আসন্ন কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে সারা দেশে ইতিমধ্যেই বসেছে পশুর হাট। এসকল পশুর হাট ঘিরে নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, বিভিন্ন সিটি ও জেলা পর্যায়ে পশুর হাট ইজারা দেয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণের পরিবর্তে গোপনে কিংবা সমঝোতার মাধ্যমে ইজারা দেয়া হয়েছে। প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এলাকার সরকার দলীয় সংসদ সদস্য, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের। এর ফলে দেশের শত কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে। আবার কোথাও কোথাও প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলেও মূলত কাউন্সিলর, প্রভাবশালী নেতা ও স্থানীয় সংসদ সদস্যরা নেপথ্যে থেকে যে ক’টি দরপত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়, তার অধিক দরপত্র সাধারণত জমা পড়ে নাই। ফলে নিয়ন্ত্রণের লাগাম ছিল সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের হাতে। পশু কেনা বেচার ছাড়পত্র মূল্য তাদের ইচ্ছাতেই নির্ধারণ করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, এবারো ইচ্ছেমতই আদায় করা শুরু হয়েছে ছাড়পত্র আদায়। হাটে পশু নিয়ে ফেরত গেলেও দিতে হচ্ছে টোল। এরপর ক্রেতা বিক্রেতাকেও দিতে হচ্ছে ফি। হাটগুলো প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে বলে তাদের ইচ্ছের কাছেই জিম্মি ক্রেতা বিক্রেতারা।
রাজধানীর কোরবানির পশুরহাটগুলো আওয়ামী লীগসহ সরকার দলীয় অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সিন্ডিকেটের দখলে। গত বছরের তুলনায় এবছর প্রায় সবকয়টি হাটেরই দর কম পড়েছে। সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে সিটি কর্পোরেশন অনেকটা বাধ্য হয়েই কম দরে হাট ইজারা দিচ্ছে। ফলে দুই সিটি কর্পোরেশন গত বছরের তুলনায় কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা রাজস্ব হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিএসসিসি’র ১৩টি হাটের ৬টি ও ডিএনসিসি’র ১০টি হাটের ৩টিতে টেন্ডারে কেউ অংশ নেয়নি। এমন কি এই হাটগুলোর জন্য দরপত্র ক্রয় করেও জমা দেননি। এর অন্যতম কারণ হিসেবে জানা গেছে, যাতে সিটি কর্পোরশন খাস আদায়ে যেতে বাধ্য হয়। এতে নির্দিষ্ট সিন্ডিকেট চক্র ইজারা মূল্য ছাড়াই হাটগুলো পেয়ে যাবে। ফলে কোনো ধরনের অর্থ খরচ ছাড়া সিটি কর্পোরেশনকে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে হাট থেকে কোটি কোটি টাকা আদায় করে নিতে পারবে তারা। সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলরসহ কর্মকর্তা, কর্মচারি ও তাদের সুবিধাভোগী চক্রে সহায়তায় সেসব হাট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলরসহ কর্মকর্তা, কর্মচারি ও তাদের সুবিধাভোগী চক্রে সহায়তায় সেসব হাটগুলো অল্প মূল্যে ইজারা ভাগিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেটচক্র। আর বাকি হাটগুলো খাস কালেকশনের শর্তে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের বরাদ্দ দেয়ার গোপন তৎপরতাও এখন প্রায় শেষের দিকে। এ অবস্থায় চলতে থাকলে এবার এ হাটগুলো থেকে ন্যূনতম রাজস্বও দেশের কোষাগারে জমা পড়বে না।
আসল কথা হল, জাতীয় নির্বাচনের নিকটবর্তী সময়ে কোরবানি ঈদ আসায় এসব হাট থেকে নির্বাচনী খরচ সংগ্রহ ও নেতাকর্মীদের সক্রিয় রাখতে সরকারদলীয় সন্ত্রাসী গ্যাংরা তা ইজারা নিতে জোর তৎপর। এ তালিকায় রয়েছে সংসদ সদস্য, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ওয়ার্ড, থানা ও মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। তাদের সহযোগিতা করছেন ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী। সর্বশেষ পর্যায়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় এর বৈধতা দেবেন ঢাকার দুই মেয়র, যে পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন আওয়ামী লীগের সক্রিয় দুই নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিবছর ঢাকার কোরবানির হাট ইজারায় অংশ নেয়া এক ইজারাদার বলেন, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা তাকে ডেকে নিয়ে হুমকি দিয়েছে। এ বছর তিনি যেন কোরবানির হাট ইজারায় অংশগ্রহণ না করেন। কারণ সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনে অনেক খরচ আছে। তিনি যেন অহেতুক ইজারায় অংশ নিয়ে হাটের দাম না বাড়ান। তিন দফার টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে তারা কর্পোরেশন থেকে খাস আদায়ের শর্তে নাম মাত্র মূল্যে হাটগুলো নিয়ে তাদের নেত-কর্মী দিয়ে পরিচালনা করাবে। এ থেকে উপার্জিত অর্থ আগামী নির্বাচনে খরচ করা হবে।
এদিকে, কুমিল্লায় জেলা ও উপজেলায় গত বছর ২৭০টি কোরবানীর পশুর হাট ইজারা দেয়া হলেও এবারে তা বেড়ে তিনশোতে দাঁড়িয়েছে। তবে ইজারার বাইরে অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারেও সতের উপজেলায় অবৈধ হাটের সংখ্যা একশো ছাড়িয়ে যাবে। যেখানে দেশের কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইজারা বহির্ভূত এসব অবৈধ হাট ক্ষমতাসীন সন্ত্রাসী দলের নেতা-কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাব এবং টেন্ডার সমঝোতায় অস্থায়ী কোরবানীর পশুর হাটগুলো এবছরও সংশ্লিষ্টদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছরই এরা প্রভাব খাটিয়ে যত্রতত্র কোরবানীর পশুর হাট বসায়। প্রতি উপজেলায় কম করে হলেও ৮/৯টি অবৈধ হাট বসে। সেই হিসেবে জেলায় ইজারাবিহীন শতাধিক হাট ঈদের আগের এক সপ্তাহ পর্যন্ত জমজমাট ব্যবসা করে। এসব হাট থেকে রাষ্টীয় কোষাগারে কয়েক কোটি টাকা আসার সম্ভাবনা থাকলেও টাকা চলে যাচ্ছে ক্ষমতাসীনদের গড়া রাঘববোয়াল সিন্ডিকেটের পকেটে। এভাবেই ক্ষমতালোভী সরকার ও তার ছত্রছায়ায় সংসদ সদস্য, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ওয়ার্ড, থানা ও মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দেশের প্রতিটি আর্থিক আয়ের উৎসকে লুটেপুটে দেউলিয়া বানিয়ে ছাড়ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আর জনগণকে মিথ্যা চাতুরতাপূর্ণ বাণী শোনাচ্ছে, বাংলাদেশ দরিদ্রতার তালিকা থেকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।