবে অথবা তাদের দ্বীনে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নিবে।” [313]
তাঁর এই আয়াতে গোপনীয়তা রক্ষার কথা বলা হয়েছে, “যাতে কেউ তোমাদের এখানে থাকার কথা টের না পায়”।
* ইবনে আব্বাস রদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আল মিকদাদ রদিআল্লাহু আনহুকে বলেন, “কোন ব্যক্তি যদি কাফিরদের সাথে অবস্থানকালে তার আপন ঈমান গোপন রাখে, এবং এরপর সে তার ঈমান প্রকাশ করার পর তাকে হত্যা করা হয়। তুমিও তো মক্কায় থাকাকালে তোমার ঈমান গোপন রেখেছিলে।”[314]
* আর আবু যার আল গিফারী রদিআল্লাহু আনহুর ঘটনায় লক্ষ্য করা যায়, যখন তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট প্রবেশ করলেন; তিনি বললেন, “আমার নিকট ইসলাম পেশ করুন।” আল্লাহর রাসূল আমার কাছে ইসলাম পেশ করলেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে গেলাম। এরপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন, “হে আবু যার! তোমার ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখো এবং তোমার এলাকায় চলে যাও। আমরা প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করেছি, একথা শোনার পর আমাদের সাথে এসে দেখা করবে।” আমি সেই সত্ত্বার শপথ করে বলছি, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, আমি কাফিরদের সামনে প্রকাশ্যে আমার ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করবো।” [315]
* এবং আল হাজ্জাজ ইবনে ইলাত আস সুলামী রদিআল্লাহু আনহু তার ইসলাম মক্কাবাসীদের থেকে গোপন রাখেন। এবং মক্কায় তার সম্পদ উদ্ধারের জন্য তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে তাদের নিকট মিথ্যা বলার অনুমতি চেয়েছেন।
* এবং মুসলিম তার “কিতাবুল ঈমান”-এ, ‘ভীত ব্যক্তির জন্য ঈমান গোপন রাখার অনুমতি’ অধ্যায়ে হুযাইফা রদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “আমরা একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন আমাদের বললেনঃ গণনা করতো, কতজন মানুষ ইসলামের কথা ঘোষণা করে। আমরা বললাম হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাদের ব্যাপারে আশংকা করছেন? আমরা তো প্রায় ছয়শ থেকে সাতশ লোক আছি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তোমরা জানো না, অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলা হবে। সাহাবী বলেন, পরবর্তীতে সত্যিই আমরা পরীক্ষার সম্মুখীন হই, এমনকি আমাদের কোন কোন ব্যক্তিকে গোপনে সালাত আদায় করতে হতো।” [316] আন নববী রহিমাহুল্লাহ
বলেন, “‘ এমনকি আমাদের কোন কোন ব্যক্তিকে গোপনে সালাত আদায় করতে হতো’ -এর দ্বারা সম্ভবত কোন সংঘটিত ফিৎনার কথা বলা হয়েছে।” [317]
লেখকের বক্তব্যঃ আপনারা দেখলেন যে, ঈমান গোপন রাখার (যাকে আমরা ‘গোপনীয়তা’ হিসেবে আলোচনা করেছি) অনুমতি রয়েছে এবং এটি ইসলামী শারীয়াহ এর অন্তর্গত, বিশেষ করে ঐ সকল মূহুর্তে যখন কাফিরদের থেকে কোন প্রকার ক্ষতির আশংকা থাকে। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন, “মু’মিনদের মধ্যে কেউ যদি এমন কোন এলাকায় থাকে যেখানে সে অত্যাচারিত অথবা এমন কোন সময়ে অবস্থান করে যখন সে অত্যাচারিত, তাহলে সে ধৈর্যের আয়াতসমূহের উপর আমল করবে এবং কিতাবীদের মধ্যে যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে যারা অপমান করে তাদের থেকে এবং মুশরিকদের থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য আমল করবে। আর যারা সক্ষম তার জিহাদের ঐসব আয়াতের উপর আমল করবে যেখানে দ্বীনের অপমানকারী কাফির নেতাদের সাথে এবং কিতাবীদের সাথে যুদ্ধ করার হুকুম দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না তারা হীন অবস্থায় জিযিয়া দেয়।” [318]
গ. সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা
আমি আগেই বলেছি যে, দাওয়াহর মূলনীতি হলো প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়া; আর এক্ষেত্রে গোপনীয়তা একটি ব্যতিক্রম মাত্র। তবে সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ঠিক উল্টো। এক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করাই মূল নীতি। এমন যে কোন কৌশল গ্রহণ করাই আবশ্যক যা তথ্য, রহস্য এবং গতিবিধি গোপন রাখতে সাহায্য করে। আর এসব করার মূল লক্ষ্যই হলো শত্রুকে অবাক করে দিয়ে তাদের অজান্তে আক্রমণ শানানো, আর এটাই বিজয়ের অন্যতম হাতিয়ার। সামরিক অভিযানের গোপনীয়তার ব্যাপারে দলীলগুলো হলোঃ
* বুখারীর বর্ণনায় তাবুকের যুদ্ধে কাব ইবনে মালিক রদিআল্লাহু আনহুর পিছিয়ে পড়ার ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারি, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোথাও জিহাদে যাওয়ার ইচ্ছা করলে অন্য স্থানের কথা বলে গন্তব্য স্থানের কথা গোপন রাখতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে অত্যধিক গরমের সময় তাবুকের যুদ্ধে যান। সফর ছিল অনেক দূরের। অঞ্চল ছিল খাদ্য ও পানীয়হীন। আর শত্রুসৈন্যের সংখ্যাও ছিল বেশী। তাই তিনি মুসলিমদের কাছে এই জিহাদের কথা খুলে বলে দিলেন, যাতে সবাই জিহাদের জন্য ঠিকমতো প্রস্তুত হতে পারেন। তিনি তাদেরকে ইঙ্গিতের মাধ্যমে তাঁর ইচ্ছার কথা জানিয়ে দিলেন।” সুতরাং ‘“রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোথাও জিহাদে যাওয়ার ইচ্ছা করলে অন্য স্থানের কথা বলে গন্তব্য স্থানের কথা গোপন রাখতেন’ -এই কথার দ্বারা বোঝা যায় যে সামরিক অভিযানের মূলনীতি হলো গোপনীয়তা রক্ষা করা। এবং আবু দাউদ তার বর্ণনায় এই কথাটিও যুক্ত করেনঃ “তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘যুদ্ধ হলো ধোঁকা দেয়া’।” আর হাদীসে একটি গোপনীয়তার ব্যাপারে একটি শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। সেটা হলো এই যে, একজন আমীর তার গন্তব্যের কথা অধঃস্তনদের অধিকাংশকে না জানিয়ে সৈন্য বাহিনী নিয়ে বের হতে পারবেন। কাবের হাদীস থেকে এ ব্যাপারটি জানা যায়, ‘ তাই তিনি মুসলিমদের কাছে এই জিহাদের কথা খুলে বলে দিলেন, যাতে সবাই জিহাদের জন্য ঠিকমতো প্রস্তুত হতে পারেন। তিনি তাদেরকে ইঙ্গিতের মাধ্যমে তাঁর ইচ্ছার কথা জানিয়ে দিলেন।’ এটা ছিল শুধুমাত্র তাবুক যুদ্ধের ঘটনা, অন্য কোন যুদ্ধে তিনি এটা করেননি। আর আমি এই বিষয়টি এই কারণে উল্লেখ করেছি যাতে মুজাহিদদের কেউ যেন একথা না বলেন যে, ‘জিহাদের গন্তব্য না জানালে আমি জিহাদে যাব না’। এবং এই হাদীসে আরো একটি উত্তম বিষয় রয়েছে, সেটা হলো এই যে, তথ্য গোপন করা শুধু শত্রুদের থেকেই নয় বরং দলীয় লোকদের থেকেও হতে পারে। এর উদ্দেশ্য হলো তথ্যকে একটি ক্ষুদ্র পরিসীমায় আবদ্ধ করা যাতে এটি পাচারের সম্ভাবনা কম থাকে; কারণ শত্রুরও গুপ্তচর থাকতে পারে আবার মিত্রও মুখ ফসকে বলে ফেলতে পারে। এ ব্যাপারে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘তোমার গোপনীয়তা তোমার রক্তের মাঝে; সুতরাং এটি তুমি কোথাও হিফাজত করবে সে ব্যাপারে খেয়াল রেখো’।
* গোপনীয়তার দৃষ্টান্ত আরো পাওয়া যায় আকাবার বাইয়াতের ঘটনায়, যা গোপনে সম্পাদিত হয়।
* এর দৃষ্টান্ত আরো রয়েছে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের ঘটনায়। যা তিনি অত্যন্ত গোপনে করেছিলেন। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
إِلا تَنْصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
“তোমরা যদি তাকে সাহায্য না করো (তবে কোন পরোয়া নেই) আল্লাহ্ তাকে ঐ সময়ও সাহায্য করেছেন, যখন কাফিররা তাকে (মক্কা থেকে) বের করে দিয়েছিল। যখন তিনি মাত্র দুইজনের একজন ছিলেন, যখন তারা দুজন গুহায় ছিলেন, যখন তিনি তার সাথীকে বলছিলেনঃ ঘাবড়িয়ো না, আল্লাহ্ আমাদের সাথেই আছেন।” [319]
এবং আবু বাকর রদিআল্লাহু আনহু বলেন, “আমি যখন গুহায় ছিলাম তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বললাম, ‘তাদের কেউ যদি তার পায়ের দিকে তাকায় তাহলে তারা আমাদের দেখে ফেলবে।’ সুতরাং তিনি বললেন, ‘তুমি কি মনে কর, হে আবু বাকর! সেই দুইজন সম্পর্কে যাদের সাথে তৃতীয় (সঙ্গী) হচ্ছেন আল্লাহ?’[320] এবং সুরাকা যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে অনুসরণ করছিল, তখন তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘আমাদের (চিহ্ন) গোপন রেখো’।
* এবং গোপনীয়তার দৃষ্টান্ত রয়েছে আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশের বাহিনীর ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কৌশলের মাঝে। তিনি তাকে একটি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন এবং তাকে আদেশ করেছিলেন যে, তিনি যেন দুই দিনের যাত্রা শেষ করার আগে এটি না খোলেন, এবং তারপর তিনি যেন এই চিঠির আদেশ অনুযায়ী কাজ করেন।
* এবং সামরিক অভিযানের গোপনীয়তার মধ্যেই রয়েছে শত্রুবাহিনীর উপর গুপ্তচরবৃত্তির বিষয়। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শত্রুদের মধ্যে গুপ্তচর পাঠাতেন, যেমন তিনি হুযাইফাকে আল আহযাবের শিবিরে পাঠিয়েছিলেন এবং আয যুবাইরকে একটি অনুসন্ধানী মিশনে একা পাঠিয়েছিলেন এবং সহীহ হাদীস থেকে এমন আরো কিছু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
* এর মাঝে আরো নুআইম ইবনে মাসউদের ইসলাম গোপনের ঘটনা, আল আহযাবের দিন যখন তিনি আল আহযাব (কাফিরদের মিত্র বাহিনী) এবং বনু কুরাইযার (মদীনার একটি ইয়াহুদী গোত্র) মাঝে অসন্তোষের বীজ বপন করেন। ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, “নুআইম ইবনে মাসউদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আসলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি ইসলামে প্রবেশ করেছি এবং আমার গোত্র আমার ইসলাম গ্রহণের কথা জানে না। সুতরাং আপনি আমাকে যা ইচ্ছা তাই হুকুম করতে পারেন।’ সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন, ‘নিশ্চয় তুমি তো মাত্র একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই নও (অর্থাৎ তুমি তো যুদ্ধ চালাতে পারবেনা); সুতরাং তুমি যদি পারো তবে তাদের তাদেরকে ধোঁকা দাও। কারণ নিশ্চয়, যুদ্ধতো হলো চালবাজি।’[321]
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, এটি জায়েজ এবং উপরন্তু তিনি এটাও বলেছেন যে, এ ধরণের সুবিধা আদায়ের জন্য মুশরিকদের অনুকরণ করে তাদের মতো পোষাক পরিচ্ছদ ধারণ করাও আবশ্যক। তিনি রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘এবং এই ব্যাপারটি স্পষ্ট করে দেয় যে, তাদের অনুকরণের ব্যাপারে যা বলা হয়েছে তা হিজরতের পূর্বে বহাল ছিল, এরপর তা রহিত হয়ে গেছে। কারণ ঐ সময়ে ইয়াহুদীরা নিজেদেরকে মুসলিমদের থেকে নিজেদের কেশবিন্যাস, কাপড় চোপড় বা কোন বেশভূষা বা অন্য কোন কিছুতে আলাদা করতো না।’
‘এরপর কিতাব ও সুন্নাহ অনুযায়ী কাফিরদের থেকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যে এবং বেশভূষায় পৃথক হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর এই হুকুম এটা আবার প্রতিষ্ঠিত হয় উমর ইবনুল খাত্তাব রদিআল্লাহু আনহুর সময়।’
‘আর এর কারণ হলো এই যে, দ্বীনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া অর্থাৎ জিহাদ এবং তাদের উপর অপমান ও জিযিয়ার আইন আরোপ করা ছাড়া তাদের থেকে ভিন্ন হওয়া যাবে না। সুতরাং মুসলিমরা প্রথমে যখন দুর্বল ছিল তখন তাদেরকে (বেশভূষায়) ভিন্ন হবার হুকুম দেয়া হয়নি। এরপর যখন দ্বীন পূর্ণতা পায় এবং এটি আধিপত্য লাভ করে এবং প্রাধান্য পায়, তখন এটি প্রয়োগ করা হয়।’
‘আর আজকের দিনে এর উদাহরণ হলো, দারুল হারব (যুদ্ধরত দেশ) অথবা যে দেশে যুদ্ধ নেই এমন দারুল কুফরে যদি কোন মুসলিম বসবাস করে, তাহলে সম্ভাব্য ক্ষতির আশংকায় তাকে তার বেশভূষায় তাদের (কাফিরদের) থেকে পৃথক হওয়ার জন্য হুকুম দেয়া হবে না। বরং তার জন্য উচিৎ হবে অথবা (ক্ষেত্র বিশেষে) তার জন্য আবশ্যক হবে তাদের সাথে মেলামেশা করা, যদি এর মধ্যে কোন দ্বীনের কোন কল্যাণ থাকে; যেমন, তাদেরকে দ্বীনের দাওয়াহ দেয়া, তাদের গোপন বিষয়ের খবরাখবর নিয়ে মুসলিমদের জানানো যাতে মুসলিমরা এর অনিষ্ট থেকে রক্ষা পায় এবং এমন আরো অনেক কাজ যা নেক উদ্দেশ্যে করা হয়।’
‘তবে ইসলামী রাষ্ট্রে যেখানে হিজরত হয়েছে (দারুল ইসলাম ওয়াল হিজরাহ), যেখানে আল্লাহ্ দ্বীনকে আধিপত্য দান করেছেন, এবং কাফিরদের উপর লাঞ্ছনা ও জিযিয়া আরোপ করা হয়েছে, সেখানে তাদের থেকে ভিন্ন হওয়ার হুকুমটি প্রয়োগ করা হবে। আর এই হাদীসের বক্তব্য তখনই পরিষ্কার হয় যখন বিভিন্ন সময় ও পরিস্থিতির কারণে এই হুকুমের অনুসরণের ভিন্নতা স্পষ্ট হয়।’[322]
লেখকের বক্তব্যঃ শারীয়াহ এর দলীল অনুযায়ী এই হলো গোপনীয়তার স্বরূপ। এই আলোচনা থেকেই আপনি তাদের ভ্রান্তি ধরতে পারবেন যারা বলে যে, ইসলাম গোপন মিশন অনুমোদন করে না। এবং এক্ষেত্রে সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, ইসলামী দাওয়াহ নিয়ে এগিয়ে চলা এক দল অন্যদের সাথে গোপনীয়তার প্রতিবাদ করে। তাদের এই প্রতিবাদ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের চিন্তা এই প্রতিবাদীদের অন্তরে কোনই প্রভাব ফেলেনি। অন্যথায় তারা গোপনীয়তার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারত, সুতরাং ভেবে দেখুন!
তিনি, (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَلَوْ أَرَادُوا الْخُرُوجَ لاعَدُّوا لَهُ عُدَّةً وَلَكِنْ كَرِهَ اللَّهُ انْبِعَاثَهُمْ فَثَبَّطَهُمْ وَقِيلَ اقْعُدُوا مَعَ الْقَاعِدِينَ
“যদি সত্যিই তাদের বের হবার ইচ্ছা থাকতো তাহলে এর জন্য তারা কিছু না কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করত।” [323]
‘যুদ্ধ হলো ধোঁকা দেয়া’ অধ্যায়ের আলোচনার এখানেই সমাপ্তি।
উনবিংশতম অধ্যায়ঃ শাহাদাতের উদ্দেশ্যে শাহাদাৎ নয়; বরং দ্বীন কায়েম করাই হলো শাহাদাতের মূল উদ্দেশ্য
এ অধ্যায়ের শিরোনাম এভাবেও দেয়া যেতে পারে,“জিহাদের মূল উদ্দেশ্য হলো দ্বীন কায়েম করা, শাহাদাৎ অর্জন নয়।”
শাহাদাতের মর্যাদার ব্যাপারে অসংখ্য আয়াত ও হাদীস রয়েছে। যেমন,
আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآَنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
“নিশ্চয় আল্লাহ্ মু’মিনদের নিকট থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন; এর বিনিময়ে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।” [324]
আবু হুরাইরা রদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে বের হয়েছে আল্লাহ্ তার জামিন হয়েছেন। আমার পথে জিহাদ করা, আমার উপর ঈমান আনা ও আমার প্রেরিত রাসূলদের সত্য বলে নেয়া ছাড়া অন্য কোন কারণ যাকে ঘরছাড়া করেনি, আল্লাহ্ তার দায়িত্ব নিয়েছেন যে, আল্লাহ্ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন অথবা সেই ঘরের দিকে প্রত্যাবর্তন করাবেন সওয়াব সহকারে বা গনীমত সহকারে, যেখান থেকে সে (জিহাদের জন্য) বের হয়েছিল। আর মুহাম্মাদের প্রাণ যে সত্তার হাতে তাঁর কসম! সেই ব্যক্তি আল্লাহর পথে যে কোন আঘাত পাবে কিয়ামতের দিন তা তাকে আল্লাহর দরবারে এমনভাবে হাজির করবে যেমন আঘাত পাবার দিন তার শারীরিক অবস্থা ছিল। তার বর্ণ হবে তখন রক্ত বর্ণ। তার গন্ধ হবে মিশকের গন্ধ। আর মুহাম্মাদের প্রাণ যে সত্তার হাতে তাঁর কসম! মুসলমানদের উপর যদি আমি এটা কঠিন মনে না করতাম তাহলে যে সেনাদলটি আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত তা থেকে আমি কখনো পেছনে অবস্থান করতাম না। কিন্তু আমি নিজেও এতটা সচ্ছল হতে পারিনি যে সবাইকে সওয়ারী দিতে পারি আর না মুসলমানদের এতটা সচ্ছলতা আছে। আর এটা তাদের জন্যও অত্যন্ত কষ্টকর হবে যে, তাদের পেছনে রেখে আমি জিহাদে চলে যাব। আর মুহাম্মাদের প্রাণ যে সত্তার হাতে তাঁর কসম! অবশ্যি আমি কামনা করি, আমি আল্লাহর পথে জিহাদে যাব এবং এত শহীদ হয়ে যাব, তারপর আবার জিহাদে যাব এবং আবার শহীদ হয়ে যাব, তারপর আবার জিহাদে যাব এবং আবার শহীদ হয়ে যাব।” [325]
আনাস রদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে সে আর পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাইবে না, যদিও সারা দুনিয়ার সমস্ত জিনিষ তার জন্য হয়ে যায়। তবে শহীদ যখন তার মর্যাদা দেখবে, সে আকাঙ্ক্ষা করবে আবার দুনিয়ায় ফিরে আসার এবং দশবার আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করার।”[326] হাদীসটিতে বোঝানো হয়েছে যে, কোন মানুষ যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে, সে কখনই দুনিয়ায় ফেরৎ আসতে চাইবে না, এমনকি যদি তাকে দুনিয়ার সমস্ত কিছু দিয়ে দেয়ার কথা বলা হয় তাহলেও না; কারণ সে দেখেছে জান্নাতের সৌন্দর্য কত অসীম। আর ঐ হাদীসঃ “জান্নাতের একটি চাবুক (সমপরিমাণ) এলাকাও এই দুনিয়া ও এর মাঝে যা কিছু আছে তা থেকে উত্তম।”[327] তবে শহীদের ব্যাপার ভিন্ন, কারণ সে আবার আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হবার জন্য দুনিয়াতে ফিরে আসাই পছন্দ করবে, যাতে সে শহীদের প্রাপ্ত মহান মর্যাদাকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে নিতে পারে। আর একারণেই ইবনে হাযার উল্লেখ করেছেন, “ইবনে বাত্তাল বলেছেনঃ শহীদের মর্যাদা সংক্রান্ত যত হাদীস এসেছে তার মাঝে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ।” [328]
এক্ষেত্রে আমরা শাহাদাৎ সংক্রান্ত কয়েকটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে চাই। সেগুলো হলোঃ প্রথমত, সফলতার পেছনে শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষার প্রভাব; দ্বিতীয়ত, বেপরোয়া বা হঠকারিতার রোগ; তৃতীয়ত, কাপুরুষতার রোগ; চতুর্থত, অনীহার রোগ।
প্রথমত: সফলতার পেছনে শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষার প্রভাব
একজন মু’মিনকে যা কিছু যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যায় তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘শাহাদাৎ লাভের আকাঙ্ক্ষা ও এর জন্য গভীর অনুরাগ’। আর এ থেকেই বলা যায়, শাহাদাৎ হলো এই জীবনে সফলতার টিকেট, কারণ এটিই আখিরাতে জান্নাতে প্রবেশের নিশ্চয়তা দেয়। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآَنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
“নিশ্চয় আল্লাহ্ মু’মিনদের নিকট থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন; এর বিনিময়ে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।” [329]
আর এর জন্য গভীর অনুরাগ সংখ্যা ও সরঞ্জামের স্বল্পতাকে পুষিয়ে দেয়, যা মুসলিমদের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে; এই অনুরাগ দেখেই কাফিররা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এর কারণ হলো, তুমি যদি কাফিরদের দিকে লক্ষ্য কর তাহলে দেখবে তারা এর সম্পূর্ণ বিপরীত, তারা এই দুনিয়ার প্রতি সবচেয়ে অনুরাগী। এ ব্যাপারে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
قُلْ إِنْ كَانَتْ لَكُمُ الدَّارُ الْآَخِرَةُ عِنْدَ اللَّهِ خَالِصَةً مِنْ دُونِ النَّاسِ فَتَمَنَّوُا الْمَوْتَ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ
وَلَنْ يَتَمَنَّوْهُ أَبَدًا بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ
وَلَتَجِدَنَّهُمْ أَحْرَصَ النَّاسِ عَلَى حَيَاةٍ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا يَوَدُّ أَحَدُهُمْ لَوْ يُعَمَّرُ أَلْفَ سَنَةٍ وَمَا هُوَ بِمُزَحْزِحِهِ مِنَ الْعَذَابِ أَنْ يُعَمَّرَ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِمَا يَعْمَلُونَ
“বলঃ ‘যদি আল্লাহর নিকট আখিরাতের বাসস্থান অন্য লোক বিশেষভাবে শুধু তোমাদের জন্যই হয় তবে তোমরা মৃত্যু কামনা কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ কিন্তু তাদের কৃতকর্মের জন্য তারা তা কখনোই কামনা করবে না এবং আল্লাহ্ জালিমদের সম্বন্ধে অবহিত। তুমি নিশ্চয় তাদেরকে জীবনের প্রতি সমস্ত মানুষ এমনকি মুশরিকদের থেকেও অধিক লোভী দেখতে পাবে। তাদের প্রত্যেকে আকাঙ্ক্ষা করে যদি তাদেরকে সহস্র বছর আয়ু দেয়া হত; কিন্তু দীর্ঘায়ু তাকে শাস্তি থেকে দূরে রাখতে পারবে না। তারা যা করে আল্লাহ্ তা দেখেন।” [330]
সুতরাং মহান আল্লাহ্ তা’আলার আয়াতটি ভেবে দেখুন, “… তারা তা কখনোই কামনা করবে না”এবং “তুমি নিশ্চয় তাদেরকে জীবনের প্রতি সমস্ত মানুষ এমনকি মুশরিকদের থেকেও অধিক লোভী দেখতে পাবে”। এবার আনাস রদিআল্লাহু আনহুর বর্ণিত হাদীসের সাথে তুলনা করে দেখুন, “তবে শহীদ যখন তার মর্যাদা দেখবে, সে আকাঙ্ক্ষা করবে আবার দুনিয়ায় ফিরে আসার এবং দশবার আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করার।” সুতরাং মৃত্যু ও শাহাদাতের জন্য মুমিনের অনুরাগ আর দুনিয়ার জন্য কাফিরের অনুরাগ সমানুপাতিক।
আর একারণেই মুসলিমদের মাঝে শাহাদাতের এই তামান্না জাগিয়ে তুলতে হবে, আর যুদ্ধক্ষেত্রে সাহাবা ও সালাফ আস সালিহীনদের দৃষ্টান্ত থেকে ঈমানী প্রস্তুতি গ্রহণ করে এই অনুরাগকে আরো দৃঢ় করতে হবে। এবং আমি এখানে আবারও বলব, আরাম আয়েশ ত্যাগ করার কথা- কারণ যে ব্যক্তি আয়েশ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কষ্ট করতে জানে, সে যুদ্ধের ময়দানেও ধৈর্য্য ধারণ করতে পারবে।
আর এক্ষেত্রে এটাও উল্লেখ করতে চাই যে, শাহাদাতের এই তামান্না আমদের প্রস্তুতিমূলক কৌশলের অংশ, যা মুসলিমদের জিহাদের অন্যতম মূলনীতি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “…আমাকে বিজয় দেয়া হয়েছে, একমাসের দূরত্বে (থেকে কাফিরদের অন্তরে) ভয়ের দ্বারা।” [331]
আর এই প্রস্তুতির নীতি দু’টি অক্ষের উপর দাঁড়িয়েঃ
১. সংখ্যার অক্ষঃ এর দ্বারা প্রস্তুতির ব্যাপ্তি বোঝাবে। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآَخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ لا تَعْلَمُونَهُمُ اللَّهُ يَعْلَمُهُمْ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لا تُظْلَمُونَ
“তোমরা তাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে, এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে এবং এতদ্ব্যতীত অন্যদেরকে যাদেরকে তোমরা জানো না, আল্লাহ্ তাদেরকে জানেন। আল্লাহর পথে যা কিছু ব্যয় করবে তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদের দেয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।” [332]
এই আয়াতে প্রস্তুতির ইঙ্গিত স্পষ্ট, তা হলো মহান আল্লাহর বাণী, “…এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে”- এর মানে হলো সামর্থ্য; আর সামর্থ্যের একেকটি অংশ হলো অর্থ, জনবল এবং অস্ত্র।
২. কৌশলের অক্ষঃ এর দ্বারা অগ্রগতি বোঝাবে। এটি দু’টি অংশে বিভক্ত; প্রথমত একজন মুসলিমের লড়াই করার ক্ষমতা;
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “একজন শক্তিশালী মু’মিন আল্লাহর কাছে একজন দুর্বল মুমিনের চেয়ে বেশী মর্যাদাবান এবং অধিক প্রিয়।” [333] অপর অংশটি মানসিক যা অর্জন হয় মুসলিমের অন্তরে শাহাদাৎ লাভের তামান্না জাগানো এবং মুসলিমদের মধ্যে ধৈর্যধারণের মাধ্যমে। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ কর, ধৈর্যে প্রতিযোগিতা কর এবং সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাক, আল্লাহর ভয় কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।” [334]
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরো বলেছেন,
وَلا تَهِنُوا فِي ابْتِغَاءِ الْقَوْمِ إِنْ تَكُونُوا تَأْلَمُونَ فَإِنَّهُمْ يَأْلَمُونَ كَمَا تَأْلَمُونَ وَتَرْجُونَ مِنَ اللَّهِ مَا لا يَرْجُونَ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا
“…যদি তোমরা যন্ত্রণা পাও তবে তারাও তোমাদের মতই যন্ত্রণা পায় এবং আল্লাহর নিকট তোমরা যা আশা কর তারা তা আশা করে না। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” [335]
এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আর জেনে রাখ বিজয় (আসবে) ধৈর্যের সাথে।” [336]
ঈমানভিত্তিক প্রস্তুতির এই আলোচনার মাঝে- আমি আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই- যুদ্ধের ময়দানে, আল্লাহর ভয় অর্থাৎ তাঁর আনুগত্য করা ও তাঁর অবাধ্যতা ত্যাগ, সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে থাকে। মহান আল্লাহ্ কাফিরদের ভীত করার মাধ্যমে তার অনুগত বান্দাদের বিজয় দেন। যেমন আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
إِذْ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى الْمَلائِكَةِ أَنِّي مَعَكُمْ فَثَبِّتُوا الَّذِينَ آَمَنُوا سَأُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ فَاضْرِبُوا فَوْقَ الْأَعْنَاقِ وَاضْرِبُوا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ
“যারা কুফরী করে আমি তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করব।” [337]
আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরো বলেন,
وَلَوْ قَاتَلَكُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوَلَّوُا الْأَدْبَارَ ثُمَّ لا يَجِدُونَ وَلِيًّا وَلا نَصِيرًا
سُنَّةَ اللَّهِ الَّتِي قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلُ وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا
“কাফিররা তোমাদের মোকাবিলা করলে তারা অবশ্যই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করত, তখন তারা কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পেত না। এটিই আল্লাহর বিধান প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে, তুমি আল্লাহর বিধানে কোন পরিবর্তন পাবে না।” [338]
আর একারণেই তাকওয়া ও নেক আমলের অংশটি কখনোই প্রস্তুতির নীতি থেকে বাদ দেয়া যাবে না। আর এই জ্ঞান উম্মাহর প্রথম যুগের মানুষগুলির মাঝে স্পষ্টভাবে বিদ্যমান ছিল। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসকে লেখা হযরত উমার রদিআল্লাহু আনহুর চিঠিতেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়, যা তিনি পারস্যের যুদ্ধের সময় লিখেছিলেন, চিঠিটির অংশবিশেষ ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বেপরোয়া বা হঠকারিতার ব্যাধি
শাহাদাৎ লাভের জন্যই শাহাদাৎ নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হলো দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করা; তবে এক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম আছে যা পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে। শাহাদাতের ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা অতি উত্তম এবং শাহাদাতের জন্য নিজের জীবনকে ঝুঁকির মাঝে ফেলাও প্রশংসনীয়, তবে এক্ষেত্রে মূল উদ্দেশ্য শাহাদাৎ লাভ করা নয়। বরং মূল উদ্দেশ্য হলো দ্বীনকে কায়েম করা। অন্যভাবে বলতে গেলে, শত্রুর উপর কতটুকু আঘাত করা যায় সেই চিন্তা না করে শুধুমাত্র শাহাদাতের লোভেই মুসলিমরা কখনো যুদ্ধের ময়দানে আক্রমণ চালাবে না। এর দলীল হলো,
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস, “যে ব্যক্তি আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে একমাত্র তার যুদ্ধই আল্লাহর পথে জিহাদ হিসেবে গণ্য।” [339]। সুতরাং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বীন কায়েম করাকে জিহাদের উদ্দেশ্য বলেছেন, শাহাদাৎ লাভ করা নয়, কারণ শাহাদাৎ মর্যাদা সে পেতেও পারে আবার নাও পেতে পারে। একজন ব্যক্তি তখনই শাহাদাৎ লাভ করবে যখন আল্লাহ্ তাকে এই মর্যাদার জন্য মনোনীত করবেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
إِنْ يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِثْلُهُ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَدَاءَ وَاللَّهُ لا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ
“এবং তোমাদের মধ্য থেকে কতককে শহীদরূপে গ্রহণ করতে পারেন।” [340]
* আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لا تُكَلَّفُ إِلا نَفْسَكَ وَحَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَكُفَّ بَأْسَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَاللَّهُ أَشَدُّ بَأْسًا وَأَشَدُّ تَنْكِيلًا
“সুতরাং আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর; তোমাকে শুধু তোমার নিজের জন্যই দায়ী করা হবে এবং মু’মিনদেরকে উদ্বুদ্ধ কর, হয়ত আল্লাহ্ কাফিরদের শক্তি সংযত করবেন। আল্লাহ্ শক্তিতে প্রবলতর ও শাস্তিদানে কঠোরতর।” [341]
সুতরাং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) কাফিরদের অশুভ শক্তিকে দমন করার জন্য জিহাদের আদেশ দিয়েছেন। এবং অন্য আয়াতে তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) কাফিরদের ফিৎনা দূর করার জন্য আদেশ দিয়েছেন,
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَإِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
“…যতক্ষণ না ফিৎনা দূরীভূত হয়…”[342]
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) কাফিরদের আঘাত করার নির্দেশ দিয়েছেন,
قَاتِلُوهُمْ يُعَذِّبْهُمُ اللَّهُ بِأَيْدِيكُمْ وَيُخْزِهِمْ وَيَنْصُرْكُمْ عَلَيْهِمْ وَيَشْفِ صُدُورَ قَوْمٍ مُؤْمِنِينَ
“তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ কর, তিনি তোমাদের হাত দ্বারা তাদেরকে শাস্তি দিবেন…”[343]
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠাকে জিহাদের উদ্দেশ্য হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
“মুশরিকরা অপ্রীতিকর মনে করলেও অপর সমস্ত দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করার জন্য তিনিই পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ তাঁর রাসূল প্রেরণ করেছেন।” [344]
আর তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) যুদ্ধকে তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার একটি মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করেছেন,
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَإِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
“এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিৎনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দ্বীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।” [345]
সুতরাং জিহাদের মূল উদ্দেশ্যই হলো দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা, শুধুমাত্র শাহাদাৎ লাভ করা নয়। আর এর উদ্দেশ্য হলো মুসলিমদের অন্তর থেকে বেপরোয়াভাব সরিয়ে একটি মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্য প্রতিস্থাপন করা, সেটি হলো সাহস। এর অবস্থান কাপুরুষতা এবং হঠকারিতার ঠিক মাঝখানে। কাফিরদের উপর কতটুকু আঘাত পড়লো সেই বিবেচনা না করেই শুধুমাত্র শাহাদাৎ লাভের জন্য জিহাদের ময়দানে যাওয়াই হলো হঠকারিতা বা বেপরোয়াভাব। যদিও কিছু ক্ষেত্রে এর অনুমতি রয়েছে; যেমন, কাউকে যদি কাফিররা ঘিরে ফেলে এবং তাকে আটক করার আশংকা থাকে তাহলে সে মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে পারে; যেমনটি ঘটেছিল আছিম ইবনে সাবিত রদিআল্লাহু আনহুর বাহিনীর ক্ষেত্রে[346]। তবে এটি মূলনীতি নয় বরং একটি ব্যতিক্রম। যদি মূলনীতিই হতো তাহলে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) কোন বাহিনীর সাথে মিলিত হওয়া বা যুদ্ধ কৌশলের অংশ হিসেবে পিছু হঠার অনুমতি দিতেন না। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَمَنْ يُوَلِّهِمْ يَوْمَئِذٍ دُبُرَهُ إِلا مُتَحَرِّفًا لِقِتَالٍ أَوْ مُتَحَيِّزًا إِلَى فِئَةٍ فَقَدْ بَاءَ بِغَضَبٍ مِنَ اللَّهِ وَمَأْوَاهُ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ
“সেদিন যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন বা দলে স্থান নেয়া ব্যতীত কেউ তাদের পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলে তার উপর আল্লাহর গযব এবং তার আশ্রয় হবে জাহান্নাম, আর তা কত নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল।” [347]
সুতরাং এর থেকে এটাই বোঝা যায় যে, জিহাদের উদ্দেশ্য হলো দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং কাফিরদের ক্ষতিগ্রস্ত করা। এবং জিহাদের আরো একটি একটি উদ্দেশ্য হলো মুসলিমদের শক্তি সংরক্ষণ করা এবং কোন সামরিক সুবিধা ছাড়াই মুসলিমদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া নয়। আর একারণেই দুই এর অধিক কাফিরের মোকাবিলায় একজন মুসলিমের পিছু হঠা বা পালানোর অনুমতি আছে। ইবনে আব্বাস রদিআল্লাহু আনহু বলেন, “যে কেউ দুইজন (কাফির) থেকে পালালো সে পালিয়েছে, আর যে কেউ তিনজন থেকে পালালো সে পালায়নি।” [348] এবং উমারের পক্ষ থেকে সাদকে (রদিআল্লাহু আনহুম) যে চিঠি দেয়া হয়েছে তাতে রয়েছেঃ “যদি তুমি কোথাও পরাজয় কিংবা কোন ক্ষতির আশংকা কর, তাহলে সেখানে কোন স্কাউট (শত্রুদের অবস্থান দেখার জন্য যাদের আগে পাঠানো হয়) বা সেনাবাহিনী পাঠাবে না।” এসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায় যে, মুসলিমদের সামর্থ্য সংরক্ষণ করা জিহাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। এর সবচেয়ে উত্তম উদাহরণ হলো যখন খালিদ বিন ওয়ালিদ রদিআল্লাহু আনহু মুতার যুদ্ধে তার বাহিনীর সাথে যোগ দেয়ার জন্য পশ্চাদপসরণ করেন; রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার এই পদক্ষেপকে ‘ফাত্হ (বিজয়)’ বলেছেন। এই ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় আনাস বিন মালিক থেকে বর্ণিত বুখারীর হাদীস থেকেঃ “মূতার যুদ্ধের খবর এসে পৌঁছাবার আগেই নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপস্থিত মুসলমানদেরকে যায়িদ, জাফর ও ইবনে রাওয়াহার (রদিআল্লাহু আনহুম)- এর শাহাদাতের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যায়িদ পতাকা হাতে অগ্রসর হলে তাকে শহীদ করা হয়। তখন জাফর পতাকা হাতে অগ্রসর হলো, তাকেও শহীদ করে ফেলা হয়। তারপর ইবনে রাওয়াহা পতাকা হাতে নিল। এবার তাকেও শহীদ করে দেয়া হলো।’ এসময় তার দু’চোখ থেকে অশ্রুধারা প্রবাহিত হচ্ছিল। (তারপর তিনি বললেন), ‘অবশেষে সাইফুল্লাহদের মধ্য থেকে এক সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তরবারী) হাতে পতাকা ধারণ করেছে। ফলত আল্লাহ্ তাদের উপর আমাদের বিজয় (ফাতাহাল্লাহু আলাইহিম) দান করেছেন।’”[349] ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “আহলুন নাকল (যারা দলীলের ভিত্তিতে কথা বলেন) তাঁর [রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] এই বক্তব্যের অর্থের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছেনঃ ‘…তারপর আল্লাহ্ তাদের উপর আমাদের বিজয় (ফাতাহাল্লাহু আলাইহিম) দান করেছেন।” – এরপর তিনি (ইবনে হাযার) বলেন, “আল ইমাদ ইবনে কাসীর বলেন, “এটার ব্যাখ্যা এভাবে করা যায় যে, যখন খালিদ বিন ওয়ালিদ মুসলিমদের নিয়ে পিছু হটলেন এবং রাত্রি অতিবাহিত করলেন এবং সকালে উঠে দেখলেন বাহিনীর পূর্বের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে, এবং শত্রুরা মনে করল যে নতুন বাহিনী এসে যোগ দিয়েছে। সুতরাং খালিদ যখন সেই মুহূর্তে তাদের আক্রমণ করলেন, তারা পিছু হটলো কিন্তু তিনি তাদের তাড়া করলেন না কারণ তিনি বুঝতে পারলেন যে মুসলিমদের সাথে নিয়ে ফিরতে পারাটাই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় গনীমত।” আমার (লেখক) বক্তব্য হলোঃ এই ঘটনা থেকেই প্রমাণিত হয় যে মুসলিমদের এবং ইসলামের শক্তি সংরক্ষণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। এবং কাফিরদের আঘাত করে কোন সামরিক সুবিধা আদায়ের সম্ভাবনা থাকলে মুসলিমদের ধ্বংসের ঝুঁকি নেয়া উচিৎ নয়; তবে মনে রাখতে হবে যে, এক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন, শাহাদাতের জন্য একজন ব্যক্তির ঝুঁকি নেয়াকে- নিজেকে ধ্বংসের মুখে ফেলার শামিল গণ্য করা হবে না, যে ব্যাপারে আবু আইয়ুব এবং আল বারা রদিআল্লাহু আনহুম দু’টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাদীস দু’টি আল্লাহর ঐ আয়াতের তাফসীরে এসেছে যেখানে তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَأَنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
“.. এবং নিজেদের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কর না।” [350]
যদিও এটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে জায়েজ কিন্তু সম্পূর্ণ বাহিনীর জন্য এটা কখনো জায়েজ নয়, উপরোক্ত দলীলসমূহ দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়। তবে এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম হলো তখন – যখন শত্রুর মুখোমুখি থাকলেও মৃত্যু নিশ্চিত আবার পিছু হটলেও মৃত্যু নিশ্চিত। এমন অবস্থায় নিজেদের অবস্থানে থাকাই উত্তম।
ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমি বলব, একজন মুসলিমের দায়িত্ব হলো যুদ্ধের ডাক আসলে তার আসন্ন মৃত্যু ও যুদ্ধের ফলাফলের কথা চিন্তা না করে এগিয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে চারটি শর্ত রয়েছে। শর্তগুলো হলোঃ
প্রথম শর্তঃ ইসলামী শারীয়াহ এর অনুসরণ
আর এটা সম্ভব হবে জিহাদ সংক্রান্ত হুকুম আহকামের জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে। দেখতে হবে যে এটা ফারদ কিনা এবং ইসলামী শরীয়াহর অনুসরণ হচ্ছে কিনা? মূলত এর মানে হচ্ছে শত্রুকে চিহ্নিত করা এবং এ ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলার কি হুকুম রয়েছে তা জেনে নেয়া। এই জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অত্যন্ত জরুরী।
দ্বিতীয় শর্তঃ জিহাদের পতাকা
শুধুমাত্র এমন কাফির শত্রু পেলেই হবে না যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে; সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে এ ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে হবে যে, আপনি যে বাহিনীর সাথে জিহাদে অংশ নিচ্ছেন তাদের ব্যানার (পতাকা) কি এবং তাদের পরিচয় কি? এটা কি ইসলামের পতাকা নাকি অন্য কিছু? এক্ষেত্রে ইসলাম বলতে সত্যিকারের ইসলাম, সেই ইসলাম নয় যেটাকে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রর মতো নানান কুফরী মতবাদের সাথে মিশিয়ে খিঁচুড়ি করা হয়েছে? ঐ পতাকার তলে যদি কেউ ইসলামী সমাজ তন্ত্র বা ইসলামী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ করে; তাহলে পুরোটাই কুফর বলে গণ্য হবে, কারণ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَنْ تَسْتَقْسِمُوا بِالْأَزْلامِ ذَلِكُمْ فِسْقٌ الْيَوْمَ يَئِسَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ دِينِكُمْ فَلا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلامَ دِينًا فَمَنِ اضْطُرَّ فِي مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِإِثْمٍ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম।” [351]
সুতরাং ইসলামের সাথে এসব মানব রচিত মতবাদ মেশানোর কোন প্রয়োজন নেই। কেউ যদি এটা করতে চায় তার মানে হলো, সে তার কথায় ও কাজে প্রমাণ করতে চাইছে যে, ইসলাম অপূর্ণ রয়ে গেছে এবং এসব মানব রচিত মতবাদ দ্বারা একে পূর্ণতা দিতে হবে। “কিতাব ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরার মূলনীতি” অধ্যায়ের আলোচনায় ইতিমধ্যে বলা হয়ে গেছে যে, এ সবই কুফর। আল্লাহ্ তা’আলার এই আয়াতটি অস্বীকার করেই তারা কুফরীতে প্রবেশ করে, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম।” সুতরাং এসব পতাকার তলে যুদ্ধ করার অর্থ হলো কুফরের পতাকার তলে যুদ্ধ করা। যে ব্যক্তি এমন পতাকার তলে অবস্থান নেবে সে আল্লাহর রাস্তায় নেই। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে একমাত্র তার যুদ্ধই আল্লাহর পথে জিহাদ হিসেবে গণ্য।” [352]
তৃতীয় শর্তঃ সামরিক ফায়দা
অর্থাৎ কোন যুদ্ধের সামরিক ফায়দার কথা চিন্তা না করে তাতে অংশগ্রহণ করা উচিৎ নয়। কারণ জিহাদের মূল উদ্দেশ্য হলো দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করা। জিহাদের মাধ্যমে কিছু সামরিক ফায়দা হাসিল করতে হবে, সেটা সামান্য হতে পারে যা একটি ছোট বাহিনীর মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। আবার শত্রুকে ভয় দেখানোর তো রাজনৈতিক ফায়দাও জিহাদকে পরিচালিত করতে পারে। তবে ফায়দা যেমনই হোক না কেন এটি পর্যালোচনা করার দায়িত্ব থাকবে আমীরের উপর; সকল সৈনিকদের উপর এই দায়িত্ব নয়। “শুরা (পারস্পরিক আলোচনা বা পরামর্শ)” এবং “জামাআহ (ঐক্য)” সংক্রান্ত আলোচনায় এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমীর কিভাবে গবেষণা ও পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে সে ব্যাপারেও পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে, ইনশাআল্লাহ্। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ঈমাম তো একটি ঢাল। তার পেছনে থেকে যুদ্ধ করা হয়, তার কাছ থেকে নিরাপত্তা আশা করা হয়।” [353] আর ইবনে কুদামাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন, “আর জিহাদের বিষয়টি ইমাম ও তাঁর ইজতিহাদের (পর্যালোচনাভিত্তিক সিদ্ধান্ত) উপর ন্যস্ত। তাঁর বাহিনীর দায়িত্ব হলো সে এই বিষয়টিকে যে দৃষ্টিতে দেখছে সেভাবেই তাকে মেনে চলা। [354]
চতুর্থ শর্তঃ নিরাপত্তা ও সাবধানতামূলক প্রস্তুতি গ্রহণ করা
এটা হতে পারে সৈন্যদলের পাহারার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে; কিংবা শত্রুকে ধোঁকা দেয়া, অথবা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া। যেমন, বর্ম পরিধান করা, শিরস্ত্রাণ পরিধান করা অথবা পরিখা খনন করা, ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বর্ম ও শিরস্ত্রাণ পরেছেন, ‘মিগফার’ করেছেন এবং তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছেন পরিখা খননের মতো কাজে। অথচ তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যাকে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) নিজে অন্য মানুষের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার কথা বলেছেন ।
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ
“আল্লাহ্ আপনাকে মানুষের ক্ষতি থেকে বাঁচাবেন।” [355]
তিনি এটা করেছেন আমাদেরকে এই হুকুমের ব্যাপারে শিক্ষা দিতে। আর মৃত্যু ও আঘাত যদি আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)র ক্বদর হয়, তাহলে সাবধানতা অবলম্বনের দ্বারা এর থেকে নিজেকে রক্ষা করাই হলো আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)র হুকুম; আত্মসমর্পণ করা বা আহত হওয়া বা মৃত্যুবরণ করা নয়। যদি ব্যাপারটা সেরকমই হতো তাহলে তো অনেকেই কাফিরদের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকতো এই ভেবে যে এটাই তো আল্লাহ্ তা’আলার ক্বদর। সুতরাং আমাদের দায়িত্ব হলো এর থেকে নিজেদের রক্ষা করা। “ক্বদর দ্বারা ক্বদর প্রতিহত করা”- সংক্রান্ত আলোচনায় ইবনুল কাইয়্যিম বলেছেন, “আর জ্ঞানসম্পন্ন আমির শেখ আব্দুল কাদির আল জিলানী বলেন, ‘মানুষ যদি ক্বদর ও সিদ্ধান্তের মুখে পড়ে তারা থমকে দাঁড়ায়, তবে আমি নই, কারণ আমি এ ব্যাপারে একটি ছোট্ট জানালা খোলা রেখেছি, যাতে আমি আল হাক্কের ক্বদরকে আল হাক্কের সত্য দ্বারা প্রতিহত করি। (সত্যিকার) মানুষ সেই যে ক্বদরের মোকাবিলা করে (ক্বদর দ্বারা), ঐ ব্যক্তি নয় যে ক্বদরের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আর একটি ক্বদর দ্বারা অন্য ক্বদরকে প্রতিহত না করলে বান্দার সুবিধাগুলো তাদের জীবদ্দশায় পূরণ হবে না। তাহলে এগুলোর বিনিময়ে কি হবে (আখিরাতে)?’
‘আর আল্লাহ্ তা’আলা হুকুম করেছেন যাতে মন্দ জিনিষকে ভালো জিনিষ দ্বারা প্রতিহত করা, যারা (মন্দ ও ভালো) উভয়েই আল্লাহর ক্বদর। অনুরূপভাবে ক্ষুধা যেমন আল্লাহর ক্বদর, তিনি নির্দেশ দিয়েছেন খাদ্য গ্রহণ করে একে নিবারণ করার জন্য, সেটাও আল্লাহর ক্বদর। বান্দা যদি খাদ্যের ক্বদর দ্বারা ক্ষুধা নিবারণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এই ক্ষুধার ক্বদরের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং এভাবে মৃত্যুর মুখে পড়ে, তাহলে সে অবাধ্যতার মাঝে মারা গেল। একইভাবে ঠাণ্ডা, গরম বা তৃষ্ণার ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। কারণ এগুলো সবই আল্লাহর ক্বদর এবং আল্লাহ্ তা’আলা হুকুম করেছেন এগুলো তাঁরই অন্য ক্বদর (যা পূর্বের ক্বদরের বিপরীত) দ্বারা প্রতিহত করতে। এবং যা প্রতিহত করে, সেই সাথে যা প্রতিহত করা হয় আর যেভাবে প্রতিহত করা হয় তার সবই তাঁর ক্বদরের অন্তর্ভুক্ত।’
‘এবং নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ব্যাপারটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন তার হাদীসে; যখন তারা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘হে রাসূলুল্লাহ, আপনি কি মনে করেন, ঔষধ, যা আমরা প্রতিকার হিসেবে ব্যবহার করি, এবং রুকিয়াহ[356] সমূহ, যা আমরা রুকিয়া করে থাকি, এবং রক্ষাকবচসমূহ, যার দ্বারা আমরা নিরাপত্তা চাই; এগুলো আল্লাহর কোন ক্বদরের বিরুদ্ধে যায়?’ তিনি বললেন, ‘এগুলো সবই আল্লাহর ক্বদর থেকে।’[357]
‘অপর এক হাদীসে রয়েছে, “নিশ্চয় দু’আ এবং পরীক্ষাসমূহ দুনিয়া ও আসমানের মাঝে (একে অন্যের সাথে) যুদ্ধ করে।” [358]
আর যদি কাফিরদের মধ্য থেকে কোন শত্রু ইসলামী রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে আসে, তাহলে তারা আল্লাহর ইচ্ছাতেই এগিয়ে আসে। তবে কি অন্য ক্বদর দ্বারা এর মোকাবিলা না করে এই ক্বদরের নিকট আত্মসমর্পণ করা মুসলিমদের জন্য জায়েজ হবে- সেই ক্বদর হলো জিহাদ, যা দ্বারা তারা আল্লাহর ক্বদরকে মোকাবিলা করবে তাঁরই অপর একটি ক্বদর দ্বারা।” [359] এবং শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহও, শেখ আব্দুল কাদির আল জিলানীর বক্তব্যের ব্যাখ্যায় একই কথা বলেছেন[360]। আমার (লেখক) বক্তব্য হলোঃ ক্বদর দ্বারা ক্বদরের মোকাবিলা করা ইসলামের অন্তর্ভুক্ত, যা সাহাবাদের (রদিআল্লাহু আনহুম) সময় থেকে মুসলিমদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। উমার ইবনুল খাত্তাব, আবু উবাইদাকে (রদিআল্লাহু আনহুম) যে জবাব দিয়েছেন তাতেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এটা তখনকার ঘটনা যখন উমার রদিআল্লাহু আনহু শামের দিকে দিকে আসলেন এবং জানতে পারলেন যে, সেখানে প্লেগের উপদ্রব হয়েছে। সুতরাং উমার মানুষের পরামর্শ নিলেন এবং ফেরার জন্য প্রস্তুত হলেন। তখন আব্দুর রহমান ইবনে আউফ তাকে জানালেন যে, এ ব্যাপারে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস রয়েছে। হাদীসটি বুখারীতে পাওয়া যায় এবং এটি ইবনে আব্বাস কর্তৃক বর্ণিত, “উমার রদিআল্লাহু আনহু লোকদের মাঝে ঘোষণা দিলেন যে, আমি ভোরে সওয়ারীর পিঠে আরোহণ করবো (ফিরে যাওয়ার জন্য) এরপর ভোরে সকলে এভাবে প্রস্তুতি নিল। আবু উবাইদা রদিআল্লাহু আনহু বললেনঃ আপনি কি আল্লাহর নির্ধারিত তাকদ্বীর থেকে পলায়ন করার জন্য ফিরে যাচ্ছেন? উমার রদিআল্লাহু আনহু বললেনঃ হে আবু উবাইদা! যদি তুমি ছাড়া অন্য কেউ কথাটি বলতো!”[361]
আমার (লেখক) বক্তব্য হলোঃ ইসলামী শারীয়াহ এর অনুসরণ, জিহাদের পতাকা, সামরিক ফায়দা, নিরাপত্তা ও সাবধানতামূলক প্রস্তুতি গ্রহণ করা; এই চারটি বিষয় যদি আপনি গ্রহণ করেন এবং জিহাদে এগুলোর উপর আমল করে তাহলে এগিয়ে যান এবং আল্লাহ্ তা’আলার উপর ভরসা করুন। আর এটি করতে গিয়ে যেসব বাধা বিপত্তি ও সুযোগ সুবিধা আসবে সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামিয়ে নিজেকে মানসিক চাপে ফেলবেন না, এ বিষয়গুলো আল্লাহর উপর ছেড়ে দিতে হবে।
তৃতীয়তঃ কাপুরুষতার ব্যাধি
কাপুরুষতা ও দুর্বলতার রোগ হচ্ছে আগের দুইটি বিষয়ের ঠিক বিপরীত, “… দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা এবং মৃত্যুকে ঘৃণা করা…”এটি এমনই এক বিধ্বংসী রোগ যা অন্য জাতিকে একত্রিত হয়ে মুসলিমদের আক্রমণ চালানোর সুব্যবস্থা করে দেয়, ঠিক যেভাবে ভোজনপাত্রের চারপাশে বসে ক্ষুধার্ত খাদকেরা উপভোগ করে; সাওবান রদিআল্লাহু আনহুর হাদীস থেকে আমরা এটাই জানতে পারি। আর এই রোগের প্রতিকারের কথা আমি পূর্বেই বলেছি- ‘আরাম আয়েশ ত্যাগ করা’। আর এটা সম্ভব হবে যখন মুসলিমদের আকীদায় তাকদীরের বিষয়টি শক্তভাবে গেঁড়ে যাবে। সে তখন জানবে যে, যা কিছুই সে পেয়েছে তা কখনোই কেউ ঠেকাতে পারতো না; আর যা কিছু সে পায়নি তা কোন ভাবেই তার কাছে পৌঁছাতো না। আমার সময় যেমন পূর্বনির্ধারিত ঠিক তেমনি আমাদের রিযকও পূর্বনির্ধারিত এবং বান্দাদের উপর যা কিছুই আসে তার সবই আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) কর্তৃক নির্ধারিত।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ
لِكَيْ لا تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلا تَفْرَحُوا بِمَا آَتَاكُمْ وَاللَّهُ لا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ
“পৃথিবীতে বা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্যয় আসে আমি তা সংঘটিত করার পূর্বেই তা কিতাবে লিপিবদ্ধ করা আছে। আল্লাহর পক্ষে এটা খুবই সহজ। এটি এজন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন তোমরা বিমর্ষ না হও, এবং যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন তার জন্য হর্ষোৎফুল্ল না হও। আল্লাহ্ পছন্দ করেন না উদ্ধত ও অহংকারীদেরকে।” [362]
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَنْ تَمُوتَ إِلا بِإِذْنِ اللَّهِ كِتَابًا مُؤَجَّلًا وَمَنْ يُرِدْ ثَوَابَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَنْ يُرِدْ ثَوَابَ الْآَخِرَةِ نُؤْتِهِ مِنْهَا وَسَنَجْزِي الشَّاكِرِينَ
“আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কারো মৃত্যু হতে পারে না..।” [363]
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلا يَسْتَقْدِمُونَ
“..যখন তাদের সময় আসবে তখন তারা মৃত্যুকাল বিলম্ব করতে পারবে না এবং ত্বরাও করতে পারবে না।” [364]
ইবনে মাসউদ রদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের প্রত্যেকেই আপন আপন মাতৃগর্ভে ৪০ দিন পর্যন্ত শুক্র বিন্দুরূপে জমা থাক। তারপর ঐরূপ ৪০ দিন রক্তপিণ্ড এবং ঐরূপ ৪০ দিন মাংসপিণ্ড আকারে থাকে। তারপর আল্লাহ্ তা’আলা একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন এবং তাকে রিযক,মাউত, দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্য এই চারটি বিষয় লিপিবদ্ধ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়।” [365] ইবনে মাসউদ কর্তৃক বর্ণিত আরো একটি হাদীসে তিনি বলেন, “..কেউ মৃত্যুবরণ করবে না যতক্ষণ না তার রিযক এবং তার (নির্ধারিত) সময় শেষ হয়…”[366]। সুতরাং রিযক এবং জীবনকাল নির্ধারিত হয়ে গেছে। আর একারণেই অনেক সালাফ আস সালেহীন দীর্ঘ জীবনের দু’আ করতে অপছন্দ করতেন। একটি হাদীসে রয়েছে, “যে ব্যক্তি তার জীবিকার প্রশস্ততা চায় এবং সে দীর্ঘায়ু কামনা করে, সে যেন তার আত্মীয়দের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে।” [367] এ ব্যাপারে ইবনে হাযার সঠিক ব্যাখ্যাটি উল্লেখ করেছেন, এবং অন্যরাও এটিকে সঠিক বলে গ্রহণ করেছেন; তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, জীবন ও জীবিকা বৃদ্ধির অর্থ হলো জীবন ও জীবিকায় বরকত বৃদ্ধি করা। এবং এই অর্থের ব্যাখ্যায় তিনি (এ সংক্রান্ত) আরো কয়েকটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। সুতরাং একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, জিহাদ মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে পারে না আর রিযিকও কমাতে পারে না।
তবে এটি অনুমোদনযোগ্য সাবধানতা গ্রহণের বিরুদ্ধে যায় না; যেমন রিযকের জন্য সংগ্রাম করা, বর্ম পরিধান করা, পরিখা খনন করা এবং শত্রুর মোকাবিলায় আরো অন্যান্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা, যা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুমোদন করেছেন। সুতরাং তাক্বদীরে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহর হুকুমসমূহ পালন (সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ) করা পরস্পর বিরোধী বা সাংঘর্ষিক কোন বিষয় নয়।
চতুর্থতঃ অনীহার ব্যাধি
অনীহার রোগ বলতে আমি যেটা বোঝাতে চাইছি তা হলো ‘বিজয়ের বাসনা’- যা অন্তরের মাঝে বাসা বাঁধে; এ ব্যাপারে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَأُخْرَى تُحِبُّونَهَا نَصْرٌ مِنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ
“এবং আরো একটি অনুগ্রহ তোমাদের দিবেন যা তোমরা পছন্দ কর। আল্লাহর পক্ষে থেকে সাহায্য এবং আসন্ন বিজয়।” [368]
আর এই ভালোবাসাই একদিন ব্যাধিতে পরিণত হয়, যা একজন মুসলিমকে প্রথম ও দ্বিতীয় যুদ্ধে যেতে নিরুৎসাহিত করে এই ভয়ে যে, সে হয়তো মারা যাবে এবং জীবিত অবস্থায় সে চুড়ান্ত বিজয় দেখতে পারবে না। আসলে এর মূল কারণ হলো একজন মুসলিমের দায়িত্ব সম্পর্কে তার অজ্ঞতা; কারণ ইসলামের হুকুম হলো জিহাদে অংশগ্রহণ করা, চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করা নয়। সুতরাং বিজয় তার হাত দিয়ে আসুক বা তার সন্তানদের হাত দিয়ে আসুক, উভয়েই সমান, কারণ সে জিহাদ করে তার দায়িত্ব পালন করেছে এবং তাকে পুরস্কৃত করা আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)র নিকট অবধারিত হয়ে গেছে, ইনশাআল্লাহ্।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
وَمَنْ يُهَاجِرْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يَجِدْ فِي الْأَرْضِ مُرَاغَمًا كَثِيرًا وَسَعَةً وَمَنْ يَخْرُجْ مِنْ بَيْتِهِ مُهَاجِرًا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ يُدْرِكْهُ الْمَوْتُ فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا
“যে কেউ নিজ গৃহ থেকে বের হয় আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি হিজরত করার উদ্দেশ্যে, অতঃপর মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তবে তার সওয়াব আল্লাহর কাছে অবধারিত হয়ে যায়।” [369]
সুতরাং এই আয়াতে হিজরতের হুকুমের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘যে কেউ… হিজরত করার উদ্দেশ্যে বের হবে’ এবং তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে বরং এর পূর্বেই সে মৃত্যুমুখে পতিত হবে। তারপরও তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট অবধারিত হয়ে যাবে। এবং এ বিষয়ে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়ে বলেছেন,
مَا كَانَ لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ وَمَنْ حَوْلَهُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ وَلا يَرْغَبُوا بِأَنْفُسِهِمْ عَنْ نَفْسِهِ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ لا يُصِيبُهُمْ ظَمَأٌ وَلا نَصَبٌ وَلا مَخْمَصَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلا يَطَئُونَ مَوْطِئًا يَغِيظُ الْكُفَّارَ وَلا يَنَالُونَ مِنْ عَدُوٍّ نَيْلًا إِلا كُتِبَ لَهُمْ بِهِ عَمَلٌ صَالِحٌ إِنَّ اللَّهَ لا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ
وَلا يُنْفِقُونَ نَفَقَةً صَغِيرَةً وَلا كَبِيرَةً وَلا يَقْطَعُونَ وَادِيًا إِلا كُتِبَ لَهُمْ لِيَجْزِيَهُمُ اللَّهُ أَحْسَنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“..এটা এজন্য যে আল্লাহর পথে যে তৃষ্ণা, ক্লান্তি এবং ক্ষুধা তাদের স্পর্শ করে এবং তাদের এমন পদক্ষেপ যা কাফিরদের ক্রোধের উদ্রেক করে এবং শত্রুদের নিকট থেকে তারা যা কিছু প্রাপ্ত হয়- তার প্রত্যেকটির বিনিময়ে তাদের জন্য লিখিত হয় নেক আমল। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সৎকর্মশীল লোকদের হক নষ্ট করেন না। আর তারা অল্পবিস্তর যা কিছু ব্যয় করে, যত প্রান্তর তারা অতিক্রম করে, তা সবই তাদের নামে লেখা হয়, যেন আল্লাহ্ তাদের সৎকর্মসমূহের উত্তম বিনিময় প্রদান করেন।” [370]
এই আয়াতে এমন একটি জিনিষও বাদ পড়েনি যা একজন মুসলিম, আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদের ক্ষেত্রে করে থাকে; এমন প্রতিটি কাজকেই নেক আমল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, যার কারণে ঐ মুসলিমকে পুরস্কৃত করা হবে। আর বিজয় অর্জন করার মতো কোন শর্ত এখানে জুড়ে দেয়া হয়নি।
একই সাথে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যে ব্যক্তি জিহাদ করেছে কিন্তু বিজয় বা গনীমত কোনটিই পায়নি তার জন্য আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)-র নিকট রয়েছে আরো বড় পুরস্কার। এর প্রমাণ পাওয়া যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্য থেকে, “যে বাহিনী আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করল এবং তাতে গনীমত লাভ করলো তারা এ দুনিয়াতেই দুই-তৃতীয়াংশ নগদ পেয়ে গেল। তাদের জন্য কেবল এক-তৃতীয়াংশ বিনিময় অবশিষ্ট থাকলো। আর যে বাহিনী কোন গনীমত লাভ করলো না, তাদের পূর্ণ বিনিময়ই পাওনা রয়ে গেল”[371]। একই রকম ইঙ্গিত পাওয়া যায় খাব্বাব ইবনুল আরাত রদিআল্লাহু আনহুর বর্ণিত হাদীস থেকে, তিনি বলেন “আমরা আল্লাহ্ তা’আলার সাথে সাক্ষাতের আশায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হিজরত করেছি, সুতরাং আল্লাহর নিকট আমাদের পুরষ্কার অবধারিত হয়ে গেছে। তবে আমাদের মধ্যে তারাও ছিল যারা পুরষ্কারের কিছুই ভোগ না করে মৃত্যুবরণ করেছে। তাদের মধ্যে ছিলেন মুসআব ইবনে উমাইর রদিআল্লাহু আনহু। তিনি উহুদের দিন নিহত হন এবং তিনি একটি চাদর রেখে যান। সুতরাং আমরা সেটি দিয়ে তার মাথা ঢেকে দিই কিন্তু তার পা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং আমার যদি তার পা ঢেকে দিই তাহলে তার মাথা বের হয়ে যায়। অতপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের তার মাথা ঢেকে দিতে এবং তার পায়ের উপর কিছু ইযখির ঘাস দিয়ে দিতে আদেশ দিলেন। এবং আমাদের মধ্যে তারাও ছিল যাদের ফল পেকেছিল এবং তারা তা পেঁড়ে উপভোগ করেছে।” [372] “তাদের ফল পেকেছিল”এবং “তারা তা পেঁড়ে উপভোগ করেছিল’ এটি রূপক হিসেবে ব্যবহার বলা হয়েছে, এর মানে হলো আল্লাহ্ তা’আলা এই দুনিয়া তাদের জন্য প্রশস্ত করেছেন এবং তাতে তাদেরকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর এবং খাব্বাবের হাদীস দু’টি উভয়েই এই বক্তব্যকে সমর্থন করে। এটাই ছিল শাহাদাতের ব্যাপারে আমার শেষ আলোচ্য বিষয়।
বিংশতম অধ্যায়ঃ এবং বিজয় তো শুধুমাত্র আল্লাহর থেকেই আসে
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,
وَمَا جَعَلَهُ اللَّهُ إِلا بُشْرَى لَكُمْ وَلِتَطْمَئِنَّ قُلُوبُكُمْ بِهِ وَمَا النَّصْرُ إِلا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ
“…এবং বিজয় তো শুধুমাত্র আল্লাহর থেকেই আসে।” [373]
এটি এমন একটি আয়াত যেখানে কঠোরতম এক সীমারেখার কথা স্মরণ করানো হয়েছে। এখানে ‘শুধুমাত্র আল্লাহর থেকেই’- কথাটির মাঝে একটি না-বোধক সুর আছে; অর্থাৎ এখানে সীমারেখা হলো যে, বিজয় অন্য কোন কারণে আসবে না; এটি শুধুমাত্র আল্লাহর তরফ থেকে আসবে, যিনি সুবহান (সুমহান), যার কোন শরীক নেই। একমাত্র তাঁর অনুমতিতেই বিজয় আসবে, কোন পার্থিব বিষয়ের আধিক্যের দ্বারা এই বিজয় লাভ করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন। আর হুনায়নের যুদ্ধে যখন মুসলিমদের মাঝে এই বিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়, অর্থাৎ তারা যখন তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে সন্তুষ্ট ছিল, তখনই আল্লাহ্ তাদের পরাজয় আস্বাদন করান যাতে তারা বুঝতে পারে যে, সংখ্যা বা সরঞ্জাম কোন কিছুই কাজে আসবে না যদি আল্লাহর অনুমতি না থাকে। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللَّهُ فِي مَوَاطِنَ كَثِيرَةٍ وَيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئًا وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُمْ مُدْبِرِينَ
ثُمَّ أَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَى رَسُولِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَنْزَلَ جُنُودًا لَمْ تَرَوْهَا وَعَذَّبَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَذَلِكَ جَزَاءُ الْكَافِرِينَ
“সত্যিই আল্লাহ্ তো তোমাদের বিজয় দিয়ে বহু ক্ষেত্রে এবং হুনায়নের যুদ্ধের দিনে যখন তোমাদেরকে তোমাদের সংখ্যাধিক্য উৎফুল্ল করেছিল; কিন্তু তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি এবং বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী তোমাদের জন্য সংকুচিত হয়েছিল এবং পরে তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে। অতঃপর আল্লাহ্ তাঁর নিকট থেকে তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের উপর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং এমন এক সৈন্য বাহিনী অবতীর্ণ করেন যা তোমরা দেখতে পাওনি এবং তিনি কাফিরদের শাস্তি প্রদান করেন; ইহাই কাফিরদের কর্মফল।” [374]
সুতরাং আল্লাহ্, মহিমান্বিত তিনি, তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন কিভাবে তিনি বহুবার কমসংখ্যক হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিজয় দান ক রে উৎফুল্ল করেছেন, আর যখন তারা নিজেদের উপর সন্তুষ্ট ছিল এবং তাদের সংখ্যার উপর ভরসা করছিল-তখন তা তাদের কোনই কাজে আসেনি, ফলশ্রুতিতে তারা পরাজিত হন। এই পরাজয়ের পর তিনি তাদের আবার বিজয় দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেন যে, সংখ্যাধিক্য দিয়ে কিছুই হবে না, বিজয় আসবে শুধুমাত্র আল্লাহর তরফ থেকে। সুতরাং এই পরাজয়ের মাধ্যমে তিনি তাদেরকে পূর্বের (মজবুত ঈমান ও সকল ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহরই উপরে ভরসা করা সেই) অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন যার অনুপস্থিতি কিছুজনের মধ্যে দেখা দিয়েছিল। সেই ঈমান হলোঃ “…এবং বিজয় তো শুধুমাত্র আল্লাহর থেকেই আসে।”
একইরকম আরেকটি আয়াতে তিনি বলেছেন,
“হে মু’মিনগণ তোমাদের হলো কি যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে অভিযানে বের হতে বলা হয় তখন তোমরা যমীনকে আঁকড়ে ধর?..”
এর পরপরই তিনি বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انْفِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ اثَّاقَلْتُمْ إِلَى الْأَرْضِ أَرَضِيتُمْ بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآَخِرَةِ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الْآَخِرَةِ إِلا قَلِيلٌ
إِلا تَنْفِرُوا يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيمًا وَيَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلا تَضُرُّوهُ شَيْئًا وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
إِلا تَنْصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
“যদি তোমরা অভিযানে বের না হও, তবে তিনি তোমাদের মর্মন্তুদ শাস্তি দেবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন এবং তোমরা তাঁর কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর তবে আল্লাহ্ তো তাকে সাহায্য করেছেন যখন কাফিররা তাকে বহিষ্কার করেছিল এবং সে ছিল দুইজনের দ্বিতীয়জন; যখন তারা উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল…।” [375]
অর্থাৎ আল মাওলা (আল্লাহ), মহিমান্বিত তিনি, মু’মিনদের আদেশ করছেন অভিযানে বেরিয়ে পড়তে এবং ঘরে বসে থাকার পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক করে দিচ্ছেন এবং ঘোষণা দিচ্ছেন যে, তিনি তাদের পাল্টে অন্য এক জাতি সৃষ্টি করবেন, “… আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান”। এর তিনি তাঁর ক্ষমতার কিছু নিদর্শন স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন – যেমন কিভাবে তিনি তার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে হিজরতের সময় মক্কার কাফিরদের বিরুদ্ধে পার্থিব কোন সরঞ্জাম ছাড়াই সাহায্য করেছেন। সুতরাং তাদেরকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চেয়েছেন, যখন তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতো, “…এবং বিজয় তো শুধুমাত্র আল্লাহর থেকেই আসে।”
এভাবেই আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
فَلَمْ تَقْتُلُوهُمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ قَتَلَهُمْ وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ رَمَى وَلِيُبْلِيَ الْمُؤْمِنِينَ مِنْهُ بَلاءً حَسَنًا إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
“তোমরা তাদেরকে হত্যা করনি বরং আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন, এবং যখন তুমি নিক্ষেপ করেছিলে তখন তুমি নিক্ষেপ করনি, আল্লাহই নিক্ষেপ করেছিলেন,…।” [376]
সুতরাং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাদেরকে ‘নিক্ষেপ’ করার কথা উল্লেখ করে প্রস্তুতি নেয়া বা সতর্ক থাকার আবশ্যকতা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। নিশানা করা এবং লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার কৃতিত্ব তাঁরই, “… আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন… আল্লাহই নিক্ষেপ করেছিলেন,…”–এর দ্বারা তিনি বুঝিয়েছেন যে, প্রস্তুতি গ্রহণ করা আবশ্যক হলেও শুধুমাত্র এর দ্বারাই কোন বিজয় আসে না; বিজয় আসে শুধুমাত্র তাঁরই তরফ থেকে; সফলতা বা অর্জনও (তৌফিক) আসে তাঁর তরফ থেকে।
এ ক্ষেত্রে দুইটি বিষয় মনে রাখা দরকারঃ
প্রথমতঃ বিজয় শুধুমাত্র আল্লাহর তরফ থেকে আসে, আর তাঁর কাছ থেকে এটি পেতে হলে অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে- যা তিনি এক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করেছেন। আর আমরা ‘ঈমানভিত্তিক প্রস্তুতি’- সংক্রান্ত আলোচনায় উল্লেখ করেছি যে, আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) মু’মিনদেরকে বিজয় দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন যারা তাঁর দ্বীনকে সাহায্য করে। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ رُسُلًا إِلَى قَوْمِهِمْ فَجَاءُوهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَانْتَقَمْنَا مِنَ الَّذِينَ أَجْرَمُوا وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِينَ
“মু’মিনদের বিজয় দেয়া আমার দায়িত্ব।” [377]
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍّ إِلا أَنْ يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ وَلَوْلا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ
“আল্লাহ্ নিশ্চয় তাদেরকে সাহায্য করেন যারা আল্লাহকে সাহায্য করে।” [378]
এবং সেখানে আমি উল্লেখ করেছি যে, বিজয়ের যোগ্যতা অর্জন করতে দুই ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করা আবশ্যক- ‘ঈমানের প্রস্তুতি এবং ‘সরঞ্জামের প্রস্তুতি’। আর এর মানে হলো নিরন্তর সংগ্রাম ও সাধনা; দাওয়া ও ধৈর্য্য। এর মাধ্যমে আমি সেইসব অলস ও প্রতিক্রিয়াহীন মানুষকে স্মরণ করাতে চেয়েছি যারা আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য না করেই তাঁর কাছ থেকে বিজয় প্রত্যাশা করে; একই তাদেরকেও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যারা ইসলামের জন্য কাজ করছেন অথচ জিহাদের রাস্তায় নামেননি এবং প্রস্তুতিও নেননি; যা আল্লাহ্ তাঁর দ্বীনের বিজয়ের জন্য আবশ্যক করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
وَمَنْ أَرَادَ الْآَخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ كَانَ سَعْيُهُمْ مَشْكُورًا
“যারা মু’মিন হয়ে আখিরাত কামনা করে এবং তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে; তাদের প্রচেষ্টা পুরস্কারযোগ্য।” [379]
দ্বিতীয়তঃ তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে চাই যারা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে পড়েছেন; তারা এমনটি আশাই করতে পারেন না যে, মুসলিমরা জেগে উঠবে এবং এই অপমান ও বঞ্চনা থেকে মুক্ত হবে। যারা নিরাশ হয়ে বসে আছেন এই ভেবে যে, মুসলিমরা কাফির বাহিনীকে পরাভূত করতে পারবে না যারা সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে। তুমি হয়তো তাদের কাউকে বলতে শুনবে, “কিভাবে মুসলিমদের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে যখন দুনিয়ার প্রায় সবদেশই আমেরিকা নয়তো রাশিয়ার পদানত হয়ে রয়েছে?”আর সে বলবে এসব বিশাল কাফির রাষ্ট্রগুলো তাদের খাদ্য ও গোলাবারুদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বসে আছে; তাদের এমন মিসাইল আছে যা এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে আক্রমণ করতে সক্ষম; তারা মহাশূন্যে এমন মারণাস্ত্র প্রস্তুত রেখেছে যা পৃথিবীর যেকোন স্থানে আঘাত হানতে পারে। আর এই জমীনে ও মহাশূন্যে (স্যাটেলাইট) এমন উন্নত ইন্টেলিজেন্স (গোয়েন্দা নজরদারী) সরঞ্জাম রয়েছে যা দ্বারা তারা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ও গোপন কথাবার্তার ওপর কড়া নজর রাখে, সুতরাং এর মধ্যে জিহাদ ও অন্যান্য কাজ করা কি সম্ভব? “তারা যেকোন পরিকল্পনাকে শুরুতেই ভেস্তে দেবে;” সে বলে, “কিভাবে মুসলিমদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে যেখানে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আই. এম. এফ. এর মতো প্রতিষ্ঠান একটি দেশের অর্থনীতিকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে বিধ্বস্ত করতে পারে?”এরকমই আরো সব বক্তব্য যা মুসলিমদের নিরুৎসাহিত করে, এবং তাদের সাহায্যের সকল রাস্তা নষ্ট করে দেয়; এবং তাদের বর্তমান পরিস্থিতির কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করে। সবচাইতে দুঃখ লাগে তখন যখন এমনসব কথা তাদের মুখ থেকে বের হয় যারা আজকাল ইসলামের দাওয়াহ দিচ্ছে। আর এদেরকেই যখন আপনি তাগুত ও কুফর শক্তির কাছ থেকে কিছু সামান্য ক্ষমতা পাবার জন্য লালায়িত দেখবেন তখন মোটেও অবাক হবেন না।
আমরা বলবো, সেই ব্যক্তি চরম পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত যে একথা বলে যে, আন্তর্জাতিক কুফরী শক্তি তাদের সকল সামর্থ্য নিয়ে বাহ্যিক ও বাস্তবিক অর্থে একটি সত্যিকার মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাঁধা দিতে সক্ষম। আসলে তারা সুমহান আল্লাহর আয়াতের সত্যতাকেই অস্বীকার করে এবং তাঁর দৃঢ় প্রতিশ্রুতিকে অগ্রাহ্য করে।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
يَا بَنِيَّ اذْهَبُوا فَتَحَسَّسُوا مِنْ يُوسُفَ وَأَخِيهِ وَلا تَيْئَسُوا مِنْ رَوْحِ اللَّهِ إِنَّهُ لا يَيْئَسُ مِنْ رَوْحِ اللَّهِ إِلا الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ
“…কারণ আল্লাহর রহমত থেকে কেউ নিরাশ হয় না, কাফির সম্প্রদায় ব্যতীত।” [380]
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরো বলেন,
وَمَا جَعَلَهُ اللَّهُ إِلا بُشْرَى لَكُمْ وَلِتَطْمَئِنَّ قُلُوبُكُمْ بِهِ وَمَا النَّصْرُ إِلا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ
“…এবং বিজয় তো শুধুমাত্র আল্লাহর থেকেই আসে।” [381]
সুতরাং বিজয় আমেরিকার হাতেও নেই রাশিয়ার হাতেও নেই। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
مَا يَفْتَحِ اللَّهُ لِلنَّاسِ مِنْ رَحْمَةٍ فَلا مُمْسِكَ لَهَا وَمَا يُمْسِكْ فَلا مُرْسِلَ لَهُ مِنْ بَعْدِهِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
“আল্লাহ্ মানুষের প্রতি রহমত অবারিত করলে তা নিবারণকারী কেউ নেই এবং তিনি কিছু নিরুদ্ধ করতে চাইলে তৎপর কেউ তার উন্মুক্তকারী নেই।” [382]
এসকল আন্তর্জাতিক কুফরী শক্তি যত আধুনিক ক্ষমতাই অর্জন করুক না কেন তারা কখনোই মহামহিম ও পরাক্রমশালী আল্লাহর ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারবে না। আর তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَلا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا سَبَقُوا إِنَّهُمْ لا يُعْجِزُونَ
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآَخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ لا تَعْلَمُونَهُمُ اللَّهُ يَعْلَمُهُمْ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لا تُظْلَمُونَ
“কাফিররা যেন কখনো মনে না করে যে তারা (আল্লাহর আযাব থেকে) পরিত্রাণ লাভ করেছে; নিশ্চয় তারা কখনো তাদেরকে (আল্লাহর আযাব থেকে) রক্ষা করতে পারবে না। তোমরা তাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখিবে…”[383]
নিশ্চয় তারা কখনোই আল্লাহর ক্ষমতার বাইরে যেতে পারবে না; আর তার পরিকল্পনাকেও ভেস্তে দিতে পারবে না। নিশ্চয় আল্লাহর তার মু’মিন সমর্থকদের সাথে আছেন, আর তিনি তাদেরকে কাফিরদের উপর বিজয় দান করবেন, আল্লাহু আকবার। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
ذَلِكُمْ وَأَنَّ اللَّهَ مُوهِنُ كَيْدِ الْكَافِرِينَ
إِنْ تَسْتَفْتِحُوا فَقَدْ جَاءَكُمُ الْفَتْحُ وَإِنْ تَنْتَهُوا فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَإِنْ تَعُودُوا نَعُدْ وَلَنْ تُغْنِيَ عَنْكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْئًا وَلَوْ كَثُرَتْ وَأَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ
“ইহাই তোমাদের জন্য, আল্লাহ্ কাফিরদের ষড়যন্ত্র দুর্বল করেন। (হে মু’মিনগণ) তোমরা মীমাংসা চেয়েছিলে, তা তো তোমাদের নিকট এসেছে; যদি তোমরা বিরত হও তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা পুনরায় কর আমি তোমাদের পুনরায় শাস্তি দেব এবং তোমরা দলসংখ্যায় অধিক হলেও তা তোমাদের কোন কাজে আসবে না, এবং নিশ্চয় আল্লাহ্ মু’মিনদের সাথে আছেন।” [384]
এবং মহিমান্বিত ও পরাক্রমশালী আল মাওলা, আমাদেরকে শক্তিসঞ্চয় করার জন্য হুকুম করেছেন। এটা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। এরপরই তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বিজয় প্রদানের দায়িত্ব নিয়েছেন। যেমন তিনি তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলেছেন, “আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুন, আমিও আপনার পাশাপাশি যুদ্ধ করব। এবং খরচ করুন, আমিও আপনার জন্য খরচ করব। এবং আপনি সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করুন আমি এরূপ পাঁচটি (বাহিনী) প্রেরণ করব।”[385] এভাবেই আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) কাফিরদের অপমান করার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন,
ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ مَوْلَى الَّذِينَ آَمَنُوا وَأَنَّ الْكَافِرِينَ لا مَوْلَى لَهُمْ
“ইহাই তোমাদের জন্য, আল্লাহ্ কাফিরদের ষড়যন্ত্র দুর্বল করেন।” [386]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরো বলেন,
الَّذِينَ آَمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا
“সুতরাং তোমরা শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; শয়তানের কৌশল অবশ্যই দুর্বল।” [387]
আর তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আমাদের সাহায্য করার দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَأُخْرَى لَمْ تَقْدِرُوا عَلَيْهَا قَدْ أَحَاطَ اللَّهُ بِهَا وَكَانَ اللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرًا
“এবং আরো আছে (তিনি আশ্বাস দিচ্ছেন আরো বিজয় ও গণীমতের) যা এখনো তোমাদের অধিকারে আসেনি, তা তো আল্লাহ্ আয়ত্বে রেখেছেন। আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।” [388]
নিশ্চয় যারা কাফিরদের সৈন্য বাহিনী দেখে ভয় পেয়েছে তারা আল্লাহ্ তা’আলার এই বাণী ভুলে গেছেঃ
وَلِلَّهِ جُنُودُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا
“আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীর বাহিনীসমূহ আল্লাহরই এবং আল্লাহ্ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” [389] এবং নিশ্চয় যারা কাফিরদের ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার দাপট দেখে ভয় পেয়েছে তারা আল্লাহ্ তা’আলার এই বাণী ভুলে গেছেঃ
هُمُ الَّذِينَ يَقُولُونَ لا تُنْفِقُوا عَلَى مَنْ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ حَتَّى يَنْفَضُّوا وَلِلَّهِ خَزَائِنُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لا يَفْقَهُونَ
“আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর ধনভাণ্ডার তো আল্লাহরই কিন্তু মুনাফিকরা তা বুঝে না।” [390]
এবং নিশ্চয় যারা কাফিরদের দূর্গ আর তাদের প্রতিরক্ষা দেখে ভয় পেয়েছে তারা আল্লাহ্ তা’আলার এই বাণী ভুলে গেছেঃ
هُوَ الَّذِي أَخْرَجَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ مِنْ دِيَارِهِمْ لِأَوَّلِ الْحَشْرِ مَا ظَنَنْتُمْ أَنْ يَخْرُجُوا وَظَنُّوا أَنَّهُمْ مَانِعَتُهُمْ حُصُونُهُمْ مِنَ اللَّهِ فَأَتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ حَيْثُ لَمْ يَحْتَسِبُوا وَقَذَفَ فِي قُلُوبِهِمُ الرُّعْبَ يُخْرِبُونَ بُيُوتَهُمْ بِأَيْدِيهِمْ وَأَيْدِي الْمُؤْمِنِينَ فَاعْتَبِرُوا يَا أُولِي الْأَبْصَارِ
“…তারা মনে করেছিল তাদের দূর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহ্ থেকে রক্ষা করবে; কিন্তু আল্লাহর শাস্তি এমন এক দিক থেকে আসল যা ছিল তাদের ধারণাতীত এবং তাদের অন্তরে তা ত্রাস সৃষ্টি করল। তারা ধ্বংস করে ফেলল তাদের বাড়িঘর নিজেদের হাতে এবং মু’মিনদের হাতেও। অতএব হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।” [391]
এবং ঐ আয়াতটিও ভুলে গেছে যেখানে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
وَأَنْزَلَ الَّذِينَ ظَاهَرُوهُمْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ مِنْ صَيَاصِيهِمْ وَقَذَفَ فِي قُلُوبِهِمُ الرُّعْبَ فَرِيقًا تَقْتُلُونَ وَتَأْسِرُونَ فَرِيقًا
وَأَوْرَثَكُمْ أَرْضَهُمْ وَدِيَارَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ وَأَرْضًا لَمْ تَطَئُوهَا وَكَانَ اللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرًا
“কিতাবীদের মধ্যে যারা তাদেরকে সাহায্য করেছিল, তাদেরকে তিনি তাদের দূর্গ থেকে অবতরণ করালেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করালেন; এখন তোমরা তাদের কতককে হত্যা করছ এবং কতককে করছ বন্দী। আর তিনি তোমাদেরকে অধিকারী করলেন এদের ভূমি, ঘরবাড়ি ও ধনসম্পদের এবং এমন ভূমির যাতে তোমরা এখনও পদার্পণ করনি। আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।” [392]
এবং নিশ্চয় যারা তাদের গোয়েন্দা সংস্থার সক্রিয়তা দেখে ভয় পেয়েছে তারা আল্লাহর আয়াতকে ভুলে গেছে,
أَوْ كَصَيِّبٍ مِنَ السَّمَاءِ فِيهِ ظُلُمَاتٌ وَرَعْدٌ وَبَرْقٌ يَجْعَلُونَ أَصَابِعَهُمْ فِي آَذَانِهِمْ مِنَ الصَّوَاعِقِ حَذَرَ الْمَوْتِ وَاللَّهُ مُحِيطٌ بِالْكَافِرِينَ
“… আল্লাহ্ কাফিরদের পরিবেষ্টন করে আছেন।” [393]
এবং তাঁর, (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা), ঐ আয়াতটিও ভুলে গেছে,
وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ مُحِيطًا
“… এবং সবকিছুকে আল্লাহ্ পরিবেষ্টন করে আছেন।” [394]
এবং ঐ আয়াতও,
وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بَطَرًا وَرِئَاءَ النَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَاللَّهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ
“তারা যা করে আল্লাহ্ তা পরিবেষ্টন করে আছেন (মুহিতুন)” [395]
আসলে কাফির হওয়া সত্ত্বেও আব্দুল মুত্তালিব আল্লাহ্ ও তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে এসব কাপুরুষের চেয়ে অনেক বেশী জানতেন। আর এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন সে আব্রাহাকে বলেছিল, “নিশ্চয় এই ঘরের (কাবা) একজন রব আছেন যিনি এটাকে রক্ষা করবেন।” যখন আল্লাহ্ পাখির ঝাঁক দিয়ে আব্রাহা বাহিনীকে বিধ্বস্ত করলেন, তাদের অনেকেই ভয়ে পালিয়ে গেল, তাদের পথপ্রদর্শক বললঃ
“কোথায় সেই ব্যক্তি যে পালিয়ে যায় এবং রবকে খোঁজে এবং আল আসরাম তো পরাভূত, সে বিজয়ী নয়।” আল আসরাম হলো আব্রাহা।
আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَفِرْعَوْنَ ذِي الْأَوْتَادِ
الَّذِينَ طَغَوْا فِي الْبِلادِ
فَأَكْثَرُوا فِيهَا الْفَسَادَ
فَصَبَّ عَلَيْهِمْ رَبُّكَ سَوْطَ عَذَابٍ
إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ
“এবং বহু সৈন্য শিবিরের অধিপতি ফিরআউনের প্রতি? যারা দেশে সীমালঙ্ঘন করেছিল, এবং সেখানে অশান্তি বৃদ্ধি করেছিল। অতঃপর তোমার রব তাদের উপর নানাবিধ শাস্তির কশাঘাত হানলেন। তোমার প্রতিপালক অবশ্যই সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।” [396]
নিজের জান ও তার সাম্রাজ্যের ভয়ে ফিরআউন বনী ইসরাঈলের কত শিশুকেই না হত্যা করেছিল; আর অবশেষে তারই ঘরে সে লালন পালন করেছে এমন একজনকে (মূসা আলাইহিস সালাম) যার হাতে দিয়ে ধ্বংস হয়েছে তার পুরো সাম্রাজ্য। আল্লাহর ক্বদরের ক্ষেত্রে কোন সতর্কতাই কাজে আসে না। আল্লাহ্ তাদের সবদিক থেকে ঘিরে আছেন। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَقَالَ الَّذِي اشْتَرَاهُ مِنْ مِصْرَ لِامْرَأَتِهِ أَكْرِمِي مَثْوَاهُ عَسَى أَنْ يَنْفَعَنَا أَوْ نَتَّخِذَهُ وَلَدًا وَكَذَلِكَ مَكَّنَّا لِيُوسُفَ فِي الْأَرْضِ وَلِنُعَلِّمَهُ مِنْ تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ وَاللَّهُ غَالِبٌ عَلَى أَمْرِهِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لا يَعْلَمُونَ
“আল্লাহর তাঁর কার্য সম্পাদনে অপ্রতিরোধ্য; কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না।” [397]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরো বলেন,
كَتَبَ اللَّهُ لاغْلِبَنَّ أَنَا وَرُسُلِي إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ
“আল্লাহ্ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ‘আমি অবশ্যই বিজয়ী হব এবং আমার রাসূলগণও’। নিশ্চয় আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান, পরাক্রমশালী।” [398]
নিশ্চয় কাফিরদের দূর্গগুলো আল্লাহর শাস্তি থেকে তাদের রক্ষা করতে পারবে না এবং তাদের সৈন্য বাহিনীও আল্লাহর আক্রমণ ঠেকাতে কোনই উপকারে আসবে না। আর নিশ্চয় তাদের সম্পদ আল্লাহর কাছে কোন সুপারিশ করবে না এবং তাদের পরিকল্পনা আর চক্রান্ত আল্লাহর ক্ষমতাকে কমাতে পারবে না। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَمَكَرُوا مَكْرًا وَمَكَرْنَا مَكْرًا وَهُمْ لا يَشْعُرُونَ
فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ مَكْرِهِمْ أَنَّا دَمَّرْنَاهُمْ وَقَوْمَهُمْ أَجْمَعِينَ
فَتِلْكَ بُيُوتُهُمْ خَاوِيَةً بِمَا ظَلَمُوا إِنَّ فِي ذَلِكَ لايَةً لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
“তারা চক্রান্ত করেছিল এবং আমিও এক কৌশল অবলম্বন করলাম, কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি। অতএব দেখ তাদের চক্রান্তের পরিণাম কি হয়েছে – আমি অবশ্যই তাদেরকে এবং তাদের সম্প্রদায়ের সকলকে ধ্বংস করেছি। এইতো তাদের ঘরবাড়ি – সীমালংঘনহেতু যা জনশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে; এতে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।” [399]
এবং আমি আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই আমাদের ব্যর্থতা প্রথমত আমাদের নিজেদের কারণেঃ
مَا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللَّهِ وَمَا أَصَابَكَ مِنْ سَيِّئَةٍ فَمِنْ نَفْسِكَ وَأَرْسَلْنَاكَ لِلنَّاسِ رَسُولًا وَكَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا
“…অকল্যাণ যা হয় তা তোমাদের নিজের কারণে।” [400]
সুতরাং প্রথমে আমাদের নিজেদেরকে বদলাতে হবে। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلا مَرَدَّ لَهُ وَمَا لَهُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَالٍ
“নিশ্চয় আল্লাহ্ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়।” [401]
নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরই অবাধ্যতার কারণে আমাদের উপরে কাফিরদের শক্তিশালী করেছেন; যেমনিভাবে তিনি মাজুসদের শক্তিশালী করেছিলেন বনী ইসরাঈলের উপর যখন তারা আল্লাহকে ক্রোধান্বিত করেছিল তাদের আমলের দ্বারা। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ أُولاهُمَا بَعَثْنَا عَلَيْكُمْ عِبَادًا لَنَا أُولِي بَأْسٍ شَدِيدٍ فَجَاسُوا خِلالَ الدِّيَارِ وَكَانَ وَعْدًا مَفْعُولًا
“তারা ঘরে ঘরে প্রবেশ করে সমস্ত কিছু ধ্বংস করেছিল। আর প্রতিশ্রুতি কার্যকরী হয়েই থাকে।” [402]
সুতরাং নিজেদেরকে পাল্টানো আজ জরুরী হয়ে পড়েছে; আমাদের তিনটি ক্ষেত্রে নিজেদের শুধরাতে হবেঃ সঠিক পন্থা; সততার সাথে এর অনুসরণ এবং সকল নিয়্যতে বিশুদ্ধতা আনয়ন।
এবং আমি এই বইতে সঠিক কর্মপন্থার বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি, যতটুক সম্ভব হয়েছে, আর আল্লাহ্ সবচাইতে ভালো জানেন। এ ব্যাপারে আলোচনা রয়েছে ‘কিতাব ও সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরার মূলনীতি’ ও ‘আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের কর্মপন্থা’ নামক অধ্যায়ে।
এবং আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,
إِنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِينَ آَمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ يَقُومُ الْأَشْهَادُ
“নিশ্চয় আমি রাসূলগণকে এবং মু’মিনগণকে সাহায্য করব পার্থিব জীবনে এবং যেইদিন সাক্ষী দন্ডায়মান হবে।” [403]
নিঃসন্দেহে এই প্রতিশ্রুতি সত্য। এবং আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
وَلا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلاحِهَا وَادْعُوهُ خَوْفًا وَطَمَعًا إِنَّ رَحْمَةَ اللَّهِ قَرِيبٌ مِنَ الْمُحْسِنِينَ
“নিশ্চয় আল্লাহর অনুগ্রহ সৎকর্মশীলদের (মুহসীন) নিকটবর্তী।” [404]
[1] সূরা আত—তাওবাহ ৯:১২০—১২১
[2] সূরা যারিয়াত ৫১:৫৬
[3] সূরা নাহল ১৬:৩৬
[4] সূরা ফাতির ৩৫:২৪
[5] সূরা নিসা ৪:১৬৫
[6] সূরা কাসাস ২৮:৫৯
[7] সূরা হুদ ১১:১১৮—১১৯
[8] সূরা ইউনুস ১০:৯৬—৯৭
[9] সূরা ইউনুস ১০:৯৯
[10] সূরা ইয়াসীন ৩৬:৮২
[11] সূরা আহযাব ৩৩:৩৮
[12] সূরা তাগাবুন ৬৪:২
[13] সূরা ইউনুস ১০:১৯
[14] সূরা আনফাল ৮:৪২
[15] সূরা বাকারা ২:২১৩
[16] সূরা বাকারা ২:২৫৩
[17] সূরা ২৭:৪৫
[18] সূরা সাফফাত ৩৭:৩৯
[19] সূরা ইউনুস ১০:৪৪
[20] সহীহ্ মুসলিম
[21] সূরা নামল ২৭:৪৫
[22] সূরা হাজ্জ ২২:১৯
[23] সূরা নিসা ৪:১০১
[24] সূরা মুহাম্মদ ৪৭:৪
[25] সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:৩১
[26] মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত
[27] সূরা মুহাম্মদ ৪৭:৩১
[28] সূরা ফুরকান ২৫:৩১
[29] সূরা আন’আম ৬:১১২
[30] সূরা আন’আম ৬:১২৩
[31] সূরা ফুসসিলাত ৪১:৪৩
[32] সূরা যারিয়াত ৫১:৫২—৫৩
[33] সূরা আন’আম ৬:৩৪
[34] সূরা মুতাফ্ফিফীন ৮৩:২৯
[35] সূরা ইয়াসীন ৩৬:৩০
[36] সূরা হিজর ১৫:৬
[37] সূরা ইউনুস ১০:৭৮
[38] সূরা মু’মিন ৪০:২৬
[39] সূরা শূরা ২৬:১১১
[40] সূরা মারইয়াম ১৯:৭৩
[41] সূরা ইয়াসীন ৩৬:১৮
[42] সূরা কাহফ ১৮:৫৬
[43] সূরা আ’রাফ ৭:৯০
[44] সূরা মু’মিন ৪০:২৬
[45] সূরা শু’আরা ২৬:৫৩—৫৬
[46] সূরা মু’মিন ৪০:২৯
[47] সূরা ত্বাহা ২০:৬৩
[48] সূরা মু’মিন ৪০:৮৩
[49] সূরা সাবা ৩৪:৩৩
[50] সূরা মুনাফিকূন ৬৩:৭
[51] সূরা কালাম ৬৮:৯
[52] সূরা মা’য়িদা ৫:৪৯
[53] সূরা বাকারা ২:১২০
[54] সূরা ইব্রাহীম ১৪:১৩
[55] সূরা কাহফ ১৮:২০
[56] সূরা আম্বিয়া ২১:৬৮
[57] সূরা আনফাল ৮:৩০
[58] সূরা বাকারা ২:২১৭
[59] সূরা যারিয়াত ৫১:৫৩
[60] সূরা আল বুরুজ ৮৫:৭—৮
[61] সূরা নিসা ৪:৮৯
[62] আত তিরমিযী; সহীহ্
[63] সূরা বাকারা ২:১২০
[64] সূরা বাকারা ২:২১৭
[65] সূরা হাজ্জ ২২:৪০
[66] সূরা আলি ‘ইমরান ৩:২০
[67] বুখারী, জাবীর (রদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত
[68] সূরা আত—তাওবাহ ৯:১১৩
[69] উসামা বিন যাইদ থেকে বর্ণিত, বুখারী ও মুসলিম
[70] সূরা মুমতাহিনা ৬০:৪
[71] সূরা নাহল ১৬:১২৩
[72] সূরা মারইয়াম ১৯:৪৮
[73] সূরা মারইয়াম ১৯:৪৯
[74] সূরা কাহফ ১৮:১৬
[75] সূরা মুমতাহিনা ৬০:৪
[76] মাজমুআত—তাওহীদঃ দ্বাদশ চিঠি, পৃঃ ৩৭৬—৩৭৮, দার আল—ফিকর পাবলিকেশন
[77] সূরা মা’য়িদা ৫:৮১
[78] সূরা কাহফ ১৮:১৬
[79] সূরা মারইয়াম ১৯:৪৮
[80] আবু দাউদ, তিরমিযী
[81] সূরা আত—তাওবাহ ৯:৫
[82] মুসলিম, ‘ইয়্যাদ বিন হিমার (রদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত
[83] ইবনে উমার (রদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, মুত্তাফাকূন ‘আলাইহি
[84] সূরা মা’য়িদা ৫:২১
[85] সূরা মা’য়িদা ৫:২৪
[86] সূরা কাসাস ২৮:৪৩
[87] সূরা হাক্কাহ ৬৯:৯—১০
[88] সূরা আত—তাওবাহ ৯:১১১
[89] তাফসীর আল কুরতুবী
[90] আবু দাউদ
[91] সূরা আলি ‘ইমরান ৩:১৬৬
[92] সূরা আলি ‘ইমরান ৩:১৭৯
[93] সূরা মুনাফিকূন ৬৩:৪
[94] সূরা আত— তাওবাহ ৯:৪৭
[95] সূরা আত—তাওবাহ ৯:৫
[96] সূরা আত—তাওবাহ ৯:২৯
[97] মুত্তাফাকূন ‘আলাইহি, ইবনে উমার (রদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত
[98] সূরা আনফাল ৮:১৫
[99] সূরা বাকারা ২:১৯০
[100] সূরা বাকারা ২:১৯৪
[101] আল ইসতিয়ারাত আল ফিখরিয়্যাহ
[102] সূরা আনকাবুত ২৯:৪৭
[103] সূরা আনফাল ৮:৬১
[104] মুত্তাফাকূন ‘আলাইহি
[105] ইবনে ইসহাকের বর্ণনা মতে
[106] সূরা মা’য়িদা ৫:৩
[107] বুখারী, আয়শা (রদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত
[108] সূরা নিসা ৪:১১৫
[109] সূরা আনফাল ৮:৬১
[110] ফাতহুল বারী
[111] ফাতহুল বারী
[112] সহীহ মুসলিম বি শারহ্ আন- নববী
[113] সূরা আহযাব —৩৩:২৩
[114] সূরা আনফাল ৮:৩৯
[115] সূরা সফ ৬১:৯
[116] সূরা আত—তওবাহ ৯:২৯
[117] আহকাম আহলূল জিম্মাহ
[118] সূরা বাকারা ২:২৫৬
[119] সুরা বাকারাঃ ২৫৬ নং এই আয়াতের ব্যাখ্যা—ইবনে কাসীর
[120] সূরা মায়িদা ৫:৪৪
[121] সূরা হজ্জ ২২:৪০
[122] সূরা আনফাল ৮:৬০
[123] সূরা— নিসা ৪:৯৫
[124] সূরা আত—তাওবাহ ৯:১২২
[125] আল্ মুগনী ওয়াশ শারহ্ আল কাবীর / দশম খন্ড
[126] সূরা আনফাল ৮:৪৫—৪৬
[127] সূরা আনফাল ৮:১৫—১৬
[128] সূরা আত—তাওবাহ ৯:৪৫
[129] মুত্তাফাকূন ‘আলাইহি)” (আল্ মুগনী ওয়াশ শারহ্ আল কাবীর / দশম খন্ড
[130] সূরা আনফাল ৮:৪৫
[131] আল্ মুগনী ওয়াশ শারহ্ আল কাবীর / দশম খন্ড
[132] সূরা আনফাল ৮:৬০
[133] সূরা নিসা ৪:১০২
[134] আল ইখতিয়ারাহ্ আল ফিক্বখিয়্যাহ্
[135] আল্ মুগনী ওয়াশ শারহ্ আল কাবীর / দশম খন্ড
[136] সূরা আত—তাওবাহ ৯:১২৬
[137] তাফসীর আল কুরতুবী, অষ্টম খন্ড
[138] সূরা আনফাল ৮:৬০
[139] মুত্তাফাকূন ‘আলাইহি, আবু মূসা হতে বর্ণিত
[140] মুত্তাফাকূন আলাইহি, আন—নু’মান ইবন বাশীর হতে বর্ণিত
[141] সূরা মুহাম্মদ ৪৭:৩৫
[142] সূরা আত—তাওবাহ ৯:৫
[143] সূরা তাওবা ,সহীহ বুখারী
[144] সূরা নিসা ৪:১০২
[145] সূরা মুহাম্মদ ৪৭:৩৫
[146] সূরা আত—তাওবাহ ৯:১
[147] সূরা আনফাল ৮:৬১
[148] সূরা মুহাম্মদ ৪৭:৩৫
[149] সূরা আনফাল ৮:৬১
[150] সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:৩৫
[151] সূরা আনফাল ৮:৩৯
[152] সূরা সফ ৬১:৯
[153] সূরা আত-তাওবাহ ৯:২৯
[154] সূরা মুজাদালাহ ৫৮:২০
[155] ফাতহুল বারী
[156] সূরা আম্বিয়া ২১:১০৭
[157] সূরা বাকারা ২:২৫৭
[158] সূরা নাহল ১৬:৯০
[159] সূরা আলি ‘ইমরান ৩:৬৪
[160] সূরা আনফাল ৮:৩৯
[161] আহমদ, হারিছ আল আশআরী রদিয়াল্লাহু আনহু
[162] আবু দাউদ (রদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত
[163] আবু দাউদ, তিরমিযী
[164] আহমাদ
[165] সূরা নাহল ১৬:১১০
[166] আহমাদ, আব্দুল্লাহ ইবনে সাদী (রদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত
[167] সূরা নিসা ৪:৯৭
[168] আবু দাউদ, তিরমিযী
[169] সাঈদ অন্যান্যদের থেকে বর্ণিত
[170] সূরা নিসা ৪:৯৭
[171] সূরা নিসা ৪:৯৮—৯৯
[172] আল মুগনি ওয়াশ শারহ্ আল কাবীর
[173] সূরা হুজরাত ৪৯:১০
[174] মুত্তাফাকূন ‘আলাইহি
[175] মুসলিম
[176] সূরা হুজুরাত ৪৯:১৩
[177] আহমদে বর্ণিত, আলবানী কর্তৃক সহীহ হিসেবে গৃহীত
[178] ইবন উমর থেকে বুখারীতে বর্ণিত
[179] মুসলিম
[180] তাফসীর আল কুরতুবী, অধ্যায়— ৮/১৫১
[181] হিশায়াত ইবন আবিদীন, অধ্যায় ৩/২৩৮
[182] সূরা আত—তাওবাহ ৯:২৪
[183] জাবীর থেকে আবু দাউদে বর্ণিত
[184] দারকুতনীতে বর্ণিত, আলবানী কর্তৃক হাসান হিসেবে স্বীকৃত
[185] জাবীর রদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বুখারীতে বর্ণিত
[186] মুসলিম
[187] সূরা হুদ ১১:৪৬
[188] সূরা মুমতাহিনা ৬০:৪
[189] সূরা আত-তাওবাহ ৯:২৪
[190] সূরা আলি ‘ইমরান ৩:১০০—১০৫
[191] সূরা আত—তাওবাহ ৯:১২৩
[192] আল মুগনি ওয়াশ শারহ্ আল কাবীর, দশম খন্ড
[193] সূরা আত—তাওবাহ ৯:১২৩
[194] মাজমু আল ফাতাওয়া
[195] মাজমু আল ফাতাওয়া
[196] মাজমু আল ফাতাওয়া
[197] সূরা আল মায়িদাহ ৫:৪৪
[198] সূরা আল আনআম ৬:১
[199] সূরা আশ শূরা ৪২:২১
[200] সূরা আত-তাওবাহ ৯:৩১
[201] ফাতহুল বারী ১৩/১২০
[202] আত তিরমীযী
[203] মাজমু আল ফাতওয়া ৩৫/৬৫
[204] সূরা আল মায়িদাহ ৫:৫১
[205] মাজমু আত তাওহীদ— ইবনে তাইমিয়্যাহ ও ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব
[206] সূরা আন নিসা ৪:৭৬
[207] বুখারী ও মুসলিম; সহীহ মুসলিম ইস. ফাউ. হাদীস নং ৪৬১৯
[208] সহীহ মুসলিম বি শারহ আন নববীঃ কিতাব আল ইমারা ১২/২২৯
[209] ফাতহুল বারী
[210] মাজমু আল ফাতওয়া ২৮/২৫৯
[211] সূরা আনফাল ৮:৫৯—৬০
[212] সহীহ মুসলিম
[213] সূরা আন নিসা ৪:৭৫
[214] সূরা আলি ইমরান ৩:৬৪
[215] সূরা আন নিসা ৪:১৪০
[216] সূরা আল বাকারা ২:১৯১
[217] সহীহ মুসলিম
[218] সূরা হাশর ৫৯:৮
[219] আল বুখারী কর্তৃক বর্ণিত, হাদীস নং ৪৮২২
[220] সূরা আল মায়িদাহ ৫:২
[221] সূরা আন নিসা ৪:৫
[222] আল বুখারী
[223] সূরা আর রাদ ১৩:১১
[224] সূরা আল কাসাস ২৮:৫—৬
[225] ‘আল ইখতিয়ারাহ আল ফিকহিয়্যাহ’ পৃঃ ৩০৯
[226] সূরা আত—তাওবাহ ৯:১২৩
[227] মাজমু আল ফাতওয়া’ খন্ড ২৮/৫০১—৫৫১
[228] সূরা হুদ ১১:৪৬
[229] সূরা মুমতাহিনাহ ৬০:৪
[230] সূরা আন নিসা ৪:১০১
[231] বুখারী ও মুসলিম
[232] সূরা হুদ ১১:৪৫—৪৬
[233] সূরা আন নিসা ৪:৫৮
[234] সূরা আন নিসা ৪:৮৪
[235] আল মুহিল্লী’ খন্ড ৭/২৯৯
[236] সূরা আল বাকারা ২:২০৭
[237] সূরা আন নূর ২৪:৬২
[238] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ – ইবনে কাসীর, খন্ড ৬/৩০৭-৩১০
[239] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ – ইবনে কাসীর, খন্ড ১০/৬-১১
[240] সূরা আল মায়িদাহ ৫:৩
[241] সূরা ফাতহ ৪৮:১৮
[242] সূরা ইউনুস ১০:৯
[243] সূরা আত—তাওবাহ ৯:৮৭
[244] সূরা আত—তাওবাহ ৯:৩৯—৪০
[245] সূরা আন নিসা ৪:৫৯
[246] সূরা আল মায়িদাহ ৫:৫১
[247] মাজমু আল ফাতওয়া’, খন্ড ২৮/৫৪৭
[248] তাতাররুস হলো যখন কাফিররা একজন মুসলিমকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার এই আশায় যে, ঐ মুসলিমকে বাঁচানোর তাগিদে মুজাহিদরা কাফিরদের আক্রমণ করা থেকে বিরত হবে
[249] ৯ হাদীস নং ৪২৮৭
[250] সূরা মুমতাহিনাহ ৬০:৪
[251] সূরা আন—নাহল ১৬:১২৩
[252] সূরা আনফাল ৮:৭
[253] এ ব্যাপারে ১৩তম এবং ১৪তম অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে
[254] হাদীস নং ৩৮৩৪
[255] ফাতহুল বারী ৭/১৫১
[256] সূরা আত—তাওবাহ ৯:৭১
[257] সূরা আল—মায়িদা ৫:৫৬
[258] সূরা আলি ইমরান ৩:১০৫
[259] হারিছ আল আশআরী থেকে বর্ণিত; মুসনাদ আহমাদ
[260] সূরা আল আনফাল ৮:৬৫
[261] সূরা আন নিসা ৪:৮৪
[262] আইয়াদ ইবনে হিমার রাদিআলাহু আনহু থেকে মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত।
[263] সূরা মায়িদা ৫:৫৬
[264] সূরা আল আনফাল ৮:৪৬
[265] সূরা আলি ইমরান ৩:১০৫
[266] সূরা সাজদা ৩২:২১
[267] বুখারী ও মুসলিম
[268] সূরা আল বাকারা ২:১১৪
[269] তাফসীর আল কুরতুবী’, খন্ড ২/৭৮
[270] সূরা আল মায়িদা ৫:২
[271] সূরা আল আনফাল ৮:২৭
[272] সূরা আন নিসা ৪:৭৯
[273] সূরা আশ শুরা ৪২:৩০
[274] সূরা আর রাদ ১৩:১১
[275] Sahih Muslim
[276] সূরা আল মায়িদা ৫:১৪
[277] সূরা আল মু’মীনুন ২৩:৫৩
[278] সূরা আল আনফাল ৮:৬২—৬৩
[279] বুখারী ও মুসলিম
[280] সহীহ মুসলিম বি শারহ্ আন নববী’, খন্ড ১২/৪৫
[281] ফাতহুল বারী’, খন্ড ৬/১৫৮
[282] নাইল আল আওতার খন্ড ৮/৫৭
[283] সূরা আন নিসা ৪:৭১
[284] সূরা আন নিসা ৪:১০২
[285] সহীহ মুসলিম, আহমাদ, আবু দাউদ
[286] সহীহ মুসলিম বি শারহ আন নববী’, খন্ড ১২/৪৫
[287] ফতহুল বারী’ খন্ড ৬/১৫৯
[288] ফাতহুল বারী’ খন্ড ৬/৩৯২
[289] সহীহ মুসলিম বি শারহ আন নববী’, খন্ড ১৮/১৩০
[290] ফাতহুল বারী’, খন্ড ৬/১৫৯
[291] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ খন্ড ৪/১২৫
[292] সূরা আত—তাওবাহ ৯:৫
[293] সহীহ বুখারী
[294] ফাতহুল বারী’, খন্ড ৭/৩৪০
[295] সহীহ মুসলিম বি শারহ আন নববী’, খন্ড ১২/১৬০
[296] সূরা আত—তাওবাহ ৯:১২
[297] সহীহ বুখারী
[298] ফাতহুল বারী’, খন্ড ৭/৩৪৫
[299] সূরা আল ফাতিহা ১:৫
[300] সাফওয়াত আল আছার ওয়াল মাফাহিম মিন তাফসীর আল কুরআন আল আছিম’, খন্ড ১/২৬৮
[301] বুখারী ও মুসলিম
[302] বুখারী ও মুসলিম
[303] সহীহ মুসলিম
[304] সহীহ মুসলিম বি শারহ আন নববী’, খন্ড ১২/৪৮—৫০
[305] আল মুগনী আশ শারহ আল কাবীর’, খন্ড ১০/৫০৩
[306] আল ইতিবার ফি আন নাশিখ ওয়াল মানসুখ’, – আল হাযিমি
[307] সূরা আল মায়িদা ৫:৬৭
[308] ঈমাম বুখারী কর্তৃক বর্ণিত
[309] ফাতহুল বারী’, খন্ড ৮/৪০৫
[310] সূরা আল হিজর ১৫:৯৪
[311] সূরা আল হিজরের তাফসীর দ্রষ্টব্য
[312] সূরা আল গাফির ৪০:২৮
[313] সূরা আল কাহফ ১৮:১৯-২০
[314] সহীহ আল বুখারী
[315] সহীহ বুখারী
[316] সহীহ মুসলিম
[317] সহীহ মুসলিম বি শারহ আন নববী’, খন্ড ২/১৭৯
[318] আস সারাম আল মাসলুল’, পৃ. ২২১
[319] সূরা আত—তাওবাহ ৯:৪০
[320] সহীহ বুখারী
[321] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ খন্ড ৪/১১১
[322] ইকতিদা আস সীরাত আল মুসতাকিম’ —ইবনে তাইমিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহ
[323]সূরা আত— তাওবাহ ৯:৪৬
[324] সূরা আত—তাওবাহ ৯:১১১
[325] সহীহ বুখারী ও মুসলিম
[326] সহীহ বুখারী ও মুসলিম
[327] সহীহ বুখারী
[328] ফাতহুল বারী; খন্ড ৬/৩৩
[329] সূরা আত—তাওবাহ ৯:১১১
[330] সূরা আল বাকারা ২:৯৪—৯৬
[331] সহীহ বুখারী
[332] সূরা আল আনফাল ৮:৬০
[333] আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত
[334] সূরা আলি ইমরান ৩:২০০
[335] সূরা আন নিসা ৪:১০৪
[336] আহমাদ কর্তৃক বর্ণিত সহীহ
[337] সূরা আনফাল ৮:১২
[338] সূরা আল ফাতহ্ ৪৮:২২—২৩
[339] বুখারী ও মুসলিম
[340] সূরা আলি ইমরান ৩ : ১৪০
[341] সূরা আন নিসা ৪:৮৪
[342] সূরা আনফাল ৮:৩৯
[343] সূরা আত— তাওবাহ ৯:১৪
[344] সূরা আত-তাওবাহ ৯:৩৩
[345] সূরা আনফাল ৮:৩৯
[346] আল মুগনী আশ শারহ আল কাবীর ১০/৫৫৩
[347] সূরা আনফাল ৮:১৬
[348] আল বায়হাকী
[349] সহীহ বুখারী
[350] সূরা বাকারা ২:১৯৫
[351] সূরা আল মায়িদা ৫:৩
[352] বুখারী ও মুসলিম
[353] সহীহ মুসলিম
[354] আল মুগনী আশ শারহ আল কাবির খন্ড ১০/৩৭৩
[355] সূরা আল মায়িদাহ ৫:৬৭
[356] রুকিয়াহঃ অসুখবিসুখ অথবা বদনজর থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য কোরআনের আয়াত ও কিছু নির্দিষ্ট দোআ করা।
[357] হাদীসটি ইবনে মাযাহ ও আহমাদ কর্তৃক বর্ণিত। তবে আলবানী এটিকে যাইফ বলেছেন
[358] এই হাদীসের একটি বর্ণনাকারীর ব্যাপারে ইবনে হাযার সন্দেহ প্রকাশ করেছেন
[359] মাদরিজ আস সালিকিন
[360] মাজমু আল ফাতাওয়া
[361] সহীহ বুখারী; হাদীস নং ৫২০৫ ইস. ফাউ
[362] সূরা হাদীদ ৫৭:২২—২৩
[363] সূরা আলি ইমরান ৩:১৪৫
[364] সূরা আল আরাফ ৭:৩৪
[365] সহীহ বুখারী; হাদীস নং ৬০২৯ ইস. ফাউ.
[366] ইবনে হিব্বান এবং আল হাকিম হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন
[367] সহীহ মুসলিম; হাদীস নং ৬২৯৩ ইস. ফাউ.
[368] সূরা আস সফ ৬১:১৩
[369] সূরা আন নিসা ৪:১০০
[370] সূরা আত—তাওবাহ ৯:১২০—১২১
[371] সহীহ মুসলিম; হাদীস নং ৪৭৭২ ইস. ফাউ.
[372] বুখারী ও মুসলিম
[373] সূরা আলি ইমরান ৩:১২৬
[374] সূরা আত-তাওবাহ ৯:২৫-২৬
[375] সূরা আত—তাওবাহ ৯:৩৮—৪০
[376] সূরা আল আনফাল ৮:১৭
[377] সূরা আর রূম ৩০:৪৭
[378] সূরা হাজ্জ ২২:৪০
[379] সূরা বনী ইসরাইল ১৭:১৯
[380] সূরা ইউসুফ ১২:৮৭
[381] সূরা আলি ইমরান ৩:১২৬
[382] সূরা ফাতির ৩৫:২
[383] সূরা আনফাল ৮:৫৯—৬০
[384] সূরা আনফাল ৮:১৮—১৯
[385] সহীহ মুসলিম, ‘আইয়াদ ইবনে হিমার (রদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত
[386] মুহাম্মাদ ৪৭:১১
[387] সূরা আন নিসা ৪:৭৬
[388] সূরা আল ফাতহ্ ৪৮:২১
[389] সূরা আল ফাতহ্ ৪৮:৭
[390] সূরা মুনাফিকুন ৬৩:৭
[391] সূরা আল হাশর ৫৯:২
[392] সূরা আল আহযাব ৩৩:২৬—২৭
[393] সূরা আল বাকারা ২:১৯
[394] সূরা আন নিসা ৪:১২৬
[395] সূরা আনফাল ৮:৪৭
[396] সূরা আল ফাজর ৮৯:১০—১৪
[397] সূরা ইউসুফ ১২:২১
[398] সূরা মুজাদিলা ৫৮:২১
[399] সূরা আন নামল ২৭:৫০—৫২
[400] সূরা আন নিসা ৪:৭৯
[401] সূরা আর রাদ ১৩:১১
[402] সূরা আল ইসরা ১৭:৫
[403] সূরা গাফির ৪০:৫১
[404] সূরা আল আরাফ ৭:৫৬