পিডিএফ/ওয়ার্ড || একজন মহীরুহের চলে যাওয়া! || মুসআব ইবরাহীম
একজন মহীরুহের চলে যাওয়া!
মুসআব ইবরাহীম
অনুবাদঃ মাওলানা আনিসুর রহমান
অনলাইনে পড়ুন
ডাউনলোড করুন
https://archive.org/details/EkjonMohiruh1
http://www.mediafire.com/file/hiks7408af1441l/EkjonMohiruh.pdf/file
word
https://archive.org/details/EkjonMohiruh1
http://www.mediafire.com/file/chfcrwbidw1mt92/EkjonMohiruh.docx/file
PDF
—-
http://www.mediafire.com/file/zbrrbybsid55bu3/139._EkjonMohiruh.pdf/file
https://archive.org/download/u_m_a_5/137.%20EkjonMohiruh.pdf
Word
—–
http://www.mediafire.com/file/d98mbf4l31okiw4/139._EkjonMohiruh.docx/file
https://archive.org/download/u_m_a_5/137.%20EkjonMohiruh.docx
=========================
একজন মহীরুহের চলে যাওয়া!
মুসআব ইবরাহীম
অনুবাদঃ মাওলানা আনিসুর রহমান
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
পূর্ণ সাড়ে চার দশক ধরে দ্বীন ও শরীয়তের হেফাজত করার পর হযরত মাওলানা জালালুদ্দীন হক্কানী স্বীয় রবের দরবারে হাজির হয়ে গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মহান আল্লাহ তা’য়ালার কালিমাকে সমুন্নত করার জন্য জিহাদ ও ক্বিতালের অভিযানে, যুদ্ধ-বিগ্রহের অঙ্গনে এবং হক্ব ও বাতিলের সংঘাতের ময়দানে তিনি হক্বের তরবারী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সমকালীন তাগুত ও বাতিলের অনুসারীদের শিরশ্ছেদকারী ছিলেন তিনি।
তিনি সমকালীন জিহাদী আন্দোলনের জন্য “শাহ্ বালূত” বৃক্ষতুল্য ছিলেন। বর্ষীয়ান এই বৃক্ষের সুশীতল ছায়াতলে দুনিয়ার সহায়-সম্বলহীন মুহাজির মুজাহিদদের বিশ্রাম ও অবস্থানের সুযোগ হয় এবং কুফরের বিরুদ্ধে ধূলা ওড়ানো যুদ্ধের সামান্য ভাগও জুটে। পৃথিবী জুড়ে চলমান তাগুত ও কুফরির অন্ধকারের প্রতিরোধে এই শাহ্ বালূত বৃক্ষ তাঁর দৃঢ়তা ও দেহ (জান-মাল), শাখা-প্রশাখা ও পাতাগুলোকে উজাড় করে দিয়েছেন। ঈমানের যতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে, সবগুলো এই বর্ষীয়ান বৃক্ষের মূলের গভীরতা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। যেমন- আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও ইয়াক্বীন, আল্লাহর উপর ভরসা ও তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন, তাক্বওয়া ও ভয়, ইলম ও আমল, ধৈর্য ও দৃঢ়তা, দ্বীনি আত্মমর্যাদাবোধ, গাইরুল্লাহর প্রতি বিদ্বেষ ও বিমুখিতা এবং কুফরের প্রতি ঘৃণা ও শত্রুতা।
তিনি সারা দুনিয়ার কুফরি শক্তিকে শুধু কাঁপিয়েই ছাড়েননি। বরং সুপার পাওয়ার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর দুই তাগুতী শক্তিকে সমূলে উপড়ে ফেলার ক্ষেত্রে স্বীয় জিহাদী আক্রমণের দ্বারা কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছেন। আল্লাহ তা’আলার তাওফীকে রাশিয়াকে পরাজিত করার ও লাল বাহিনীর পতাকাধারীদেরকে রাতের অন্ধকারে গুম করে ফেলার জন্য সাধারণ আফগান মুজাহিদদের যোগ্য বানিয়েছেন উঁচু মাপের এই অসাধারণ কমান্ডার। অস্ত্র-শস্ত্র ও সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও মুজাহিদগণ তাঁরই উসিলায় সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো ভয়ঙ্কর যোদ্ধা জাতিকে পরাজিত করতে সফল হন।
সোভিয়ের ইউনিয়নের পরাজয়ের পর কিছু জিহাদী সংগঠনের পারস্পরিক আস্থাহীনতা, মতবিরোধ ও বদমেজাযির কারণে পুরা আফগানের জমিন যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বাকবিতণ্ডার ময়দান হয়ে গেল। আফগান মুসলমানদের পারস্পরিক যুদ্ধে বর্ণনাতীত রক্ত প্রবাহিত করা ঐ সকল জিহাদী গ্রুপের নেতাদের থেকে তিনি বিদ্যা ও বুদ্ধি, যোগ্যতা ও শক্তিতে বহু গুণে এগিয়ে ছিলেন। যদি তিনি চাইতেন, তাহলে তিনি একাই এই ফেতনা-ফাসাদকে হাওয়ার সাথে মিশিয়ে দিতে পারতেন। স্বীয় সামরিক অভিজ্ঞতার প্রভাব খাটিয়ে বড় পদ বাগিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু এ অবস্থায় তিনি সব ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহ, বাকবিতণ্ডা ও ফেতনা-ফাসাদ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ পৃথক রেখেছেন। কোনো অবস্থাতেই মুসলমানদের পারস্পরিক যুদ্ধে পড়ে নিজের হাত মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত করেননি।
ফাসাদকে নির্মূল করার জন্য আমিরুল মুমিনিন মোল্লা মোহাম্মাদ উমর মুজাহিদ (রহঃ) এর নেতৃত্বে তাহরীকে তালেবানেরর ভিত্তি স্থাপন করা হলো। পরিশেষে সকল জালেম ও অপরিচিত লিডারদেরকে অধীনস্থ করে মুজাহিদগণ ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের সংস্কার কাজ শুরু করলেন। তখন আমিরুল মুমিনিন মোল্লা মোহাম্মাদ উমর মুজাহিদ (রহঃ) এর হাতে বাই’আত হন জালালুদ্দীন হক্কানী। তিনি নিজেকে ও নিজের সকল প্রকারের যোগ্যতা, আসবাবপত্র, কেন্দ্র ও তাঁর সকল মুজাহিদ সহ সবকিছু ইমারতে ইসলামিয়ার কাছে অর্পণ করেছেন। অথচ ঐ সময় তিনি জ্ঞানে-বয়সে ও জিহাদী অভিজ্ঞতায় আমিরুল মুমিনিন মোল্লা মোহাম্মাদ উমর মুজাহিদ(রহঃ) থেকে বহু গুণে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু তিনি বিনা সংশয়ে আমিরুল মুমিনের বাই’আত মেনে নেন।
তিনি শেষ সময় পর্যন্ত ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের সাথে স্বীয় প্রতিশ্রুত অঙ্গীকারকে বাস্তবায়ন করেছেন। তাঁর এই আমল তাঁকে স্বার্থহীনতা ও ইখলাছের মাইলফলক বানিয়েছে। আমিরুল মুমিনিন (রহঃ) এর হাতে তাঁর বাই’আত এটা প্রমাণ করে যে, তিনি প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর ওয়ালী এক বুজুর্গ ছিলেন। তিনি কখনো সুনাম-সুখ্যাতি, প্রসিদ্ধি, দুনিয়াবী ইজ্জত, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও বাহবা অর্জনের দিকে মনোনিবেশ করেননি। বরং যখন যেখানে দ্বীন ও শরীয়তের কোনো বিষয় আসত, তখন সেখানে তিনি স্বার্থহীনভাবে বিনয় ও নম্রতার সাথে মূল্যবান দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেন। ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের মোবারক শাসনামলে তিনি সীমান্তবর্তী এলাকার গভর্নর ছিলেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জিহাদ চলাকালীন সময়ে সারা বিশ্ব থেকে আগত আরব ও আনারবের মুজাহিদদেরকে সর্ব দিক থেকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে কোনো সময়ই উদাসীন থাকতেন না। মোজাদ্দিদে জিহাদ শায়খ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহঃ), মুহসিনে উম্মত শায়খ উসামা বিন লাদেন (রহঃ), শায়খ উমর আব্দুর রহমান (রহঃ), শায়খ আইমান আয্-যাওয়াহেরী হাফিজাহুল্লাহু এবং শায়খ আবু মুসআব আয্-যারকাবী (রহঃ) সহ সকল আরব মুজাহিদের দেখা-শোনা ও খোঁজ-খবর তিনি নিতেন। তিনিই তাঁদের আবাসস্থল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থা করতেন। এবং তাঁদের সমস্ত সামরিক প্রয়োজনও তিনি হক আদায় করে পুরা করতেন। অন্যান্য সকল প্রয়োজনের দিকেও পুরোপুরি খেয়াল রাখতেন। আলেমে রব্বানী ও ইসলামী বিশ্বের সু-পরিচিত, জিহাদী ও ইলমী ব্যক্তিত্ব শায়খ আবু মুহাম্মাদ আল-মাক্বদিসী হাফিজাহুল্লাহু (তাঁর) শোক সভার স্বীয় আলোচনায় এই বাস্তবতাই খুলে বর্ণনা করেছেন:
“নেতা, মুজাহিদ, শায়খ মৌলভী জালালুদ্দীন হক্কানী দীর্ঘ অসুস্থতার পর ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর উপর রহম করুন এবং জান্নাতুল ফেরদাউসের সর্বোচ্চ আসন দ্বারা সৌভাগ্যবান করুন। তিনি শুরু থেকেই আফগানিস্তানে জিহাদী নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত ছিলেন। তিনি মোল্লা উমর (রহঃ) ও ইমারতে ইসলামিয়াকে সাহায্য করেছেন, এবং এই পথে নিজের একাধিক সন্তানকে শহীদ হওয়ার জন্য পেশ করেছেন। نحسبهم كذالك – বাতিলের তল্পীবাহী হুকুমত ও তার নেতা আমেরিকার পক্ষ থেকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির দিকে তিনি অন্যান্যদের মতো ঝুঁকে পড়েননি। এই লোভ-লালসার কারণে জিহাদের রাস্তাও ছাড়েননি, যেই লোভ-লালসার ফাঁদে পড়েছে সাইয়্যাফ, রাব্বানী, হেকমতিয়ার ও এ জাতীয় আরো কিছু ব্যক্তি। তিনি কখনও মুজাহিদদের বিপক্ষে কাফেরদের সাথে একমত হননি। বরং তিনি তো আফগান যুদ্ধের শুরুতে প্রথমে কমিউনিস্টদের সাথে স্বাধীনতার যুদ্ধ করেছেন, তারপর খৃষ্টানদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। আমি নিজে সরাসরি মৌলভী জালালুদ্দীন হক্কানী(রহঃ) এর সাথে আফগানিস্তানে সাক্ষাৎ করেছি। আমি তাঁকে আরব মুজাহিদদের খুব কাছের এবং তাদেরকে অনেক বেশি মুহাব্বতকারী পেয়েছি। আরব মুজাহিদদের অধিকাংশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ঐ সকল এলাকায়ই ছিল, যেগুলো তাঁর নিরাপত্তা বেষ্টনিতে ছিল। তিনি সীমাহীন সাহসী ও অতিথিপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর বাড়িতে কতক আরব মুজাহিদ এবং তাদের পরিবার পরিজন বসবাস করেছিল, যাদের মধ্যে আবু মুসআব আয্-যারকাবী (তাক্বাব্বালাল্লাহু) এর পরিবার-পরিজনও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুতরাং আমরা দোয়া করছি আল্লাহ তা’য়ালা যেন তাঁর উপর রহম করেন, তাঁর জিহাদকে কবুল করেন এবং তাঁর ঠিকানা নবীগণ, সিদ্দীকিন, শুহাদা ও সালেহীনদের সাথে যেন করেন আর এটা কতই না উত্তম বন্ধুত্ব।”
আমেরিকার দমন-পীড়নের কারণে সুদান সরকার যখন শায়খ উসামা বিন লাদেন (রহঃ) ও তাঁর মুহাজির সাথীগণকে আর বেশি দিন থাকতে দিতে অস্বীকৃতি জানালো, তখন শায়খ উসামা (রহঃ) ও তাঁর সাথীগণকে আফগানিস্তানে আসার দাওয়াত দিয়েছেন মৌলভী ইউনুস খালেস (রহঃ) ও জালালুদ্দীন হক্কানী (রহঃ)। তাঁরা তাঁদের হেফাজত, নুসরাত, সহযোগিতা ও দেখাশোনার সার্বিক জিম্মাদারী গ্রহণ করেন। এই দুইজন সহ পুরো ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান এরপর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও শায়খ উসামা (রহঃ) ও তাঁর সাথীদের জিহাদী আন্দোলনকে সাহায্য-সহযোগিতা করা থেকে পিছু হটেনি।
১১ই সেপ্টেম্বরের জিহাদী হামলার পর যখন আমেরিকা পাগলা হাতির মতো আফগানিস্তানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন শায়খ হাক্কানির সামনেও দুটি রাস্তা খোলা ছিল। একটি হলো দুনিয়াবি আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসিতার রাস্তা। আরেকটি হলো দুনিয়াবি সংকীর্ণতা, পরীক্ষা ও কষ্ট-ক্লেশের রাস্তা, যার শেষ মাথায় রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি, পরকালীন নাজ-নেয়ামত, প্রশস্ততা ও চিরস্থায়ী জান্নাতের বাগান। হামিদ কারজাঈ তাঁকে তিন এলাকার অর্ধেক হুকুমত এবং আফগান সেনাবাহিনীর সেনাপতি বানানোর জোর প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু দুনিয়াবি ক্ষমতার এই চাকচিক্য তাঁর মতো বীরপুরুষকে পরকালীন নেয়ামতরাজি থেকে উদাসীন করতে পারেনি। তিনি ধৈর্য ও দৃঢ়তার রাস্ততা গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন:
“আমি আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। পরাশক্তির সাথে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর শরীয়তের উসূলের আলোকে করেছি। আমরা আল্লাহ তা’য়ালার কাছে আশাবাদী যে, অতীতে যেভাবে সুপার পাওয়ার রাশিয়াকে আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের হাতে পরাজিত ও বেইজ্জতি করে টুকরা টুকরা করেছেন, সেভাবেই আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে বিজয় দান করবেন। দুনিয়াবী জয়-পরাজয়ের দিকে দৃষ্টিপাত ছাড়াই আখেরাতের কামিয়াবী ও শা’ফিয়ে মুহতারাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে নিশ্চিত মস্তক অবনত থাকবে, যার থেকে আগে বেড়ে সফলতার সম্ভাবনা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে।”
এই নাজুক পরিস্থিতিতে সর্বপ্রথম তিনি যে কাজটি করেছেন তা হলো কাবুল হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর আফগানিস্তান থেকে আগত সকল আরব-অনারব মুহাজির মুজাহিদদেরকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করার প্রতি মনোনিবেশ। আফগানিস্তানের অবস্থা যেহেতু ঘোলাটে ছিল এবং পুরো দুনিয়ার কুফুরী শক্তি জোটবদ্ধ হয়ে একযোগে আফগানিস্তানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেহেতু তখন তিনি মিরান শাহ্ ও উত্তর ওয়াজিরিস্তানে অবস্থিত স্বীয় কেন্দ্র ও সংগঠনকে মুজাহিদদের সহযোগিতার জন্য ব্যবহার করেছেন। এর ফলে এই উত্তর ওয়াজিরিস্তানই আমেরিকার বিরুদ্ধে আফগান যুদ্ধে মুজাহিদদের যুদ্ধ পরিচালনার মারকায হয়েছে।
তিনি যদিও বয়স্ক এবং শারিরিক গঠনে হালকা ও দুর্বল প্রকৃতির ছিলেন, তা সত্ত্বেও তিনি জিহাদী কাতারসমূহকে বিন্যাস ও মজবুত করার জন্য নিজেকে সজাগ রাখতেন। সাহসী বাহাদুর জিহাদী নেতা খলিফা সিরাজুদ্দীন হাফিজাহুল্লাহু তাঁরই সংস্পর্শে লালিত হয়েছেন। তাঁর সাহস ও দৃঢ়তা, বাহাদুরী ও ওয়াফাদারী, জানবাজী ও আয়েশী, আত্মমর্যাদাবোধ ও সম্ভ্রম সবই তিনি তাঁর মিরাছ থেকে পেয়েছেন। এই জন্যই তো তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে জিহাদের নেতৃত্বের জন্য তাঁকে নির্বাচন করেছেন। কিছু দিনের মধ্যেই হক্কানী খান্দান এবং তাঁর নেগরানিতে জিহাদের উদ্দেশ্যে নেতৃস্থানীয় মুজাহিদগণ খলিফা সিরাজুদ্দীন হক্কানীর নেতৃত্বে আমেরিকানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দক্ষিণ পূর্ব আফগানিস্তানকে মার্কিনীদের জন্য শ্মশান বানিয়েছেন। এই কারণে হক্কানী নেটওয়ার্কের থাবা খৃস্টান মার্কিন বাহিনীর উপর সাওয়ার হয়েছে এবং এখনো সাওয়ার হয়ে আছে। এখানে এ বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার যে, হক্কানী নেটওয়ার্ক ভিন্ন কোনো সংগঠন বা দল নয়। বরং শুরু থেকেই এটি মুজাহিদীনদের একটি গ্রুপ, যা প্রথমে মাওলানা জালালুদ্দীন হক্কানী (রহঃ) এবং তাঁর পরে খলিফা সিরাজুদ্দীন হক্কানী হাফিজাহুল্লাহু এর তত্ত্বাবধানে ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানে মজবুত সামরিক বাহিনীর একটি হাত ও একটি জিহাদী গ্রুপ ছিল। আর খলিফা সিরাজুদ্দীন হক্কানী হাফিজাহুল্লাহু ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানে আমিরুল মু’মিনীন মোল্লা হাইবাতুল্লাহ নাসারাহুল্লাহু এর নায়েবও ছিলেন।!
এই হক্কানী নেটওয়ার্ককে খৃস্টান আমেরিকা আফগানিস্তানে নিজেদের প্রথম শত্রু সাব্যস্ত করেছে। স্বীয় নেতাদের চাটুকারিতা করতে গিয়ে “ফ্রন্ট লাইন ইত্তেহাদী” ও তাদেরকে নিজেদের প্রথম শত্রু হিসেবে বুঝত। এ কারণেই উত্তর ওয়াজিরিস্তানে গত দশ বছরে যতগুলো ড্রোন ও মিজাইল হামলা হয়েছে, তার আশি পার্সেন্টেরও বেশি হামলা হক্কানী মারকাযে হয়েছে। আর এই অপ্রীতিকর ঘটনার বাস্তবতা এখন পুরো স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ড্রোন হামলাগুলোর সকল কারসাজি ও তদারকি পাক বাহিনী ও তাদের গোপন কেন্দ্রের জিম্মাদারীতে ছিল।
মাওলানা জালালুদ্দীন হক্কানী (রহঃ) এর চার ছেলের এক জন মার্কিন বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন। বাকি তিন জনের মধ্যে দুই জন উত্তর ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনীর সাহায্যে পরিচালিত ড্রোন হামলায় শহীদ হয়েছেন। আরেক জন সন্তান ডাঃ নাসীরুদ্দীনকে ইসলামাবাদে আমেরিকান ও পাকিস্তানী গোয়েন্দা এজেন্সির যৌথ অভিযানে শহীদ করা হয়েছে। তাছাড়া তিনি এক স্ত্রী, কন্যা, নাতি-নাতনী, পৌত্র-পৌত্রী সহ আরো কিছু নিকট আত্মীয়কেও চলমান ক্রুসেড যুদ্ধে দ্বীন ও শরীয়তের জন্য উৎসর্গ করেছেন। এসকল শহীদের রক্তের দায়ভার ক্রুসেডার মার্কিনীদের সাথে সাথে তাদের পা চাটা গোলাম পাক বাহিনী ও তাদের গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর উপরও বর্তায়!
২০১৪ সালের জুন মাসে শুরু হওয়া সামরিক অভিযানের ঘাত-প্রতিঘাতের শুরুতেই ঐ সময়ের ডাইরেক্টর জেনারেল আই. এস. পি. আর. আছেম পরিস্কার ভাষায় ঘোষণা করে দিল, “এই অপারেশনের উদ্দেশ্য হলো আতঙ্ক সৃষ্টিকারী গ্রুপ তথা মুজাহিদ বাহিনীকে নির্মূল করা, যাদের তালিকায় হক্কানী নেটওয়ার্কও রয়েছে।”
নিশ্চিত ভাবে এ কথা বলা যায় যে, তিনি (জালালুদ্দীন হক্কানী রহঃ) বর্তমান জমানায় জিহাদ প্রেমিকদের জন্য এক জন যোগ্য নেতা! তিনি দুঃসময়েও জিহাদ করেছেন, সুসময়েও জিহাদের ময়দান উত্তপ্ত রেখেছেন। সংকীর্ণতার হালতেও তিনি এ পথের দ্রুতগামী অশ্বারোহী, সচ্ছলতার হালতেও। এমনটি কখনো হয়নি যে, দুনিয়াবী লোভ-লালসা তাঁকে এ পথ থেকে সরিয়ে সফলকাম হয়েছে। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের নাস্তিক কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধেও নাঙ্গা তলোয়ার ছিলেন, এবং উম্মতে মুসলিমার বিরুদ্ধে ইয়াহুদী খৃস্টানদের সৃষ্ট অরাজকতার বিরোধিতায়ও তৎপর ছিলেন। তিনি আহমদ শাহ্ মাসউদ, সাইয়্যাফ, রাব্বানী, মুজাদ্দেদী ও হেকমতিয়ারের ন্যায় স্বীয় আখেরাতকে দুনিয়ার চাকচিক্য ও ধন-সম্পদের বিনিময়ে বিক্রি করে দেননি, বরং অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি পাহাড়ের মতো অবিচলতার সাথে আল্লাহর দুশমনদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন ও অব্যহত আছেন। তিনি সব ধরনের বিরোধিতা মেনে নিতে প্রস্তুত থাকলেও আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাতানো নীতিমালা থেকে পিছু হটতে কিছুতেই প্রস্তুত নন। কঠিন থেকে কঠিন হালতেও তাঁর দৃঢ়তার মাঝে সামান্যতম বিচ্যুতি ঘটেনি। তিনি স্বীয় জিহাদী জীবনের সূচনালগ্নের দিনগুলোকে স্মরণ করতে গিয়ে বলেন:
“জিহাদের প্রথম বছর লোকেরা আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারত না। আমরা সংখ্যায় কম ছিলাম এবং পাহাড়ের গুহায় থাকতাম। কেউ আমাদের কাছে আসতে পারত না, কেউ আমাদেরকে সহযোগিতা করারও সাহস করত না। চা বানানোর জন্য আমরা আগুন পর্যন্তও জ্বালাতাম না এই আশংকায় যে, কোনো দিক থেকে আগুনের ধোঁয়া উপরে উঠে যায় কি না এবং শত্রুরা আমাদের অবস্থান জেনে যায় কি না। এমনকি প্রশাসন পর্যন্ত জানত না আমরা কোথায় আছি। আর জমিনও আমাদের জন্য সংকীর্ণ হতে লাগল এবং রেশনও শেষ হয়ে গিয়েছিল। কেউ অসুস্থ হলে ধৈর্য ধরে সহ্য করে থাকতেন। মর্যাদার আসন কোনো কারণে সরে গেলে সেটাও তিনি ধৈর্যের সাথে গ্রহণ করতেন। কিন্তু ক্ষুধার জ্বালা কীভাবে সহ্য করা সম্ভব? না খেয়ে কি বাঁচা যায়? একবার আমি ফজর নামায পড়ে সংকীর্ণতার হালতে জায়নামাযে বসে আছি। তখন আমি প্রচণ্ড ক্লান্ত। এমন সময় পেছন থেকে কোনো একজন ব্যক্তি এসে আমার কাঁধ ঝাড়া দিলেন। তিনি জায়নামাযে বসা ছিলেন আর আমাকে বলছিলেন, “হে জালালুদ্দীন! তোমার রব তোমাকে ত্রিশ বছর যাবত পানাহার করিয়েছেন, কিন্তু তুমি তাঁর পথে জিহাদ করনি। এখন তিনি যদি তোমাকে এই দুরবস্থা থেকে মুক্ত করেন, তবে কি তুমি তাঁর পথে জিহাদ করবে?!”
বাস্তবতা হলো তিনি (জালালুদ্দীন হক্কানী রহঃ) জিহাদের রাস্তা পরিত্যাগ করে এক মুহূর্তের জন্যও পিছনে বসে থাকাটা পছন্দ করতেন না! তিনি জিহাদকে নিজের জীবনের ক্যারিয়ার বানিয়ে নিয়েছেন। আর এটা কতই না উত্তম ক্যারিয়ার! দুনিয়াতে বড়ত্ব ও উঁচু মর্যাদাও এরই মাঝে নিহিত আছে, যা তাঁর অর্জিত হয়েছে। আল্লাহ তা’য়ালা এই জিহাদের বরকতে স্বীয় শত্রুদের অন্তরে তাঁর ভয় ও প্রভাব প্রতিপত্তি ঢেলে দিয়েছেন। এবং এই জিহাদের ওসিলায় ঈমানদারদের অন্তরে তাঁর প্রতি ভালোবাসা, আত্মবিশ্বাস ও সদিচ্ছার পুঁজি বানিয়েছেন। আর এই জিহাদ এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা পরকালে আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টি পাওয়ার উত্তম ব্যবস্থা এবং জান্নাতে সুউচ্চ মাক্বাম অর্জনের উপায়।
হে উলামায়ে কেরাম! হে মজবুত দ্বীনের প্রকৃত ধারক বাহকগণ! হে ইলমে নবুয়্যাতের উত্তরাধিকারীগণ! মাওলানা জালালুদ্দীন হক্কানী (রহঃ) স্বীয় ইলম ও আমলের দ্বারা উলামায়ে রাব্বানীর ব্যক্তিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন! উলামায়ে হক্ব তো এমনই হয়ে থাকে, যারা দুনিয়ার সর্ব প্রকার কুফর ও তাগুতের মোকাবেলায় সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় মজবুত! যারা কোনো লোভ-লালসা, আশা-আকাঙ্খা, ভয়-ভীতি ও লাভ-ক্ষতির আশংকা এবং দুনিয়ার ভালবাসায় মত্ত হয় না এবং পরকালীন জবাবদিহিতার ব্যাপারেও নির্ভয় হয় না।
সুতরাং মাওলানা জালালুদ্দীন হক্কানী (রহঃ) এর ঈমান ও বিশ্বাসে ভরা জীবনীতে আমাদের সকলের জন্য রয়েছে অগণিত শিক্ষা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এই যে, যখন জালেম শত্রু রুশ বাহিনী ছিল তখনও জিহাদ ও ক্বিতালের ময়দানে অবতরণ করা ফরজ ছিল। আর এই ফরজ তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আদায় করে দেখিয়েছেন। এমনিভাবে বর্তমানে যেমন জালেম শত্রু আমেরিকা, তাদের বিরুদ্ধেও জিহাদ ও ক্বিতালের ময়দানে অবতরণ করা ফরজ। “পয়গামে পাকিস্তান” এবং “মক্কা কনফারেন্স” এর মতো দ্বীনের দুশমন, শরিয়তের সাথে খেয়ানত, এবং জিহাদকে অকেজো ও রহিত করার মতো যে দুঃসাহস দেখিয়েছে, তিনি তেমনটি করেননি!!! এটা তাঁর এমন এক শিক্ষা, যার দিকে তোমাদের উলামায়ে কেরামদেরকেও আহ্বান করা হচ্ছে। ইলমের ময়দানে, কুফরের মোকাবেলায় বীরত্বের অঙ্গনে এবং ইলমকে আমলের ছাঁচে ঢালার প্রাঙ্গনে তোমাদেরকে আহ্বান করা হচ্ছে! তোমরা এই আহ্বানে সাড়া দাও এবং উম্মতের কাতারের নেতৃত্ব দাও!!!
********************