আল-ফিরদাউস মিডিয়া ফাউন্ডেশনবাংলাদেশমিডিয়াশাইখুল হাদীস মুফতি আবু ইমরান হাফিযাহুল্লাহ

পিডিএফ/ওয়ার্ডঃ উজব থেকে বাঁচার উপায়! – শাইখুল হাদিস মুফতি আবু ইমরান হাফিজাহুল্লাহ

শাইখুল হাদিস মুফতি আবু ইমরান হাফিজাহুল্লাহ এর
“উজব থেকে বেঁচে থাকার উপায়”
শীর্ষক অডিও লেকচার থেকে লিখিত
উজব থেকে বাঁচার উপায়!
শাইখুল হাদিস মুফতি আবু ইমরান হাফিজাহুল্লাহ
পিডিএফ/ওয়ার্ডঃ উজব থেকে বাঁচার উপায়! – শাইখুল হাদিস মুফতি আবু ইমরান হাফিজাহুল্লাহ
অনলাইনে পড়ুন
ডাউনলোড করুন
পিডিএফ
ওয়ার্ড
আরও ডাউনলোড লিঙ্ক পেতে ক্লিক করুন এখানে
****************************

Ujob2.jpg

‘আল-ফিরদাউস’

পরিবেশিত

শাইখুল হাদিস মুফতি আবু ইমরান হাফিজাহুল্লাহ এর

“উজব থেকে বেঁচে থাকার উপায়”

শীর্ষক অডিও লেকচার থেকে লিখিত

 

“উজব থেকে বাঁচার উপায়!”

 

 

শাইখুল হাদিস মুফতি আবু ইমরান হাফিজাহুল্লাহ

 

***************************************

 

بِسْمِ اللَهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ

نحمده ونصلي علي رسوله الكريم – أما بعد – فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم – بسم الله الرحمن الرحيم وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا [٣:١٠٣]  صدق الله العظيم

আজকে আমাদের কয়েকটা দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ। মানুষের দুর্বলতাগুলোর মধ্যে একটা হলো, নিজেকে নির্ভুল মনে করা বা আত্মম্ভরিতা। আরবিতে যেটাকে বলা হয়, উজব। নিজের কাজের উপর সন্তুষ্ট হওয়া। তার খুব প্রভাব হলো যে, এই ধরণের ব্যক্তি এমন অহংকারের স্বীকার হয় যে অন্যের নসীহত সে আর গ্রহণ করেনা! এখন এর থেকে বাঁচার কী উপায়? পূর্ববর্তীদের এই ধরণের দুর্বলতার ক্ষেত্রে আদর্শ কী ছিলো? মোটামুটি এই কয়টা বিষয়ে আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।

  • “উজব” এর দুর্বলতা !
  • এটার কারণে অন্যের নসীহত গ্রহণ না করার প্রবণতা !
  • তার থেকে বাঁচার উপায়
  • সবশেষে এই ব্যাপারে পূর্ববর্তীদের আদর্শ

উজব এর দুর্বলতা

নিজেকে নির্ভূল মনে করার ব্যাপারে কোরআনে কারীমে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন :

اعوذ بالله من الشيطان الرجيم –

فَلَا تُزَكُّوا أَنفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَىٰ [٥٣:٣٢]

নিজেদেরকে তোমরা পবিত্র ঘোষণা করোনা কে বেশি খোদাভীরু – তিনি ভালো জানেন [৫৩:৩২]

এই ধরণের ব্যক্তিদের নিন্দা করে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন :

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يُزَكُّونَ أَنفُسَهُم  بَلِ اللَّهُ يُزَكِّي مَن يَشَاءُ وَلَا يُظْلَمُونَ فَتِيلًا [٤:٤٩]

ওদেরকে আপনি দেখেন না, যারা নিজেদেরকে পবিত্র হিসেবে প্রকাশ করে! বরং যাকে ইচ্ছা আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র ঘোষণা দিবেন তাদেরকে অল্প পরিমাণও জুলুম করা হবেনা [:৪৯]

বিষয়টা এমন না যে, আমি যদি নিজেকে পবিত্র হিসেবে – ভালো হিসেবে প্রকাশ না করি, তাহলে আমি আমার নেক আমলের ফল কম পাবো। আল্লাহ তা’য়ালা আমাকে মূল্যায়ন করবেন না। বরং

يَوْمَ تُبْلَى السَّرَائِرُ [٨٦:٩]

স্বরণ করো সেই দিনকে যেদিন ভিতরের নেপথ্যের বিষয়গুলিও প্রকাশ করে ফেলা হবে [৮৬:]

এইজন্য একজন ব্যক্তি ভিতরে যে অবস্থা পোষণ করে, সেটা তার উপর দিয়ে প্রকাশ পেয়েই যায়। হাদীসের মধ্যে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :

لاتزكوا انفسكم الله اعلم باهل البر منكملا تخفي منه خافية

তোমরা নিজেদেরকে পবিত্র ঘোষণা করো না তোমাদের মধ্যে নেককার কে? – আল্লাহ তা’য়ালা ভালো জানেন আল্লাহ তা’য়ালার কাছে কোন গোপন বিষয় গোপন না

হাদীসে এসেছে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :

من استر بسريرة البس الله ردائه

কেউ যদি কোন গোপন অবস্থা নিজের ভিতরে পোষণ করে, আল্লাহ তা’য়ালা সেই অবস্থাটার পোষাক তার বাহ্যিক অবয়বে পড়িয়ে দেন

বাহ্যিক আচরণের মধ্যে এটা প্রকাশ পেয়ে যায়। কেউ যদি ভালো অবস্থা ভিতরে পোষণ করে, তাহলে বাহ্যিকভাবে তার একজন ভালো মানুষ হবার আচরণসমূহ প্রকাশ হয়ে থাকে। কেউ যদি মন্দ অবস্থা ভিতরে ধরে রাখে – পোষণ করে, তাহলে সে খারাপ এমন একটা ধারণা লোকদের হয় বা সমাজের মধ্যে তার ব্যাপারে এই ধরণের একটা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ হয়েই যায়। এইজন্য নিজেকে ভালো ঘোষণা করা, নিজেকে ভালো হিসেবে প্রকাশ করা – এর প্রয়োজন নাই। নিজে ভালো হওয়া, এটা হলো জরুরী। ভালো হিসেবে প্রকাশ করা – এই বিষয়টা আরেকটু বিশ্লেষণ করছি :

মনে মনে নিজেকে নিয়ে মুগ্ধ থাকা – নিজেরটাকেই সঠিক মনে করা, এটাও ভুল। নিজেকে নির্ভূল প্রকাশ করা, এটাও অপরাধ। এটাও নিন্দনীয়। এটারও তিরস্কার করা হয়েছে এই আয়াতের মধ্যে। আবার কোন দলিল প্রমাণ ছাড়া অন্য কোন মুসলমানকে দোষী মনে করা, তাও অপরাধ। আবার নিজেকে সঠিক হিসেবে প্রকাশ করা – আবার নিজেদের মধ্যে কাউকে সার্টিফাই করে দেওয়া যে, সে খুব ভালো। এটাও নিষেধ। কারণ ভিতরের অবস্থা তো আমি জানি না। যেমন : কাউকে – কোন ব্যক্তিকে দলিল প্রমাণ ছাড়া খারাপ বলা বা খারাপ ধারণা করা, এটাও আবার শরীয়তে নিষিদ্ধ।

উযবের কারণে অন্যের নসীহত গ্রহণ না করার প্রবণতা :

أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ [٤٩:١٢]

ওহে যারা ঈমান এনেছ! অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্দেহ এড়িয়ে চল, কেননা ধারণার কিছু এমন রয়েছে, যেগুলি অপরাধ পাপ [৪৯:১২]

অর্থাৎ দলিল প্রমাণ ছাড়া কোন মুসলমানকে – বাহ্যিকভাবে যেই ব্যক্তির আচার-আচরণ ও কার্যক্রম ভালো – এই ব্যক্তিকে কোন দলিল প্রমাণ ছাড়া খারাপ মনে করা, অন্যায়কারী মনে করা (إِثْمٌ), এইটা পাপ। আবার নিজেকে মন্দ হিসেবে প্রকাশ করা, নিজেকে খারাপ হিসেবে চিত্রিত করা, খারাপ একটা অবস্থা নিজের মধ্যে ধরে রাখা – এটাও শরিয়তে কাম্য না। তাই এখানে একটু সূক্ষ্ম বিষয় আছে।

একটা হলো :

  • নিজেকে নিয়ে নিজে মুগ্ধ হয়ে থাকা – নিজেকে নিজে ভালো মনে করা। এটা নিষিদ্ধ।
  • নিজেকে নিজে ভালো হিসেবে প্রকাশ করা। এটা নিষিদ্ধ।
  • অন্যের ব্যাপারে খারাপ ধারণা করা। এটাও নিষিদ্ধ। দলিল প্রমাণ ছাড়া অন্য কারো ব্যাপারে খারাপ ধারণা করা। এটাও নিষিদ্ধ।
  • কাউকে ভালো হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া। ভালো হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দেওয়া। নিজেকে হউক বা অন্য কাউকে হউক। এটাও নিষিদ্ধ।

অন্যটি হলো :

  • নিজেকে খারাপ হিসেবে চিত্রিত করে রাখা, নিজে খারাপ হিসেবে চিত্রিত থাকা। এটাকে কোন বিষয় মনে না করা।
  • আমি খারাপই, আমার এতো ভালো হবার প্রয়োজন নাই, আমাকে তোমরা খারাপই জানো! আর মানুষের দৃষ্টিতে খারাপ হইয়া থাকাকে সে কোন বিষয়ই মনে করে না।

এই জিনিসটা হলো নির্লজ্জতা, বেহায়াপনা। এটা শরিয়তে কাম্য না। আর এটা থেকে যদি একটা মানুষ বিরত না থাকে, তাহলে তার দ্বারা যেকোন ধরণের অপরাধ হয়ে যেতে পারে।

اذا ان لم تستحي فافعل ما شئت

যদি তোমার লজ্জা না থাকে, একেবারে যা ইচ্ছা তাই করতে পারো

এইযে নির্লজ্জ হয়ে যাওয়া – সব অপরাধের দরজা ব্যক্তির জন্য খুলে দেয়। এইজন্য আমার ব্যাপারে মানুষের ভালো ধারণা থাকুক – এই অবস্থাটা ( (حسن ظنথাকুক, এই অবস্থাটা ধরে রাখাটা শরিয়তে কাম্য।

তাহলে বান্দা করবে কী?

সে নিজেকে নিজে অপরাধী হিসেবে সর্বদা মনে করবে এবং এই অপরাধের সংশোধন আমার জন্য প্রয়োজন – এই একটা অবস্থা ধরে রাখবে নিজের মধ্যে। মানুষের সঠিক অবস্থান হলো, সে আল্লাহ তা’য়ালার কাছে সর্বদা নিজেকে অপারগ বানিয়ে রাখবে, অক্ষম হিসেবে প্রকাশ করবে। নিজে দোষী – অপরাধী হিসেবে তাঁর সামনে বিনয়ের সাথে থাকবে, কাকুতি মিনতি করবে, কান্নাকাটি করবে। এটাই হলো মানুষের স্বাভাবিক অবস্থা।

তার উল্টোটা হল – সে নিজের উপর মুগ্ধ হয়ে থাকে, নিজেকে নিয়ে সে গৌরবান্বিত। নিজেকে নিয়ে সে খুব ফখরের মধ্যে, অহংকারের মধ্যে আছে। নিজেরটাকেই সে নির্ভূল মনে করে – এটা হলো তার জন্য একটা খারাপ অবস্থা।

এই যে নিজেকে নিয়ে মুগ্ধ হওয়া – এটারই পরবর্তী একটা প্রকাশ হলো যে, তার মধ্যে একটা অহংকার চলে আসে। কিবির চলে আসে। আর কিবির হলো সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা। আর মানুষদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করা।

অন্য এক হাদীসের মধ্যে রাসুল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ যমানায় যখন দূরাবস্থা একেবারে চূড়ান্ত অবস্থায় পৌছবে – সেই সময়ের দূরাবস্থাগুলোর একটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লেখ করেছেন।

هواء متبعا

খেয়াল-‍খুশির অনুসরণ করা হবে

মানুষ নিজের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করা শুরু করবে। এমন কঠিন অবস্থান যখন চলে আসবে, তখন أمر بالمعروف و نهي عن المنكر ও কার্যকরী থাকবে না। তখন জনসাধারণের জন্য যারা চিন্তা করতে যাবে, তাদের অবস্থা এমন হয়ে যাবে যে, জনসাধারণ চিন্তা করতে গিয়ে নিজে জনসাধারণের মত হয়ে যাবে! হেদায়াত করতে এসেছো (?) হেদায়াত হয়ে যাবে! এমন হয়ে যাবে!! তখন দেখা যাবে যে, সমাজ এমনভাবে বিকৃতির স্বীকার হয়েছে যে, সমাজের সাথে যে মিশে থাকতে চাইবে, সে নিজে বিকৃতির সাথে জড়িয়ে যাবে! সমাজ ভালো করতে যেয়ে নিজে খারাপ হয়ে যাবে! বাস্তবতা হল, সে মানুষদেরকে উপদেশ দেওয়ার নেক আমল করতে যেয়ে দেখবে, সে উপদেশ দিতে গিয়ে সত্য কথাকে গোপন করছে! মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করছে! মানুষদের মন জুগিয়ে কথা বলতে হচ্ছে! শক্তির ভয়ে – লোক লজ্জার ভয়ে – জুলুম-অত্যাচারের ভয়ে বা বিভিন্ন ধরণের বিপদ আপদের আশংকায় সে সত্যটাকে প্রকাশ করতে পারছে না! মানুষও বিভ্রান্তির মধ্যে থেকে যাচ্ছে!! এইসময়ে যে রোগটা মানুষের মধ্যে দেখা দিবে সেটা হলো :

هواء متبعا

খেয়ালখুশির অনুসরণ শুরু হয়ে যাবে

কেউ কারোটা মানবে না! নিজে যেটা ভালো মনে করে, সেটার পিছনেই ছুটবে! এইযে, নিজেরটাকেই নিজে অগ্রসর করে রাখা, সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া – এটা মানুষের একটা মারাত্বক রোগ।

আর এই রোগের পরিণতি হলো, তার মধ্যে অহংকার সৃষ্টি হয়। অহংকার এসে যায়। তখন সে নিজেকে সত্যের চেয়ে বড় মনে করে! হক্ব এমন বস্তু, যার সামনে যে কেউ মাথা নত করতে বাধ্য। কিন্তু সে তখন হক্বের সামনে মাথা নত করাকে নিজের জন্য – তখন নিজের পজিশন – নিজের শান – নিজের মানের পরিপন্থী মনে করে!

বাস্তবে হক্বটা হলো মু’মিনের হারানো সম্পদ। যেখানে সে এটাকে পাবে, সেখান থেকে সে এটাকে নিবে। কিন্তু দেখেন, এক ধরণের লোক ছিলো যাদের ব্যাপারে আল্লাহ পাক বলেছেন – কোরআনে কারীমে তাদের আচরণটা এইভাবে প্রকাশ করেছেন :

وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِلَّذِينَ آمَنُوا لَوْ كَانَ خَيْرًا مَّا سَبَقُونَا إِلَيْهِ [٤٦:١١]

আর যারা অবিশ্বাস পোষণ করে তারা তাদের সন্বন্ধে বলে যারা ঈমান এনেছ, এই বিষয়টা যদি সত্য হতো তাহলে লোকগুলো সেখানে আমাদের আগে যেতে পারতো না [৪৬:১১]

সাধারণভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাথমিক অনুসারি কারা ছিলো? দুর্বল শ্রেণীর লোক। এখন সমাজের প্রতিষ্ঠিত লোক, বড়রা কী বলছে?

لَوْ كَانَ خَيْرًا مَّا سَبَقُونَا إِلَيْهِ [٤٦:١١]

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, এটা যদি ভালো হতো, এটা যদি উত্তম কিছু হতোতাহলে এই নিচু শ্রেণীর লোকগুলো এই উত্তম জিনিসটার দিকে আমাদের আগে অগ্রসর হতে পারতো না [৪৬:১১]

কারণ :

الجنس يميل الي الجنس

প্রতিটা বস্তু তার সমজাতীয় বস্তুর দিকে ধাবিত হয়

মুহাম্মদের আনিত বিষয়গুলো যদি উত্তম হয়, তাহলে আমরা যেহেতু উত্তম আমরা সেইগুলো আগে গ্রহণ করার কথা! অধমরা তো সেগুলি গ্রহণ করার কথা না!!

وَكَذَٰلِكَ فَتَنَّا بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لِّيَقُولُوا أَهَٰؤُلَاءِ مَنَّ اللَّهُ عَلَيْهِم مِّن بَيْنِنَا ۗ أَلَيْسَ اللَّهُ بِأَعْلَمَ بِالشَّاكِرِينَ [٦:٥٣]

আর এইভাবে আমি তাদের একদলকে শাসন করি অন্য দলের দ্বারা ফলে তারা বলে, “এই লোকগুলোকে আল্লাহ পাক আমাদের মধ্য থেকে অনুগ্রহের পাত্র বানিয়েছেন [:৫৩]

আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন কারো উপড়  অনুগ্রহ করবেন – এটাও তারা মনে করে যে অপাত্রে অনুগ্রহ। আসল অনুগ্রহের পাত্র ছিলো তারা নিজেরা! এইভাবে :

وَقَالَ الَّذِينَ لَا يَرْجُونَ لِقَاءَنَا لَوْلَا أُنزِلَ عَلَيْنَا الْمَلَائِكَةُ أَوْ نَرَىٰ رَبَّنَا  لَقَدِ اسْتَكْبَرُوا فِي أَنفُسِهِمْ وَعَتَوْا عُتُوًّا كَبِيرًا [٢٥:٢١]

আর যারা আমার সাথে মোলাকাতের কামনা করে না তারা বলে, “কেন আমাদের কাছে ফিরিশ্‌তাদের পাঠানো হয় না অথবা আমাদের প্রভুকেই বা কেন আমরা দেখতে পাই না?” তারা নিজেরা নিজেদেরকে বড় বানিয়ে রেখেছে, তারা বড় ধরনের বাড়া বেড়ে গেছে [২৫:২১]

এই যে একটা অবস্থা, নিজেকে হক্বের চেয়ে উপরে উঠিয়ে ফেলা – এটাই হাদীসে বলা হয়েছে যে, আসল “তাকাব্বুর”। তাকাব্বুরের সাথে – এই অহংকারের সাথে ঈমান মিশে না। এক দিলের মধ্যে ২টা জিনিস – ঈমান ও কিবির – একত্রে থাকে না।

আর কিবিরের ব্যাখ্যা করা হয়েছে হাদীসের মধ্যে এটাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী বলেছেন?

لا يدخل الجنة من في قلبه مثقال ذرة من كبر

যার দিলের মধ্যে জাররা পরিমাণ অহংকার বিদ্যমান, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না

অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কিবির – অহংকারের ব্যাখ্যা করেছেন :

بطل الحق و غمط الناس

  • সত্যকে মিথ্যা বলে সাব্যস্ত করা।
  • আরেকটা হলো সত্যকে স্বীকারই না করা।
  • অথবা সত্যকে সত্য হিসেবে স্বীকার করেছে, কিন্তু সত্যকে সে গ্রহণ করছে না। অথবা সত্যকে সে প্রতিহত কছে।

এই সবগুলো بطل الحقএর অন্তর্ভুক্ত। সত্যকে প্রত্যাখ্যান করলো সে!

و غمظ الناس

  • আর লোকদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করা – হেয় জ্ঞান করা! তাদেরকে অসম্মান করা!!

বাকী এখানে তাকাব্বুরের ব্যাপারে একটা সংশয় হতে পারে। যেমন :

এক সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছে যে, হে আল্লাহর রাসূল! কোন ব্যক্তি – তার কাপড় ভালো হবে, জুতা ভালো হবে। এইগুলো তার কাছে ভালো লাগবে – পছন্দ লাগবে, এটা কি তাকাব্বুর – অহংকারের অন্তর্ভূক্ত?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, “না”।

ان الله جميل يحب الجمال

আল্লাহ পাক সুন্দর তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন

ان الكبر من بطل الحق و غمط الناس

তাকাব্বুর হলো, যে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে আর লোকদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করে

এটা হলো তাকাব্বুর। বরং ভালো পোষাক পরিধান করা, ভালো জুতা পরিধান করা, কাউকে যদি আল্লাহ তা’য়ালা সম্পদ দান করেন – দুনিয়েবি সম্পদ থাকে এবং অন্যান্য হক্ব আদায়ের পরে অতিরিক্ত তার থাকে তাহলে আল্লাহ পাক চান যে, আল্লাহ পাকের নেয়ামতের প্রকাশ তার মধ্যে দেখা যাক। সে কৃপনের মত নিজেকে গোপন করে রাখলো, যেন নিজে কোন ভিখারি! কোন অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি তার কাছে কিছু চাইতে না পারে। এইটা শরিয়তে কাম্য না। বরং তার মধ্যে আল্লাহর নেয়ামতের প্রকাশ থাকাটাই শরিয়ত কামনা করে। এটাই কাম্য। আম কাজ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সবচেয়ে বড় যে প্রবণতাটা সেটা হলো, মনের চাহিদার পরিপন্থি কোনকিছু তারা গ্রহণ করে না! সেই সত্যটাকেই তারা গ্রহণ করে, যেটা তাদের মনের চাহিদার অনুযায়ী। এটাকে কোরআনে কারীমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন খুব ভয়ানক ভাবে বলেছেন। কী বলেছেন?

[٤٥:٢٣] أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَٰهَهُ هَوَاهُ

আপনি দেখলেন, ব্যক্তিকে যে তার খেয়াল-‍খুশিকে তার উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে [৪৫:২৩]

খেয়াল-খুশিকে সে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ তার খেয়াল-খুশির অনুকূলে যে বিষয়গুলো থাকে, সে বিষয়গুলোকে সে মানে। আর খেয়াল ‍খুশির বিপরীতে যা আসবে, সেগুলিকে সে প্রত্যাখান করবে! নিজের দুনিয়েবি স্বার্থ – নিজের সুবিধা – নিজের মনের চাহিদা, এগুলোর পক্ষে হলে সে মানবে। আর এগুলোর উপর আঘাত আসলে বা হক্ব মানতে যেয়ে স্বার্থগুলো নষ্ট হলে, সেই হক্বকে সে মানবে না। এইভাবে আসলে যখন একজন মানুষ নিজেকে বড় করে রাখে – হাদীসের মধ্যে এসেছে :

لا يزال الرجل يذهب بنفسه حتي يكتب في الجبارين فيصيبه ما اصابهم

কোন ব্যক্তি এইভাবে তাকে নিয়ে আগে বাড়তে থাকেনিজেকে এইভাবে বড় বানিয়ে রাখতে থাকেঅন্য লোকদের চেয়ে সে নিজেকে উঁচু মনে করে, অতঃপর সে নিজেকে জাব্বারিনদের মধ্যে জালিমদের মধ্যেঅত্যাচারী এবং স্বৈরাচারীদের মধ্যে তার নাম উঠে যায় অতঃপর সেই অত্যাচারীদের উপর যে আপদ আসে, তাকেও সেই আপদে গ্রাস করে নেয়

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরোও সতর্ক করেছেন যে :

তোমাদেরকে বলবো?

الاأخبركم باهل النار

জাহান্নামের অধিবাসী কোন শ্রেণীর লোক হবে, এটা বলবো?

كل عتل جواز مستكبر

(عتل) – الغليظ الجافي রূঢ় স্বভাব, খিটখিটে স্বভাব। কোন ধরণের প্রীতি, মায়া-মমতা, দরদ – এগুলো তার মধ্যে নেই।

(والجواز) –  الجموع المنوع সম্পদ সঞ্চয়কারী বা জমাকারী, সম্পদ আটকে রাখে।

(والمستكبر) –  অহংকারী –  المختال الفخورগৌরবান্বিত।

কোরআনে কারীমে আল্লাহ তা’য়ালা এদের অবস্থাটা তুলে ধরেছেন এভাবে :

وَقَالَ الَّذِينَ لَا يَرْجُونَ لِقَاءَنَا لَوْلَا أُنزِلَ عَلَيْنَا الْمَلَائِكَةُ أَوْ نَرَىٰ رَبَّنَا  لَقَدِ اسْتَكْبَرُوا فِي أَنفُسِهِمْ وَعَتَوْا عُتُوًّا كَبِيرًا [٢٥:٢١]

আর যারা আমার সাক্ষাতের আশাবাদী না তারা বলে যে, কেন আমাদের নিকট ফেরেস্তা প্রেরণ করা হয় না (?) অথবা আমরা কেন আমাদের রবকে দেখতে পাই না (?) তারা নিজেদেরকে অনেক বড় ভেবে রেখেছে এবং অতিরিক্ত বাড়তি বেড়ে গিয়েছে [২৫:২১]

তাদের অবস্থান এত উন্নত যে, এরা হক্ব গ্রহণ করতে হলে আল্লাহ এসে তাদেরকে হক্ব দিয়ে যেতে হবে অথবা ফেরেস্তারা এসে তাদের সাথে কথা বলে যেতে হবে!

وَإِذَا جَاءَتْهُمْ آيَةٌ قَالُوا لَن نُّؤْمِنَ حَتَّىٰ نُؤْتَىٰ مِثْلَ مَا أُوتِيَ رُسُلُ اللَّهِ [٦:١٢٤]

আর যখন তাদের কাছে কোনো নিদর্শন আসে, তারা বলে – রাসূলগণ যেভাবে সরাসরি আল্লাহর থেকে পেয়েছেন, এভাবে যতক্ষণ আমরা না পাবো ততক্ষণ আমরা ঈমান আনবো না! [৬:১২৪]

নিজেকে এত বিশাল বড় মনে করে রেখেছে যে, আমাকে দলে ভিড়াইতে হলে আল্লাহ আমার সাথে কথা বলা দরকার! আমি তো আর ছোটখাটো একজন কেহ না! এই অবস্থায় পৌছে গেছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে রেখে দেওয়া কোরআন-সুন্নাহ তার জন্য যথেষ্ট না! শরিয়তের বিধি-বিধানগুলো তার জন্য যথেষ্ট না! দ্বীনের হুকুম আহকামগুলো – রীতিনীতিগুলো তার জন্য যথেষ্ট না! এগুলো অন্যদের থেকে আসা! নিজেদের মধ্য থেকে লোকদের দ্বারা তার কাছে পৌছা, এগুলো গ্রহণ করার জন্য যথেষ্ট না!!

ঈমানদারদের ব্যাপারে তাদের আচরণটা কী হয় দেখেন :

اعوذ بالله من الشيطان الرجيم –

إِنَّ الَّذِينَ أَجْرَمُوا كَانُوا مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا يَضْحَكُونَ [٨٣:٢٩]

অপরাধীরা ঈমানদারকে নিয়ে হাসিতামাসা করতো [৮৩:২৯]

وَإِذَا مَرُّوا بِهِمْ يَتَغَامَزُونَ [٨٣:٣٠]

যখন ওদের পাশ দিয়ে গমন করতো, তারা চোখের ইশারায় ঠাট্টা করতো [৮৩:৩০]

এই হলো দুনিয়েদারদের অবস্থা। এই হল অহংকারীদের আচরণ সাধারণ মু’মিনদের ব্যাপারে। পরে কী হবে এটার পরিণতি?

فَالْيَوْمَ الَّذِينَ آمَنُوا مِنَ الْكُفَّارِ يَضْحَكُونَ [٨٣:٣٤]

সেদিন ঈমানদাররা কাফেরদেরকে নিয়ে তামাশা করবেহাসবে [৮৩:৩৪]

عَلَى الْأَرَائِكِ يَنظُرُونَ [٨٣:٣٥]

আরাম কেদারায় তারা তাদের(কাফেরদের) অবস্থা প্রত্যক্ষ করবে দেখতে থাকবে [৮৩:৩৫]

هَلْ ثُوِّبَ الْكُفَّارُ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ [٨٣:٣٦]

কাফেরদেরকে প্রতিদান দেয়া হয়েছে (?) ঐসব কাজের যা তারা করেছিলো(?) এখন উপযুক্ত প্রতিদান তারা পাচ্ছে! [৮৩:৩৬]

 

زُيِّنَ لِلَّذِينَ كَفَرُوا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَيَسْخَرُونَ مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا  وَالَّذِينَ اتَّقَوْا فَوْقَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ  وَاللَّهُ يَرْزُقُ مَن يَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ [٢:٢١٢]

যারা অবিশ্বাস পোষণ করে তাদের কাছে এই দুনিয়ের জীবন মনোরম ঠেকেএই কাফেররা দুনিয়ের মধ্যে ঈমানদারকে নিয়ে কৌতুক করে হাসিতামাশা করে আর বাস্তবতা হলো যারা খোদাভীরু, তারা এই কাফেরদের চেয়ে উন্নত হবে, কেয়ামতের দিন আর আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে করেন বে-হিসাব রিযক দান করেন। [:২১২]

এখন এই সত্যের উপর অটল থাকতে হলে, এই দুরবস্তা থেকে বাঁচতে হলে, নিজেকে হক্বের অনুগত বানাতে হলে – ধৈর্যধারণ করতে হবে। এজন্য আল্লাহ তা’য়ালা পরে বলে দিয়েছেন :

أتصبرون علي الحق ام لاتصبرون

সত্যের উপর তোমরা কি অটল থাকবে ধৈর্য় ধরবে? না ধৈর্য ধরবে না?

এজন্য তাকাব্বুর স্বাভাবিকভাবে জঘন্য একটা মানসিকতা – দুর্বলতা। যার কারণে মানুষ হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। হক্ব থেকে সে বঞ্চিত হয়ে যায়। অনেকসময় দুনিয়ার মধ্যে যারা অহংকারী আছে, মুতাকাব্বির আছে – এদের সাথে নরম আচরণ আবার মুতাকাব্বিরগুলিকে আরো বেশি বাড়িয়ে দেয়। এজন্য ফাসেক ফুজ্জারদের সাথে বাহ্যিক আচরণে কঠোরতা করা। তাদের সাথে নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করা, অহংকার দেখানো – এটা আবার শরিয়তে কাম্য। একটা হাদীসের মধ্যে এসেছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :

من تعاظم في نفسه واختال في مشيته لقي الله وهو عليه غضبان

যে ব্যক্তি নিজেকে বড় ভাবে আর অহংকারের ঢং নিয়ে চলাফেরা করে, সে আল্লাহর সাথে এমনভাবে মিলিত হবে যে আল্লাহ তা’য়ালা তার উপর ক্ষুব্ধ থাকবেন

আল্লাহর সাথে মিলিত হবার দিন আল্লাহ ক্ষুব্ধ থাকবেন -অবস্থাটা কত ভয়াবহ!

এই অহংকারের পরিণতি দেখেন :

পূর্ববর্তীদের মধ্যে কারুনের ব্যাপারে কোরআনে কারীমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উল্লেখ করেছেন :

إِنَّ قَارُونَ كَانَ مِن قَوْمِ مُوسَىٰ فَبَغَىٰ عَلَيْهِمْ  وَآتَيْنَاهُ مِنَ الْكُنُوزِ مَا إِنَّ مَفَاتِحَهُ لَتَنُوءُ بِالْعُصْبَةِ أُولِي الْقُوَّةِ إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لَا تَفْرَحْ  إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفَرِحِينَ [٢٨:٧٦]

কারুন ছিলো মুসার সম্প্রদায়ের লোক সে তাদের মধ্যে সীমালঙ্ঘন করেছে তাকে এই পরিমাণ ধনভান্ডার দিয়েছি যে, তার চাবিসমুহ শক্তিশালী একটা দলকে বোঝাই ন্যুজ করে দেয় [২৮:৭৬]

(لتنوئ بالعصبة اولي القوة) শক্তিশালী একটা দলের জন্য চাবির বোঝা বহন করা ভার হয়ে যায়।

কারুনকে তার সম্প্রদায়ের লোকেরা বলল যে, তুমি আনন্দে আটখানা হয়ে যেও না উৎফুল্য হয়ে আত্মহারা হয়ে যেও না এই ধরণের উল্লাশিতদেরকে আল্লাহ তা’য়ালা পছন্দ করেন না [২৮:৭৬]

তার এই ধরণের শান-শওকত ও ক্ষমতা ছিল , যেটা এক সময় মানুষের জন্য ঈর্ষণীয় ছিলো।

فَخَسَفْنَا بِهِ وَبِدَارِهِ الْأَرْضَ فَمَا كَانَ لَهُ مِن فِئَةٍ يَنصُرُونَهُ مِن دُونِ اللَّهِ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنتَصِرِينَ [٢٨:٨١]

তাকে এবং তার গৃহকে আমি জমিনের গ্রাসে দিয়ে দিয়েছি তখন তার জন্য এমন কোনো দল ছিল না যারা আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করতে পারত আর সে আ‌ত্মপক্ষকে সাহায্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। [২৮:৮১]

 

এখন এই রোগ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

পরিত্রাণের উপায়টা হাদীসের মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

توبي لمن شغله عيبه عن عيوب الناس

সুসংবাদ ব্যক্তির জন্য যার নিজের দোষ ত্রুটির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া, অন্যের দোষ ত্রুটি থেকে তাকে উদাসিন রাখে

আসলে একইসাথে মানুষ সব কাজ করতে পারে না। কেউ ‍যদি নিজের দোষ ত্রুটির দিকে দৃষ্টি দেয়, তখন অন্যের দোষ ত্রুটি তার নজরে পড়বে না। আর যতদিন অন্যের দোষ ত্রুটিই খুজে ফিরতে থাকবে, নিজের দোষ ত্রুটি নজরে পড়বে না। এইজন্য খালি অন্যের দোষ ত্রুটির পিছনে ছোটা, এই ব্যক্তি যে নিমজ্জিত – তার একটা প্রমাণ। আর যে নিজের দোষ ত্রুটির দিকে নজর দেয়, সে অন্যের দোষ ত্রুটির ব্যাপারে উদাসিন থাকে। তার দ্বারা গীবত, তোহমত, অন্যের প্রতি হিংসা, বিদ্ধেষ – এইগুলি কম কাজ করে। এইজন্য বাঁচার ব্যবস্থা এটা যে, নিজের দোষের দিকে দৃষ্টি দিবে। তখন নিজেকে ছোট মনে হবে। তার দিকে সবগুলো রহমত ধাবিত হবে। সত্যটাকে গ্রহণ করাও তার জন্য সহজ হবে।

হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :

لا تحاسدوا ولا تباغضوا ولا تناجشوا

তোমরা পরস্পরে হিংসা করো না, শত্রুতা পোষণ করো না, ধোকাবাজি করো না, একে অপরের পিছনে পড়ো না

ولا يبيع بعضكم علي بيع بعض

একে অপরের কেনাবেচার মধ্যে কেনাবেচা করো না

وكونوا عباد الله اخوانا

আল্লাহর বান্দারা তোমরা ভাইভাই হয়ে থাকো

এমনি তো মানুষ হিসেবে ভাই। কিন্তু শরয়ি ভাই। মুসলমান একে অপরের ভাই হয়ে থাকো।

المسلم اخو المسلم

মুসলমান মুসলমানের ভাই

শরিয়তে মুসলমান মুসলমানের ভাই। কোন কাফের বংশগত ভাই হলেও সে মুসলমানের শরিয়তগতভাবে ভাই না।

قَالَ يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ  إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ  فَلَا تَسْأَلْنِ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ  إِنِّي أَعِظُكَ أَن تَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ [١١:٤٦]

নূহ আলাইহিস সালাম এর সন্তানের ব্যাপারে নূহ আলাইহিস সালাম কে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন – “হে নূহ! নিঃসন্দেহ সে আপনার পরিবারের সদস্য না নিঃসন্দেহ তার কাজকর্ম সৎকর্মের বহির্ভূত কাজেই আমার কাছে সওয়াল কর না, যে সন্বন্ধে তোমার কোনো জ্ঞান নেই। আমি অবশ্যই তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি — পাছে তুমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়” [১১:৪৬]

المسلم اخو المسلم

মুসলমান মুসলমানের ভাই

لا يظلمه ولا يخذله و لا يحقره

সে তার উপর জুলুম করবে না, তাকে অপদস্ত করবে না,

কখনও তার সাহায্য প্রয়োজন; সাহায্য না করে নিজে নিজের সুখ-সুবিধা নিয়ে পড়ে থাকলো, এটাকে বলা হয় (خذلان) – সাহায্য না করা। কারো প্রয়োজনের সময় তাকে সহায়তা না দেয়া – এমনটা মুসলমানের সাথে সে করবে না। তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে না

التقوي ههنا

তাক্বওয়া অন্তরের ভিতরে

কিন্তু এই তাক্বওয়ার প্রকাশটা ঘটে বিভিন্ন কাজ দিয়ে।

بحسب امرئ من الشر ان يحقر اخاه المسلم

একটা মানুষ খারাপ হওয়ার জন্য যথেষ্ট যে, সে কোন মুসলমানকে তুচ্ছ জ্ঞান করে

মুসলমান হিসেবে তার প্রতি তার মর্যাদাবোধ নেই। তার সম্পদের কারণে বা তার দীনতার কারণে, তার অন্যকোন দুর্বলতার কারণে, খুঁতের কারণে – তাকে সে তুচ্ছ জ্ঞান করে! বর্তমানে এটা তো মহামারী আকারে হচ্ছে!

সমাজে বর্তমানে যারা দুর্বল শ্রেণী, এদেরকে সব ধরণের অপরাধে এবং সব ধরণের অন্যায়ে অভিযুক্ত করা হয়। আর যে শক্তিশালী, সে সব ধরণের ভালো! সব শ্রেণীর মধ্যেই দেখেন, যে শক্তিশালী অবস্থানের মধ্যে আছে, সব দোষ দুর্বলের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। সংসারের মধ্যে বলেন – পরিবারের মধ্যে বলেন – সমাজের মধ্যে বলেন – দেশের মধ্যে বলেন – রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বলেন, যারা শক্তিশালী তারা যা করবে সব ন্যায়! আর যারা দুর্বল তারা যা করবে সব অন্যায়।

শক্তিশালী রাষ্ট্র যদি অন্য দুর্বল রাষ্ট্রের উপর বোমা মেরে হাজার হাজার নারী-শিশু মারতেও থাকে, লাখ-লাখও যদি শেষ করতে থাকে – তারপরও তারা শান্তিকামী! আর যদি কোন মজলুম নিরীহ অসহায় ব্যক্তিরা বাঁচার জন্য চেষ্টা করে, তার এই চেষ্টাটাও অন্যায়! এটাও অপরাধ! এটাও জঙ্গিবাদ! এটাও সন্ত্রাস! এটাও নিয়ম বহির্ভূত! অসাংবিধানিক!

তো মুসলমান মুসলমানের ভাই। প্রত্যেক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই ।

حرام ماله و دمه و عرضه

তার জন্য নিষিদ্ধ অপর মুসলমানের রক্ত, অপর মুসলমানের সম্পদ, অপর মুসলমানের সম্মান

এটার হস্তক্ষেপ সে সেখানে করতে পারে না। এটা মুহতারাম। তার কাছে সম্মানিত। এটার সম্মান রক্ষা করা তার উপর কর্তব্য। তার জন্য নিষিদ্ধ এই সম্মানকে নষ্ট করা। একজন মুসলমানকে সম্মান দিতে হবে কী হিসেবে? মুসলমান হিসেবে। সে যে শ্রেণীরই হোক – যে কোন পজিশনেই থাকুক।

সাধারণত দেখুন, আমাদের মধ্যে যদি কোন মামুর কাজে পারদর্শি হয় – খুব ভালো সার্ভিস দিতে পারে, তখন সে আর আমিরকে মানতে চায় না। আবার কোন আমির যদি বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন হয়, তখন মামুরদেরকে কোন গণ্যের মধ্যে রাখে না। কারো সাথে মাশওয়ারা করার প্রয়োজন মনে করে না। একটু একটু রিজালানা শুরু করে দেয়। স্বৈরাচারী হয়ে যায়। মানে দুই দিকেই – মুসলমান হিসেবে কাউকে মেনে নেয়া – এই বিষয়টা আমাদের মাঝে খুব কম!

পূর্ববর্তীদের এই ব্যাপারে আদর্শ

পূর্ববর্তীদের আদর্শ ১:

রবীঈ ইবনে খুসাইন উনাকে একজন জিজ্ঞাসা করলো:

হে আবু ইয়াজিদ!

الا تضم الناس

আপনি মানুষের নিন্দা করেন না?

মানুষের কোন দোষ ত্রুটি আলোচনা করেন না?

فقال الربيع والله ما انا عن نفس براض فاضم الناس

আবু ইয়াজিদ বললেন, আমি তো আমার নিজের উপর সন্তুষ্ট না। আমার নিজের কার্যক্রমই আমার কাছে পছন্দ না। তো আমি আরেক জনের কী নিন্দা করবো!

আপনি দৃষ্টিভঙ্গিটা দেখেন। কেউ যদি নিজের ব্যাপারে আত্মম্ভরী হয়, তখনই সে আরেক জনের দোষ খুজে। আর কেউ যদি দেখে দোষ সব আমার। তো আরেক জনের দোষ আমি কীভাবে তালাশ করবো!

ان الناس خافوا الله علي ذنوب الناس و امنواه علي ذنوبهم

মানুষের অবস্থা হয়ে গেছে যে, মানুষ আল্লাহকে ভয় করে অন্য মানুষের পাপাচারের কারণে! যে অন্যরা যে পাপাচারে লিপ্ত, না জানি আল্লাহর আজাব এসে যায়। আর নিজেদের পাপাচারের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে তারা নির্ভয় হয়ে আছে!

তার পাপাচারের কারণে যে আল্লাহ পাক তাকে শাস্তি দিবেন – দিতে পারেন – দেওয়ার আশংকা আছে, এই ব্যাপারে সে নির্ভিক! নিজের পাপের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার শাস্তির ব্যাপারে নির্ভিক হয়ে আছে। আর অন্যদের পাপাচারের কারণে না জানি শাস্তি আসে, এই ভয়ে তারা আতংকগ্রস্ত হয়ে আছে!!

 

তো এই অবস্থাটা কেন?

এই অবস্থাটা এইজন্য যে, আসলে আমাদের নিজেদের পুঁজি মজবুত না

পূর্ববর্তীদের আদর্শ ২:

উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু। যিনি এতো বড় খলিফাতুল মুসলিমিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাদের কোরবানি কত উচু পর্যায়ের এবং কতবেশি। তারপরও উমর রাযিআল্লাহু আনহুর নিজের ব্যাপারে তার ধারণাটা কী ছিলো?

হুযাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গোপন বিষয়গুলো জানতেন। কারা কারা মুনাফিক আল্লাহ তা’য়ালা আসমানী ওহী দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। এই গোপন বিষয়গুলো হুযাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহুকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানিয়েছিলেন। উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজের ব্যাপারে হুযাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহু কে গিয়ে জিজ্ঞেস করছেন :

হুযাইফা! মুনাফিকদের লিস্টের মধ্যে কি আমার নাম আছে?

তারা নিজেদের ব্যাপারে কী পরিমাণ চিন্তা করতেন! আর আমরা মনে করছি যে, জান্নাত তো আমাদের কেনা! কারণ আমরা হক্ব বুঝেছি – হক্বের উপর চলছি – হক্ব জামাতের সাথে আছি। তো আমরা জান্নাতে না গেলে জান্নাতে যাবে কে!! আমাদের মধ্যে এই মারাত্বক একটা আত্মম্ভরিতা কাজ করে। আমাদের তো কোন নেক আমলের বা নিজের চরিত্র সংশোধনের – নিজেদের নিয়ম কানুন মানার প্রয়োজন নাই! অথচ উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এর মতো ব্যক্তি, তিনি আতংকিত – আশংকাগ্রস্ত যে, না জানি তার নাম মুনাফিকদের মধ্যে আছে!!

পূর্ববর্তীদের আদর্শ ৩:

আসলে বাস্তবতা হলো, হাসান বসরি রাহিমাহুল্লাহ বলেন :

ما اصبح ولا امسخ مؤمن الا وهو يخاف النفاق علي نفسه

কোন মু’মিন কোন সন্ধ্যা অথবা সকাল এমন তার হয় না যে, সে তার নিজের ব্যাপারে নেফাকের আশংকায় ভীত না থাকে

মানে মু’মিন হলে তার মধ্যে নেফাকের আশংকা থাকবে। আতংকিত থাকবে যে, না জানি আমি নেফাকের মধ্যে পড়ে যাই। না জানি আমার মধ্যে নেফাক চলে আসে। না জানি মুনাফিকির গুণ আমার দ্বারা প্রকাশ পায়। কে আতংকে থাকবে? কী হলে?? মু’মিন হলে। তো যে যতবেশি ঈমানের মধ্যে পোক্তা হবে, সে ততবেশি নিজেকে নিয়ে আতংকিত থাকবে। যার মধ্যে ঈমানের অবস্থা যত দূর্বল হবে, সে ঈমান চলে যাওয়া নিয়ে বা ঈমান বিষয়টা নিয়ে ততবেশি উদাসিন থাকবে! চিন্তা থাকবে না তার!!

পূর্ববর্তীদের আদর্শ ৪

তাবেয়ী ইবনে আবি মুলাইকা, তিনি বলেন :

ادركت ثلاثين من اصحاب محمد صلي الله عليه و سلم كلهم يخشي النفاق علي نفسه

আমি ত্রিশজন (৩০) সাহাবীকে পেয়েছি, প্রত্যেকেই তার নিজের উপর মুনাফিকির ভয়ে আতংকিত থাকতেন, না জানি আমি মুনাফিকির মধ্যে পড়ে যাই

আর বাস্তবে মুনাফিকি – ছোট ছোট নেফাকগুলি – এগুলো বড় নেফাকের কারণ হয়ে যায়। যেমন নাকি গোনাহগুলি পথ হলো কুফুরির। গোনাহ করতে করেতে মানুষ কুফুরির মধ্যে লিপ্ত হয়ে যায়।

المعاصي بريد الكفر

কুফুরির পোষ্টঅফিস(ডাকঘর) কি? গোনাহ

গোনাহের মধ্যে লিপ্ত হয়। পরে আস্তে আস্তে মানুষ কুফুরির মাঝে লিপ্ত হয়ে যায়। বারবার যখন গোনাহ করতে থাকে তখন ঈমান তার সলব (سلب) হয়ে যাওয়ার – ঈমান তার থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যায়। মৃত্যুর সময় তখন সে আর আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করতে পারে না। আর আল্লাহর ব্যাপারে কুধারণা রেখে যখন কেউ মৃত্যু বরণ করে, তখন সে বেঈমান হয়ে মৃত্যু বরণ করে। আল্লাহর রহমত সে আর পায় না। এটা একটা বড় মারাত্মক পয়েন্ট।

গোনাহের মধ্যে যখন কেউ বারবার জড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন মৃত্যুর সময় তার এই গোনাহের কারণে আল্লাহর উপর কোন আশা জাগ্রত হয় না! আর রহমতের আশা না থাকার কারণে – নিরাশ থাকার কারণে, এই নিরাশার কুফুরি নিয়ে মারা যায়!!

আর যখন কেউ নেক আমলের জন্য কষ্ট করতে থাকে, হয়তো সারা জীবন সে কষ্ট করে গেছে – নিজের ব্যাপারে সে আতংকিত ছিল – ভয়ের মধ্যে ছিলো। তখন দুই ভয় আল্লাহ তা’য়ালা একত্রিত করেন না। মৃত্যুর সময় তার আশাটা প্রবল হয়ে যায়। আর তখন আল্লাহ তা’য়ালার ব্যাপারে সে একটা সুধারণা নিয়ে মৃত্যু বরণ করে যে, আল্লাহ আমাকে মাপ করবেন।

انا عند ظن عبدي بي

আমার বান্দা আমার ব্যাপারে যেই ধারণা পোষণ করবে, আমি সে অনুযায়ী তার সাথে আচরণ করবো

মৃত্যুর সময় ভালো ধারণা নিয়ে সে মারা গেলো, সে আল্লাহ পাকের ভালো আচরণ পাবে। আর মৃত্যুর সময়টা এমন যে সেখানে ইচ্ছা করে কোনকিছু করার থাকে না।

এগুলো দেখেন না, যখন মানুষ হোচট খায় – ধাক্কা খায়, কেউ বলে “মারে”, কেউ বলে “বাপরে”, কেউ অন্য কোন শব্দ করে। কেউ বলে “ইন্না লিল্লাহ”। এরকম বিভিন্ন শব্দ করে না? সে যে দেশের সে দেশের একটা শব্দ সে উচ্চারণ করে। সেই উচ্চারণটা কিন্তু সে ইচ্ছা করে না। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়।

মৃত্যুর ধাক্কা লাগার সময় যারা সারাটা জীবন চেষ্টা করে গেছে সৎ থাকার জন্য, তখন তার ঐ ভালো জিনিসই তার মুখ দিয়েও বের হবে। আর মনের মাঝেও তার ভাল জিনিসই জাগ্রত হবে। আশাটাই তার জাগ্রত হবে।

আর যে পাপাচারের মধ্যে ডুবে ছিলো, তার মৃত্যুর সময় নৈরাশ্য তাকে গ্রাস করে নিবে। তখন সে ভাববে আমার কোন ক্ষমা নেই। আমার কোন মাফ হবে না। আর ঐ অবস্থায় যদি তার মৃত্যু হয়ে যায়, সে মাফ পায়ও না।

তো যখন জীবন যাপন করতেছে, দুনিয়েতে বসবাস করতেছে, নিজের উপর আতংকিত থাকা – এটা কাম্য। আর এই আতংকিত থাকার পিছনে যখন নিজের সারাটা জীবন কাটাতে থাকে, তখন মৃত্যুর সময় তার আশাবাদটা বেড়ে যায়।

নেফাকির চরিত্রের উপর যখন কেউ নাকি দৃঢ় থাকে, তখন নেফাকি তার মধ্যে স্থায়ী হয়ে যায়। তখন ঐ মুনাফিকি অবস্থায়ই – খালেস মুনাফিকি অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়।

এখানে মূল উৎসটা কী ছিলো? এখানে আমরা যে বিষয়টা আলোচনা করতেছি, মূল উৎসটা কী ছিলো? নিজের ব্যাপারে – নিজেকে নিরাপদ মনে করা। আত্মম্ভরিতায় লিপ্ত হওয়া। নিজেকে নিয়ে নিজে তুষ্ট থাকা। নিজেকে বড়কিছু মনে করা।

এখন এর বিপরীতটা হলো বিনয়। যে নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞান করা – নিজেকে ছোট জ্ঞান করা – নিজেকে অসহায় মনে করা। আর এই অসহায়ত্বটা, এটা প্রকাশ পায় কথা দিয়ে – কাজ দিয়ে – পোষাক পরিচ্ছদ দিয়ে – আসবাব পত্র দিয়ে – বাড়িঘর দিয়ে। এই পাঁচ ভাবেই অসহায়ত্বটা প্রকাশ পায়। এখন যখন এই পাঁচ লাইনেই কেহ বিনয়ের অবস্থাটা ধরে রাখে, সে ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ বিনয়ী হয়ে যায়।

আর এর বিপরীতটাই হলো অহংকার – কিবির। কথাবার্তায়, কাজেকর্মে, পোষক-পরিচ্ছদে, আসবাব-পত্রে, বাড়ি ঘরের দিক দিয়ে সে বিপরীতটা করছে। সব হাইফাই – সব উন্নত। সব নতুন-নতুন মডেলের। এই প্রবণতা তার মধ্যে আর প্রতিযোগিতা। লোক দেখানোর প্রবনতা। এগুলো নিয়ে যখন ব্যস্ত হয়ে থাকে, মানুষে অহংকারের মধ্যে জড়িয়ে যায়। এই সবগুলোর ক্ষেত্রে যখন নাকি সে এভাবেই চলতে থাকে, তখন পরিপূর্ণ মুতাকাব্বের হিসেবে সে নিজেকে গড়ে তুলে। মুতাকাব্বের হয়েই যায়।

আসলে অহংকার এবং বিনয় এর মূল হলো : অন্তর। কিন্তু বাহ্যিক এই বিষয়গুলি দিয়ে – কথাবার্তা, কাজে-কর্মে – প্রকাশ পায় এটা।

পূর্ববর্তী বিজ্ঞজনরা সেটা বলেছেন যে :

সবচেয়ে বেশি বিচক্ষণ ব্যক্তি হলো, যে নিজের গুনাহগুলকে গুণে। অন্য মানুষের অপরাধ এবং গুনাহ এর ব্যাপারে সে সেখানে থেমে যায়। সেটার পিছনে সে ছুটে না।

من ابصر عيبه لم يعد احدا

কেহযদি নিজের দোষ দেখে তাহলে অন্যকে সে দোষী বানবে না

و من عمي عنه لم يرشد ابدا

আর কেউ যদি নিজের দোষ দেখার ব্যাপারে অন্ধ থাকে, সে কখনও তার রাস্তা পাবে না

তার তখন দোষই নাই! তাওবাহ করবে কী? সে শোধরাবে কী? ভালো হবে কী? আমি কোন দোষের কাজ জীবনে করছি যে, আমি ঠিক কাজ করবো এখন!? এইযে মানসিকতা – আমার দ্বারা কোন ভুল হয়ই না! আমি যা করি সব ঠিক করি! এই লোকটা এখন ঠিক হবে কীভাবে বলেন? এমন কিন্তু প্রচুর বিদ্যমান, যে নিজেরটাকেই ঠিক ভাবে।

পূর্ববর্তীদের আদর্শ ৫

উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু মসজিদে দাড়িয়ে খুতবাহ দিচ্ছেন। তিনি বলছেন যে, তোমরা মহিলাদের মোহর খুব বেশি করে নির্ধারণ করো না। এটা কোন সম্মানের বস্তু না। এক মহিলা দাড়াইয়া বলতেছে :

উমর! আপনার কথা মানবো না কোরআনের কথা মানবো?

উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু মসজিদে দাড়াইয়া খুতবাহ দিচ্ছেন, খলিফাতুল মুসলিমিন। সাধারণ একজন মুসল্লি। তারপরও মহিলা সে। এই ভর-মজলিসে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর কথার প্রতিবাদ করে উঠছেন। তারপরও কী? শরয়ি একটা বিষয়। ইসলামী একটা বিষয়ের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের ক্ষেত্রে।

উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এভাবে বলছেন যে, মোহর বেশি নির্ধারণ করা, এটা আল্লাহর নিকট সম্মানের কোন বিষয় না। তোমরা মোহর খুববেশি নির্ধারণ করো না। মহিলা দাড়াইয়া বলতেছে – “আপনার কথা মানবো না আল্লাহর কথা মানবো”?

উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন – “আল্লাহর কথা এক্ষেত্রে কী”? মহিলার কাছে তিনি জিজ্ঞেস করছেন, এক্ষেত্রে আল্লাহর কথাটা কী? তিনি এটা বলেন নাই, হেই মহিলা! তুমি আল্লাহর কথা কী জানলা এই ব্যাপারে? তুমি কে? আমি রাসুলের সাথে এতদিন কাটাইছি! এত – এতগুলো কর্মকাজ আমার দ্বারা হইছে! সতের (১৭বার) ওহী নাযিল হয়েছে, আমি যেভাবে বলছি সেইভাবে। আমি বুঝি না আর তুমি বুঝ”?!!

না। তিনি জিজ্ঞেস করছেন, কোরআনে এই ব্যাপারে বক্তব্যটা কী? মহিলা বলছেন, আল্লাহ তা’য়ালা কোরআনে বলেছেন :

وَإِنْ أَرَدتُّمُ اسْتِبْدَالَ زَوْجٍ مَّكَانَ زَوْجٍ وَآتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنطَارًا فَلَا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئًا  أَتَأْخُذُونَهُ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُّبِينًا [٤:٢٠]

আর তোমরা যদি এক স্ত্রীর স্থলে আরেক স্ত্রী বদলে নিতে চাও এবং যদি এদের একজনকে একস্তূপ দিয়ে থাকো, তবে তা থেকে কিছুই নিও না। তোমরা কি তা নেবে কুৎসা রটিয়ে এবং ডাহা অন্যায় করে? [:২০]

বৃদ্ধ মহিলা এবার বলছেন- “স্বর্ণের স্তুপ কি তোমার এই বার (১২) উকিয়ায় হয়”? আল্লাহ পাক অবকাশ দিয়ে রেখেছেন যে, স্বর্ণের স্তুপও মোহর হিসেবে দেয়া যাবে। আর তুমি বলছো, মোহর তোমরা বেশি দিও না! উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু সাথে সাথে মহিলার কথা কী করেছেন? শুধু মেনেই নেন নাই। এই ভর-মজলিসে তিনি বলেছেন যে- “একজন মহিলা পর্যন্ত উমর এর চেয়ে কোরআন ভালো বোঝে”

সত্যের সামনে এভাবেই নত ছিলেন তারা। এজন্য আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে এতো উন্নত বানিয়েছেন।

من تواضع لله رفعه الله

আল্লাহর জন্য যে নত হবে, আল্লাহ তা’য়ালা তাকে উঠিয়ে দিবেন উন্নত করে দিবেন

ومن تكبر علي الله وضعه الله

আর যে আল্লাহর উপর আগে বেড়ে যাবে, আল্লাহ তা’য়ালা তাকে নিচু করে দিবেন

সত্যের সামনে এভাবে নত হয়ে যাওয়াটা, মানুষের হেদায়াতের উপর থাকার জন্য একটা অপরিহার্য বিষয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত নিজের রায় – নিজের যুক্তি – নিজের চিন্তা ভাবনা থেকে সরাসরি সব সিন্ধান্ত নিয়ে নিতেন না। এটি হলো নিজের সিন্ধান্তের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা পরিহারের নমুনা।

খেয়াল খুশির অনুসরণ ১

এবার দেখি নিজের খেয়াল খূশির অনুসরণের নমুনা।

আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই। যুদ্ধের ব্যাপারে পরামর্শ হচ্ছে। মদিনায় থেকে যুদ্ধ করা হবে নাকি মদিনা থেকে বের হয়ে যুদ্ধ করা হবে? আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই পরামর্শ দিলো : মদিনায় থেকেই যুদ্ধ করাই সমীচিন হবে আর অন্যান্য অনেক সাহাবীর সিদ্ধান্তই ছিলো, বিশেষ করে নবীন সাহাবায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত ছিলো : মদিনা থেকে বের হয়ে আমরা যুদ্ধ করবো

যাইহোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ বের হয়ে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছেন

তো আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মনঃপুত হয়নি। তার খেয়াল-খুশি অনুযায়ী সিদ্ধান্তটা হয়নি। তার খেয়াল-খুশি অনুযায়ী না হওয়ার কারণে সে কী বলেছে?

وَلِيَعْلَمَ الَّذِينَ نَافَقُوا  وَقِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا قَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوِ ادْفَعُوا  قَالُوا لَوْ نَعْلَمُ قِتَالًا لَّاتَّبَعْنَاكُمْ  هُمْ لِلْكُفْرِ يَوْمَئِذٍ أَقْرَبُ مِنْهُمْ لِلْإِيمَانِ  يَقُولُونَ بِأَفْوَاهِهِم مَّا لَيْسَ فِي قُلُوبِهِمْ  وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا يَكْتُمُونَ [٣:١٦٧]

আর যেন তিনি জানতে পারেন তাদের যারা কপটতা করে তাদের বলা হয়েছিল, “এসো! আল্লাহ্‌র পথে যুদ্ধ করো অথবা আ‌ত্মরক্ষা করো।” তারা বলেছিল,  যদি আমরা বুঝতাম এটা কোন যথাযথ যুদ্ধ, তাহলে অবশ্যই তোমাদের সাথে আমরা গমন করতাম[:১৬৭]

একথা বলে সে যুদ্ধ থেকে পিছনে সরে এসেছে। যুদ্ধে যায় নাই। তার খেয়াল-খুশি মত হয় নাই। একারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নেতৃত্বে চলা যুদ্ধটাকেও সে সঠিক যুদ্ধ বলতে পারছে না এবং সেটার সঙ্গ না দিয়ে সে পিছনে সরে চলে এসেছে।رئيس المنافقين   এই হলো মুনাফিকদের সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের আচরণ। অনুসরণ না করে নিজের যুক্তির পিছনে ছুটা।

খেয়াল খুশির অনুসরণ ২

এর চেয়েও বড় উদাহরণ দেখেন, আল্লাহ তা’য়ালা ফেরেস্তাদেরকে নির্দেশ দিলেন :

وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ [٢٠:١١٦]

আর আমরা যখন ফিরিশ্‌তাদের বললাম,তোমরা আদমকে সেজদা করো তখন তারা সিজদা করলকিন্তু ইবলিস করল না। সে অমান্য করল। [:১১৬]

ইবলিশ যুক্তি দেখালো কী? আমি আগুনের তৈরি। আদম হলো মাটির তৈরি। আগুনের ধর্ম হলো উপরের দিকে গমন করা। সে মাটির তৈরি আদমের সামনে নত হয় কী করে! এটা যুক্তি বহির্ভূত। সে নিজের যুক্তি – নিজের খেয়াল খুশি এর পিছনে ছুটছে। আল্লাহর নির্দেশের সামনে সে মাথা নত করে নাই!

আমাদের বর্তমানে এই বিভিন্ন দল, বিভিন্ন শ্রেণী, বিভিন্ন গোষ্ঠী এত ভাগ হওয়ার একটা কারণ এটাও যে, আমরা সত্যের সামনে নিজেকে সমর্পন করে দিই না। একেক জন একেকটা দলীয় মনোভাব, একেকটা গোষ্ঠীগত অবস্থান। দেশীয় বা বিভিন্নভাবে আমরা  একটা যুগ প্রবণতায়(সমাজে যেটা প্রচলিত সেটা গ্রহন করার প্রবনতা) আমরা আক্রান্ত হয়ে আছি। এখন সেই অনুকূলে যদি আমার কোন জিনিস হয়, তাহলে আমি সেটাকে মানি। আর বিপরীত যদি হয়, তাহলে আর মানি না!

হক্বকে হক্ব হিসেবে রেখে, যেখান থেকেই আসুক আমি এটাকে গ্রহণ করবো। এই মানসিকতাটা আমাদের থেকে উঠে গেছে। যারা যেই দলের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছে, ঐ দলের পক্ষ থেকে যদি কিছু আসে, সেটাকে আমরা মানি। হক্ব যেভাবে আছে, সেভাবে আমরা নিজেকে ঘুরাই না। আমরা যেভাবে আছি সেটাকে ঠিক রেখে হক্বটাকে ঘুরিয়ে ফেলি। আমাদের উপযোগী করে ফেলি। ব্যাখ্যা অপব্যাখ্যা দিয়ে অথবা কাট-ছাট করে।

খুদ বদলতে নিহী, কোরআন বদল দেতে হোনিজে পরিবর্তন হয় না, কোরআনকে পরিবর্তন করে দেয়

ঘুরিয়ে নিজের সাথে এটাকে ফিট করে। নিজেকে কোরআন অনুযায়ী, কোরআনের ছাঁচে গড়ে তুলে না। নিজে ঐভাবে ঘুরে যায় না। অপব্যাখ্যা দিয়ে – বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে নিজের সাথে মিলায়। ফেরআউনের ব্যাপারে একজন ব্যাখ্যা মিলিয়েছে। ফেরআউন সে জান্নাতে যাবে! দলিল কী? আল্লাহ তা’য়ালা কোরআনে কারীমে ফেরআউনের ব্যাপারে বলছেন :

النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا  وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ [٤٠:٤٦]

তাদের কাছে আগুন আনা হবে সকালে ও সন্ধ্যায়আর কেয়ামতের দিন ফিরআউনের লোকদের কঠোরতম শাস্তিতে প্রবেশ করাও [৪০:৪৬]

এইযে কোরআন শরীফে নির্দেশ এসেছে। এটার ব্যাখ্যা দিয়েছে কী? عذاب এর মূলমাদ্দা হলো عذب আর عذب অর্থ মিষ্টি। اشد العذاب মানে ফেরআউন ভালো মিষ্ট অবস্থান -মধুর অবস্থানের মধ্যে থাকবে। ব্যাখ্যা দিয়ে নিজের পক্ষে নেয়া যেকোন বিষয়কে! আল্লাহ তা’য়ালা মানুষদেরকে হাইওয়ানে নাতেক বানিয়েছেন। মানে সে কথা ঘুরাতে পারে। এজন্য ঘুরিয়ে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু এটা হেদায়াতের পথ না। ইবলিশও নিজের কাজের ব্যাপারে একটা না একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে। যেকেউ নিজের কাজের ব্যাপারে একটা না একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারে।এজন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা  মুনাফিকদেরকে বলেছেন যে,

[٩:٦٦]  تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُم بَعْدَ إِيمَانِكُمْ لَا

তোমরা ওযর দেখাবে না তোমরা ঈমান আনার পর আলবৎ  অবিশ্বাস করেছো [:৬৬]

(لا تعتذرو)اওযর দেখাবে না। ওযর দেখানোর দরকার নাই। এই সমস্যা ছিলো – সেই সমস্যা ছিলো। এগুলো দেখানোর দরকার নাই। দেখালে তো মিথ্যা কথাই বলবা। তোমাদেরকে তোমাদের অবস্থায় ছেড়ে দিলাম। সামনে দেখা যাবে, কী করো? আর ওযরের পিছনে যারা ছুটে, এরা কোনদিনও সংশোধন হয় না। একটার পর একটা মিথ্যা। একটার পর একটা অজুহাত। একটার পর একটা ওসিলা- এগুলি বানাইয়াই ফেলে। আর বানাতে-বানাতে তার একটা যোগ্য হইয়া যায়। তখন আর সংশোধনের রাস্তা তার জন্য খোলা থাকে না।

পূর্ববর্তীদের আদর্শ ৬

স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় যাওয়ার পরে আনসারি সাহাবিদেরকে দেখেছেন যে, তারা খেজুরের গাছের মধ্যে পরাগায়ন করে। নিজেরা পুরুষ গাছের ফুল মাদা গাছের মধ্যে নিয়ে শুকায়। তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভাবছেন যে, এটা মনে হয় একটা অপ্রয়োজনীয় জিনিস। সাধারণত ফল – ফুলের এই বিভিন্ন পরাগায়ণ হয় বাতাস দিয়ে, পশুপাখি দিয়ে, বিভিন্ন কীটপতঙ্গ দিয়ে, ফড়িং-টরিং এগুলি দিয়েই।

তো রাসূল ভাবছেন যে, খেজুরের পরাগায়ণটার জন্য আলাদাভাবে ফুল শুকানোর হয়তো প্রয়োজন নাই। এটা মনে হয়, তারা এমনেই করছে। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন, তোমরা এটা না করলেও তো পার। সাহাবায়ে কেরাম এক বৎসর এই পরাগায়ণ করেন নাই – ফুল শুকান নাই। ঐ বৎসর ফল কম আসছে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

انتم اعلم بامور دنيائكم

তোমাদের দুনিয়েবি এই বিষয়গুলি তোমরা ভালো জানো

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবী। এখানে তিনি নিজের কোন অদৃশ্য পবিত্রতা দেখিয়ে কোনকিছু চাপিয়ে দেন নাই। এটা দুনিয়েবি একটা তাজরেবার বিষয়। একটা অভিজ্ঞতার বিষয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এই বাস্তবতাটাকে মেনে নিয়েছেন।

এখানে আসলে আমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে যে, আসলে সত্যকে সত্য হিসেবে নেওয়া এবং এটাকে গ্রহণ করে নেয়া – এটা হলো শরিয়তের কাম্য। আর এর পথে বাঁধা হলো মানুষের অহংকার। আর এই অহংকার আর ঈমান দুইটা একসাথে থাকে না।

যে প্রয়োজনে নিজেকে বিনয়ী বানাতে পারবে, নিজের অহংবোধটা, নিজেকে নিজে ভালো মনে করাটা – এটাকে ছাড়তে পারবে হক্বের পথে থাকাটা – তার জন্য সম্ভব হবে।

পূর্ববর্তীদের আদর্শ ৭

সুলহে হুদাইবিয়ার সময় সাহাবায়ে কেরামের সবার সিদ্ধান্ত ছিলো : আমরা এই সন্ধি করবো না আমরা যুদ্ধ করবো কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন : না সন্ধি মেনে নিতে হবে

দেখেন তারা নিজেদের রায়ের উপর – নিজেদের মতের উপর অটল না থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সিদ্ধান্তকেই মেনে নিয়েছেন। আর মেনে নেবার ফল কী হইছে? আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন :

إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِينًا [٤٨:١]

তোমাদেরকে আমি ফাতহে মুবিন দিয়ে দিলাম বড় বিজয় দিয়ে দিলাম এই বিজয় অচিরেই তোমাদের হাতে এসে যাবে [৪৮:]

পূর্ববর্তীদের আদর্শ ৮

দেখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আল্লাহর নবী হওয়া সত্বেও সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে মাশওয়ারা করতেন। নিজে যদি সিদ্ধান্তের ব্যাপারে একবারে নিজেকে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেন আর স্বতন্ত্র হিসেবে ধরে রাখতেন, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি পরামর্শ করতেন? প্রয়োজন ছিলো?

তারপরও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে পরামর্শ করেছেন। শুধুমাত্র পরামর্শ করেছেনই না বরং সাহাবায়ে কেরামের মাশওয়ারা অনুযায়ী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। আবু বকর এবং উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে বলেছেন যে,

তোমরা দুইজন যে বিষয়ের উপর একমত হয়ে যাবে, আমি সে বিষয়ে আর কোন দ্বিমত পোষণ করবো না সেই বিষয়ে আমি সিদ্ধান্ত দিয়ে দিবো

তো দেখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবী হয়েও অন্যের সিদ্ধান্তের উপর নিজের সিদ্ধান্ত রাখছেন না। নিজের থেকে সরাসরি সিদ্ধান্ত দিয়ে দিচ্ছেন না। এইযে মেনে নেয়া। আসলে মূল ইসলামের বানীই হলো যে,

আমরা মানবো নিজের পক্ষ থেকে কিছু করবো না

কেউ যদি খেয়াল খুশি মত ইবাদত বন্দেগীও করে, তারপরেও সেটা ইবাদত হবে না। আর যদি মান্যতার সাথে কাউকে হত্যাও করে, তারপরও সেটা পুণ্যতার কাজ হয়ে যাবে। নেককাজ হয়ে যাবে।

আর এজন্য আমরা হলাম আসলে মান্যকারী। মুসলিম অর্থই হলো মান্যকারী। সে আসলে নিজের থেকে চলে না। সে আল্লাহকে মেনে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী নিজেকে পরিচালনা করে। এটাই হলো মুসলিম।

আর এই মান্যতা যার মধ্যে আসলো না, সে আসলে মুসলিম হলোই না। সুবিধা অনুযায়ী আমি চললাম। যেটা সুবিধা হলো, সেটার অনুসরণ করলাম। যেটা সুবিধা-স্বার্থের অনুযায়ী হলো না, সেটার অনুসরণ করলাম না। এটার নাম শরিয়ত পালন না।

কাফের মুশরিকরা যত কাজ করে, সব কাজ কি এরা শরিয়ত বিরোধী করে? এজন্য কি তারা যখন সেই কাজ করছে, তখন কি তাদেরকে বলা হবে যে, তারা শরিয়তের কাজ করছে। না। ঐ কাজগুলো তাদের মনের বিরোধী না হিসেবে এবং তাদের স্বার্থের বিপরীত না হিসেবে, সেগুলি তারা করছে। তাই এরদ্বারা তারা পুণ্যবান হয়ে যাবে না। নেককার হয়ে যাবে না। তখনও তাদেরকে বলা হবে না যে,

তারা পুণ্যবান পুণ্যের কাজ করছে

আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে আমল করার তাওফিক দিন। আমিন।

ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

 

—————————

 

Al Firdaus Logo.n.png

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twelve − eight =

Back to top button