আকিদা-মানহাজআত-তিবইয়ান পাবলিকেশন্সবই ও রিসালাহমিডিয়া

তাওহীদের পতাকাবাহীদের প্রতি

 তাওহীদের পতাকাবাহীদের প্রতি

http://www.mediafire.com/download/1j9z7tekjvt421k/flag-in-bangla.pdf

https://www.mediafire.com/file/2jjguaq1vz2zflf/tawhider_potakabahider_proti.pdf/file

সূচিপত্র

তাওহীদের পতাকাবাহীদের প্রতি.. 4

পরীক্ষা.. 6

নবীদের দেখানো পথে দাওয়াহ দেওয়া এবং ইবরাহীম (আঃ)-এর মিল্লাতের অনুসারী হওয়া যা হলো – দাওয়াহকে প্রকাশ্য এবং সুপরিচিত করে তোলা এবং ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে আপোষহীন শত্রুতা। 8

তাগুতকে ধ্বংস এবং চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়ার উপায়ঃ.. 14

যেহেতু ফলাফল আল্লাহর হাতে সেহেতু পরিণতি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে কিন্তু কাজের ভিত্তি এবং পদ্ধতি সবসময় একই  20

পরীক্ষার মাধ্যমেই প্রকাশ হয়ে যায় মুনাফিকদের পরিচয়. 24

পরীক্ষার মাধ্যমে মু’মিনদের পরিশুদ্ধি এবং উন্নতি.. 30

পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য মু’মিনদের পাথেয়. 36

পরীক্ষার সময় নিচের কাতারের মুসলিমদের অবস্থাঃ… 39

মিল্লাতে ইব্রাহীমকে ধ্বংস করতে এবং দা’য়ীদের এই মিল্লাত থেকে সরিয়ে নিতে তাগুতদের নেয়া কিছু পদক্ষেপের বর্ণনা: 42

তাওহীদের পতাকাবাহীদের প্রতি

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলার। আমরা তাঁরই কাছে সাহায্য চাই। আমরা তাঁরই কাছে ক্ষমা চাই। আমরা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি। আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই আমাদের নফসের সমস্ত অনিষ্ট থেকে এবং আমরা আরও আশ্রয় চাই আমাদের আমলের সমস্ত খারাপ দিক থেকে। আল্লাহ যাকে হিদায়াত দেন কেউ তাকে গোমরাহ করতে পারে না এবং আল্লাহ যাকে গোমরাহ করেন তাকে কেউ হেদায়াত দিতে পারে না। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ নাই, তিনি একক তাঁর কোন শরীক নাই। এবং আমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত বান্দা ও রাসূল।

হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ! তোমরা প্রকৃত ভীতি সহকারে আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা মুসলমান হওয়া ব্যতীত মৃত্যুবরণ কর না। (সূরা আলি ‘ইমরান ৩: ১২)

হে মানবমন্ডলী! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তা হতে তদীয় সহধর্মিণী সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের উভয় হতে বহু নর ও নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং সেই আল্লাহকে ভয় কর যার নামের দোহাই দিয়ে তোমরা একে অপরকে তাগাদা কর এবং আত্মীয়-জ্ঞাতিদের সম্পর্কে সতর্ক থাক, নিশ্চয় আল্লাহই তোমাদের তত্ত্বাবধানকারী। (সূরা নিসা ৪:১)

হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। তিনি তোমাদের আমল সংশোধন করে দিবেন এবং তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দিবেন। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এর আনুগত্য করবে, সে অবশ্যই সাফল্য অর্জন করবে। (সূরা আহযাব ৩৩: ৭০-৭১)

হে আমার দ্বীনি ভাই ও বোনেরা! যারা ইসলাম ও তাওহীদে প্রতিষ্ঠিত, যারা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, কোন ইলাহ নাই (ইবাদত/ আনুগত্যের যোগ্য যাকে মানা হয়) একমাত্র আল্লাহ ছাড়া, যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা জাহিলিয়াতের অন্ধকার জীবন থেকে ইসলাম ও ঈমানের আলোতে এনে সম্মানিত করেছেন। যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা সম্মানিত করেছেন এবং যাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যারা তাদের জাতির মধ্যে সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজের নিষেধ করবে।

সত্যিই আল্লাহ তা’আলা তাঁর অশেষ দয়া এবং তাঁর মহান রহমতের গুণে সমস্ত সৃষ্টির মাঝ থেকে আমাদের বেছে নিয়েছেন এক গুরুদায়িত্বের জন্য। এটা এমন এক দায়িত্ব যার বোঝা বহন করতে আসমান-যমীনও ছিল ভীত। যে কথা আল্লাহ ﷻ কোরআনে বলেছেনঃ

আমি তো আসমান, যমীন ও পর্বতমালার প্রতি এই আমানত অর্পণ করেছিলাম, তারা ইহা বহন করতে অস্বীকার করল এবং ভয় পেল, কিন্তু মানুষ ইহা বহন করল; সে তো অতিশয় যালেম, অতিশয় অজ্ঞ। (সূরা আহযাব ৩৩: ৭২)

আল্লাহ তা’আলা আমাদের জন্য তাওহীদকে একটি আমানত স্বরূপ দান করেছেন এবং আমাদের জন্য দায়িত্ব ঠিক করে দিয়েছেন যেন আমরা সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করি যে আমরা ‘আল্লাহর বান্দা’-এই উপলব্ধি শুধু মুখের কথা বা এর প্রতি ভালবাসার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এর বহিঃপ্রকাশ ঘটবে আমাদের কাজ বাস্তবায়নে, চেষ্টায় এবং আত্মত্যাগে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এখনও এই সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মতের মাঝে এমন অনেক মানুষ আছে যারা এখন পর্যন্ত ’লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর ব্যাপকতা এবং এর দাবী সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ। এই কালিমার মাঝে যে গুরুদায়িত্ব ও আমানত আছে তার মর্ম বুঝতে হলে একটি হাদিসই যথেষ্টঃ

মুসা (আঃ) বলেন, ‘হে আমার রব আমাকে এমন কিছু শিক্ষা দিন যা দ্বারা আমি আপনাকে ডাকতে পারি এবং আপনার যিকর করতে পারি।’ আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, হে মুসা! বল- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’। মুসা (আঃ) বললেন, ‘হে আমার রব আপনার সমস্ত বান্দারা তো ইহা বলে।’ আল্লাহ্ আহকামুল হাকিমীন, রাব্বুল আলামীন যিনি সব জানেন যেখানে আমরা কিছুই জানিনা, তিনি নাযিল করলেন,

‘হে মুসা! আমি ছাড়া সাত আকাশ এবং উহার মধ্যে যাহা কিছু আছে এবং সাত যমীন যদি পাল্লার এক দিকে স্থাপন করা হয় এবং অপর দিকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-কে স্থাপন করা হয় তবে দ্বিতীয় অংশটি ভারী হয়ে যাবে।’ (ইবনে হিব্বান ২৩২৩, আল হাকিম ১/৫২৮)

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত-রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ ‘আমাকে পাঠানো হয়েছে সবচেয়ে ছোট বক্তব্য নিয়ে যার অর্থ সবচেয়ে ব্যাপক। এবং আমাকে শুধু ভয় (যা আল্লাহ্ কাফেরদের মনে গেঁথে দেন) দ্বারা বিজয় দান করা হয়েছে। এবং যখন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম তখন এই দুনিয়ার সমস্ত সম্পদের চাবি আমার কাছে আনা হয়েছিল এবং আমার হাতে দেয়া হয়েছিল।’ (বুখারী, কিতাবুল জিহাদ)

আল্লাহু আকবার!

 

পরীক্ষা

ভাইয়েরা এবং বোনেরা! এই কালেমা শুধুমাত্র কয়েকটি সুন্দর সুন্দর শব্দই নয় এবং শুধু এর প্রতি ভালবাসার দাবী করলেই এই কালিমার হক আদায় হয়ে যাবে না। বরং এর হক আদায় করতে হলে আমাদেরকে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুও ত্যাগ করতে হবে যাতে এই পৃথিবীর বুকে এই কালেমা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা একের পর এক পরীক্ষার মাধ্যমে খারাপের থেকে ছেকে আলাদা করে নেন কিছু খাঁটি মানুষকে যাদের যোগ্যতা আছে এই কালেমার জন্য সর্বোচ্চ সংগ্রাম করার ও একে নিজের জীবনে এবং সারা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ স্থান দেয়ার। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার এই পরীক্ষা ক্রমাগতই কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকে, যাতে মু’মিন ও সত্যনিষ্ঠদের দলটি ক্রমাগতই পরিশুদ্ধ হতে থাকে। যারা প্রথম পরীক্ষাতেই ব্যর্থ হয় – সবচেয়ে সহজ পরীক্ষাতে, তাদের আল্লাহ্ ছেড়ে দেন, তাদের আর পরবর্তী পরীক্ষাগুলো দেয়ার যোগ্যতা নেই, আর এই কালেমার আমানত বহন করার যোগ্যতা তো একেবারেই নেই।

আমরা এখন এক পরীক্ষার সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এটা এমন এক সময় যখন আমাদের প্রতিমুহূর্তে শয়তান এবং তাগুতের পথ এবং তাদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে – যাতে আমরা কখনো সঠিক পথ থেকে সরে গিয়ে বিফলকাম লোকদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে যাই। এটা এমন এক সময় যখন আমাদের এই কালিমার প্রতিটি দাবীর ব্যাপারে পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে কারণ আমাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে এই সব দাবী পূরণ করার জন্য। এবং একই সাথে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে আরো পরীক্ষার জন্য এবং এজন্য আমাদের প্রয়োজন আল্লাহ্ তা’আলার উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল যাতে আমরা এসব পরীক্ষা সফলভাবে পার হয়ে আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি। আর মনে রাখতে হবে আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ্ তা’আলা জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষার জন্য-

যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন তোমাদের পরীক্ষা করবার জন্য – কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল। (সূরা মুলক ৬৭:২)

এবং আল্লাহ দ্যর্থহীন ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে শুধু ঈমান আনার দাবী করলেই তিনি আমাদের ছেড়ে দিবেন না; আল্লাহ তা’আলা পরীক্ষার মাধ্যমে পার্থক্য করে দিবেন যে কারা এই দাবীর উপর অবিচল এবং কারা শুধু নিজেদেরই প্রতারিত করছে; এই পরীক্ষা সবসময়ই হয়ে আসছে এবং সর্বোচ্চ পরীক্ষা হবে জিহাদ/ক্বিতালের মাধ্যমে।

“তারা কি এই ধারণা করে নিয়েছে যে “আমরা ঈমান এনেছি” এই কথা বলে তারা অব্যাহতি পেয়ে যাবে, আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আর আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম যারা তাদের পূর্বে অতীত হয়ে গিয়েছে,

সুতরাং আল্লাহ সেই লোকদেরকে জেনে নিবেন যারা সত্যবাদী ছিল এবং মিথ্যাবাদীদেরকেও জেনে নিবেন। (সূরা ‘আনকাবুত ২৯:২-৩)

তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ আল্লাহ একথা জেনে নিবেন না যে কে তোমাদের মধ্যে জিহাদ করেছে আর কে, ধৈর্য ধারণ করেছে?” (সূরা আলি ’ইমরান ৩:১৪২)

যাকেই আল্লাহ্ তা’আলা পরীক্ষা করবেন, তার সামনে দুইটি পথ খোলা থাকবে – একটি পথ এই দুনিয়ার সমস্ত আমোদ-প্রমোদ, বিলাসী জীবন, যার দ্বারা আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেনঃ

ভূপৃষ্ঠে যা কিছু আছে, তা আমি তাদের জন্য সৌন্দর্যের উপকরণ করে দিয়েছি, যেন আমি মানুষকে পরীক্ষা করে নিই যে, তাদের মধ্যে কে অধিকতর ভাল কাজ করে।(সূরা কাহাফ ১৮:৭)

দুনিয়ার জীবনে ভোগের এই পথ যে গ্রহণ করলো সে ধ্বংস হয়ে গেলো। আর দ্বিতীয় পথটিতে ছড়ানো আছে ভয়ংকর সব কষ্ট, ভয়, ক্ষুধা, দারিদ্র, ব্যবসায়িক ক্ষয়ক্ষতি, বাড়ি-ঘরের ক্ষয়ক্ষতি থেকে শুরু করে মৃত্যুর আশংকা পর্যন্ত সবই এই পথের জন্য স্বাভাবিক। তবে আল্লাহর কসম! এটাই সাফল্যের রাস্তা:

আর আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয় দ্বারা, ক্ষুধা দ্বারা, সম্পদ, জান ও ফল-শস্যের বিনষ্টের দ্বারা; আর সুসংবাদ শুনিয়ে দিন এমন ধৈর্যশীলদেরকে। (সূরা বাকারা ২:১৫৫)

আমাদের সামনেও এখন এই দুইটি পথ খোলা আছে, যেমনটি ছিল পূর্বের সব জাতিদের সামনে এবং যেমনটি থাকবে ভবিষ্যতেও কিয়ামতের আগে দাজ্জালের আবির্ভাব পর্যন্ত এবং আল্লাহ তা’আলা যুগে যুগে মানুষের মধ্যে থেকে বেছে নিয়েছেন নবী, শহীদ ও সত্যনিষ্ঠদের এবং অন্যদিকে বেছে নিয়েছেন তাগুত, কাফের ও মুনাফিকদের। আর এই দুই শ্রেণীর লোক পছন্দ করে নিয়েছে এই দুই পথের যে কোন একটি – এক শ্রেণী পেয়েছে চিরন্তন পুরষ্কার আর অন্য শ্রেণী অনন্তকালের আযাব।

আল্লাহ তা’আলা আমাদের তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে এবং যারা তাদের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-কে বাস্তবে প্রমাণ করেছে।

মুমিনদের মধ্যে কিছু লোক এমনও আছে, তারা আল্লাহর সাথে যে অঙ্গিকার করেছে তা সত্যে পরিণত করেছে, অতঃপর তাদের মধ্যে কিছু নিজেদের (শাহাদাত) মান্নত পূর্ণ করেছে….। (সূরা আহযাব ৩৩:২৩)

তাকে বলা হলঃ জান্নাতে প্রবেশ কর।সে বলে উঠলোঃ হায়! আমার সম্প্রদায় যদি জানতে পারতো কি কারণে আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিত করেছেন। (সূরা ইয়াসিন ৩৬:২৬–২৭)

যদি আমরা জান্নাতের পথ বেছে নেই, পরীক্ষার পথকে বেছে নেই, তাহলে এখনই সময়।

 

নবীদের দেখানো পথে দাওয়াহ দেওয়া এবং ইবরাহীম (আঃ)-এর মিল্লাতের অনুসারী হওয়া যা হলো – দাওয়াহকে প্রকাশ্য এবং সুপরিচিত করে তোলা এবং ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে আপোষহীন শত্রুতা।

এটাই হচ্ছে এই দ্বীনের ভিত্তি এবং প্রত্যেক নবীরই কর্মপন্থা।

আমি তোমার পূর্বে এমন কোন রাসূল প্রেরণ করি নাই তাহার প্রতি এই ওহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া কোন ইলাহ নাই। সুতরাং আমারই ইবাদাত কর। (সূরা আম্বিয়া ২১:২৫)

আমি প্রত্যেক উম্মতের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছিলাম এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাগুতকে বর্জন করবে….। (সূরা নাহল ১৬:৩৬)

আল্লাহ্ তাআলা তোমাদের জন্য সেই দ্বীন নির্ধারিত করেছেন, যা তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এবং যা আমি আপনার প্রতি ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করেছি, আর আমি ইব্রাহীম, মূসা এবং ঈসাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম যে, এই দ্বীনকে কায়েম কর এবং এতে কোন বিভেদ সৃষ্টি করো না; মুশরেকদের নিকট সেই (তাওহীদ) বিষয়টি বড়ই কষ্টকর মনে হয় যার প্রতি আপনি তাদেরকে আহবান করেন, আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা নিজের দিকে আকৃষ্ট করে নেন এবং যে আল্লাহর দিকে রুজু হয়, তাকে তিনি তাঁর দিকে চলার সামর্থ্য দান করেন। (সূরা শূরা ৪২:১৩)

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘এই পৃথিবীতে এবং আখিরাতে দুই স্থানেই আমি সব মানুষের মাঝে মরিয়ম ইবনে ঈসা (আঃ)-এর সবচেয়ে নিকটবর্তী। নবীরা সবাই পৈত্রিক সম্পর্কে ভাই; তাদের মা ভিন্ন, কিন্তু তাদের দ্বীন একটাই।’ (বুখারী)

উপরে উল্লেখিত আয়াত ও হাদিস এবং এরকম আরও যেসব দলিল আছে তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, যদিও বিভিন্ন নবীর শরীয়াহ শাখা প্রশাখার মাঝে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু ভিত্তি তাওহীদ ও দ্বীন সর্বক্ষেত্রেই অভিন্ন ছিল।

তাছাড়া আমাদেরকে অর্থাৎ উম্মতে মুহাম্মদী-কে এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে আদেশ করেছেন, এই ভিত্তির (তাওহীদ, কুফর বিত তাগুত, মিথ্যা উপাস্য এবং তাদের অনুসারীদের প্রতি শত্রুতা, ইত্যাদি) ক্ষেত্রে মিল্লাতে ইব্রাহীমের অনুসরণ করতে এবং তার উদাহরণ অনুকরণ করতে এবং এই একই ভিত্তি দেয়া হয়েছিল সমস্ত নবীদেরকে।

এখন আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, তুমি একনিষ্ঠ ইব্রাহীমের (আঃ) দ্বীনের অনুসরণ কর; এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। (সূরা নাহল ১৬:১২৩)

“….তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেন নাই; এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহীম (আঃ) – এর মিল্লাত; তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিমএবং এই কিতাবেও, যাতে রাসূল তোমাদের জন্যে সাক্ষী স্বরূপ হয় এবং তোমরা সাক্ষী স্বরূপ হও মানব জাতির জন্যে….। (সূরা হাজ্জ ২২:৭৮)

এসব আয়াত থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইব্রাহীম (আঃ)-এর পদ্ধতি ছিল তাওহীদের প্রকাশ্য ঘোষণা এবং সেই সাথে কুফর বিত্ তাগুত ও মুশরিকদের প্রতি ‘বারাআ’ (আভ্যন্তরীণ ঘৃণা ও বাহ্যিক শত্রুতা)। এমনকি দুর্বল অবস্থাতেও তিনি এই একই নীতিতে চলেছেন। আসলে, তারাই দুর্বল যারা নিজেদের দুর্বল মনে করে, আর যারা সবর করে এবং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে তাদের জন্য আল্লাহই সাহায্যকারী। যেমনটি ইব্রাহীম (আঃ) বলেছেনঃ ‘হাসবুনাল্লাহি ওয়া নি’মাল ওয়াক্বীল’। এবং আল্লাহও বলেছেন যে তিনি মু’মিনদের ওয়ালী। তাহলে তার চেয়ে বেশী শক্তিশালী কে হতে পারে যার ওয়ালী স্বয়ং আল্লাহ? আর সে কি কখনো দুর্বল হতে পারে? অবশ্যই না!

অথচ তারপরও অনেককেই দেখা যায় ইব্রাহীম (আঃ)-এর এই পথ থেকে দূরে সরে যেতে। তারা অজুহাত হিসেবে ‘দাওয়ার সুবিধা’ বা ‘মুসলিমদের ক্ষতি থেকে বাঁচানো’ ইত্যাদি কথা বলে। অথচ এই মিল্লাত থেকে যারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাদেরকে আল্লাহ বলছেনঃ

এবং যে নিজেকে নির্বোধ করে তুলেছে সে ব্যতীত কে ইব্রাহীমের (আঃ)-এর দ্বীন হতে বিমুখ হবে? এবং নিশ্চয়ই আমি তাকে এই পৃথিবীতে মনোনীত করেছিলাম, নিশ্চয়ই সে পরকালে সৎ কর্মশীলগণের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা বাকারা ২:১৩০)

যারা এরকম সস্তা অজুহাত দিয়ে সঠিক পথ থেকে সরে যায়, তারা আসলে আল্লাহর প্রেরিত ওহীর চেয়ে নিজের নফসকেই বেশী গুরুত্ব দেয়। আর শয়তান তাদের কাছে তাদের কাজকে সুন্দর এবং যৌক্তিক হিসেবে তুলে ধরে যাতে তারা এর খারাপ দিকগুলো বুঝতে না পারে। এসব লোকেরা কি মনে করে যে দাওয়াহ দেয়ার পদ্ধতির ব্যাপারে তারা ইব্রাহীম (আঃ) এর চেয়ে বেশী জ্ঞান রাখে? অথচ আল্লাহই তো এদেরকে ডেকেছেন ‘অজ্ঞ’ আর ইব্রাহীম (আঃ)-কে ঘোষণা করেছেন ‘শ্রেষ্ঠ উদাহরণ’ হিসেবে। এবং আল্লাহ তা’আলা ইব্রাহীম (আঃ)-এর ব্যাপারে আরো বলেছেনঃ

আমি তো এর পূর্বে ইব্রাহীমকে (আঃ) সৎ পথের জ্ঞান দিয়েছিলাম এবং আমি তার সম্বন্ধে সম্যক অবগত। (সূরা আম্বিয়া ২১:৫১)

তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত কর তাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের মানি না। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হল শত্রুতা ও ঘৃণা চিরকালের জন্য; যদি না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো।(সূরা মুমতাহিনা ৬০:৪)

সুতরাং ইব্রাহীম (আঃ)-এর মিল্লাত হলো তাগুতকে প্রকাশ্য এবং নির্ভয়ে প্রত্যাখ্যান করা, মুশরিকদের এবং তারা যাদের ইবাদত করে তাদের সবার সাথে ’বারাআ’ ঘোষণা করা, এবং আল্লাহর শত্রুদের প্রতি অন্তরে ঘৃণা পোষণ করা এবং তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা প্রদর্শন করা এগুলোই হলো দ্বীনের ভিত্তি এবং প্রত্যেক নবীর কাছে এই একই বার্তাই পাওয়া যায়।

আমি প্রত্যেক উম্মতের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছিলাম এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাগুতকে বর্জন করবে….। (সূরা নাহল ১৬:৩৬)

এবং আল্লাহ তা’আলা আরও বলেনঃ এই ঘোষণাকে সে স্থায়ী বাণীরূপে রেখে গেছে তার পরবর্তীদের জন্যে যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে। (সূরা যুখরুফ ৪৩:২৮)

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে তাওহীদের এই ঘোষণা ইব্রাহীম (আঃ)-এর পরবর্তী নবীদের জন্যও স্থায়ী করা হয়েছে।

অন্যান্য নবীরা যে তাদের দুর্বল অবস্থাতেও এই একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তার অনেক উদাহরণ আছে। সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রুদের মুখোমুখি হয়েও তাঁরা মুশরিক এবং তাদের উপাস্যদের বিরুদ্ধে ’বারা’ ঘোষণা করেছেন।

আর তুমি তাদেরকে নূহের ইতিবৃত্ত পড়ে শুনাও, যখন সে নিজের কওমকে বললো – হে আমার কওম! যদি তোমাদের কাছে দুর্বহ মনে হয় আমার অবস্থান এবং আল্লাহর আদেশাবলী নসিহত করা, তবে আমার তো আল্লাহর উপর ভরসা, সুতরাং তোমরা তোমাদের (কল্পিত) শরীকদেরকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের তদবির মজবুত করে নাও, অতঃপর তোমাদের সেই তদবির (গোপন ষড়যন্ত্র) যেন তোমাদের দুঃচিন্তার কারণ না হয়, তারপর আমার সাথে (যা করতে চাও) করে ফেলো, আর আমাকে মোটেই অবকাশ দিও না। (সূরা ইউনুস ১০:৭১)

আমাদের কথা তো এই যে, আমাদের উপাস্য দেবতাদের মধ্য হতে কেউ তোমাকে দুর্দশায় ফেলে দিয়েছে; সে বললোঃ আমি আল্লাহকে সাক্ষী করছি এবং তোমরাও সাক্ষ্য থেকো, আমি ঐসব বস্তুর প্রতি অসন্তুষ্ট যাদেরকে তোমরা শরীক সাব্যস্ত করছো তাকে ছাড়া, অনন্তর তোমরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাও, অতঃপর আমাকে সামান্য অবকাশও দিও না। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করেছি, যিনি আমারও প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক, ভূ-পৃষ্ঠে যত বিচরণকারী রয়েছে সবারই ঝুঁটি তাঁর মুষ্টিতে আবদ্ধ; নিশ্চয় আমার প্রতিপালক সরল পথে অবস্থিত। (সূরা হুদ ১১:৫৪-৫৬)

এভাবে কোরআনের অনেক আয়াত থেকে আমরা দেখতে পাই যে, হিজরতের আগেও মহানবী ﷺ-কে আল্লাহ তা’আলা এই একই পথের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিনি আল্লাহর এই নির্দেশ মেনে সেই পথেই চলেছেন যদিও মুসলিমরা তখন ছিল খুবই কম সংখ্যক।

“[হে মুহাম্মাদ ] আপনি বলুন, হে কাফেরগণ! তোমরা যার ইবাদত করছো, আমি তার ইবাদত করি না এবং আমি যাঁর ইবাদত করি তোমরা তার ইবাদত করো না এবং তোমরা যার ইবাদত করছো, আমি তার ইবাদতকারী নই, এবং আমি যাঁর ইবাদত করছি, তোমরা তাঁর ইবাদতকারী নও। তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন এবং আমার জন্য আমারই দ্বীন।(সূরা কাফিরূন ১০৯:১-৬)

আবূ লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হোক এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক। (সূরা লাহাব ১১১:১)

তোমরা কি ভেবে দেখেছো লাতউয্যাসম্বন্ধে এবং তৃতীয় আরেকটি মানাতসম্বন্ধে? তবে কি পুত্র সন্তান তোমাদের জন্যে এবং কন্যা সন্তান আল্লাহর জন্যে? এই প্রকার বণ্টন তো অসঙ্গত। এগুলো কতক নাম মাত্র যা তোমাদের পূর্বপুরুষরা ও তোমরা রেখেছো, যার সমর্থনে আল্লাহর কোন দলীল প্রেরণ করেননি। তারা তো অনুমান এবং নিজেদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে, অথচ তাদের নিকট তাদের প্রতিপালকের পথ-নির্দেশ এসেছে। (সূরা নাজম ৫৩:১৯-২৩)

তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত কর সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সবাই তাতে প্রবেশ করবে। যদি তারা উপাস্য হতো তবে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করতো না; তাদের সবাই তাতে স্থায়ী হবে। (সূরা আম্বিয়া ২১:৯৮-৯৯)

কাফিররা যখন তোমাকে দেখে তখন তারা তোমাকে শুধু বিদ্রূপেই গ্রহণ করে; তারা বলেঃ এই কি সেই, যে তোমাদের দেবতাগুলির সমালোচনা করে? অথচ তারাই তো রহমানএর উল্লেখের বিরোধিতা করে। (সূরা আম্বিয়া ২১:৩৬)

তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে কুরাইশের কাফিরদের ধারণা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এমন এক মানুষ যে কিনা তাদের ইলাহদের ব্যাপারে খারাপ কথা বলে। সত্যিকার অর্থে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এই সব ইলাহদের স্বরূপ সবার সামনে তুলে ধরতেন, এদের উপাসনার বিরুদ্ধে কথা বলতেন এবং এদেরকে আলিহা হিসেবে গ্রহণ করা যে কত বড় বোকামি ও অজ্ঞতা তা সবার কাছে স্পষ্ট করে দিতেন। এভাবেই রাসূল ﷺ সেই একই পথের অনুসরণ করেছেন যে পথে এক সময় ইব্রাহীম (আঃ) চলেছেন- যদিও মক্কায় তিনি ছিলেন দুর্বল। নবীদের দাওয়াহ ছিল এমন যে সবসময়ই কাফিররা এর বিরোধিতা করতো-এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন কুরাইশরা রাসূল ﷺ-কে অত্যাচার করতো, তাকে বিতাড়িত করতে চাইতো এবং এমনকি হত্যার চেষ্টাও করতো। সঠিক দাওয়াহর প্রকৃতিই এমন।

মুশরিক এবং মু’মিনের এই দ্বন্দ্ব চিরকালই হয়ে আসছে, কারণ আল্লাহ্ তাঁর স্বীয় ইচ্ছায় হক্ব (ও এর অনুসারী) এবং বাতিল (ও এর অনুসারী) আলাদা করে দিয়েছেন। এবং এই দুইয়ের মাঝে সব সময়ই যুদ্ধ চলে আসছে। আর এর মাধ্যমেই আল্লাহ তা’আলা জাহান্নামীদের জড়ো করেন এবং মু’মিনদের মাঝে থেকে বেছে নেন শহীদদের।

আর এমনিভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর জন্যে বহু শয়তানকে শত্রুরূপে সৃষ্টি করেছি, তাদের কতক শয়তান মানুষের মধ্যে এবং কতক শয়তান জ্বিনদের হতে হয়ে থাকে, এরা একে অন্যকে কতগুলো মনোমুগ্ধকর, ধোঁকাপূর্ণ ও প্রতারণাময় কথা দ্বারা প্ররোচিত করে থাকে, তোমার প্রতিপালকের ইচ্ছা হলে তারা এমন কাজ করতে পারতো না, সুতরাং তুমি তাদেরকে এবং তাদের মিথ্যা রচনাগুলোকে বর্জন করে চলবে। (সূরা আন’আম ৬:১১২)

আর এইভাবেই আমি সৃষ্টি করেছি প্রত্যেক নবীর জন্যই অপরাধপরায়ণ লোকদের মধ্যে থেকে শত্রু; এবং পথপ্রদর্শক ও সাহায্যকারীরূপে আপনার রবই যথেষ্ট। (সূরা ফুরকান ২৫:৩১)

কাফিররা সবসময়ই নবীদের নিয়ে ঠাট্টা করতো-

আফসোস বান্দাদের উপর! তাদের নিকট কখনও এমন কোন রাসূলই আসেননি, যাকে তারা বিদ্রূপ না করেছে। (সূরা ইয়াসিন ৩৬:৩০)

আর সেই কাফেররা নিজেদের রাসূলগণকে বললো, আমরা তোমাদেরকে আমাদের দেশ হতে বের করে দেবো, নতুবা তোমরা আমাদের দ্বীনে ফিরে আসো; তখন সেই রাসূলগণের প্রতি তাহাদের রব ওহী প্রেরণ করলেন যে, আমি সেই যালিমদেরকে অবশ্যই ধ্বংস করব। (সূরা ইবরাহীম ১৪:১৩)

যারা ঈমান এনেছে, দ্বীনের জন্যে হিজরত করেছে, নিজেদের জানমাল দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, এবং যারা আশ্রয় দান ও সাহায্য করেছে, তারা পরস্পরের বন্ধু, আর যারা ঈমান এনেছে, কিন্তু হিজরত করেনি তারা হিজরত না করা পর্যন্ত তাদের অভিভাবকত্বের কোন দায়িত্ব তোমাদের নেই, আর তারা যদি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের নিকট সাহায্যপ্রার্থী হয়, তবে তাদের সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য, কিন্তু তোমাদের ও যে জাতির মধ্যে চুক্তি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে নয়, তোমরা যা করছো আল্লাহ তা খুব ভাল রূপেই প্রত্যক্ষ করেন। (সূরা আনফাল ৬:৭২)

আর তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক ও অহংকারী প্রধানরা বলেছিল – হে শোআইব (আঃ)! আমরা অবশ্যই তোমাকে ও তোমার সঙ্গী সাথী মুমিনদেরকে আমাদের জনপদ হতে বহিষ্কার করব অথবা তোমরা আমাদের ধর্মাদর্শে ফিরে আসবে, তখন সে বললো – আমরা যদি তাতে রাযী না হই (তবুও কি জোর করে ফিরিয়ে নিবে)?” (সূরা আরাফ ৭:৮৮)

কাফেররা যে নবী ও মু’মিনদের উপর অত্যাচার চালায়, তাদের হত্যা করে, এবং তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে – এটা আসলে নতুন কিছু নয়।

“….এটা এই কারণে যে এরা ক্রমাগত আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করতে থাকলো এবং আল্লাহর নবীদের অন্যায়ভাবে হত্যা করতে শুরু করলো, …. (সূরা বাকারা ২:৬১)

“….কিন্তু পরে যখন তোমাদের নিকট কোন রাসূল-তোমাদের প্রবৃত্তি যা ইচ্ছে করতো না, তা নিয়ে উপস্থিত হলো তখন তোমরা অহংকার করলে; অবশেষে একদলকে মিথ্যাবাদী বললে এবং একদলকে হত্যা করলে। (সূরা বাকারা ২:৮৭)

তারা বললোঃ হে শুআইব (আঃ)! তোমার বর্ণিত অনেক কথা আমাদের বুঝে আসে না, এবং আমরা নিজেদের মধ্যে তোমাকে দুর্বল দেখছি, আর যদি তোমার স্বজনবর্গের লক্ষ্য না হতো, তবে আমরা তোমাকে প্রস্তারাঘাতে চূর্ণ করে ফেলতাম, আর আমাদের নিকট তোমার কোনই মর্যাদা নেই। (সূরা হুদ ১১:৯১)

তারা বললোঃ তোমরা সকলে পরস্পর শপথ করো যে, আমরা রাত্রিকালে ছালেহ্ (আঃ)-কে এবং তাঁর অনুসারীদেরকে হত্যা করে ফেলবো, অতঃপর আমরা তাঁর উত্তরাধিকারীদেরকে বলবো, আমরা তাদের হত্যাকান্ডে উপস্থিত ছিলাম না এবং আমরা সম্পূর্ণ সত্যবাদী। (সূরা নামল ২৭:৪৯)

যদি তারা কোনরূপে তোমাদের সন্ধান জেনে ফেলে, তবে হয় তোমাদেরকে প্রস্তারাঘাতে মেরে ফেলবে অথবা তোমাদেরকে তাদের ধর্মে ফিরিয়ে নেবে এবং এরূপ ঘটলে কখনোই তোমরা সাফল্য লাভ করবে না। (সূরা কাহাফ ১৮:২০)

জনপদবাসীরা বললো, আমরা তো তোমাদেরকে অশুভ মনে করি, যদি তোমরা নিবৃত্ত না হও, তবে আমরা তোমাদেরকে প্রস্তারাঘাত করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিবো এবং আমাদের পক্ষ থেকে কঠিন উৎপীড়ন তোমাদেরকে স্পর্শ করবে। (সূরা ইয়াসিন ৩৬:১৮)

এগুলো (শত্রুতা, বিদ্রূপ, হুমকি, অত্যাচার, হত্যা, দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি) কোন কিছুই হতো না, যদি না নবীরা এবং তাদের অনুসারী মু’মিনরা তাগুতকে উন্মোচিত না করতেন, যদি না তারা শিরক এবং মুশরিকদের থেকে ‘বারা’ ঘোষণা না করতেন। সুতরাং প্রিয় ভাই ও বোনেরা, এটা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত যে, এই পথে চললে আমাদেরও এ সবের মুখোমুখি হতে হবে। আর এই পথই নবীদের পথ, এই পথই মিল্লাতে ইব্রাহীম (আঃ)-এর দেখানো পথ। এই সেই পথ যেই পথে তাওহীদের ডাক সবদিকে ছড়িয়ে যায়। যেমন হয়েছিল সূরা বুরুজে বর্ণিত মু’মিনদের ক্ষেত্রে।

 

তাগুতকে ধ্বংস এবং চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়ার উপায়ঃ

আমাদের মনে রাখতে হবে, আজ পর্যন্ত ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়েই তাগুত তাদের জুলুমের রাজত্ব কায়েম রেখে আসছে তাদের দুইটি ‘হাতের’ সাহায্যেঃ

(১) তাদের সামরিক বাহিনী (আর্মি, নেভী, এয়ারফোর্স, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী, গোয়েন্দা সংস্থা ইত্যাদি)।

(২) তাদের বুদ্ধিজীবী বাহিনী (জাদুকর, পুরোহিত, পথভ্রষ্ট আলেম ইত্যাদি)।

এই বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর কাজ হলো জনগণকে শিরকের মাঝে ডুবিয়ে রাখা এবং তাদেরকে তাগুতের ব্যাপারে অজ্ঞ করে রাখা; এর ফলে তাগুতকে সব সময়ই বেশীরভাগ মানুষই মেনে নিয়েছে এবং আল্লাহর বাণীর আলো থেকে সরে অন্ধকারে চলে গিয়েছে। তবে সব সময়ই অল্প কিছু মু’মিন ছিল যারা আল্লাহর উপর ঈমান রাখতো এবং তাগুতকে অস্বীকার করতো – আর তাদের দমন করার জন্যই তাগুতের সামরিক বাহিনী অতীতে ছিল এবং বর্তমানেও আছেঃ

যারা মুমিন তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে এবং যারা কাফির তারা তাগুতের পথে যুদ্ধ করে;” (সূরা নিসা ৪:৭৬)

তাই যখন আমরা নবীদের পথে চলতে শুরু করি, এবং এই কালিমার দাওয়াহ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেই, তখন তাগুতের ভীতে ফাটল ধরে এবং জনগণ এদের সীমালঙ্ঘন বুঝতে পারে। এভাবেই তাগুতের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে হারানো যায় এবং তাগুতের দুর্বলতা প্রকাশ করে দেয়া যায়- যেমনটি হয়েছিল ইব্রাহীম (আঃ), মুসা (আঃ) এবং সূরায় বুরুজের সেই ছেলেটির সময় যখন তারা নিজেরা দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও তাদের সময়ের তাগুতের মুখামুখি হয়েছিল। যখন মু’মিনরা এই পথ গ্রহণ করে তখন তাগুতের প্রশাসন ভেঙে পড়ে, জাহিলিয়াতের দল থেকে বের হয়ে মানুষ ইসলামের দলে ঢুকতে থাকে – যেমন হয়েছিল ফিরাউনের জাদুকরদের ক্ষেত্রে এবং মুহাজির ও আনসারদের মাঝে অগ্রবর্তীদের ক্ষেত্রে যাদের মধ্যে অনেকেরই পরিবার ছিল ইসলামের শত্রু।

ঠিক এমন অবস্থতেই মু’মিনদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাগুতের সৈন্যদল, অতীতে এর অনেক নজির দেখা যায়। এসময় তাগুতরা দুর্বল ও অসহায় মুসলিমদের বেছে নিয়ে অত্যাচার শুরু করে, তবে যাদের পারিবারিক সুরক্ষা বা সামাজিক মর্যাদা আছে তেমন মুসলিমদের এরা প্রথমে ছেড়ে দেয়। এমনটিই হয়েছিল রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সময় এবং শুয়াইব (আঃ) এর সময়ওঃ

তারা বলল, ‘হে শুআইব! তুমি যা বল তার অনেক কথা আমরা বুঝি না এবং আমরা তো আমাদের মধ্যে তোমাকে দুর্বলই দেখছি। তোমার স্বজনবর্গ না থাকলে আমরা তোমাকে প্রস্তর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলতাম, আর আমাদের উপর তুমি শক্তিশালী নও। (সূরা হুদ ১১:৯১)

অত্যাচারের পাশাপাশি তাগুত অনেকের সামনে বিভিন্ন আকর্ষণীয় প্রস্তাব রাখতে পারে; এবং এসব প্রস্তাব বাইরে থেকে দেখে নিরাপদ এবং লাভজনক মনে হলেও, আসলে এগুলো গ্রহণ করা মানে হবে ইব্রাহীম (আঃ) এবং অন্যান্য সব নবীর মিল্লাত থেকে সরে যাওয়া। এই দাওয়াকে ‘কুফর বিত তাগুত’ এবং ‘আল-বারাআ’-র মত কঠোর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে ঘুরিয়ে অন্য দিকে নিতে এবং এর বিষয়বস্তু হালকা কিছু বিষয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখতে তাগুত যে কি ধরনের ষড়যন্ত্র করে চলেছে সে ব্যাপারে পরে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশা-আল্লাহ। তাগুত আমাদের সাথে আপোষ করতে চাইবে, যাতে আমরা যদি নবীদের পথ থেকে সামান্যও সরে যাই, তারা এই সুযোগে আমাদের আরও দূরে নিতে থাকবে এবং একসময় আমরা হয়ে যাবো ইসলামের পোশাকে তাগুতের মুখপাত্র। আল্লাহ আমাদের এর থেকে রক্ষা করুক এবং আমাদের মাঝে তলোয়ারকেই মীমাংসার একমাত্র পদ্ধতি বানিয়ে দিক; এই তলোয়ার হয় আমাদের মৃত্যু ঘটাবে সেক্ষেত্রে আমরা অর্জন করব শাহাদাত বরণ করার মর্যাদা, আর তা না হলে আল্লাহর শত্রুদের গর্দান ফেলে দিবে আর সেক্ষেত্রে আমরা হব গালিবীন (বিজয়ী)। আমাদের এবং তাদের মাঝে শুধু একটাই সম্পর্ক – যুদ্ধ।

এসব পরীক্ষার মধ্যে দিয়েই মু’মিনরা বিভিন্ন স্তরে স্তরে বাছাই হয়ে যায়। কেউ কেউ সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে যায়, কেউ নিচু স্তরেই থেকে যায়, আবার এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে ঈমান থেকে বেরও হয়ে যায় (নাউযুবিল্লাহ)।

মু’মিনরা সংখ্যায় যত অল্পই হোক না কেন, দুর্বল অবস্থাতেও (পার্থিব সম্পদ বা সামর্থ্যরে দিক দিয়ে) তারা দুইটি বিষয় কখনই ত্যাগ করতে পারবে নাঃ

প্রথমতঃ মিল্লাতে ইবরাহীম (আঃ)-এর সাথে লেগে থাকা অর্থাৎ তাওহীদ ও কুফর বিত তাগুতের দাওয়াহ প্রকাশ্যে দিতে থাকা এবং যারা এর বিরোধিতা করবে তাদের প্রতি বারা প্রদর্শন করা।

দ্বিতীয়তঃ মিল্লাতে ইবরাহীম (আঃ)- এর সাথে লেগে থাকার অংশ হিসেবে আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং শত্রুতা স্পষ্ট করে দেয়া।  আমাদের রব, পরম দয়ালু, সর্বজ্ঞানী আল্লাহ আমাদেরকে ‘ক্বিতাল’এর হুকুম দিয়েছেন। যদিও জিহাদের মাধ্যমে অনেক লক্ষ্য অর্জন করা যায়, তবুও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, জিহাদ শুধু অন্য কোন ইবাদতের (যেমনঃ দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার) হাতিয়ার নয় – বরং এটা নিজেই সবচেয়ে বড় ইবাদত, আর এত বড় ইবাদত থেকে অন্যান্য আরো অনেক উপকার হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশ্বজগতের স্রষ্টা মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন যে কিসের মাঝে কি মঙ্গল নিহিত আছে। আমরাও আমাদের সীমিত জ্ঞানেই জিহাদের অনেক সুফল দেখতে পারি। কিন্তু তারপরও, দূরদৃষ্টির অভাবে বেশির ভাগ মানুষই জিহাদের বাহ্যিক কষ্ট ও দুর্ভোগের কথা ভেবে জিহাদকে অপছন্দ করে। আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ

তোমাদের জন্য কিতালের বিধান দেওয়া হল যদিও তোমাদের নিকট ইহা অপ্রিয়। কিন্তু তোমরা যা অপছন্দ কর সম্ভবত তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যা ভালবাস সম্ভবত তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ জানেন আর তোমরা জাননা। (সূরা বাকারা ২:২১৬)

সালামাহ ইবনে নুফাইল (রাঃ) বলেছেনঃ যখন আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে বসে ছিলাম তখন একজন মানুষ এসে বলল, “হে রাসূলুল্লাহ ﷺ, ঘোড়াদের অপমান করা হচ্ছে, অস্ত্র ফেলে রাখা হয়েছে আর মানুষ মনে করছে আর জিহাদ নেই এবং সব যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।” রাসূল ﷺ বললেনঃ “তারা মিথ্যা বলছে, যুদ্ধ সবে শুরু হয়েছে। যুদ্ধ তো সবে শুরু হয়েছে। আমার উম্মাহর থেকে একটি দল সবসময়ই সত্যের পথে যুদ্ধ করতে থাকবে এবং আল্লাহ কিছু মানুষের ক্বলবকে পথভ্রষ্ট করে দিবেন এবং তাদের থেকে এই দলের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী সরবরাহ করবেন, যতক্ষণ না শেষ সময় ঘনিয়ে আসে এবং আল্লাহর ওয়াদা সত্য বলে প্রমাণিত হয়। এবং কিয়ামত পর্যন্ত ঘোড়ার কপালেই মঙ্গল লেখা থাকবে। আমাকে ওহী করা হচ্ছে যে, আমি অচিরেই তোমাদের ছেড়ে চলে যাব এবং তোমরা একে অপরের সাথে যুদ্ধ করে আমার অনুগামী হবে। আর জেনে রেখো, মু’মিনদের বাড়ী হবে শাম অঞ্চলে।” (সুনান আন-নাসাঈ)

আন-নাসাঈর টীকা হিসেবে আল-সিন্দি লিখেছেনঃ “ঘোড়াদের অপমান” বলতে বুঝানো হয়েছে ঘোড়াদের অবহেলা করা এবং তাদের গুরুত্বকে খাটো করে দেখা বা যুদ্ধর কাজে তাদের ব্যবহার না করা।

“যুদ্ধ সবে শুরু হয়েছে। যুদ্ধ তো সবে শুরু হয়েছে।” – এটা দুইবার বলার উদ্দেশ্য হলো এর উপর গুরুত্ব আরোপ করা। এর থেকে বোঝা যায় যে, যুদ্ধ বাড়তেই থাকবে, কারণ আল্লাহ মাত্র কিছুদিন আগে এটা ফরয করেছেন, সুতরাং এতো জলদি কিভাবে এটা শেষ হয়ে যাবে? অথবা এর অর্থ হতে পারে যে, সত্যের যুদ্ধ সবে শুরু হচ্ছে, কারণ এর পূর্বে তারা শুধু নিজেদের এলাকাতেই যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু এখন সময় এসেছে অন্যান্য দূরবর্তী এলাকাতেও যুদ্ধ নিয়ে যাওয়ার।

“আল্লাহ কিছু মানুষের ক্বলবকে পথভ্রষ্ট করে দিবেন” – এর অর্থ হলো আল্লাহ চিরদিনই এমন কিছু মানুষ রাখবেন যাদের বিরুদ্ধে সত্যপন্থীরা তাদের জিহাদ অব্যাহত রাখতে পারে এমনকি এজন্য যদি কারো মনকে ঈমান থেকে কুফরের দিকে ঘুরিয়ে দিতে হয়, আল্লাহ সেটাও করবেন। এর মাধ্যমেই আল্লাহ মু’মিনদের উপর তাঁর রহমত বর্ষণ করবেন যাতে তারা তাঁর রাস্তায় জিহাদ করার গৌরব অর্জন করতে পারে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে পারে।

“ঘোড়ার কপালে মঙ্গল”-এর অর্থ হলো পুরষ্কার এবং গণিমতের মাল, সম্মান এবং গৌরব।

“মু’মিনদের বাড়ী হবে শাম অঞ্চলে” – এখানে কিয়ামতের কাছাকাছি সময়ের কথা বলা হয়েছে। সেই সময় শাম হবে মুসলিমদের শক্ত ঘাঁটি এবং জিহাদের কেন্দ্রস্থল।

জিহাদের মাধ্যমে মু’মিনদের জন্য এই দুনিয়াতেও যেসব উপকার হতে পারে সেগুলো হলোঃ

  • শিরক এবং ফিতনা দূর করে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা

এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দ্বীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যদি তারা বিরত হয় তবে তারা যা করে আল্লাহ তো তার সম্যক দ্রষ্টা। (সূরা আনফাল ৮:৩৯)

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে বলা হয়েছে যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই এবং মুহাম্মাদ রাসূল ﷺ আল্লাহর রাসূল, তারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে। আর তারা যদি এটা করে, তাহলে তাদের জান ও মাল আমার কাছ থেকে নিরাপদ শুধুমাত্র ইসলামের শরীয়াহর দাবী ব্যতীত। আর তাদের হিসাব আল্লাহর কাছে।”  (এই হাদীস ইবনে উমার, আবু হুরায়রা, জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ, আনাস বিন মালিক, জাবীর ইবনে আব্দুল্লাহ, আউস ইবনে আবু আউস, ইবনে আব্বাস, সাহল ইবনে সাদ, আল-সুমান ইবনে বশীর, তারিক ইবনে আশিয়াম, আবু বাকরাহ, মুয়ায ইবনে জাবাল এবং সামুরা ইবনে জুনদুব থেকে বর্ণিত- এবং এটি বুখারী, মুসলিম, তিরমীযী, নাসাঈ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমেদ, আল-বায়হাকী, ইবনে হিব্বান, আল-দারকুতনী এবং মুয়াত্তা ইমাম মালিক-এই সব হাদীস গ্রন্থে এটি সংকলন করা হয়েছে। সুতরাং এটি মুতাওয়াতির হাদীস, অর্থাৎ সবচেয়ে সহীহ শ্রেণীর হাদীস।)

  • তাগুতদের ধ্বংস করা (যারা কাফিরদের সর্দার)

তাদের চুক্তির পর তারা যদি তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে বিদ্রূপ করে তবে কাফিরদের প্রধানদের সহিত যুদ্ধ কর; ইহারা এমন লোক যাদের কোন প্রতিশ্রুতি রহিল না; যেন তারা নিবৃত্ত হয়। (সূরা তাওবা ৯:১২)

  • কাফিরদের অপমানিত করা, তাদের মনোবল ভেঙে দেয়া এবং মুসলিমদের সম্মান ফিরিয়ে আনা

তোমরা তাদের সহিত যুদ্ধ করবে। তোমাদের হস্তে আল্লাহ উহাদেরকে শাস্তি দিবেন, উহাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন, উহাদের উপর তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন ও মুমিনদের চিত্ত প্রশান্ত করবেন, এবং তিনি উহাদের অন্তরের ক্ষোভ দূর করবেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তার প্রতি ক্ষমাপরায়ণ হন, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবা ৯:১৪-১৫)

  • দুনিয়া থেকে জুলুম সরিয়ে ফেলা

তোমাদের কী হল যে, তোমরা যুদ্ধ করবে না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নরনারী এবং শিশুদের জন্য, যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক। এই জনপদযার অধিবাসী যালিম, উহা হতে আমাদেরকে অন্যত্র নিয়ে যাও; তোমার নিকট হতে কাউকেও আমাদের অভিভাবক কর এবং আমাদের সহায় কর। যারা মুমিন তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে এবং যারা কাফির তারা তাগুতের পথে যুদ্ধ করে। সুতরাং তোমরা শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; শয়তানের কৌশল অবশ্যই দুর্বল। (সূরা নিসা ৪:৭৫-৭৬)

  • কাফিরদের ভীত-সন্ত্রস্ত করা এবং তাদের কুকর্ম করার সাহস হতে না দেয়া

কিতাবীদের মধ্যে যারা উহাদিগকে সাহায্য করেছিল, তাদেরকে তিনি তাদের দুর্গ হতে অবতরণ করালেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন, এখন তোমরা উহাদের কতককে হত্যা করতেছ এবং কতককে করতেছ বন্দী।(সূরা আহযাব ৩৩:২৬)

স্মরণ কর, তোমাদের প্রতিপালক ফেরেশতাদের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন, আমি তোমাদের সাথে আছি, সুতরাং মুমিনগণকে অবিচলিত রাখ। যারা কুফরী করে আমি তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করব; সুতরাং তোমরা আঘাত কর তাদের স্কন্ধে ও আঘাত কর তাদের প্রত্যেক আঙ্গুলের অগ্রভাগে। (সূরা আনফাল ৮:১২)

তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী প্রস্তুত রাখবে এতদ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে এবং এতদ্ব্যতীত অন্যদেরকে যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাদেরকে জানেন। আল্লাহ পথে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে উহার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে দেয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি যুলুম করা হবে না। (সূরা আনফাল ৬:৬০)

আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “……আমাকে বিজয় দেয়া হয়েছে ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে (যা আল্লাহ শত্রুদের অন্তরে গেঁথে দেন)।” (বুখারী, কিতাবুল জিহাদ)

এগুলো ছাড়াও জিহাদের আরো অনেক উপকার আছে, যা আল্লাহই ভালো জানেন। আল্লাহু আকবার! আমরা যদি জিহাদ আর তরবারি ত্যাগ করি, তাহলে আল্লাহ আমাদের ত্যাগ করবেন। জিহাদ না করলে জিহাদের কোন সুফল মু’মিনরা পাবেনা, বরং এর উল্টোটাই ঘটবে (অর্থাৎ শত্রুদের দ্বারা অপমানিত এবং তাদের দাসত্ব)।

সুতরাং তারা আল্লাহর হুকুমে উহাদেরকে পরাভূত করল; দাউদ জালূতকে হত্যা করল, আল্লাহ তাকে রাজত্ব ও হিম্মত দান করলেন এবং যা তিনি ইচ্ছা করলেন তা তাকে শিক্ষা দিলেন। আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ জগতসমূহের প্রতি অনুগ্রহশীল। (সূরা বাকারা ২:২৫১)

ইমাম আল-হালিমী তার সুয়াব-আল-ঈমান বইতে লিখেছেনঃ “আল্লাহ সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তিনি যদি মু’মিনদের দ্বারা কাফিরদের দমন না করে রাখতেন অথবা মু’মিনদের দ্বারা ইসলামকে রক্ষা করার ও কাফির বাহিনীকে ধ্বংস করার ক্ষমতা না দিতেন- তাহলে পৃথিবীতে কুফরের রাজত্ব চলতো এবং সত্য দ্বীন হারিয়ে যেতো। এখান থেকেই প্রমাণ হয় যে, ইসলামের টিকে থাকার কারণ হলো জিহাদ- আর এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় অবশ্যই ঈমানের একটি স্তম্ভ হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্যতা রাখে।”

সুতরাং আমরা এভাবেই তাগুতের দ্বিতীয় হাতকে ভেঙে দেবো, ক্বিতালের মাধ্যমে।

যারা মুমিন তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে এবং যারা কাফির তারা তাগুতের পক্ষে যুদ্ধ করে। সুতরাং তোমরা শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; শয়তানের কৌশল অবশ্যই দুর্বল। (সূরা নিসা ৪:৭৬)

মূর্তিপূজকরা তাদের মূর্তিগুলোর ক্ষমতার উপর বিশ্বাসে অটল থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ সেগুলোর দুর্বলতা প্রকাশ করে দেয়। কিন্তু এরপরও কেউ কেউ মূর্তির ক্ষমতাকে ভয় করতে থাকে, যতক্ষণ না কেউ এটাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। একইভাবে আমাদেরও কাজ হবে দাওয়াহর মাধ্যমে তাগুতের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়া, এবং সাথে সাথে যুদ্ধ চালিয়ে তাগুতকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া, যাতে করে আমরা মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে সর্বোচ্চ, মহান একমাত্র আল্লাহর দাসত্বে নিয়ে আসতে পারি। আল্লাহ উপরের আয়াতে মু’মিনদের এবং বিশেষত মুজাহিদদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, তাগুত এবং তাগুতের ষড়যন্ত্র দু’টোই আসলে অত্যন্ত দুর্বল। অতীতেও তাগুতরা পরাস্ত হয়েছে এবং তাদের অক্ষমতা প্রকাশ হয়ে গেছে, তাদের দুর্বল পরিকল্পনা তাদের নিজেদেরই ক্ষতির কারণ হয়েছে – যেমনটা দেখা যায় নমরুদ, ফেরাউন এবং আসহাবে উখদুদের ঘটনার সেই রাজার ক্ষেত্রে। এবং এখনও ইনশাআল্লাহ, তাগুত ধ্বংস হয়ে যাবে, কেবলমাত্র যদি মু’মিনরা আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ ত্বাওয়াক্কুল রাখে, ইসলামের বার্তাকে ছড়িয়ে দেয় এবং তলোয়ার তুলে নেয়।

বিশিষ্ট আলেম ইবনুল কাইয়্যিম বলেছেনঃ

 

আমি জিহাদ চালাবো

আপনার শত্রুর সাথে ততদিন,

আমাকে আপনি

টিকিয়ে রাখবেন যতদিন।

যুদ্ধকেই আমি বানাব আমার পেশা।

বড় বড় জন সমাগমের মাঝেই

আমি প্রকাশ করে দেব তাদের ষড়যন্ত্র,

আর আমার জিহবার ধারে

ছিন্ন করে দেব তাদের শক্তি।

(তাগুতের প্রতি) নিষ্ফল ক্রোধে জ্বলতে জ্বলতেই

তোরা ধ্বংস হয়ে যা,

কারণ আমার রব জানেন

তোরা যা লুকাতে চাস,

আর জানেন

যা আছে তোদের অন্তরে।

আর আল্লাহ তো আছেন

তাঁর দ্বীন এবং কোরআনের পক্ষে,

আরও আছেন রাসূলুল্লাহ

তার জান এবং কর্তৃত্ব নিয়ে

সত্য এমন এক খুঁটি

যাকে কেউ ধ্বংস করতে পারবেনা,

এমনকি যদি ছাকালান (জ্বীন ও মানুষ)

এক হয়, তাহলেও না।

 

যেহেতু ফলাফল আল্লাহর হাতে সেহেতু পরিণতি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে কিন্তু কাজের ভিত্তি এবং পদ্ধতি সবসময় একই

তাগুতের সাথে সংগ্রামে আমরা কি ফলাফল দেখতে পাব, তা আল্লাহই ভালো জানেন; অতীত মু’মিনরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিণতি পেয়েছে, কিন্তু তাদের কাজের ভিত্তি সবসময়ই একই ছিল।

নূহ (আঃ) এবং তাঁর অনুসারী মু’মিনদের রক্ষা করা হয়েছিল এবং কাফেরদের ধ্বংস করা হয়েছিল। ইব্রাহীম (আঃ) এবং তাঁর অনুসারী মু’মিনরা অত্যাচারিত হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে আল্লাহ ইব্রাহীম (আঃ)-কে রক্ষা করেন এবং তাগুতকে ধ্বংস করেন। মুসা (আঃ) তৎকালীন দুর্ধর্ষ তাগুত ফেরাউনের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে পারেন নি। আল্লাহ তাকে আদেশ দিলেন মু’মিনদের সাথে নিয়ে ভোর বেলায় গোপনে পালিয়ে যেতে। ফেরাউন তার বাহিনী নিয়ে মু’মিনদের ঘিরে ফেললো, কিন্তু মুসা (আঃ) এর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তার রব তাদের সাথেই আছেন এবং অবশ্যই তিনি কোন একটি উপায় বাতলে দিবেন। তারপর মু’মিনরা পালাতে সক্ষম হয় এবং ফেরাউন ধ্বংস হয়। আসহাবুল উখদুদের ঘটনায় মু’মিনরা ছিল একেবারেই দুর্বল, তারপরও তারা তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আর আসহাবুল কাহাফের যুবকেরা দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং তাদের ঈমান রক্ষা করার জন্য পালিয়ে যাবার সুযোগ পেয়েছিল। তারা এক গুহায় আশ্রয় নেয়। ৩০০ বছর অথবা ৩০৯ বছরের ঘুম থেকে জেগে তারা তাদের মধ্য থেকে একজনকে পাঠায় খাবার আনতে। তারা ভেবেছিল তারা বড়জোর একদিন কি দুইদিন ঘুমিয়েছে, তাই খাবার আনতে গিয়ে তারা সাবধান ছিল পাছে কেউ তাদের চিনে ফেলে এবং তাদের শিরকের জন্য বাধ্য করে।

উহারা যদি তোমাদের বিষয় জানতে পারে তবে তোমাদেরকে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করবে অথবা তোমাদেরকে উহাদের ধর্মে ফিরাইয়া নিবে এবং সেক্ষেত্রে তোমরা কখনই সাফল্য লাভ করবে না। (সূরা কাহাফ ১৮:২০)

সাহাবা (রাঃ)-গণ এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ ছিলেন নির্যাতিত এবং অকল্পনীয় অত্যাচারের শিকার। এই নির্যাতনের মাঝেও রাসূল ﷺ সাহাবাদের সবর করতে বলতেন। যেমন, তিনি বলেছেন, “ধৈর্য্য ধর, হে ইয়াসিরের পরিবার! কারণ তোমাদের জন্য জান্নাত অপেক্ষা করছে”, অনুরূপভাবে “তোমাদের পূর্বের মানুষদের মাঝে, কাউকে কাউকে ধরে মাটিতে পুতে রেখে তার মাথা থেকে করাত দিয়ে দুইভাগ করা হয়েছে, লোহার চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে তার হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলা হয়েছে; কিন্তু তারপরও সে তার ঈমান থেকে একচুলও সরেনি।” যারা দ্বীনের আনসার হতে চায় এমন লোকদের রাসূল ﷺ খুঁজছিলেন, তিনি তায়িফে গিয়েছিলেন এবং অন্যান্য গোত্রের কাছেও।  কিন্তু বনু থাকিফ (তায়িফের অধিবাসী) উনাকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করলো এবং তাদের বাচ্চাদের দিয়ে রাসূলের দিকে পাথর মারালো। এই সময়ই রাসূলুল্লাহ ﷺ  বলেছিলেন, “হে আল্লাহ তোমার কাছেই আমি আমার দুর্বলতার জন্য অভিযোগ করছি।” আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীর জন্য নুসরাহর ব্যবস্থা করার আগে তাকে মিরাজে নিয়ে গেলেন। তারপর অবশেষে, ইয়াসরিবের কিছু মানুষ দাওয়াহ কবুল করলো এবং মুসায়াব ইবনে উমাইরের সাহায্যে ইয়াসরিবের ঘরে ঘরে ইসলামের বার্তা পৌঁছে গেলো এবং তারপর নবী ﷺ-কে তারা নুসরাহ দিলো। সাহাবারা গোপনে হিজরত শুরু করলেন। অবশেষে রাসূলুল্লাহ ﷺ-ও আল্লাহর সাহায্যে কাফিরদের হত্যা প্রচেষ্টাকে ফাঁকি দিয়ে আবু বকর (রাঃ)-কে সাথে করে হিজরত করলেন। জিহাদের আয়াত নাযিল হওয়ার আগ পর্যন্ত মু’মিনদের ধৈর্য ধরে সব অত্যাচার সহ্য করতে বলা হয়েছিল। তারপর শুধু তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ অনুমোদন করা হলো যারা মু’মিনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে। শেষে, আল্লাহ আদেশ দিলেন সব মুশরিকদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করতে, যখনই হারাম মাসগুলো অতিবাহিত হয়ে যাবে এবং যতক্ষণ না সব ফিতনা দূর হয়ে কেবলমাত্র আল্লাহর দেয়া দ্বীনই টিকে থাকে। সাহাবারা আল্লাহর আদেশ পালন করলেন এবং ইসলামের তলোয়ার তাগুত এবং শিরকের রাজত্বকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে মানুষকে জাহিলিয়াতের অন্ধকার থেকে ইসলামের আলোতে নিয়ে আসলো। মুসলিমের মাঝে যতদিন তাওয়াক্কুল ও ইখলাস ছিল এবং যতদিন তারা আল্লাহকে সেইভাবে ইবাদত করেছে ও ভয় করেছে, যেভাবে করা উচিত- ততদিন পর্যন্ত তারা একের পর এক বিজয় পেতেই থাকলো। আর যখনই তারা এই গুণগুলো হারিয়ে ফেললো, দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়লো এবং অহংকারী হয়ে উঠলো তখনই আল্লাহ তাদের উপর সেই মর্যাদা উঠিয়ে নিলেন যা পূর্ববর্তী প্রজন্মের মুসলিমরা পেয়েছিল।

সুতরাং যা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে – পূর্বের মু’মিনরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ফলাফল ভোগ করেছে, কিন্তু তাদের ভিত্তি ছিল একই। তারা যত দুর্বলই হোক না কেন, তাওহীদের দাওয়াহ ছিল সবসময়ই উচ্চতর ও প্রবল। তাগুতকে প্রত্যাখ্যান এবং আল-ওয়ালা ও আল-বারাআ হলো দ্বীনের ভিত্তি এবং শাহাদাহর শর্ত ও স্তম্ভ। আমরা আমাদের দাওয়াকে হালকা করবো না, বা এটাকে গোপনও রাখবো না। বরং, তাগুত যদি আমাদের অত্যাচার করতে বা হত্যা করতে শুরু করে, তাহলে দাওয়াহ আরো জোরেশোরে চালাতে হবে। ইনশা-আল্লাহ এই দাওয়াহকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিবেন এবং আমাদের জন্য যেমন চান তেমন পরিণতি দেবেন। একই সাথে ক্বিতালের জন্য আমাদের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে, এবং যখনই আমাদের সামর্থ্য হবে তখন ক্বিতাল করতে হবে। কারো কারো একটা ভুল ধারণা আছে যে, ক্বিতালের জন্য প্রস্তুতি নেয়াটাও নিষিদ্ধ। যদি তাদের ধারণা সত্যি হয়, তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব যে আনসাররা নুসরাহ দিতে প্রস্তুত ছিল (যদি তাদের ক্বিতালের প্রস্তুতি না থাকে)? আনসাররা কি আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াতের দিন রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে জিহাদের অনুমতি চাননি? (ইবনে ইসহাকের লেখা সীরাত দেখুন) তার উত্তরে রাসূল ﷺ কি বলেছিলেনঃ “না, আগে ইসলামী রাষ্ট্র শক্তিশালী হোক”। না! তিনি একথা বলেননি। বরং তিনি বলেছেন, “আমাদের উপর এমন কোন হুকুম আসেনি।” অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ ﷺ ওহীর মাধ্যমে যা হুকুম পেয়েছেন তাই তামিল করেছেন। পরে যখন জিহাদের হুকুম দিয়ে ওহী আসলো, তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, “এখন (সময় হয়েছে) ওদের উপর আক্রমণ করার, ওরা এখন থেকে আর আমাদের হামলা করতে আসবে না। বরং আমরাই ওদের দিকে আমাদের বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাব।” (বুখারী)

রাসূলুল্লাহ ﷺ আরো বলেছেন, “কিয়ামতের আগে আমাকে পাঠানো হয়েছে তরবারি হাতে যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন শরীক ছাড়াই এক আল্লাহর ইবাদত করা হচ্ছে। আমার বর্শার ছায়ায় আমার জন্য রাখা হয়েছে জীবিকা এবং আমার শত্রুর জন্য আছে অপমান এবং লাঞ্ছনা।” (মুসনাদে আহমেদ)

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে বলা হয়েছে যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ নাই এবং মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর রাসূল, তারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে। আর তারা যদি এটা করে, তাহলে তাদের জান ও মাল আমার কাছ থেকে নিরাপদ, শুধুমাত্র ইসলামের শরীয়াহর দাবী ব্যতীত; আর তাদের হিসাব আল্লাহর কাছে।” (মুসলিম)

এখনও যেহেতু জিহাদ এবং ক্বিতালের আয়াত জারি আছে, তখন আমরা কিভাবে হিজরতের আগে রাসূলূল্লাহ ﷺ এর অবস্থাকে দুর্বল অবস্থায় জিহাদ না করার দলিল হিসেবে বর্ণনা করতে পারি? কোথাও কি এমন কোন স্পষ্ট দলিল আছে যে, দারুল ইসলাম না থাকলে তাগুতকে অপসারণ করতে জিহাদ করা যাবে না? অথচ তাফসীরের একটি উসূল হলো সার্বজনীন আয়াতের অর্থকে সর্বসময়ে এবং পরিস্থিতিতে অভিন্নভাবে বুঝতে হবে এবং ব্যবহার করতে হবে, যদি না অন্য কোন স্পষ্ট দলিল দ্বারা এই অর্থকে কোন নির্দিষ্ট সময় বা পরিস্থিতির জন্য সীমাবদ্ধ করা হয়। জিহাদ ও ক্বিতালের ব্যাপারে যে আয়াত এবং হাদিসগুলো রয়েছে সেগুলোর হুকুম এবং উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট নয় কি?

তাদের চুক্তির পর তারা যদি তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে বিদ্রূপ করে তবে কাফিরদের প্রধানদের সহিত যুদ্ধ কর; এরা এমন লোক যাদের কোন প্রতিশ্রুতি রইল না; যেন তারা নিবৃত্ত হয়। (সূরা তাওবা ৯:১২)

তোমরা তাদের সহিত যুদ্ধ করবে। তোমাদের হস্তে আল্লাহ উহাদেরকে শাস্তি দিবেন, উহাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন, উহাদের উপর তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন ও মুমিনদের চিত্ত প্রশান্ত করবেন, এবং তিনি উহাদের অন্তরের ক্ষোভ দূর করবেন। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা তার প্রতি ক্ষমাপরায়ণ হন, আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবা ৯:১৪-১৫)

যদি কোন স্থানে তাগুতকে হঠানোর মতো মুসলিমদের হাতে শক্তি থাকে, তাহলে কি বলতে পারবে যে, নুসরাহ পাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা জিহাদ করবে না এবং তাগুতকে বহাল তবিয়তে থাকতে দিবে? না, কারণ এটা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথার সম্পূর্ণ বিপরীতে যায় “কিয়ামতের আগে তরবারি হাতে আমাকে পাঠানো হয়েছে যতক্ষণ না কোন শরীক ছাড়াই আল্লাহর ইবাদত করা হয়।” এবং এ কথা আল্লাহর কথারও বিরুদ্ধে যায়ঃ

এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দ্বীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যদি তারা বিরত হয় তবে তারা যা করে আল্লাহ তো তার সম্যক দ্রষ্টা। (সূরা আনফাল ৮:৩৯)

সুতরাং মুসলিমদের অন্তত ক্বিতাল করার জন্য প্রস্তুতিটুকু অবশ্যই নিতে হবে, কারণ এটাই আল্লাহর হুকুম।

তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী প্রস্তুত রাখবে এতদ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে এবং এতদ্ব্যতীত অন্যদেরকে যাহাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাহাদেরকে জানেন। আল্লাহর পথে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে উহার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে দেয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি যুলুম করা হবে না। (সূরা আনফাল ৮:৬০)

উহারা বাহির হতে চাইলে নিশ্চয়ই ইহার জন্য প্রস্তুতির ব্যবস্থা করত, কিন্তু উহাদের অভিযাত্রা আল্লাহর মনঃপূত ছিল না। সুতরাং তিনি উহাদেরকে বিরত রাখেন এবং উহাদেরকে বলা হয়, যারা বসে আছে তাদের সহিত বসে থাক। (সূরা তাওবা ৯:৪৬)

আল্লাহ যদি চান, তাহলে তিনি এই প্রস্তুতির ভিতর দিয়েই আমাদের তাঁর দ্বীনের আনসার হওয়ার জন্য তৈরি করবেন।

‘আল্লাহর সন্তুষ্টির সন্ধানে’ (IN PURSUIT OF ALLAH’S PLEASURE) বইটির লেখকগণের বক্তব্য কতই না সত্যঃ “জিহাদের বিষয়ে আলোচনা করতে আমার দুঃখ হয়।” আমি ভাইবোনদের অনুনয় করছি, আপনারা ঐ বইয়ের জিহাদ অধ্যায়টি পড়ুন। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের তাদের মতো করে দিয়েন না যারা নিজেরা জিহাদ থেকে সরে থাকে এবং অন্যদেরও জিহাদ করতে নিষেধ করে। কারণ, ক্বিতালের মাধ্যমেই আল্লাহ আমাদের অপমান থেকে মুক্ত করে মর্যাদার আসন দেন। ক্বিতাল এবং এর প্রস্তুতিই হলো শয়তানের অনুসারীদের ভয় দেখানোর একমাত্র উপায়। আমরা আজ কতটা নিচে নেমে গিয়েছি যে, শুকর ও বানরের উত্তরসূরিরা এখন আমাদের বোনদের অপমান করার স্পর্ধা পোষণ করে? আমাদের আলেমগণ, যাঁরা নবীদের উত্তরসূরি, তাঁদের বন্দী করার সাহস দেখায়? আমাদের উপর এই অপমান নেমে এসেছে কারণ আমরা আল্লাহর হুকুম পালন করিনি – অর্থাৎ ক্বিতালের প্রস্তুতি নেইনি যার মাধ্যমে শত্রুদের ভীত সন্ত্রস্ত করা যাবে।

সুতরাং তারা আল্লাহর হুকুমে উহাদেরকে পরাভূত করল; দাউদ জালূতকে হত্যা করল, আল্লাহ তাকে রাজত্ব ও হিম্মত দান করলেন এবং যা তিনি ইচ্ছা করলেন তা তাকে শিক্ষা দিলেন। আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ জগতসমূহের প্রতি অনুগ্রহশীল। (সূরা বাকারা ২:২৫১)

ইমাম আল-হালিমী তাঁর সুয়াব-আল-ঈমান বইতে লিখেছেনঃ

‘আল্লাহ সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তিনি যদি মু’মিনদের দ্বারা কাফিরদের দমন না করে রাখতেন অথবা মু’মিনদের দ্বীন রক্ষা করার ও কাফির বাহিনীকে ধ্বংস করার কর্তৃত্ব না দিতেন – তাহলে পৃথিবীতে কুফরের রাজত্ব কায়েম হতো এবং সত্য দ্বীন হারিয়ে যেতো। এখান থেকেই প্রমাণ হয় যে, ইসলামের টিকে থাকার কারণ হলো জিহাদ আর এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় অবশ্যই ঈমানের একটি স্তম্ভে হওয়ার উপযুক্ত।’

ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি, “তোমরা যদি নিজেদের মধ্যে ব্যবসা করতে থাকো, আর ষাঁড়ের লেজের পেছনে চলতে থাকো, এবং কৃষক হিসেবে থেকেই সন্তুষ্ট হয়ে যাও এবং জিহাদ ভুলে যাও; তাহলে আল্লাহ তোমাদের উপর অপমান চাপিয়ে দিবেন যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের দ্বীনে ফিরে যাও।” (আবু দাঊদ – সহীহ)

এই হাদীসের অর্থ হলো, যদি মানুষ ব্যবসা, কৃষিকাজ বা এরকম অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে জিহাদকে অবহেলা করে, তাহলে আল্লাহ তাদের উপর তাদের শত্রুদের চাপিয়ে দেবেন যারা তাদের জন্য অপমান বয়ে আনবে যা কখনো দূর করা যাবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের আসল কাজ অর্থাৎ কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ, তাদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন, দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করা, মু’মিনদের বিজয়ী করা, আল্লাহর বাণীকে উচ্চে তুলে ধরা, কুফর এবং কাফিরদের অপমানিত করা, ইত্যাদিতে ফিরে যায়। এই হাদীস থেকে দেখা যাচ্ছে যে, জিহাদ ত্যাগ করা মানে ইসলাম ত্যাগ করা, কারণ রাসূল ﷺ বলেছেন, “যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের দ্বীনে ফিরে যাও।”

আবু বকর (রাঃ) বলেন, “যদি মানুষ জিহাদ ছেড়ে দেয়, তাহলে আল্লাহ তাদের উপর সবধরনের আযাব দিবেন।” (তাবারানি, নির্ভরযোগ্য সূত্র)

ইবনে আসাকির বলেন, যখন আবু বকর খলিফা হলেন তখন উনি মিম্বারে দাঁড়িয়ে বললেন, “যদি মানুষ জিহাদ ছেড়ে দেয়, তাহলে আল্লাহ তাদের উপর দরিদ্রতা চাপিয়ে দিবেন।”

পরীক্ষার মাধ্যমেই প্রকাশ হয়ে যায় মুনাফিকদের পরিচয়

আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলা পরীক্ষার মাধ্যমে মু’মিনদের কাতার থেকে ছেঁকে ফেলেন মুনাফিকদের এবং মু’মিনদেরও তাদের ঈমানের স্তর অনুযায়ী শ্রেণীবিন্যাস করে দেন। তিনি এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেনঃ

মানুষ কি মনে করে যে, আমরা ঈমান এনেছি এই কথা বললেই উহাদেরকে পরীক্ষা না করে অব্যাহতি দেয়া হবে? আমি তো ইহাদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম; আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দিবেন কারা সত্যবাদী এবং তিনি অবশ্যই প্রকাশ করে দিবেন কারা মিথ্যাবাদী। (সূরা আনকাবুত ২৯:২-৩)

এছাড়া বহু হাদীস থেকেও দেখা যায় যে, সবচেয়ে বেশি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন নবীরা, তারপর যাদের ঈমান ছিল সবচেয়ে বেশি, তারপর তাদের চেয়ে কিছুটা কম ঈমান যাদের, এভাবে শেষ পর্যন্ত।

মুনাফিকরা এইসব পরীক্ষা থেকে বেঁচে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ইসলামকে সহজ করে নিতে সবরকম প্রচেষ্টা চালায়। যদিও এই সহজ করে নিতে গিয়ে তাদের বড় মূল্য দিতে হয় (অর্থাৎ ঈমান এবং আখিরাত দুই দিকই হারাতে হয়)। প্রাথমিক পরীক্ষাতেই মু’মিনদের সারি থেকে এই মুনাফিকরা আলাদা হয়ে যাবে। এরা কাফিরদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে, দাওয়াকে বিকৃতি করে, জিহাদের পথে চলতে নিষেধ করে। তারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়া খরিদ করে নেয়।

তারাই সৎ পথের বিনিময়ে ভ্রান্ত পথ এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করেছে; আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল! (সূরা বাকারা ২:১৭)

এরা সেই সব মানুষ যারা দাওয়াহ (ইসলামের দিকে আহবান)-কে বিকৃত করে; তারা দাওয়াহকে হালকা করতে থাকে এবং এর কিছু অংশ গোপন করতে থাকে যতক্ষণ না তাগুত এদের কাজে খুশি হয়। তারা এর সাথে সাথে তাদের অন্যান্য কুকাজও চালাতে থাকে, আর দাবী করতে থাকে যে তারা এসব করছে ‘দাওয়াহ এবং মুসলিমদের উপকারের জন্যই’। অর্থাৎ, হয় তারা নিজেদের কুকর্মকে সৎকাজের আবরণ দিতে চায়, আর নয়তো শয়তানের কুমন্ত্রণায় তারা নিজেরাই হয়তো কুকর্মকেই সৎকাজ মনে করে। তবে যখনই তাদের কাজকর্মকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং ‘আল-ওয়ালা ওয়াল বারাআ-এর পাল্লায় মাপা হয়, তখনই তাদের কুরূপ প্রকাশ হয়ে যায়- কারণ সত্য মিথ্যাকে পরাস্ত করে। তারা যে কত বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে, তা স্পষ্টই বোঝা যায় তাদের ব্যাপারে আমাদের সাবধান করতে নাযিলকৃত আয়াতের সংখ্যা এবং এগুলোর বক্তব্যের তীব্রতা থেকে, রাসূল ﷺ বলেন, “আমি তোমাদের জন্য যা ভয় করি তা হলো, বিদ্বান এবং ভাল বক্তা কোন মুনাফিকের পেশ করা যুক্তি।” (ইমরান ইবনে হুসেন থেকে বর্ণিত, ইবনে হিব্বান)

আর আল্লাহ আমাদের সতর্ক করেছেনঃ

তাদেরকে যখন বলা হয়, পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কর না, তারা বলে, আমরাই তো শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! এরাই অশান্তি সৃষ্টিকারী কিন্তু এরা বুঝতে পারে না। (সূরা বাকারা ২:১১-১২)

তারা তাদের শপথগুলিকে ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করে আর তারা আল্লাহর পথ হতে মানুষকে নিবৃত্ত করে। তারা যা করছে তা কত মন্দ! (সূরা মুনাফিকূন ৬৩:২)

তুমি যখন উহাদের দিকে তাকাও উহাদের দেহাকৃতি তোমার নিকট প্রীতিকর মনে হয় এবং উহারা যখন কথা বলে, তুমি সাগ্রহে উহাদের কথা শ্রবণ কর যদিও উহারা দেওয়ালে ঠেকান কাঠের স্তম্ভ সদৃশ; উহারা যে কোন শোরগোলকে মনে করে উহাদেরই বিরুদ্ধে। উহারাই শত্রু, অতএব উহাদের সম্পর্কে সতর্ক হও; আল্লাহ উহাদেরকে ধ্বংস করুন! বিভ্রান্ত হইয়া উহারা কোথায় চলছে! (সূরা মুনাফিকূন ৬৩:৪)

তারা তাদের এই রোগে (নিফাক) ভুগতে থাকে প্রধানত এসব কারণেঃ

(১) তাগুতকে বেশি ভয় করা এবং আল্লাহকে ভয় না পাওয়া –

মানুষের মধ্যে কতক লোক বলে, আমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করি, কিন্তু আল্লাহর পথে যখন উহারা নিগৃহীত হয়, তখন উহারা মানুষের পীড়নকে আল্লাহর শাস্তির মত গণ্য করে এবং তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে কোন সাহায্য আসলে উহারা বলতে থাকে, আমরা তো তোমাদের সংগেই ছিলাম। বিশ্ববাসীর অন্তঃকরণে যা আছে, আল্লাহ কি তা সম্যক অবগত নন?” (সূরা ‘আনকাবুত ২৯:১০)

এবং যাদের অন্তঃকরণে ব্যাধি রয়েছে তুমি তাদেরকে সত্বর তাদের সাথে মিলিত হতে দেখবে এই বলে, আমাদের আশংকা হয় আমাদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটবে….. (সূরা মা‘য়িদা ৫:৫২)

তুমি কি তাদেরকে দেখ নাই যাদেরকে বলা হয়েছিল, তোমরা তোমাদের হস্ত সংবরণ কর, সালাত কায়েম কর এবং যাকাত দাও? অতঃপর যখন তাদের যুদ্ধের বিধান দেওয়া হল তখন তাদের একদল মানুষকে ভয় করছিল আল্লাহ ভয় করার মত অথবা তদপেক্ষা অধিক, এবং বলতে লাগল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে যুদ্ধের বিধান কেন দিলে? আমাদেরকে কিছুদিনের অবকাশ দাও না?’ বল, ‘পার্থিব ভোগ সামান্য এবং যে মুত্তাকী তার জন্য পরকালই উত্তম। তোমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও যুলুম করা হবে না।’” (সূরা নিসা ৪:৭৭)

আর স্মরণ কর, মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ছিল ব্যাধি, তারা বলছিল, আল্লাহ এবং তার রাসূল আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা প্রতারণা ব্যতীত কিছুই নয়। (সূরা আহযাব ৩৩:১২)

(২) দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা, এর আরাম-আয়েশের প্রতি আকর্ষণ এবং ত্যাগ স্বীকারে অনিচ্ছাঃ

যারা কৃপণতা করে এবং মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দিয়েছেন তা গোপন করে, আর আমি আখিরাতে কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি। (সূরা নিসা ৪:৩৭)

মুমিনরা বলে, একটি সূরা অবতীর্ণ হয় না কেন? অতঃপর যদি দ্ব্যর্থহীন কোন সূরা অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যুদ্ধের কোন নির্দেশ থাকে তুমি দেখবে যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা মৃত্যু ভয়ে বিহ্বল মানুষের মত তোমার দিকে তাকাচ্ছে। শোচনীয় পরিণাম উহাদের। (সূরা মুহাম্মদ ৪৭:২০)

“…….. এবং বলতে লাগল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান কেন দিলে? আমাদেরকে কিছুদিনের অবকাশ দাও না?’ বল, ‘পার্থিব ভোগ সামান্য এবং যে মুত্তাকী তার জন্য পরকালই উত্তম। তোমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও যুলুম করা হবে না।’” (সূরা নিসা ৪:৭৭)

(৩) বুদ্ধির অভাব বা হৃদয়ের কোমলতার এতই অভাব যে তারা বর্তমানে নির্যাতিত মুসলিম-মুসলিমাদের কষ্ট বুঝতে পারে নাঃ

ইহা এই জন্য যে, শয়তান যা প্রক্ষিপ্ত করে তিনি উহাকে পরীক্ষাস্বরূপ করেন তাদের জন্য যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, যারা পাষাণহৃদয়। নিশ্চয়ই যালিমরা দুস্তর মতভেদে রয়েছে। (সূরা হাজ্জ ২২:৫৩)

তারা বধির, মূক, অন্ধ, সুতরাং তারা ফিরবে না। (সূরা বাকারা ২:১৮)

এই মুনাফিকরা মু’মিনদের যেসব ক্ষতি করতে পারে তার মধ্যে অন্যতম হলো- মু’মিনদের জিহাদ এবং তাওয়াক্কুলের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা এবং মু’মিনদের মনে কাফিরদের প্রতি ভয় ঢুকিয়ে দেয়া। তারা এসব কাজে লিপ্ত কারণ, তারা আল্লাহ সঠিকভাবে চেনে না, আর তারা চিনবেই বা কিভাবে? তারাতো আল্লাহর কথা খুব কমই স্মরণ করে এমনকি তারা যদি কখনো ভাল কাজও করে তাতেও নিয়তের বিশুদ্ধতা থাকে না, বেশির ভাগই হলো মানুষকে দেখানোর জন্য ও তাদের প্রশংসা পাবার জন্য।

নিশ্চয়ই মুনাফিকগণ আল্লাহর সহিত ধোঁকাবাজি করে; বস্তুতঃ তিনি তাদেরকে উহার শাস্তি দেন আর যখন তারা সালাতে দাড়ায় তখন শৈথিল্যের সহিত দাড়ায়, কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে। (সূরা নিসা ৪:১৪২)

কোন মানুষ যদি ভালো বক্তা হয়, অথচ তার ‘রব’-এর ক্ষমতা বোঝার জন্য বা এই দুনিয়ার জীবন এবং আখেরাতের জীবনের মর্ম বোঝার জন্য যে ইলম দরকার, সেই ইলম চর্চা না করে – তাহলে তার এই সীমিত জ্ঞান তাকে নিশ্চিতভাবেই ভুল পথে নিয়ে যাবে।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “কেউ যদি এমন কোন জ্ঞান শিক্ষা করে যা দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যায়, অথচ সে সেটা করলো দুনিয়াবি কোন লাভের আশায় – তাহলে কিয়ামতের দিন সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।” (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিযী)

এ রকম মানুষ কোরআন-হাদীসের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও দ্বীনের সঠিক বুঝ থেকে বঞ্চিত থাকে। এ জন্যই আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেছেন, “একজন মুনাফিকের মধ্যে কখনোই দুইটি গুণ এক সাথে থাকবে না – জ্ঞান এবং ভাল আচরণ।”

এবং আল-কোরআনে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ আমাদের সর্তক করে বলছেনঃ

তুমি যখন উহাদের দিকে তাকাও উহাদের দেহাকৃতি তোমার নিকট প্রীতিকর মনে হয় এবং উহারা যখন কথা বলে, তুমি সাগ্রহে উহাদের কথা শ্রবণ কর যদিও উহারা দেওয়ালে ঠেকান কাঠের স্তম্ভ সদৃশ;” (সূরা মুনাফিকূন ৬৩:৪)

উহারা উহাদের শপথগুলিকে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করে আর উহারা আল্লাহর পথ হতে মানুষকে নিবৃত্ত করে। উহারা যা করছে তা কত মন্দ! (সূরা মুনাফিকূন ৬৩:২)

মুনাফিকরা যে ধরনের ওজুহাত দেখায়, যেভাবে মু’মিনদের জিহাদ ও তাওয়াক্কুল থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করে, আর যেভাবে মু’মিনদের মনে কাফিরদের প্রতি ভয় ঢুকিয়ে দেয়- এই সবই আল্লাহ ফাঁস করে দিয়েছেন। একজন আলেম সত্যিই বলেছেন, ‘যাদের মন এই দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা এবং মৃত্যুর প্রতি ঘৃণায় পরিপূর্ণ, তারা ভীরু-কাপুরুষ ছাড়া কি হতে পারে? বর্তমানে

এসব লোকেরা তাদের মিথ্যা অজুহাত এবং ভ্রান্ত চিন্তাধারাকে, ইসলামী ভাষায় মুখোশ পরিয়ে এবং নিজেদের তথাকথিত জ্ঞান এবং যুক্তির মাধ্যমে, গোপন রাখতে চায়- আর দাবী করে তারা ইসলামের ভালোর জন্যই কাজ করছে। তবে প্রথম কাতারের মু’মিনগণ বসে থাকবে না, তারা ঠিকই তাগুতকে ধ্বংস করে তাওহীদের দাওয়াহ এবং তরবারি নিয়ে এগিয়ে যাবে- আর মুনাফিকরা তাদের মিথ্যা অজুহাত নিয়েই পড়ে থাকবে, এরা নিজেরাও বিভ্রান্ত এবং অন্যদের বিভ্রান্তিতে নিতে চায়।

তোমরা উহাদের নিকট ফিরে আসলে উহারা তোমাদের নিকট অজুহাত পেশ করবে। বলিও অজুহাত পেশ কর না, আমরা তোমাদেরকে কখনও বিশ্বাস করবো না; আল্লাহ আমাদেরকে তোমাদের খবর জানিয়ে দিয়েছেন এবং আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করবেন এবং তাঁহার রাসূলও……। (সূরা তাওবা ৯:৯৪)

এ চরিত্রের মানুষেরা পূর্বেও বলতোঃ

“…….. আমাকে অব্যাহতি দাও এবং আমাকে ফিতনায় ফেল না। (সূরা তাওবা ৯:৪৯)

“…….. গরমের মধ্যে অভিযানে বের হইও না,” (সূরা তাওবা ৯:৮১)

“…….. যদি যুদ্ধ সংঘটিত হবে তা জানতাম তবে নিশ্চিতভাবে তোমাদের অনুসরণ করতাম (সূরা আলি ’ইমরান ৩:১৬৭)

 “…….. হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান কেন দিলে? আমাদেরকে কিছুদিনের অবকাশ দাও না?” (সূরা নিসা ৪:৭৭)

“…….. ইহাদের দ্বীন ইহাদিগকে বিভ্রান্ত করেছ। (সূরা আনফাল ৮:৪৯)

“…….. নির্বোধগণ যেরূপ ঈমান এনেছে আমরাও কি সেইরূপ ঈমান আনব?” (সূরা বাকারা ২:১৩)

 “…….. এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, তোমরা ফিরে চল,” (সূরা আহযাব ১৩)

 “…….. ‘হে মুসা! সেখানে এক দুর্দান্ত সম্প্রদায় রয়েছে এবং তারা সেই স্থান হতে বাহির না হওয়া পর্যন্ত আমরা কখনই সেখানে কিছুতেই প্রবেশ করব না; তারা সেই স্থান হতে বাহির হয়ে গেলেই আমরা প্রবেশ করব।’” (সূরা আহযাব  ১৩)

“…….. ‘আমাদের ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন আমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছে, অতএব আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’” (সূরা মা‘য়িদাঃ ২২)

 “…….. আমাদের বাড়িঘর অরক্ষিত; অথচ ঐগুলি অরক্ষিত ছিল না, আসলে পলায়ন করাই ছিল উহাদের উদ্দেশ্য। (সূরা ফাতহ ১১)

কিন্তু আল্লাহ তা’আলা সত্য প্রকাশ করে দিয়েছেনঃ

উহারা তোমাদের সহিত বাহির হলে তোমাদের বিভ্রান্তিই বৃদ্ধি করত এবং তোমাদের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদের মধ্যে ছুটাছুটি করত। তোমাদের মধ্যে উহাদের জন্য কথা শুনবার লোক আছে। আল্লাহ যালিমদের সম্বদ্ধে সবিশেষ অবহিত। (সূরা আহযাব ৩৩:১৩)

তোমরা কি মনে কর যে, তোমাদেরকে এমনি ছাড়িয়া দেয়া হবে যখন পর্যন্ত আল্লাহ না প্রকাশ করেন তোমাদের মধ্যে কারা মুজাহিদ এবং কারা আল্লাহ ও তাঁহার রাসূল ও মুমিনগণ ব্যতীত অন্য কাউকেও অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করে নাই? তোমরা যা কর, সে সম্বদ্ধে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত। (সূরা তাওবা ৯:৪৭)

যারা ঘরে বসে রইল এবং তাদের ভাইদের সম্বদ্ধে বলল যে, তারা তাদের কথামত চললে নিহত হত না, তাদেরকে বল, যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে নিজদেরকে মৃত্যু হতে রক্ষা কর। (সূরা তাওবা ৯:১৬)

পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ প্রথম সারির মু’মিনদের সামনে মুনাফিকদের চিহিৃত করে দেন-

এবং মুমিনগণ বলবে, ‘ইহারাই কি তারা যারা আল্লাহ নামে দৃঢ় শপথ করেছিল যে, তারা আমাদের সঙ্গেই আছে?’ তাদের কার্য নিষ্ফল হয়েছে; ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। (সূরা মা‘য়িদা ৫:৫৩)

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আসুন আমরা আল্লাহর কাছে তওবা করি এবং ক্ষমা প্রার্থনা করি;

“…….. আল্লাহ যাকে ইচ্ছা দীনের প্রতি আকৃষ্ট করেন এবং যে তাঁর অভিমুখী তাকে দীনের দিকে পরিচালিত করেন। (সূরা শূরা ৪২:১৩)

হে আল্লাহ! তোমার নবীরা মানুষের সতর্ককারী হিসেবে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। হে আল্লাহ, আমাদের ঐ মুনাফিকদের মতো করেন না যাদের ব্যাপারে আপনি বলেছেনঃ

মুনাফিকগণ তো জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে এবং তাদের জন্য তুমি কখনও কোন সহায় পাবে না। (সূরা নিসা ৪:১৪৫)

হে আল্লাহ! আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে জান্নাত সত্য, জাহান্নামও সত্য। হে আল্লাহ, আমরা সেই আগুনকে ভয় করি যার চারপাশ আকর্ষণীয় বস্তু এবং লোভনীয় এই পথ দিয়ে ঘেরা- হে আল্লাহ, আপনি আমাদের এর থেকে রক্ষা করুন। আল্লাহ আমাদের নিফাক এবং এর শাখা প্রশাখা যা আমরা জানি বা না জানি – তার থেকে আমাদের রক্ষা করুন। আমাদের মিথ্যা, বিশ্বাসঘাতকতা, খারাপ আচরণ, সালাতে অলসতা, আপনার স্মরণের অভাব, তাগুতের প্রতি ভয়, লোক দেখানোর প্রবণতা, ধার্মিক মুসলিম ও মুজাহিদদের ব্যাপারে কুৎসা রটানো, দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা এবং জিহাদের প্রতি ঘৃণা থেকে দূরে রাখুন। হে আল্লাহ আমাদের মনকে তুমি তোমার প্রতি, তোমার পছন্দের কাজের প্রতি এবং তোমার পছন্দের বান্দার প্রতি ভালবাসা পরিপূর্ণ করে দাও, আমাদের মনকে জিহাদের প্রতি ভালবাসায় এমনভাবে পূর্ণ করে দাও, যেন এর কথা শুনলেই জান্নাত এবং সেখানে তুমি যেসব আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করে রেখেছো তা আমাদের মনে ভেসে উঠে, যেমন তুমি বলেছঃ

“আমি আমার সত্যপন্থী বান্দাদের জন্য এমন কিছু প্রস্তুত করে রেখেছি যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, কোন কান কখনো শুনেনি, কোন মন কখনো উপলব্ধি করেনি।” (বুখারী, মুসলিম)

হে আল্লাহ! আমাদের আপনার প্রতি তেমন অনুগত করে দিন যেমন আপনি বলেছেনঃ

হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সম্মুখে তোমরা কোন বিষয়ে অগ্রণী হইও না এবং আল্লাহকে ভয় কর; আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সূরা হুজুরাত ৪৯:১)

হে আল্লাহ! আমাদের জিহ্বাকে মুনাফিকদের মতো কথা বলা থেকে বিরত রাখুন; আমাদের জিহ্বাকে রক্ষা করুন, যা সেই চরমভীতির দিনে (কিয়ামতের দিন) আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে, আমাদের জিহ্বাকে রক্ষা করুন, যার কারণে অতীতে অসংখ্য মানুষ জাহান্নামী হয়েছে, হে আল্লাহ, একমাত্র আপনিই পারেন বাতাসে ঘূর্ণায়মান পালকের মতো করে আমাদের মনকে ঘুরিয়ে দিতে – “ইয়া মুকালি­বাল ক্বুলুব, ছাব্বিত ক্বুলুবানা আ’লা দ্বীনিকা (হে অন্তরের নিয়ন্ত্রণকারী, আমাদের অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর রাখুন)”।

হে আমাদের রব! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্য লংঘনপ্রবণ করিও না এবং তোমার নিকট হতে আমাদেরকে করুণা দাও, নিশ্চয়ই তুমি মহাদাতা। (সূরা আলি ’ইমরান ৩:৮)

তারা বলল, হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব। (সূরা আ‘রাফ ৭:২৩)

পরীক্ষার মাধ্যমে মু’মিনদের পরিশুদ্ধি এবং উন্নতি

পরীক্ষার মাধ্যমে মু’মিনদের ঈমানের স্তর অনুযায়ী তাদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। প্রত্যেকেই তাদের ভালো আমল এবং আত্মত্যাগের মাত্রানুযায়ী আখিরাতে তাদের পুরষ্কার পাবে এবং দুনিয়াতেও একই হিসেব মতো অন্যান্য মু’মিনদের থেকে ওয়ালা লাভ করবে। প্রত্যেক মুসলিমেরই উচিত সর্বোচ্চ স্তরের  মুসলিম অর্থাৎ সাবেকুন হওয়ার জন্য চেষ্টা করা।

আর অগ্রবর্তীগণই তো অগ্রবর্তী, উহারাই নৈকট্যপ্রাপ্ত- নিআমতপূর্ণ উদ্যানে; বহু সংখ্যক হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে; এবং অল্প সংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্য হতে। (সূরা ওয়াকি‘য়াহ ৫৬:১০-১৪)

যেসব মুসলিম সৎকাজে এগিয়ে আছে তাদের উচিত ঐসব মুসলিম ভাইদের উপদেশ দেয়া যারা পিছিয়ে পড়ছে। কারণ, হিসবাহ ছাড়া অর্থাৎ একে অন্যকে সৎকাজ এবং সবরের জন্য উপদেশ দেয়া ছাড়া, মু’মিনরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

আল্লাহ পরীক্ষা সৃষ্টি করেছেন তাঁর সেরা বান্দাদের অবস্থান উন্নয়ন করতে, যাদের গুণাবলীর আল্লাহ বর্ণনা দিয়েছেন। আসুন আমরা এসব পরীক্ষার মুখোমুখি হই এবং নফসের ওয়াস ওয়াসা না শুনে ঠিক যেভাবে আল্লাহ চান সেই ভাবেই এর মোকাবেলা করি। আল্লাহ আমাদেরকে সাবেকুনদের মতো গুণাবলী অর্জন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাতে সন্তুষ্ট এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে। ইহা মহাসাফল্য।(সূরা তাওবা ৯:১০০)

সাবেকুন তারাই যারা তাদের ঈমানের বর্মে সজ্জিত হয়ে যে কোন পরীক্ষার মুখোমুখি হয় এবং যে কোন শত্রুর মোকাবেলা করে (আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে সাহায্য পেয়ে)। জান্নাতের পুরষ্কার সমূহের প্রতি তাদের ইয়াক্বীন আর তা অর্জনের আকাঙ্ক্ষার কারণে এই দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ ও আনন্দই তারা তুচ্ছ বলে মনে করে। ফলে সহজেই তারা তাদের জীবন এবং সম্পদ আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দিয়ে সফলতা লাভ করে, আর অন্যরা দেরি করতেই থাকে যতক্ষণ না তাদের জীবন ও সম্পদ আপনা থেকেই তাদের কাছ থেকে চলে যায় আর মৃত্যু তাদের গ্রাস করে নেয়। আল্লাহর শপথ ইবনে নুহাস (আল্লাহ তাকে শহীদ হিসেবে কবুল করুন), তার জিহাদ বিষয়ক বইতে সত্যি কথাই বলেছেন, ‘সাহস কখনো সাহসী ব্যক্তির জীবনকে ছোট করে দেয় না, আর বিরত থাকাটা কখনো যারা পিছিয়ে পড়ে তাদের জীবনকে দীর্ঘ করে না।’ সাবেকুনরা, শিরকী এবং কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদে, সর্বদা দৃঢ় থাকে। এমনকি প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলেও তারা ধৈর্য ধারণ করে। তারা সহজে হতাশ হয় না, কারণ তাদের আছে তাওয়াক্কুল ও ইয়াকীন। তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় পায় না। তাই তাদের দুর্বল অবস্থা আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ক আরো মজবুত করে দেয়। শত্রুর সংখ্যা তাদেরকে কোন রকম দুশ্চিন্তায় ফেলতে পারে না- কারণ, তারা তাদের রবের ক্ষমতার ব্যাপারে জানে, আর গায়েব তাদের কাছে কোন বক্তৃতার বিষয় নয়, বরং এর উপর তাদের আছে শক্ত ইয়াক্বীন। তাদের একমাত্র চিন্তা হলো নিজেদের দৃঢ় রাখা (তাওহীদে, তাওয়াক্কুলে, আনুগত্যে, সাহসে এবং ক্বিতালে) কুৎসারটনাকারীর কুৎসা তাদেরকে থামাতে পারেনা, মুনাফিকদের প্ররোচনা তাদেরকে তাগুতের ভয়ে ভীত করতে পারেনা। তারা ক্ষমতাধর যালিমদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে হক্ব ঘোষণা করে। কোন ধরনের অত্যাচার বা শাস্তির সাধ্য নেই তাদের অন্তরকে কাবু করার, তাদের সবরকে কমানোর বা তাদের শহীদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে নষ্ট করার। অত্যাচারের মুখে তারা শ্রেষ্ঠ পথটিই অবলম্বন করে, যা রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের শিখিয়েছেন, “আল্লাহর সাথে কখনো শরীক করো না, এমনকি যদি তোমাকে খন্ড খন্ড করা হয় বা পুড়িয়েও মারা হয়, তবুও না।” (ইবনে মাজাহ এবং বায়হাকীতে বর্ণিত, সহীহ আত-তারগীবে আল-আলবানী কর্তৃক সত্যায়িত) যালিমের প্রতি তাদের কথা হলো ফেরাউনের জাদুকররা ঈমান আনার পর যেমন কথা বলেছিল। এমনকি চরম হতাশাজনক (যাদের ইয়াক্বীন, তাওয়াক্কুল ও রবের ব্যাপারে জ্ঞানের অভাব তাদের বিবেচনায়) অবস্থাতেও এরা সেই কথাই বলবে যা এক আলেম একবার বলেছিলেন –

বন্ধুরা, আমি আমার মর্যাদা নিয়েই বেঁচে থাকবো,

আর চিরকাল মুনাফিকদের চূর্ণ করতে থাকবো।

মর্যাদার পথে আমি চলতেই থাকবো।

এমনকি শত্রুরা আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেললেও

আমি দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাবো শাহাদার দিকে।

কারণ মৃত্যুর সাথে আমার চলছে প্রতিযোগিতা।

তাই যারা আমাকে চেনো, তারা কখনো বল না-

কেন তুমি নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছো?

তাই যারা আমাকে চেনো, তারা কখনো বল না-

কেন তুমি নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছো?

কারণ আমি তো এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী মু’মিন

আর আমি তো অসম্মান আর অমর্যাদায় সন্তুষ্ট নই

আর আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য তো আল্লাহর সন্তুষ্টি

আর আমি এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সফল হবই,

তাই তারা যদি প্রতিদিনই আমার রক্ত ঝরায়

আর আমার ও ভাইদের মাঝে দেয়াল তুলে দেয়

আর আমার জীবনকে কষ্টপূর্ণ করে দেয়

আর বিশ্ব আমার জন্য চিরঅন্ধকার হয়ে যায়,

(এমনকি) তখনও, তারা পারবে না,

আমার অন্তরে পৌঁছাতে, বা আমার দৃঢ়তা থেকে সরাতে।

আমি তাদের অবজ্ঞা করতেই থাকবো

আমি তাদের অবজ্ঞা করতেই থাকবো, কারণ

আমার পাথেয় হলো আমার কিতাব (কোরআন)

এবং আল-মুস্তফার বাণী,

এগুলোই আমার অনুপ্রেরণা।

আমি এক দুর্ভেদ্য দুর্গই রয়ে যাবো

রয়ে যাবো মর্যাদার আকাশে উঁচু হয়ে,

এবং অচিরেই ফিরে আনবো হারানো সেদিনগুলো,

সালাহ্উদ্দিন আর অন্যান্য সিংহদের স্মৃতিতে।

অচিরেই আসবে সে দিন যখন যালিম

এবং মুনাফিক সর্দাররা ছটফট করবে কষ্টে।

মানুষ সুখ খোঁজে তাদের কামনা বাসনা, বিলাস বাসনে

অথচ বেশির ভাগকেই পুড়তে হবে অনন্ত আগুনে।

আর আমি সুখ খুঁজি মর্যাদাপূর্ণ পথে-

সবচেয়ে সুমধুর সুখ, জান্নাতে।

হে আল্লাহ, আপনি আমাদের এই কাতারের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করুন, আপনার কথা আমাদের আশা যোগায়-

এবং অল্প সংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্যে হতে। (সূরা ওয়াকি‘য়াহ ৫৬:১৪)

এই কাতারে অন্তর্ভুক্ত করার আগে আল্লাহ অবশ্যই আমাদের পরীক্ষা করবেনঃ

তোমরা হীনবল হইও না এবং দুঃখিতও হইও না; তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও। যদি তোমাদের আঘাত লাগে থাকে, অনুরূপ আঘাত তো উহাদেরও লেগেছিল। মানুষের মধ্যে এই দিনগুলির পর্যায়ক্রমে আমি আবর্তন ঘটাই, যাতে আল্লাহ মুমিনগণকে জানতে পারেন এবং তোমাদের মধ্যে হইতে কতককে শহীদ রূপে গ্রহণ করতে পারেন। এবং আল্লাহ যালিমদেরকে পছন্দ করেন না; তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যখন আল্লাহ তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করেছে আর কে ধৈর্যশীল তা এখনও প্রকাশ করেন নাই? মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়ার পূর্বে তোমরা তো উহা কামনা করতে, এখন তো তোমরা তা স্বচক্ষে দেখলে। মুহাম্মাদ একজন রাসূল মাত্র; তাহার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনও আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না; বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবেন। আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কারও মৃত্যু হতে পারে না, যেহেতু উহার মেয়াদ অবধারিত। কেহ পার্থিব পুরষ্কার চাইলে আমি তাকে তার কিছু দেই এবং শীঘ্রই কৃতজ্ঞদিগকে পুরস্কৃত করব। এবং কত নবী যুদ্ধ করেছে, তাদের সাথে বহু আল্লাহওয়ালা ছিল। আল্লাহর পথে তাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল তাতে তাহারা হীনবল হয় নাই, দুর্বল হয় নাই এবং নত হয় নাই। আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে ভালবাসেন। এই কথা ব্যতীত তাদের আর কোন কথা ছিল না, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পাপ এবং আমাদের কার্যে সীমালঙ্ঘন তুমি ক্ষমা কর, আমাদের পা সুদৃঢ় রাখ এবং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য কর। (সূরা আলি ’ইমরান ৩:১৩৯-১৪৭)

যেদিন দুই দল পরস্পরের সম্মুখীন হইয়াছিল, সেদিন তোমাদের উপর যে বিপর্যয় ঘটেছিল তা আল্লাহরই হুকুমে….। (সূরা আলি ’ইমরান ৩:১৬৬)

তোমরা কি মনে কর যে, তোমাদেরকে এমনি ছেড়ে দেওয়া হইবে যখন পর্যন্ত আল্লাহ না প্রকাশ করেন তোমাদের মধ্যে কারা মুজাহিদ এবং কারা আল্লাহ ও তাঁহার রাসূল ও মুমিনগণ ব্যতীত অন্য কাউকেও অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করে নাই? তোমরা যা কর, সে সম্বদ্ধে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত। (সূরা তাওবা ৯:১৬)

অতএব যখন তোমরা কাফিরদের সহিত যুদ্ধে মুকাবিলা কর তখন তাদের গর্দানে আঘাত কর, পরিশেষে যখন তোমরা উহাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করবে তখন উহাদেরকে কষিয়া বাঁধবে; অতঃপর হয় অনুকম্পা, নয় মুক্তিপণ। তোমরা জিহাদ চালাবে যতক্ষণ না যুদ্ধ ইহার অস্ত্র নামিয়ে ফেলে। ইহাই বিধান। ইহা এইজন্য যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে উহাদেরকে শাস্তি দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি চান তোমাদের একজনকে অপরের দ্বারা পরীক্ষা করতে। যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তিনি কখনও তাদের কর্ম বিনষ্ট হতে দেন না। (সূরা মুহাম্মদ ৪৭:৪)

 “আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব, যতক্ষণ না আমি জানে নেই তোমাদের মধ্যে জিহাদকারী ও ধৈর্যশীলদেরকে এবং আমি তোমাদের ব্যাপারে পরীক্ষা না করি। (সূরা মুহাম্মদ ৪৭:৩১)

সুতরাং যারা আখিরাতের বিনিময়ে পার্থিব জীবন বিক্রয় করে তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করুক এবং কেহ আল্লাহর পথে জিহাদ করলে সে নিহত হোক অথবা বিজয়ী হোক আমি তাকে মহা পুরষ্কার দান করবই। (সূরা নিসা ৪:৭৪)

নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের নিকট হতে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাত আছে ইহার বিনিময়ে। তারা আল্লাহ পথে যুদ্ধ করে ও নিহত হয়। তাওরাত, ইনজীল ও কুরআনে এই সম্পর্কে তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে। নিজ প্রতিজ্ঞা পালনে আল্লাহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর কে আছে? তোমরা যে সওদা করেছ সেই সওদার জন্য আনন্দিত হও এবং উহাই তো মহা সাফল্য। (সূরা তাওবা ৯:১১১)

হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্যে কেহ দ্বীন হতে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন যাদেরকে তিনি ভালবাসেন এবং যারা তাঁকে ভালবাসবে; তারা মুমিনদের প্রতি কোমল ও কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে; তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না; ইহা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। (সূরা মা‘য়িদা ৫:৫৪)

তারাই মুমিন যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, পরে সন্দেহ পোষণ করে না এবং জীবন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে, তারাই সত্যনিষ্ঠ। (সূরা হুজুরাত ৪৯:১৫)

যারা আল্লাহর পথে নিহত হইয়াছে তাদেরকে কখনই মৃত মনে করও না, বরং তারা জীবিত এবং তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে তারা জীবিকাপ্রাপ্ত। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দিয়েছেন তাতে তারা আনন্দিত এবং তাদের পিছনে যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয় নাই তাদের জন্য আনন্দ প্রকাশ করে, এইজন্য যে, তাদের কোন ভয় নাই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহের জন্য তারা আনন্দ প্রকাশ করে এবং ইহা এই কারণে যে, আল্লাহ মুমিনদের শ্রমফল নষ্ট করেন না। যখম হওয়ার পর যারা আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দিয়েছে তাদের মধ্যে যারা সৎকার্য করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে চলে তাদের জন্য মহা পুরষ্কার রয়েছে। এদেরকে লোকে বলেছিল, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জমায়েত হয়েছে, সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় কর; কিন্তু ইহা তাদের ঈমান দৃঢ়তর করেছিল এবং তারা বলেছিল, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক। তারপর তারা আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহসহ ফিরে এসেছিল, কোন অনিষ্ট তাদেরকে স্পর্শ করে নাই এবং আল্লাহ যাতে রাযী তারা তারই অনুসরণ করেছিল এবং আল্লাহ অনুগ্রহশীল।(সূরা আলি ’ইমরান ৩:১৬৯-১৭৪)

অতঃপর তালূত যখন সৈন্যবাহিনীসহ বাহির হল সে তখন বলল, আল্লাহ এক নদী দ্বারা তোমাদের পরীক্ষা করবেন। যে কেহ উহা হতে পান করবে সে আমার দলভুক্ত নহে; আর যে কেহ উহার স্বাদ গ্রহণ করবে না সে আমার দলভুক্ত; ইহা ছাড়া যে কেহ তার হস্তে এক কোষ পানি গ্রহণ করবে সেও। অতঃপর অল্প সংখ্যা ব্যতীত তারা উহা হতে পান করল। সে এবং তাহার সংগী ঈমানদারগণ যখন উহা অতিক্রম করল তখন তারা বলল,  জালূত ও তার সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত শক্তি আজ আমাদের নাই। কিন্তু যাদের প্রত্যয় ছিল আল্লাহর সহিত তাদের সাক্ষাত ঘটবে তারা বলল, আল্লাহর হুকুমে কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাভূত করেছে! আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। তারা যখন যুদ্ধার্থে জালূত ও তার  সৈন্যবাহিনীর সম্মুখীন হল তখন তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ধৈর্য দান কর, আমাদের পা অবিচলিত রাখ এবং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য দান কর। (সূরা বাকারা ২:২৪৯-২৫০)

যেমন আসহাবুল উখদুদের ব্যাপারে বলা হয়েছে “…….. রাজা তখন একটি গভীর গর্ত খুড়ে তার ভেতরে আগুন জ্বালাতে আদেশ দিলো এবং বললোঃ যে এই বালকের দ্বীন থেকে সরে না আসবে তাকেই এই আগুনে নিক্ষেপ করো বা তাকেই আগুনে লাফ দিতে আদেশ করো। তারা এমনটাই করতে থাকলো যতক্ষণ না এক মহিলা তার শিশুসন্তান সহ আসলো। সে আগুনে ঝাঁপ দিতে দ্বিধা করছিল। কিন্তু শিশুটি বলে উঠলোঃ মা, সহ্য করো (এই পরীক্ষা), কারণ তুমি সঠিক পথে আছো।” (সহীহ মুসলিম)

আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আমার প্রিয় মানুষটি ﷺ আমাকে উপদেশ দিলেন, “আল্লাহর সাথে কখনো শরীক করোনা, এমনকি যদি তোমাকে খন্ড খন্ড করা হয় বা পুড়িয়ে মারা হয়, তবুও না।” (ইবনে মাজা, বায়হাকী)

রাসূল ﷺ বলেছেন, “তিনটি (অবস্থা) – এগুলোতে যারা আছে তারা ঈমানের মিষ্টতা সঠিকভাবে বুঝতে পারবে….” আর বলেছিলেন, “….সে কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে এমনভাবে ঘৃণা করবে যেমন সে ঘৃণা করে জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করতে।” (বুখারী, মুসলিম)

রাসূল ﷺ বলেছেন, “…. তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিদের মাঝে, কাউকে ধরে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে তাকে পুঁতে রাখা হতো, তারপর করাত দিয়ে তার মাথা থেকে শরীর আলাদা করে ফেলা হতো; অথচ তার পরও সে তার ঈমান থেকে একচুলও সরতো না….।” (বুখারী)

পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য মু’মিনদের পাথেয়

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, জান্নাতে যেতে হলে বা পৃথিবীতে আল্লাহ কালিমাকে বিজয়ী করার জন্য শত্রুর মুখোমুখি হতে হলে – একজন মুমিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্বল হলো আল্লাহ ইবাদত এবং তাঁকে বেশি বেশি স্মরণ করা। এমনকি সাহায্যকারী হিসেবে যদি কেউ নাও থাকে, তাহলেও চিন্তার কিছু নেই যদি সে আল্লাহর হক্ক অনুযায়ী তাঁর ইবাদত করে এবং স্মরণ করে। আল্লাহ অনেক আয়াতেই আমাদের আদেশ করেছেন সবর এবং সালাতের মাধ্যমে তার কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য। আর পরবর্তী এই আয়াতে তিনি আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে, যারা খাশিউন (সালাতে বিনম্র এবং অন্যান্য সব ইবাদতে অত্যন্ত বিনয়ী ও অনুগত) নয়, তাদের পক্ষে এভাবে সাহায্য চাওয়া খুবই কঠিন।

তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর এবং ইহা বিনীতগণ ব্যতীত আর সকলের নিকট নিশ্চিতভাবে কঠিন। (সূরা বাকারা ২:৪৫)

আমরা যদি সর্বক্ষণ আল্লাহ কাছে সাহায্য চাইতে না থাকি, তাহলে আমরা কখনোই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো না। আমরা যদি আমাদের বিপদ সংকুল পথ চলার জন্য পাথেয় জোগাড় করতে না পারি, তাহলে আমরা কখনোই আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো না। “IN PURSUIT OF ALLAH’S PLEASURE” বইয়ের লেখক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, এগুলোকে এমনকি আমরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও বলতে পারি। লেখক বলেছেনঃ “প্রত্যেক মুসাফিরেরই তার যাত্রার জন্য কিছু পাথেয় প্রয়োজন হয়। পথ যত দীর্ঘ, যত কঠিন হবে আর যত বেশি আত্মত্যাগ দরকার হবে- ঠিক তত বেশি পাথেয় প্রয়োজন। আমাদের সবসময় আল্লাহর কাছ থেকে সাহায্য এবং নির্দেশনা দরকার, আল্লাহর আমাদের কাছ থেকে কিছু দরকার নেই। বরং সব বিষয়েই আমাদের তাঁকে প্রয়োজন।”

যখন যুবকরা গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল তখন তারা বলেছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি নিজ হতে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান কর এবং আমাদের জন্য আমাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা কর। (সূরা কাহাফ  ১৮:১০)

আমাদের প্রতি মুহূর্তেই আল্লাহর ইবাদত এবং তাঁর স্মরণে লিপ্ত থাকতে হবে, কারণ এছাড়া আমাদের পক্ষে শত্রুর মোকাবেলা করা বা দুনিয়ার কোন পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়া সম্ভব না। ইবাদত এবং জিকিরের মাধ্যমে, সবর এবং সালাতের সাথে সাহায্য চেয়ে, তাহাজ্জুদ এবং কান্নার সাথে আমাদের আল্লাহর কাছে চাইতে হবে, (যিনি সামিউদ দু’আ) যেন তিনি দুনিয়ার সব কষ্ট আমাদের জন্য সহজ করে দেন এবং আমাদের দ্বীনের উপর দৃঢ় রাখেন।

মুমিন তো তারাই যাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তার আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন উহা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপরই নির্ভর করে। (সূরা আনফাল ৮:২)

হে আমাদের প্রতিপালক! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্য লংঘনপ্রবণ করও না এবং তোমার নিকট হতে আমাদেরকে করুণা দাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ ওয়াদা খেলাফ করেন না। (সূরা আলি ’ইমরান ৩:৮)

যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুইয়ে আল্লাহর স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বদ্ধে চিন্তা করে ও বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি ইহা নিরর্থক সৃষ্টি কর নাই, তুমি পবিত্র, তুমি আমাদেরকে অগ্নিশাস্তি হতে রক্ষা কর। (সূরা আলি ’ইমরান ৩:১৯১)

হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; প্রত্যেকেই ভাবিয়া দেখুক আগামী কলের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠাইছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত। আর তোমরা তাদের মত হইও না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করেছেন। উহারাই তো পাপাচারী। (সূরা হাশর ৫৯:১৮-১৯)

যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়; জানিয়া রাখ, আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়। (সূরা রা’দ ১৩:২৮)

এবং কারারুদ্ধ এই শাইখ (আল্লাহ তাকে রক্ষা করুন, পুরস্কৃত করুন এবং শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করুন) আরো বলেছেন, “আল্লাহকে তাঁর হক্ব অনুযায়ী ইবাদত করা ছাড়া বান্দার পক্ষে কখনোই শিরক এবং মুশরিকদের মুখামুখি হওয়া, তাদের প্রতি বারা প্রদর্শন এবং তাদের মিথ্যাচারের প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন সম্ভব না, সর্বশক্তিমান, মহামহিম আল্লাহ তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ ﷺ-কে মক্কায় অবস্থানকালে কুরআন তেলাওয়াত এবং তাহাজ্জুদের আদেশ দিয়েছিলেন। এবং তিনি শিখিয়েছিলেন যে দাওয়াহ বহন করার জন্য এটা তার প্রতিরক্ষা এবং সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করবে। এবং এই আদেশ (তাহাজ্জুদের) এসেছিল যে আয়াতে তা হলোঃ

হে বস্ত্রাবৃত! রাত্রি জাগরণ কর, কিছু অংশ ব্যতীত, অর্ধ রাত্রি কিংবা তদপেক্ষা অল্প অথবা তদপেক্ষা বেশী। আর কুরআন পাঠ কর ধীরে ধীরে ও সুস্পষ্টভাবে; আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুভার বাণী। (সূরা মুযযাম্মিল ৭৩:১-৫)

সুতরাং তিনি ﷺ এবং তাঁর সাহাবারা (সালাতে) দাঁড়ানো শুরু করলেন – তারা এত সময় ধরে সালাতে দাঁড়াতেন যে তাদের পা ফেটে যেত। তারা এই অভ্যাস অব্যাহত রাখেন যতদিন না আল্লাহ এ ব্যাপারে কিছু ছাড় দেন। আর এই দাঁড়ানো, তিলাওয়াত এবং সেইসাথে আল্লাহর বাণীর কথা স্মরণ করা-এগুলোই হলো একজন দা’য়ীর জন্য শ্রেষ্ঠ সুরক্ষা এবং সহায়তা, যা তাকে দাওয়ার সমস্ত সমস্যায় সাহায্য করে এবং প্রতিরোধ থেকে সুরক্ষা দেয়। আর কেউ যদি মনে করে যে, সে বিশুদ্ধ ইবাদত না করেই, বা দীর্ঘ সময় ধরে আল্লাহর স্মরণ ও তাসবীহ্ না করেই এই দাওয়াহ বহন করতে পারবে- তাহলে সে নিশ্চিতভাবেই ভুল করছে। এমনকি তারা যদি কোন উন্নতি করতেও পারে, তাহলেও কোন অবলম্বন ছাড়া তাদের পক্ষে এই সঠিক, সরল পথে থাকা সম্ভব হবে না। আর নিশ্চয়ই সবচেয়ে বড় অবলম্বন হলো তাক্বওয়া। সর্বশক্তিমান আল্লাহ এখানে দাওয়াহর বাহকদের কথা বর্ণনা করেছেন- যারা তাদের রবের সন্তুষ্টির জন্য তাকে সকালে ও সন্ধ্যায়, যারা রাতে সামান্যই ঘুমায়, যাদের পিঠ বিছানা স্পর্শ করে না, রবের ভয়ে এবং তাঁর দয়ার আশা নিয়ে যারা দুআ করে, যারা রবের পক্ষ থেকে এক ভয়াল দিনের ভয় করে, যাদের প্রতি আল্লাহ তাঁর রাসূল ﷺ-কে ধৈর্যধারণ করতে বলেছেন। আর যাদের এই গুণাবলী নেই, তাদের এই দাওয়াহ বহন করারও যোগ্যতা নেই। আল্লাহ আমাদের এদের অন্তর্ভুক্ত করে দিন, আমিন।

আর ‘In Pursuit of Allah’s Pleasure’ – বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ে লেখকরা উল্লেখ করেছেন, আমাদের পাথেয় হলোঃ (১)  তাক্বওয়া (আল্লাহর ভয়) (২) ইলম (জ্ঞান) (৩) ইয়াক্বীন (নিশ্চিত বিশ্বাস) (৪) তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা) (৫) শোকর (কৃতজ্ঞতা) (৬) সবর (ধৈর্য) এবং (৭) যুহুদ (দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা না রাখা)। আমি প্রত্যেক ভাই ও বোনকে অনুরোধ করছি এই অধ্যায়টি খুব ভাল ভাবে পড়তে এবং আল্লাহ কাছে দু’আ করতে যেন তিনি এই জ্ঞান আমাদের অন্তরে গেঁথে দেন যাতে আমরা এটা কখনো ভুলে না যাই এবং তিনি যেন আমাদের জীবনে এই পাথেয়গুলো দিয়ে দেন যাতে আমরা সব পরীক্ষা পার হয়ে শুদ্ধ হতে পারি এবং আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি।

শ্রেষ্ঠ কাতারের মুসলিমদের এসব পাথেয় থাকে। আল্লাহ আমাদেরকে তাদের অন্তর্গত করুন এবং আমাদের আখিরাতকে নবী, সিদ্দিক, শহীদ এবং সালেহদের সাথে করুন।

আর কেউ আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করলে সে নবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ – যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন – তাদের সংগী হবে এবং তারা কত উত্তম সংগী! (সূরা নিসা ৪:৬৯)

ও আমার নাফস! এটা কিভাবে সম্ভব যে, তুমি তাদের সাথে থাকতে আগ্রহী, অথচ তারপরও কেন তুমি সেই সব কঠিন অবস্থা থেকে পালাতে চাচ্ছো যেসব অবস্থায় তাঁরা সম্পূর্ণ তাওয়াক্কুল এবং ঈমানের পরিচয় দিয়েছেন? এটা কিভাবে সম্ভব যে তুমি উনাদের সাথে থাকতে চাও, অথচ উনারা পার্থিব যেসব বস্তু ছুড়ে ফেলেছেন এবং পরিত্যাগ করেছেন সেগুলোই তুমি আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছো?

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “আমার উম্মাতের মধ্যে একটি অংশ (ত্বাইফা) কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর হুকুমের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। অপমানকারীর অপমান এবং বিরোধিতাকারীর বিরোধিতা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তারা মানুষের মাঝে বিজয়ী থাকবে।” (মুয়াবিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মুসলিম ১৩০)

রাসূল ﷺ বলেছেন, “আমার উম্মত থেকে একটি দল হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে প্রকাশ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে কিয়ামত পর্যন্ত।” (জাবীর বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, মুসলিম)

হে আল্লাহ, আমাদের এই কাতারে শামিল করে দিন যেমনটি আপনি আমাদেরকে আশা দিয়েছেন-

এবং অল্প সংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্যে হতে। (সূরা ওয়াকি‘য়াহ ৫৬:১৪)

পরীক্ষার সময় নিচের কাতারের মুসলিমদের অবস্থাঃ

এই কাতারের মুসলিম হলো তারা, যারা নিজেদের ফিতনা থেকে দূরে এবং শিরক থেকে বাঁচাতে একাকী নির্জনে বসবাস শুরু করে। জীবনের ন্যুনতম চাহিদা পূরণের জন্য যা দরকার, শুধু তাই নিয়ে সে পাপের এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও (যেমন, পাহাড়ে) গিয়ে একাকী আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকে। অথবা সে শুধু নিজের পরিবারকে আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করে; সে তাওহীদের উপর থাকে এবং তার মনে শিরক ও মুশরিকদের প্রতি ঘৃণাও থাকে – কিন্তু সাবেকুনদের তুলনায় তার ঈমানের দুর্বলতার কারণে সে এটা প্রকাশ্যভাবে প্রচার করতে পারেনা। সে পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে এবং সুযোগ পেলেই বেশি খারাপ স্থান থেকে হিজরত করে কম খারাপ স্থানে চলে যায় (যেমন, সাহাবাদের আবিসিনিয়ায় হিজরত)। এই শ্রেণীর মু’মিনরা মানুষের মাঝে নিজেদের দ্বীনকে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে না। তাই এরা ঐসব মু’মিনদের কাতারে থাকতে পারেনা যারা সব ধরনের মুনকার প্রতিরোধ করছে তাদের জিহ্বা দিয়ে, তাদের হাত দিয়ে, দাওয়াহ এবং জিহাদের মধ্যে দিয়ে। সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মু’মিন হলো তারা যারা মিল্লাতে ইবরাহীম অনুসরণ করে তাদের দাওয়াহ এবং দ্বীনকে উম্মুক্তভাবে প্রকাশ করে দেয় এবং শত্রুদের প্রতি তাদের বারা’আ, শত্রুতা এবং ঘৃণাও সুস্পষ্ট করে দেয়। সবচেয়ে উঁচু স্তরের ঈমান হলো মুনকারকে হাত দিয়ে পরিবর্তন করা, তার পরের স্তর হলো কথা দিয়ে তা পরিবর্তন করা এবং সবচেয়ে নিচু স্তর হলো মন থেকে ঘৃণা করা।

তবে এটা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য যে, এই মু’মিনরা নিজেদের ঈমানকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। যেহেতু অত্যাচার সহ্য করার বা কুফরী শক্তির বিরোধিতা করার সাধ্য তাদের নেই, সেহেতু তাওহীদ হারাবার ভয়ে তারা সেই সমাজ ত্যাগ করে। যদিও এই মু’মিনরা তাদের সমান নয় যারা কুফর এবং ফিতনার বিরুদ্ধে জিহাদ করছে তবুও অন্ততপক্ষে এরা ঐসব মানুষের চেয়ে ভালো যারা কাফিরদের মাঝেই বসবাস করছে, নিজের দ্বীনকে বিকৃত করে এবং অত্যাচারের ভয়ে কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব করে।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেনঃ “একটা সময় আসবে যখন একজন মুসলিমের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হবে তার ভেড়ার পাল, যা নিয়ে সে পাহাড়ের চূড়ায় চলে যাবে বা যেখানে বৃষ্টিপাত হয় সেখানে চলে যাবে, যাতে সে তার দ্বীনকে ফিতনা থেকে বাঁচাতে পারে।” (বুখারী)

আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “এমন এক ফিতনার সময় আসবে যখন একজন বসে থাকা মানুষের অবস্থা হবে দাঁড়ানো মানুষের চেয়ে ভালো, দাঁড়ানো মানুষের অবস্থা হবে হাটতে থাকা মানুষের চেয়ে ভালো, হাটতে থাকা মানুষের অবস্থা হবে ছুটন্ত মানুষের চেয়ে ভালো –  আর যে কেউ এই ফিতনায় নিজেকে উন্মুক্ত করে দিবে, সেই ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই কেউ যদি এর থেকে বাঁচার মতো কোন জায়গা পায়, তাহলে সে যেন সেখানে আশ্রয় নেয়।” (বুখারী)

যে বাইরে বাইরে কুফর দেখালেও অন্তর থেকে সেটাকে ঘৃণা করে

এ রকম মানুষের অবস্থা দুইরকম হতে পারেঃ

(১) যাকে বাধ্য (ইকরাহ) করা হয়েছে

এটা হচ্ছে সেই ব্যক্তির অবস্থা, যাকে কাফিররা প্রচন্ডভাবে অত্যাচার করেছে এবং কুফরী কাজ না করলে বা কুফরী কথা না বললে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। এই অবস্থায় কেউ যদি বাইরে কুফর করে, তবে তার মনে দৃঢ় ঈমান থাকে – তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে না। যেমনঃ

কেহ তার উপর ঈমান আনার পর আল্লাহকে অস্বীকার করলে এবং কুফরীর জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখলে তার উপর আপতিত হবে আল্লাহর গযব এবং তার জন্য আছে মহাশাস্তি; তবে তার জন্য নয়, যাকে কুফরীর জন্য বাধ্য করা হয় কিন্তু তার চিত্ত ঈমানে অবিচলিত। (সূরা নাহল ১৬:১০৬)

তবে আলেমরা এমন ঘটনায় কুফরী না হওয়ার জন্য কিছু শর্ত দিয়েছেন। যদি এই শর্তগুলো অনুপস্থিত থাকে, তাহলে কেউ কুফরী কথা বা কাজ করলে সেই ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যাবে, এমনকি সে যদি নিজেকে নিরুপায় (’ইকরাহ’র কারণে) মনে করে এবং উপরের আয়াতের কারণে ছাড় পাওয়ার আশা করে তাহলেও।

শর্তগুলো হলোঃ

# তাকে অবশ্যই তার সমস্ত সামর্থ্য এবং সম্পদ দিয়ে এই অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে নিজের ঈমান বাঁচাতে চেষ্টা করতে হবে। তার যদি পালানোর উপায় থাকে, তাহলে অত্যাচারের এলাকায় সে থাকতে পারবে না। আসহাবে কাহাফের ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়-

যখন যুবকরা গুহায় আশ্রয় নিল তখন তারা বলেছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি নিজ হতে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান কর এবং আমাদের জন্য আমাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা কর। (সূরা ইউনুস ১০:১৮)

তোমরা যখন বিচ্ছিন্ন হলে ওদের হতে ও উহারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করে তাদের হতে তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য তাহার দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসূ করবার ব্যবস্থা করবেন। (সূরা কাহাফ ১৮:১৬)

এবং এইভাবেই আমি উহাদেরকে জাগরিত করলাম যাতে উহারা পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করে। উহাদের একজন বলল, তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ? কেহ কেহ বলিল, আমরা অবস্থান করেছি এক দিন অথবা একদিনের কিছু অংশ। কেহ কেহ বলিল, তোমরা কত কাল অবস্থান করেছ তা তোমাদের প্রতিপালকই ভালো জানেন। উহারা যদি তোমাদের বিষয় জানতে পারে তবে তোমাদেরকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করবে অথবা তোমাদেরকে উহাদের ধর্মে ফিরাইয়া নিবে এবং সেক্ষেত্রে তোমরা কখনও সাফল্য লাভ করবে না।  (সূরা কাহাফ  ১৮:২০)

আমরা যদি পালানোর সুযোগ পেয়েও পালানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা না করি, তাহলে এরপরে যদি কাফিররা আমাকে দিয়ে জোর করে কুফরী করায় – তাহলেও আমি কাফির হয়ে যাব।

# যে কাফির হত্যা বা অত্যাচারের হুমকি দিচ্ছে, তার পক্ষে এগুলো সত্যি সত্যিই করা সম্ভব এবং মুসলিম ব্যক্তিটির পক্ষে এটা থামানো সম্ভব না বা পালানোও সম্ভব না।

# মুসলিম ব্যক্তিটি নিশ্চিত যে, সে যদি কাফিরের কথামতো কুফরী কাজটি না করে তাহলে সে (ঐ কাফির) সত্যি সত্যিই তার হুমকি মতো মুসলিমটিকে হত্যা করবে।

# কাফির যে হুমকি দিচ্ছে সেটা তাৎক্ষনিক হতে হবে। যেমন, কাফির যদি বলে, “তুমি অমুক কাজ না করলে আমি আগামীকালই তোমাকে মারবো।” – তাহলে তার কথা শুনে কুফরী করলে আর ইকরাহর অজুহাত দেয়া যাবে না। অর্থাৎ ভবিষ্যতের কোন হুমকির মাঝে থাকাটা ইকরাহ হিসেবে গ্রহণযোগ্য অবস্থা না।

# অত্যাচার বা মৃত্যু থেকে বাঁচতে ন্যুনতম যেটুকু বলতে হয় বা করতে হয়, শুধুমাত্র ততটুকুই বলা বা করা যাবে। কেউ যদি তাকে যতটুকু কুফরী করার জন্য জোর করা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি কুফর করে তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে।

(২) যাকে বাধ্য করা হয়নি

এ সেই লোক যে ইসলামকে ঘৃণা করে না বা অবিশ্বাস করে না বরং মনে মনে কুফরকেই ঘৃণা করে – কিন্তু ক্ষমতার লোভে, সম্পদের লোভে, দেশ বা পরিবারের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসার কারণে বা সম্পদ হারানোর ভয়ে বাইরে বাইরে কুফরী আচরণ করে, এরকম অবস্থা হলে সে মুরতাদ হয়ে যাবে। মনে মনে কুফরীকে ঘৃণা করায় কোন লাভই হবে না। আর এদের ব্যাপারেই আল্লাহ বলেছেনঃ

ইহা এইজন্য যে, তারা দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের উপর প্রাধান্য দেয় এবং আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না। (সূরা নাহল ১৬:১০৭)

মিল্লাতে ইব্রাহীমকে ধ্বংস করতে এবং দা’য়ীদের এই মিল্লাত থেকে সরিয়ে নিতে তাগুতদের নেয়া কিছু পদক্ষেপের বর্ণনা:

যদি মিল্লাতে ইব্রাহীমের ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট জ্ঞান হয়ে থাকে এবং আমরা যদি বুঝে ফেলি যে এটাই ছিল নবীদের এবং তাদের অনুসারীদের পথ এবং এই পথেই দুনিয়া এবং আখিরাতের সাফল্য ও সুখ পাওয়া সম্ভব – তাহলে আমাদের এটাও নিশ্চিতভাবে জেনে রাখা উচিত যে, তাগুতের বাহিনী কখনোই আমাদের কাজে খুশি হবে না বরং তারা নিশ্চিতভাবে এই শ্রেষ্ঠ মিল্লাতকে ভয় পায় এবং বিভিন্ন উপায়ে একে ধ্বংস করার এবং এর অনুসারী ও দা’য়ীদের এই মিল্লাত থেকে বের করে আনার চেষ্টা করতে থাকে। এ ব্যাপারে মক্কী সময়ে নাযিলকৃত সূরা আল-কালামের একটি আয়াতে আল্লাহ তা’আলা আমাদের বলেছেনঃ

তারা চায় যে, তুমি নমনীয় হও, তাহলে তারাও কিছুটা নমনীয় হবে। (সূরা কালাম ৬৮:৯)

অর্থাৎ তারা চায় যে, দা’য়ীরা মিল্লাতে ইব্রাহীম থেকে সরে গিয়ে অন্য এমন পথে চলে যাক, যে পথে গেলে তাদের দাওয়াহ আর নবীদের দাওয়াহর মতো মজবুত এবং সঠিক হতে পারবে না। তাগুত ততক্ষণ পর্যন্ত এই যড়যন্ত্র চালাতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত দা’য়ীরা তাদের দাওয়াহকে পরিবর্তন করে ফেলে, তাগুতের দোষ গোপন করতে শুরু করে এবং তাগুতকে খুশি করতে চেষ্টা করে যখন দা’য়ীরা এমন করবে, তখন তাগুতও তাদের জন্য ছাড় দিবে। এভাবেই দাওয়াহ ধ্বংস হয়ে যাবে, এর বক্তব্য হারিয়ে যাবে এবং দা’য়ীরা সরল সঠিক পথ থেকে সরে যাবে। তাগুত জানে দা’য়ীরা যদি একবার তাদের দাওয়াহ থেকে এক ধাপ সরে যায়, তাহলে তারা সরতেই থাকবে এবং একসময় দাওয়াহর মূল ভিত্তি থেকেই তারা দূরে চলে যাবে। আর দূরে সরে যাবার কারণেই তারা একসময় কাফিরদের কুফরী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আর যখন দা’য়ীরা এতটা নিচে চলে যায়, তখন তাগুত তাদের খুশি প্রকাশ করে এবং এইসব বিভ্রান্ত দা’য়ীদের সাহায্য করে ও পৃষ্ঠপোষকতা করে। তাগুত এদেরকে প্রশংসা করতে শুরু করে এবং এদের প্রতি সহানুভূতি ও ভালবাসা দেখাতে থাকে। আল্লাহ বলেনঃ

আমি তোমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করেছি তা হতে তারা পদস্খলন ঘটাবার চেষ্টা প্রায় চূড়ান্ত করেছিল যাতে তুমি আমার সম্বন্ধে তার বিপরীত মিথ্যা উদ্ভাবন কর; তবেই তারা অবশ্যই তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত। (সূরা বনী ইসরাইলঃ ৭৩)

মুশরিকরা যখন রাসূল্লাহ ﷺ-কে তার দাওয়াহ এবং দ্বীনের ব্যাপারে কিছু ছাড় দিতে প্রস্তুত করেছিল এবং অনুরোধ করেছিল যে তিনি যেন মুশরিকদের দেব-দেবীদের বিরুদ্ধে কথা না বলে অন্য কিছুর বিরুদ্ধে কথা বলেন- এই ঘটনার উল্লেখ করে সায়্যিদ কুতুব (রহঃ) উপরের আয়াতের আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “এই যে প্রচেষ্টা থেকে আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূল ﷺ-কে রক্ষা করেছেন, তা সর্বকালেই ক্ষমতাসীন মানুষেরা দা’য়ীদের উপর প্রয়োগ করতে চায়। এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য হলো দা’য়ীদেরকে সঠিক পথ থেকে এক চুল পরিমাণ হলেও সরিয়ে দেয়া। যাতে তারা অনেক সওয়াবের পথ থেকে সরে এসে এই সাদামাটা জীবনের ছলনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেক দা’য়ীই এভাবে সঠিক পথ থেকে সরে গেছে, কারণ তারা এটাকে এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে করেনি। ক্ষমতাসীনরা দা’য়ীদেরকে দাওয়াহ পুরোপুরি বন্ধ করতে বলে না, বরং তাদেরকে তাদের দাওয়ার মাঝে অল্প কিছু পরিবর্তন আনতে বলে – যাতে দুই পক্ষই কিছু ছাড় দিয়ে অবশেষে একমত হতে পারে। শয়তান অনেক সময় এমনভাবে দা’য়ীদের বিভ্রান্ত করে ফেলে যে, তারা ভাবতে শুরু করে, যেকোনো উপায় এমনকি কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও ক্ষমতাসীনদের হাত করতে পারাটাই হলো সবচেয়ে ভালো দাওয়াহ। অথচ দাওয়াহর শুরুতেই যদি সামান্য পথভ্রষ্টতা আসে, তাহলে শেষ পর্যন্ত এটা সঠিক পথ থেকে অনেক অনেক দূরে সরে যাবে। যে দা’য়ী একবার ছাড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে, তা সেটা যত সামান্য বিষয়েই হোক না কেন – সে কিছুতেই থামতে পারে না, তার ছাড় দেয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকে। ক্ষমতাধররা দা’য়ীদেরকে এভাবেই আস্তে আস্তে ছাড় দেয়ার দিকে নিতে থাকে, যতক্ষণ না তারা তাদের মর্যাদাবোধ এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যেসব দা’য়ী এই ফাঁদে পড়ে তারা বুঝতে পারে যে, বেশি বেশি ছাড় দেয়া এবং ক্ষমতাধরদের নিজেদের সাথে বরণ করে নেয়াটা আসলে দাওয়াহকে বিজয়ী করতে পারে না, বরং এটা পরাজিতই হয় – কারণ এক্ষেত্রে দাওয়াহর সাফল্য চলে যায় ক্ষমতাশীলদের হাতে, অথচ মু’মিনরা কেবলমাত্র আল্লাহর কাছ থেকেই সাফল্য কামনা করে। সত্যিই, এখন অনেক দা’য়ীকে দেখা যায় যাদেরকে তাগুত বন্ধু হিসেবে নিয়ে নিয়েছে এবং তাগুত এদের কোন ক্ষতি করে না, এদের বাধা দেয় না এবং এদের প্রতি শত্রুতাও দেখায় না- কারণ এই দা’য়ীরাও তাগুতকে তাদের কিছু কিছু সীমালঙ্ঘনে বাধা দেয় না, বরং তাগুতকে সমর্থন করে। এরা তাগুতের সাথে সমঝোতা করে, একসাথে সভা-সেমিনার করে, উৎসব করে ইত্যাদি। তাগুত যেসব উপায়ে দা’য়ীদের ধ্বংস করে দেয় তার কিছু নমুনা হলঃ-

  • তাগুত কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে, যেমন – পার্লামেন্ট, জাতিসংঘ, ইত্যাদি যেখানে তারা একত্রিত হতে পারে। তারা দা’য়ীদের আহ্বান করে তাদের সাথে এসব জায়গায় বসে আলোচনার মাধ্যমে সব বিষয়ের ফয়সালা করতে। এর ফলে, তাগুতের প্রতি, তাদের কুফরের প্রতি এবং তাদের বানানো আইনের প্রতি বারা’ প্রদর্শন করা হয়না- বরং তাদের সহযোগিতাই করা হয়। এই আলোচনার উদ্দেশ্য হয়ে দাড়ায় দেশের উন্নয়ন, অর্থনীতি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাগুতকে সাহায্য করা ও উপদেশ দেয়া – অথচ দেশ থেকে যাচ্ছে তাগুতের অধীনে এবং তাদের মনগড়া ও ভ্রান্ত আইনের মাধ্যমে শাসিত হয়ে। এমন অনেককেই এখন দেখা যায় যারা নিজেদেরকে সালাফদের পথের অনুসারী বলে দাবী করে এবং সাইয়্যেদ কুতুবের কথা থেকে উদ্ধৃতি পেশ করে- অথচ তারাই তাগুতের এই ফাঁদে পড়ে এক সময় তাগুতের প্রশংসা করতে শুরু করে, তাদের উপস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখায় এবং সম্মানজনক উপাধি দিয়ে তাগুতদের সম্বোধন করে। এমনকি তারা জনগণকে তাদের সরকারের প্রতি আনুগত্য করার ডাক দেয়, তাগুতের সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সাহায্য করতে বলে, তাগুতের সংবিধান ও আইন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেয়। তাহলে দাওয়াহর আর কি বাকী থাকলো? আমরা আল্লাহর কাছে এই গোমরাহী থেকে আশ্রয় চাই।
  • তাগুতের আরেকটি কাজ হলো আলেমদের এমন কোন কাজে নিয়োজিত করা এবং ব্যস্ত রাখা যা তাগুতের জন্য লাভজনক। যেমন – বিরোধীদল বা অন্য কোন রাজনৈতিক শক্তি যা তাগুতের বিরুদ্ধে হুমকি স্বরূপ, তাদের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য আলেমদের উস্কানি দেয়া, যেমন – সমাজতন্ত্রী, শিয়া বা কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে। এভাবেই ভ্রান্ত আক্বীদার (শিয়া, সমাজতন্ত্রী ইত্যাদি) প্রতি আলেমদের ঘৃণাকে কাজে লাগিয়ে তাগুত নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে। তাই তাগুত আলেমদের সাহায্য করতে থাকে অন্যান্য শত্রুর বিরুদ্ধে, যারা আসলে তাগুতেরও শত্রু। তাগুত বাইরে বাইরে ইসলামের জন্য ভালবাসা দেখায় এবং আলেমদের কাজের জন্য উৎসাহ ও পুরষ্কার দেয়, বড় বড় উপাধি দেয় – অথচ আসলে সে নিজেরই উপকার করছে। যারা এই ফাঁদে পড়ে নিজেদের জীবন ও সময় বিলিয়ে দিচ্ছে তারা বুঝাতেও পারছে না যে, তারা আসলে ইসলামের এক শত্রুর বিরুদ্ধে ইসলামের আরেক শত্রুকে সাহায্য করছে। এভাবে ক্রমে ক্রমে অনেক আলেম তাদের নিকট-শত্রু তাগুতের প্রতি শত্রুতা করা বন্ধ করে দিয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের বন্ধু, সহায়ক এবং উপদেষ্টা হয়ে গেছে। তাগুতের সেবা এবং তাগুতের ক্ষমতা ও শাসনকে সুরক্ষিত রাখাই এখন এসব আলেমের একমাত্র কাজ- কেউ বুঝে করছে আবার কেউবা করছে না বুঝে। আমরা আশা করছি মহামহিমান্বিত আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে এই আয়াতটি বোঝার তওফিক দিবেন – হে আমার প্রতিপালক! তুমি যেহেতু আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছ, আমি কখনও অপরাধীদের সাহায্যকারী হব না। (সূরা কাসাসঃ ১৭)

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় কুরতুবী বলেছেন, “যে বনী ইসরাইলের লোকটি মুসা (আঃ)-এর কাছে সাহায্য চেয়েছিল, সে কাফির ছিল এবং সে তার দলে যোগ দিয়েছিল কেবলমাত্র ইসরাইলী বংশের কারণে দ্বীনের প্রতি আনুগত্যের কারণে নয়। এ জন্যই মুসা (আঃ) আক্ষেপ করেছেন যে, তিনি এক কাফিরের বিরুদ্ধে আরেক কাফিরকে সাহায্য করেছেন। তাই তিনি বলেছেন, “আমি এর পরে আর কখনো কোন কাফিরের সাহায্যকারী হব না।” এবং এখানে ‘যাহির’-এর অর্থ হলো ‘সাহায্যকারী’।

আমরা আরও আশা করি তারা আল্লাহ তা’আলার এই কথা বুঝতে পারবেঃ

হে মুমিনগণ! কাফিরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সাথে যুদ্ধ কর এবং তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়। জেনে রেখ, আল্লাহ তো মুত্তাকীদের সাথে আছেন। (সূরা তাওবাহ ৯:১২৩)

এই আয়াতটি বুঝলে তারা বুঝতে পারতো যে, যদিও সমাজতন্ত্রী বা শিয়ারা যে ইসলামের শত্রু এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই এবং তাদের প্রতি শত্রুতা এবং বারা’আ প্রদর্শন করাটাও নিশ্চয়ই আমাদের কর্তব্য – কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, মুসলিমরা শুরু করে কাছের শত্রুকে দিয়ে, তারপর তার থেকে দূরের, এভাবে শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সীরাত থেকেও এটাই পাওয়া যায়। এমনকি সাধারণ বিচার-বুদ্ধি থেকেও বলা যায় যে, কাছের শত্রু বেশী ভয়ংকর কারণ সে সরাসরি সম্পর্কিত এবং তার করা ক্ষয়ক্ষতি আমাদের উপর বেশী প্রভাব ফেলবে। এই একই কারণে সাধারণত নিজের নাফস এবং শয়তানের সাথে আগে লড়াই করতে হয়, শত্রুর সাথে জিহাদ পরে।

[ইসলামী ফিকহের বইতে এই বিষয়টি আলোচিত হয়েছে ‘কাছের শত্রু’ এবং ‘দূরের শত্রু’ অধ্যায়। যেমন – ইবনে ক্বুদামাহ বলেছেন, “বিষয়ঃ ‘প্রত্যেকের উচিত সবচেয়ে কাছের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা’ আর এর পেছনে মূলনীতি হল আল্লাহর বাণী – হে মুমিনগণ! কাফিরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সাথে যুদ্ধ কর… (সূরা তাওবাহ ৯:১২৩)] এবং যেহেতু কাছের শত্রু বেশী ক্ষতিকর, আর তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে যারা সরাসরি এদের সামনে আছে তারা রক্ষা পেতে পারে। আর দূরের শত্রুকে নিয়েই ব্যস্ত থাকলে এই কাছের শত্রুরা অপ্রস্তুত মুসলিমদের ক্ষতি করার সুযোগ পেয়ে যাবে।” তিনি আরো বলেছেন, “তবে তারপরও যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে দূরের শত্রুকে আগে আক্রমণ করা দরকার – যেমন, সে যদি বেশী ভয়ংকর হয় বা কাছের শত্রু আনুগত্য স্বীকার করে নেয় বা কাছের শত্রুর সাথে যুদ্ধে কোন বাধা থাকে, তাহলে দূরের শত্রুকে আক্রমণ করতে কোন সমস্যা নেই কারণ এটা হলো ‘নিদ’-এর অবস্থা।” (আল-মুগনী ওয়া আশ শারহ আল-কাবীর, ১০ম খন্ড, পৃঃ ৩৭২-৩৭৩)

উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেছেন, “ইসলামী রাষ্ট্রের সবচেয়ে কাছের শত্রুর বিরুদ্ধে আল্লাহ্ মু’মিনদের সবচেয়ে আগে যুদ্ধ করতে বলেছেন, এবং সবচেয়ে দূরের শত্রুর বিরুদ্ধে সবচেয়ে পরে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রথমে জাজিরাতুল আরবের মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করেন। এদের সাথে যুদ্ধ হলে এবং আল্লাহ তাকে মক্কা, মদীনা, তায়িফ, ইয়েমেন, ইয়ামামাহ, হিজর, খায়বার, হাদরামাউত এবং অন্যান্য আরব এলাকার উপর আধিপত্য দান করলে এবং আরব গোত্রগুলো দলে দলে ইসলামে প্রবেশের পরে তিনি রোমানদের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন যারা ছিলো আরবের সবচেয়ে কাছে, এবং এই কারণেই তাদেরই ইসলামের ডাক পাওয়ার বেশি অধিকার ছিল, তাছাড়া তারা ছিল আহলে কিতাব।” (তাফসীর ইবনে কাসীর ২য় খন্ড)

  • তাগুত অনেক সময় কিছু নির্বোধ আলেমকে ব্যবহার করে অন্যান্য দা’য়ীদের বাধা দেয়ার জন্য। যাদের দাওয়াহ, মাযহাব বা কর্মপদ্ধতি (মিনহাজ) এইসব আলেমদের মতের সাথে মিলে না- সেই সব দা’য়ী এবং তাদের দলের বিরুদ্ধে তাগুত – এই আলেমদের লেলিয়ে দেয়। এমনকি তাগুত এসব আলেমদের মাধ্যমে ফতোয়াও জারী করে, যেখানে দা’য়ীদেরকে খারিজী, বিদ্রোহী (বুগাত) বা ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অথচ, সাবধান! তারাই অশান্তি সৃষ্টিকারী, কিন্তু তারা তা বুঝতে পারে না। (সূরা বাকারা ২:১২)
  • আর এসব আলেমের বোঝা উচিত যে দা’য়ীদের মাঝে অনেক ধরনের বিভ্রান্তি থাকতে পারে, কিন্তু সেটা কখনোই তাগুতের বিভ্রান্তির সমপর্যায়ের নয়। কারণ, তাগুত হলো আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের সরাসরি বিরুদ্ধে।
  • তাগুতের আরেকটি চাল হলো আলেমদেরকে এবং দা’য়ীদেরকে উচ্চ পদমর্যাদা, চাকরি, উপাধি, প্রচুর সম্মান এবং সম্পদ দান করা, যাতে তারা তাগুতের বিরুদ্ধে কিছু করা থেকে বিরত থাকে। যেসব আলেম মনে করে – ‘নুন খাই যার, গুণ গাই তার’ – তারা এই ফাঁদে পড়ে একসময় তাগুতের সব খারাপ কাজকে সমর্থন করতে শুরু করে, তাদের পক্ষে ফতোয়া দেয়, তাদের গুনের বর্ণনা করে এবং তাদের কাজের প্রশংসা করে। ইবন আল-জাওযি বলেছেন, “ইবলিস ফকিহদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য তাদেরকে সুলতান ও আমিরদের সাথে ঘনিষ্ঠ করে দেয় যাতে তারা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরোধিতা না করে।” (তালবিসুল ইবলিস, পৃঃ ১২১) এবং তিনি আরো বলেছেন যে, সুলতানদের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার উদ্দেশ্য প্রথমে হয়তো ভালো থাকে, কিন্তু পরে সুলতানদের উপঢৌকন এবং পুরষ্কার পেয়ে এবং নিজেদের লোভের কারণে এই ভালো উদ্দেশ্য বদলে যায়। একসময় আর তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ না হয়ে পারা যায়না এবং তাদের বিরোধিতাও করা যায়না। সুফিয়ান আস-সাওরী বলেছেন, ‘আমি এই ভয় করিনা যে, সুলতানরা আমাকে অপমানিত করবে, বরং আমি ভয় করি যে তারা তাদের দানের মাধ্যমে আমাকে তাদের পক্ষে টেনে নিবে।”’ (তালবিস ইবলিস, পৃঃ ১২২) আর চিন্তা করে দেখুন সুফিয়ান কাদের ব্যাপারে এই কথা বলেছেন আর আজকের তাগুত তো তাদের চেয়ে অনেক বেশী সীমালংঘনকারী।
  • তাগুত ইসলামের কিছু শাখা-প্রশাখা নিয়ে খুব আগ্রহ দেখায় এবং ঐসব বিষয়ে দাওয়াহ দেয়ার অজুহাতে সেইসব আলেমদের জড়ো করে, যাদের ন্যায়-নিষ্ঠতাকে তাগুত ভয় পায় এবং যারা মানুষের কাছে প্রিয়। তাই তাগুত এদের জন্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ইত্যাদি তৈরি করে দেয়, রেডিও-টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করতে দেয়। সরকারি নানা কাজে নিয়োগ দেয়, বিভিন্ন বই লিখতে দেয়- ইত্যাদি অনেক কাজে ব্যস্ত করে রাখে যাতে তারা তাদের প্রধান কাজ অর্থাৎ তাগুতের সীমালঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কিছু করতে সময় পায় না। এছাড়া তাগুত ইসলামের নামে বিভিন্ন সংস্থা তৈরি করে এবং আলেমদেরকে সেখানে সদস্য হতে বলে। যেমন, সউদী সরকার তৈরি করেছে ‘মুসলিম লীগ’। আলেমরা জানে যে এগুলোর সদস্য হওয়ার অর্থ হলো তাগুতের সাথে ঘনিষ্ঠতা করা, কিন্তু তারপরও অনেক আলেম এই ধোঁকায় প্রতারিত হয়ে যায়। বর্তমানে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, অধিকাংশ ইসলামী বইতেই সউদী তাগুত সরকারের প্রশংসা করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হচ্ছে। যদি কোন দেশের সাথে তাগুতের বিরোধিতা থাকে, কেবলমাত্র তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে। যেমন, একসময় গাদ্দাফীর সাথে সউদী সরকারদের শত্রুতা ছিল, তখন তার বিরুদ্ধে অনেক লেখালেখি, অনেক ফতোয়া হয়েছে। কিন্তু যখন, এই বিরোধ মিটে গেল তখন সব ফতোয়াও হারিয়ে গেল। এখন এসব তাগুত কা’বা তাওয়াফ করে, অথচ আলেমরা কিছুই বলেনা। একমাত্র আল্লাহর কাছেই আমরা আমাদের এই বিপদের কথা বলতে পারি। যখনই দেখা যাবে যে, কোন প্রতিষ্ঠানের পেছনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আছে, তখনই ঐ প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে থাকতে হবে।
  • তাগুত কিছু কিছু দা’য়ীকে বাছাই করে তাদেরকে দাওয়াহ এবং খুতবা দেয়ার লাইসেন্স দেয়। তারা ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার কমিটি’ তৈরি করে এবং আলেমদের এই কমিটিকে ঢুকিয়ে সন্তুষ্ট করতে চায়, যাতে আলেমরা এই কাজেই ব্যস্ত থাকে এবং সরকারের দোষত্রুটি, রাজনীতি এবং তাগুতের সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে চুপ থাকে। তাগুত তাদেরকে ব্যস্ত রাখে জনগণের কিছু সমস্যা নিয়ে যা কিনা সরকারের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে (যেমন-ঘুষ, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি)। ফলে আলেমরা এসব ছোট ছোট সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত থাকে, সবচেয়ে বড় সমস্যা নিয়ে তারা ভাবারই সময় পায়না। কারণ তাদের কর্মকাণ্ড ও দাওয়াহর পরিচালনার দায়িত্ব থাকে এসব কমিটির হাতে।
  • তাগুত পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে থেকে এই মিল্লাত দূরে সরিয়ে দিতে তাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া এবং আরো অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে। এই তাগুতরা আসলে ফিরাউনের চেয়েও খারাপ। কারণ, ফেরাউন পরবর্তী প্রজন্মকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে যখন তার সবকিছু ব্যর্থ হয়েছে – আর আজকের তাগুত প্রথম থেকেই সেই চেষ্টা শুরু করেছে। তাগুত এসব ছেলেমেয়েকে বড় করে তোলে এমন এক পরিবেশে যেখানে তাদের তাগুতকে শ্রদ্ধা করতে শেখানো হয়, তাগুতের আইনকে এবং দেশকে ভালবাসতে বলা হয়। এই শিক্ষা দেয়া হয় স্কুল-কলেজে এবং মিডিয়ায় আর মুসলিমরা তাদের বোকামীর কারণে স্বেচ্ছায় নিজের সন্তানকে এর মাঝে ঠেলে দেয়। এই তাগুত যদি ফিরাউনের মতো করে হত্যা করা শুরু করতো তাহলে জনগণ বিদ্রোহ করতো- কিন্তু তাদের এই গভীর ষড়যন্ত্রের ফলে জনগণ বিদ্রোহ করা তো দূরের কথা, বরং তাগুতকে ভালবাসতে শুরু করে। জনগণ মনে করে তাগুত অশিক্ষা দূর করছে, মানুষকে সভ্যতা ও উন্নতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ, এসবের আড়ালে তাগুত আসলে তার সরকার ও আইনের প্রতি অনুগত ও বিশ্বস্ত সেবক তৈরি করে নিচ্ছে। আর এতটা যদি নাও হয় তাহলেও অন্ততে এমন এক প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে যারা পথহারা, অজ্ঞ এবং অবুঝ। এই প্রজন্ম সঠিক মিল্লাত থেকে দূরে চলে যায়, এবং তাগুতের বিরোধিতা করা তো পরের ব্যাপার তাগুতের বিরোধিতা করার চিন্তাও এদের মাথায় আসে না। তাগুতের এসব ফাঁদে পড়ে অনেক আলেমই পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। ফলে মানুষ এখন আলেম এবং ইসলামী নেতাদের উপর ভরসা হারিয়ে ফেলেছে। আর তাগুতের চোখেও এমন আলেমরা অত্যন্ত তুচ্ছ হয়ে গেছে, কারণ তাগুত এখন আর এদের ভয় পায়না, এদের দাওয়াহকেও ভয় পায়না এবং এমনকি এদের ব্যাপারে দুশ্চিন্তাও করে না, অথচ এই আলেমরাই যদি তাদের দাওয়াহ দৃঢ় রাখতো, পাহাড়ের মতো অটল থাকতো, তাগুতের প্রতি বারা’আ প্রদর্শন করতো এবং তাদের কথামতো সঠিক পথ থেকে সরে যাওয়াকে ঘৃণা করতো- তাহলে তাগুত এই আলেমদের ভয় পেতো এবং বিচলিত হতো। আল্লাহ তাগুতদের মনে মু’মিনদের প্রতি ভয় ঢুকিয়ে দেন, যেমন তিনি সেই সময়ের কাফিরদের মনে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, এবং এই ভয়ের মাধ্যমেই এক মাসের দূরত্ব থেকেই কাফিরদের উপর বিজয় লাভ করেন। জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলূল্লাহ ﷺ বলেছেন, “আমাকে এমন পাঁচটি জিনিষ দেয়া হয়েছে যা আগে কাউকে দেয়া হয়নিঃ (১) আমাকে শুধুমাত্র ভয়ের মাধ্যমেই এক মাসের দূরত্বে থেকে বিজয় দেয়া হয়েছে; (২) সমস্ত দুনিয়াকেই আমার জন্য ইবাদতের জায়গা করা হয়েছে-যেখানেই আমার উম্মাতের যে কেউ ইবাদত করতে চাইবে, সেখানেই সে করতে পারবে, (৩) গণিমতের মাল আমার জন্য বৈধ করা হয়েছে যা আগে বৈধ ছিলনা (৪) আমাকে সুপারিশ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে,(৫) অন্য নবীরা ছিলেন কেবল তাদের নিজ নিজ জাতির জন্য প্রেরিত, কিন্তু আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য।” (বুখারী)

সুতরাং আমাদের এইসব ফাঁদ থেকে সাবধান হওয়া উচিত, আল্লাহ্ আমাদের কাছে এইসব ষড়যন্ত্র প্রকাশ করে দিয়েছেন, ফাঁদগুলো চিনিয়ে দিয়েছেন এবং আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন। এবং সেই সাথে তিনি এর সমাধান দিয়ে দিয়েছেন এবং আমাদেরকে সঠিক পথটিও দেখিয়ে দিয়েছেন। যেমনঃ

তারা চায় যে, তুমি নমনীয় হও, তাহলে তারাও কিছুটা নমনীয় হবে। (সূরা কালাম ৬৮:৯)

আয়াতটি বলার আগেই আল্লাহ বলে দিয়েছেন-

সুতরাং তুমি মিথ্যাচারীদের অনুসরণ করো না (সূরা কালাম ৬৮:৮)

তাদের আনুগত্য করা যাবেনা, তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়া যাবেনা এবং তাদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত হওয়া যাবে না, কারণ আল্লাহ আমাদের সত্য দ্বীন দিয়েছেন, সঠিক পথ দেখিয়েছেন এবং মিল্লাতে ইব্রাহীমের দিকে চালিত করেছেন।

  • যেমন মক্কী যুগে অবতীর্ণ সূরা আল-ইনসানের একটি আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

সুতরাং ধৈর্যের সাথে তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের প্রতীক্ষা কর এবং তাদের মধ্যে যে পাপিষ্ঠ অথবা কাফির তার আনুগত্য করো না। (সূরা ইনসান ৭৬:২৪)

এখানে আল্লাহ্ তা’আলা দুষ্কৃতকারী কাফিরদের আনুগত্য করতে নিষেধ করেছেন। এই পথ দা’য়ীদের নিজেদের মনগড়া কোন পথ নয়- তারা ইচ্ছামতো এই পথকে পরিবর্তন করার বা এর কোন বৈশিষ্ট্য বদলে দেবার অধিকার রাখে না। বরং এটা হলো ইব্রাহীম (আঃ) এর মিল্লাত এবং অন্য সব নবী ও রাসূলের পথ, যার বর্ণনা কুরআনে আছে।

  • মক্কী যুগের আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছেঃ

সুতরাং তুমি কাফিরদের আনুগত্য করও না এবং তুমি কুরআনের সাহায্যে তাদের সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যাও। (সূরা ফুরকান ২৫:৫২)

সুতরাং কুরআনে বর্ণিত পথ ছাড়া অন্য কোন পথে বা পদ্ধতিতে দাওয়াহর কাজ করা যাবে না। তাদেরকে এই কুরআনের মাধ্যমেই সতর্ক করতে হবে এবং কোন বাতিল, বিকৃত পথ অনুসরণ করা যাবেনা, যেসব পথে গেলে কাফিরদের আনুগত্য করতে হয় বা তাদের কুফরীর ব্যাপারে চুপ থাকতে হয়।

  • একই ভাবে আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূলকে আদেশ করেছেন কুরআন থেকে কিছু কিছু করে ‘তিলাওয়াত’ করতে। এখানে ‘তিলাওয়াত’ অর্থ হলো অনুসরণ। এবং এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, দ্বীনে দৃঢ় থাকার জন্য কিতাব পড়া, বোঝা এবং মজবুতভাবে অনুসরণ করার চেয়ে ভালো কোন উপায় থাকতে পারে না এবং ঈমানের দৃঢ়তা আরো বাড়ানো যায় আল্লাহর বেশি স্মরণ এবং ‘ক্বিয়াম-উল-লাইল’ (রাত্রির নামাজ)-এর সাহায্যে, যেমন বলা হয়েছে-

 “এবং তোমাদের প্রতিপালকের নাম স্মরণ কর সকাল ও সন্ধ্যায়, রাত্রির কিয়দংশে তাঁর প্রতি সিজদায় নত হও, এবং রাত্রির দীর্ঘ সময় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। (সূরা ইনসান ৭৬:২৫-২৬)

তুমি নিজেকে ধৈর্য সহকারে রাখবে তাদের সাথে যারা সকাল ও সন্ধ্যায় আহ্বান করে তাদের প্রতিপালককে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এবং তুমি পার্থিব জীবনের শোভা কামনা করো না তাদের হতে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নাও। তুমি তাদের আনুগত্য করোনা যাদের চিত্তকে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি, যে তার খেয়ালখুশির অনুসরণ করে ও যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে। (সূরা কাহাফ ১৮:২৮-২৯)

এবং এই আয়াতগুলোও নাযিল হয়েছিল মক্কী সময়ে। একইভাবে সূরা আশ-শুরার এই আয়াতটিও মক্কী সময়ের যেখানে তিনি বলেছেন পূর্বের নবীদের প্রতি তাঁর দেয়া বিধানের কথা:

“….. যেভাবে আদেশ করা হয়েছে, সেভাবেই প্রতিষ্ঠিত থেকো এবং ওদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না—। (সূরা আশ-শুরা ৪২:১৫)

এবং কিছুটা পরেই তিনি কাফিরদের প্রতি ঘোষণা করতে বলেছেন,

“–আমাদের কাজ আমাদের কাছে এবং তোমাদের কাজ তোমাদের কাছে….। (সূরা জাছিয়াহ ৪৫:১৮)

এই ঘোষণার মাধ্যমে কাফিরদের ভ্রান্ত ইচ্ছা, পদ্ধতি এবং পথের প্রতি বারা’আ প্রদর্শিত হয়। একই কথা বলা হয়েছে সূরা জাছিয়াতে।

এরপর আমি তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি দ্বীনের বিশেষ বিধানের উপর সুতরাং তুমি তার অনুসরণ কর, অজ্ঞদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ কর না। (সূরা আশ-শুরা ৪২:১৫)

আমরা কুরআন থেকে গবেষণা করলেই দেখতে পাবো প্রচুর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি মানুষকে খেলার ছলে সৃষ্টি করেননি এবং কোন দায়িত্ব ছাড়াই ছেড়ে দেননি। আল্লাহর দেয়া পদ্ধতির স্পষ্টতা এবং দৃঢ়তা কি দা’য়ীদের জন্য যথেষ্ট নয়? নবীরা যেই পথে সন্তুষ্ট ছিলেন, দা’য়ীরা কি সেই পথ নিয়ে সন্তুষ্ট নয়? দা’য়ীদের জন্য এখনও ঘুম থেকে জাগার এবং বিপথগামীতা থেকে ফিরে আসার সময় হয়নি? তারা ইতিমধ্যেই তাগুতের ফাঁদে পড়ে তার দোষ গোপন করছে, মানুষকে বিভ্রান্ত করছে এবং নিজেদের আমল ধ্বংস করছে – তারা কি আরো খারাপ হতে চায়? আল্লাহর শপথ, এখন শুধু একটিই সিদ্ধান্ত নিতে হবে – হয় আল্লাহর দেয়া শরীয়াহ, আর না হলে ঐসব অজ্ঞ মানুষের খেয়ালখুশি। এর বাইরে তৃতীয় কোন পথ নেই কারণ এই দুইয়ের মাঝামাঝি বলতে কোন কিছু নেই।

এসব আয়াত একজন দা’য়ীকে তার পথ চিনিয়ে দেয়। নিশ্চিতভাবেই, এই শরীয়াহ এবং এর বাইরে যা কিছু আছে তার সবই হলো বাতিল এবং নিছক খেয়ালখুশি যা অজ্ঞতা থেকে জন্ম নিয়েছে। দা’য়ীর দায়িত্ব হলো শরীয়াহকে গ্রহণ করা এবং অন্য সবকিছু ছেড়ে দেয়া। একজন দা’য়ী কখনোই এই শরীয়াহ থেকে সামান্যও সরতে পারবে না বা অন্য কারো মনগড়া মতের দিকে সামান্যও ঝুঁকে পড়তে পারবে না। কারণ ঐসব মত ও পথ যারা তৈরি করেছে তারা একতাবদ্ধ হয়ে ইসলামকে ধ্বংস করতে চেষ্টা করছে। তাই তাদের সাহায্য করা যাবেনা। তারা সবাই দাওয়াহ ও দা’য়ীদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ এবং একে অন্যের সাহায্যকারী। কিন্তু তারপরও তারা দা’য়ীর কোন ক্ষতি করতে পারবে না, সামান্য বিরক্তি ছাড়া। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ্ তাকে সাহায্য করবেন ও বিজয় দিবেন। আল্লাহু সুরক্ষা ও সাহায্যের তুলনায় ঐসব তাগুতদের পারস্পরিক সহায়তা কিছুই না। আর শারীয়াহ আঁকড়ে রাখা দা’য়ী যে কিনা আল্লাহর সাহায্য পেয়েছে তার সামনে এইসব ভাঁড়গুলো কতোই না দুর্বল যাদের সাহায্যকারী কেবলমাত্র তারা নিজেরাই।

“…..আর মুত্তাকীদের আসল বন্ধু হচ্ছেন আল্লাহ্। (সূরা জাছিয়াহ ৪৫:১৯)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × 3 =

Back to top button