ইউসুফ আল-কারদাবি ও তার ধ্যানধারনার পর্যালোচনা
ClarificationOfTheDoubts
পরিবেশিত একটি যুগান্তকারী গ্রন্থ
ইউসুফ আল-কারদাবি ও তার ধ্যানধারনার পর্যালোচনা
ডাউনলোড করুন
http://www.mediafire.com/file/l3ha577ca3d2z2x/alQardawiBn.pdf
মর্ডানিস্ট কিংবা মডারেট বলুন আধুনিক সময়ের এ ফিরকাগুলো তাত্ত্বিক ও আদর্শিক ভাবে এক ব্যক্তির কাছে কৃতজ্ঞ। কাফিরের সংজ্ঞা, আল ওয়ালা ওয়াল বারা, হুদুদ, ফ্রি-মিক্সিং, সঙ্গীত, হাদীসের মনগড়া ব্যাখ্যা, কোন শার’ই বিধানকে বর্তমান সময়ে অপ্রযোজ্য ঘোষণা করা, ব্যাঙ্কিং, জিহাদ, আক্বিদাসহ ইসলামের যেসব বিষয়ে ক্রুসেডার ও যায়নিস্টদের অ্যালার্জি আছে তার সবগুলোর ক্ষেত্রেই মর্ডানিস্ট ও মডারেট – দু দলই একজন ব্যক্তিকে কমন রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে।
.
তিউনিশিয়ার রাশিদ ঘান্নুসি থেকে শুরু করে আল ওয়ালা ওয়াল বারা সংজ্ঞা উল্টে দেওয়া জনপ্রিয় পশ্চিমা ‘স্কলার’-দা’ঈ-বক্তা, কিংবা বাংলাদেশে বিভিন্ন কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে ফ্রি-মিক্সিংকে উস্কে দেওয়া, ফিকহের পরিভাষা ব্যবহার করে পাঠক-শ্রোতা বিভ্রান্ত করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, গা বাঁচানো বাছাবাছির আর সুবিধাবাদী এক ইসলামের দাওয়াত দেওয়া বিভিন্ন সেলিব্রিটি দা’ঈরা পর্যন্ত – সকলেই জ্ঞাতসারে বা অজান্তে আল-কারদাবির তৈরি করা আদর্শিক ভিত্তি ও কাঠামোর উপর দাড়িয়েই নিজ নিজ ব্র্যান্ডের গোমরাহির প্রচারনা চালায়।
.
দেশে কিংবা বিদেশে যারাই বর্তমানে বিভিন্ন গোমরাহিকে ইসলামের পোষাক পড়িয়ে জায়েজ করতে চাইছে – সেটা গনতন্ত্রকে বৈধতা দেওয়া, জিহাদের ভুল ব্যাখ্যা করা, সঙ্গীতকে জায়েজ বলা, ফ্রি-মিক্সিংকে উৎসাহিত করা, নিক্বাবের বিরোধিতা করা, দাড়ি কামানোকে জায়েজ বলা, মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য করাকে বৈধতা দেওয়া, যেটাই হোক না কেন – তারা সবাই ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে আল-কারদাবির শেখানো ‘যুক্তিকেই’ উপস্থাপন করছে।
.
ইখওয়ান, জামাতে ইসলামি এবং তাদের অফশুট মর্ডানিস্ট ও মডারেটদের আধ্যাত্মিক গুরু ও আদর্শিক রাজমিস্ত্রি ইউসুফ আল-কারদাবি। দুঃখজনক ভাবে বর্তমাএন কওমি ধারার অনেকের কাছেও অনুসরনীয় এক ব্যক্তি। অথচ তার বিচ্যুতি নিছক বিদ’আহ গোমরাহির পর্যায় পেড়িয়ে কুফরেও পৌঁছেছে। কারদাবির বিচ্যুতি নিয়ে দালিলিক ও প্রামাণিক আলোচনা। অবশ্য পাঠ্য !
জামাতে ইসলামী ও ইখওয়ানুল মুসলিমীনের প্রধান আলেম
ইউসুফ আল কারদাবি
পরিচয় ও তার চিন্তাধারার পর্যালোচনা
বঙ্গানুবাদের ভূমিকা
ইন্নাল হামদা লিল্লাহ ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু ‘আলা রাসূলুলিল্লাহ ওয়া ‘আলা আলিহি ওয়া আসহাবিহি সাল্লাম তাসলিমান কাসীরা। আম্মা বা‘আদ।
আধুনিক সময়ে মুসলিম উম্মাহ নানা দিক থেকে আক্রমনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন শত্রুরা ক্রমাগত ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে যাচ্ছে। একদিকে ইসলামের শত্রুরা যেমন সামরিকভাবে উম্মাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, অন্যদিকে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে এক মনস্তাত্ত্বিক ও আদর্শিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতি বছর বিপুল পরিমান অর্থ তারা এ আদর্শিক যুদ্ধের জন্য ব্যয় করছে। উম্মাহর বিরুদ্ধে চলা এ সামরিক যুদ্ধের উদ্দেশ্য উম্মাহকে কুফফার ও তাদের দালালদের অধীনস্ত রাখা, উম্মাহর পুনঃজাগরনকে প্রতিহত করা, ইসলামী শরীয়াহ প্রতিষ্ঠাকে বাধা দেওয়া। আর মনস্তাত্ত্বিক ও আদর্শিক এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য হল ইসলামকে বদলে দেওয়া।
এমন এক নতুন ইসলাম তৈরি করা যা মুসলিমদের ক্রুসেডার ও যায়নিস্টদের আগ্রাসনকারীদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের শিক্ষা দেবে। কুফর ও শিরকের প্রতি সহনশীলতার শিক্ষা দেবে। আল্লাহর রাহে ভালবাসা ও ঘৃণার বদলে, বিশ্ব কুফর শক্তির রাহে ভালবাসা ও ঘৃণা, মৈত্রী ও শত্রুতা নির্ধারনের শিক্ষা দেবে।
উম্মাহর বিরুদ্ধে সামরিক বিজয়ের জন্য যেমন কাফিরদের বিভিন্ন বাহিনী যুদ্ধরত আছে, তেমনিভাবে আদর্শিক ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে বিজয় অর্জনের জন্যও বিভিন্ন বাহিনী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর ইসলামের বিরুদ্ধে আদর্শিক যুদ্ধ চালানো এসব বাহিনীর অন্যতম হল আধুনিক সময়ের মর্ডানিস্ট বা কথিত মডারেট ইসলামের ধারক ও বাহকরা। যদিও বিভিন্ন বিষয়ে মর্ডানিস্ট ও মডারেটদের মতপার্থক্য আছে, কিন্তু মৌলিকভাবে এ দুটি ধারা একইরকম।
দুটি ধারাই নুসুসের, অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সংশোধনবাদী (revisionist), পুনঃব্যাখ্যার (re-interpretation) দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহন করে। অর্থাৎ তারা সালাফ আস-সালেহিন এবং আহলুস সুন্নাহর ইমামদের অবস্থানকে বাদ দিয়ে নতুনভাবে শারীয়াহর ব্যাখ্যা করে। এজন্য ‘এই বিধান শুধু রাসূলুল্লাহর ﷺ সময়ের জন্য প্রযোজ্য ছিল’, ‘আধুনিক প্রেক্ষাপটের জন্য আমাদের নতুনভাবে এ বিধানকে ব্যাখ্যা করতে হবে’, ‘১৪০০ বছর আগের চিন্তাধারা আকড়ে থেকে উম্মাহর কোন লাভ নেই’- এ জাতীয় কথাগুলো দুই দলের কাছ থেকেই শোনা যায়।
এদের মধ্যে পার্থক্য হল এই যে মর্ডানিস্টরা অনেক সময় সরাসরি হাদীস অস্বীকার করে এবং মোটামুটি সরাসরি তাদের ইসলামকে বদলে দেওয়ার উদ্দেশ্যের কথা প্রকাশ করে। অন্যদিকে মডারেটরা কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফ আস-সালেহিনের অনুসরনের কথা মুখে বলে কিন্তু কার্যত তারা নিজস্ব ব্যাখ্যা আর ইজতিহাদের দোহাই দিয়ে এমন সব অবস্থানকে জায়েজ বানিয়ে নেয় যা কখনোই শারীয়াহ দ্বারা সমর্থিত না।
মর্ডানিস্টরা প্রকাশ্যে ইসলামকে বদলানোর কথা বলে, আর মডারেটরা কাজটা চুপিসারে করে। একারণে অনেক দিক থেকেই মর্ডানিস্টদের চাইতে উম্মাহর প্রতি মডারেট হুমকি অধিক বিপদজনক।
তবে মর্ডানিস্ট বলুন কিংবা মডারেট বলুন আধুনিক সময়ের এ ফিরকাগুলো তাত্ত্বিক ও আদর্শিক ভাবে এক ব্যক্তির কাছে কৃতজ্ঞ। কাফিরের সংজ্ঞা, আল ওয়ালা ওয়াল বারা, হুদুদ, ফ্রি-মিক্সিং, সঙ্গীত, হাদীসের মনগড়া ব্যাখ্যা, কোন শার’ই বিধানকে বর্তমান সময়ে অপ্রযোজ্য ঘোষণা করা, ব্যাঙ্কিং, জিহাদ, আক্বিদাসহ ইসলামের যেসব বিষয়ে ক্রুসেডার ও যায়নিস্টদের অ্যালার্জি আছে তার সবগুলোর ক্ষেত্রেই মর্ডানিস্ট ও মডারেট–দু’দলই একজন ব্যক্তিকে কমন রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে।
শাইখ আবু কাতাদা আল ফিলিস্তিনী হাফিযাহুল্লাহ বলেন-
“প্রত্যেক বিচ্যুতির একটি মূল থাকে।” আর আধুনিক সময়ের মর্ডানিস্ট এবং বিশেষ করে মডারেটদের বিচ্যুতির মূল হল এ ব্যক্তি – ইউসুফ আল-কারদাবি।
আল-কারদাবির গোমরাহি ও তার ধ্যানধারণা উম্মাহর জন্য কোন মাত্রা হুমকিস্বরূপ অনুধাবনের জন্য শাইখ আবু আব্দুর রাহমান সুলতান আল-উতাইবির রাহিমাহুল্লাহ এ বক্তব্যই যথেষ্ট-
“আর এরকম কত ব্যক্তিই না আজ আছে যারা সত্যের পরিপন্থী ফতওয়া দিয়েছে, এবং আল্লাহর আদেশের বিপরীতে এসব ফতোয়াকে মান্য করা হয়েছে আর এর মাধ্যমে এসব ফতোয়াবাজদের আল্লাহর পরিবর্তে রব হিসেবে গ্রহন করা হয়েছে? আর বর্তমান সময়ে যাদের এভাবে আল্লাহর পরিবর্তে রব হিসেবে গ্রহন করা হয়েছে তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে তাগুত (মিথ্যা ইলাহ) আল-কারদাবি। এই ব্যক্তি উম্মাহকে পথভ্রষ্ট করেছে এবং তাদের জন্য সবকিছুই হালাল করে দিয়েছে।”
তিউনিশিয়ার রাশিদ ঘান্নুসি থেকে শুরু করে আল ওয়ালা ওয়াল বারার সংজ্ঞা উল্টে দেওয়া জনপ্রিয় পশ্চিমা ‘স্কলার’-দা’ঈ-বক্তা, কিংবা বাংলাদেশে বিভিন্ন কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে ফ্রি-মিক্সিংকে উস্কে দেওয়া, ফিকহের পরিভাষা ব্যবহার করে পাঠক-শ্রোতা বিভ্রান্ত করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, গা বাঁচানো বাছাবাছির আর সুবিধাবাদী এক ইসলামের দাওয়াত দেওয়া বিভিন্ন সেলিব্রিটি দা’ঈরা পর্যন্ত- সকলেই জ্ঞাতসারে বা অজান্তে আল-কারদাবির তৈরি করা আদর্শিক ভিত্তি ও কাঠামোর উপর দাড়িয়েই নিজ নিজ ব্র্যান্ডের গোমরাহির প্রচারনা চালায়।
কারণ দেশে কিংবা বিদেশে যারাই বর্তমানে বিভিন্ন গোমরাহিকে ইসলামের পোষাক পড়িয়ে জায়েজ করতে চাইছে-সেটা গনতন্ত্রকে বৈধতা দেওয়া, জিহাদের ভুল ব্যাখ্যা করা, সঙ্গীতকে জায়েজ বলা, ফ্রি-মিক্সিংকে উৎসাহিত করা, নিকাবের বিরোধিতা করা, দাড়ি কামানোকে জায়েজ বলা, মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য করাকে বৈধতা দেওয়া, যেটাই হোক না কেন–তারা সবাই ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে আল-কারদাবির শেখানো যুক্তিকেই উপস্থাপন করছে।
আর বর্তমানে আমাদের দেশেও এ প্রবণতা আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের আলিম সমাজ ও তালিবাতুল ইলমের মধ্য অধিকাংশই এ এ ব্যক্তির গোমরাহির তীব্রতা এবং এসব ফিরকার অস্তিত্ব ও প্রসারের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা সম্পর্কে পূর্ণ ধারনা রাখেন না। একারণেই বিশেষভাবে আল-কারদাবির বিষাক্ত ধ্যানধারনা সাধারন মুসলিমদের সামনে উপস্থাপন করা এবং সেগুলোর অপনোদন করা বর্তমানে অপরিহার্য হয়ে দাড়িয়েছে।
মূলত এ প্রয়জনীয়তাকেই মাথায় রেখে আমাদের এ প্রচেষ্টা। “ইউসুফ আল-কারদাবি ও তার ধ্যানধারনার পর্যালোচনা” শীর্ষক প্রবন্ধে সংক্ষিপ্ত পরিসরে এ ব্যক্তির গোমরাহির বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। এ প্রবন্ধটি সর্বপ্রথম “নিদা আত-তাওহিদ” নামক কমিউনিটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে বিখ্যাত আত-তিবইয়্যান ফোরাম লেখাটি প্রকাশ করা হয়।
লেখাটির গুরুত্ব ও বর্তমানের আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আমরা লেখাটি অনুবাদের সিদ্ধান্ত নেই। আল্লাহ এ প্রবন্ধের সংকলকদের উত্তম প্রতিদান দান করুন, এবং বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের সামনে এ প্রবন্ধ তুলে দেওয়ার আমাদের এ প্রচেষ্টা কবুল করুন।
আশা করি সচেতন মুসলিম ভাই ও বােনেরা এ আলোচনা থেকে উপকৃত হবেন, আল-কারদাবি এবং তার শিষ্য মর্ডানিস্ট ও মডারেটদের গোমরাহি ও ফিতনা সম্পর্কে সতর্ক হবেন, এবং অন্যান্যদেরকেও সতর্ক করতে সমর্থ হবেন। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ ﷺ, তার পরিবার ও তার সাহাবীদের উপর।
ইউসুফ আল-কারদাবি ও তার চিন্তাধারার পর্যালোচনা
সকল প্রশংসা আল্লাহর, সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক নবী মুহাম্মাদ ﷺ এবং তাঁর সাহাবীদের উপর কিয়ামতের দিন পর্যন্ত,
আম্মা বা‘আদঃ
ভূমিকাঃ
মাঝেমধ্যে আলিমদের মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন বিষয়ে ভুল মত দিয়ে থাকেন। এমন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না, কারণ আমরা জানি আলিমরা ভুলত্রুটির উর্ধে নন। ইসলামের সমগ্র ইতিহাস জুড়েই এমন উদাহরন আছে। আর যখনই এমন হয়েছে তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তী অন্যান্য আলিমগণ তাদের ভুলগুলো চিহ্নিত ও সংশোধন করেছেন।
আর তাই এ ভুলগুলোর ক্ষেত্রে পারস্পরিক সংশোধন ও নসীহতের জন্য আমরা সামষ্টিকভাবে সকল মুসলিম আলিমদের উপর নির্ভর করি। ‘ইলম অন্বেষণকারী ও আল্লাহর দিকে আহবানকারী দা’ইদের কাজের ক্ষেত্রে এটি একটি মৌলিক নীতি।
তাই একজন আলিম কোন লেখা, বক্তব্য কিংবা ফতোয়াতে ভুল করে ফেললে আদব ও সম্মানের সাথে তাকে নসীহত করা ও তার ভুলের সংশোধন করা উচিৎ। যাতে করে কুর’আন, সুন্নাহ ও আলিমগণের ‘ইজমার আলোকে তার ভুল মতকে বিশ্লেষন করার পর তা প্রত্যাহার অথবা সংশোধন করা সম্ভব হয়। মুসলিম আলিমদের ভুলের ব্যাপারে আহলে ‘ইলমের নীতি এটিই।
এই নীতির অনুসরনের মাধ্যমে দ্বীন, এর মৌলিক বিষয়াবলী এবং এর মূলনীতিসমূহ সংরক্ষণ ও অক্ষুন্ন রাখা হয়। এক্ষেত্রে ভুলের ব্যাপারে নসীহত ও সংশোধনের উদ্দেশ্য কোন ব্যক্তিকে অপমান করা, তার সম্মানহানি কিংবা মানুষের চোখে তার মর্যাদাহানি করা না। কারণ একথা জানা যে কোন আলিমই ভুল থেকে মুক্ত না এবং সর্বোত্তম ও সবচেয়ে আন্তরিক আলিমগণও ভুল করতে পারেন।
ইবনু রজব আল-হানবলি রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ “যে ব্যক্তিই রাসূলুল্লাহর কোন নির্দেশের ব্যাপারে জানে বা অবগত হবে, তার জন্য উম্মাহর সামনে তা উপস্থাপন করা, আন্তরিক ভাবে নসীহত করা এবং উম্মাহকে রাসূলুল্লাহর ﷺ নিদের্শ অনুসরণ করতে বলা আবশ্যক। এমনকি যদি তা কোন মহান ব্যক্তির মতের বিরুদ্ধেও যায়।
কারণ উম্মাহর উপর সর্বাধিক কর্তৃত্ব রাসূলুল্লাহর। তাই উম্মাহর কোন মহান আলিমও যদি অজ্ঞাতসারে রাসূলুল্লাহর ﷺ নির্দেশের বিরুদ্ধে মত দিয়ে ফেলেন, সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে তার মতের পরিবর্তে রাসূলুল্লাহর এ নির্দেশ অনুসৃত হবার, সম্মানিত ও অধিক মর্যাদা পাবার দাবি রাখে।
এ কারণে কেউ সহিহ সুন্নাহর বিরুদ্ধে কোন মত দিলে সাহাবীগণ রাঃ, ও তাদের পরবর্তীরা তা খন্ডন করতেন, এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা তা করতেন অত্যন্ত কঠোর ভাষায়।
কোন ব্যক্তির প্রতি বিদ্বেষবশত তারা এমন করতেন না। বরং তারা ঐ ব্যক্তিদের ভালোবাসতেন ও সম্মান করতেন। তথাপি সালাফগন কঠোরতা অবলম্বন করতেন কারণ রাসূলুল্লাহকে ﷺ তারা আরো বেশি ভালোবাসতেন ও সম্মান করতেন। সকল সৃষ্টির মতের উপর রাসূলুল্লাহর ﷺ নিদের্শ অধিকতর কর্তৃত্ব ও মর্যাদাপ্রাপ্ত। তাই রাসূলুল্লাহর ﷺ নির্দেশের সাথে অন্য কারো মতের অমিল হলে অবশ্যই রাসূলুল্লাহর ﷺ নিদের্শ বাস্তবায়িত ও অনুসৃত হবার অধিক উপযুক্ত।
উপরোক্ত কারণে সালাফগণ কোন ব্যক্তির মতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও ব্যক্তির মতের বিরোধিতা, ব্যক্তিকে সম্মান করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়াতো না। কারণ তারা জানতেন তাদের এ ভুলগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। আর রাসূলুল্লাহর ﷺ নির্দেশের বিপরীত হবার কারণে কোন মতের বিরোধিতা করা হচ্ছে, একথা স্পষ্ট হলে, যার মতের বিরোধিতা করা হতো তিনিও একে খারাপভাবে দেখতেন না। [1]
কারণ আলিমরা ভুল করলেও তারা ঐসব বিষয়ে অনুসৃত হবার যোগ্য যেগুলোতে তারা সঠিক। আর ক্ষতি বা সম্মানহানি করার উদ্দেশ্য ক্রমাগত অপর মুসলিমের ভুল খুজে বেড়ানো একজন মুসলিমের জন্য জায়েজ না। সেটা আলিমের ভুল হোক কিংবা সাধারন মুসলিমের ভুল হোক। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
“ হে ঐ লোকেরা যারা মুখে বিশ্বাস করো, অন্তরে করো না-মুসলিমের দোষ খুজে বেড়িয়ে না আর তার ক্ষতি করো না। কারণ যে মুসলিমের দোষ খুঁজতে শুরু করে আল্লাহ তার দোষ খুঁজতে শুরু করবেন।
আর আল্লাহ যে ব্যক্তির দোষ খুজবেন, তার দোষ প্রকাশিত হবে যদিও সে নিজ বাড়ির গোপনীয়তায় তা করে থাকে।”( [2])
তবে সব ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একইরকম না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছু ব্যক্তি আলিম খেতাব পায়, আলিম হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু ইসলামের ব্যাপারে তাদের চিন্তায় এমন মৌলিক ও সাংঘাতিক গলদ থাকে যে তারা অনুসারীদের জন্য গোমরাহির উৎসে পরিণত হয় এবং সাধারন মুসলিম জনগণের দ্বীনের বুঝের ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
এধরনের ব্যক্তি ও তাদের নবউদ্ভাবিত ভিত্তিহীন ধ্যানধারণা ও আদর্শের ব্যাপারে মুসলিমদের সতর্ক করা, এগুলোর বাস্তবতা মানুষের সামনে তুলে ধরা ও ভুলের খন্ডন করা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষ করে বারবার নসীহত, সংশোধন ও সতর্ক করার পরও যখন এধরনের লোকেরা তাদের বাতিল ধ্যানধারনার উপর অটল থাকে এবং এগুলো প্রচার করতে থাকে, তখন তাদের ব্যাপারে সাধারন মুসলিমদের সতর্ক করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আর তা কোন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ কিংবা শত্রুতার কারণে না, বরং মুসলিম জনগণের উপর তাদের গোমরাহির প্রভাব দূর করার মাধ্যমে উম্মাহকে রক্ষার জন্যে।
ইবনু রযব আল-হানবলি রাহিমাহুল্লাহ বলেন-“আর আহলুল বিদ’আহ ও গোমরাহিতে লিপ্ত লোকেরা যারা আলিমগণের অনুকরন করে কিন্তু আদতে আহলে ইলমের অন্তর্ভুক্ত না–তাদের অনুসরণ করা থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্য ভুল তুলে ধরা ও সতর্ক করা জায়েজ।” ([3])
আশ-শাতিবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন- “এজাতীয় লোকেরা যখন তাদের গোমরাহির দিকে মানুষকে আহবান করা শুরু করে আর ইলমহীন সাধারন মানুষের সামনে গোমরাহিকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে উপস্থাপন করে, তখন এরা মুসলিমদের এরূপক্ষতির কারণে পরিণত হয়, যেমন ক্ষতি ইবলিস করে থাকে। আর এরা হল মানুষের অন্তর্ভুক্ত শায়াত্বিন। নিঃসন্দেহে এধরনের লোকের প্রকৃত রূপ মানুষের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন। আর এদের প্রকৃত পরিচয় হল এরা বিদ’আহ ও গোমরাহির দিকে আহবানকারী। এই কথা ঐসকল লোকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যারা এধরনের লোকের আদর্শের সাথে নিজেদের সংযুক্ত করে এবং স্পষ্টতই তাদের অন্তর্ভুক্ত।
এব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে এধরনের লোকেদের মুখোশ উন্মোচন করা এবং তাদের বিতাড়িত করা অপরিহার্য, যাতে করে তাদের থেকে উৎসারিত অনিষ্ট মুসলিমদের প্রতি ফিরে না আসে। [4]
অতঃএব, আহলুস সুন্নাহর অবস্থান হল আলিমগণের ভুলের ব্যাপারে দুই চরমপন্থাকে এড়িয়ে চলা। প্রতিটি ভুলকে আলিমদের আক্রমন করা ও তাদের ব্যাপারে মন্দ বলার অজুহাতে পরিণত করার মতো কঠোর ও কর্কশ মনোভাবাপন্ন না হওয়া।
আবার এতো বেশি উদারপন্থী না হওয়া যে কথিত ‘আলিমরা’ নুসুসের সাথে সাংঘর্ষিক যা ইচ্ছে তাই বলবে আর তা ভুল হিসেবে চিহ্নিত করা হবে না, খন্ডন করা হবে না, তাদের ব্যাপারে মুসলিমদের সতর্ক করা হবে না, বরং বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেওয়া হবে।
ইউসুফ আল-কারদাবি, তার চিন্তাধারা এবং এর অপনোদন
ইউসুফ আল-কারদাবি ১৯২৬ সালে পশ্চিম মিশরে জন্মগ্রহণ করে, এবং আল-আযহার বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে উসূল আদ-দ্বীন বিভাগ থেকে ১৯৫৩ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে।
১৯৬১ সালে আল-কারদাবি কাতারে চলে যায়, এবং বর্তমানে কাতারের শাসক গোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক উপভোগ করছে।[5]
কাতারের শাসকগোষ্ঠী ও ইউসুফ আল-কারদাবির মধ্যে সম্পর্ক, সমর্থন ও সহযোগিতা পারস্পরিক। আল-কারদাবি কাতার কেন্দ্রিক ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ ইসলামিক স্কলার নামক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান।
তার অফিশিয়াল টাইটেল হল, “গ্রান্ড ইসলামিক স্কলার এন্ড চেয়ারম্যান অব সুন্নাহ এন্ড সীরাহ কাউন্সিল”, যেটা কাতারী প্রশাসনের অধীনস্ত। এর সাথে সাথে সে দীর্ঘদিন ইউনিভার্সটি অব কাতারের ইসলামিক স্ট্যাডিস ডিপার্টমেন্টপর ভীনের দায়িত্বও পালন করেছে।
ইউসুফ আল-কারদাবি (আল্লাহ তাকে হিদায়াতে পথে ফিরিয়ে আনুক) আধুনিক যুগের বিদাতী এবং গোমরাহ “আলিমদের মধ্যে একজন আইকনে পরিণত হয়েছে। এই পুস্তিকার ভূমিকাতে যে দুধরনের ভুলের কথা আলোচিত হয়েছে আল – কারদাবির ভ্রান্তি তার দ্বিতীয়টির অন্তর্ভুক্ত। তার গোমরাহি ও বিদ’আতি ধারনাসমূহ দ্বীন ইসলাম ও উসুল আদ – দ্বীনের ব্যাপারে জানতে আগ্রহী সাধারন মুসলিমদের জন্য হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
আল – কারদাবি আধুনিক সময়ের বিদা’আতিদের এমন একটি বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, সমসাময়িক তালিবুল ইলম এবং উলামাগণ যাদের কমবেশি প্রত্যাখ্যান এবং সমালোচনা করেছেন।
‘ইলমের বিভিন্ন শাখার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তালিবাতুল ইলম ও আলিম আল – কারদাবি, তার লেখা অথবা টিভি বক্তব্যগুলোর খন্ডন করেছেন।
তাফসির, হাদিস, সীরাহ, আক্বীদাহ, এমনকি ফিকহের উলামা ও তালিবুল ইলমগণ, আরব ও অনারব, আল – কারদাবির খন্ডন করেছেন।
ইউসুফ আল – কারদাবির গোমরাহী খন্ডন করে লিখিত কিছু সুপরিচিত রচনাঃ – •
“ইসকাত কাল্লু আল – আওই” (ঘেউঘেউ করতে থাকা কুকুরের নিশ্চুপকরন)-শাইখ মুকলি ইবন হাদি আল-ওয়াদী রাহিমাহুল্লাহ
- “খুলাসাত বাদ্ধ আফকার আল-কারদ্বাউইয়ি” (কারদাবির বিভিন্ন ধারণার সারাংশ)-শাইখ নাসির বিন হামাদ আল-ফাহাদ, ফাকাল্লাহু আাসরাহ
- “আল – ই’লাম বি নাক্কদ কিতাব; আল-হালাল ওয়াল-হারাম” (“হালাল এবং হারাম” বইটির খন্ডন)-শাইখ সালিহ আল-ফাওযান।
- “আল-হাক্ক আদ-দামিগ্ব লিদ-দাওয়াহ ফী দাহ মাযা’ঈম আল-কারদাবি” (কারদাবির খন্ডন সম্পর্কে উত্থাপিত অভিযােগের ব্যাপারে অকাট্য সত্য)-আব্দুল করিম বিন সালিহ আল-হুমাইদ
- “সাক্বিয়াতুন লাতামাত বাহরান” (যে খাল সাগরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছে)-শাইখ আব্দুল আযীয বিন সালিহ আল-জারবু
- “মাওয়াক্বিফ আল-কারদাবি মিনান-নাসারাহ (খ্রিষ্টানদের ব্যাপারে কারদাবির অবস্থান)-মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আল-যায়ী
- “রুদ্দ ওয়া মানাক্বাশাত হাউল তাওয়ালি আল – মার’ল্লাহ লিল – উইলায়াত আল-আমমাহ” (নারী নেতৃত্বের খন্ডন ও এ ব্যাপারে যুক্তি সমূহ)-শাইখ আব্দুর রহমান ই আব্দুল-খালি
- “আল-মাওয়াক্বিফ আশ-শারঈ মিনাল-কারদাবি” (কারদাবির ব্যাপারে শরীয়াহর অবস্থান)-শাইখ আবু বাসির মুস্তাফা হালিমাহ আত-তারতুসী
- আফগানিস্তানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সামরিক হামলায় মুসলিমদের অংশগ্রহণের বৈধতা দেওয়া ফতোয়ার রদ্দ
শাইখ সালাহ আস-সাউই
- “আর-রদ্দ আলা ফাতওয়া আদ-দুক্তুর ইউসুফ আল – কারদাবি ফি রাতহা বাব আল – ফাতিকান” (ড. ইউসুফ আল – কারদাবির ভ্যাটিকানের পোপের প্রতি সমবেদনা জানানো ফতোয়ার রদ্দ ) -শাইখ আবু ইশা আল – হুওয়ায়নি
আলোচনা অত্যাধিক দীর্ঘায়িত হবার আশঙ্কা না থাকলে দশটির জায়গায় আরো অনেক নাম আমরা এখানে উল্লেখ করতাম।
আল-কারদাবি বিভিন্ন তথাকথিত “মর্ডানিস্ট মুসলিম” এবং “মডারেট মুসলিম” দলগুলোর টেমপ্লেটে পরিণত হয়েছে; যারা সবসময় কাফিরদের সন্তুষ্টি ও অনুমোদন অর্জনে উদগ্রীব থাকে। এ ধরনের দলগুলো ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীর নতুন নতুন ব্যাখ্যা ও কাফিরদের নির্ধারিত মাপকাঠি অনুযায়ী শারীয়াহ সংস্কার করার জন্যে মুখিয়ে থাকে।
তাই এতে অবাক হবার কিছু নেই যে এধরনের বেশিরভাগ সংগঠন, সংস্থা ও প্রকাশনাগুলো কারদাবির লেখা এবং বক্তব্য নিয়মিত প্রচার ও প্রকাশ করে থাকে। এরা একে অপরের দ্বারা উপকৃত হয়।
এসব সংগঠন, সংস্থা ও প্রকাশনাগুলো উপকৃত হয় আল-কারদাবির জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করার মাধ্যমে। আল-কারদাবি উপকৃত হয় কারণ এরা তার ধ্যান-ধারনা ও আদর্শের প্রচারনা চালিয়ে যায়।
আল-কারদাবির রচনা ও বিভিন্ন উক্তি বিশ্লেষণ করলেই এসব ব্যাপারে তার চিন্তাধারা এবং প্রবনতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে আল-কারদাবি যেসব ব্যাপারে গোমরাহিতে নিমজ্জিত হয়েছে সেগুলো ছোটখাট কোন ফুরুয়ী বিষয় না যেখানে আলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকা বৈধ। বরং সে দ্বীনের ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এমন বেশ কয়েকটি বিষয়ে গোমরাহ হয়েছে যেগুলোর ব্যাপারে অতীত ও বর্তমানের আলিমগণ একমত।
কারদাবির কিছু উক্তি
“আশ-শারিয়াহ ওয়াল-হায়াত” (শরীয়াহ ও জীবন)-নামক অনুষ্ঠানের১২/১০/৯৭ -তে প্রচারিত পর্বে “শরীয়াহর আলোকে অমুসলিমেরা” শীর্ষক লেকচারে আল-কারদাবি বলে-
“একই ভূমির সন্তান হিসেবে আমরা (অর্থাৎ মিসরের মুসলিম ও খ্রিস্টানরা) সকল বিষয়ে একে অপরের অংশীদার। আমাদের গন্তব্য এক, আমাদের উম্মাহ এক। আমি তাদের আমাদের খ্রিষ্টান ভাই “বলার কারণে অনেকে আপত্তি করেন। তারা প্রশ্ন করেন আমরা কীভাবে তাদেরকে “আমাদের খ্রিষ্টান ভাই” সম্বােধন করতে পারি?
(আল্লাহ বলেছেন),
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
“নিশ্চয়ই মু‘মিনরা তো পরস্পর ভাই” (হুজুরাত: ১০)
হ্যাঁ আমরা মু‘মিন এবং তারাও আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে মু‘মিন।” ([6])
একই অনুষ্ঠানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার এই আয়াত সম্পর্কে সে বলে –
لَتَجِدَنَّ اَشَدَّ النَّاسِ عَدَاوَۃً لِّلَّذِیۡنَ اٰمَنُوا الۡیَہُوۡدَ وَ الَّذِیۡنَ اَشۡرَکُوۡا ۚ
“সবার চেয়ে আপনি ইহুদী এবং মুশরিকদের মু‘মিনদের প্রতি অধিক শত্রুতা করতে দেখবেন… (মায়িদা: ৮২)
“এই আয়াত কেবলমাত্র নবীজী এর সময় ও প্রেক্ষাপটের জন্য প্রযোজ্য, এটি বর্তমান সময় ও প্রেক্ষাপটের জন্য প্রযোজ্য নয়।”([7] )
আর তারপর বর্তমান সময়ের খ্রিষ্টানদের সাথে অন্তরঙ্গতা ও তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহন করার জন্য সে এই একই আয়াতের বাকি অংশ ব্যবহার করে। এমনকি কাফিরদের ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলোতে তাদের শুভেচ্ছা জানানোকেও সে বৈধ ঘোষণা করে। ([8])
তার বক্তব্য এবং বইগুলো এ ধরনের কথাবার্তায় ভর্তি। যেমন তার বই “আল-ফাতওয়া আল মু’আশারাহ”, “আল-খাসা’ইস আল-আমমাহ লি’ল-ইসলাম” এবং “মালামিহ আল-মুযতা’মা’ আল-মুসলিম”। একইভাবে তার দাওয়াহ বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলোও এধরনের ধ্যান-ধারনা দিয়ে ভর্তি আর এসব অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে সে এগুলো প্রচার করে যায়। সেই একই “আশ-শারিয়াহ ওয়াল-হায়াত” (শরীয়াহ ও জীবন) অনুষ্ঠানে সে বলে, “…কপটিকরা (মিশরীয় খ্রিষ্টান) হাজার হাজার শহীদ উৎসর্গ করেছে…।” সে আরো বলেছে, “ইহুদীদের সাথে আমাদের শত্রুতা কেবল ভূমিকে কেন্দ্র করে, দ্বীনকে কেন্দ্র করে নয়…” (“আল-উম্মাহ আল ইসলামিয়াহ হাক্বিকাহ লা ওয়াহম”, পৃষ্ঠা: ৭০)। এ একই কথা সে তার “আস-সিরা” বায়ান আল মুসলিমিন ওয়াল-ইয়াহুদ” নামক টিভি অনুষ্ঠানেও বলেছে।
বস্তুত, আল-কারদাবি অনেক জায়গাতেই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে মুসলিম এবং কাফিরদের মধ্যে বৈরীতা দ্বীনকে কেন্দ্র করে না, বরং সম্পদ-ভূমি ইত্যাদি ছোটখাট বিষয়কে নিয়ে। যেমন সে বলেছে, “আমরা আকীদার কারণে না, বরং আমাদের ভূমির জন্য ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে লড়ছি। আমরা কাফির বিরুদ্ধে তারা কুফর করার কারণে যুদ্ধ করি না। বরং আমাদের ভূমি ও বাসস্থান অন্যায়ভাবে দখল করে নেওয়ার কারণে সেগুলোর পুনর্দখলের জন্য আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি।” (“আর-রায়াত” ম্যাগাজিন, #৪৬৯৬, ২৪ শে শাবান, ১৯৯৫) ([9])
সে অনেক জায়গায় দাবি করেছে যে ইসলাম “ … পূর্ববর্তী নাযিলকৃত ধর্মগুলোকে সম্মান করে (অর্থাৎ ইয়াহুদি ও নাসরানি/খ্রিস্টান ধর্ম)… ” (তার “আশ-শারিয়াহ ওয়াল-হায়াত” নামক অনুষ্ঠানের ২৪/১/১৯৯৯ এ প্রচারিত “দ্বীন উল-বাশাইর ওয়াল-মুবাশিরাত” নামক অংশ)।
সে আরো বলেছে এসব ধর্মগুলোর অনুসারীরা মুসলিমদের মতোই, যা কিছু মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য তা তাদের জন্যও প্রযোজ্য, যা কিছু মুসলিমদের উপর তা তাদেরও উপর। (“আল ইসলাম ওয়াল-ইলমানিয়াহ”, পৃষ্ঠা: ১০১)
পোপ দ্বিতীয় জন পলের মৃত্যুর পর আল-কারদাবি তার টেলিভিশন প্রোগ্রাম “আস শরিয়াহ ওয়াল-হায়াত”-এ শোক প্রকাশ করে, পাপের প্রশংসা করে, এমনকি আল্লাহর কাছে দুয়া করে যেন আল্লাহ পাপকে ক্ষমা করে দেন এবং পুরস্কৃত করেন! অভিশপ্ত ক্রুশের পূজারীদের নেতার ব্যাপারে তার কথাগুলো কতটা জঘন্য দেখুন:
“তিনি ছিলেন শান্তিকামী এবং শান্তির দিকে আহ্বানকারী। তিনি ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, ফিলিস্তিনে (ইহুদিদের) বানানো দেয়ালের বিরোধিতা করেছিলেন এবং একাজের জন্য ইহুদিদের নিন্দা করেছিলেন, এবং এরকম আরো অনেক ভূমিকা তিনি নিয়েছিলেন যা প্রশংসার দাবী রাখে… (সুতরাং) আমরা আল্লাহর তা‘আলার এ দুআর কম ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না, যেন তিনি তার (পপাপের) প্রতি রহম করেন এবং তাকে পুরস্কৃত করেন, মানবতার কল্যাণ জন্য এবং সত্যের পথে তিনি যেসব ভালো কাজ করেছেন ও রেখে গিয়েছেন সেগুলো অনুযায়ী। এবং আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি বিশ্বের সকল খ্রিষ্টানদের প্রতি, রোম এবং রোমের টিয়োদোরো সংস্থায় আমাদের বন্ধুদের প্রতি। এবং আমরা আশা করি আল্লাহ খ্রিষ্টান জাতিকে তার জায়গায় উত্তম কাউকে দান করবেন।” ([10])
আল্লাহর কসম, কোন মুসলিম আলিম কিংবা ইসলামী সংগঠনের নেতার মৃত্যুর পর আমরা আল কারদাবির মুখ থেকে এমন সমবেদনা বাক্য ও প্রশংসা শুনি নি। তবে নিচের আয়াতটি নিয়ে চিন্তা করলে বুঝা যায় এ অস্বাভাবিক কিছু না
–وَ مَنۡ یَّتَوَلَّہُمۡ مِّنۡکُمۡ فَاِنَّہٗ مِنۡہُمۡ ﴿۵۱﴾
“এবং তোমাদের মধ্যে যারাই তাদের আউলিয়া (অভিভাবক, মিত্র) হিসেবে গ্রহণ করবে, নিশ্চয়ই তারা তাদের মধ্যেই গণ্য হবে।” (মায়িদা: ৫১)
কাফিরদের প্রতি আল-কারদাবির এধরণের ভালবাসা এবং অনুরক্তি বিশেষ করে তখন থেকে লক্ষণীয় যখন সে আফগানে বুদ্ধ মূর্তির ধ্বংস ঠেকাতে ফতোয়া দেয় এবং নিজে নেতৃত্ব দিয়ে আফগানিস্তানে ‘আলিম’দের এক প্রতিনিধি দল নিয়ে যায়। ([11]) এই ফতোয়াতে দাবি করা হয় বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তিগুলো হল গুরুত্বপূর্ণ “ঐতিহাসিক স্থাপনা”, তাই সেগুলো ধ্বংস করা উচিত না। বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, এ বিশেষ প্রতিনিধিদল ও ফতোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত গঠন ও প্রকাশ করা হয় নি, যতক্ষণ না এ মূর্তিগুলো ভাঙার ব্যাপারে কাফিরেরা এবং সেকুলার প্রশাসনগুলো অসন্তোষ প্রকাশ এবং হৈচৈ শুরু করে।
(দেখুন: https://www.islam-online.net/English/News/2001-03/10/articles.shtml )
পরবর্তিতে, একটি ‘ফতোয়া’ প্রকাশ হয় , যেখানে বলা হয় অ্যামেরিকান মুসলিমদের মধ্যে যারা অ্যামেরিকান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে তাদের জন্য আফগানিস্তানে চালানো অ্যামেরিকান সামরিক অভিযানে অংশগ্রহন করা বৈধ । এই তথাকথিত ফতোয়ায় স্বাক্ষরকারী ‘আলিমদের’ মধ্যে ইউসুফ আল-কারদাবির স্বাক্ষরটি ছিল সবার প্রথমে। অ্যামেরিকান সেনাবাহিনীর হয়ে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানে অংশগ্রহন কেন জায়েজ হবে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আল কারদাবি বলে–
“পরিশেষে বলা যায়, অ্যামেরিকার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর কারণে অ্যামেরিকা যে দেশের বিরুদ্ধেই সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিক না কেন, অ্যামেরিকান সামরিক বাহিনীতে চাকরিরত মুসলিমদের জন্য আসন্ন সে যুদ্ধে অংশগ্রহন করা জায়েজ, ইন শা আল্লাহ-যদি তারা তাদের অন্তরে সঠিক নিয়্যাত রাখে, যার ব্যাপারে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। (আর অ্যামেরিকান মুসলিমদের জন্য এরূপ করা বৈধ হবে) যাতে অ্যামেরিকার প্রতি তাদের আনুগত্যের ব্যাপারে কোন সন্দেহ না থাকে অথবা তাদের (অ্যামেরিকান মুসলিমদের) যেন ক্ষতি হয়, বর্তমান অবস্থায় যার আশঙ্কা আছে। এই অবস্থান ইসলামি ফিকহের এ মূলনীতি আলেকেই যে, প্রয়োজনের কারণে হুকুমের ব্যতিক্রম হয়, এবং এই মূলনীতির আলোকেও যে বড় ক্ষতি এড়াতে ছোট ক্ষতি মেনে নেয়া যাবে।”
[১০ রজব, ১৪২২ হিজরী, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০১ এ প্রকাশিত ফতোয়া। সুন্নাহ এন্ড সীরাহ কাউন্সিল, কাতার -এর গ্র্যান্ড ইসলামিক স্কলার এন্ড চেয়ারম্যান ইউসুফ আল-কারদাবি কর্তৃক স্বাক্ষরিত] ([12])
অনেক আলিমের চোখেই আল-কারদাবির এই ফতোয়া ছিল সীমালঙ্ঘনের এমন এক চূড়ান্ত পর্যায় যেটার পর তার উপর তাকফিরকে (কাফির ঘোষণা করা) আর প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না। কারণ এ ‘ফতোয়ার মাধ্যমে আল- কারদাবি একটি মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে একটি কাফির দেশকে (অ্যামেরিকা) মিত্র হিসেবে গ্রহন করে, সে দেশের সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহন করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যাওয়াকে হালাল ঘোষণা করেছে।
যেমন, শাইখ আবু কাতাদা ‘উমার ইবন মাহমুদ আবু উমার হাফিযাহুল্লাহ স্পষ্টতই আল কারদাবিকে উদ্দেশ্য করে একটি রেকর্ডকৃত অডিও সাক্ষাৎকারে বলেন, “মূলনীতি হল, কাফিরদের সাহায্য করা যাবে না। এরপর যদি কিছু আহলুল ইলম এক কাফিরের বিরুদ্ধে অপর কাফিরকে সাহায্য করাকে এজন্য বৈধ বলেন যে এর ফলে মুসলিমদের উপকৃত হবার সম্ভাবনা আছে, সেক্ষেত্রে সেটাও ফিকহী ভাবে গ্রহনযোগ্য, কারণ এক্ষেত্রে মূলনীতির লঙ্ঘন হচ্ছে না। কিন্তু যদি বলা হয়, যেমন বর্তমানের কিছু গোমরাহ ব্যক্তিরা বলছে যে-মুসলিমদের বিরুদ্ধে। কাফিরদের সাহায্য করাও জায়েজ, তবে সেটা কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য না। বরং যে এরকম বলে, যেমন তালিবানের বিরুদ্ধে অ্যামেরিকাকে সহযোগিতা করাকে বৈধতা দেয়, সে তার এ ফতোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে কুফর করেছে!”
শাইখ আবু বাসির মুস্তাফা হালিমাহ আত-তারতুসী বলেন, “এ ব্যাপারটি এবং এর সাথে সাথে আরো কিছু ব্যাপারের কারণে, আমরা বলি যে আল্লাহ যেসব জিনিস হালাল এবং হারাম করেছেন, সে (আল-কারদাবি) সেগুলো পরিবর্তন ও প্রতিস্থাপন করেছে, এবং সুস্পষ্ট কুফরে আপতিত হয়েছে। আর সে যদি প্রকাশ্যে তাওবাহ না করে, তার এসব কুফরী অবস্থান থেকে ফিরে না আসে এবং সকলকে ফিরে আসার আহবান না করে, তাহলে তার উপর তাকফিরের ক্ষেত্রে আমরা আর কোন প্রতিবন্ধকতা খুঁজে পাই না। এবং আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত। (“আল-মাওয়াকিফ আশ-শারঈ মিন আল-কারদাবি”, পৃষ্ঠা: ৪)
শাইখ সালাহ আস-সাওয়ী আল-কারদাবির এই ফতোয়া রদ্দ (অপনোদন) করেন। সেখানে তিনি বলেন,
“(এ ফতোয়া দেওয়া হল) এমন এক যে দেশে অবস্থিত মুসলিমদের জন্য যেখানকার সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, এবং নিজ বিশ্বাস ও আদর্শের সাথে সাঘর্ষিক হলে কোন সেনাকে যুদ্ধ থেকে বিরত থেকে বিরত থাকার স্বাধীনতা দেয়?! কোন চাকরি-হোক সেটা সামরিক কিংবা বেসামরিক-কি ইসলামের মাপকাঠিতে মুসলিমদের রক্তের চাইতে অধিক ওজনদার হতে পারে? অ্যামেরিকার নাগরিকত্ব কি মুসলিমদের রক্তের চেয়েও বেশি দামি? মুসলিম রক্তের চাইতেও বেশি পবিত্র? আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন! আরও বিস্ময়কর হল, এই ফতোয়াতে যুক্তি দেখানো হয়েছে- ‘এ ধরনের সামরিক অভিযানে অংশগ্রহন করা বৈধ হবে যদি ব্যক্তি যে দেশের নাগরিক সে দেশের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখার নিয়্যাতে তা করে!’ এটা তো ওয়ালা এবং বারআ-র (মৈত্রীতা এবং শত্রুতা) এক নতুন ধরনের মূলনীতি। আমরা এধরনের মুফতি আর এধরনের ফতোয়া ছাড়া আর কোথাও এরকম কথা আর শুনি নি। (পৃষ্ঠা: ১৮)
এছাড়া আছে কাফির এবং তাদের জাতিরাষ্ট্রের আদর্শের প্রতি কারদাবির অনুরক্তি। সে পশ্চিমাদের নানা প্রতিষ্ঠান ও শাসন ব্যবস্থার; বিশেষ করে গণতন্ত্রের প্রশংসায় সবর্দা পঞ্চমুখ থাকে।
ইউসুফ আল-কারদাবির একটি জুম্মার খুতবার ব্যাপারে শাইখ মুবিল ইবন হাদি আল-ওয়াদি রাহিমাহুল্লাহ মন্তব্য করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জিতে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হবার পর আল-কারদাবি এ বক্তব্যটি দিয়েছিল। তার খুতবাটি রেকর্ড করা হয়েছিল। এ খুতবায় কারদাবি বলেছিল-
“এ অবস্থান (মিম্বার) ত্যাগ করার আগে আমি ইস্রাইলের নির্বাচনের ফলাফলের ব্যাপারে কিছু বলতে চাই । সকল আরবরা আশা করছিল নির্বাচনে বার্লিন (উক্ত নির্বাচনে নেতানিয়াহুর প্রতিদ্বন্দ্বী) বিজয়ী হবে। কিন্তু সে পরাজিত হল। আর (আমি) ইস্রাইলের এ বিষয়টির প্রশংসা করি। আমরা চাই এবং আশা করি এ ব্যাপারে আমাদের দেশগুলোও যেন ইস্রাইলের মতো হতে পারে। স্বল্প সংখ্যক কিছু লোকের কারণে এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রার্থী পরাজিত হয়েছে। আমাদের দেশের মতো ৯৪% বা ৯৫% না, বরং ৯৯% ভোট! স্বয়ং আল্লাহ জনগনের সামনে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করলে এ পরিমাণ ভোট পেতেন না… ইস্রাইল যা অর্জন করেছে তার জন্য আমরা অভিনন্দন জানাই।”
জুমুআর খুতবায় মুসল্লিদের সামনে, তার বক্তব্য রেকর্ড করা হচ্ছে তা জেনেও নিঃসংকোচে, বিন্দুমাত্র লজ্জা ছাড়া কারদাবি একথা বলেছিল। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মানুষের খেয়ালখুশি অনুযায়ী হারামকে হালাল আর হারামকে হালাল করে-তার প্রশংসা করে সে ক্ষান্ত হয় নি। বরং সে নির্বাচনে জেতা এক ইহুদি প্রার্থীর সাথে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার তুলনা পর্যন্ত করলো, এবং বললো যদি আল্লাহ আর রাহমানুর রাহীম নির্বাচনে প্রার্থী হতেন তবুও এ ইহুদি প্রার্থী, আর-রাহমানের চেয়ে অধিক ভোট পেয়ে বিজয়ী হতো। এরকম অসম্মানজনক, মূখতাপূর্ণ তুলনা থেকে আমর আশ্রয় চাই।
আল-কারদাবির এ বক্তব্যের ব্যাপারে শাইখ মুকবিল বলেনঃ “আজ ভাই সালিহ আল বাকরি আমাকে জানিয়েছেন, তিনি ক্যাসেটে (কারদাবির) কিছু কথা শুনেছেন। যেখানে আল কারদাবি বলেছে যে এই ইহুদী (ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়হু) ৯৯ % ভোট পেয়ে জিতেছে । যদি আল্লাহও নির্বাচনে প্রার্থী হতেন তাহলে তিনি এতো ভোট পেতে, ৯৯ % ভোট পেতে সক্ষম হতেন না। একথাগুলো স্পষ্ট ও প্রকাশ্য গোমরাহি ছাড়া আর কিছুই না। যদি সে এ বক্তব্যের মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা, যিনি সকল ত্রুটি থেকে মুক্ত, তাঁর তুলনায় একজন ইহুদিকে উত্তম সাব্যস্ত করতে চেয়ে থাকে, তবে সে একজন কাফির (মুরতাদ)। আর যদি তার কথার অর্থ এই হয় যে ইহুদি, খ্রিষ্টান, গরুপূজারী, মুরগীপূজারী এবং অন্যান্যরা সংখ্যায় অনেক, কিন্তু তারা কেউ আল্লাহর জন্য ভোট দেয় না-তবে সেটা ভিন্ন কথা। তবে সেক্ষেত্রেও এটি (আল-কারদাবির) স্পষ্ট গোমরাহী ছাড়া কিছুই নয়।”
“কারণ নিশ্চয় আমাদের রব আল্লাহ আযযা ওয়া জাল-এর কোন ভোটের প্রয়োজন নেই। তিনি সকলপ্রকার দূর্বলতা ও ত্রুটি থেকে মুক্ত। যিনি বলেন ‘হও’, এবং হয়ে যায়। যিনি ধ্বংস করেছেন ফিরাউনকে, কারুনকে; এবং এমন অনেক জাতিকে যারা কিনা সীমালঙ্ঘন করেছিল, এবং আল্লাহ আযযা ওয়া জাল-এর নবীদের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছিল। অতঃপর তিনি তার নবীদের সাহায্য করেছেন, এবং তাদের দুনিয়া আর আখিরাতে বিজয়ী করেছেন।”
“আরে মিসকিন! ভোট তো শুধু দূর্বল মানুষের প্রয়োজন। তুমি কি কুফরী করলে ও কারদাবি! নাকি তুমি নিজেকে এর নিকটবর্তী করলে?” (“ইসকাত কাল্ব আল-আওই”, পৃষ্ঠা: ১১০-১১২)
যখন কারদাবির এসব কথার রেকর্ডিং শাইখ ইবন উসাইমিনকে রাহিমাহুল্লাহ শোনানো হল, তিনি বললেনঃ “আউযুবিল্লাহ! এই ব্যক্তির জন্য তাওবাহ করা (অর্থাৎ তাওবাহ করে ইসলামে ফেরত আসা) ওয়াজিব। আর যদি সে তাওবাহ না করে তাহলে তাকে মুরতাদ হিসেবে হত্যা করা উচিৎ, কারণ সে সৃষ্টিকে স্রষ্টার চেয়ে বেশি জ্ঞানী সাব্যস্ত করেছে। তার জন্য তাওবাহ করা আবশ্যক। যদি সে তাওবাহ করে তবে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের গুনাহর ব্যাপারে ক্ষমাশীল। আর যদি সে তাওবাহ না করে, তবে এই ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের (শাসকদের) জন্য আবশ্যকে তার গদানে আঘাত করা (অর্থাৎ তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা) হবে। (শাইখ ইবন উসাইমিনের ক্যাসেট রেকর্ডিং যা “ইসকাত কাল্ব আল-আওই” গ্রন্থের ১১৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত হয়েছে।)
মানবরচিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ব্যাপারে কারদাবির নিয়ত প্রশংসার ব্যাপারে, শাইখ আবু বাসির মুস্তাফা হালিমাহ আত-তারতুসী বলেন, “সে আদর্শিকভাবে শিরকি গনতন্ত্রের দিকে আহবান করে, এর প্রচার করে এবং মুরতাদ ধর্মনিরপেক্ষ (সেকুলার) দলগুলোকে স্বাধীনতা দেওয়া এবং যদি অধিকাংশ জনগণ তাদের ভোট দেয় তাহলে মুসলিমদের ভূখন্ডের উপর তাদের কর্তৃত্ব দেবার কথা বলে..” (“আল-মাওয়াকিফ আশ-শারঈ মিন আল-কারদাবি” পৃষ্ঠা: ২)
এসব বিদা’তী, গোমরাহ ও কুফরী বক্তব্যের সাথে আরো আছে সঙ্গীত (বিশেষ করে নারী গায়িকা), মনোরঞ্জন ও হাসিতামাশার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রতি আল-কারদাবির বিশেষ ও নিঃসংকোচ অনুরক্তি। কারদাবি তার বিভিন্ন বইতে গান-বাজনা এবং সিনেমাকে হালাল বলেছে, এবং ‘ভালো জিনিস’ বলেছে। তার বিভিন্ন বইতে এ ধরনের কথা এসেছে, যেমন “আল-হালাল ওয়াল-হারাম”, “আল-মারজা’আহ আল-উলইয়া ফি’ল-ইসলাম”, “আল-ফাতওয়া আল মু’আশারাহ”। তার এগুলোর প্রায় সবগুলোরই শর’ঈ খন্ডন করা হয়েছে।
সিনেমাকে হালাল হওয়া সম্পর্কে তারা ফতোয়া আছে “আল-হালাল ওয়াল-হারাম” কিতাবে। সিনেমাকে হালাল বলার পাশপাশি এ কিতাবে সে এও বলেছে যে সে নিজে ফাইযা আহমাদ, শাদিয়াহ, উম্মে কুলসুম, ফাইরু এবং অন্যান্য নারীদের গান পছন্দ করেন। (“আর রায়াহ” নামক কাতারী ম্যাগাজিন থেকে, নং ৫৯৬৯, ১৯ জুমাদিউল-উলা, ১৪১৯ হিজরী)
পরিশেষে আমরা বলতে চাই, আমরা এ রচনায় চেষ্টা করেছি আল-কারদাবির ধ্যানধারণা ও গোমরাহির সামান্য কিছু অংশ তুলে ধরার এবং দ্বীনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার পথভ্রষ্টতাকে তুলে ধরার। যদি আমরা বিস্তারিত আলোচনায় যেতাম, এবং অর্থনৈতিক লেনদেন, ওয়াসিয়াত, নারী ও পুরুষের মেলামেশা, রাজনীতিসহ অন্যান্য বিষয়ে তার হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করার ব্যাপারে আলোচনা করতাম, এবং তা খন্ডন করতাম তাহলে এ রচনা হয়তো শেষই হতো না।
শাইখ আবু আব্দুর রহমান সুলতান আল-উতাইবীর রাহিমাহুল্লাহ নিম্নোক্ত বক্তব্যে আল কারদাবির অবস্থান ও ভ্রষ্টতার বাস্তবতা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ও অল্পকথায় ফুটে উঠেছেঃ
“আর এরকম কত ব্যক্তিই না আজ আছে যারা সত্যের পরিপন্থী ফতওয়া দিয়েছে, এবং আল্লাহর আদেশের বিপরীতে এসব ফতোয়াকে মান্য করা হয়েছে আর এর মাধ্যমে এসব ফতোয়াবাজদের আল্লাহর পরিবর্তে রব হিসেবে গ্রহন করা হয়েছে? আর বর্তমান সময়ে যাদের এভাবে আল্লাহর পরিবর্তে রব হিসেবে গ্রহন করা হয়েছে তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে তাগুত (মিথ্যা ইলাহ) আল-কারদাবি। এই ব্যক্তি উম্মাহকে পথভ্রষ্ট করেছে এবং তাদের জন্য সবকিছুই হালাল করে দিয়েছে। অভিনয়, ছবি আঁকা ও গানবাজনাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার ব্যাপারে, নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশার ব্যাপারে নারীদের উৎসাহিত করার মাধ্যমে সে নারীদের ধ্বংসের দিকে আহবান করছে। আর আল-কারদাবি যেসমস্ত বিষয়ে গোমরাহি ও কুফরে আপতিত হয়েছে সেগুলো হলঃ
ক) কুফফার ইহুদী-খ্রিষ্টানদের ব্যাপারে অতি কোমলতা ও উদারতা। কারণ তার মত হল ইহুদি খ্রিস্টানদের মধ্যে যারা শান্তিকামী আমাদের তাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক (ওয়ালা) রাখা উচিৎ। (“আল-হালাল ওয়াল-হারাম; পৃষ্ঠা: ৩০৭, ১৪ সংস্করন), এবং তাদের বিকৃত ধর্মকে আসমানি ধর্ম হিসেবে সম্মান করা উচিৎ। (“আল-ইসলাম ওয়াল-ইলমানিয়াহ; পৃষ্ঠা: ১০১), এবং তারা নাকি আমাদের ভাই (“নাহু উইহদাত ফিকরিয়াতিন লি’ল-আলিমিন লি’ল-ইসলাম”, পৃষ্ঠা: ৮১), আর আমাদের সাথে ইহুদীদের যুদ্ধ আক্বীদার কারণে নয় । (“আল-বায়ান” ম্যাগাজিন ইস্যু #১২৪, এবং কাতারী পত্রিকা “আর-রায়াহ” ইস্যু #৪৬৯৬)
খ) আহলুল- বিদা’আহ এবং গোমরাহদের প্রতি অতি নমনীয়তা, এবং তাদের কুফরীপূর্ণ বিদ’আতগুলোকে (বিদ’আহ কুফরিয়্যাহ) এবং সেগুলোর খন্ডন করা অত্যন্ত হালকা, অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত করা। (“আস-সাহওয়াহ আল-ইসলামিয়্যাহ বায়ান আল-জুহুদ ওয়াত তাতাররুফ, পৃষ্ঠা: ৮৯)
গ) আহলুস-সুন্নাহর মতের অনুযায়ী হাশরের ময়দানে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল-কে দেখতে পাওয়ার বিষয়টি সে অস্বীকার করে, আর সে এই ব্যাপারটি বিদ’আতি আশারিদের মতো করে ব্যাখ্যা করে। অথচ আল্লাহ আযযা ওয়া জাল বলেন,
وُجُوۡہٌ یَّوۡمَئِذٍ نَّاضِرَۃٌ ﴿ۙ۲۲﴾ اِلٰی رَبِّہَا نَاظِرَۃٌ ﴿ۚ۲۳﴾
“সেদিন মুখমন্ডলগুলো উজ্জ্বল হবে, তাদের রব্বকে দেখে।” (কিয়ামাহ: ২২-২৩)
(“আল-মার‘আহ আল-উলইয়া ফিল-ইসলাম”, পৃষ্ঠা: ৩৪৮)
ঘ) সে আমাদের (আহলুস-সুন্নাহ) সাথে রাফেযিদের (চরমপন্থী শিয়া) ঐক্যের কথা বলে। অথচ রাফেযিদের আক্বিদা হল কুর’আনের ব্যাপারে সন্দেহ করা, এবং আলীকে রাঃ ইলাহ মনে করা। তারা সাহাবীদের রাঃ অভিশাপ দেয়, অথচ আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্টির ঘোষণা দিয়ে বলেন,
مُحَمَّدٌ رَّسُوۡلُ اللّٰہِ ؕ وَ الَّذِیۡنَ مَعَہٗۤ اَشِدَّآءُ عَلَی الۡکُفَّارِ رُحَمَآءُ بَیۡنَہُمۡ
“মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, এবং তার সাহাবীরা কুফফারদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে সহানুভূতিশীল।” (ফাতহ: ২৯) (“আল-খাসা’ই আল-আমমাহ লি’ল-ইসলাম”, পৃষ্ঠা: ২০৯)
ঙ) সে কুফরী গণতন্ত্রের দিকে আহবানকারী, যার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে আল্লাহর আইনের পরিবর্তে অন্য কিছুকে আইন হিসেবে গ্রহণ করা। অথচ আল্লাহ আযযা ওয়া জাল বলেন,
وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡکٰفِرُوۡنَ
“আর যারাই আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে শাসন করে না তারাই কাফির।” (মায়িদা: ৪৪) (“আল – ফাতওয়া আল-মু’আশারাহ, খন্ড: ২/৬৩৭)
চ) সে আলানিয়ুন (Rationalist) দের-যারা মু’তাযিলাদের নব্য রূপ-তাদের মানহাজ গ্রহণ করেছে। একারণে সে বেশ কিছু সাহিহ হাদিসকে অস্বীকার করেছে এই দাবিতে যে এই হাদিসগুলো কুর’আনের যাহির অর্থের বিপরীত, এবং একইসাথে এই হাদীসগুলো আক্কলের সাথেও সাংঘর্ষিক। অথচ আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা বলেন,
وَ مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡہُ وَ مَا نَہٰىکُمۡ عَنۡہُ فَانۡتَہُوۡا ۚ
“রাসূল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ কর, এবং যা নিষেধ করেন, তা পরিত্যাগ কর।” (হাশর: ৭)।
আল-কারদাবি এরকম কিছু হাদিস অস্বীকারের উদাহরন-
প্রথমত: সহীহ মুসলিম থেকে সরাসরি রাসূলুল্লাহ ﷺ পর্যন্ত সনদে পাওয়া যায়, নবীজী ই বলেছেন, “নিশ্চয়ই আমার পিতা এবং তোমার পিতা আগুনে।” আর এ বিষয়টি নিয়ে ‘আলিমদের ইজমা (একমত) আছে। কিন্তু আল-কারদাবি বলে, “(আমি বলি) আব্দুল্লাহ ইবন আব্দুল-মুত্তালিবের গুনাহ কী যে তিনি জাহান্নামে থাকবেন? অথচ তিনি হচ্ছেন আহলুল-ফাতরাহর (আহলুল ফাতরাহঃ যারা এক নবীর যুগের পর আরেক নবী আসার মধ্যবর্তী সময়ের মানুষ) অন্তর্ভুক্ত? বরং সঠিক মত হল যে, তারা (জাহান্নাম থেকে) পরিত্রাণ পাবেন।” (“কাইফাহ নাত’আমাল মা’ আস-সুন্নাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ৯৭)
দ্বিতীয়ত: দুইটি সহীহ গ্রন্থ (বুখারি ও মুসলিম) হাদিস থেকে সরাসরি রাসূলুল্লাহ ﷺ পর্যন্ত সনদে প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ বলেন-“মৃত্যুকে একটি সাদা রঙের ভেড়ার আকারে আনা হবে..” অথচ আল-কারদাবি বলেন, “স্বাভাবিক জ্ঞান, বিবেচনাবোধ এবং বাস্তবতা থেকে যা জ্ঞাত ও যার ব্যাপারে সবাই একমত তা হল, মৃত্যু কোন ভেড়া অথবা বলদ; কিংবা কোন প্রাণী না।” (“কাইফাহ নাত’আমাল মা’ আস-সুন্নাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ১৬২)
তৃতীয়ত: দুইটি সহীহ (বুখারী, মুসলিম) থেকে প্রমাণিত: “যে জাতি নারীদের নেতৃত্বের আসনে বসায় কখনোই সফলকাম হবে না।” অথচ আল-কারদাবি বলে, “এটি শুধু রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সময়ের জন্য প্রযোজ্য ছিল, কারণ তখন শাসনের কাজ শুধুই পুরুষদের জন্য ছিল। কিন্তু এখনকার সময়ের জন্য এটি প্রযোজ্য না।” (এ.আর.টি চ্যানেলে ৪/৭/১৪১৮ হিজরী তারিখে আল-কারদাবি এবং কিছু বেপর্দা মহিলার মাঝে একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠান হয়, যাতে করে এসব বেপর্দা মহিলাদের জন্য নবীজীর সুন্নাহর ব্যাপারে সে মত দিতে পারে)
চতুর্থত: সহীহ হাদিস থেকে প্রমাণিত যে রাসূলুল্লাহ ﷺ নারীদের ব্যাপারে বলেছেন- “আমি আর কাউকে দ্বীন এবং বোধ-বুদ্ধির ক্ষেত্রে মিসকিন, কিন্তু মানুষের বিবেচনাবোধ লোপ করতে এতোটা সক্ষম দেখিনি, যেমনটা তোমাদের (নারীদের) কাউকে দেখেছি।” এই হাদিসের ব্যাপারে ঐ একই অনুষ্ঠানে আল-কারদাবি বলে, “ রাসূল ﷺ হাসি – ঠাট্টার ছলে কথাটি বলেছিলেন।”
এভাবে সে নিজের কলুষিত বুদ্ধিবৃত্তিকে নবীজী ﷺ এর হাদিসের উপর স্থান দিয়ে, সরাসরি হাদিস অস্বীকার করলো। (এ.আর.টি চ্যানেলে ৪/৭/১৪১৮ হিজরী)
পঞ্চমত: সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “কোন কাফিরের বদলে কোন মুসলিমকে মারা যাবে না।” এ হাদিসের বক্তব্যে বিরুদ্ধে গিয়ে আল-কারদাবি দাবি করে যে একজন কাফির হত্যার কারণে একজন মুসলিমকে হত্যা করা যাবে, এবং সে বলে- “এই মতটি (অর্থাৎ তার নিজের মত) ছাড়া আর কোন মত বর্তমান সময়ে মানানসই নয়। আর এ মতটিকেই এ ব্যাপারে শক্তিশালী মত ঘোষণা করার মাধ্যমে এ ব্যাপারে অজুহাতগুলোকে বাতিল সাব্যস্ত করেছি এবং সম্মানিত শারীয়াহর পতাকা উচিয়ে ধরেছি।” (“আশ-শাইখ আল-গাজ্জালী কামা আরাফতুহু”, পৃষ্ঠা: ১৬৮)
“এছাড়া সে এমন কথা উচ্চারন করেছে যেখানে সাদৃশ্য আরোপ করে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর কে ব্যাঙ্গ করা হয়েছে (ইস্রাইলি নির্বাচনের ব্যাপারে তার বক্তব্য, যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে)। সে ঐসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত যারা বুদ্ধ মূর্তি ভাঙার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং এর প্রতিবাদ করেছিল। দুঃখজনক ব্যাপার হল কিছু দ্বীনের দাঈ তার সমর্থনে কথা বলে এবং তাকে সম্মানিত ও মর্যাদাবান শাইখ হিসেবে উপস্থাপন করে। অথচ তাওহীদের ব্যাপারে অজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া কেউই আল-কারদাবির পক্ষে কথা বলবে না। কারণ তার কুফর এবং রিদ্দা স্পষ্ট। আমরা আল্লাহর কাছ থেকে তাঁর ক্রোধ এবং শাস্তি থেকে আশ্রয় কামনা করছি। (“আল-হাক্ক ওয়াল-ইয়ার্কিন ফি’’ ‘আদওয়াত আত-তুগাত ওয়াল-মুরতাদীন”, পৃষ্ঠা: ১৬)
পরিশেষে, এতোটুকু বলাই যথেষ্ট যে আমরা আমাদের সকল পাঠককে নাসিহাহ করবো এই ব্যক্তির লেখা, বক্তব্য, এবং অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকতে, এবং তার ব্যাপারে অন্যান্যাদেরকেও সতর্ক করতে। আল্লাহ তার দ্বীনকে হিফাযাত করুক বাহ্যিক শত্রু এবং অভ্যন্তরীন শত্রু মুনাফিদের ষড়য়ন্ত্র থেকে।
সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক নবীজী মুহাম্মাদ ﷺ, এবং তার পরিবার, এবং তার সাহবীগণ, এবং অনুসারীদের উপর কিয়ামাত পর্যন্ত।
[আত-তিবইয়্যান ফোরাম থেকে গৃহীত। প্রথম প্রকাশ নিদা আত-তাওহিদ নামক একটি কমিউনিটি পত্রিকাতে।]
[1] [দেখুন ইক্বায আল-হিমামের পৃষ্ঠা ৯৩ এর ফুটনোট]
[2] আহমাদ ও আবূ দাউদে বর্ণিত, শাইখ আলবানির মতে সহীহ
[3] আল-ফারক্ব বাইনা আন-নাসীহাহ ও ওয়াত-তা‘ইর, ৩০-৩৩ পৃষ্ঠা
[4] আল-ই‘তিসাম, খন্ড ২/২২৮-২২৯
[5] পাঠকের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ্য যে, কাতারের শাসকগোষ্ঠী ইরাকে সামরিক আগ্রাসণ চালানোর সময়, অ্যামেরিকার সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য তাদের আকাশপথ, বিমানছাউনি ও রানওয়েগুলো উম্মক্ত করে দিয়েছিলো।
আর ২০০২ সালের ইরাক অভিযান ও অভিযান পরবর্তী দখলদারিত্বের জন্য কাতারের রাজধানী দোহাতে অ্যামেরিকান সেনাবাহিনীর মূল কমান্ড সেন্টার স্থাপন করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে অ্যামেরিকার সবচেয়ে বড় সেনাস্থাপনা হলো কাতারের আল-উদেইদ এয়ারবেইস।
[6] সূরা হুজুরাতের আয়াতের ব্যাপারে কারদাবির বক্তব্য দেখুন! কিভাবে সে এই আয়াতকে ব্যবহার করে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার ইবাদাতকারী (মুসলিম) ও আল্লাহর নবী ঈসার আঃ ইবাদাতকারীদের (খ্রিষ্টান) মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করার চেষ্টা করছে!আল-কারদাবির এ বক্তব্যকে আল্লাহ তা‘আলার কালামের সাথে মিলিয়ে দেখুনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُواْ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاء بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللّهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরেরবন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না। [ সুরা মায়েদা ৫:৫১ ]
এ আয়াতের তাফসীর ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ, সীরীন রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ ইবন,“আব্দুল্লাহ ইবন উতবাহ বলেছেন-‘তোমাদের সকলে ভয় করা উচিত যে তোমরা নিজেদের অজান্তে ইয়াহুদী কিংবা খ্রিষ্টানে পরিণত হবে। ‘মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন তার একথা শুনে বললেন- আমরা ধরে নিলাম তিনি এই আয়াতের কথা বলছেনঃ হে ঈমানদারগণঃ (তোমরা ইয়াহূদ ও নাসারাদের কে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না)
আর এ আয়াতের , “তোমাদের মধ্যে কেউ তাদের কে বন্ধরূপে গ্রহণ করলে সে তাদের ই অন্তর্ভূক্ত হবে”-আশ- শাওক্বানী তার তাফসীরে বলেছেন, অর্থাৎ (যে ব্যক্তি এমন করবে) সে তাদের দলের এবং জনগণের অন্তর্ভূক্ত। আর এটি(এ আয়াত) শাস্তির ব্যাপারে শক্ত হুঁশিয়ারি, কারন এ হল এমন অবাধ্যতা যা কুফরের পর্যায়ে পৌঁছে এবং এমন চরম পর্যায়ের যে তারপর আর কিছুই বাকি থাকে না।
আর সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হল – নিশ্চয় মুমিনরা তো পরস্পর ভাই- এই আয়াত কে আল-কারদাবী দলীল হিসাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে এই যুক্তিতে যে, ইয়াহূদী – খ্রিষ্টানরা তাদের নিজ নিজ ধর্মের ক্ষেত্রে “মুমিন”/বিশ্বাসী। আর যেহেতু তারা নিজ নিজ ধর্মের ব্যাপারে বিশ্বাসী তার আল-কারদাবির মতে কুরআন ও সুন্নাহতে যাদের ‘মুমিন’ বা বিশ্বাসী আখ্যায়িত করা হয়েছে, ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানরা তাদের অন্তর্ভূক্ত। শুধু তাই না, তারা এ কারণে মুসলিমদের ভাই বলেও গণ্য হবে। অথচ আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার স্পষ্ট আয়াত-
– لَّقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُواْ إِنَّ اللّهَ ثَالِثُ ثَلاَثَةٍ
নিশ্চয় তারা কাফের, যারা বলেঃ আল্লাহ তিনের এক; [ সুরা মায়েদা ৫:৭৩ ]
এবং
لَّقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَآلُواْ إِنَّ اللّهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ (ج)
নিশ্চয় তারা কাফের, যারা বলে, মসীহ ইবনে মরিয়মই আল্লাহ। [ সুরা মায়েদা ৫:১৭ ]
এবং শাইখ আব্দুল-লতীফ ইবন আব্দুর-রাহমান আল আশ-শাইখ রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ সবচেয়ে বড় গুনাহ, সবচেয়ে বড় গোমরাহী, সর্বাধিক চরম পথভ্রষ্টতা যা দ্বীনের ভিত্তিকে বাতিল করে দেয়(ঈমান ধ্বংশ করে ) তাহল আল্লাহর শত্রুদের সাহায্য ও সহযোগিতা করা। এবং তাদের সাথে একসাথে এমন কাজ করা যা তাদের দ্বীনকে এবং যে কুফর ও শিরকের উপর তারা আছে তাকে শক্তিশালী করে। আর সর্বাধিক বিপদজনক বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত হল তাদের প্রতি নিজের অন্তরকে উম্মুক্ত করে দেওয়া, তাদের আনুগত্য করা, তাদের প্রশংসা করা এবং যা কিছু তাদের অধীনস্ত তার প্রশংসা করা, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ছেড়ে দেওয়া, এবং তাদের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বজায় রাখা। [আর রাসাইল- আল-মুফিদাহ, পৃষ্ঠা ৬৪]
[7] এমন আয়াত কোন নির্দিষ্ট সময় বা স্থানের জন্য প্রযোজ্য, এমন দাবি স্পষ্ট মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই না। যদি কেউ কুরআনের কোন হুকুম কে কোন নির্দিষ্ট স্থান, কাল বা পাত্রের ব্যাপারে সীমাবদ্ধ করতে চায় বা এমন দাবি করে তবে তাকে অবশ্যই এব্যাপারে দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে।
সুনির্দিষ্ট দলীলের অবর্তমানে কুরআনের হুকুমসমূহ কে সার্বজনীন ও চিরন্তন বলে গণ্য করতে হবে।অন্যথায় কুরআনের যে কোন আয়াতের ব্যাপারে যে কেউ দাবী করতে পারে-“ এ তো কেবলমাত্র নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামের সময় ও প্রেক্ষাপটের জন্য প্রযেোজ্য, এটি বর্তমান সময় ও প্রেক্ষাপটের জন্য প্রযোজ্য নয়”- যেমন আল-কারদাবী দাবি করেছে, কোন প্রমাণ উপস্থাপন না করেই।
যেমনটা ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন-“ যদি এসব আয়াত কোন নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে নাজিল হয়েও থাকে, তবুও সেগুলোর অর্থ এবং হুকুম আমভাবে প্রযোজ্য হবে, কারনে অধিকাংশ আয়াতই কোন না কোন নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছিল। এব্যাপারে কোন ভিন্নমতের কথা আমরা জানি না। এসব আয়াতগুলো আমভাবে এমন সব লোকের জন্য প্রযোজ্য যার অবস্থা ঐসব লোকদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ যাদের ব্যাপারে আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে। যদি আয়াতের শব্দাবলী ‘আম হয়, তাহলে এটা উল্লেখে সমস্যা নেই ‘ এ আয়াত অমুক-অমুক ব্যক্তির ব্যাপারে অমুক-অমুক প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছে’।
কিন্তু এর মাধ্যমে ঐ আয়াতের অর্থ ও হুকুমকে কেবল ঐসব ব্যক্তিবর্গ ও প্রেক্ষাপটের জন্য সীমাবদ্ধ করা যাবে না। আর অধিকাংশ লোকেরা এব্যাপারে একমত যে, এসব আয়াতের অর্থ ও হুকুমকে আমভাবে গ্রহণ করা ওয়াজিব যদি না তাদের হুকুম তাদের নাযিল হবার প্রেক্ষাপটের মধ্যে সীমাবদ্ধ হবার স্পষ্ট দলীল থাকে।” [আস্সারিমুল মাসলূল আ‘লা শাতিমির রাসূল, পৃষ্ঠা- ৩৩]
[8] আল-কারদাবির এই বক্তব্যের সাথে ইবনুল কায়্যিমের (রাহিমাহুল্লাহ) বক্তব্যের তুলনা করুন, যিনি বলেছিলেনঃ “কাফিরদের উৎসবের দিনে তাদের ব্যবহৃত অভিনন্দনসূচক শব্দে তাদের শুভেচ্ছা জানানোর ব্যাপারে মত হল, এটা আলিমদের ইজমা অনুযায়ী হারাম। যেমন তাদের উৎসব কিংবা উপবাসের দিনে শুভেচ্ছা জানানো, কিংবা তাদের উৎসব বরকতপূর্ণ হোক এমন বলা , ইত্যাদি সবই হারাম। যদিও কেউ বলে এমন বলাটা কুফুরি থেকে মুক্ত (অর্থাৎ এতে কুফুরি যুক্ত নেই)। কারন এটা হল ক্রশের সামনে সিজদাহরত ব্যক্তিকে অভিনন্দন জানানোর মত।
কোন মদ্যপায়ীকে তার মদ পান করার ব্যাপারে, কিংবা খুনকে খুন করার ব্যাপারে, কিংবা যিনাকারীকে যিনার ব্যাপারে অভিনন্দন জানানোর চাইতেও কাফিরদের উৎসবের দিনে তাদের শুভেচ্ছা জানানো আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতর গুনাহ। যারা এমন করে, তারা দ্বীনের প্রতি কোন সম্মান রাখে না এবং তাদের এ কাজের জঘন্যতা তারা অনুধাবন করে না। যে ব্যক্তি কোন গুনাহ, কোন বিদ‘আহ কিংবা কোন কুফর আমলের ব্যাপারে কাউকে অভিনন্দন জানায়, সে নিজেকে আল্লাহর ক্রোধ ও গযবের প্রতি উম্মুক্ত করে দেয়।” [আহকামু আহলিয্ যিম্মাহ, খন্ড ১/৪৪১-৪৪২]
[9] আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর কিতাবে আমাদের জানিয়েছেন কাফিরদের প্রতি আমাদের বিদ্বেষ ও শত্রুতার সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল তাদের কুফর। আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এবং তাঁর কিতাবের সুস্পষ্ট আয়াতের বিপরীতে আল-কারদাবী আর তার এসব ধ্যান-ধারনার কী-ই বা অবস্থান? আর ইব্রাহীমের (আলাইহিমুস্সালাতু ওয়াস্সালাম)মুখে এ সাক্ষ্যই উচ্চারিত হয়েছিল এবং আল্লাহ তা‘আলা এর প্রশংসা করেছিলেন এবং অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন-
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَاء مِنكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاء أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ
তোমাদের জন্যে ইব্রাহীম ও তাঁর সঙ্গীগণের মধ্যে চমৎকার আদর্শ রয়েছে। তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিলঃ তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার এবাদত কর, তার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের মানি না। তোমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করলে তোমাদের মধ্যে ও আমাদের মধ্যে চিরশত্রুতা থাকবে। [ সুরা মুমতাহিনা ৬০:৪ ]
সুতরাং মুসলিম ও কাফিরদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষের কারন হল মুসলিমদের ভূমি ও সম্পদ দখল- এমন দাবি করা দ্বীনের ব্যাপারে মিথ্যাচার ও বিদ‘আহ। বরং এ শত্রুতা ও বিদ্বেষের ভিত্তি হল আকীদা ও তাওহীদের ব্যাপারে মতপার্থক্য। আর মুমিন ও কাফিরদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষের উৎস হল তাওহীদ ও আকীদার ব্যাপারে এই মতপার্থক্য। আর কিয়ামাত পর্যন্ত এ শত্রুতা ও বিদ্বেষ জারি থাকবে।
إِنَّ الْكَافِرِينَ كَانُواْ لَكُمْ عَدُوًّا مُّبِينًا
নিশ্চয় কাফেররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। [ সুরা নিসা ৪:১০১ ]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন-
وَلَوْ شَاء رَبُّكَ لَجَعَلَ النَّاسَ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلاَ يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَإِلاَّ مَن رَّحِمَ رَبُّكَ وَلِذَلِكَ خَلَقَهُمْ وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ لأَمْلأنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
আর তোমার পালনকর্তা যদি ইচ্ছা করতেন, তবে অবশ্যই সব মানুষকে একই জাতিসত্তায় পরিনত করতে পারতেন আর তারা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হতো না। তোমার পালনকর্তা যাদের উপর রহমত করেছেন, তারা ব্যতীত সবাই চিরদিন মতভেদ করতেই থাকবে এবং এজন্যই তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আর তোমার আল্লাহর কথাই পূর্ণ হল যে, অবশ্যই আমি জাহান্নামকে জ্বিন ও মানুষ দ্বারা একযোগে ভর্তি করব। [ সূরা হূদ- ১১৮-১১৯]
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছেন দ্বীন ও আক্বীদার ব্যাপারে মতপার্থক্যের জন্য। আর এটিই এ ব্যাপারে সঠিক ও জমহুরের মত, যা ইবনু কাসীর তার তাফসীরে উল্লেখ করেছেন। [দেখুন, তাফসীরে ইবনে কাসীর , খন্ড ২ পৃষ্ঠা ৪৬৫]
আর তাওহীদ ও আকীদার পর কাফির ও মুমিনদের মধ্যকার শত্রুতা , বিদ্বেষ ও সংঘাতের পরবর্তী কারণ হল নবী-রাসূলদের আঃ স্বীকার করা ও অস্বীকার করার বিষয়টি, যেমনটা জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বুখারিতে বর্ণিত হাদীসে উল্লোখ করেছেন “…. আর মুহাম্মাদ হলেন মানুষের মধ্যে বিভাজনকারী”। (৬/৭৩৮)
আর এ বিষয়গুলোর ভিত্তিতেই মুমিন ও কাফিরদের মধ্যে চিরন্তন শত্রুতা ও বিদ্বেষের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা বলেনঃ
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا إِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ فَإِذَا هُمْ فَرِيقَانِ يَخْتَصِمُونَ
আমি সামুদ সম্প্রদায়ের কাছে তাদের ভাই সালেহকে এই মর্মে প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর। অতঃপর তারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বিতর্কে প্রবৃত্ত হল। [ সুরা নাম’ল ২৭:৪৫ ]
هَذَانِ خَصْمَانِ اخْتَصَمُوا فِي رَبِّهِمْ
এই দুই বাদী বিবাদী, তারা তাদের পালনকর্তা সম্পর্কে বিতর্ক করে। সুরা হাজ্জ্ব ২২:১৯ ]
সুতরাং মুমিন ও কাফিরদের বিরুদ্ধে শত্রুতা ও বিদ্বেষ কোন ভূমি কিংবা সম্পদের জবরদখলকে কেন্দ্র করে না, যেমনটা আল-কারদাবী দাবি করে। তাওহীদ অস্বীকারকারীদের ঘৃণ্য চক্রান্ত থেকে আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদের হেফাযত করুন।
[10] Look to http://www.alheweny.net/index2/qaradawi.HTM
দশ বছর বয়সে সে আল্লাহর কিতাব হিফয করার দাবি করা এ মুফতি সাব সম্ভবত সূরা তাওবাহর এ আয়াত ভুলে গিয়েছে-
مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُواْ أَن يَسْتَغْفِرُواْ لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُواْ أُوْلِي قُرْبَى مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ
নবী ও মুমিনের উচিত নয় মুশরেকদের মাগফেরাত কামনা করে, যদিও তারা আত্নীয় হোক একথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা দোযখী। [ সুরা তাওবা ৯:১১৩ ]
আল-আহকামে (খন্ড ৮/১৭৩) আল-ক্বুরতুবী বলেছেনঃ “এ আয়াতের অর্থ হল একজন মু’মিনের উচিৎ জীবিত ও মৃত কাফিরদের সাথে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছেদ করা। আল্লাহ মু’মিনদের মুশরিকদের জন্য ক্ষমার দু‘আ করাকে অনুমোদন দেন নি। একজন মুশরিক কে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য দু‘আ করা জায়েয না।”
ফাতহুল কাদীরে (খন্ড ২/৪১০) আশ-শাওক্বানী বলেছেনঃ এ আয়াত থেকে বুঝা যায় কাফিরদের সাথে কোন অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব নেই। আর কাফিরদের ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য, অথবা অননুমোদিত কোনভাবে কাফিরদের জন্য দু’আ করা বৈধ না (হারাম)।”
فَإِنِ انتَهَوْاْ فَإِنَّ اللّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
তারপর যদি তারা বিরত হয়ে যায়, তবে আল্লাহ তাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করেন। [ সুরা আনফাল ৮:৩৯ ]
এখানে “যদি তারা বিরত থাকে” – এ কথার অর্থ যদি তারা কাফির হওয়া থেকে বিরত হয়ে আল্লাহর সাথে কোন শরীক না করে, শুধুই তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণ করে। [তাফসির আস-সা’দি]
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমি আমার রবের কাছে অনুমতি চাইলাম আমার মায়ের জন্য ক্ষমার দু’আ করার। তিনি অনুমতি দিলেন না। আমি তাঁর কাছে অনুমতি চাইলাম আমার মায়ের কবর দেখতে যাবার, আল তিনিন এতে অনুমতি দিলেন।” [মুসলিম, #৯৭৬]
আন-নাওয়ায়ি বলেছেনঃ “ক্বুরআনের দলীল ও আলিমদের ‘ইজমা অনুযায়ী একজন কাফিরের জানাযার নামায পড়া, তার নাজাতের জন্য দু’আ করা অবৈধ (হারাম)।” [আল-মাজমু’, খন্ড ৫/১২০]। তুহফাত আল-মুহতাজে বলা হয়েছেঃ “একজন কাফির এবং যে ব্যক্তির ইসলাম নিয়ে সংশয় আছে, তাদের জন্য আখিরাতের বিষয়ে দু’আ করা হারাম। যদি (কোন মুসলিমের) পিতা-মাতার অবস্থা এমন হয়ে থাকে, তবুও দু’আ করা জায়েয না।” [খন্ড ৩/১৪১
[11] সে সময় আমাদের আফগানিস্তানের ভাইরা যা করছিলেন তা সম্পূর্ণভাবে সুন্নাহর ঐসব বিপুল পরিমান দলীলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল যেখানে চিত্র, ভাস্কর্য ও মূর্তি ভাঙ্গার আদেশ এসেছে। আবুল হাইয়্যাজ আল-আসাদি বলেছেন, আলি ইবনু আবি তালিব (রাঃ) বলেছেনঃ “আমি কি তোমাকে সেই দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যেই দায়িত্ব দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা হচ্ছে এই যে, তুমি যেখানেই কোন ছবি-মূর্তি(তামাসিল-প্রতিমা, ভাস্কর্য ইত্যাদি) দেখবে সেটা ভেঙ্গে ফেলবে এবং যেখানেই কোন পাকা উঁচু কবর দেখবে সেটা ভেঙ্গে মাটির সাথে সমান করে দেবে।” [মুসলিম,#৯৬৯]
ইবনুল কাইয়্যিম বলেছেনঃ “তামাসিল হল তিমসাল (ভাস্কর্য) এর বহুবচন, যা দ্বারা কোন প্রতিরূপ বা অনুকৃতিমূলক চিত্র ( বা এ জাতীয় অন্য কিছুকে) বুঝানো হয়।” ( আল- ফাওয়া’ইদম পৃষ্ঠা ১৯৬)। ‘উরওয়া ইবনু আবাসা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করলেনঃ “আপনাকে কী দিয়ো পাঠানো হয়েছে? ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আল্লাহ তা’আলা আমাকে প্রেরণ করেছেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার, মূর্তিসমূহ ভেঙ্গে ফেলার এবং এক আল্লাহর ইবাদাত করার ও তাঁর সঙ্গে অন্য কোনো কিছুকে শরীক না করার বিধান দিয়ে।” [মুসলিম, ৮৩২]
[12] মূল আরবি ফতোয়া দেখুনঃ
https://www.unc.edu/~kurzman/Qaradawi_et-al_Arabic_Page_1.jpg[/url]) https://www.unc.edu/~kurzman/Qaradawi_et_al_Arabic_page_2.jpg
https://www.unc.edu/~kurzman/Qaradawi_et_al_Arabic_page_3.jpg
অথবা এর ইংরেজি অনুবাদ দেখুনঃ