অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ || ফিতনার যুগে মুজাহিদদের প্রতি নসিহত -ড. শায়খ সামী আল-উরাইদী হাফিযাহুল্লাহ ||
مؤسسة النصر
আন নাসর মিডিয়া
An Nasr Mediaتـُــقدم
পরিবেশিত
Presentsالترجمة البنغالية
বাংলা অনুবাদ
Bengali Translationبعنوان:
শিরোনাম:
Titled:
نصائح للمجاهد في زمن الفتن
ফিতনার যুগে মুজাহিদদের প্রতি নসিহত
Advice to the Mujahideen in the age of fitnaللشيخ سامي العريدي حفيظه الله
ড. শায়খ সামী আল-উরাইদী হাফিযাহুল্লাহ
By Dr. Sheikh Sami Al-Uraidi Hafizahullah
للقرائة المباشرة والتحميل
সরাসরি পড়ুন ও ডাউনলোড করুন
For Direct Reading and Downloading
https://justpaste.it/fitnar_juge_nosihat
https://archive.vn/7CP5v
https://mediagram.io/10aa610e7801b2d3
https://archive.vn/86HYb
https://web.archive.org/web/20201223…aa610e7801b2d3
https://web.archive.org/web/20201223…r_juge_nosihat
روابط بي دي اب
PDF (2 MB)
পিডিএফ ডাউনলোড করুন [২ মেগাবাইট]
https://banglafiles.net/index.php/s/WZgz82KMztR4tnK
https://archive.org/details/fitnar-j…sami-al-uraidy
https://www.file-upload.com/45mdruraztf4
https://www.mediafire.com/file/1hjic…raidy.pdf/file
https://anonfiles.com/x2221a1bp5/Fit…miAlUraidy_pdf
روابط ورد
Word (927 KB)
ওয়ার্ড [৯২৭ কিলোবাইট]
https://banglafiles.net/index.php/s/rtgWkfERNtW2Fkn
https://archive.org/download/fitnar-…iAlUraidy.docx
https://www.file-upload.com/sts0vmedg0py
https://www.mediafire.com/file/bx07s…aidy.docx/file
https://anonfiles.com/p32d1d14p4/Fit…iAlUraidy_docx
روابط الغلاف- ١
book Banner [8 MB]
বুক ব্যানার ডাউনলোড করুন [৮ মেগাবাইট
https://banglafiles.net/index.php/s/doBb7QZB9efPbne
https://archive.org/download/uradi_202012/uradi.jpg
https://www.file-upload.com/5thfgfwlkd06
https://www.mediafire.com/view/m5fnh…uradi.jpg/file
https://anonfiles.com/F2241d17p3/uradi_jpg
روابط الغلاف- ٢
Banner [75 KB]
ব্যানার ডাউনলোড করুন [৭৫ কিলোবাইট]
https://banglafiles.net/index.php/s/3ko3tkJxiPTACpL
https://archive.org/download/banner_20201222/banner.jpg
https://www.file-upload.com/n94cytkcp2gx
https://www.mediafire.com/view/8d7p7…anner.jpg/file
https://anonfiles.com/l52e1814p6/banner_jpg
مع تحيّات إخوانكم
في مؤسسة النصر للإنتاج الإعلامي
قاعدة الجهاد في شبه القارة الهندية (بنغلاديش)
আপনাদের দোয়ায় মুজাহিদ ভাইদের ভুলবেন না!
আন নাসর মিডিয়া
আল কায়েদা উপমহাদেশ বাংলাদেশ শাখা
In your dua remember your brothers of
An Nasr Media
Al-Qaidah in the Subcontinent [Bangladesh]
========================
ফিতনার যুগে
মুজাহিদদের প্রতি নসিহত
ড. শায়খ সামী আল-উরাইদী হাফিযাহুল্লাহ
সূচীপত্র
শাইখ আইমান আয যাওয়াহিরী হাফিজাহুল্লাহর ভূমিকা.. 6
সালাফে সালিহীনের বুঝ অনুযায়ী কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরতে হবে.. 15
নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা.. 18
এক. আযাব প্রতিহতকারী ইস্তেগফার. 30
দুই. ইস্তেগফারের মাধ্যমে প্রতিহত আযাব. 32
আমর বিল মারূফ, নাহি আনিল মুনকার এবং হকের দাওয়াত.. 34
রাসূলের অনুসরণ, বিদআত ও কুমন্ত্রণা থেকে সংবরণ. 40
ইলম অন্বেষণ ও রব্বানী আহলে ইলমের দিকে প্রত্যাগমন. 43
ইতিহাস অধ্যয়ন করা এবং ঘটনার পরিণাম ও সেখান থেকে পাওয়া কল্যাণ-অকল্যাণের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা 48
যে কোনো সংবাদে, যে কোনো ঘটনায় অটল-অবিচল থাকা.. 52
ফিতনার জমানায় জবানের অবস্থান. 54
সবর, অবিচলতা, আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা পোষণ. 56
তাকওয়া ও ন্যায়ের পথে জামাআত-বদ্ধ হয়ে থাকা, মতবিরোধ ও বিভেদ থেকে দূরে থাকা 62
সৎকাজের সামনে মাথা নত করা তখা আনুগত্য করা.. 65
শাইখের মুখতাসার পরিচিতি
শাইখ সামী আল উরাইদি ছিলেন জামাআত কায়িদাতুল জিহাদের বিলুপ্ত শাম শাখা ‘জাবহাতুন নুসরাহ’র প্রধান শরীয়াহ বিশেষজ্ঞ, মুফতি এবং বর্তমান শাখা তানযিম হুররাস-আদ-দ্বীনেরও প্রধান মুফতি। ১৯৭৩ সালে জর্ডানের আম্মানে জন্মগ্রহণকারী এই আলেম জামেয়া জর্ডান থেকে হাদিসের উপর পড়াশোনা করেন এবং একই প্রতিষ্ঠান থেকে হাদিসের উপর পিএইচডি করেন। তিনি প্রখ্যাত সিরিয়ান জিহাদি সমরকৌশলবিদ শাইখ আবু মুসআব আস-সুরী দ্বারা খুবই অনুপ্রাণিত ছিলেন। আফগানিস্তানে আল কায়েদার প্রখ্যাত জিহাদি সমরকৌশলবিদদের সাথে থেকে তিনি জিহাদ করেছিলেন, অতঃপর আল কায়েদার হয়ে ইরাকে লড়াই করেন এবং জাবহাতুন নুসরাহর প্রধান ছয় প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন। তিনি প্রাথমিক পর্যায়ে আন নুসরাহ ফ্রন্টের ২য় প্রধান নেতা ছিলেন। সিরিয়াতে আন নুসরাহ ফ্রন্টের শক্ত অবস্থানের পেছনে আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি জিহাদ ও মুজাহিদদের নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি লিখেছেন। আধুনিক জিহাদের কর্মকৌশল নিয়ে তাঁর কিতাব ও ভিডিও মজলিসগুলো বিশ্বব্যাপী মুজাহিদদের মাঝে প্রভাব ফেলেছিল।
শাইখ আইমান আয যাওয়াহিরী হাফিজাহুল্লাহর ভূমিকা
بسم الله والحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وآله وصحبه ومن والاه
আমি শাইখ সামী আল-উরাইদী হাফিজাহুল্লাহ প্রণীত نصائح للمجاهد في زمن الفتن রিসালা সম্পর্কে অবগত হয়েছি। আল্লাহর তাওফিকে আমি একে ফিতনা-ফাসাদের জমানায় মুজাহিদ ভাইদের জন্য স্বল্প পরিসরে একটি উপকারী পাথেয় গ্রন্থ হিসেবে পেয়েছি।
ফিতনার জমানায় মুজাহিদদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তার সঠিক পথকে উপলব্ধি করা। কারণ হাতিয়ার ধারণ করা, কিতাল করা, ন্যায় সঙ্গতভাবে তা দিয়ে রক্ত ঝরানো, সঠিকভাবে মাল উসুল করে যথাস্থানে স্থাপন করা- এসব তার দায়িত্ব। প্রয়োজনে সে শত্রুকে বন্দি করবে, কখনো ধ্বংস করবে, কখনো নিশ্চিহ্ন করে দিবে।
এই সবকটি কাজ অনেক ঝুঁকিপূর্ণ, যার পরিণাম অনেক কঠিন। এসব ক্ষেত্রে যদি শরীয়তের বিধান মেনে না চলে তাহলে উল্টো নিজে ধ্বংস হবে, জমিনেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বসবে।
একজন মুজাহিদ শুধু মুজাহিদ হওয়ার কারণে অন্যায়-অপরাধ, গুনাহ ও বিদআত থেকে নিষ্পাপ নয়। অতীত ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, খারেজী সম্প্রদায় কীভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে গেল, কীভাবে তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের উপর তরবারি চালাল! রাফেজী সম্প্রদায় কেমন করে রাসূলের সাহাবীদেরকে অস্বীকার করে বসল! আমরা আরো দেখতে পাই, জালিম শাসকগণ কীভাবে ইসলামের বিধি-বিধানকে বাতিল সাব্যস্ত করল, শত শত ব্যক্তিকে হত্যা করল। এমন কি তারা কা’বাকে পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিল!
বর্তমান সময়ে আফগান জিহাদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, আফগানিস্তান থেকে রুশবাহিনী চলে যাওয়ার পর তা কীভাবে ক্ষমতা, লুণ্ঠন ও ছিনতাইয়ের লড়াইয়ে পরিণত হল। এমনকি খোদ মুজাহিদদের মাঝেই বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। পরিশেষে আল্লাহ তা’আলা তালেবান আন্দোলনকে নির্বাচন করে আফগানিস্তানে ইসলামীক ইমারাহ প্রতিষ্ঠা করলেন। এভাবে মুসলমানরা ‘আমর বিল মারুফ, নাহি আনিল মুনকার’, শরীয়তের হুকুম বাস্তবায়ন এবং ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদের মাধ্যমে জিহাদের উৎকৃষ্ট ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হয়; যে বিষয়গুলো ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের হাতে প্রায় বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
উত্তর আফ্রিকায় আমরা দেখতে পাই, সেখানে বিজয়ের কাছাকাছি পর্যন্ত পৌঁছার পরও নির্বোধ ও চরমপন্থীদের অবাধ্যতার ফলে জিহাদি কাজ কীভাবে দমে গেল। আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে জিহাদের মিশনকে সঠিক পথে পরিচালনাকারী মুজাহিদদের ইস্তেকামাত এবং সৎকর্মশীলদের দৃঢ়তা না থাকলে জিহাদ একেবারে নিঃশেষ হয়ে যেত।
বসনিয়ায় দেখেছি, মুসলমানদের ইজ্জত রক্ষার জন্য ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ থেকে কীভাবে মুজাহিদরা ভিড় করে ছিল। কিন্তু অবশেষে তারা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদদের ছাড়ের ফলে অন্যায় ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ল।
ফিলিস্তিনে দেখেছি, রাজনীতিবিদরা মুসলিম যুবকদের কুরবানিকে ফিলিস্তিন বিক্রেতাদের বৈধতার স্বীকৃতি ও ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের ধাঁধাঁয় ফেলে কীভাবে নষ্ট করে দিল।
আবু মুসআব ও আবু হামযা রাহিমাহুল্লাহ এ দুই শাইখের শাহাদাতের পর ইরাকে দেখেছি, ক্ষমতাশীলদের এক দল কীভাবে মুজাহিদ ভাইদের নেতৃত্ব ছিনিয়ে নিলো। যার ফলে তারা তাকফির, কতল, ধোঁকা ও মিথ্যা বলাকে বৈধ মনে করতে লাগল।
মোটকথা হলো, একজন মুজাহিদ শুধুমাত্র মুজাহিদ হওয়ার কারণে ফিতনা থেকে নিরাপদ নয়, গুনাহ থেকে নিষ্পাপ নয়। এ জন্য তার উপর আবশ্যিক করণীয় দায়িত্ব হচ্ছে, ফিতনা ও গুনাহ থেকে সর্বাত্মক বেঁচে থাকা। সংক্ষিপ্ত রিসালাটি আশা করি এ ব্যাপারে মুজাহিদদের জন্য সহায়ক হবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন লেখককে এবং এ রিসালার মাধ্যমে উপকার প্রদানকারী, উপকার গ্রহণকারী সবাইকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين ، وصلى الله على سيدنا محمد و آله وصحبه وسلم
– আইমান আয-যাওয়াহিরী
ভূমিকা
المحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على عبده و رسوله محمد و على الأنبياء و الرسل اجمعين، رب اشرح لي صدري و يسر لي أمري واحلل عقدة من لساني يفقهوا قولي ، وبعد :
আল্লাহ তা’আলা বান্দাদেরকে ফিতনার ব্যাপারে সতর্ক করে তার থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ ফিতনা এমন এক জিনিস, বান্দার জন্য আল্লাহর পথে চলার ক্ষেত্রে যার খারাপ প্রভাব রয়েছে। বান্দাকে সরল পথ থেকে সরিয়ে ফেলে অথবা তাকে বর্তমান সময়ের দাবি অনুযায়ী বৃহৎ উদ্দেশ্যের পরিবর্তে অন্য কাজে ব্যস্ত করে তোলে। বৃহৎ উদ্দেশ্যটি হচ্ছে, আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর হুকুম বাস্তবায়ন।
সুতরাং আল্লাহ তা’আলা বান্দাদের মধ্য হতে যাকে নির্বাচন করেন, বৃহৎ উদ্দেশ্যটি উপলব্ধি করার ক্ষমতা যাকে দান করেন, যার মাধ্যমে বর্তমান সময়ে তা বাস্তবায়ন করার কাজ নেন সে এ বৃহৎ উদ্দেশ্য ও চূড়ান্ত লক্ষ্য থেকে ছোটখাটো কোনো উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের কারণে সরে আসতে পারে না, যা তাকে বৃহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কাজে সহায়ক হতে সক্ষম নয়। যদিও ছোটখাটো বিষয়গুলো মূলগতভাবে মুবাহের পর্যায়ভুক্ত। সময় সীমিত, দায়িত্ব অনেক বড়। অবশ্যই এটি আল্লাহর দীনের জন্য নুসরত। আল্লাহ তা’আলা কুরআনে কারিমে ইরশাদ করেন,
قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّـهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّـهُ بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّـهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ ﴿٢٤﴾
‘বল, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান যাকে তোমরা পছন্দ কর- আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত দান করেন না।’ (সূরা তওবা ৯:২৪)
যে দীনের নুসরত ও ইসলামী বিধান বাস্তবায়নের পথের পথিক তার জন্য আবশ্যক সব ধরণের প্রতিবন্ধকতা থেকে বেঁচে থাকা, যা তাকে শরীয়তের বিধান বাস্তবায়নের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ফিতনা। এ জন্য ফিতনা যাকে পেয়ে বসে তাকে শুধু শরীয়ত বাস্তবায়নের পথেই বাধা দেয় না, বরং তাকে শরীয়তের এ মহান বিধানকে ধ্বংস করার মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলে। অনেক লোককেই ফিতনা পেয়ে বসেছে বর্তমান সময়ের বহু প্রেক্ষাপট এর সুস্পষ্ট প্রমাণ। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সরল সঠিক পথ ও দৃঢ়তা দান করুন।
লোকদেরকে সিরাতে মুসতাকিম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ফিতনা একটি ভয়াবহ বিষয় হওয়ার কারণে জামেয়ার অধিকাংশ কিতাবের অবস্থা হলো এই, যেগুলোর একটি বা একাধিক অধ্যায়ে শুধু ফিতনা ও তদসংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আমরা যুগে যুগে প্রত্যেক শহরের আলেমদেরকে দেখেছি, তাঁরা এ বিষয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন।
সুতরাং বর্তমান সময়ে এ সুদৃঢ় পথের পথিক ও সুমহান দায়িত্বের ধারক-বাহকের উপর আবশ্যক হলো ফিতনা ও তার উপকরণ থেকে বেঁচে থাকা, এ পথের অন্যান্য ভাইদেরকেও ফিতনা থেকে সতর্ক করে দেয়া এবং ফিতনা থেকে বেঁচে থাকা ও সতর্কতার জন্য পরস্পরে উপদেশমূলক আলোচনা করা। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَجِيبُوا لِلَّـهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ ۖ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّـهَ يَحُولُ بَيْنَ الْمَرْءِ وَقَلْبِهِ وَأَنَّهُ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ ﴿٢٤﴾ وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَّا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنكُمْ خَاصَّةً ۖ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّـهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ ﴿٢٥﴾
‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মান্য কর, যখন তোমাদেরকে সে কাজের প্রতি আহ্বান করা হয় যাতে রয়েছে তোমাদের জীবন। জেনে রেখো, আল্লাহ মানুষের এবং তার অন্তরের মাঝে অন্তরায় হয়ে যান। বস্তুতঃ তোমরা সবাই তাঁরই নিকট সমবেত হবে। আর তোমরা এমন ফাসাদ থেকে বেঁচে থাক, যা বিশেষতঃ শুধু তাদের উপরই পতিত হবে না যারা তোমাদের মধ্যে জালিম। জেনে রেখো, আল্লাহর আযাব অত্যন্ত কঠিন।’ (সূরা আনফাল 8׃ ২৪-২৫)
আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন,
وَالْعَصْرِ ﴿١﴾ إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ ﴿٢﴾ إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ﴿٣﴾
‘কসম যুগের! নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরে সদুপদেশ দেয় সত্যের, উপদেশ দেয় সবরের।’ (সূরা আসর ১০৩׃ ১-৩)
ইমাম মুসলিম রহ. থেকে বর্ণিত, আব্দুর রহমান ইবনে আবদে রব্বে কা’ব রহ. বলেন, ‘আমি মসজিদে হারামে প্রবেশ করলাম, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. কা’বার ছায়ায় বসা ছিলেন। আর লোকেরা তাঁর কাছে জমায়েত হল। আমিও তাদের সাথে বসে গেলাম। তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমরা এক সফরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। পথে আমরা এক জায়গায় অবস্থান করি। সেখানে আমাদের কেউ তাঁবু ঠিক করছিল, কেউ তীর প্রতিযোগিতা করছিল, কেউ তাদের গোত্রের সাথে অবস্থান করছিল। এমন সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোষক ঘোষণা দিতে লাগল, নামাজের সময় হয়ে গেছে। আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে হাজির হলাম। তিনি বললেন, ‘আমার পূর্বে প্রত্যেক নবীর উপর দায়িত্ব ছিল তিনি যা ভালো কিছু জানতেন তা উম্মতের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া এবং মন্দ বিষয়ের ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন করা। আর এ জাতির প্রথম অংশকে ফিতনা মুক্ত রাখা হয়েছে। এ জাতির শেষ ভাগে এমন মসিবত এবং মন্দ বিষয় আত্মপ্রকাশ করবে যা তোমরা অপছন্দ করে থাক, এমন ফিতনা আসবে যা পরস্পরে ফাসাদ সৃষ্টি করবে। যখন ফিতনার আগমন ঘটবে তখন মুমিন বলবে, এ ফিতনা আমার ধ্বংসের কারণ। অতঃপর ফিতনা থেকে মুক্তি লাভ করবে। আরেক ফিতনা আসবে তখনও মুমিন এই সেই বলতে থাকবে। সুতরাং যে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করতে চায়, জান্নাতে প্রবেশ করতে চায়- তার কাছে যেন আল্লাহ ও পরকালের উপর ঈমান থাকা অবস্থায় মৃত্যু এসে যায়। এবং সে যেন এমন লোকের কাছে চলে আসে যার কাছে আসা পছন্দনীয়। যে ব্যক্তি কোনো ইমামের হাতে বাইআত গ্রহণ করল, অতঃপর তাকে তার হাত ও অন্তরের খোরাকী দান করল- সে যেন যতটুকু সম্ভব তার অনুসরণ করে। যদি অন্য কেউ তার বিরুদ্ধাচরণ করতে আসে তাহলে তোমরা ভিন্ন লোকটির গর্দান উড়িয়ে দেবে।’
যয়নাব বিনতে জাহাশ রা. এর সূত্রে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে,
أَنَّ زَيْنَبَ بِنْتَ جَحْشٍ زَوْجَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ خَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمًا فَزِعًا مُحْمَرًّا وَجْهُهُ يَقُولُ ” لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَيْلٌ لِلْعَرَبِ مِنْ شَرٍّ قَدِ اقْتَرَبَ فُتِحَ الْيَوْمَ مِنْ رَدْمِ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مِثْلُ هَذِهِ ” . وَحَلَّقَ بِإِصْبَعِهِ الإِبْهَامِ وَالَّتِي تَلِيهَا . قَالَتْ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَنَهْلِكُ وَفِينَا الصَّالِحُونَ قَالَ ” نَعَمْ إِذَا كَثُرَ الْخَبَثُ ” .
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী যাইনাব বিনতু জাহ্শ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একদা রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় বের হলেন। তখন তাঁর বারাকাতময় চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করলো। তিনি বলছিলেন, ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’। আরব বিশ্বের আগত অকল্যাণের দরুন বড়ই পরিতাপ যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে। আজ ইয়া’জূজ মা’জূজ এর প্রাচীর এতটুকু পরিমাণ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এ সময় তিনি তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি ও শাহাদাত আঙ্গুলির দ্বারা বেড় বানালেন।
আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের মাঝে অনেক সৎ লোক থাকা অবস্থায়ও কি আমরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হব? তিনি বললেন, হ্যাঁ, যখন পাপাচার অধিক পরিমাণে বেড়ে যাবে। (ই.ফা. ৬৯৭৩, ই.সে. ৭০৩১)
উসামা ইবনে যায়েদ রা. এর সূত্রে বুখারী-মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْد ٍ ـ رضى الله عنهما ـ قَالَ أَشْرَفَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَلَى أُطُمٍ مِنْ آطَامِ الْمَدِينَةِ فَقَالَ ” هَلْ تَرَوْنَ مَا أَرَى ”. قَالُوا لاَ. قَالَ ” فَإِنِّي لأَرَى الْفِتَنَ تَقَعُ خِلاَلَ بُيُوتِكُمْ كَوَقْعِ الْقَطْرِ ”.
উসামা ইবনে যায়েদ রা. বলেন, ‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনার টিলাসমুহের একটির উপর উঠে বললেনঃ আমি যা দেখি তোমরা কি তা দেখতে পাও? উত্তরে সাহাবা-ই-কিরাম বললেন, না। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ নিঃসন্দেহে আমি দেখতে পাচ্ছি, তোমাদের ঘরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ফিতনা বৃষ্টিধারার মতো নিপতিত হচ্ছে। (বুখারী-৬৫৮২)
বিষয়টি যখন এমনই, তাই আমি বর্তমান সময়ে খোদা প্রদত্ত শরীয়ত ও দ্বীন প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট বন্ধু-বান্ধবদের সামনে উল্লিখিত আলোচ্য বিষয়ে এ নসিহতটি উপস্থাপন করলাম।
ফিতনার পরিচয়:
ইমাম যুহরী রহ. ‘তাহযীবুল লুগাত’ এ বলেন, আরবদের ভাষায় ‘আল-ফিতনা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, বিপদে পতিত হওয়া, পরীক্ষা করা ইত্যাদি। এ শব্দটি মূলত গৃহীত হয়েছে فتنت الفضة و الذهب (আমি স্বর্ণ-রূপা পরীক্ষা করেছি) থেকে। এটি তখনই বলা হয় যখন স্বর্ণ-রূপাকে আগুন দ্বারা বিগলিত করা হয়, যেন ভাল থেকে মন্দটি আলাদা হয়ে যায়।’
ইবনুল আরাবী রহ. বলেন, ‘الفتنة শব্দের অর্থ হচ্ছে, পরীক্ষা, পরিশ্রম, মাল, সন্তানাদি, কুফরি, মতপার্থক্য, আগুন দ্বারা জ্বালিয়ে দেয়া ইত্যাদি। কারো কারো মতে الفتنة শব্দের অর্থ অবিচার করা। বলা হয়ে থাকে, فلان مفتون في طلب الدنيا অর্থাৎ- অমুক দুনিয়া তালাশের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করেছে।’- লিসানুল আরব
এ ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হলো, শরীয়তের ভাষায় ফিতনা একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়, যা তার পূর্বাপরের দ্বারা বুঝে আসবে। ইবনুল কায়্যিম রহ.‘যাদুল মা’আদ’ (৩/১৫০)-এ বলেন, ‘যে فتنة শব্দটি আল্লাহ তা’আলা নিজের দিকে সম্পৃক্ত করেছেন অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের দিকে সম্পৃক্ত করে বলেছেন, যেমন আল্লাহর বাণী, وكذلك فتنا بعضهم ببعض মূসা আ. এর বক্তব্য, إن هي إلا فتنتك تضل بها من تشاء وتهدي من تشاء এক্ষেত্রে শব্দটির অর্থ হবে ভিন্ন। তা হচ্ছে, আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাকে ভাল-মন্দের নিয়ামত ও বিপদ-আপদের মাধ্যমে পরীক্ষা করা। সুতরাং মুশরিকদের পরীক্ষার মধ্যে এক ধরণের রং বিদ্যমান, আর মুমিনের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ও পরিজনের ক্ষেত্রে পরীক্ষার রং আলাদা। যে ফিতনা মুসলমানদের মাঝে দেখা যায় তা মূলত আলী ও মুআবিয়া রা. এর সঙ্গীদের মাঝে, জঙ্গে জামাল ও জঙ্গে সিফ্ফীনের মুজাহিদদের মাঝে এবং মুসলমানদের মাঝে সংঘটিত ফিতনার পর্যায়ভুক্ত। তাদের পরস্পরের জিহাদ ও একে অপরকে ছেড়ে যাওয়ার রং ভিন্ন রকম। এটি এমন ফিতনা, যে ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
الْقَاعِدُ فِيهَا خَيْرٌ مِنَ الْقَائِمِ وَالْقَائِمُ فِيهَا خَيْرٌ مِنَ الْمَاشِى وَالْمَاشِى فِيهَا خَيْرٌ مِنَ السَّاعِى
‘সেখানে(ফেতনার সময়) দণ্ডায়মান ব্যক্তির চেয়ে বসে থাকা ব্যক্তি উত্তম, হেঁটে চলা ব্যক্তির চেয়ে দণ্ডায়মান ব্যক্তি উত্তম, ধাবমানকারী ব্যক্তির চেয়ে হেঁটে চলা ব্যক্তি উত্তম।’(মুসলিম-৭৪২৯)
যে সব ফিতনার হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু’দলকেই পরিত্যাগ করতে বলেছেন এসব সে প্রকারের ফিতনা।
কখনো কখনো ‘ফিতনা’ দ্বারা ‘গোনাহ’ উদ্দেশ্য হয়। আল্লাহ তা’আলার বাণী, ومنهم من يقول اءذن لي ولاتفتني এ কথাটি জাদ্দ ইবনু কায়েসের। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাবুক যুদ্ধের জন্য আহ্বান করছিলেন তখন সে বলেছিল, আমাকে ঘরে থাকার অনুমতি দেন, আমাকে বনুল আসফারের মেয়েদের সম্মুখীন করে ফিতনায় ফেলবেন না। কারণ আমি তাদের থেকে ধৈর্য ধারণ করতে পারব না। তখন আল্লাহ তা’আলা বলেন, ألا في الفتنة سقطوا ‘তারা ফিতনার শিকার হয়ে গেছে’। অর্থাৎ তারা নেফাকের ফিতনায় জড়িয়ে পড়েছে। বনুল আসফারের মেয়েদের ফিতনা থেকে বাঁচার জন্য নেফাকের ফিতনাকে বেছে নিয়েছে।
হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন, ‘ফিতনা শব্দের মূল অর্থ- পরীক্ষা করা, যাচাই করা। শরীয়তের পরিভাষায় অপছন্দনীয় বিষয় প্রকাশপূর্বক পরীক্ষা করার নাম ফিতনা। যখন ভালটি পরখ করার জন্য স্বর্ণকে আগুন দ্বারা যাচাই করা হয় তখন বলা হয় فتنت الذهب । উদ্দিষ্ট বিষয়ে গাফলতি পাওয়া যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যেমন আল্লাহর বাণী, إنما أموالكم وأولادكم فتنة ‘নিশ্চয় ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য ফিতনা স্বরূপ।’ দ্বীন থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য বাধ্য করার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। আল্লাহর বাণী
إِنَّ الَّذِينَ فَتَنُوا الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَتُوبُوا فَلَهُمْ عَذَابُ جَهَنَّمَ وَلَهُمْ عَذَابُ الْحَرِيقِ (10)
যারা মুমিন পুরুষ ও নারীকে নিপীড়ন করেছে, অতঃপর তওবা করেনি, তাদের জন্যে আছে জাহান্নামের শাস্তি, আর আছে দহন যন্ত্রণা, (সূরা আল-বুরুজ ৮৫׃ ১০)
আমি বলি, ফিতনা শব্দটি পথভ্রষ্ট, অন্যায়, কুফর, শাস্তি ও অপমানের অর্থেও ব্যবহৃত হয়। পূর্বাপরের সম্পর্ক ও লক্ষণ অনুযায়ী উদ্দিষ্ট অর্থ বুঝা যাবে।’
বি.দ্র.- যে ফিতনা মতৈক্য ও ঝগড়া-বিবাদের সময় দেখা দেয়- সেটি এমন ফিতনা যার কারণে হকের সাথে বাতিলের তালগোল পেকে যায়, তাতে হক বিষয়টি প্রকাশিত হতে পারে না; বরং অধিকাংশ মুসলমানের কাছে অস্পষ্ট থেকে যায়। হুযাইফা রা. বলেন,
“لا تضرك الفتنة ما عرفت دينك،
إنما الفتنة إذا اشتبه عليك الحق والباطل
فلم تدر أيهما تتبع؟
فتلك الفتنة”.
[مصنف ابن أبي شيبة:٧٠/١٥]
‘সঠিক দ্বীন তোমার সামনে স্পষ্ট হওয়ার পরও যেন ফিতনা তোমাকে ক্ষতি করতে না পারে। ফিতনার কারণে যখন তোমার কাছে হক-বাতিল অস্পষ্ট হয়ে যাবে এবং বুঝতে পারছ না তুমি কোনটার অনুসরণ করবে- তাহলে ধরে নিবে এটিই ফিতনা।’ –( মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা-১৫/৭০)
সালাফে সালিহীনের বুঝ অনুযায়ী কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরতে হবে
খাইরুল কুরুন এবং উত্তমরূপে তাদের অনুসরণকারীদের দিকনির্দেশনায় কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা ফিতনার জমানায় মুজাহিদদের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জনের বিষয়। সব সময়ের জন্য এই মজবুত রজ্জুকে আঁকড়ে ধরাই মুক্তির পথ। যে ব্যক্তি আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ করতে পারল সেই হিদায়েত প্রাপ্ত এবং কামিয়াব। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّـهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّـهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّـهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ ﴿١٠٣﴾
‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরো, বিচ্ছিন্ন হয়ো না। এবং তোমাদের উপর দেয়া আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা একে অপরের শত্রু ছিলে, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের অন্তরসমূহকে এক করে দিলেন, যার ফলে সে নেয়ামত দ্বারা তোমরা একে অপরের ভাই হয়ে গেলে। তোমরা আগুনের এক গর্তের কিনারে অবস্থান করছিলে, তিনি তা থেকে তোমাদের রক্ষা করলেন। এভাবে আল্লাহ তা’আলা তাঁর নিদর্শনাবলী তোমাদের সামনে উপস্থাপন করেন যাতে তোমরা হিদায়েত লাভ কর।’ (সূরা আল-ইমরান ৩ ׃ ১০৩)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إنِّي قد خَلَّفتُ فيكم اثنين، لن تضلُّوا بعدهما أبدًا: كتاب الله، وسُنتي، ولن يتفرَّقَا حتى يرِدَا عليَّ الحوض
‘তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে গেলাম, যে দু’টির অনুসরণ করলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হচ্ছে কিতাবুল্লাহ, দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমার সুন্নত। হাউজে কাউসারে উপনীত হওয়ার আগ পর্যন্ত এ দু’টি জিনিস বিচ্ছিন্ন হবে না।’ –( আল-হাকিম-৪৩২১)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে আবযা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘যখন উসমান রা. এর ব্যাপারটি নিয়ে লোকজন সমস্যার সম্মুখীন হলো তখন আমি উবাই ইবনে কা’বকে বললাম, আবুল মুনজির! এ বিষয় থেকে আমাদের উত্তরণের পথ কী? তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাব এবং নবীর সুন্নত। এ বিষয়ে তোমাদের কাছে যা পরিষ্কার মনে হয় তা কর, আর যা তোমাদের কাছে অস্পষ্ট মনে হয় তার দায় দায়িত্ব এ বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমের হাতে ছেড়ে দাও।’ – আল-হাকিম
কুরআন-সুন্নাহকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরার এ বিষয়টি সালাফে সালিহীনের বুঝ ও আমলের সঙ্গে মিলা উচিত। কারণ আল্লাহ তা’আলা তাদের পবিত্রতা ঘোষণা করেছেন, তাদের উপর খুশি হয়েছেন এবং আমাদেরকে তাদের অনুসরণ করতে বলেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَمَن يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا (115
‘দলিল-প্রমাণ স্পষ্ট হওয়ার পরও যে রাসূলের বিরোধ মত পোষণ করল এবং মুমিনদের পথ ভিন্ন অন্য কিছুর অনুসরণ করল তাহলে আমি তাকে সেদিকেই ফিরিয়ে দিব এবং নিক্ষেপ করব তাকে জাহান্নামে। কত নিকৃষ্ট তার ঠিকানা!’ (সূরা আন-নিসা ৪׃১১৫)
আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে বলেন,
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللَّـهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ﴿١٠٠﴾
‘আর যারা সর্ব প্রথম হিজরতকারী ও আনসারদের মাঝে পুরাতন, এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তা’আলা সে সকল লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। আর তাদের জন্য তৈরি করে রেখেছেন জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নহরসমূহ। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই সবচেয়ে বড় সফলতা।’ (সূরা আত –তাওবা ৯׃ ১০০)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“ لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِي مَا أَتَى عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ حَتَّى إِنْ كَانَ مِنْهُمْ مَنْ أَتَى أُمَّهُ عَلاَنِيَةً لَكَانَ فِي أُمَّتِي مَنْ يَصْنَعُ ذَلِكَ وَإِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي ” . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ مُفَسَّرٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ لاَ نَعْرِفُهُ مِثْلَ هَذَا إِلاَّ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ
অর্থ: বানী ইসরাঈল যে অবস্থায় পতিত হয়েছিল, নিঃসন্দেহে আমার উম্মাতও সেই অবস্থার সম্মুখীন হবে, যেমন একজোড়া জুতার একটি আরেকটির মতো হয়ে থাকে। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ যদি প্রকাশ্যে তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করে থাকে, তবে আমার উম্মাতের মধ্যেও কেউ তাই করবে। আর বানী ইসরাঈল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল। আমার উম্মাত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। শুধু একটি দল ছাড়া তাদের সবাই জাহান্নামী হবে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! সে দল কোনটি? তিনি বললেনঃ আমি ও আমার সাহাবীগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত।(তিরমিজী-২৬৪১)
ইরবায ইবনে সারিয়া রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
قَالَ: صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا بِوَجْهِهِ فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَأَوْصِنَا قَالَ: «أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ كَانَ عبدا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ من يَعش مِنْكُم يرى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ» . رَوَاهُ أَحْمَدُ وَأَبُو دَاوُدَ
অর্থ: ইরবায ইবনে সারিয়া রা. বলেন, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে নামাজ আদায় করলেন, এরপর আমাদের সামনে এসে একটি চমৎকার নসিহত পেশ করলেন, যার দ্বারা অশ্রু সিক্ত হয় ও হৃদয় বিগলিত হয়। একজন বলছিল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! মনে হচ্ছে এটি বিদায়ী ভাষণ। অতএব, আপনি আমাদের কী উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে খোদাভীতি ও আনুগত্যের উপদেশ দিয়ে যাচ্ছি, যদিও তা একজন হাবশি গোলামের প্রতি হয়ে থাকে। আমার পরে যে বেঁচে থাকবে সে অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নত এবং খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নতকে মেনে চলবে এবং মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরবে। আর আবিষ্কৃত নতুন নতুন বিষয় থেকে বেঁচে থাকবে; কারণ, দ্বীনের মাঝে প্রত্যেক নতুন আবিষ্কার বিদআত, আর প্রত্যেক বিদআতই গুমরাহী।’ – আবু দাউদ
নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা
ফিতনার জমানায় যে বিষয়টি বান্দাকে সবচেয়ে বেশি হেফাজত করবে তা হচ্ছে, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ এবং তাঁর আনুগত্য, ইবাদত ও নেক আমলের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা। সুতরাং নেক বান্দা যখন কোনো বিষয়ে সন্দেহে পতিত হবে তখন দোয়া, ইস্তেগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার দিকে মনোনিবেশ করবে। ফিতনার জমানায় আনুগত্য ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ, হিদায়েত ও অবিচলতার সবচেয়ে বড় সহায়ক। এর দ্বারা বিপদ-আপদ দূর হয়, হিদায়েত নাযিল হয় এবং বান্দা অবিচলতার রিজিকে ধন্য হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
فَإِذَا بَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمْسِكُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ أَوْ فَارِقُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ وَأَشْهِدُوا ذَوَيْ عَدْلٍ مِّنكُمْ وَأَقِيمُوا الشَّهَادَةَ لِلَّـهِ ۚ ذَٰلِكُمْ يُوعَظُ بِهِ مَن كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّـهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ وَمَن يَتَّقِ اللَّـهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًا ﴿٢﴾ وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ ۚ وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّـهِ فَهُوَ حَسْبُهُ ۚ إِنَّ اللَّـهَ بَالِغُ أَمْرِهِ ۚ قَدْ جَعَلَ اللَّـهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا ﴿٣﴾
‘অতঃপর তারা যখন তাদের ইদ্দতকালে পৌঁছে, তখন তাদেরকে যথোপযুক্ত পন্থায় রেখে দেবে অথবা যথোপযুক্ত পন্থায় ছেড়ে দেবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে দু’জন নির্ভরযোগ্য লোককে সাক্ষী রাখবে। তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাক্ষ্য দিবে। এর দ্বারা যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে। আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন। (2) এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন।‘ (3) – (সূরা তালাক 65: ২-3)
وَمَثَلُ الَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُمُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّـهِ وَتَثْبِيتًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ كَمَثَلِ جَنَّةٍ بِرَبْوَةٍ أَصَابَهَا وَابِلٌ فَآتَتْ أُكُلَهَا ضِعْفَيْنِ فَإِن لَّمْ يُصِبْهَا وَابِلٌ فَطَلٌّ ۗ وَاللَّـهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ﴿٢٦٥﴾
‘যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও নিজের মনকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে, তাদের উদাহরণ টিলায় অবস্থিত বাগানের মত, যাতে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়; অতঃপর দ্বিগুণ ফসল দান করে। যদি এমন প্রবল বৃষ্টিপাত নাও হয়, তবে হাল্কা বর্ষণই যথেষ্ট। আল্লাহ তোমাদের কাজকর্ম যথার্থই প্রত্যক্ষ করেন।’ (সূরা বাকারা 2: ২৬৫)
وَلَوْ أَنَّا كَتَبْنَا عَلَيْهِمْ أَنِ اقْتُلُوا أَنفُسَكُمْ أَوِ اخْرُجُوا مِن دِيَارِكُم مَّا فَعَلُوهُ إِلَّا قَلِيلٌ مِّنْهُمْ ۖ وَلَوْ أَنَّهُمْ فَعَلُوا مَا يُوعَظُونَ بِهِ لَكَانَ خَيْرًا لَّهُمْ وَأَشَدَّ تَثْبِيتًا ﴿٦٦﴾ وَإِذًا لَّآتَيْنَاهُم مِّن لَّدُنَّا أَجْرًا عَظِيمًا ﴿٦٧﴾
‘আর যদি আমি তাদের নির্দেশ দিতাম যে, নিজেদের প্রাণ ধ্বংস করে দাও কিংবা নিজেদের নগরী ছেড়ে বেরিয়ে যাও, তবে তারা তা করত না; অবশ্য তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন। যদি তারা তাই করে যা তাদের উপদেশ দেয়া হয়, তবে তা অবশ্যই তাদের জন্য উত্তম এং তাদেরকে নিজের ধর্মের উপর সুদৃঢ় রাখার জন্য তা উত্তম হবে। (66) আর তখন অবশ্যই আমি তাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে মহান সওয়াব দেব। (67) (সূরা আন নিসা ৪:৬৬-৬৭)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
العِبَادَةُ في الهَرْجِ كَهِجْرَةٍ إِليَّ رواه مسلم
‘ফিতনার মুহূর্তে ইবাদত করা আমার উদ্দেশ্যে হিজরত করার মত।’ –(মুসলিম-৭৫৮৮)
ইমাম নববী রহ. বলেন, ‘হাদিসে উল্লিখিতهرج শব্দের অর্থ হচ্ছে ফিতনা, গোলমাল। এসব মুহূর্তে ইবাদতের ফজিলত অনেক; কিন্তু মানুষ এ মুহূর্ত গুলোতে উদাসীন থাকে, অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কিছু সংখ্যক লোক ছাড়া সময় দেয়ার মত কাউকে পাওয়া যায় না।’ -শরহুন নববী আলা মুসলিম:৯/৩৩৯
‘লাতাইফুল মাআরিফ:১৩৮’-এ ইবনে রজব রহ. বলেন, ‘মুসলিম শরিফে বর্ণিত:
عَن مَعْقِلِ بنِ يَسَارٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُما قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ العِبَادَةُ في الهَرْجِ كَهِجْرَةٍ إِليَّ رواه مسلم
মা’কাল ইবনে ইয়াসার রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘গোলযোগ মুহূর্তে ইবাদত করা আমার উদ্দেশ্যে হিজরত করার মত।’–(মুসলিম-৭৫৮৮)
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. এর বর্ণনায় এ হাদিসটি ‘ফিতনা’ শব্দে উল্লেখ হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, ফিতনার জমানায় মানুষ তার মন মতো চলে, দ্বীনের ধার ধারে না। তখন তাদের অবস্থা জাহেলী যুগের লোকদের মত হয়ে যায়। এমন কঠিন মুহূর্তে যে মানুষ থেকে আলাদা হয়ে দ্বীনকে আঁকড়ে ধরে, আল্লাহর ইবাদত করে, তাঁর সন্তুষ্টি মোতাবেক চলার চেষ্টা করে এবং অন্যায় অবিচার থেকে বেঁচে থাকে, সে ঐ ব্যক্তির মত যে জাহেলী যুগে রাসূলের প্রতি ঈমান এনে, তাঁর আদেশ মান্য করে, নিষেধকে পরিহার করে তাঁরই উদ্দেশ্যে হিজরত করল। এ ধরণের একটি বিষয়, যে ব্যক্তি গাফেল অপরাধী সম্প্রদায় থেকে ইবাদত করার উদ্দেশ্যে আলাদা হয়, তার কারণে কখনো কখনো সকল মানুষের বিপদ-আপদ দূর হয়ে যায়। যেন সে তাদেরকে বাঁচালো, তাদের বিপদ দূর করে দিল।
এক সালাফে সালেহ বলেন, গাফেলদের মাঝে আল্লাহর যিকিরকারী ঐ ব্যক্তির মত, যে নিশ্চিত ধ্বংসশীল সম্প্রদায়কে রক্ষা করে। গাফেল সম্প্রদায়ের মাঝে যদি আল্লাহর যিকিরকারী কোনো ব্যক্তি না থাকত তাহলে তারা ধ্বংস হয়ে যেত। পূর্বযুগের এক ব্যক্তি স্বপ্নে দেখল, বিভিন্ন শহরে ফেরেশতারা অবতরণ করে একে অপরকে বলছে, এই সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দাও। তখন তাদের কেউ কেউ বলে উঠল, কীভাবে ধ্বংস করব অথচ অমুক নামাজী, ইবাদতকারী এখানে বিদ্যমান? আরেক ব্যক্তি স্বপ্নযুগে এক কবিকে দেখল, সে বলছে,
‘যদি নামাজীরা না থাকত, যদি রোজাদাররা না থাকত, তাহলে তোমাদের জমিন এক ভেলকিতেই ধ্বংস হয়ে যেত; কারণ তোমরা নিকৃষ্ট সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর না।’
আল্লাহর পথের প্রিয় বন্ধু! এখন আপনার সামনে এমন কিছু ইবাদতের কথা আলোচনা করব, ফিতনার জমানায় প্রত্যেক বান্দার জন্য যা খুবই প্রয়োজনীয়।
নামাজ
নামাজ বান্দা এবং আল্লাহর মধ্যকার বিশেষ একটি বন্ধন, যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করে, যার মাঝে প্রশান্তি খোঁজে পায়। নামাজ বান্দার জন্য চোখের শীতলতা, উচ্চ মর্যাদা ও চির সফলতা লাভের কারণ, আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুসংহত পদ্ধতি। আল্লাহ তা’আলার ইরশাদ,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ ۚ إِنَّ اللَّـهَ مَعَ الصَّابِرِينَ ﴿١٥٣﴾
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছেন।’ (সূরা বাকারা ২׃ ১৫৩)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন,
يَا بِلاَلُ أَقِمِ الصَّلاَةَ أَرِحْنَا بِهَا
হে বিলাল। সলাত ক্বায়িম করো। আমরা এর মাধ্যমে স্বস্তি লাভ করতে পারবো। (আবু দাউদ-4985)
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«حُبِّبَ إِلَيَّ مِنَ الدُّنْيَا النِّسَاءُ وَالطِّيبُ، وَجُعِلَ قُرَّةُ عَيْنِي فِي الصَّلَاةِ»
‘দুনিয়ার তুলনায় নারী ও সুগন্ধিকে আমার কাছে প্রিয় করে দেয়া হয়েছে। আর আমার চোখের শীতলতা রাখা হয়েছে নামাজের মধ্যে।’ –(নাসাঈ-৩৯৩৯)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“ أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ وَهُوَ سَاجِدٌ فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ ”
‘সিজদার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে বেশি নৈকট্যশীল হয়। অতএব, তোমরা বেশি বেশি দোয়া করতে থাক।’ –(মুসলিম-৪৮২)
হুযাইফা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أن الرسول صلى الله عليه وسلم كان إذا حزبه أمر فزع إلى الصلاة) فهذا الحديث أخرجه أبو داود (1319) من حديث حذيفة رضي الله عنه ، وحسنه الألباني في صحيح أبي داود ( 1319 )
‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতেন তখন নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন।’ –(আবু দাউদ)
দোয়া ও যিকির
দোয়া ও যিকির মুমিন বান্দার সবসময়ের অস্ত্র; বিশেষকরে ফিতনার জমানায়। সুতরাং ফিতনার সময়কালে মুসলমান বেশি বেশি দোয়া-ইস্তেগফার ও যিকিরে মশগুল থাকবে; কারণ ফিতনার জমানায় কেউ দ্বীনের উপর অটল থাকতে পারবে না, কেবল আল্লাহ যাকে অটল রাখেন, যাকে ফিতনা থেকে বাঁচিয়ে রাখেন- সে ছাড়া। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ ۚ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ ﴿٦٠﴾
‘তোমাদের পালনকর্তা বলছেন, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের দোয়া কবুল করব। নিশ্চয় যারা আমার ইবাদত থেকে অহমিকা প্রদর্শন করে তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সূরা গাফির ৪০: ৬০)
فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ ﴿١٥٢﴾
‘তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর আমার শুকরিয়া আদায় কর, অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ – (সূরা বাকারা ২: ১৫২)
اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ ۖ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ ۗ وَلَذِكْرُ اللَّـهِ أَكْبَرُ ۗ وَاللَّـهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ ﴿٤٥﴾
আপনি আপনার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব পাঠ করুন এবং নামাজ কায়েম করুন। নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন তোমরা যা কর। (সূরা আনকাবুত 29:৪৫)
اذْهَبْ أَنتَ وَأَخُوكَ بِآيَاتِي وَلَا تَنِيَا فِي ذِكْرِي ﴿٤٢﴾
‘তুমি এবং তোমার ভাই আমার নিদর্শনাবলীসহ যাও, আর আমার যিকির থেকে গাফেল হয়ো না। (সূরা ত্বহা 20: 42)
أَمَّن يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ وَيَجْعَلُكُمْ خُلَفَاءَ الْأَرْضِ ۗ أَإِلَـٰهٌ مَّعَ اللَّـهِ ۚ قَلِيلًا مَّا تَذَكَّرُونَ ﴿٦٢﴾
‘বল তো কে অসহায়ের ডাকে সাড়া দেন যখন সে ডাকে এবং কষ্ট দূর করেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে পূর্ববর্তীদের স্থলাভিষিক্ত করেন? সুতরাং আল্লাহর সাথে অন্য কোনো উপাস্য আছে কি? তোমরা অতি সামান্যই ধ্যান কর।’ (সূরা নামল 27:৬২)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّ الدُّعَاءَ هُوَ الْعِبَادَةُ، ثُمَّ قَرَأَ: {ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ}
‘নিশ্চয়ই দোয়া-ই ইবাদত। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করেছেন: (অনুবাদ তোমাদের প্রতিপালক বলেন,) ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’ -আবু দাউদ, তিরমিযী
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ اللهُ تَعَالَى أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي فَإِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلاَ ذَكَرْتُهُ فِي مَلاَ خَيْرٍ مِنْهُمْ وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَيَّ بِشِبْرٍ تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَيَّ ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ بَاعًا وَإِنْ أَتَانِي يَمْشِي أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আল্লাহ্ ঘোষণা করেন, আমার ব্যাপারে বান্দা যেমন ধারণা করে আমি তেমন আচরণ করি। বান্দা যতক্ষণ আমাকে স্মরণ করে আমি তার সাথে থাকি। যদি আমাকে মনে মনে স্মরণ করে আমিও মনে মনে স্মরণ করি। যদি আমাকে কোনো লোকসমাজে স্মরণ করে আমি তাকে এমন ব্যক্তিদের মাঝে স্মরণ করি যারা তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যদি আমার জন্য এক বিঘাত অগ্রসর হয় তাহলে আমি তার জন্য এক হাত অগ্রসর হই, যদি এক হাত অগ্রসর হয় তাহলে আমি দু’হাত প্রসারিত সমান অগ্রসর হই, যদি আমার দিকে হেঁটে আসে তাহলে আমি দৌড়ে আসি।’ – [বুখারী-৭৪০৫,মুসলিম ৪৮/১, হাঃ ১৬৭৫, আহমাদ ৭৪২৬]
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতেন তখন বলতেন,
لا إله إلا الله الحليم العظيم، لا إله إلا الله رب العرش الكريم، لا إله إلا الله رب العرش العظيم، لا إله إلا الله رب السماوات ورب الأرض ورب العرش الكريم
এরপর দোয়া করতেন। – আহমাদ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে ফিতনার সময়গুলোতে বেশি বেশি আউযুবিল্লাহ পড়ার নির্দেশ দিতেন এবং বলতেন,
«تَعَوَّذُوا بِاللَّهِ مِنَ الْفِتَنِ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ»
‘তোমরা প্রকাশ্য-গোপন সব রকম ফিতনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর।’ -মুসলিম
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, লোকেরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রশ্ন করত। এমন কি প্রশ্ন করতে করতে তারা তাঁকে বিরক্ত করে তুলত। একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরে আরোহণ করলেন এবং বললেন, তোমরা (আজ) আমাকে যাই প্রশ্ন কর আমি তার উত্তর দেব। আনাস রা. বলেন, আমি ডানে বামে তাকাচ্ছিলাম। দেখতে পেলাম প্রত্যেকেই আপন বস্ত্রে মাথা গুজে কাঁদছে। তখন এমন এক ব্যক্তি -পারস্পরিক বাক-বিতণ্ডার সময় যাকে অন্য ব্যক্তির সন্তান বলে সম্বোধন করা হতো- উঠে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার পিতা কে? তিনি বললেন, হুযাইফা তোমার পিতা। এরপর উমর রা. সম্মুখে এসে বললেন, আমরা রব হিসেবে আল্লাহকে, দ্বীন হিসেবে ইসলামকে এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাসূল হিসেবে মেনে পরিতুষ্ট। ফিতনার অনিষ্ট থেকে আমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আজকের মত এত উত্তম বস্তু এবং এত খারাপ বস্তু আমি আর কখনো প্রত্যক্ষ করিনি। আমার সম্মুখে জান্নাত ও জাহান্নাম পেশ করা হয়েছে। এমনকি আমি সে দুটিকে এ দেয়ালের পাশেই দেখতে পাচ্ছিলাম।’
কাতাদা রহ. বলেন, উপরে বর্ণিত হাদিসটি নিম্নোক্ত আয়াত প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়। ইরশাদ হল,
يا أيها الذين آمنوا لا تسألوا عن أشياء إن تبد لكم تسؤكم
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা এমন বিষয়ে প্রশ্ন কর না, যা প্রকাশিত হলে তোমরা দুঃখিত হবে।’ -বুখারী
সা’দ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, لا إله إلا أنت سبحانك إني كنت من الظالمين মাছের পেটে থাকা অবস্থায় ইউনুস আ. এর এ দোয়ার মাধ্যমে যে মুসলমান ব্যক্তিই কোনো বিষয়ে দোয়া করবে, অবশ্যই আল্লাহ তার দোয়া কবুল করবেন।’ -তিরমিযী, আলবানী রহ. হাদিসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন
ইবনে উমর রা. সাফা পাহাড়ের কাছে গিয়ে পাঠ করতেন,
اللهم أحيني على سنة نبيك صلى الله عليه وسلم وتوفني على ملته وأعذني من مضلات الفتن
‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের উপর বাঁচিয়ে রেখো, তাঁর দ্বীনের উপর আমাকে মৃত্যু দান কর, আর আমাকে ফিতনার খারাপি থেকে রক্ষা কর।’ – আল-বায়হাকী
হুযাইফা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
ليأتينّ على الناس زمان، لا ينجو فيه إلا الذي يدعو الله بدعاءٍ كدعاء الغريق
‘মানুষের নিকট এমন সময় আসবে, যখন ডুবন্ত ব্যক্তির মত দোয়াকারী ছাড়া কেউ রেহাই পাবে না।’ –(মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা)
ফিতনার জমানায় নববী দোয়া ও যিকিরের অনেক হাদিস উলামায়ে কেরামের বিভিন্ন কিতাবে আলোচিত হয়েছে। অতএব, সেখানে নজর দেয়ার অনুরোধ রইল।
তওবা-ইস্তেগফার
গুনাহ থেকে তওবা এবং ইস্তেগফারের পাবন্দি বান্দাকে ফিতনা ও বিপদ-আপদের সময় সাহায্য করে, তার ভিতরে শক্তি পয়দা করে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَيَا قَوْمِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُم مِّدْرَارًا وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلَىٰ قُوَّتِكُمْ وَلَا تَتَوَلَّوْا مُجْرِمِينَ ﴿٥٢﴾
‘আর হে আমার কওম, তোমাদের পালনকর্তার কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ কর। তিনি আসমান থেকে তোমাদের উপর বারিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন, তোমরা কিন্তু অপরাধীদের মত বিমুখ হয়ো না।’ -সূরা হুদ 11: ৫২
قَالَ يَا قَوْمِ لِمَ تَسْتَعْجِلُونَ بِالسَّيِّئَةِ قَبْلَ الْحَسَنَةِ ۖ لَوْلَا تَسْتَغْفِرُونَ اللَّـهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ﴿٤٦﴾
‘সালেহ আ. বললেন, হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা কল্যাণের পূর্বে দ্রুত কেন অকল্যাণ কামনা করছ? তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছ না কেন? সম্ভবত তোমরা দয়া প্রাপ্ত হবে।’ সূরা নামল 27:৪৬
وَأَنِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُم مَّتَاعًا حَسَنًا إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى وَيُؤْتِ كُلَّ ذِي فَضْلٍ فَضْلَهُ ۖ وَإِن تَوَلَّوْا فَإِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ كَبِيرٍ ﴿٣﴾
‘আর তোমরা নিজেদের পালনকর্তা সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অনন্তর তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ কর। তাহলে তিনি তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎকৃষ্ট জীবনোপকরণ দান করবেন এবং অধিক আমলকারীকে বেশি দান করবেন আর যদি তোমরা বিমুখতা প্রদর্শন কর তবে আমি তোমাদের উপর এক মহা দিবসের আযাবের আশঙ্কা করছি।’ -সূরা হুদ 11:৩
ইমাম শানকিত্বী রহ. أضواء البيان في إيضاح القرآن بالقرآن (২/১৬৯)-এ উল্লেখ করেন, ‘আয়াতে কারিমাটি এ কথার প্রমাণ বহন করছে যে, আল্লাহর সমীপে গুনাহ থেকে তওবা ও ইস্তেগফার নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তম জীবনোপকরণ লাভের মাধ্যম। কারণ আল্লাহ তা’আলা এ বিষয়টিকে ধারাবাহিকভাবে তওবা-ইস্তেগফারের পর উল্লেখ করেছেন। এটি ‘শর্ত’ উল্লেখের পর ‘জাযা’ এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করার মত।
আসল কথা হলো, مَّتَاعًا حَسَنًا ‘দ্বারা উদ্দেশ্য, প্রশস্ত রিজিক, স্বাচ্ছন্দময় জীবন, দুনিয়ার সচ্ছলতা। আর أجل مسمي দ্বারা উদ্দেশ্য, মৃত্যু। এই সূরার মধ্যেই হুদ আ. এবং আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী এর সুস্পষ্ট প্রমাণ,
وَيَا قَوْمِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُم مِّدْرَارًا وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلَىٰ قُوَّتِكُمْ وَلَا تَتَوَلَّوْا مُجْرِمِينَ ﴿٥٢﴾
‘আর হে আমার কওম, তোমাদের পালন কর্তার কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ কর। তিনি আসমান থেকে তোমাদের উপর বারিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন। তোমরা কিন্তু অপরাধীদের মত বিমুখ হয়ো না।’ -সূরা হুদ ১১:৫২
নূহ আ. সম্পর্কে আল্লাহর বাণী,
فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا
অতঃপর বলেছিঃ তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। (সূরা নূহ ৭১:১০)
يُرْسِلِ السَّمَاء عَلَيْكُم مِّدْرَارًا
তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দিবেন, (সূরা নুহ ৭১;১১)
وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَارًا
তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন। (সূরা নূহ ৭১:১২)
আল্লাহ বলেন:
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ
যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমানদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরষ্কার দেব যা তারা করত। (সূরা আন-নাহল ১৬;৯৭)
আল্লাহর বাণী
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُواْ وَاتَّقَواْ لَفَتَحْنَا عَلَيْهِم بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَاء وَالأَرْضِ وَلَـكِن كَذَّبُواْ فَأَخَذْنَاهُم بِمَا كَانُواْ يَكْسِبُونَ
আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেযগারী অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানী ও পার্থিব নেয়ামত সমূহ উম্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি তাদের কৃতকর্মের বদলাতে। (সূরা আল-আরাফ ৭;৯৬)
وَلَوْ أَنَّهُمْ أَقَامُواْ التَّوْرَاةَ وَالإِنجِيلَ وَمَا أُنزِلَ إِلَيهِم مِّن رَّبِّهِمْ لأكَلُواْ مِن فَوْقِهِمْ وَمِن تَحْتِ أَرْجُلِهِم مِّنْهُمْ أُمَّةٌ مُّقْتَصِدَةٌ وَكَثِيرٌ مِّنْهُمْ سَاء مَا يَعْمَلُونَ
যদি তারা তওরাত, ইঞ্জিল এবং যা প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, পুরোপুরি পালন করত, তবে তারা উপর থেকে এবং পায়ের নীচ থেকে ভক্ষণ করত। তাদের কিছুসংখ্যক লোক সৎপথের অনুগামী এবং অনেকেই মন্দ কাজ করে যাচ্ছে। (সূরা আল-মায়েদা ৫;৬৬)
আল্লাহর বাণী,
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا *
وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ
‘যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার জন্য (সমাধানের) পথ বের করে দেন এবং তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দান করেন, যা তার কল্পনাতেও ছিল না।’(সূরা আত-তালাক ৬৫:২-৩)
ইত্যাদি অনেক আয়াতে কারিমা।
আল্লাহর বাণী,
وَمَا كَانَ اللَّـهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنتَ فِيهِمْ ۚ وَمَا كَانَ اللَّـهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ ﴿٣٣﴾
‘অথচ আল্লাহ কখনই তাদের উপর আযাব নাযিল করবেন না যতক্ষণ আপনি তাদের মাঝে অবস্থান করবেন। তাছাড়া তারা যতক্ষণ ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে আল্লাহ কখনও তাদের উপর আযাব দেবেন না।’ সূরা আনফাল 8:৩৩
ইমাম তবারী রহ. এ আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে আবু মুসা আশআরী রা. থেকে বর্ণনা করেন,
وما كان الله ليعذبهم
وأنت فيهم وما كان الله معذبهم وهم يستغفرون
এ আয়াত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু ইস্তেগফার তোমাদের মাঝে কিয়ামত পর্যন্ত বাকি থাকবে।’ -তাফসীরে তবারী: ১৩/৫১৩
ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘পরিচ্ছেদ: وما كان الله ليعذبهم وأنت فيهم وما كان الله معذبهم وهم يستغفرون প্রসঙ্গ। এ আয়াতের উপর দু’টি বিষয়ে আলোচনা করা যায়:
এক. আযাব প্রতিহতকারী ইস্তেগফার
আযাব আসে গোনাহের কারণে। আর ইস্তেগফার এমন গুনাহকে মিটিয়ে দেয়, যার কারণে আযাব সুনিশ্চিত। বুঝা গেল, ইস্তেগফারের মাধ্যমে আযাব দূর হয়। আল্লাহ বাণী,
الر ۚ كِتَابٌ أُحْكِمَتْ آيَاتُهُ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِن لَّدُنْ حَكِيمٍ خَبِيرٍ ﴿١﴾ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا اللَّـهَ ۚ إِنَّنِي لَكُم مِّنْهُ نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ ﴿٢﴾ وَأَنِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُم مَّتَاعًا حَسَنًا إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى وَيُؤْتِ كُلَّ ذِي فَضْلٍ فَضْلَهُ ۖ وَإِن تَوَلَّوْا فَإِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ كَبِيرٍ ﴿٣﴾
‘আলিফ, লা-ম, রা; এটি এমন এক কিতাব, যার আয়াতসমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত। অতঃপর যা সবিস্তারে বর্ণিত এক মহাজ্ঞানী সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ হতে। যেন তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো বন্দেগী না কর। নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতি তাঁরই পক্ষ হতে সতর্ককারী ও সুসংবাদ দাতা। তোমরা নিজেদের পালনকর্তার সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ কর। তাহলে তিনি তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎকৃষ্ট জীবনোপকরণ দান করবেন, সেই সাথে অধিক আমলকারীকে বেশি করে দেবেন।’ – সূরা হুদ 11:১-৩
উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বর্ণনা করলেন, তারা যখন এ কাজগুলো করবে, তো তাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উত্তম জীবনোপকরণ দান করা হবে। এরপর তাদের অধিক নেক আমল থেকে থাকলে তাদেরকে আরো বেশি দেয়া হবে।
নূহ আ. সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
وَيَا قَوْمِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُم مِّدْرَارًا وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلَىٰ قُوَّتِكُمْ وَلَا تَتَوَلَّوْا مُجْرِمِينَ ﴿٥٢﴾
‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের পালনকর্তার কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তারই প্রতি মনোনিবেশ কর; তিনি আসমান থেকে তোমাদের উপর বৃষ্টিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন।’ (সূরা হুদ ১১׃৫২)
এটা এজন্য যে, আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ ﴿٣٠﴾
‘তোমরা যে মসিবতে আক্রান্ত হয়েছ তা তোমাদের হাতের কামাই, তিনি তোমাদের অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ ( সূরা আশ-শুরা ৪২׃৩০)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ تَوَلَّوْاْ مِنكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ إِنَّمَا اسْتَزَلَّهُمُ الشَّيْطَانُ بِبَعْضِ مَا كَسَبُواْ وَلَقَدْ عَفَا اللّهُ عَنْهُمْ إِنَّ اللّهَ غَفُورٌ حَلِيمٌ
তোমাদের যে দুটি দল লড়াইয়ের দিনে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল শয়তান তাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল, তাদেরই পাপের দরুন। (সূরা ইমরান ৩׃১৫৫)
আল্লাহর বাণী,
‘أَوَلَمَّا أَصَابَتْكُم مُّصِيبَةٌ قَدْ أَصَبْتُم مِّثْلَيْهَا قُلْتُمْ أَنَّى هَـذَا قُلْ هُوَ مِنْ عِندِ أَنْفُسِكُمْ إِنَّ اللّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
যখন তোমাদের উপর একটি মুসীবত এসে পৌছাল, অথচ তোমরা তার পূর্বেই দ্বিগুণ কষ্টে পৌছে গিয়েছ, তখন কি তোমরা বলবে, এটা কোথা থেকে এল? তাহলে বলে দাও, এ কষ্ট তোমাদের উপর পৌছেছে তোমারই পক্ষ থেকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ের উপর ক্ষমতাশীল। (সূরা ইমরান ৩;১৬৫)
আল্লাহর বাণী
وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ (30)
‘যদি তোমাদেরকে কোনো মসিবত স্পর্শ করে তাহলে তা তোমাদের কর্মফল। (সূরা আশ-শুরা ৪২׃৩০)
দুই. ইস্তেগফারের মাধ্যমে প্রতিহত আযাব
প্রতিহত আযাবটি আসমানি আযাব হতে পারে, মানুষের পক্ষ থেকেও হতে পারে। তবে আল্লাহ তা’আলা উভয়টিকেই আযাব বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহর বাণী,
وَإِذْ نَجَّيْنَاكُم مِّنْ آلِ فِرْعَوْنَ يَسُومُونَكُمْ سُوءَ الْعَذَابِ يُذَبِّحُونَ أَبْنَاءَكُمْ وَيَسْتَحْيُونَ نِسَاءَكُمْ ۚ وَفِي ذَٰلِكُم بَلَاءٌ مِّن رَّبِّكُمْ عَظِيمٌ ﴿٤٩﴾
‘আর স্মরণ কর সে সময়ে কথা, যখন আমি তোমাদেরকে মুক্তিদান করেছি ফেরাউনের বাহিনীর কবল থেকে যারা তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি দান করত; তোমাদের পুত্রসন্তানদেরকে জবাই করত এবং তোমাদের স্ত্রীদেরকে বাঁচিয়ে রাখত।’ -সূরা বাকারা 2:৪৯
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
قَاتِلُوهُمْ يُعَذِّبْهُمُ اللّهُ بِأَيْدِيكُمْ وَيُخْزِهِمْ وَيَنصُرْكُمْ عَلَيْهِمْ َ
‘তাদের সাথে কিতাল কর, আল্লাহ তোমাদের হাতে তাদেরকে শাস্তি দেবেন, তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন এবং তাদের বিপক্ষে তোমাদেরকে সাহায্য করবেন।’ (সূরা আত-তাওবা ৯׃১৪)
এমনিভাবে,
قُلْ هَلْ تَرَبَّصُونَ بِنَا إِلَّا إِحْدَى الْحُسْنَيَيْنِ ۖ وَنَحْنُ نَتَرَبَّصُ بِكُمْ أَن يُصِيبَكُمُ اللَّـهُ بِعَذَابٍ مِّنْ عِندِهِ أَوْ بِأَيْدِينَا ۖ فَتَرَبَّصُوا إِنَّا مَعَكُم مُّتَرَبِّصُونَ ﴿٥٢﴾
‘আপনি বলুন, তোমরা তো তোমাদের জন্য দু’টি কল্যাণের একটি প্রত্যাশা কর; আর আমরা অপেক্ষায় আছি তোমাদের জন্য, আল্লাহ তোমাদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন নিজের পক্ষ থেকে অথবা আমাদের হাতে।’ (সূরা তওবা 9: ৫২)
কেননা আযাব আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, মানুষের পক্ষ থেকেও হয়। আল্লাহ পাক বলেন,
قَاتِلُوهُمْ يُعَذِّبْهُمُ اللّهُ بِأَيْدِيكُمْ وَيُخْزِهِمْ وَيَنصُرْكُمْ عَلَيْهِمْ َ
‘তাদের সাথে কিতাল কর, আল্লাহ তোমাদের হাতে তাদেরকে শাস্তি দেবেন, তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন এবং তাদের বিপক্ষে তোমাদেরকে সাহায্য করবেন।’ (সূরা আত-তাওবা ৯׃১৪)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْ لَزِمَ الاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللَّهُ لَهُ مِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا وَمِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ
‘যে ইস্তেগফারকে নিজের জন্য আবশ্যকীয় বস্তু হিসাবে নির্ধারণ করে নিয়েছে আল্লাহ তা’আলা তার সকল সমস্যা সমাধানের পথ বের করে দেন, তাকে চিন্তামুক্ত করে দেন এবং তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দান করেন, যা সে কল্পনাও করত না।’ –(আবু দাউদ, আলবানী রহ. এর মতে হাদিসটির সনদগত মান ‘জঈফ’, তবে তার অর্থ সঠিক।)
আমর বিল মারূফ, নাহি আনিল মুনকার এবং হকের দাওয়াত
ফিতনার জমানায় মুক্তির যে সব পথ শরীয়ত কর্তৃক বর্ণিত তা হচ্ছে, সৎপথের নসিহত, আমর বিল মা’রূফ, নাহি আনিল মুনকার। এসব আমল ব্যক্তি ও সমাজকে ফিতনার জমানায় বিপদ-আপদ থেকে রক্ষ করার উপযুক্ত মাধ্যম। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
فَلَوْلَا كَانَ مِنَ الْقُرُونِ مِن قَبْلِكُمْ أُولُو بَقِيَّةٍ يَنْهَوْنَ عَنِ الْفَسَادِ فِي الْأَرْضِ إِلَّا قَلِيلًا مِّمَّنْ أَنجَيْنَا مِنْهُمْ ۗ وَاتَّبَعَ الَّذِينَ ظَلَمُوا مَا أُتْرِفُوا فِيهِ وَكَانُوا مُجْرِمِينَ ﴿١١٦﴾
‘তাহলে তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলোর মধ্যে এমন সৎকর্মশীল কেন রইল না, যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে বাধা দিত; তবে মুষ্টিমেয় লোক ছিল যাদেরকে আমি তাদের মধ্য হতে রক্ষা করেছি। আর পাপিষ্ঠরা তো ভোগ বিলাসে মত্ত ছিল যার সামগ্রী তাদেরকে যথেষ্ট দেয়া হয়েছিল। আসলে তারা ছিল মহাঅপরাধী।’ –(সূরা হুদ 11:১১৬)
আল্লাহর বাণী,
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّـهَ وَرَسُولَهُ ۚ أُولَـٰئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّـهُ ۗ إِنَّ اللَّـهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ﴿٧١﴾
‘আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তা’আলা দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ -সূরা তাওবা 9:৭১
সুতরাং আল্লাহর রহমত ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের উপর বর্ষিত হয়। আর আমর বিল মা’রূফ, নাহি আনিল মুনকার অবশ্যই একটি সৎকর্ম।
আল্লাহ তা’আলার ইরশাদ,
وَاسْأَلْهُمْ عَنِ الْقَرْيَةِ الَّتِي كَانَتْ حَاضِرَةَ الْبَحْرِ إِذْ يَعْدُونَ فِي السَّبْتِ إِذْ تَأْتِيهِمْ حِيتَانُهُمْ يَوْمَ سَبْتِهِمْ شُرَّعًا وَيَوْمَ لَا يَسْبِتُونَ ۙ لَا تَأْتِيهِمْ ۚ كَذَٰلِكَ نَبْلُوهُم بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ ﴿١٦٣﴾
وَإِذْ قَالَتْ أُمَّةٌ مِّنْهُمْ لِمَ تَعِظُونَ قَوْمًا ۙ اللَّـهُ مُهْلِكُهُمْ أَوْ مُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا ۖ قَالُوا مَعْذِرَةً إِلَىٰ رَبِّكُمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ ﴿١٦٤﴾ فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ أَنجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ ﴿١٦٥﴾ فَلَمَّا عَتَوْا عَن مَّا نُهُوا عَنْهُ قُلْنَا لَهُمْ كُونُوا قِرَدَةً خَاسِئِينَ ﴿١٦٦﴾
‘আর তাদের কাছে সে জনপদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর যা ছিল নদীর তীরে অবস্থিত। যখন শনিবার দিনের নির্দেশের ব্যাপারে সীমাতিক্রম করতে লাগল, যখন আসতে লাগল মাছগুলো তাদের কাছে শনিবার দিন পানির উপর, আর যেদিন শনিবার হতো না, আসত না। এভাবে আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি। কারণ, তারা ছিল নাফরমান। আর যখন তাদের মধ্য থেকে এক সম্প্রদায় বলল, কেন সে লোকদের সদুপদেশ দিচ্ছেন, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিতে চান কিংবা আযাব দিতে চান কঠিন আযাব? সে বলল, তোমাদের পালনকর্তার সামনে দোষ ফুরাবার জন্য এবং এ জন্য যেন তারা ভীত হয়। অতঃপর যখন তারা সেসব বিষয় ভুলে গেল, যা তাদেরকে বোঝানো হয়েছিল, তখন আমি সেসব লোককে মুক্তি দান করলাম যারা মন্দ কাজ থেকে বারণ করত। আর পাকড়াও করলাম গুনাহগারদেরকে নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের নাফরমানীর দরুন। তারপর যখন তারা এগিয়ে যেতে লাগল সে কর্মে যা থেকে তাদের বারণ করা হয়েছিল, তখন আমি নির্দেশ দিলাম যে, তোমরা লাঞ্ছিত বানর হয়ে যাও।’ -সূরা আরাফ 7: ১৬৩-1৬৬
সায়্যিদ কুতুব রহ. এ আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে বলেন,
‘সুতরাং এটা হচ্ছে আমাদের দায়িত্ব, আমরা তা আদায় করব। সৎ কাজের আদেশ করব, অসৎ কাজ থেকে বারণ করব; আল্লাহর বিধিবিধান লঙ্ঘন করার ভয় দেখাব। যাতে করে আল্লাহর কাছে আমরা ওযরখাহী করতে পারি। তিনি যেন জানেন, আমরা আমাদের দায়িত্ব পূরণ করেছি। তাহলে হতে পারে এসব কঠিন হৃদয়ে নসিহতগুলো কাজে লাগবে, তাকওয়ার উপলব্ধি আসবে।
শহরের লোকজন তিন শ্রেণী বা তিন জাতিতে বিভক্ত। ইসলামী পরিভাষায় সেসব মানুষের সমষ্টিকে উম্মত বলা হয়, যারা আকিদা ও চলন-বলনে এক ধর্মের, যাদের নেতৃত্বও এক। অতীত বা বর্তমান জাহেলী মতবাদ যে সংজ্ঞা উপস্থাপন করে সেভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। জাহেলী সংজ্ঞা হচ্ছে, মানুষের এমন সমষ্টি, যারা এক ভূখণ্ডে বাস করে, যাদেরকে এক সরকার শাসন করে। এটা এমন বুঝ যাকে ইসলাম সমর্থন করে না। এটা অতীত বা বর্তমান কোনো জাহেলী পরিভাষা হবে। আবার কখনো এক গ্রামের অধিবাসীই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত থাকে। এক শ্রেণী আছে, যারা গুনাহগার প্রতারক। আরেক শ্রেণী আছে যারা অস্বীকৃত, ব্যাখ্যা, নসিহতের মাধ্যমে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে গুনাহ ও প্রতারণার পথে চলে। তৃতীয় প্রকার হচ্ছে যারা মুনকার ও আহলে মুনকারকে ছেড়ে দিয়ে নেতিবাচক অস্বীকৃতির যায়গায় অবস্থান করে; কিন্তু তাকে ইতিবাচক আমলের মাধ্যমে দূর করে না। এগুলো কাল্পনিক অনেক পথ ও পদ্ধতি, যা তিন শ্রেণীকে তিন জাতিতে পরিণত করেছে। সুতরাং যখন সে উপদেশ খোঁজে পায় না, নসিহত তার কোনো কাজে আসে না এবং সে বিভ্রান্তির মাঝেই চলতে থাকে তখন আল্লাহর কালিমার প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়িত হয়। যারা অন্যায়কে বারণ করে তাদেরকে রক্ষা করা হয়, আর অবাধ্য কাফেরদেরকে কঠিন আযাব দ্বারা পাকড়াও করা হয়। অপর দিকে তৃতীয় প্রকার লোক বা জাতি যাদের ব্যাপারে কুরআনে কারিম নীরব- তাদের বিষয়টি হালকাভবে নিয়ে যদিও তাদেরকে আযাবের দ্বারা পাকড়াও করা হবে না; কারণ তারা ইতিবাচক অস্বীকৃতিকে উপেক্ষা করে নেতিবাচক অস্বীকৃতির সীমায় অবস্থান করেছে, তারপরও তারা অবহেলার উপযুক্ত, যদিও শাস্তি দেয়া হবে না।
فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ أَنجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ ﴿١٦٥﴾ فَلَمَّا عَتَوْا عَن مَّا نُهُوا عَنْهُ قُلْنَا لَهُمْ كُونُوا قِرَدَةً خَاسِئِينَ ﴿١٦٦
‘অতঃপর যখন তারা সেসব বিষয় ভুলে গেল, যা তাদেরকে বুঝানো হয়েছিল, তখন আমি সেসব লোককে মুক্তি দান করলাম যারা মন্দ কাজ থেকে বারণ করত। আর পাকড়াও করলাম গুনাহগারদেরকে নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের নাফরমানীর দরুন। তারপর যখন তারা এগিয়ে যেতে লাগল সে কর্মে, যা থেকে তাদের বারণ করা হয়েছিল, তখন আমি নির্দেশ দিলাম যে, তোমরা লাঞ্ছিত বানর হয়ে যাও।’ -সূরা আরাফ 7: 165-১৬৬
কুরআনী নস যে অবাধ্যতার কথা উল্লেখ করেছে তার দ্বারা উদ্দেশ্য কুফর। যাকে কোনো সময় যুল্ম শব্দে কখনো ফিস্ক শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। যেমনিভাবে কুফর-শিরককে কুরআনের ভাষায় অধিকাংশ জায়গায় যুল্ম ও ফিস্ক শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। এগুলো এমন কিছু শব্দ যা পরবর্তী ফিকহী পরিভাষার বিপরীত। কারণ, কুরআন যে অর্থটি উদ্দেশ্য করেছে তা পরবর্তীতে ফিকহী আন্দাজে প্রকাশিত অর্থের সাথে হুবহু মিল নেই। সুতরাং উল্লিখিত আয়াতে কঠিন শাস্তি যা ধূর্ত অবাধ্যদের উপর আরোপিত হয়েছে তার দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানবাকৃতি থেকে বানরাকৃতিতে পরিণত হওয়া। যখন তারা মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে তখন মনুষ্যত্বও হারিয়েছে। তারা পশুর জগতে পারি জমিয়েছে যখন মানুষের গুণকে পদদলিত করেছে। তাদেরকে বলা হলো, তারা নিজেদের জন্য যেভাবে লাঞ্ছনা ও অবমাননার ইচ্ছা করছে সেভাবে যেন হয়ে যায়। সুতরাং কীভাবে তারা বানরে পরিণত হল? বানর হওয়ার পর তাদের কী হল? তারা কি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল যেভাবে প্রত্যেক বিকৃত জিনিস তার জাতি থেকে বেরিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়? নাকি বানর থাকা অবস্থায় তাদের বংশানুক্রম চলতে থাকে? …….. এসব বিষয়ে তাফসীরে অনেক বর্ণনা রয়েছে। এসব ব্যাপারে কুরআনুল কারিম নীরব। হাদিসে রাসূলেও এ ব্যাপারে কোনো কিছু বর্ণিত হয়নি। অতএব, এ জাতীয় ব্যাপার নিয়ে আমাদের তলিয়ে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই।’ – ফী যিলালিল্ কুরআন:৩/১৩৮৪
হযরত হুযাইফা রা. থেকে বর্ণিত:
عَنْ حُذَيْفَةَ، قَالَ كُنَّا عِنْدَ عُمَرَ فَقَالَ أَيُّكُمْ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَذْكُرُ الْفِتَنَ فَقَالَ قَوْمٌ نَحْنُ سَمِعْنَاهُ . فَقَالَ لَعَلَّكُمْ تَعْنُونَ فِتْنَةَ الرَّجُلِ فِي أَهْلِهِ وَجَارِهِ قَالُوا أَجَلْ . قَالَ تِلْكَ تُكَفِّرُهَا الصَّلاَةُ وَالصِّيَامُ وَالصَّدَقَةُ وَلَكِنْ أَيُّكُمْ سَمِعَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَذْكُرُ الْفِتَنَ الَّتِي تَمُوجُ مَوْجَ الْبَحْرِ قَالَ حُذَيْفَةُ فَأَسْكَتَ الْقَوْمُ فَقُلْتُ أَنَا . قَالَ أَنْتَ لِلَّهِ أَبُوكَ . قَالَ حُذَيْفَةُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ “ تُعْرَضُ الْفِتَنُ عَلَى الْقُلُوبِ كَالْحَصِيرِ عُودًا عُودًا فَأَىُّ قَلْبٍ أُشْرِبَهَا نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ وَأَىُّ قَلْبٍ أَنْكَرَهَا نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ بَيْضَاءُ حَتَّى تَصِيرَ عَلَى قَلْبَيْنِ عَلَى أَبْيَضَ مِثْلِ الصَّفَا فَلاَ تَضُرُّهُ فِتْنَةٌ مَا دَامَتِ السَّمَوَاتُ وَالأَرْضُ وَالآخَرُ أَسْوَدُ مُرْبَادًّا كَالْكُوزِ مُجَخِّيًا لاَ يَعْرِفُ مَعْرُوفًا وَلاَ يُنْكِرُ مُنْكَرًا إِلاَّ مَا أُشْرِبَ مِنْ هَوَاهُ ” . قَالَ حُذَيْفَةُ وَحَدَّثْتُهُ أَنَّ بَيْنَكَ وَبَيْنَهَا بَابًا مُغْلَقًا يُوشِكُ أَنْ يُكْسَرَ . قَالَ عُمَرُ أَكَسْرًا لاَ أَبَا لَكَ فَلَوْ أَنَّهُ فُتِحَ لَعَلَّهُ كَانَ يُعَادُ . قُلْتُ لاَ بَلْ يُكْسَرُ . وَحَدَّثْتُهُ أَنَّ ذَلِكَ الْبَابَ رَجُلٌ يُقْتَلُ أَوْ يَمُوتُ . حَدِيثًا لَيْسَ بِالأَغَالِيطِ . قَالَ أَبُو خَالِدٍ فَقُلْتُ لِسَعْدٍ يَا أَبَا مَالِكٍ مَا أَسْوَدُ مُرْبَادًّا قَالَ شِدَّةُ الْبَيَاضِ فِي سَوَادٍ . قَالَ قُلْتُ فَمَا الْكُوزُ مُجَخِّيًا قَالَ مَنْكُوسًا .
অর্থ:হযরত হুযাইফা রা. থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, একদিন আমরা উমর রা. এর কাছে ছিলাম। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ফিতনা সম্পর্কে আলোচনা করতে শুনেছ? উপস্থিত একদল বললেন, আমরা শুনেছি। উমর রা. বললেন, তোমরা হয়ত একজনের পরিবার ও প্রতিবেশীর ফিতনার কথা মনে করেছ। তারা বললেন, হ্যাঁ! অবশ্যই। তিনি বললেন, সালাত, রোযা ও সাদকার মাধ্যমে এগুলোর কাফফরা হয়ে যায়। উমর রা. বললেন, না! আমি জানতে চেয়েছি, তোমাদের কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সে বৃহৎ ফিতনার কথা আলোচনা করতে শুনেছে, যা সমুদ্র তরঙ্গের মত ধেয়ে আসবে? হুযাইফা রা. বলেন, প্রশ্ন শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। আমি বললাম, আমি শুনেছি। উমর রা. বললেন, তুমি শুনেছ, মা-শা আল্লাহ। হুযাইফা রা. বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, চাটাই বুননের মতো এক এক করে ফিতনা মানুষের অন্তরে আসতে থাকে। যে অন্তরে তা গেঁথে যায়, তাতে একটি করে কালো দাগ পড়ে। আর যে অন্তর তা প্রত্যাখ্যান কবে, তাতে একটি করে শুভ্রোজ্জ্বল চিহ্ন পড়বে। এমনি করে দুটি অন্তর দু’ধরণের হয়ে যায়। একটি শ্বেত পাথরের মত; আসমান ও জমিন যতদিন থাকবে ততদিন কোনো ফিতনা তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর অপরটি হয়ে যায় উল্টানো কালো কলসির মত, প্রবৃত্তি তার মধ্যে যা সেধে দিয়েছে তা ছাড়া ভাল-মন্দ বলতে সে কিছুই চিনে না। হুযাইফা রা. বলেন, উমর রা.-কে আরো বললাম, আপনি এবং সে ফিতনার মধ্যে একটি বন্ধ দরজা রয়েছে। অচিরেই সেটি ভেঙে ফেলা হবে। উমর রা. বললেন, সর্বনাশ! তবু ভেঙে ফেলা হবে? যদি ভেঙে ফেলা না হতো, তাহলে হয়ত পুনরায় বন্ধ করা যেত। হুযাইফা রা. উত্তর করলেন, না ভেঙে ফেলাই হবে। হযাইফা রা. বলেন, আমি উমর রা.-কে এ কথাও শুনিয়েছি, সে দরজাটি হলো একজন মানুষ; সে নিহত হবে কিংবা স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবে। এটি কোনো গল্প নয় বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস। বর্ণনাকারী আবু খালিদ বলেন, আমি সা’দকে জিজ্ঞেস করলাম, এর অর্থ কী? উত্তরে তিনি বললেন, ‘কালো-সাদায় মিশ্রিত রং’। আমি বললাম, এর অর্থ কী? তিনি বললেন, ‘উল্টানো কলসি’।’ – মুসলিম:১৪৪
নু’মান ইবনে বাশীর রা. হতে বর্ণিত।
عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ “ مَثَلُ الْقَائِمِ عَلَى حُدُودِ اللَّهِ وَالْوَاقِعِ فِيهَا كَمَثَلِ قَوْمٍ اسْتَهَمُوا عَلَى سَفِينَةٍ، فَأَصَابَ بَعْضُهُمْ أَعْلاَهَا وَبَعْضُهُمْ أَسْفَلَهَا، فَكَانَ الَّذِينَ فِي أَسْفَلِهَا إِذَا اسْتَقَوْا مِنَ الْمَاءِ مَرُّوا عَلَى مَنْ فَوْقَهُمْ فَقَالُوا لَوْ أَنَّا خَرَقْنَا فِي نَصِيبِنَا خَرْقًا، وَلَمْ نُؤْذِ مَنْ فَوْقَنَا. فَإِنْ يَتْرُكُوهُمْ وَمَا أَرَادُوا هَلَكُوا جَمِيعًا، وَإِنْ أَخَذُوا عَلَى أَيْدِيهِمْ نَجَوْا وَنَجَوْا جَمِيعًا
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে মহান আল্লাহর নির্ধারিত সীমায় প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং যে তাতে সীমালঙ্ঘন করে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই যাত্রীদলের মতো, যারা এক নৌযানে নিজেদের স্থান নির্ধারণ করে নিলো। তাদের কেউ স্থান পেল উপর তলায় আর কেউ নীচ তলায় (পানির ব্যবস্থা ছিল উপর তলায়)। কাজেই নীচতলার লোকেরা পানি সংগ্রহকালে উপর তলার লোকদের ডিঙ্গিয়ে যেত। তখন নীচতলার লোকেরা বলল, উপর তলার লোকদের কষ্ট না দিয়ে আমরা যদি নিজেদের অংশে একটি ছিদ্র করে নেই (তবে ভালো হয়)। এমতাবস্থায় তারা যদি এদেরকে আপন মর্জির উপর ছেড়ে দেয় তাহলে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি তারা এদের হাত ধরে রাখে তবে তারা এবং সকলেই রক্ষা পাবে।’ -বুখারী: ২৪৯৩
সুতরাং যখন ফিতনা ও অবাধ্যতা ছেয়ে যায় এবং সমাজে তার বিস্তৃতি ঘটে তখন ‘আমর বিল মা’রূফ, নাহি আ’নিল মুনকার’ একটি উপযুক্ত মুক্তির পথ ।
রাসূলের অনুসরণ, বিদআত ও কুমন্ত্রণা থেকে সংবরণ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ অমান্য করা, তাঁর অনুসরণ না করা ফিতনার বড় একটি কারণ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেমনটি তাঁর মহাগ্রন্থে ইরশাদ করেছেন,
‘যারা তাঁর নির্দেশ অমান্য করে তাদেরকে যেন সতর্ক করে দেয় যে, তাদেরকে ফিতনা গ্রাস করবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে আক্রান্ত করবে।’
অপরদিকে হিদায়েত ও জান্নাতে অনুপ্রবেশকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যের সাথে জুড়ে দিয়েছেন।
قُلْ أَطِيعُوا اللَّـهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ ۖ فَإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُم مَّا حُمِّلْتُمْ ۖ وَإِن تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا ۚ وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ ﴿٥٤﴾
‘বলুন, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের অনুসরণ কর। যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তবে তাঁর উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্যে সে দায়ী এবং তোমাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্যে তোমরা দায়ী। তোমরা যদি তাঁর আনুগত্য কর, তবে সৎ পথ পাবে। রাসূলের দায়িত্ব তো কেবল সুস্পষ্টরূপে পৌঁছে দেয়া।’ -সূরা নূর 24:৫৪)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْ أَطَاعَنِي فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ عَصَى اللهَ وَمَنْ أَطَاعَ أَمِيرِي فَقَدْ أَطَاعَنِي وَمَنْ عَصَى أَمِيرِي فَقَدْ عَصَانِي.
অর্থ: যে আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহ্রই আনুগত্য করল। আর যে আমার নাফরমানী করল, সে আল্লাহ্রই নাফরমানী করল। এবং যে আমার (নির্বাচিত) আমীরের আনুগত্য করল, সে আমারই আনুগত্য করল। আর যে আমার (নির্বাচিত) আমীরের নাফরমানী করল সে আমারই নাফরমানী করল। [বুখারী-৭১৩৭; মুসলিম ৩৩/৮, হাঃ ১৮৩৫, আহমাদ ৯৩৯৬]
ইমাম দারিমী উমর ইবনে ইয়াহয়া এর সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি আমার পিতাকে তার পিতা থেকে বলতে শুনেছি, ‘আমরা ফজর সালাতের পূর্বে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর দরজার কাছে এসে বসে থাকতাম; যখন তিনি ঘর থেকে বের হতেন আমরা একসাথে মসজিদে যেতাম। আবু মুসা আশআরী রা. এসে বললেন, আবু আব্দুর রহমান কি তোমাদের কাছে এসেছে? যখন আমরা না বললাম তখন তিনি তাঁর আসার আগ পর্যন্ত আমাদের সাথে বসে রইলেন। তিনি বের হলে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম। আবু মুসা আশআরী বললেন, হে আবু আব্দুর রহমান! আমি কিছুক্ষণ পূর্বে মসজিদে একটি বিষয় লক্ষ্য করতে পেলাম যা আমার অপছন্দ। তবে বিষয়টি আলহামদুলিল্লাহ! আমার কাছে কল্যাণজনক মনে হয়েছে। তিনি বললেন, বিষয়টি কী? আবু মুসা বললেন, কিছুক্ষণ থাকলে আপনিই দেখতে পাবেন। আমি দেখেছি, মসজিদে কয়েক দল লোক গোল হয়ে নামাজের অপেক্ষা করছে। তাদের হাতে রয়েছে পাথর। প্রত্যেক দলে আছে একজন করে লোক, সে বলছে, তোমরা একশ বার আল্লাহু আকবার বল, তারা একশ বার পাঠ করল। তোমরা একশ বার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ কর, তারা একশ বার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করল। অতঃপর বলল, তোমরা একশ বার সুবহানাল্লাহ পাঠ কর, তার একশ বার পাঠ করল। আবু আব্দুর রহমান জিজ্ঞেস করলেন, তখন তুমি তাদেরকে কী বললে? আপনার মতামত ও সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আমি কিছু বলিনি। তিনি বললেন, আমি কি তাদেরকে গুনাহ পরিত্যাগ করার নির্দেশ দেয়নি, তারা যেন তাদের গোনাহের হিসাব কষে নেয় এবং আমি তাদের দায়ভার নিচ্ছি যে, তাদের নেক আমলকে কোনো কিছু বরবাদ করতে পারবে না? তিনি সামনে চলতে লাগলেন। আমরাও তাঁর সাথে চললাম। তিনি তাদের এক দলের কাছে এসে বললেন, তোমরা এসব কী করছ? তারা বলল, হে আবু আব্দুল্লাহ! আমরা পাথর দিয়ে আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ গণনা করছি। তিনি বললেন, তোমরা বরং তোমাদের গোনাহের হিসাব কষো, আমি তোমাদের দায়িত্ব নিচ্ছি, তোমাদের নেকীসমূহকে কোনো কিছু বরবাদ করতে পারবে না। তিনি লোকদের উদ্দেশ্য করে বললেন, হে মুহাম্মদের উম্মতগণ! কিসে তোমাদেরকে ধ্বংসের দিকে তাড়া করল? অথচ তোমাদের নবীর সাহাবীরা ভরপুর, তাঁর পোশাক এখনো শুকায়নি, তাঁর পাত্রগুলো এখনো ভাঙ্গেনি! সে সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! তোমরা যে ধর্মের উপর রয়েছে তা হয়ত মুহাম্মদের ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নতুবা তোমরা গুমরাহীর দার উন্মোচনকারী। তারা বলল, আল্লাহর শপথ! হে আবু আব্দুর রহমান, আমরা তো কল্যাণেরই ইচ্ছা করেছি। তিনি বললেন, অনেক কল্যাণকামী এমন আছে যে সঠিকতায় পৌঁছতে পারে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এমন কিছু জাতি আছে যারা কুরআন পাঠ করে; কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করে না। আল্লাহই ভালো জানেন, হয়ত তাদের অধিকাংশ তোমাদের মধ্য থেকে হবে। এরপর তিনি তাদের থেকে চলে গেলেন। আমর ইবনে সালমা বলেন, পরবর্তীতে তাদের অধিকাংশকে আমরা নাহরাওয়ানের দিন খারেজীদের সাথে দেখেছি।’ -দারিমী: ২১০
যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনিত বিষয়ের বিপরীত হবে তা-ই ফিতনা। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
لَّا تَجْعَلُوا دُعَاءَ الرَّسُولِ بَيْنَكُمْ كَدُعَاءِ بَعْضِكُم بَعْضًا ۚ قَدْ يَعْلَمُ اللَّـهُ الَّذِينَ يَتَسَلَّلُونَ مِنكُمْ لِوَاذًا ۚ فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ﴿٦٣﴾
‘রাসূলের আহ্বানকে তোমরা তোমাদের একে অপরের আহ্বানের মত গণ্য কর না। আল্লাহ তাদের সম্পর্কে জানেন, যারা তোমাদের মধ্যে চুপিসারে সরে পড়ে। অতএব তারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদেরকে স্পর্শ করবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে।’ -সূরা নূর 24:৬৩
ইলম অন্বেষণ ও রব্বানী আহলে ইলমের দিকে প্রত্যাগমন
মূর্খতা ও ইলম ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা-সমাধানে আত্মনিয়োগ করা ফিতনা ও ভ্রষ্টতায় পতিত হওয়ার বড় একটি কারণ। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِّنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ ۖ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَىٰ أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنبِطُونَهُ مِنْهُمْ ۗ وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّـهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لَاتَّبَعْتُمُ الشَّيْطَانَ إِلَّا قَلِيلًا ﴿٨٣﴾
‘আর যখন তাদের কাছে পৌঁছে কোনো সংবাদ শান্তি কিংবা ভয়ের, তখন তারা সেগুলোকে রটিয়ে দেয়। আর যদি সেগুলো পৌঁছে দিত রাসূল পর্যন্ত কিংবা তাদের শাসকদের পর্যন্ত, তখন অনুসন্ধান করে দেখা যেতো সেসব বিষয়, যা তাতে রয়েছে অনুসন্ধান করার মত। বস্তুত আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা যদি তোমাদের উপর বিদ্যমান না থাকত তবে তোমাদের অল্প কিছু লোক ব্যতীত সবাই শয়তানের অনুসরণ করা শুরু করত!’ -সূরা নিসা 4:৮৩
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ إِلاَّ رِجَالاً نُّوحِي إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُواْ أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ
আপনার পূর্বেও আমি প্রত্যাদেশসহ মানবকেই তাদের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম অতএব জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তোমাদের জানা না থাকে; (সূরা আন-নাহল ১৬;৪৩)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لَا يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالًا فَسُئِلُوا فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ فضلوا وأضلوا
‘আল্লাহ তা’আলা বান্দাদের থেকে ইলমকে একেবারে উঠিয়ে নিবেন না। তবে উলামায়ে কেরামকে উঠিয়ে নেয়ার দ্বারা ইলমকে উঠিয়ে নিবেন। যখন একজন আলেমও জীবিত থাকবে না, তখন মানুষ কিছু মূর্খ লোককে নেতা হিসেবে গ্রহণ করবে। তাদেরকে প্রশ্ন করা হবে, তারা সমাধান দিবে। এতে নিজেরাও ভ্রষ্ট হবে অন্যদেরকেও ভ্রষ্ট করবে।’ -বুখারী: ১০০
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
يَتَقَارَبُ الزَّمَانُ وَيُقْبَضُ الْعِلْمُ وَتَظْهَرُ الْفِتَنُ وَيُلْقَى الشُّحُّ وَيَكْثُرُ الْهَرْجُ ” . قَالُوا وَمَا الْهَرْجُ قَالَ ” الْقَتْلُ
‘সময় সংকীর্ণ হয়ে যাবে, ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে, ফিতনা দেখা দিবে, কার্পণ্য ও ‘হারজ’ বেড়ে যাবে।’ লোকেরা জিজ্ঞেস করল, ‘হারজ’ কী জিনিস? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হত্যা’। – (মুসলিম: ১৫৭)
সুতরাং জ্ঞানী হলো সে ব্যক্তি, যে শরঈ কোনো বিষয়ে অগ্রসর হওয়ার আগে বিজ্ঞজনের কাছে জিজ্ঞেস করে, পর্যালোচনা ও অধ্যয়ন করে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَمَا أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
‘আপনার পূর্বে অল্প কিছু লোককেই পাঠিয়েছি, যাদের কাছে আমি ওহী প্রেরণ করতাম। সুতরাং তোমরা আহলে ইলমকে জিজ্ঞেস কর যদি তোমরা না জানো।’(সুরা আম্বিয়া-২১:৭)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
يرث هذا العلم من كل خلف عدوله ينفون عنه تأويل الجاهلين وانتحال المبطلين وتحريف الغالين” رواه البيهقي وصححه الألباني
‘এ ইলমের উত্তরাধিকার লাভ করবে পরবর্তী জমানার নিষ্ঠাবান লোকেরা। তাঁরা ইলম থেকে জাহেলদের অপব্যাখ্যা, বাতিল লোকদের বানোয়াট কথা, জালিমদের বিকৃতিকে দূর করবে।’ –(মিশকাত, বাইহাক্বী)
জাবের রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
خَرَجْنَا فِي سَفَرٍ فَأَصَابَ رَجُلاً مِنَّا حَجَرٌ فَشَجَّهُ فِي رَأْسِهِ ثُمَّ احْتَلَمَ فَسَأَلَ أَصْحَابَهُ فَقَالَ هَلْ تَجِدُونَ لِي رُخْصَةً فِي التَّيَمُّمِ فَقَالُوا مَا نَجِدُ لَكَ رُخْصَةً وَأَنْتَ تَقْدِرُ عَلَى الْمَاءِ فَاغْتَسَلَ فَمَاتَ فَلَمَّا قَدِمْنَا عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أُخْبِرَ بِذَلِكَ فَقَالَ ” قَتَلُوهُ قَتَلَهُمُ اللَّهُ أَلاَّ سَأَلُوا إِذْ لَمْ يَعْلَمُوا فَإِنَّمَا شِفَاءُ الْعِيِّ السُّؤَالُ
আমরা এক সফরে বের হলাম। আমাদের একজন পাথর দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হলে তার মাথা বেধে দেয়া হল। এমতাবস্থায় তার স্বপ্নদোষ হয়ে গেল। তার সাথী-সঙ্গীদের কাছে জিজ্ঞেস করল, এ অবস্থায় আমার জন্য কি তায়াম্মুম করার সুযোগ আছে? তারা বলল, না; তোমার জন্য কোনো সুযোগ দেখছি না, তুমি তো পানি ব্যবহারে সক্ষম। শেষপর্যন্ত সে গোসল করল এবং মারা গেল। যখন আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলাম, তিনি ঘটনা জানতে পেরে বললেন, ‘তারা লোকটিকে হত্যা করেছে, আল্লাহ তাদেরকে হত্যা করুন! যেহেতু তারা জানে না তাহলে কেন জিজ্ঞেস করে নিলো না? নিশ্চয় না জানার ঔষধ হচ্ছে জিজ্ঞাসা করা।’ –(আবু দাউদ-৩৩৬)
সালাফে সালেহীনের নীতি ছিল, যখন কোনো নতুন বিষয় বা মাসআলায় সন্দেহ দেখা দিত তখন নিজে গবেষণা করার আগে জিজ্ঞেস করে নিতেন। হুযাইফা ইবন ইয়ামান রা. বলেন,
كَانَ النَّاسُ يَسْأَلُونَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنْ الْخَيْرِ وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنْ الشَّرِّ مَخَافَةَ أَنْ يُدْرِكَنِي فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّا كُنَّا فِي جَاهِلِيَّةٍ وَشَرٍّ فَجَاءَنَا اللهُ بِهَذَا الْخَيْرِ فَهَلْ بَعْدَ هَذَا الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ وَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الشَّرِّ مِنْ خَيْرٍ قَالَ نَعَمْ وَفِيهِ دَخَنٌ قُلْتُ وَمَا دَخَنُهُ قَالَ قَوْمٌ يَهْدُونَ بِغَيْرِ هَدْيِي تَعْرِفُ مِنْهُمْ وَتُنْكِرُ قُلْتُ فَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ قَالَ نَعَمْ دُعَاةٌ عَلَى أَبْوَابِ جَهَنَّمَ مَنْ أَجَابَهُمْ إِلَيْهَا قَذَفُوهُ فِيهَا قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ صِفْهُمْ لَنَا قَالَ هُمْ مِنْ جِلْدَتِنَا وَيَتَكَلَّمُونَ بِأَلْسِنَتِنَا قُلْتُ فَمَا تَأْمُرُنِي إِنْ أَدْرَكَنِي ذَلِكَ قَالَ تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَإِمَامَهُمْ قُلْتُ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُمْ جَمَاعَةٌ وَلاَ إِمَامٌ قَالَ فَاعْتَزِلْ تِلْكَ الْفِرَقَ كُلَّهَا وَلَوْ أَنْ تَعَضَّ بِأَصْلِ شَجَرَةٍ حَتَّى يُدْرِكَكَ الْمَوْتُ وَأَنْتَ عَلَى ذَلِكَ.
‘লোকেরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে কল্যাণের বিষয়াবলী জিজ্ঞেস করত। কিন্তু আমি তাঁকে অকল্যাণের বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম এ ভয়ে যে, অকল্যাণ আমাকে পেয়ে না বসে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তো জাহিলিয়্যাত ও অকল্যাণের মাঝে ছিলাম। এরপর আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এ কল্যাণের মধ্যে শামিল করলেন। এ কল্যাণের পর আবারও কি অকল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে এর মধ্যে কিছুটা ধূম্রজাল থাকবে। আমি প্রশ্ন করলাম, এর ধূম্রজাল কিরূপ? তিনি বললেন, এক জামাআত আমার তরীকা ছেড়ে অন্য পথ ধরবে। তাদের থেকে ভালো কাজও দেখবে এবং মন্দ কাজও দেখবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সে কল্যাণের পর কি আবার অকল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী এক সম্প্রদায় হবে। যে ব্যক্তি তাদের আহ্বানে সাড়া দেবে, তাকে তারা জাহান্নামে নিক্ষেপ করে ছাড়বে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের কিছু স্বভাবের কথা আমাদের বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, তারা আমাদের লোকই এবং আমাদের ভাষায়ই কথা বলবে। আমি বললাম, যদি এমন অবস্থা আমাকে পেয়ে বসে, তাহলে কী করতে হুকুম দেন? তিনি বললেন, মুসলিমদের জামাআত ও ইমামকে আঁকড়ে থাকবে। আমি বললাম, যদি তখন মুসলিমদের কোনো জামাআত ও ইমাম না থাকে? তিনি বললেন, তখন দলমত ত্যাগ করে সম্ভব হলে কোনো গাছের শিকড় কামড়িয়ে পড়ে থাকবে, যতক্ষণ না সে অবস্থায় তোমার মৃত্যু উপস্থিত হয়।’ -বুখারী: ৭০৮৪
ইয়াহইয়া ইবনে ইয়া’মুর থেকে ইবনে বুরাইদাহ এর বর্ণনা।
عَنِ ابْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ يَحْيَى بْنِ يَعْمَرَ، قَالَ كَانَ أَوَّلَ مَنْ قَالَ فِي الْقَدَرِ بِالْبَصْرَةِ مَعْبَدٌ الْجُهَنِيُّ فَانْطَلَقْتُ أَنَا وَحُمَيْدُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْحِمْيَرِيُّ حَاجَّيْنِ أَوْ مُعْتَمِرَيْنِ فَقُلْنَا لَوْ لَقِينَا أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَسَأَلْنَاهُ عَمَّا يَقُولُ هَؤُلاَءِ فِي الْقَدَرِ فَوُفِّقَ لَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ دَاخِلاً الْمَسْجِدَ فَاكْتَنَفْتُهُ أَنَا وَصَاحِبِي أَحَدُنَا عَنْ يَمِينِهِ وَالآخَرُ عَنْ شِمَالِهِ فَظَنَنْتُ أَنَّ صَاحِبِي سَيَكِلُ الْكَلاَمَ إِلَىَّ فَقُلْتُ أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ إِنَّهُ قَدْ ظَهَرَ قِبَلَنَا نَاسٌ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ وَيَتَقَفَّرُونَ الْعِلْمَ – وَذَكَرَ مِنْ شَأْنِهِمْ – وَأَنَّهُمْ يَزْعُمُونَ أَنْ لاَ قَدَرَ وَأَنَّ الأَمْرَ أُنُفٌ . قَالَ فَإِذَا لَقِيتَ أُولَئِكَ فَأَخْبِرْهُمْ أَنِّي بَرِيءٌ مِنْهُمْ وَأَنَّهُمْ بُرَآءُ مِنِّي وَالَّذِي يَحْلِفُ بِهِ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ لَوْ أَنَّ لأَحَدِهِمْ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا فَأَنْفَقَهُ مَا قَبِلَ اللَّهُ مِنْهُ حَتَّى يُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ
ইয়াহইয়া ইবনে ইয়া’মুর থেকে ইবনে বুরাইদাহ বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বসরায় সর্বপ্রথম যে তাকদীর নিয়ে কথা বলে, সে হচ্ছে মা’বাদ আল-জুহানী। আমি এবং উমাইদ ইবনে আব্দুর রহমান হিময়ারী হজ্ব বা উমরায় গমন করেছিলাম। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, যদি রাসূলের কোনো সাহাবীকে পাই তাহলে এসব লোকেরা তাকদীর সম্পর্কে যা বলাবলি করছে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করব। তো মসজিদের ভিতর আমরা আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ইবনুল খত্তাব রা.-কে পেয়ে গেলাম। আমি এবং আমার সঙ্গী তাকে ঘিরে ধরলাম। আমাদের একজন তাঁর ডানে অপর জন বামে। আমি ধারণা করলাম, আমার সঙ্গী কথা বলার দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত করবে। আমি বললাম, হে আবু আব্দুর রহমান! আমাদের এলাকায় কিছু মানুষের আত্মপ্রকাশ হয়েছে, যারা কুরআন পড়ে, ইলম অন্বেষণ করে। (এভাবে তাদের পরিচয় তুলে ধরলেন)। তাদের ধারণা, তাকদীর বলতে কিছু নেই। যে কোনো বিষয় যখন-তখন হতে পারে। তিনি বললেন, যখন তোমাদের সাথে তাদের সাক্ষাত হয় তখন বলে দেবে, আমার উপর তাদের কোনো দায়িত্ব নেই, তাদের উপরও আমার কোনো দায়িত্ব নেই। সে সত্তার শপথ! যার নামে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর শপথ করে থাকে, তাদের কেউ যদি উহুদ পরিমাণ স্বর্ণ দান করে, তাহলে আল্লাহ তা’আলা তাদের দান কবুল করবেন না, যতক্ষণ না তারা তাকদীরের উপর ঈমান আনে। -মুসলিম
ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, ‘আল্লাহ ভালো জানেন, আমি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর চেয়ে সুখী জীবন-যাপনকারী কাউকে দেখিনি। সংকীর্ণ জীবনের অধিকারী, যেখানে বিলাসিতা নেই, স্বাচ্ছন্দ্য নেই; সেইসাথে রয়েছে বন্দি জীবন, ধমকি ও কষ্টের জীবন; তা সত্ত্বেও তিনি মানুষের মাঝে উত্তম জীবন-যাপনকারী; খোলা মন, মজবুত হৃদয় ও সবচেয়ে বেশি আনন্দের অধিকারী। তার চেহারায় স্বাচ্ছন্দ্যের ভাব সর্বদা প্রস্ফুটিত। আমাদের যখন ভয় বেড়ে যেতো, ধ্যান-ধারণার অবনতি ঘটত, জমিন সংকীর্ণ হয়ে আসত, তখন আমরা তাঁর কাছে আসতাম, তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতাম, তাঁর কথা শুনতাম; এতেই আমাদের সব সমাধান হয়ে যেতো, আমারা শক্তি, দৃঢ়তা ও প্রশান্তি লাভ করতাম।’ -আল-ওয়াবিলুস সায়্যিব: ৬৭
ইতিহাস অধ্যয়ন করা এবং ঘটনার পরিণাম ও সেখান থেকে পাওয়া কল্যাণ-অকল্যাণের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা
ফিতনার জমানায় বান্দাকে যে বিষয়টি সরল-সঠিক পথে সাহায্য করবে, তা হচ্ছে, এ জাতীয় অন্যান্য ঘটনার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা; পূর্ববর্তীরা এসব বিষয়কে কীভাবে সমাধান করেছেন। এমনিভাবে পরিণাম ও ঘটে যাওয়া বিষয়ের ফলাফল সম্পর্কে ইলম ভিত্তিক সঠিক জ্ঞান অর্জন করা। সবরকে মুসাব্বাবের উপর পরিপূর্ণভাবে ফিট করা। ধারণা, খেয়াল-খুশি ও সন্দেহের উপর ভিত্তি করে নয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ ۗ مَا كَانَ حَدِيثًا يُفْتَرَىٰ وَلَـٰكِن تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ كُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ﴿١١١﴾
‘তাদের কাহিনীতে বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে প্রচুর শিক্ষণীয় বিষয়, এটা কোনো মনগড়া কথা নয়, কিন্তু যারা বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের জন্যে এটি পূর্বেকার কালামের সমর্থন এবং প্রত্যেক বস্তুর বিবরণ, রহমত ও হেদায়েত স্বরূপ।’ -সূরা ইউসুফ 12:১১১
আল্লাহ তা’আলার বাণী,
وَكُلًّا نَّقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنبَاءِ الرُّسُلِ مَا نُثَبِّتُ بِهِ فُؤَادَكَ ۚ وَجَاءَكَ فِي هَـٰذِهِ الْحَقُّ وَمَوْعِظَةٌ وَذِكْرَىٰ لِلْمُؤْمِنِينَ ﴿١٢٠﴾
‘আর আমি রাসূলগণের সব বৃত্তান্তই তোমাকে বলছি, যার মাধ্যমে তোমার অন্তরকে মজবুত করেছি। আর এভাবে তোমার নিকট মহাসত্য এবং ঈমানদারদের জন্য নসিহত ও স্মরণীয় বিষয়বস্তু এসেছে।’ -সূরা হুদ 11:১২০
ইমাম শাতিবী রহ. বলেন, ‘কাজের পরিণামের প্রতি লক্ষ্য করা শরীয়ত কর্তৃক গৃহীত একটি বিষয়। অনুকূলে হোক বা প্রতিকুলে। কারণ, মুজতাহিদ ইমাম মুকাল্লিফ থেকে প্রকাশিত কোনো কাজের সিদ্ধান্ত শরীয়তগত ভাবে এর পরিণাম কী হতে পারে তার প্রতি লক্ষ্য করা ছাড়া দিতে পারেন না। কল্যাণকর বিষয়কে গ্রহণ করে অকল্যাণ দূর করবেন। তবে কখনো কল্যাণকর বিষয়ে উল্টো প্রতিক্রিয়ায় থাকতে পারে। অথবা ব্যাপারটি এমন যে, কোনো ক্ষতি সাধিত হওয়া বা কোনো উপকার দূরীভূত হওয়ার কারণে শরীয়তসম্মত মনে করা হল না; অথচ তার মাঝে বিপরীত বিধান লুকায়িত রয়েছে। সুতরাং যখন প্রথমটিকে শরীয়ত সম্মত বলা হল, অথচ তখন দেখা গেল, যে ক্ষতিকে দূর করার জন্য মাসলাহাতকে গ্রহণ করা হচ্ছে সে ক্ষতিটি মাসলাহাতের বরাবর বা তার চেয়ে বেশি। এমতাবস্থায় এ বিষয়টিকে শরীয়ত সম্মত বলা যাবে না। এমনিভাবে দ্বিতীয়টিকে যখন শরীয়ত পরিপন্থী বলা হল, অথচ তখন দেখা গেল, এক ক্ষতিকারক বিষয়ের মাধ্যমে এমন এক ক্ষতিকে প্রতিহত করা হলো, যা তার বরাবর বা তার চেয়ে বড়; তাহলে তো তাকে শরীয়ত পরিপন্থী মনে করার কোনো কারণ নেই। এটি ইজতেহাদী একটি বিষয়, কঠিন একটি জায়গা। তবে বিষয়টি মজাদার, পরিণাম প্রশংসনীয় এবং মাকসেদে শরীয়ার অন্তর্ভুক্ত।’ – আল-মুআফাকাত:৪/১৯৪
ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, ‘অনুচ্ছেদ: স্থান-কাল, অবস্থা ও প্রেক্ষাপট ভেদে ফতওয়া বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। দুনিয়া ও আখিরাত বিষয়ে বান্দার কল্যাণের উপর শরীয়তের ভিত্তি।’
এটি গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী একটি অনুচ্ছেদ। এ ব্যাপারে অজ্ঞ থাকার কারণে শরীয়তের মধ্যে অনেক ভুল-ভ্রান্তি ঢুকে পড়েছে, অনেক সমস্যা ও জটিলতা পরিলক্ষিত হয়েছে, শরীয়তে যার কোনো স্থান নেই। অনেকের এ কথা জানা নেই যে, এ সবের মাধ্যমে মহান শরীয়ত – যার সুউচ্চ চূড়ায় রয়েছে কল্যাণ- তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ, দুনিয়া ও আখিরাতে কুরআনী বিধান ও বান্দার কল্যাণের উপর শরীয়তের ভিত্তি। এটিই সব কিছুর জন্য ইনসাফ, রহমত, কল্যাণ ও হিকমত। যে বিষয় ইনসাফ থেকে বে-ইনসাফে পরিণত হল, রহমতের পরিবর্তে বিপরীত দিকে চলে গেল, কল্যাণের পরিবর্তে ক্ষতিকারক হয়ে গেল, হিকমতের পরিবর্তে খেলনার পাত্রে পরিণত হল- তাহলে বুঝতে হবে তা শরীয়ত নয়। মন্দ বিষয় দূর হওয়ার চারটি পথ:
এক. একটি মন্দ দূর হয়ে বিপরীত আরেকটি তার স্থলাভিষিক্ত হওয়া।
দুই. মন্দ বিষয়টি কমে যাওয়া, যদিও পরিপূর্ণভাবে দূর না হয়।
তিন. হুবহু আরেকটি মন্দ তার স্থলাভিষিক্ত হওয়া।
চার. পূর্বের চেয়ে মারাত্মক কোনো মন্দ তার স্থলাভিষিক্ত হওয়া।
প্রথম দু’টি শরীয়ত কর্তৃক গৃহীত। তৃতীয়টি ইজতেহাদ-যোগ্য। চতুর্থটি হারাম।’ -ই’লাউল মুআক্কিঈন:৩/৪
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘আদেশ-নিষেধ যদিও কল্যাণ সাধন করা ও ক্ষতিকারক বিষয় দূর করার জন্য নির্ধারিত, তারপরও বাস্তব ময়দান অবশ্যই লক্ষণীয়। আদেশ-নিষেধ দ্বারা যদি কল্যাণ দূর হওয়া বা ক্ষতি সাধিত হওয়ার পরিমাণ বেশি হয় তাহলে তা পালনীয় নয়। বরং উপকারের তুলনায় যখন ক্ষতির দিকটি বেশি হবে তখন তা হারাম। তবে উপকার ও ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করার মাপকাঠি শরীয়ত। মানুষ যখন নসের উপর আমল করতে সক্ষম হবে তখন সেখান থেকে সরবে না। তা না হলে দৃষ্টান্ত ও নজির দেখে ইজতেহাদ করবে। তবে এ ব্যাপারে ভালো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তির সংখ্যা সীমিত। এরই উপর ভিত্তি করে আরেকটি বিষয়, যদি কোনো ব্যক্তি বা গুষ্ঠী ভালো ও মন্দ উভয় গুণে গুণী হয়, কিন্তু তাদেরকে কোনোটি থেকে পার্থক্য করা যাচ্ছে না। বরং সকলে উভয়টির সাথে জড়িয়ে পড়ল অথবা সকলে উভয়টিকে ছেড়ে দিল। এমতাবস্থায় তাদেরকে ভালো কাজের আদেশ করা যাবে না, খারাপ কাজ থেকে বারণও করা যাবে না। যদি অধিকাংশ কাজ ভালো হয় তাহলে ভালো কাজের আদেশ করা হবে, যদিও তার কারণে কিছু মন্দ আসতে পারে। তাদেরকে এমন খারাপ কাজ থেকে বারণ করা যাবে না, যার কারণে তুলনামূলক তার চেয়ে ভালো কাজ হারাতে হয়। তখন এই বারণটা হবে আল্লাহর পথে বাধা প্রদান; আল্লাহর আনুগত্য, আল্লাহর রাসূলে আনুগত্য ও ভালো কাজ বিদূরিত করার নামান্তর। আর যদি খারাপ দিকের পরিমাণ বেশি হয় তাহলে খারাপ কাজ থেকে বারণ করা হবে। যদিও এর দ্বারা কিছু ভালো দিক ব্যাহত হবে যা খারাপের তুলনায় কম। এমতাবস্থায় ভালো কাজের আদেশ করা, যা তার চেয়ে বড় খারাপ কাজকে ডেকে আনে- তা খারাপ কাজের আদেশ এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। যখন ভালো দিক, খারাপ দিক উভয়টি বরাবর হয়ে যাবে, তখন ভালো কাজের কথা বলা যাবে না, খারাপ কাজ থেকে বারণ করাও যাবে না। এতে কখনো ভালো কাজে আদেশ কল্যাণকর হতে পারে, কখনো খারাপ কাজ থেকে বারণ কল্যাণকর হতে পারে। কখনো আদেশও কল্যাণজনক হবে না, কখনো নিষেধও কল্যাণজনক হবে না। এটা সে সময় যখন ভালো-মন্দ উভয়টি বরাবর হবে।’ -মাজমুউল ফাতওয়া: ২৮/১২৯-১৩০
আমরা এখানে আবারও সে কথার দিকে ইঙ্গিত করছি, যার প্রতি শাইখ ইবনে তাইমিয়া রহ. সতর্ক করেছেন, ‘কিন্তু উপকার ও ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করার মাপকাঠি শরীয়ত। মানুষ যখন নসের উপর আমল করতে সক্ষম হবে তখন সেখান থেকে সরবে না। তা নাহলে দৃষ্টান্ত ও নজির দেখে ইজতেহাদ করবে। তবে নসকে বোঝা ও তদনুযায়ী হুকুম বের করার মত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তির সংখ্যা সীমিত।’
এখানে আরো যে বিষয়ে সতর্ক করা উচিৎ তা হলো, যখন দুটি কল্যাণকর বিষয় বিরোধপূর্ণ হবে তখন তুলনামূলক বড়টিকে আমরা গ্রহণ করব। যখন দুটি মন্দ বিষয় পরস্পর বিরোধপূর্ণ দেখা দিবে তখন আমরা ক্ষতির দিক থেকে বড়টিকে দূর করব। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘শরীয়তের ভিত্তি فاتقوا الله ماستطعتم (আল্লাহকে সাধ্যমত ভয় কর)-এর উপর, যা اتقوا الله حق تقاته (আল্লাহকে ভয় করার মত ভয় কর)এর ব্যাখ্যা। এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী,( إذا أمرتكم بأمر فأتوا منه ما استطعتم) ‘যখন তোমাদের কোনো কাজের আদেশ করি তখন যথাসম্ভব তা বাস্তবায়ন কর’-এর উপর। এটি বুখারী-মুসলিমের যৌথ রেওয়ায়েত। শরীয়তের ভিত্তি যার উপর তার আরেকটি হচ্ছে, কল্যাণ অর্জন করে তাকে পূর্ণতায় পৌঁছানো; মন্দ বিষয়কে বন্ধ করা এবং তা কমিয়ে নিয়ে আসা। যখন দু‘টি পরস্পর বিরোধপূর্ণ হয়ে যাবে তখন ছোট কল্যাণকে ছেড়ে বড় কল্যাণটি গ্রহণ করতে হবে, বড় ক্ষতিকে দূর করে ছোটটি সয়ে নিতে হবে। এটিই শরীয়তের কথা। যে ব্যক্তি অত্যাচারীকে তার অত্যাচারের কাজে সাহায্য করল সে অন্যায় ও অবাধ্যতার সাহায্যকারী। তবে যে জালিমের কাছে মাজলুমের জুলুমকে লাঘব করার জন্য গেল তাহলে সে মাজলুমের সাহায্যকারী, জালিমের নয়। সে ঐ ব্যক্তির মত যে তার কাছে ঋণী অথবা তার মাল জালিমের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিলো। এর একটি দৃষ্টান্ত, এতিম বা ওয়াকফের ওয়ালির কাছে যদি কোনো জালিম তাদের মাল তলব করে তাহলে সে মাল দেয়ার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ইজতেহাদ করার পর তার কাছে অথবা অন্যের কাছে রক্ষিত তুলনামূলক কম মাল পরিশোধ করবে। তাহলে এ ক্ষেত্রে সে নেককার। আর নেককারদের উপর অভিযোগের কোনো পথ নেই।’ – মাজমুউল ফাতওয়া: ২৮/২৮৪-২৮৫
যে কোনো সংবাদে, যে কোনো ঘটনায় অটল-অবিচল থাকা
বিভিন্ন সংবাদ, বর্ণনা, আজেবাজে কথা-বার্তা ফিতনার জমানায় বেশি হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে বান্দার জন্য আবশ্যক সর্বাবস্থায় অটল-অবিচল থাকা। পূর্বেকার একটি প্রবাদ, ‘আজেবাজে বর্ণনা সংবাদের আপদ’। কিছু সংবাদ, কিছু বর্ণনা এমন থাকবে যা সঠিক নয়। কিছু থাকবে এমন, যা বর্ণনাকারী নিজের বুঝ অনুযায়ী বলে, অথচ বাস্তবতা তার বিপরীত। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن جَاءكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَأٍ فَتَبَيَّنُوا أَن تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ
হে! মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও। [ সুরা হুজুরাত ৪৯:৬ ]
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ جَاءُوا بِالْإِفْكِ عُصْبَةٌ مِّنكُمْ ۚ لَا تَحْسَبُوهُ شَرًّا لَّكُم ۖ بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۚ لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُم مَّا اكْتَسَبَ مِنَ الْإِثْمِ ۚ وَالَّذِي تَوَلَّىٰ كِبْرَهُ مِنْهُمْ لَهُ عَذَابٌ عَظِيمٌ ﴿١١﴾ لَّوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوهُ ظَنَّ الْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بِأَنفُسِهِمْ خَيْرًا وَقَالُوا هَـٰذَا إِفْكٌ مُّبِينٌ ﴿١٢﴾ لَّوْلَا جَاءُوا عَلَيْهِ بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ ۚ فَإِذْ لَمْ يَأْتُوا بِالشُّهَدَاءِ فَأُولَـٰئِكَ عِندَ اللَّـهِ هُمُ الْكَاذِبُونَ ﴿١٣﴾ وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّـهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ لَمَسَّكُمْ فِي مَا أَفَضْتُمْ فِيهِ عَذَابٌ عَظِيمٌ ﴿١٤﴾ إِذْ تَلَقَّوْنَهُ بِأَلْسِنَتِكُمْ وَتَقُولُونَ بِأَفْوَاهِكُم مَّا لَيْسَ لَكُم بِهِ عِلْمٌ وَتَحْسَبُونَهُ هَيِّنًا وَهُوَ عِندَ اللَّـهِ عَظِيمٌ ﴿١٥﴾ وَلَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوهُ قُلْتُم مَّا يَكُونُ لَنَا أَن نَّتَكَلَّمَ بِهَـٰذَا سُبْحَانَكَ هَـٰذَا بُهْتَانٌ عَظِيمٌ ﴿١٦﴾ يَعِظُكُمُ اللَّـهُ أَن تَعُودُوا لِمِثْلِهِ أَبَدًا إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ ﴿١٧﴾ وَيُبَيِّنُ اللَّـهُ لَكُمُ الْآيَاتِ ۚ وَاللَّـهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ ﴿١٨﴾ إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ۚ وَاللَّـهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ﴿١٩﴾ وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّـهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ وَأَنَّ اللَّـهَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ ﴿٢٠﴾
‘যারা মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল। তোমরা একে নিজেদের জন্যে খারাপ মনে কর না; বরং এটা তোমাদের জন্যে মঙ্গলজনক। তাদের প্রত্যেকের জন্যে ততটুকু আছে যতটুকু সে গুনাহ করেছে এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, তার জন্যে রয়েছে বিরাট শাস্তি। তোমরা যখন এ কথা শুনলে, তখন ঈমানদার পুরুষ ও নারীগণ কেন নিজেদের লোক সম্পর্কে উত্তম ধারণা করনি এবং বলনি যে, এটা তো নির্জলা অপবাদ? তারা কেন এ ব্যাপারে চার জন সাক্ষী উপস্থিত করেনি; অতঃপর যখন তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, তখন তারাই আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী। যদি ইহকালে ও পরকালে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত, তবে তোমরা যা চর্চা করছিলে, তজ্জন্যে তোমাদেরকে গুরুতর আযাব স্পর্শ করত। যখন তোমরা একে মুখে মুখে ছড়াচ্ছিলে এবং মুখে এমন বিষয় উচ্চারণ করছিলে, যার কোনো জ্ঞান তোমাদের ছিল না। তোমরা একে তুচ্ছ মনে করছিলে, অথচ এটা আল্লাহর কাছে গুরুতর ব্যাপার ছিল। তোমরা যখন এ কথা শুনলে তখন কেন বললে না যে, এ বিষয়ে কথা বলা আমাদের উচিত নয়। আল্লাহ তো পবিত্রতম মহান। এটা তো এক গুরুতর অপবাদ। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, তোমরা যদি ঈমানদার হও, তবে কখনও পুনরায় এ ধরণের আচরণের পুনরাবৃত্তি কর না। আল্লাহ তোমাদের জন্যে কাজের কথা স্পষ্ট করে বর্ণনা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্যে ইহকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। যদি তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত এবং আল্লাহ দয়ালু ও মেহেরবান না হতেন, তবে কত কিছুই হয়ে যেত। -সূরা আন্-নূর 24: ১১-২০
শাইখুল ইসলাম রহ. বলেন, ‘কারো জন্য অন্য কোনো ব্যক্তির কথাকে সে যা বুঝাতে চাচ্ছে তা ভিন্ন অন্য কোনো অর্থে প্রকাশ করার অধিকার নেই। সাধারণভাবে সবাই যে অর্থ উদ্দেশ্য করে সেভাবে প্রকাশ করা যাবে না।’ -মাজমুউল ফাতওয়া: ৭/৩৬
‘অনেক বর্ণনাকারী আছে মিথ্যা বলা যাদের উদ্দেশ্য নয়, তবে তারা মানুষের সরাসরি শব্দ ছাড়া অন্য শব্দে প্রকাশ করে। তখন তাদের উদ্দেশ্য বুঝা অনেকের জন্য কঠিন হয়ে যায়, অনেকের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে যায়।’ -মানাহিজুস্ সুন্নাতিন্ নববিয়্যাহ: ৬/১৯৩
ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, ‘মানুষ উলামায়ে কেরামের উদ্ধৃতি দিয়ে যে সব বাতিল মতাদর্শ পেশ করে- তার অধিকাংশ হয়ে থাকে বুঝের স্বল্পতার কারণে।’ -মাদারিজুস্ সালিকীন:২/৪৩১
ফিতনার জমানায় জবানের অবস্থান
বান্দাকে সব সময় জবান হিফাজত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ই ফিতনার জমানায় আরো গুরুত্বের সাথে নির্দেশিত। কারণ ফিতনার জমানায় কথার অনেক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যার বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায়। সুতরাং বিচক্ষণ ও জ্ঞানী ব্যক্তি ফিতনা ও এ-জাতীয় অন্যান্য সমস্যায় জবানকে হেফাজত করবে, ভালো ছাড়া কোনো কথা বলবে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ ۖ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ ﴿١٦﴾ إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ ﴿١٧﴾ مَّا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ ﴿١٨﴾
‘আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী। যখন দুই ফেরেশতা ডানে ও বামে বসে তার আমল গ্রহণ করে। সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্যে তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।’ -সূরা ক্বাফ 50: ১৬-১৮
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَن كانَ يُؤْمِنُ باللَّهِ واليَومِ الآخِرِ فلا يُؤْذِ جارَهُ، ومَن كانَ يُؤْمِنُ باللَّهِ واليَومِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ، ومَن كانَ يُؤْمِنُ باللَّهِ واليَومِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أوْ لِيَصْمُتْ
‘যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন মেহমানের ইকরাম করে। যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ –(বুখারী-6018,মুসলিম-47)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْ صَمَتَ نَجَا
‘যে চুপ থাকে সে নাজাত পায়।’(তিরমিযি-২৫০১)
ইবনে আব্দুল বার রহ. বলেন, ‘হুযাইফা ইবনে ইয়ামান রা. বলেছেন,
إنَّ الفِتْنةَ تُلقَحُ بالنَّجْوى، وتُنتَجُ بالشَّكْوى
‘নিশ্চয়ই ফিতনা গোপন পরামর্শ দ্বারা ফলপ্রসূ হয়, আর তা অভিযোগ থেকে তৈরি হয়।’ (হিলয়াতুল আওলিয়া-৬/১০৭)
হুযাইফা রা. এর এ-কথাটি নাসর ইবনে সাইয়ার গ্রহণ করেছিলেন যখন তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধের শুরু হলো কথাবার্তা ( যা একটি কবিতার অংশ)। এখানে (সেই কবিতার) কয়েকটি পংক্তি উল্লেখ করা হলো, যা তিনি মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদের কাছে লিখে পাঠান:
أرى خلل الرّماد وميض نار … ويوشك أن يكون لها ضرام
‘ছাইয়ের মাঝে নিভু নিভু কয়লা কখনো কখনো অগ্নিকুণ্ড হয়ে দেখা দেয়;
فإن النّار بالعودين تذكى … وإنّ الحرب أوّلها الكلام
কারণ আগুন এমন জিনিস যা প্রজ্বলিত হওয়ার জন্য দুটি কাঠিই যথেষ্ট। আর যুদ্ধের শুরুটা হয়ে থাকে সামান্য কথাবার্তার মাধ্যমে।
فقلت من التّعجب ليت شعري … أأيقاظٌ أميّة أم نيام
সুতরাং আমি অবাক হয়ে ভাবছি, আমার এ কবিতাটি কি জাগরণকারী নাকি ঘুমপাড়ানি।’- (বাহজাতুল মাজালিস: ১০২)
হযরত উমর রা. বলেন,
“إِنَّ لِله عِبَادًا يُمِيتُونَ الْبَاطِلَ بِهَجْرِهِ، وَيُحْيُونَ الحقّ بِذِكْرِهِ”
‘আল্লাহর কিছু বান্দা আছে যারা বাতিলকে ধ্বংস করে চুপ থাকার মাধ্যমে, হককে জিন্দা করে আলোচনার মাধ্যমে।’(হিলয়াতুল আওলিয়া-১/৫৫)
সবর, অবিচলতা, আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা পোষণ
ফিতনার জমানায় বান্দার জন্য সবর, অবিচলতা ও আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করা উচিত। চেষ্টা হলো সবচেয়ে বড় বিষয়। যে এগুলোকে আঁকড়ে ধরতে পারল না, তার পক্ষে ফিতনার মুকাবিলা করা সম্ভব নয়। অনেকেই এমন আছে যারা ফিতনায় ডুবে গেছে- নাউযুবিল্লাহ। এসব কিছু হয়েছে সবর না থাকার কারণে, আল্লাহর ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করার কারণে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اسْتَعِينُواْ بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ إِنَّ اللّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
হে মুমিন গণ! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চিয়ই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন। (সূরা বাকারা ২:১৫৩)
আল্লাহ তা’আলার বাণী,
وَلَنَبْلُوَنَّكُم بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ ۗ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ ﴿١٥٥﴾ الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّـهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ ﴿١٥٦﴾ أُولَـٰئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ ۖ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ ﴿١٥٧﴾
‘অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয় তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাব। তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত।’ -সূরা বাকারা 2: ১৫৫-১৫৭
আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন:
فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا ﴿٥﴾ إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا ﴿٦﴾
‘নিশ্চয় কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি। নিশ্চয় কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।’ -সূরা ইনশিরাহ 94׃ 5-6
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
وأنَّ النصرَ مع الصبرِ ، وأنَّ الفرجَ مع الكربِ ، وأنَّ مع العسرِ يُسرًا
‘নিশ্চয় সবরের সাথে রয়েছে সাহায্য। বিপদের সাথে রয়েছে আরাম। কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।’ -সিলসিলাতুস্ সহিহাহ: ২৩৮২
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إن من ورائكم أيام الصبر، للمتمسك فيهن يومئذ بما أنتم عليه أجر خمسين منكم، قالوا: يا نبي الله أو منهم، قال: بل منكم
رواه الطبراني، وصححه الألباني في السلسلة الصحيحة
‘তোমাদের পরে রয়েছে সবরের দিন। সে দিনগুলোতে যে ব্যক্তি তোমরা যে দ্বীনের উপর রয়েছ, তা আঁকড়ে ধরতে পারবে তার জন্য রয়েছে তোমাদের পঞ্চাশ জনের সাওয়াব।’ লোকেরা জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের নাকি তাদের পঞ্চাশ জনের? তিনি বললেন, ‘বরং তোমাদের পঞ্চাশ জনের।’ – সিলসিলাতুস্ সহিহাহ: ৪৯৪
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّ السَّعِيدَ لَمَنْ جُنِّبَ الْفِتَنَ إِنَّ السَّعِيدَ لَمَنْ جُنِّبَ الْفِتَنَ إِنَّ السَّعِيدَ لَمَنْ جُنِّبَ الْفِتَنَ وَلَمَنِ ابْتُلِيَ فَصَبَرَ فَوَاهًا
‘সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি যে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকল। সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি যে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকল। সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি যে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকল। আর যে ব্যক্তি ফিতনায় পড়ে ধৈর্য ধারণ করবে, তাঁর জন্য কতই না মঙ্গল! (-আবু দাউদ: ৪২৬৩)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي، وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي، فَإِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي، وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلأٍ ذَكَرْتُهُ فِي مَلأٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَىَّ بِشِبْرٍ تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَىَّ ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ بَاعًا، وَإِنْ أَتَانِي يَمْشِي أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً
‘আমার ব্যাপারে বান্দার যেমন ধারণা -আমি তার কাছাকাছি থাকি। যখন আমাকে স্মরণ করে আমি তার সাথে থাকি। যদি আমাকে মনে মনে স্মরণ করে, আমিও তাকে মনে মনে স্মরণ করি। যদি আমাকে কোনো লোকসমাজে স্মরণ করে, আমি তাকে এমন ব্যক্তিদের সামনে স্মরণ করি, যারা তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যদি আমার দিকে এক বিঘাত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই। যদি আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে দুই হাত প্রসারিত পরিমাণ অগ্রসর হই। যদি আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে দৌড়ে আসি।’ –(বুখারী-7405,মুসলিম-6698)
তিরমিযী রহ. থেকে বর্ণিত, শাহর ইবনে হাওশাব র. বলেন,
قُلْتُ لأُمِّ سَلَمَةَ يَا أُمَّ الْمُؤْمِنِينَ مَا كَانَ أَكْثَرُ دُعَاءِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا كَانَ عِنْدَكِ قَالَتْ كَانَ أَكْثَرُ دُعَائِهِ ” يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ ” . قَالَتْ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا لأَكْثَرِ دُعَائِكَ يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ قَالَ ” يَا أُمَّ سَلَمَةَ إِنَّهُ لَيْسَ آدَمِيٌّ إِلاَّ وَقَلْبُهُ بَيْنَ أُصْبُعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ اللَّهِ فَمَنْ شَاءَ أَقَامَ وَمَنْ شَاءَ أَزَاغَ
আমি উম্মে সালমা রা.-কে জিজ্ঞাসা করলাম, হে উম্মুল মুমিনীন! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আপনার কাছে থাকতেন তখন তিনি কোন দুআটি বেশি পাঠ করতেন? তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দুআটি বেশি বেশি পড়তেন, (يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ)‘হে কলবের পরিবর্তনকারী! আমার কলবকে আপনার দ্বীনের উপর অবিচল রাখুন।’ উম্মে সালামা রা. বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি (يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ)‘হে কলবের পরিবর্তনকারী! আমার কলবকে আপনার দ্বীনের উপর অবিচল রাখুন।’ এ দুআটি কেন বেশি বেশি পাঠ করেন? তিনি বললেন, ‘হে উম্মে সালামা! প্রত্যেক মানুষের কলব আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝে রক্ষিত। অতএব, যাকে চান স্থির রাখেন, যাকে চান বিপথগামী করেন।’ –(তিরমিযী: ৩৫২২)
সুতরাং ফিতনার জমানায় সবর করা ও আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা রাখা আবশ্যক। তাহলে ফিতনা দূর হয়ে যাবে, সর্বদা স্থির থাকবে না। সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি যে এমন কঠিন মুহূর্তে ধৈর্য ধারণ করে, মুক্তির পথ অবলম্বন করে এবং তার সর্বস্ব আল্লাহর সামনে বিলিয়ে দেয়।
সহনশীলতা, নম্রতা, দয়া
সহনশীলতা ও নম্রতাকে আল্লাহ তা’আলা পছন্দ করেন। যে বান্দা এ দুটি গুণে গুণান্বিত আল্লাহ তা’আলা তার প্রশংসা করেছেন। কারণ, এ দুটি গুণের মাঝে রয়েছে কল্যাণ, সিদ্ধান্ত ও সঠিক মতামত গ্রহণ করতে সহায়ক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশাজ্জ আব্দুল কায়েসকে বললেন,
إن فيك خصلتين يحبهما الله الحلم والأناة
‘তোমার মাঝে দুটি গুণ আছে, যা আল্লাহ তা’আলা পছন্দ করেন। তা হচ্ছে সহনশীলতা ও স্থিরতা।’ -সহীহ মুসলিম: ৪০৫৯
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
التَّأنِّي مِن الله، والعَجَلة مِن الشَّيطان
‘স্থিরতা আল্লাহর পক্ষ থেকে আর তাড়াহুড়া শয়তানের পক্ষ থেকে।’ -তারগীব: ১৫৭২
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّ الرِّفْقَ لاَ يَكُونُ فِي شَىْءٍ إِلاَّ زَانَهُ وَلاَ يُنْزَعُ مِنْ شَىْءٍ إِلاَّ شَانَهُ
নম্রতা যে কোন বিষয়কে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। আর যে কোন বিষয় থেকে নম্রতা বিদূরিত হলে তাকে কলুষিত করে। (অর্থাৎ ‘নম্রতা যার মধ্যে থাকবে, তাকে সুন্দর করে তুলবে। যার থেকে দূর হয়ে যাবে তাকে লাঞ্ছিত করে ছাড়বে।’) -সহীহ মুসলিম: ৬৪৯৬
ফিতনা থেকে দূরে থাকা
ফিতনার জমানায় বান্দাকে যে নসিহতটি গ্রহণ করা দরকার, তা হচ্ছে ফিতনা থেকে দূরে থাকা। কারণ, ফিতনা থেকে দূরে থাকার মধ্যে রয়েছে শান্তি ও মুক্তি। অনেক লোক এমন রয়েছে, যারা ফিতনার দিকে অগ্রসর হওয়ার কারণে, ফিতনাকে আলিঙ্গন করার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। সুতরাং সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি, যে ফিতনার জমানায় ফিতনা থেকে বেঁচে থাকল, ফিতনা থেকে দূরে থাকল। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَجِيبُوا لِلَّـهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ ۖ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّـهَ يَحُولُ بَيْنَ الْمَرْءِ وَقَلْبِهِ وَأَنَّهُ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ ﴿٢٤﴾ وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَّا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنكُمْ خَاصَّةً ۖ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّـهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ ﴿٢٥﴾
‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মান্য কর, যখন তোমাদের সে কাজের প্রতি আহ্বান করা হয়, যাতে রয়েছে তোমাদের জীবন। জেনে রেখো, আল্লাহ মানুষের এবং তার অন্তরের মাঝে অন্তরায় হয়ে যান। বস্তুতঃ তোমরা সবাই তাঁরই নিকট সমবেত হবে। আর তোমরা এমন ফাসাদ থেকে বেঁচে থাক, যা বিশেষতঃ শুধু তাদের উপর আপতিত হবে না যারা তোমাদের মধ্যে জালিম এবং জেনে রেখো, আল্লাহর আযাব অত্যন্ত কঠোর।’ -সূরা আনফাল 8:২৪-২৫
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ السَّعِيدَ لَمَنْ جُنِّبَ الْفِتَنَ إِنَّ السَّعِيدَ لَمَنْ جُنِّبَ الْفِتَنَ إِنَّ السَّعِيدَ لَمَنْ جُنِّبَ الْفِتَنَ وَلَمَنِ ابْتُلِيَ فَصَبَرَ فَوَاهًا
‘সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি যে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকল। সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি যে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকল। সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি যে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকল। এবং যে ফিতনায় পতিত হয়েও ধৈর্য ধারণ করল। তার জন্য সৌভাগ্য।’ -আবু দাউদ: ৪২৬৩
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
تَكُونُ فِتْنَةٌ النَّائِمُ فِيهَا خَيْرٌ مِنَ الْيَقْظَانِ وَالْيَقْظَانُ فِيهَا خَيْرٌ مِنَ الْقَائِمِ وَالْقَائِمُ فِيهَا خَيْرٌ مِنَ السَّاعِي فَمَنْ وَجَدَ مَلْجَأً أَوْ مَعَاذًا فَلْيَسْتَعِذْ
‘ফিতনার জমানায় ঘুমন্ত ব্যক্তি জাগ্রত ব্যক্তির চেয়ে শ্রেষ্ঠ, জাগ্রত ব্যক্তি দাঁড়ানো ব্যক্তির চেয়ে শ্রেষ্ঠ, দাঁড়ানো ব্যক্তি ধাবমান ব্যক্তি চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যে মুক্তির বা আশ্রয়ের কোনো জায়গা পেয়ে যায়, সে যেন আশ্রয় গ্রহণ করে।’ -সহীহ মুসলিম: ২৮৮৬
ইমাম জাওযী রহ. বলেন, ‘যে ফিতনার নিকটবর্তী হয়ে যায়, শান্তি তার থেকে দূরে সরে যায়। যে সবরের দাবি করে, তার দায়ভার তার উপরই বর্তাবে। অনেক দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি আছে যারা দেখতে পায় না।’- সয়দুল খাতের: ৩
তাকওয়া ও ন্যায়ের পথে জামাআত-বদ্ধ হয়ে থাকা, মতবিরোধ ও বিভেদ থেকে দূরে থাকা
যখন ফিতনা শুরু হয়ে যাবে, সে সময় যদি কোনো মুসলিম জামাআত বা দল থাকে তাহলে ন্যায় ও হকের উপর সকলে তাতে জমায়েত হয়ে যাবে। কেননা, ফিতনার জমানায় জামাআত-বদ্ধ হয়ে থাকা, তাকওয়া ও ন্যায়ের পথে সহযোগিতা করা, বিভেদ থেকে দূরে থাকা- এগুলো বান্দাকে ফিতনা থেকে মুক্তিদানে সাহায্য করে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّـهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّـهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّـهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ ﴿١٠٣﴾
‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে, এখন তোমরা তাঁর অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ। তোমরা এক অগ্নিকুণ্ডের পাড়ে অবস্থান করছিলে, অতঃপর তা থেকে তিনি তোমাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ নিজের নিদর্শন সমূহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা হেদায়েত প্রাপ্ত হতে পার।’ –(সূরা আলে ইমরান 3:১০৩)
আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ ۖ وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ۚ وَاتَّقُوا اللَّـهَ ۖ إِنَّ اللَّـهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ ﴿٢﴾
তোমরা সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা কর না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা কঠোর শাস্তিদাতা।-সূরা মায়িদা 5:২
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ ۖ وَاصْبِرُوا ۚ إِنَّ اللَّـهَ مَعَ الصَّابِرِينَ ﴿٤٦﴾
‘তোমরা পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হয়ো না। যদি তা কর, তবে তোমরা কাপুরুষ হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব চলে যাবে।’ -সূরা আনফাল 8:৪৬
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ، وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ
‘জামাআত-বদ্ধতায় রয়েছে রহমত, বিভেদে রয়েছে শাস্তি।’ –(মুসনাদে আহমাদ, শাইখ আলবানি সহিহ বলেছেন)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
نَضَّرَ اللَّهُ امْرَأً سَمِعَ مَقَالَتِي فَوَعَاهَا وَحَفِظَهَا وَبَلَّغَهَا فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ . ثَلاَثٌ لاَ يُغَلُّ عَلَيْهِنَّ قَلْبُ مُسْلِمٍ إِخْلاَصُ الْعَمَلِ لِلَّهِ وَمُنَاصَحَةُ أَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَلُزُومِ جَمَاعَتِهِمْ فَإِنَّ الدَّعْوَةَ تُحِيطُ مِنْ وَرَائِهِمْ
‘আল্লাহ তা’আলা সে ব্যক্তিকে উজ্জ্বল করে দেন, যে আমার কথা শুনে তা সংরক্ষণ করে, হেফাজত করে এবং অন্যের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। অনেক ফকিহ আছে যে তার চেয়ে অধিক বিজ্ঞ ফকিহের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। তিনটি বিষয়ের ব্যাপারে মুসলমানের অন্তর বিদ্বেষী হতে পারে না: এক. আল্লাহর জন্য ইলম অর্জনে ইখলাস থাকা। দুই. মুসলিম ইমামদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। তিন. তাদের জামাআতকে আঁকড়ে ধরা। কারণ, দাওয়াত পরবর্তীদেরকেও বেষ্টন করে নেয়।’ -তিরমিযী: ২৬৫৮
হুযাইফা ইবন ইয়ামান রা. বলেন,
كَانَ النَّاسُ يَسْأَلُونَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنْ الْخَيْرِ وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنْ الشَّرِّ مَخَافَةَ أَنْ يُدْرِكَنِي فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّا كُنَّا فِي جَاهِلِيَّةٍ وَشَرٍّ فَجَاءَنَا اللهُ بِهَذَا الْخَيْرِ فَهَلْ بَعْدَ هَذَا الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ وَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الشَّرِّ مِنْ خَيْرٍ قَالَ نَعَمْ وَفِيهِ دَخَنٌ قُلْتُ وَمَا دَخَنُهُ قَالَ قَوْمٌ يَهْدُونَ بِغَيْرِ هَدْيِي تَعْرِفُ مِنْهُمْ وَتُنْكِرُ قُلْتُ فَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ قَالَ نَعَمْ دُعَاةٌ عَلَى أَبْوَابِ جَهَنَّمَ مَنْ أَجَابَهُمْ إِلَيْهَا قَذَفُوهُ فِيهَا قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ صِفْهُمْ لَنَا قَالَ هُمْ مِنْ جِلْدَتِنَا وَيَتَكَلَّمُونَ بِأَلْسِنَتِنَا قُلْتُ فَمَا تَأْمُرُنِي إِنْ أَدْرَكَنِي ذَلِكَ قَالَ تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَإِمَامَهُمْ قُلْتُ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُمْ جَمَاعَةٌ وَلاَ إِمَامٌ قَالَ فَاعْتَزِلْ تِلْكَ الْفِرَقَ كُلَّهَا وَلَوْ أَنْ تَعَضَّ بِأَصْلِ شَجَرَةٍ حَتَّى يُدْرِكَكَ الْمَوْتُ وَأَنْتَ عَلَى ذَلِكَ.
‘লোকেরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে কল্যাণের বিষয়াবলী জিজ্ঞেস করত। কিন্তু আমি তাঁকে অকল্যাণের বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম এ ভয়ে যে, অকল্যাণ আমাকে পেয়ে না বসে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তো জাহিলিয়্যাত ও অকল্যাণের মাঝে ছিলাম। এরপর আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এ কল্যাণের মধ্যে শামিল করলেন। এ কল্যাণের পর আবারও কি অকল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে এর মধ্যে কিছুটা ধূম্রজাল থাকবে। আমি প্রশ্ন করলাম, এর ধূম্রজাল কিরূপ? তিনি বললেন, এক জামাআত আমার তরীকা ছেড়ে অন্য পথ ধরবে। তাদের থেকে ভালো কাজও দেখবে এবং মন্দ কাজও দেখবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সে কল্যাণের পর কি আবার অকল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী এক সম্প্রদায় হবে। যে ব্যক্তি তাদের আহ্বানে সাড়া দেবে, তাকে তারা জাহান্নামে নিক্ষেপ করে ছাড়বে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের কিছু স্বভাবের কথা আমাদের বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, তারা আমাদের লোকই এবং আমাদের ভাষায়ই কথা বলবে। আমি বললাম, যদি এমন অবস্থা আমাকে পেয়ে বসে, তাহলে কী করতে হুকুম দেন? তিনি বললেন, মুসলিমদের জামাআত ও ইমামকে আঁকড়ে থাকবে। আমি বললাম, যদি তখন মুসলিমদের কোনো জামাআত ও ইমাম না থাকে? তিনি বললেন, তখন দলমত ত্যাগ করে সম্ভব হলে কোনো গাছের শিকড় কামড়িয়ে পড়ে থাকবে, যতক্ষণ না সে অবস্থায় তোমার মৃত্যু উপস্থিত হয়।’ -বুখারী: ৭০৮৪
ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘বিদআতের সম্পর্ক বিভেদের সাথে, আর সুন্নতের সম্পর্ক জামাআতের সাথে। এ জন্য এক দিকে বলা হয়, ‘আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’। অপরদিকে বলা হয়, ‘আহলুল্ বিদআতি ওয়াল ফিরকাহ’। -আল-ইস্তিক্বামাহ: ৪২
সৎকাজের সামনে মাথা নত করা তখা আনুগত্য করা
“জামাআতকে আঁকড়ে ধরা” এর থেকে আরেকটি শাখাগত বিষয় নির্গত হয়, তা হলো, বিদ্যমান জামাআতের সীমার ভিতরে সৎকাজের সামনে মাথা নত করা। চাই তা ব্যাপক নেতৃত্ব হোক অথবা এমন কোনো দল বা জামাআত হোক যারা সত্যের উপর জমায়েত হয়েছে। কেননা, সৎকাজের সামনে মাথা নত করা- দল ও ব্যক্তিকে ফিতনার মুখোমুখি হওয়া ও ফিতনা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধতার ভূমিকা রাখে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْ أَطَاعَنِي فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ عَصَى اللهَ وَمَنْ أَطَاعَ أَمِيرِي فَقَدْ أَطَاعَنِي وَمَنْ عَصَى أَمِيرِي فَقَدْ عَصَانِي.
যে আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহ্রই আনুগত্য করল। আর যে আমার নাফরমানী করল, সে আল্লাহ্রই নাফরমানী করল। এবং যে আমার (নির্বাচিত) আমীরের আনুগত্য করল, সে আমারই আনুগত্য করল। আর যে আমার (নির্বাচিত) আমীরের নাফরমানী করল সে আমারই নাফরমানী করল। (-বুখারী-৭১৩৭,মুসলিম)
উক্ত হাদিসের এই আনুগত্যকেই বলা হয় সৎকাজের অনুসরণ। ইমাম মুসলিম রহ. এর হাদিস থেকে যেমনটি আমরা ইঙ্গিত করেছি; আলি রা. থেকে বর্ণিত,
عَنْ عَلِيٍّ قَالَ بَعَثَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم سَرِيَّةً وَأَمَّرَ عَلَيْهِمْ رَجُلاً مِنْ الأَنْصَارِ وَأَمَرَهُمْ أَنْ يُطِيعُوهُ فَغَضِبَ عَلَيْهِمْ وَقَالَ أَلَيْسَ قَدْ أَمَرَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَنْ تُطِيعُونِي قَالُوا بَلَى قَالَ قَدْ عَزَمْتُ عَلَيْكُمْ لَمَا جَمَعْتُمْ حَطَبًا وَأَوْقَدْتُمْ نَارًا ثُمَّ دَخَلْتُمْ فِيهَا فَجَمَعُوا حَطَبًا فَأَوْقَدُوا نَارًا فَلَمَّا هَمُّوا بِالدُّخُولِ فَقَامَ يَنْظُرُ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ قَالَ بَعْضُهُمْ إِنَّمَا تَبِعْنَا النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فِرَارًا مِنْ النَّارِ أَفَنَدْخُلُهَا فَبَيْنَمَا هُمْ كَذَلِكَ إِذْ خَمَدَتْ النَّارُ وَسَكَنَ غَضَبُهُ فَذُكِرَ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ لَوْ دَخَلُوهَا مَا خَرَجُوا مِنْهَا أَبَدًا إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوفِ.
আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি ক্ষুদ্র সৈন্যদল পাঠালেন এবং একজন আনসারীকে তাঁদের আমীর নিযুক্ত করে সেনাবাহিনীকে তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি (‘আমীর) তাদের উপর রাগান্বিত হলেন এবং বললেনঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি তোমাদের আমার আনুগত্য করার নির্দেশ দেননি? তাঁরা বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদের দৃঢ়ভাবে বলছি যে তোমরা কাঠ জড় কর এবং তাতে আগুন জ্বালাও। এরপর তোমরা তাতে প্রবেশ করবে। তারা কাঠ জড় করল এবং তাতে আগুন জ্বালাল। এরপর যখন প্রবেশ করতে ইচ্ছা করল, তখন একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল। তাঁদের কেউ কেউ বলল, আগুন থেকে পরিত্রাণের জন্যই তো আমরা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণ করেছি। তাহলে কি আমরা (সবশেষে) আগুনেই প্রবেশ করব? তাঁদের এসব কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ আগুন নিভে যায়। আর তাঁর (আমীরের) ক্রোধও দমিত হয়ে যায়। এ ঘটনা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বর্ণনা করলে তিনি বললেনঃ যদি তারা তাতে প্রবেশ করতে, তাহলে কোনদিন আর এ থেকে বের হত না। জেনে রেখো! আনুগত্য কেবল বৈধ কাজেই হয়ে থাকে। [বুখারী-৭১৪৫; মুসলিম ৩৩/৮, হাঃ ১৮৪০, আহমাদ ৭২৪]
মুতাশাবিহ (যে সকল বাক্যের অর্থ জটিল এবং কয়েকটি সম্ভাব্য অর্থ থাকে সেগুলোকে মুতাশাবিহ বলা হয়) এমন মুতাশাবিহকে মুহকাম (যে সকল বিষয় অকাট্য ও দৃঢ় তাকে মুহ্কাম বলা হয়) এর দিকে ফিরিয়ে দেয়া এবং শরীয়ত-সম্মত ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের প্রতি মনোনিবেশ করা
ফিতনার জমানায় একটি মূলনীতির প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিৎ, তা হল কথা-কাজ ও বিধিবিধানের ক্ষেত্রে মুহ্কাম তথা যা অকাট্য ও সদৃঢ় তা গ্রহণ করা, মুশকিল ও মুতাশাবিহ (যার অর্থ জটিল ও কয়েকটি সম্ভাব্য অর্থ থাকে) এমন বিষয়কে মুহ্কামের দিকে ফিরিয়ে দেয়া। এমনিভাবে ফিতনার সময়কালে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের প্রতি মনোনিবেশ করা।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” كَيْفَ بِكُمْ وَبِزَمَانٍ ” . أَوْ ” يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَ زَمَانٌ يُغَرْبَلُ النَّاسُ فِيهِ غَرْبَلَةً تَبْقَى حُثَالَةٌ مِنَ النَّاسِ قَدْ مَرِجَتْ عُهُودُهُمْ وَأَمَانَاتُهُمْ وَاخْتَلَفُوا فَكَانُوا هَكَذَا ” . وَشَبَّكَ بَيْنَ أَصَابِعِهِ فَقَالُوا وَكَيْفَ بِنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ ” تَأْخُذُونَ مَا تَعْرِفُونَ وَتَذَرُونَ مَا تُنْكِرُونَ وَتُقْبِلُونَ عَلَى أَمْرِ خَاصَّتِكُمْ وَتَذَرُونَ أَمْرَ عَامَّتِكُمْ ”
‘অচিরেই একটি জামানা আসছে যখন মানুষদেরকে চালনি দিয়ে চালা হবে, সে সময় খরকোটার মত কিছু মানুষ অবশিষ্ট থাকবে। যারা অঙ্গিকার, আমানত নষ্টকারী হবে। সেইসাথে মতবিরোধ করতে করতে এরূপে পরিণত হবে’, (এ কথা বলে) তিনি আঙ্গুলসমূহকে পরস্পর মিলিত করলেন। সাহাবীরা বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের কী অবস্থা হবে? তিনি বললেন, ‘যা জানা আছে তোমরা তা গ্রহণ করবে এবং যা অপছন্দ মনে হয় তা পরিহার করবে। বিশেষ ব্যক্তিদের নির্দেশ কবুল করবে, আর সাধারণদের নির্দেশ পরিহার করবে।’- আবু দাউদ: ৪৩৪২
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
إِنَّمَا كَانَ مَثَلُنَا فِي الْفِتْنَةِ كَمَثَلِ قَوْمٍ كَانُوا يَسِيرُونَ عَلَى جَادَّةٍ يَعْرِفُونَهَا ، فَبَيْنَمَا هُمْ كَذَلِكَ إِذْ غَشِيَتْهُمْ سَحَابَةٌ وَظُلْمَةٌ ، فَأَخَذَ بَعْضُهُمْ يَمِينًا وَشِمَالا فَأَخْطَأَ الطَّرِيقَ ، وَأَقَمْنَا حَيْثُ أَدْرَكَنَا ذَلِكَ حَتَّى جَلَّى اللَّهُ ذَلِكَ عَنَّا ، فَأَبْصَرْنَا طَرِيقَنَا الأَوَّلَ فَعَرَفْنَاهُ وَأَخَذْنَا فِيهِ ، وَإِنَّمَا هَؤُلاءِ فِتْيَانُ قُرَيْشٍ يَقْتَتِلُونَ عَلَى السُّلْطَانِ وَعَلَى هَذِهِ الدُّنْيَا ، مَا أُبَالِي أَنْ يَكُونَ لِي مَا يُفَتِّلُ بَعْضُهُمْ بَعْضًا بِنَعْلَيَّ هَاتَيْنِ الْجَرْدَاوَيْنِ
‘এ ফিতনায় আমাদের উদাহরণ হলো সে জাতির মত, যারা তাদের পরিচিত পথেই চলতে লাগল। এক পর্যায়ে মেঘ ও অন্ধকার এসে তাদেরকে আচ্ছাদিত করে ফেলল। ফলে কেউ ডানে কেউ বামে চলতে চলতে পথ হারিয়ে ফেলল। আমাদের যখন এমন হলো, আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। আল্লাহ আমাদের পথ দেখালেন। আমরা প্রথম পথটি দেখে চিনে ফেললাম এবং চলতে থাকলাম। এ হলো কুরাইশী যুবকদল, সুলতানের বিরুদ্ধে, দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তারা যদি আমার এ কাপড়ের দু’টি জুতা নিয়ে পরস্পরে মারামারিতে লিপ্ত হয়- আমি তাকে পরওয়া করি না।’ -হিলয়াতুল আওলিয়া: ১/৩০৯
হুযাইফা রা. বলেন, নিশ্চয় ফিতনা কলবের সামনে পেশ করা হয়। যে ফিতনায় জড়িয়ে পড়ে তার অন্তরে একটি কালো দাগ স্থাপিত হয়। আর যে তাকে অস্বীকার করে তার অন্তরে একটি সাদা দাগ পড়ে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যার জানতে মনে চায়, তাকে ফিতনায় পেয়ে বসেছে কি না, সে যেন লক্ষ্য রাখে- যদি সে কোনো হারামকে দেখে যা সে হালাল মনে করত অথবা কোনো হালালকে দেখে যা সে হারাম মনে করত। তাহলে বুঝতে হবে তাকে ফিতনায় পেয়ে বসেছে।
মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল-কুরাযী থেকে আবুল মিকদাম হিশাম ইবনে যিয়াদ বলেন, তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ফিতনার আলামত কী? তিনি বললেন, লোকে ভালো জিনিসকে খারাপ মনে করতে শুরু করবে আর খারাপ জিনিসকে ভালো মনে করতে থাকবে।’- হিলয়াতুল আওলিয়া: ৩/২১৪
বর্তমানে মুসলমানরা যে সমস্যার সম্মুখীন, শরঈ শাসন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি তার চেয়ে আরো মারাত্মক সমস্যা
এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে আমরা আলোচনার ইতি টানব যে, বর্তমানে মুসলমানরা যে সমস্যার সম্মুখীন, মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ থেকে শরঈ শাসন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি তার চেয়ে বেশি মারাত্মক ব্যাপার। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শরীয়ত বিবর্তনকারী তাগুতদের সাথে মিলে ইসলামকে নিয়ে মুসলমানদের অবহেলা- অনেক ফিতনা ও মসিবত ছড়ানোর ক্ষেত্রে বেশি অবদান রাখছে। এ ক্ষেত্রে বাস্তব শরঈ বিধানের দাবি কী তা গোপন নয়, সে মাসআলা সূর্যালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। হাফেজ ইবনে হাজার রহ. এ ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেছেন। তা হচ্ছে, আল্লাহর শরীয়তকে শরীয়ত পরিপন্থী অন্যান্য বিধিবিধানের মাধ্যমে পরিবর্তনকারী শাসক স্পষ্ট কাফের। তিনি (আল-বিদায়া ওয়ান নেহায়া-১৩/১৩৯) কিতাবে বলেন, ‘এসবের প্রত্যেকটি আম্বিয়া কেরামের উপর আবর্তিত শরীয়তের পরিপন্থী। সুতরাং যে খাতামুন নাবিয়্যীন মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাযিলকৃত সুসংহত শরীয়তকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো রহিত শরীয়তদারীর কাছে ফায়সালা তলব করল সে কাফের। তাহলে যে ইলয়াসার কাছে ফায়সালা তলব করল এবং মামলা দায়ের করল তার কী অবস্থা? যে এমনটি করবে সে মুসলমানদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাফের।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ ۚ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّـهِ حُكْمًا لِّقَوْمٍ يُوقِنُونَ ﴿٥٠﴾
‘তারা কি জাহেলী যুগের ফায়সালা কামনা করে? আল্লাহ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্য উত্তম ফায়সালাকারী আর কে আছে?’ -সূরা মায়িদা 5:৫০
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا ﴿٦٥﴾
‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায় বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্টচিত্তে কবুল করে নিবে।’ -সূরা নিসা 4:৬৫
মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম রহ. বলেন, ‘বিশ্ববাসীর মাঝে ফায়সালা করার লক্ষ্যে এবং অসঙ্গতি ও অবাধ্যতায় ঝগড়াকারীদের ঝগড়ার সময় মীমাংসাকারী রূপে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় ভীতি প্রদর্শনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরে জিবরাইল আ. যা নাযিল করেছেন তার পরিবর্তে অভিশপ্ত নিয়ম-নীতি গ্রহণ করা স্পষ্টতই সবচেয়ে বড় কুফরি।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّـهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ ۖ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّـهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّـهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا ﴿٥٩﴾
‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।‘ -সূরা নিসা 4:৫৯
পরস্পর বিবাদের সময় যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ফায়সালাকারী রূপে গ্রহণ না করে তাদের ঈমানকে আল্লাহ তা’আলা বারবার নেতিবাচক ও কসমের শব্দ দ্বারা শক্তভাবে নাকচ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন,
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا ﴿٦٥﴾
‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায় বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্টচিত্তে কবুল করে নিবে।’ -সূরা নিসা 4:৬৫
আল্লাহ তা’আলা তাদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুধু ফায়সালাকারী রূপে মেনে নেয়াকে যথেষ্ট মনে করেননি; বরং পরবর্তীতে এ বিষয়ে অন্তরে কোনোরূপ সংকোচতা না থাকার বিষয়টিকেও যুক্ত করেছেন। আল্লাহর বাণী, ‘অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা পাবে না।’ الحرج অর্থ সংকীর্ণতা। বরং এ ব্যাপারে অন্তর থাকবে প্রশস্ত, পেরেশানি ও অস্থিরতা থেকে নিরাপদ।
এখানে আল্লাহ তা’আলা এ দু’টি বিষয় উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হননি; তার সাথে তাসলীম তথা মেনে নেয়াকেও যুক্ত করেছেন। তা হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুকুমের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা। নফসের সাথে সম্পর্কিত যে কোনো প্রকার সংকীর্ণতা থেকে পবিত্র হবে এবং একে পরিপূর্ণরূপে মেনে নিবে। এখানে তাকীদযুক্ত মাসদার উল্লেখ করা হয়েছে। তা হচ্ছে, আল্লাহর বাণী, تسليما আবার تسليما শব্দের উপরও যথেষ্ট নয়; বরং এখানে التسليم المطلق (সাধারণ মেনে নেয়া)।’ -তাহকীমুল্ কাওয়ানীন: ১
মাসআলাটি সুস্পষ্ট, পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত দ্বারা সাব্যস্ত। এটি মতবিরোধপূর্ণ কোনো মাসআলা নয় যে, উলামায়ে-সু এর সূত্র ধরে মানুষের মাঝে দ্বীনকে নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলবে। সুতরাং এসব তাগুতদেরকে বাতিল সাব্যস্ত করা, তাদের ভ্রষ্টতা বর্ণনা করা এবং তাদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি অবস্থান করা অনেক বড় সাওয়াবের কাজ, ফিতনা নয়। বরং ফিতনা হলো, মুসলমানদের মাঝে আল্লাহর শরীয়তের বিবর্তনকারী তাগুতদের ব্যাপারে নীরব থাকা। অতএব, বর্তমান উলামা ও দাঈগণের উপর কর্তব্য হলো, এ মাসআলা প্রকাশ করা এবং তার দাওয়াত দেয়া। নিশ্চয় তাগুত ও তাদের সহযোগীরা মাসআলাটি মুছে দেয়া ও মানুষদেরকে এ থেকে বিরত রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা ভালো করেই জানে যে, শরীয়তের নেতৃত্ব তাদেরকে ধ্বংস ও গুমরাহী সাব্যস্ত করার চূড়ান্ত মাধ্যম।
ড. সামী আল-উরায়দী
৮ সফর ১৪৩৮
************
مع تحيّات إخوانكم
في مؤسسة النصر للإنتاج الإعلامي
قاعدة الجهاد في شبه القارة الهندية (بنغلاديش)
আপনাদের দোয়ায় মুজাহিদ ভাইদের ভুলবেন না!
আন নাসর মিডিয়া
আল কায়েদা উপমহাদেশ বাংলাদেশ শাখা
In your dua remember your brothers of
An Nasr Media
Al-Qaidah in the Subcontinent [Bangladesh]
“গ্রেটার ইজরাইল” ভবিষ্যতবানী সম্পর্কে একটু ধারনা দিন কেউ ভাইয়েরা!