আকিদা-মানহাজপাকিস্তানবই ও রিসালাহমাওলানা আসিম উমরহযরত উলামা ও উমারায়ে কেরাম

দাওয়াতে খিলাফত ও মানহাজে রাসূল সা. – মাওলানা আসিম উমর হাফিজাহুল্লাহ । পিডিএফ/ওয়ার্ড

এই উম্মতের জন্য ব্যক্তিগত ও সংঘবদ্ধ জীবনের প্রতিটি স্তরে পথ প্রদর্শনের জন্য কুরআন-সুন্নাই যথেষ্ট। চাই সেটা কোন ব্যক্তির বাহ্যিক ও আত্মিক তথা যাহের ও বাতেনের সংশোধনের মাসআলা হােক অথবা লক্ষ কোটি মানুষের জীবনের গতি পরিবর্তনকারী আন্দোলনের ভিত্তিই হােক । আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ, আমাদেরকে এমন পরিপূর্ণ ও ত্রুটিমুক্ত
পথ-প্ৰদৰ্শন করে, যে আর কোনদিকে দৃষ্টিপাত করা এই মহান নেয়ামতের প্রতি অবমূল্যায়ন ও বােকামি বৈ কিছু নয়। আজ এই উম্মতের নওজোয়ানদের এমন আহলে ইলমের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং চাহিদা রয়েছে যারা পশ্চিমা চিন্তা ও দর্শনের ঈমানবিধ্বংসী আক্রমণের মাঝেও সামনে অগ্রসর হয়ে তাকে সামলে নেবে। তাদের মনের জটিলতা ও সন্দেহকে প্রজ্ঞা, মুহাব্বত এবং সান্ত্বনার মাধ্যমে দূর করে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কদমে এনে বসাবে……….

দাওয়াতে খিলাফত ও মানহাজে রাসূল সা.

 

ডাউনলোড

পিডিএফ লিঙ্ক:

www.mediafire.com/file/7npo3q3tc4ojl8c/Dawate_Khilafat_O_Manhaje_Rasool_Sm..pdf

 

ওয়ার্ড লিঙ্ক:

https://archive.org/download/20220603_20220603_1232/%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%93%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%87%20%E0%A6%96%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%A4%20%E0%A6%93%20%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%87%20%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%82%E0%A6%B2%20%EF%B7%BA.docx

https://mega.nz/file/RENiHY6I#QXyFNNohaPz4osaAcCNKb6UrS16fE6tEs2UXexvWZ0A

https://u.pcloud.link/publink/show?code=XZKXtzVZyNTKkEzktGpz2dAvdMClFRu2zTry

https://www.mediafire.com/file/p4rx695ik010n2x/%25E0%25A6%25A6%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%2593%25E0%25A6%25AF%25E0%25A6%25BC%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%2587_%25E0%25A6%2596%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AB%25E0%25A6%25A4_%25E0%25A6%2593_%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A8%25E0%25A6%25B9%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%259C%25E0%25A7%2587_%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2582%25E0%25A6%25B2_%25EF%25B7%25BA.docx/file

 

*****

دعوت خلافت

اور منهج رسول ﷺ

দাওয়াতে খিলাফত

মানহাজে রাসূল ﷺ

মাওলানা আসেম উমর হাফিযাহুল্লাহ

 

 

 

   দাওয়াতে খিলাফত

  ও মানহাজে রাসূল

 

মাওলানা আসেম উমর হাফিযাহুল্লাহ

অনুবাদ

মোল্লা আবু লাবীব

     মাকতাবাতুল কুরআন

নিখুঁত         মুদ্রণ     ও               প্রকাশনা                    প্রতিষ্ঠান

ইসলামী টাওয়ার, ১১ বাংলাবাজার, ঢাকা। ফোন: ০১৯১৪৭৩৫০১৩

প্রথম প্রকাশ: এপ্রিল ২০১৬ ঈ.

দাওয়াতে খিলাফত ও মানহাজে রাসূল সা.প্রকাশক: মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ • স্বত্ব: প্রকাশক কর্তৃক সংরক্ষিত • প্রচ্ছদ: আবু উমায়ের • কম্পোজ: আল-কুরআন কম্পিউটার গ্রাফিক্স সিস্টেম ১১, বাংলাবাজার, ঢাকা।

মূল্য: ৪০ টাকা মাত্র

ISBN : 984-70098-0012-0

 

 

ইনতিসাব

দ্বীনের পথে নিবেদিতপ্রাণ সকল।

দাঈয়ে ইসলামের মকবুলিয়াত

এবং আমার আত্মার আত্মীয়

স্নেহের খাওলা, খানসা, শামিলের

উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনায়।

সূচিপত্র

বিষয়                                            নাম্বার

প্রাক কথন. 7

অনুবাদকের কথা.. 8

শুরুর কথা.. 9

অবতরণিকা.. 11

দ্বীনের দাওয়াত কিভাবে দিতে হয়?. 12

দাওয়াতের কয়েকটি মূল ভিত্তি.. 12

এক. শ্রোতাদের নিকট দাওয়াত পৌছানোর সুযোগ সন্ধান করা.. 12

সাইয়্যেদিনা হযরত ইবরাহীম (আ.)- এর দাওয়াত. 13

হযরত মুসা (আ.)- এর দাওয়াত. 14

দুই. শ্রোতার মেজাজ ও ব্যক্তিত্ব বুঝা.. 15

তিন. সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়া বিপজ্জনক. 21

চার.অবস্থার প্রেক্ষিতে আলোচনা করা.. 24

পাঁচ.অবস্থার ভিন্নতায় নির্দেশের ভিন্নতা.. 26

ছয়. প্রতিপক্ষের কথাও মনোযোগ দিয়ে শুনা.. 27

সাত. গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ ব্যক্তিদের ওপর মেহনত করা.. 27

আট. সাধারণ দাওয়াত ও বিশেষ দাওয়াতের মধ্যে পার্থক্য করা.. 27

নয়. নির্বাচিত বাক্য ও উপযুক্ত শব্দ চয়ন. 28

দশ. যে সকল বিতর্ক দাওয়াতের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা থেকে নিজেকে বাঁচানো   29

এগার. বিতর্কে প্রমাণভিত্তিক জবাবের পরিবর্তে অভিযোগমূলক জবাব দেয়া.. 29

বার. দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে দাওয়াত দেয়া.. 31

তের. পরীক্ষার মুখোমুখী হলে দৃঢ়পদ থাকা.. 32

শেষ কথা.. 34

 

 

 

 

প্রাক কথন

যদিও এই উপমহাদেশ দ্বীনি জামা’আত এবং ইসলামী আন্দোলনের এক মজবুত কেন্দ্র, বহু বছর ধরে বিভিন্ন আন্দোলনের দাওয়াত এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং প্রত্যেক আন্দোলন তার দাওয়াতকে মৌখিক ও বক্তৃতার মাধ্যমে জনসাধারণের নিকট পৌছিয়েছেন কিন্তু বাংলা ভাষায় এমন রচনার অভাব দীর্ঘদিন যাবৎ অনুভব হচ্ছিল যা স্বয়ং ঐ সকল হযরতদেরকে উদ্দেশ্য করে লিখা যারা অন্যকে দাওয়াত দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উপবিষ্ঠ, এবং তাদের সামনে দাওয়াতের শরঈ আদাব ও দাওয়াতের নিয়ম-নীতিকে সুস্পষ্ট করবে। বক্ষমান কিতাবটি বিশিষ্ট মুজাহিদ আলেম হযরত মাওলানা আসেম ‘উমর (দা.বা.)-এর সংক্ষিপ্ত কিন্তু সমৃদ্ধ এক রচনা যা উল্লেখিত বিষয়ের অভাবকে দূর করার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই কিতাবে তিনি তার নিজস্ব বর্ণনাভঙ্গি ও হৃদয়ের গভীরে রেখাপাত করার মতো পদ্ধতিতে দ্বীনের দাঈদেরকে সম্বোধন করেছেন এবং কুরআনের আয়াত ও আম্বিয়ায়ে কিরামের আদর্শের আলোকে দাওয়াতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আদব লিপিবদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা তাকে এই মূল্যবান প্রচেষ্টার জন্য উত্তম বিনিময় দান করুন এবং অন্যান্য উলামায়ে কিরামকেও উৎসাহ প্রদানের উসিলা বানিয়ে দিন, তাহলে তারা হয়ত দ্বীনি দাওয়াতের শরঈ নিয়মনীতির অন্যান্য বিষয়াবলীর ওপরও কলম উঠাতে পারবেন এবং এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শরিয়তের শিক্ষাকে সামাজিকভাবে বিশেষ করে দ্বীনি আন্দোলনের কর্মীদের সামনে সহজ পদ্ধতিতে পেশ করবে। এই রচনাটি এজন্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ যে তার লেখক নিজেও জিহাদী কাফেলার একজন অগ্রপথিক এবং এই কিতাবের পাঠকদের মধ্যেও অনেকে জিহাদের সাথে সম্পৃক্ত পৃষ্ঠপোষক ও দায়িত্বশীল। দ্বীনের দাওয়াতকে প্রচার প্রসার করা এবং আল্লাহ তা’আলার কালিমাকে প্রতিষ্ঠিত করা জিহাদের মূল উদ্দেশ্য। প্রত্যেক মুজাহিদ একই সময়ে মুকাতিল মুজাহিদ এবং পৃথিবীবাসীর জন্য বার্তাবাহক দাঈও।

 

অনুবাদকের কথা

সকল প্রশংসা সেই রবুল আলামিনের জন্য যিনি আমাদেরকে ইসলামের মতো পরিপূর্ণ এক দ্বীন তথা জীবন বিধান দান করেছেন। লক্ষ-কোটি দুরুদ ও সালাম সেই নবীউস-সাইফ, নবীউল মালাহিম মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর; যিনি আপন দেহ মুবারকের পবিত্র খুন ঝরিয়ে এই দ্বীনকে ধরণীতে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

প্রিয় পাঠক! আজ হতে দেড় হাজার বছর পূর্বে নবীউস-সাইফের হাতে গড়া যেই কাফেলা এই দ্বীনকে বিজয়ী করতে বদরের প্রান্তর থেকে পথচলা শুরু করেছিল, রক্ত পিচ্ছিল সেই কাফেলার সেই পথচলা অজও চলমান এবং কেয়ামত অবধি চলবে অবিরাম। নবীজীর ভবিষ্যবাণী অনুযায়ী কোন জালিমের জুলুম-নির্যাতন কিংবা ইনসাফগারের ইনসাফ বিপ্লবী এই কাফেলার অগ্রযাত্রা রুখতে পারবে না।

সেই নির্ভিক কাফেলার বর্তমান সময়ের এক অকুতোভয় সেনাপতি, পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন মাওলানা আসেম উমর দা.বা.।

হজরতের ব্যক্তিত্ব ও রচনা ইতোমধ্যে এ দেশের সচেতন পাঠকের নিকট ব্যাপক সমাদৃত। তার লিখিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে ছোট্ট একটি পুস্তিকা “দাওয়াতে খিলাফত আওর মানহাজে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।” যার বাংলা অনুবাদ এখন আপনার হাতে। দ্বীনের দাঈদের জন্য পুস্তিকাটি একটি আদর্শ পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

নিজের হাজারো অযোগ্যতা সত্ত্বেও এই মহান কাফেলার সাথে সামান্য সম্পৃক্ততার নিয়্যতেই অধমের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। পরিশেষে প্রার্থনা, অনুবাদ ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে যে যেভাবে সহযোগিতা করেছেন- সকলকে আল্লাহ তা’আলা তার শান অনুযায়ী জাজায়ে খায়ের দান করুন। এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে কাল কেয়ামতে আমাদের সকলের নাজাতের উসিলা হিসেবে কবুল করুন, আমীন।

                                                                            বিনয়াবনত

                                                                         মোল্লা আবু লাবীব

                                                                       ২৭ জমাদিউস সানী ১৪৩৭ হি.

 

শুরুর কথা

بسم الله والحمد لله والصلاة والسلام علي رسول الله وبعد

আমাদের এই উপমহাদেশ যদিও দ্বীনি জামাআত ও ইসলামী আন্দোলনের এক মজবুত ঘাঁটি, যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দ্বীনি আন্দোলনের দাওয়াত এখানে বিদ্যমান এবং প্রতিটি আন্দোলনই তার দাওয়াতকে মুখে মুখে ও বয়ান বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌছিয়েছে কিন্তু উর্দু ভাষায় এমন রচনার অভাব বহুদিন হতে অনুভূত হচ্ছিল যা স্বয়ং ঐ সকল ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে লেখা যারা অন্যকে দাওয়াত দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন এবং তাদের সামনে দাওয়াতের শরঈ আদব ও নিয়ম-কানুন স্পষ্ট করবে। এই বিষয়ে এই ক্ষুদ্র পুস্তিকাটি মুজাহিদ আলেমে দ্বীন মাওলানা আসেম উমর দামাত বারকাতুহুমের সংক্ষিপ্ত কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা উল্লেখিত বিষয়ের অভাব কিছুটা হলেও পূরণ করবে। এই পুস্তিকায় লেখক নিজস্ব ও হৃদয়গ্রাহী বাচনভঙ্গিতে দ্বীনের দাঈদের সম্বোধন করেছেন এবং কুরআনের আয়াত ও আম্বিয়া (আ.)-এর আদর্শের আলোকে দাওয়াতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আদব বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা’আলা তাকে এই মহতি কর্মের উত্তম প্রতিদান দান করুন এবং অন্যান্য আহলে ইলমকে উদ্বুদ্ধ করণের হাতিয়ার হিসেবে পুস্তিকাটি কবুল করে নিন। যেন তারা দ্বীনি দাওয়াতের শরঈ নিয়ম-কানুন সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়েও কলম ধরেন এবং এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্বন্ধে শরঙ্গ নির্দেশনা, বিশেষ করে দ্বীনি আন্দোলনের কর্মীদের সামনে সহজ পদ্ধতিতে উপস্থাপন করেন।

এই পুস্তিকাটি এজন্যও গুরুত্বপূর্ণ যে এর লেখক নিজেও জিহাদী কাফেলার পথপ্রদর্শক এবং এই লেখার মূল সম্বোধিত হলেন, জিহাদী কাফেলার সাথে সম্পৃক্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ । দ্বীনের দাওয়াতিকে প্রচার প্রসার করা এবং আল্লাহ তা’আলার কালিমাকে সমুন্নত করাই জিহাদের মূল উদ্দেশ্য। প্রত্যেক মুজাহিদ একই সময়ে মুকাতিল তথা কাফিরকে হত্যাকারী মুজাহিদ যেমন হয় তেমনি বিশ্ববাসীর জন্যে এক মহান বাণীর বার্তাবাহক দায়ীও হয়ে থাকেন। যদিও কিতালের জন্য শরীয়ত পৃথক অদব শিখিয়েছেন এবং দাওয়াতের জন্যও পৃথক। দাওয়াত ও কিতালের আদব সম্পর্কে জানা এবং তার অনুসরণই এই কথার জামানত হতে পারে যে মুজাহিদ ফী সাবিলিল্লাহ তার পথ চলার কঠিন সময়ে কখনোই শরীয়তের নির্দেশাবলীর খেলাফ করবে না এবং তার আন্দোলন দুনিয়াতেও সেই সুফল বয়ে আনবে যা প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ের প্রশান্তির কারণ হবে। এ জন্য মুজাহিদদের বিশেষভাবে এই কিতাবটি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করা এবং এই নববী আদর্শের দ্বারা নিজেদের জীবন-চরিতকে সজ্জিত করা। অপরিহার্য। আমরা বিশেষ করে মুজাহিদ দায়িত্বশীলদের, তাদের মিডিয়ার বিভিন্ন শাখার কর্মকর্তা তাদের খতিব-বক্তা, লেখক, সাহিত্যিক, মুরুব্বী ও উলামা অনলাইন জগতের সৈনিকগণ এবং বাস্তব রণাঙ্গনে মুখোমুখি দাওয়াত প্রদানকারী মুজাহিদ ভাইদের নিকট অনুরোধ করবো যে, তারা যেনো এই পুস্তিকাটি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েন এবং নিজেদের ইলমী ও আমলী নেসাবের অন্তর্ভুক্ত করে নেন, যাতে এহইয়ায়ে খিলাফত এবং নেফাযে শরীয়তের দাঈগণ এই পবিত্র আন্দোলনে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি, সাহায্য ও সহযোগিতা অর্জন করতে পারে।

এই কিতাবের প্রতি পৃষ্ঠায়, প্রতি লাইনে এই বার্তাও লুকায়িত আছে যে, এই উম্মতের জন্য ব্যক্তিগত জীবন ও সংঘবদ্ধ জীবনের প্রতিটি স্তরে পথ প্রদর্শনের জন্য কুরআন-সুন্নাই যথেষ্ট। চাই সেটা কোন ব্যক্তির তথা বাহ্যিক ও আত্মিক যাহের ও বাতেনের সংশোধনের মাসআলা হোক অথবা লক্ষ কোটি মানুষের জীবনের গতি পরিবর্তনকারী আন্দোলনের ভিত্তিই হোক। আল্লাহর কিতাব ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ আমাদেরকে এমন পরিপূর্ণ ও ত্রুটিমুক্ত পথ-প্রদর্শন করে যে আর কোনদিকে দৃষ্টিপাত করা এই মহান নেয়ামতের প্রতি অবমূল্যায়ন ও বোকামি বৈ কিছু নয়। আজ এই উম্মতের নওজোয়ানদের এমন আহলে ইলমের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবও রয়েছে এবং চাহিদাও রয়েছে যারা পশ্চিমা চিন্তা ও দর্শনের ঈমানবিধ্বংসী আক্রমণের মাঝেও সামনে অগ্রসর হয়ে তাকে সামলে নেবে। তাদের মনের জটিলতা ও সন্দেহকে প্রজ্ঞা ও মুহাব্বত এবং সান্ত্বনার মাধ্যমে দূর করে তাদেরকে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কদমে এনে বসাবে। আল্লাহ তা’আলা এই উম্মতকে তার স্বীয় কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর সাথে নিজেদের সম্পর্ক মজবুত করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

وصلي الله علي نبينا وعلي اله وصحبه وسلم!

 

অবতরণিকা

কোন জাতির যখন পতন আসে সেই পতন তখন কোন নির্দিষ্ট একটি শ্রেণি বা গোষ্ঠীর ওপরই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং জীবনের সকল স্তর তার ধ্বংসের আওতায় এসে যায়। চিন্তা ও চেতনার মধ্যে স্থবিরতার সৃষ্টি হয়। সকল কর্মতৎপরতা নিঃশেষ হয়ে শুধু কল্প-কাহিনিই রয়ে যায়। সামাজিক ঐক্য টুকরো টুকরো এবং মনে সংকীর্ণতা সৃষ্টি হয় আর দৃষ্টির প্রসারতা শুধুমাত্র উদরপূর্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। পতনের এই কুপ্রভাব যেমনি দ্বীনি কর্মকাণ্ডের ওপর প্রভাব ফেলে তেমনি দুনিয়াবী কর্মকাণ্ডও সেই ধ্বংসের আওতায় চলে আসে। তেমনি মুসলিম উম্মাহর ওপর পতনের যে দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে তা মুসলিম জীবনের প্রতিটি স্তরকেই প্রভাবিত করেছে। অবনতি থেকে উন্নতির দিকে পথচলা এবং এই পথচলার জন্য কোন কাফেলা তৈরি করা কোন সহজ কজি নয়। পরাধীন থাকতে থাকতে পরাধীনতাকেই নিজের ভাগ্য জ্ঞানকারীর এ কথা কিভাবে বুঝে আসবে উঁচু ও পাহাড়ের কংকরময় ভূমিতে বাসস্থান গড়ার প্রয়োজনীয়তা কী? যখন নিচেই তাদের দু’বেলা রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়, তখন খামখা এতো উঁচুতে গিয়ে বসবাস করা কোন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হতে পারে? তখন এ সমস্ত লোক নিজেদের বাপ-দাদাদের জ্ঞানকেও মূর্খতা জ্ঞান করতে শুরু করে এবং তাদের কখনো এ কথা বুঝেই আসে না যে তারা পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে কেনো বসবাস করেছেন।

পতনের দিকে ধাবমান এবং হীনম্মন্যতার স্বীকার লোকদের নিকট রাহবার ও পথপ্রদর্শকও এমনই ভালো লাগে যিনি উন্নতির পরিবর্তে পতনের দিকে পথ-প্রদর্শন করেন। কেউ যদি উন্নতির দিকে পথচলার আহ্বান করে তাহলে এই কষ্টসাধ্য সফরের জন্য সেই জাতি কি করে প্রস্তুত হতে পারে যারা অবনতির দিকে অবতরণেই অভ্যস্ত। তাই তাদের বক্তা, পথ-প্রদর্শক, কবি, সাহিত্যিক তাদেরকে এই অবনতির উপকারিতাই বর্ণনা করে এবং এই জীবনাচারেই লিপ্ত রাখে।

যেহেতু পরাধীনতার হীনম্মন্যতার স্বীকার জাতিকে উন্নতির দিকে পথচলার জন্য প্রস্তুত করা কোন সহজ কাজ নয় বরং তাদের জন্য দাঈকে সর্বশক্তি ব্যয় করতে হয়। তাই এহইয়ায়ে খিলাফত-এর আন্দোলন পরিচালনাকারী দাঈ, বক্তা এবং লেখকদের এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে এই ময়দানে পা ফেলতে হবে।

যে কোন আন্দোলনের দাওয়াত প্রদানকারীর জন্য জরুরি যে, সে অবিরাম চেষ্টা, সীমাহীন পরিশ্রম – ধৈর্য শুধা পানে অভ্যস্ত হবে। দাওয়াতের ফলাফল ও  স্বচক্ষে না দেখে মনক্ষুন্ন হবে না; বরং আরশ – কুরসির মালিকের ওপর ভরসাকারী হবে এবং এমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা হবে যে যদি হাজার বছরও দাওয়াত দিতে হয় এবং একটি মানুষও এই দাওয়াত কবুল না করে তাহলে এই দাওয়াতের মধ্যে বিন্দু পরিমাণ অবসাদ ও ক্লান্তি আসবে না।

দ্বীনের দাওয়াত কিভাবে দিতে হয়?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে উত্তম আদর্শ কেউ হতে পারে না। তাই আমাদের জন্য জরুরি হলো আমরা আমাদের দাওয়াতকে ইমামুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত অনুযায়ী পরিচালনা করা।

আমাদের দাওয়াত তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকায় হবে। আমরা যদি এই কথার পরওয়া না করি এবং নিজেদের ইচ্ছে মতো দাওয়াত দিতে থাকি তাহলে মনে রাখবে যে নিঃসন্দেহে আমাদের কথা যতই সত্য ও সঠিকই হোক না কেন এবং আমরা যতই ইখলাসের সাগরে হাবুডুবু খাই না কেন, কিন্তু তা মানুষের সামনে উপস্থাপনের পদ্ধতিগত ভুলের কারণে মানুষ আমাদের সঙ্গী হওয়ার পরিবর্তে শত্রুতে পরিণত হয়ে যাবে।

দাওয়াতের কয়েকটি মূল ভিত্তি

এক. শ্রোতাদের নিকট দাওয়াত পৌছানোর সুযোগ সন্ধান করা

দাঈর জন্য জরুরি হল, সে এমন সুযোগের সন্ধানে থাকবে যে কখন শ্রোতা তার দাওয়াতকে শোনার জন্য মনোযোগী হবে। সময় মতো বলা অত্যন্ত সাদামাঠা কথাও শ্রোতার ওপর অনেক শুভকর বয়ে আনে। বিপরীতে অনুপযুক্ত স্থানে এবং অসময়ে অনেক জ্ঞানগর্ব আলোচনাও কোন উপকারে আসে না। এমনিভাবে কখনো কখনো অনেক ভালো কথাও অনুপযুক্ত স্থানে বলার দ্বারা দাওয়াতের উপকারের পরিবর্তে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বুঝার জন্য কিছু উপমা পেশ করা হচ্ছে।

সাইয়্যেদিনা হযরত ইবরাহীম (আ.)- এর দাওয়াত

সাইয়্যেদিনা হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর জাতিকে ঐ সময় দাওয়াত দিয়েছেন যখন সমগ্র জাতি তার দিকে মনোযোগী ছিলেন। যখন তিনি মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেললেন এবং কাফির নেতৃবর্গ তাকে সবার সম্মুখে দাঁড় করাল এবং জিজ্ঞাস করল, হে ইবরাহীম আমাদের দেবতাদের এই অবস্থা কি তুমি করেছো? সাইয়্যেদিনা ইবরাহীম (আ.) উত্তর দিলেন-

قَالَ بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا فَاسْأَلُوهُمْ إِن كَانُوا يَنطِقُونَ

অর্থাৎ এই কাজটি এই বড় মূর্তিটিই করেছে সুতরাং তোমরা তাকেই জিজ্ঞাস করো, যদি সে বলতে পারে। [সূরা আম্বিয়া -৬৩]

একজন দাঈর জন্য কখনো কখনো এমন সুবর্ণ সুযোগ সামনে এসে যায় যখন তার সকল শ্রোতা পুরোপুরি মনোযোগের সাথে তার দুই ঠোটের নড়াচডা পর্যন্ত অনুভব করে থাকে। তাই ঐ সময় দাঈ তার পুরো দাওয়াতকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করে থাকে। এটা সেই দাঈর দূরদর্শিতা এবং আল্লাহ তা’আলার তাওফিকের ওপর নির্ভর করে। যেহেতু হযরত ইবরাহীম (আ.)- এর সংক্ষিপ্ত বাক্য বিরোধী কাফিরদের ওপর ঐ কুঠারের ধারের চেয়েও হাজারো গুণ ধারাল ছিল যেটা দিয়ে তিনি তাদের প্রতিমাগুলো ভেঙ্গে ছিলেন। এই বাক্য শুধুমাত্র জনসাধারণের মধ্যেই নয় বরং তাদের নেতাদেরও লজ্জাকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা তাদের জাতির সামনে এই কথাকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছে যা সাধারণ অবস্থায় কখনোই স্বীকার করে না। তারা বলতে লাগল-

لَقَدْ عَلِمْتَ مَا هَؤُلَاء يَنطِقُونَ

তুমি তো ভালোকরেই জানেনা যে এই দেবতা কথা বলতে পারে না। [সূরা আম্বিয়া -৬৫]

قَالَ أَفَتَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكُمْ شَيْئًا وَلَا يَضُرُّكُمْأُفٍّ لَّكُمْ وَلِمَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ أَفَلَا تَعْقِلُونَ

হযরত ইবরাহীম (আ.) বললেন, তোমরা কেন আল্লাহ ব্যতীত এমন দেবতাদের ইবাদত করো যেগুলো না তোমাদের কোন উপকার করতে পারে কোন ক্ষতি করতে পারে, দুঃখ হয় তোমাদের ওপর এবং তোমাদের দেবতাদের ওপর। তোমাদের কি জ্ঞান-বুদ্ধি বলতে কিছুই নেই? [সূরা আম্বিয়া-৬৬-৬৭]

ফায়দা

এই ঘটনা দ্বারা একথা জানা গেল দাঈ এমন সুযোগের তালাশে থাকবে যখন মানুষ তার কথা শুনতে চাইবে। অথবা যদি সে এমন সুযোগকে হারিয়ে ফেলে তাহলে কবির ভাষায়

زمانہ بڑےغور سےسن رہاتھا • ہمیں سو گۓ داستاں کہتے کہتے

যমানা অনেক মনোযোগ দিয়ে শুনতে ছিলো আমরা ঘুমিয়ে পড়েছি কাহিনি বলতে বলতে।

হযরত মুসা (আ.)- এর দাওয়াত

হযরত মুসা (আ.) ফেরাউনের দরবারে যখন মু’জিযা দেখালেন তখন ফেরাউন বলল যে, এটাতো জাদু, সুতরাং আমিও তোমাদের মোকাবেলায় আমার জাদুকরদের নিয়ে আসবো, একটি সময় নির্ধারণ করো। হযরত মুসা (আ.) বললেন,

قَالَ مَوْعِدُكُمْ يَوْمُ الزِّينَةِ وَأَن يُحْشَرَ النَّاسُ ضُحًى

নির্ধারিত দিনটি তাহলে রাজকীয় অনুষ্ঠানের দিনই হোক। এবং সময় হলো দিনের শুরুতে যখন লোকজন জমা হবে। [সূরা ত্বা-হা -৫৯]

ফায়দা,

সাইয়্যেদিনা হযরত মুসা (আ.) এখানে একটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন, আর তা হলো যে লোকজন বেশি থেকে বেশি জমা হয়। এজন্য তিনি রাজকীয় অনুষ্ঠানের দিনকে নির্ধারণ করেছেন। কেননা রাজকীয় অনুষ্ঠানের দিন তাদের মেলা হয় এবং মেলার দিনেও তিনি সময়টা এমন সময় পছন্দ করেছেন যখন সকল লোকজন মেলায় পৌছবে, যেন সকলের সামনে সত্যের সত্যতা ও ভ্রান্তির ভ্রান্ততা প্রমাণ হয়ে যায়। ক্ষমতাশীল শ্রেণি সর্বদাই এই চেষ্টা করে যেন সত্যের দাওয়াত জনসাধারণ পর্যন্ত পৌঁছতে না পারে। সুতরাং দাঈকে একথা ভাবতে হবে, সে তার দাওয়াতকে জনসাধারণ পর্যন্ত কিভাবে পৌঁছাবে।

বর্তমানেও দাওয়াতী ময়দানে নিয়োজিত মুজাহিদদের এমন সুযোগের তালাশে থাকা চাই কখন তার দাওয়াতকে বেশি থেকে বেশি মানুষের নিকট পৌছানো যাবে।

এর একটি উদাহরণ হল হযরত ইউসুফ (আ.)- এর ঘটনা। তিনি জেলখানায় উপস্থিত কয়েদীদেরকে তখনই দাওয়াত দিয়েছেন যখন কয়েদীরা তার নিকট তাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে এসেছে।

দুই. শ্রোতার মেজাজ ও ব্যক্তিত্ব বুঝা

শ্রোতার মন-মেজাজ এবং তার ব্যক্তিত্ব ও সে অনুযায়ী চাহিদা বুঝতে হবে। কোন আন্দোলন যদি তার শ্রোতার মন ও মেজাজকে না বুঝে তাকে সম্বোধন করে তাহলে ভবিষ্যতে দাওয়াতের মধ্যে এমন ভুল-ভ্রান্তি প্রকাশ পাবে যার কারণে শ্রোতা তার সঙ্গ দেওয়ার পরিবর্তে তার বিরোধী হয়ে যাবে অথবা কমপক্ষে তার দাওয়াতের প্রতি উদাসীন হয়ে যাবে। যেমন আরব বিশ্ব এবং হিন্দুস্থান-পাকিস্তানের কথাই ধরুন। এখানে প্রত্যেক এলাকার বাসিন্দাদের মেজাজ ভিন্ন ভিন্ন। কারো সাথে কারো মেজাজের মিল নেই। এখানে যদি আপনারা একই পদ্ধতিতে সকল এলাকার মুসলমানদেরকে আপনার বার্তা পৌছাতে চান তাহলে তারা আপনার দাওয়াতের প্রতি মনোযোগী হবে না। এমনিভাবে শ্লোগান ও প্রচারণার ক্ষেত্রেও যদি আপনি আপনার দেশের শুধুমাত্র এক এলাকার অবস্থাকেই সামনে রাখেন এবং এই দাওয়াত ও শ্লোগানকে পুরো দেশের মুসলিমদের জন্য ঘোষণা দিয়েদেন তাহলে ঐ নির্দিষ্ট শ্রেণি তো অবশ্যই আপনার দাওয়াতের প্রতি মনোযোগী হবে যাদের অবস্থার ওপর ভিত্তি করে আপনি শ্লোগান নির্বাচন করেছেন কিন্তু বাকি এলাকার মুসলিমগণ এদিকে মোটেই কর্ণপাত করবে না। ([1])

এমনিভাবে কোন বাক্য কোন একটি এলাকার লোকজনের জন্যে অনেক অর্থবোধক এবং তেজোদীপ্ত হতে পারে কিন্তু সেই একই বাক্য অন্য কোন এলাকার জন্য একেবারেই অনর্থকও হতে পারে; যা শুনে তাদের কানে মাছিও সরবে না। আবার কখনো একটি বাক্য কোন এলাকাবাসীর জন্যে তেমন মন্দ বা বাজে কিছু নয় কিন্তু সেই একই বাক্য অন্য এলাকায় যারপর নাই মন্দ, লজ্জাকর ও সমাজ-সামাজিকতার ক্ষেত্রে চরম আপত্তিকরও মনে হতে পারে। তাইতো আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এই দাওয়াতী উসূলের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন,

وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلاَّ بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ فَيُضِلُّ اللّهُ مَن يَشَاء وَيَهْدِي مَن يَشَاء وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

অর্থাৎ এবং আমি কোন রাসূল প্রেরণ করিনি তার স্বজাতির ভাষা ব্যতীত যেনো সে তার স্বজাতিকে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে পারে। [সূরা ইবরাহীম–৪] সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে যে দাঈ তার শ্রোতাকে এমন চমৎকারভাবে তার দাওয়াতকে বুঝাবে যে শ্রোতা খুব সহজেই গোটা দাওয়াতকে বুঝে যাবে। চমৎকার বর্ণনা তো তা যা শ্রোতার মন ও মেজাজ অনুযায়ী হবে। খুলে বর্ণনা করার দ্বারা উপকার হয় এই যে, লোকেরা ভালোভাবে আপনার আন্দোলন সম্পর্কে অবগতি লাভ করে, তারা আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে যায়। কিন্তু আপনি যদি আপনার শ্লোগান তথা মূল মিশন ও উদ্দেশ্য খোলাখুলি বর্ণনা না করেন তাহলে লোকজন আপনার দিকে মনোযোগী হওয়া কঠিন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাওয়াতের বেলায় সর্বদাই শ্রোতার মেজাজ ও মর্তবা – ব্যক্তিত্বের প্রতি লক্ষ রাখতেন এবং সংক্ষিপ্ত ও হৃদয়গ্রাহীভাবে দাওয়াত দিতেন। হজ্জের মৌসুমে যখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন গোত্রের নিকট গিয়ে দাওয়াত দিতেন তখন ওখানেও তিনি এবিষয়টি খুব লক্ষ্য রাখতেন, দাওয়াত যেনো শ্রোতার মন মেজাজ অনুযায়ী হয়। যেমন মদীনা থেকে আগত লোকদের যখন দাওয়াত দিলেন তখন তারা জিজ্ঞাস করল যে, আপনি কোন বিষয়ের প্রতি আমাদের দাওয়াত দিচ্ছেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি তোমাদের এই কথার দাওয়াত দিচ্ছি যে, কোন শক্তিমান কোন দুর্বলের ওপর জুলুম করবে না, ইয়াতীম ও অসহায়ের প্রতি খেয়াল রাখবে, মেহমানের মেহমানদারী করবে ও মুসাফিরকে খানা খাওয়াবে। যেহেতু মদীনাবাসী ও অন্যান্য আরবদের মাঝে উল্লেখিত বিষয়গুলো ইজ্জত ও সম্মানী বিষয় মনে করা হতো তাই তাদের নিকট শুরুতেই ইসলামের ঐরূপকেই তুলে ধরা হয়েছে যা উক্ত গোত্রগুলোর নিকটও অনেক উত্তম হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছিল। এমনকি কুরাইশ সর্দারদের দাওয়াত দেয়ার বেলায়ও এই বাস্তবতাকে ভুলে যাননি। যার ফলে যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত দিন দিন বাড়তে লাগলো এবং কাফিরদের অত্যাচার, কঠোরতা এবং সমূহ নির্যাতন সত্ত্বেও সাহাবায়ে কিরাম (রা.) ইসলামের ওপর অটল অবিচল ছিলেন তখন কুরাইশের বিশেষ একটি শ্রেণি নবীজীর চাচা আবু তালেবের নিকট আসল এবং বিচার দিল, তোমার ভাতিজা আমাদের ধর্মের মধ্যে দোষ বের করে আমাদের দেবতাদেরকে মন্দ বলে এবং আমাদেরকে বোকা ও নির্বোধ সাব্যস্ত করে। সুতরাং আপনি তাকে বুঝান অথবা আপনি তার এবং আমাদের মধ্য থেকে সরে যান।

আবু তালেব নবীজীকে ডেকে পাঠালেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাশরিফ আনলেন তখন বললেন, ভাতিজা! তোমার জাতি তোমার নামে অভিযোগ করেছে এবং এমন এমন বলে, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, চাচাজান! আমি তো তাদেরকে এমন এক কালিমার স্বীকারোক্তি দেয়ার কথা বলি, যদি তারা শুধু একবার এই কালিমাকে মেনে নেয় তাহলে তাদের গোটা আরব ও আজমের সর্দারি মিলে যাবে। এ কথা শুনামাত্র সকল সর্দার একবাক্যে বলে উঠল যে, আমাদেরকে দ্রুত বলে, এমন কালিমা তো আমরা একবার কেন দশবার পড়তে প্রস্তুত; যার দ্বারা আমাদের আরব ও আজমের সর্দারি মিলবে।

ফায়দা.

প্রিয় পাঠক, একটু ভাবুন তো! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশ সর্দারদের মেজাজের প্রতি লক্ষ রেখে এমন কথা বললেন, যা সেই সর্দারগণকে সাথে সাথে তার দিকে মনোযোগী করে তুললো। কেননা কুরাইশ সর্দারদের নবীজীর দাওয়াতের দ্বারা আসল ভয়ই ছিলো যে এই দাওয়াতের কারণে তাদের কর্তৃত্ব ও সর্দারি চলে যায় কি না? এ জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের এই আশঙ্কার জবাব দিয়েছেন যে আমি তো তোমাদেরকে এমন এক কালিমার দিকে আহ্বান করছি যেই কালিমা মানলে তোমরা শুধু আরবেরই নয় বরং আজমেরও সর্দার ও শাসক হয়ে যাবে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বাহরাইনের বাদশাহকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন তখন সেখানেও তিনি এ কথা লিখলেন যে, কালিমা পড়ে নাও, তোমাদের গোটা এলাকা তোমাদের অধীনেই থাকবে। যদিও এই কালিমা পড়ার আসল ফায়দা তো আখেরাতে; কিন্তু মানুষের স্বভাব হলো সে প্রথম এই দুনিয়াবী দৃষ্টিতেই ভাবে, যে নতুন এই দাওয়াত যা আমাদের সামনে পেশ করা হচ্ছে এর মাঝে আমাদের জন্য কী রয়েছে?

স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা যিনি এই কথার মুখাপেক্ষী নন যে কে এই দ্বীনকে মানলো আর কে মানলো না। তিনিও কুরআনে কারীমে যেখানে ইসলামের দাওয়াত গ্রহণকারীদেরকে জান্নাতের বিশ্বাস স্থাপন করাতে চেয়েছেন সেখানে দুনিয়ার ব্যাপারেও তাদেরকে এক উত্তম নিরাপদ জীবনের ওয়াদা দিয়েছেন। আরব্য সমাজে দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টি থেকে মুক্তি এবং ব্যাপক জুলুম অত্যাচারের পরিবেশ এর পরিবর্তে নিরাপদ জীবন। এ দুটি বিষয় ছিল তাদের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তথা সবিশেষ কামনার বস্তু। যেমন আল্লাহ তা’আলা মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ইরশাদ করেন,

فَلْيَعْبُدُوا رَبَّ هَذَا الْبَيْتِالَّذِي أَطْعَمَهُم مِّن جُوعٍ وَآمَنَهُم مِّنْ خَوْفٍ

অর্থ, সুতরাং তারা যেন তাদের সেই ঘরের প্রতিপালকের ইবাদত করে যিনি তাদেরকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় আহার দিয়েছেন এবং ভয়ের সময়ে নিরাপত্তা। [সূরা কুরাইশ- ৩-৪]

 আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা আরো ইরশাদ করেন,

وَضَرَبَ اللّهُ مَثَلاً قَرْيَةً كَانَتْ آمِنَةً مُّطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِّن كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللّهِ فَأَذَاقَهَا اللّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُواْ يَصْنَعُونَ

অর্থ. আল্লাহ তা’আলা দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন এমন এক জনপদের যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত, যেথায় অসততা সর্বদিক থেকে প্রচুর জীবনোপকরণ, অতঃপর তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করলো, ফলে তারা যা করতো তার জন্যে আল্লাহ তাদেরকে আস্বাদন করালেন ক্ষুধা ও ভীতির আচ্ছাদন। [সূরা নাহল -১১২]

এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা এমন এক এলাকার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন যা সম্পূর্ণ শান্তিময় ও নিরাপদ ছিলো। সেখানে সামাজিক নিরাপত্তা ছিল এবং তাদের সর্ব প্রকার জীবনোপকরণের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তথাপিও তারা আল্লাহ তা’আলার হুকুমের বিরুদ্ধাচরণ ও আল্লাহ তা’আলার এই সকল নিয়ামতের না শুকরি করেছিল, যার ফলে আল্লাহ তা’আলা সেই এলাকাবাসীর ওপর থেকে উক্ত নিয়ামত ছিনিয়ে নিলেন এবং তাদের জীবনোপকরণ ধ্বংস করে তাদের ওপর দুর্ভিক্ষ চাপিয়ে দিলেন এবং নিরাপত্তা ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ওপর ভীতির সঞ্চার করে দিলেন।

এই বাস্তবতাও স্মরণ রাখা জরুরি, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এটাও অন্তর্ভুক্ত যে তারা সেই সময় পর্যন্ত কোন জিনিসের গুরুত্ব অনুভব করে না অথবা সেদিকে পরিপূর্ণ মনোযোগী হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের সামনে এই দেখা ও না দেখা বস্তুসমূহের দৃশ্যপট তুলে না ধরা হবে। তাইতো চির অমুখাপেক্ষী প্রভুও এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি লক্ষ রেখেছেন এবং তাঁর জান্নাতের দিকে দাওয়াত দেয়ার সময় এমনভাবে জান্নাতের দৃশ্যপট এঁকেছেন যেনো শ্রবণকারী ব্যক্তি তার চোখের সামনে তা দেখতে পায়। তাই আমরা কুরআনে কারীম তিলাওয়াত করার সময় যখন ঐ সব আয়াত পাঠ করি যেখানে জান্নাতের বাগানসমূহ এবং ঝর্ণার আলোচনা রয়েছে- সর্বোত্তম পোশাকে সজ্জিত হয়ে, হাতের মধ্যে পানপাত্র নিয়ে, দোলনার মধ্যে হেলান দিয়ে জান্নাতী লোকজন এবং তাদের আশেপাশে শুভ্র মুতি ও পদ্ধরাগ চুনির ন্যায় ঘোরাফেরাকারী হুর গিলমানদের দৃশ্য যেন গোচরীভূত হতে থাকে। তখন হৃদয় তার অজান্তেই রবের জান্নাতের প্রতি লালায়িত হয়ে যায়।

এমনিভাবে যেখানে আল্লাহ তা’আলা জাহান্নামের ভয় দেখিয়েছেন তো তার ব্যাপারেও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন যেনো মানুষের হৃদয়ে জান্নাতের নিয়ামত সমূহ অর্জনের আগ্রহ হয় এবং জাহান্নামের ভয় তাদের চিন্তা-চেতনায় বদ্ধমূল হয়ে যায়। এমনকি আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দাজ্জালের বর্ণনা প্রসঙ্গে নাওয়াস বিন সাময়ান (রা.) বলেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – এর বর্ণনাভঙ্গি এমন ছিলো য, আমাদের এমন মনে হচ্ছিল যেনো আমাদের সামনের খেজুর বাগান হতে এখনই দাজ্জাল বের হয়ে আসবে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে তার খলিফাগণও এই মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। হযরত আনাস বিন মালেক (রা.) বলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) যখন আমাদের সামনে মানুষের জন্মের বর্ণনা দিতেন তখন আমাদের নিজেদের প্রতি নিজেদের ঘৃণা চলে আসতো। তিনি বলতেন, মানুষ দুইবার প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে বের হয়েছে।

সুতরাং খিলাফতের দাওয়াত প্রদানকারীকেও এই মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি লক্ষ্য রাখা চাই। আজ নতুন এক দাওয়াত আপনি দিচ্ছেন, তাই তা এমনভাবে খুলে খুলে বর্ণনা করা চাই যেনো মানুষের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, খিলাফত প্রতিষ্ঠা হলে সাধারণ মুসলমানরা আখেরাতের পূর্বে স্বয়ং এই পৃথিবীতে কী পাবে। এর মধ্যে ব্যবসায়ীদের জন্য কী আকর্ষণ রয়েছে? একজন কৃষক কেন আপনার সঙ্গী হবে? একজন শ্রমিক, হত দরিদ্র মুসলমান কিভাবে আপনার আন্দোলনে অংশ দিবে? জুলুম অত্যাচার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও দুর্নীতির করালগ্রাসে জর্জরিত এই জাতি কোন ভিত্তির ওপর আপনার দাওয়াতের প্রতি মনোেযোগী হবে? শুধু কি এজন্যই যে আপনার দাওয়াত সত্যের দাওয়াত? না কখনোই না! যদি মানুষের জন্যে শুধুমাত্র এতটুকুই যথেষ্ট হতো তাহলে আল্লাহ তা’আলা এই দাওয়াতকে শব্দ এবং বাক্য পরিবর্তন করে করে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে বর্ণনা করতেন না? শুধু এতটুকু ঘোষণা করে দিতেন যে, এটা সত্যের দাওয়াত যে মানবে সে জান্নাত পাবে এবং যে না মানবে সে জাহান্নামী হবে।

উচিত তো ছিলো, আমাদের দাওয়াতে শুধু মুসলমান নয় বরং সাধারণ কাফেরও মনোযোগ দেবে যে এই লোক যেই কথার শ্লোগান লাগাচ্ছে যে, জুলুমের জায়গায় ইনসাফ, ভয় দূর করে শান্তি, বিশেষ শ্রেণির হাতে লাঞ্ছনার পরিবর্তে মানবতার সম্মান, পুঁজিবাদের গ্রাস থেকে মুক্তি, নারীদেরকে বাজারী পণ্য বানানোর পরিবর্তে ঘরের শাহজাদী ও রাণী বানানো। এ সকল শ্লোগান শুনে কাফিরও চিৎকার করে বলে উঠবে যে, এই সবগুলো তো আমারও প্রয়োজন।

তিন. সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়া বিপজ্জনক

যে কোন আন্দোলন যখন আমভাবে দাওয়াতের সূচনা করে তখন তার দাঈদের মাঝে আবেগ ও উদ্যম থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু দাঈ এবং কর্মীগণ সত্যকে বর্ণনা করতে কারো তিরস্কারের পরওয়া করবে না। কিন্তু দায়িত্বশীলদের জন্য জরুরি হলো, তারা এই জজবা-আবেগের মূল্যায়ন করার পাশাপাশি নিজস্ব দাঈ ও কর্মীদের এই কথা বুঝাবে, সত্য কথা সর্বদা সর্ব জায়গায় বলা যায় না। বরং অনেক সময় চুপ থাকাই আন্দোলনের জন্য উপকারী। আপনার দাওয়াতের বিরোধীরা আপনাকে এমন প্রশ্নের বাণে জড়াতে চায় যাতে মুখ খোলা অথবা সুস্পষ্ট জবাব দেয়া উভয়টিই আপনার আন্দোলনের জন্য অনাকাক্ষিত ক্ষতির কারণ হতে পারে। কুরআন ও সুন্নাহ আমাদের এটাই শিক্ষা দেয় যে এমন স্থানে বুদ্ধিমত্তার সাথে কেটে পড়বে।

ইবনে আবি শায়বা রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, উৎবা বিন রাবীয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন যে, তুমি উত্তম না কি আব্দুল মুত্তালিব? যদি তুমি মনে করে যে সে তোমার থেকে উত্তম তাহলে সেও তো সেই দেবতাদের পূজা করতো তুমি যার নিন্দা করো আর যদি তোমার খেয়াল এই হয় যে তুমি তার থেকে উত্তম তাহলেও বলল আমরা শুনি। হাদীসে এসেছে যে,

فسكت رسول الله صلي الله عليه وسلم

অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপ ছিলেন। কারণ এটা এক বিপদজনক প্রশ্ন ছিলো যা আরবের এক অভিজ্ঞ ও বিদগ্ধ বৃদ্ধ খুব বুঝে শুনে করেছেন। এমন মুহূর্ত যে কোন দাঈর জন্য বিশেষত দাওয়াতের সূচনা লগ্নে খুবই বিপদজনক হয়ে থাকে। সামান্য দ্রুততা ও জজবা এবং শরীয়তের মেজাজ ও প্রকৃতির অজ্ঞতা তার দাওয়াতকে সূচনালগ্নেই বাধাগ্রস্ত করতে পারে। একটু ভাবুন তো, যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব দিয়ে দিতেন এবং বলে দিতেন আমি আব্দুল মুত্তালিবের চেয়ে উত্তম; তাহলে এই সূচনালগ্নেই নবীজীর বংশের সেই সকল লোকই নবীজীর বিরুদ্ধে চলে যেতেন যারা তখন পর্যন্ত তার পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং যাদের কারণে কাফেররা নবীজীকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সহ্য করে যাচ্ছিল। আব্দুল মুত্তালিব কুরাইশের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। সুতরাং যদি সামান্য একজন যুবক এমন প্রসিদ্ধ ব্যক্তিকেই ভুল আখ্যা তখনই দিয়ে দিতেন; প্রাথমিক অবস্থায় নবীজীর এতটুকু পৃষ্ঠপোষকতাও মিলতো না যতটুকু ঐ সময় নিজ বংশের নিকট মিলেছিল। কিন্তু তিনি তো আল্লাহ তা’আলার রাসূল ছিলেন তাই তিনি কোন উত্তর দেননি চুপ ছিলেন। অতঃপর উৎবা সামনে কথা শুরু করল। এমন প্রশ্ন ফিরাউন হযরত মুসা (আ.) কে করেছিলেন যখন হযরত মুসা (আ.) ফিরাউনের দরবারে দাঁড়িয়ে তাকে এবং তার রাজসভাসদকে দাওয়াত দিলেন তখন ফিরাউন জিজ্ঞেস করল-

قَالَ فَمَا بَالُ الْقُرُونِ الْأُولَى

অর্থাৎ ফিরাউন বলল, হে মুসা! তুমি যে দাওয়াত দিচ্ছ, আমাদের রব আল্লাহ এবং তাকে ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত যে করবে সে গোমরাহ এবং জাহান্নামে যাবে; তাহলে পূর্বের লোকদের যারা আমাদের এই ধর্মের ওপর ছিল তাদের কী হবে? তারা কি জাহান্নামে যাবে? [সূরা ত্ব-হা: ৫১]

হযরত মুসা (আ.) উত্তরে বললেন,

قَالَ عِلْمُهَا عِندَ رَبِّي فِي كِتَابٍ لَّا يَضِلُّ رَبِّي وَلَا يَنسَى

অর্থাৎ এই কথার ইলম আমার প্রতিপালকের নিকট কিতাবে সংরক্ষিত আছে। আমার প্রভু কারো ব্যাপারে ভুল করেন না। [সূরা ত্ব-হা: ৫২]

যদিও হযরত মুসা (আ.)- এর মতো নির্ভীক নবীর জন্য এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব দেয়া কোন কঠিন ছিল না; কিন্তু যেহেতু সুস্পষ্ট জবাব দিলে দাওয়াতের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিলো এবং লোকদের শুরুতেই তার দাওয়াতের প্রতি ঘৃণা চলে আসতো তাই তিনি অস্পষ্ট জবাব দিয়েছেন এবং পুনরায় তার নিজ দাওয়াত দেয়া আরম্ভ করলেন, আমার প্রভু তিনি যিনি জমিনকে তোমাদের জন্য বিছানা বানিয়েছেন।

যেহেতু হযরত মুসা (আ.) এখনো তার দাওয়াতের সূচনালগ্নে ছিলেন এবং দাওয়াতকে পুরা খোলাখুলি বর্ণনা করতে পারেন নি, লোকেরাও তার দাওয়াতকে এখনো পুরোপুরি গ্রহণ করে নি বরং এখনো ঠিকমতো শুনেও নাই, এজন্য যদি তিনি এই অবস্থায়ই তাদের বাপ-দাদাদেরকে মুরতাদ ও কাফির ঘোষণা দিয়ে দিতেন তাহলে এই বাক্য শুধু হাওয়ায় উড়ন্ত কথাই হতো না বরং অত্যন্ত ভারি ও অসহ্যকর এক বাক্য হতো। তবে যখন দাওয়াত ব্যাপক হয়ে যাবে এবং মানুষ দাওয়াত গ্রহণ করে নেবে তখন তাদেরকে তাদের বাপ-দাদাদের হুকুম বয়ান করার প্রয়োজন হবে না বরং কুফরের প্রতি ঘৃণা তাদের হৃদয়ে এমন বদ্ধমূল হয়ে যাবে, যে কোন অবস্থাতেই তারা কুফরকে সহ্য করতে প্রস্তুত হবে, চাই সেটা তাদের বাপ – দাদাদের মধ্যেই হোক না কেন?

দাঈর তরবিয়ত এমন হওয়া চাই যেনো তার জানা থাকে যে কোথায় মুখ খুলবে এবং কোথায় মুখ একেবারে বন্ধ থাকবে। কোন কথার জবাব দিবে আর কোন কথায় প্রকৃত উত্তর না দিয়ে কোন রকমে গা-বাঁচিয়ে আসতে হবে। বিরোধী শক্তি কিভাবে ফাসাতে চেষ্টা করে এবং তার থেকে বের হয়ে আসার পথ কী হবে?

আমাদের মুরুব্বীরা সর্বযুগে দাওয়াতের এই সূক্ষ্ম বিষয়গুলো খেয়াল রাখতেন। যেমন কেউ যদি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) কে সাহাবাদের মতবিরোধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন তাহলে তিনি বলতেন-

تلك أمة قد خلت

যে তারা এক জাতি ছিল যারা অতীত হয়ে গেছেন, তাদের আমল তাদের জন্য এবং তোমাদের আমল তোমাদের জন্য।

এমনই হযরত ইমাম মালেক (রহ.)- কে কেউ আল্লাহ তা’আলার গুণাবলী সম্পর্কে অধিক প্রশ্ন করলে বলতেন, এগুলোর ওপর ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এ সম্পর্কে অধিক প্রশ্ন করা বিদ’আত।

উপরোক্ত সকল আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, দাঈকে তার দাওয়াতের বেলায় এমন সকল বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে, যে বিষয়গুলো তার দাওয়াতের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। যে কথা ও যে বিষয়ের দাওয়াত দিবে সেই বিষয়ের ওপর কোনরকম দুর্বলতা দেখানো উচিৎ নয়। তবে শব্দ চয়ন ও বর্ণনাভঙ্গি স্থান, কাল, পাত্র ভেদে নির্বাচন করা চাই। যেমন ফিরাউনের মতো জালিমকে দাওয়াত দেয়ার জন্য যখন আল্লাহ তা’আলা হযরত মুসা (আ.) কে পাঠালেন তখন বললেন-

قَالَ لَقَدْ كُنتُمْ أَنتُمْ وَآبَاؤُكُمْ فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ

অর্থাৎ নিঃসন্দেহে তুমি এবং তোমার বাপ-দাদাগণ সুস্পষ্ট গোমরাহিতে আছো। [সূরা আম্বিয়া-৫৪] কিন্তু এমন জবাবও অবস্থার পরিপেক্ষিতে দেয়া হয়েছে। যখন পন্থা অবলম্বন করা ও নির্ভয় কথা বলা বুদ্ধিমত্তার চাহিদা ছিলো।

চার.অবস্থার প্রেক্ষিতে আলোচনা করা

মক্কার কাফিররা যখন মুসলমানদের ওপর নির্যাতন- নিপীড়ন আরম্ভ করল তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর নির্দেশে সাহাবায়ে কিরামের একটি দল হাবশা (ইথিউপিয়া) হিজরত করে চলে গেলেন। হাবশার বাদশা একজন ন্যায়পরায়ন খ্রিস্টান ছিলেন, যাকে নাজ্জাশী বলা হতো। যখন মক্কার কাফিররা এই ঘটনা জানতে পারল তখন তারা তাদের একটি প্রতিনিধি দল পাঠাল যেন তারা নাজ্জাশীর সাথে কথা বলে তাদের বিদ্রোহীদেরকে (মুসলমানদের) হাবশা থেকে বের করে দিতে বাধ্য হয়।

তাই উক্ত প্রতিনিধি দল হাবশা পৌছে নাজ্জাশীকে বলল যে, আমাদের কিছু বিদ্রোহী যারা নতুন এক ধর্ম আবিষ্কার করেছে এবং ভাইকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে, তারা আপনার দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আপনি তাদেরকে আমাদের নিকট সোপর্দ করে দিন অথবা তাদেরকে আপনার দেশ থেকে বের করে দিন। এ কথা শুনে নাজ্জাশী মুসলমানদেরকে তাঁর দরবারে ডেকে পাঠালেন। মুসলমানরা পুরো ব্যাপারটি জানতে পেরে সকলে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন যে, যদি আমাদেরকে মক্কার কাফিরদের নিকট সোপর্দ করে দেয়া হয় তাহলে তো আমাদের ওপর পূর্বের চেয়েও আরো বেশি নির্যাতন – নিপীড়ন করবে। হযরত জাফর ইবনে আবী তালেব (রা.) ও এই মুহাজের কাফিলায় ছিলেন। তিনি বললেন, পেরেশান হয়ো না, আমি যা বলি তার ওপর আমল করো। নাজ্জাশী যদি কোন প্রশ্ন করে তাহলে কেউ জবাব দিবে না শুধু আমি জবাব দিব। মুসলমানরা যখন নাজ্জাশীর দরবারে পৌছল তখন নাজ্জাশী মক্কার কাফিরদের কথা পুনরাবৃত্তি করলেন যে, এই প্রতিনিধি দল কুরাইশ সর্দারদের পক্ষ থেকে এসেছে এবং তোমাদের সম্পর্কে এমন এমন বলছে। হযরত জাফর ইবনে আবী তালেব (রা.) তখন দাঁড়িয়ে আল্লাহ তা’আলার প্রশংসা করার পরে বললেন, হে বাদশা! আমরা মূর্খ ও অসভ্য ছিলাম, আমাদের মাঝে না আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিলো না অন্য কোন সম্পর্কের মূল্য, শিরিক ও মূর্তিপূজায় এবং অজ্ঞতায় লিপ্ত ছিলাম। তারপরে আল্লাহ তা’আলা আমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন। আমাদের হিদায়েতের জন্য আমাদের মধ্য হতেই এমন এক ব্যক্তিকে তার রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন যার বংশ ও বংশীয় মর্যাদার সাক্ষ্য গোটা আরববাসী দেবে। এই যুবক কখনো মিথ্যা বলেন না। তিনি এসে আমাদেরকে শিখিয়েছেন আল্লাহ কে এবং দ্বীন কী?

এই বক্তব্যের পরে নাজ্জাশী জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের নবীকে যেই কুরআন দিয়ে পাঠানো হয়েছে তা থেকে আমাকে শুনাও তো দেখি। হযরত জাফর (রা.) যে আয়াত তখন তিলাওয়াত করলেন তা উপস্থিত সভাসদদের মেজাজ অনুযায়ী ছিলো। এবং তাদের ওপর প্রতিক্রিয়াশীল ছিলো, কেননা তারা ছিলো খ্রিস্টান, এজন্য হযরত জাফর (রা.) সূরা মরিয়মের শুরুর দিকের আয়াতগুলোই তিলাওয়াত করেছেন। যা শুনে নাজ্জাশীর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে ছিলো এবং মুসলমানদেরকে কাফিরদের সোপর্দ করতে অস্বীকার করলেন।

মক্কার কাফিররা যখন দেখলো তখন তারা কৌশলে কাজ আদায় করার জন্যে অন্য পথে নাজ্জাশীর কান ভারি করে বলতে লাগলেন যে এই মুসলমানগণ নিজেদের ব্যতীত অন্য সবাইকে ভ্রান্ত মনে করে। আপনি তাদেরকে আপনার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করুন; দ্বিতীয় দিন নাজ্জাশী পুনরায় মুসলমানদেরকে ডেকে পাঠালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা হযরত মাসিহ (আ.) সম্পর্কে কী বলে?

মুসলমানদের জন্য এই পরিস্থিতিটা অনেক কঠিন ছিলো; সত্যকে গোপন করা যাচ্ছে না আবার প্রকাশও করা যচ্ছিল না। এমন পদ্ধতিতে বয়ানও করতে পারছিলেন না যাতে মুসলমানদের জন্য সেখানে থাকা কঠিন হয়ে যায়। তাই হযরত জাফর ইবনে আবী তালেব (রা.) বললেন যে, আমরা তাঁর সম্পর্কে ঐ কথাই বলি যা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। আর তা হলো তিনি আল্লাহ তা’আলার বান্দা এবং তার রাসূল। তার আত্মা যা তিনি পুতপবিত্রা কুমারী মরিয়মের ওপর অবতীর্ণ করেছেন।

এটা শুনে নাজ্জাশী নিজের হাত জমিনের উপর মারলেন এবং একটু ধুলিকণা উঠালেন এবং বললেন যে, খোদার কসম! যা কিছু তুমি বললে হযরত ঈসা (আ.) এই ধুলিকণার পরিমাণও বাড়িয়ে বলেননি। তারপরে নাজ্জাশী কুরাইশদের প্রতিনিধি দলকে সুস্পষ্ট বলে দিলেন, আমি এই লোকদেরকে কখনোই তোমাদের সোপর্দ করবো না।

ফায়দা.

নাজ্জাশীর প্রশ্নের উত্তরে হযরত জাফর (রা.) এমন জবাব দিলেন যা কুরআনে ছিলো কিন্তু ইঞ্জিলেও তা উল্লেখ ছিল। জাফর (রা.) এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে না সত্যকে লুকিয়েছেন না এমন উত্তেজনামূলক জবাব দিয়েছেন যা শুনে নাজ্জাশী এবং হাবশাবাসী মুসলমানদের বিরোধী হয়ে যায় এবং মুসলমানদেরকে মক্কার কাফিরদের নিকট সোপর্দ করে দেয়। এমনকি এই ঘটনা থেকে আমরা এটাও জানতে পারি যে, এমন পরিস্থিতিতে এমন কোন বক্তাকে নির্বাচন করবে যে চমৎকারভাবে সম্মিলিত অবস্থানকে তুলে ধরতে পারেন এবং পরিবেশ ও পরিস্থিতির ভয়াবহতা সামলে রেখে কথা বলতে পারেন।

পাঁচ.অবস্থার ভিন্নতায় নির্দেশের ভিন্নতা

দাঈর জন্য জরুরি হলো, সে অবস্থা ও পরিবেশের পরিবর্তন অনুভব করে শরঈ সীমারেখার ভিতরে থেকে নিজের দাওয়াতের মধ্যেও পরিবর্তন আনবে। হযরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) এক মহল্লায় মানুষকে নামাজ পড়াতেন। একদিন সেই মসজিদের মুসল্লিরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমরা ক্ষেত-খামারে কাজ করা কৃষক মানুষ-সারাদিন পরিশ্রম করে সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে ফিরি, মু’আজ (রা.) অনেক দীর্ঘ নামাজ পড়ান যা আমাদের জন্য খুবই কষ্ট হয়। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মু’আজ (রা.)- কে ডেকে বললেন

يا معاذ أفتان  انت

হে মু’আজ! তুমি কি মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলতে চাও? হযরত মুআজ (রা.) যেখানে নামাজ পড়াতেন সেখানের বিশেষ অবস্থার চাহিদাই ছিলো যে নামাজ সংক্ষিপ্ত পড়ানো। [সহীহ বুখারী হাদীস নং -৬৬৪]

এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানের অবস্থার ওপর লক্ষ্য করে মু’আজ (রা.) কে সংক্ষিপ্ত নামাজ পড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন, যদিও মূলত স্বাভাবিক অবস্থায় নামাজ দীর্ঘ পড়াই উত্তম।

ছয়. প্রতিপক্ষের কথাও মনোযোগ দিয়ে শুনা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হিজরতের পূর্বে যখন উৎবা কুরাইশের প্রতিনিধি হয়ে আসল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কথা পূর্ণ মনোযোগের সাথে শুনলেন, এমন কি সে যখন নিজের কথা সম্পূর্ণ শেষ করে চুপ হল, তারপরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংক্ষিপ্তভাবে তার সাথে কথাবার্তা বললেন।

সাত. গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ ব্যক্তিদের ওপর মেহনত করা

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাত আমাদেরকে এটাই শিক্ষা দেয়, সমাজের এমন বিশেষ ব্যক্তি যার সহযোগিতা আপনার আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করবে, তার ওপর বিশেষ মেহনত করা চাই, এমনকি তার জন্য দু’আ এবং তাকে নিজেদের সম্পৃক্ত করার জন্য চেষ্টা করা চাই যেমন আমরা দেখতে পাই যে ইমামুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু’আ করেছেন, হে আল্লাহ! উমর ইবনে খাত্তাব অথবা উমর ইবনে হিশাম (আবু জাহেল) এই দুই জন থেকে যে কোন একজনকে আমাকে দান করুন। আল্লাহ তা’আলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দু’আ কবুল করেছেন এবং হযরত উমর ফারুক (রা.) কে দিয়ে দিলেন যার দ্বারা ইসলাম শক্তিশালী হয়েছে এবং মক্কায় ব্যাপকভাবে প্রকাশ্যে দ্বীনের দাওয়াত দেয়া শুরু হয়েছে।

আট. সাধারণ দাওয়াত ও বিশেষ দাওয়াতের মধ্যে পার্থক্য করা

সাধারণ দাওয়াতের বিষয় বিশেষ দাওয়াতের বিষয় থেকে ভিন্ন হওয়া চাই। সাধারণ দাওয়াতে (অর্থাৎ জনসাধারণকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে) কথাবার্তা খুবই সতর্কতামূলক মাপজোখা হওয়া যাতে শ্রোতাদের সর্বশ্রেণির মন মানসিকতা লক্ষ্য রাখা যায়। এই দাওয়াতে এমন ধরনের তথ্য উপাত্ত বেশি আলোচনা করা চাই যা আপনি এবং আপনার শ্রোতাদের মাঝে সম্পৃক্ত। তার বিপরীত বিশেষ দাওয়াতের ক্ষেত্রে আপনি খোলামেলা কথা বলতে পারেন এবং বিশেষ শ্রোতার বিশেষ মানসিকতা ও মেজাজ অনুযায়ী বিস্তারিত আলোচনা করতে পারেন।

নয়. নির্বাচিত বাক্য ও উপযুক্ত শব্দ চয়ন

দাওয়াতের ক্ষেত্রে উত্তম বাক্য ও উপযুক্ত শব্দ চয়ন আপনার দাওয়াতকে আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী করে তুলবে এবং বহুদূর এগিয়ে দেবে আবার এই শব্দ চয়নে অসতর্ক আপনার দাওয়াতকে প্রতিক্রিয়াহীন বানিয়ে দিতে পারে। কুরআনে কারীমের তো এটাও একটি মু’জিজা যে, কুরআনের আয়াত তার শব্দ এবং বিন্যাস এতটা পরিপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ যে সমগ্র মানবজাতি তার উপমা দিতে অক্ষম। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

و أوتيت جوامع الكلم

আমাকে উত্তম বাক্য দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। [সহীহ মুসলিম হাদীস নং -৮১৪]

আমাদের এই যুগে আল্লাহ তা’আলা শায়েখ উসামা (রহ.) কে সম্ভবত দাওয়াতে নববীর পদ্ধতি এলহাম করেছিলেন। শায়েখ (রহ.)- এর বয়ান শুনলে এমন মনে হয় যেন একেকটি বিষয়, একেকটি বাক্য, একেকটি শব্দ তার কণ্ঠে উচ্চারণ করানো হয়েছে। যেই শ্রেণিকেই সম্বোধন করেছেন পরিপূর্ণ করেছেন। সহজবোধ্য, হৃদয়-মন আকর্ষণ কারী সর্বজনমান্য যুক্তিনির্ভর এমন বয়ান যাকে যে কেউ সমর্থন করতে বাধ্য। শায়েখ উসামা (রহ.) একবার পশ্চিমা বিশ্বকে সম্বোধন করতে গিয়ে তাদেরকে বুঝালেন তোমরা ইয়াহুদিদের গোলাম; কিন্তু শায়েখ (রহ.) উক্ত বয়ানে ইয়াহুদি শব্দের পরিবর্তে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি শব্দটি ব্যবহার করলেন, কেননা পশ্চিমা বিশ্বে যদি ইহুদিদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বক্তব্য দেয়া হয় তাহলে তারা তাদের গোত্রীয় টানের কারণে এই বক্তব্যকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে মারবে। এ জন্য শায়েখ এমন এক বাক্য ব্যবহার করেছেন যা তাদের সকল পরিশ্রমকে পণ্ড করে দিয়েছে এবং বিকল্প এমন এক শব্দ ব্যবহার করেছেন যার ফলে তার দাওয়াতের আকর্ষণও অনেক গুণ বেড়ে গেছে; কেননা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নির্যাতনের স্টিম রোলারে পিষ্ঠ পশ্চিমা জনসাধারণের জন্য এই বয়ান অনেক আকর্ষণীয় ছিলো, বরং তা তাদের চেতনার সঠিক প্রতিনিধিত্বই করেছিলো। বি. বি. সি এই বয়ানের ওপর অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলে, মনে হয় যেনো এই বয়ান অনেক অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা হয়েছে।

দশ. যে সকল বিতর্ক দাওয়াতের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা থেকে নিজেকে বাঁচানো

খেলাফত প্রতিষ্ঠার শত্রুরা আপনাকে এমন বিতর্কে লিপ্ত করতে চাইবে যাতে লিপ্ত হয়ে আপনি আপনার মূল উদ্দেশ্য হতে ছিটকে পড়বেন এবং অন্য কোথাও লিপ্ত থাকবেন। যেমন মতবিরোধপূর্ণ ও বিতর্কিত বিষয় এবং মতভেদগত বিষয় ইত্যাদি। একবার যদি আপনি এই সকল মাসআলায় জড়িয়ে পড়েন তাহলে আপনার নিকট খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেয়ে এই মাসআলাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে। এতে আপনি আপনার আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে অন্য কোথাও গিয়ে পড়ে থাকবেন। এজন্য সর্বদা এমন বিতর্ক থেকে বেঁচে থাকতে হবে যা দাওয়াতের গতি অন্য কোন দিকে ঘুরিয়ে দেয়। বিশেষ করে দায়িত্বশীলদের ওপর কর্তব্য যে তারা তাদেরকে অত্যন্ত কঠোরতার সাথে এমন বিষয়ে বিতর্কে জড়ানো থেকে নিষেধ করবে।

দাঈদের উচিত হলো তারা যেনো দাওয়াত দেয়ার সময় সেই দোকানদারের মতো হয়ে যায় যে তার পণ্য বিক্রির সময় তার সামনে তা ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য রাখে না যে কিভাবে তার পণ্য গ্রাহকের নিকট বিক্রি করবে। সে তার পণ্যকে গ্রাহকের নিকট এমনভাবে উপস্থাপন করে মনে হয় যেনো এই পণ্য তৈরীই হয়েছে এই গ্রাহকের জন্য এবং এই গ্রাহকের চেয়ে উপযুক্ত এই পণ্যের পৃথিবীতে আর কেউ হতে পারে না। এমন বুদ্ধিমান দোকানদার আপনার সাথে অন্য কোন বিতর্কে জড়াবে না, আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে, আপনার পক্ষাবলম্ভবন করবে কিন্তু ঘুরে ফিরে সে তার পণ্যের গুণাগুণই বর্ণনা করবে।

এগার. বিতর্কে প্রমাণভিত্তিক জবাবের পরিবর্তে অভিযোগমূলক জবাব দেয়া

কখনো কখনো দাঈকে তার প্রতিপক্ষের জবাব দেয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু বিতর্কের সময় এমন সুযোগ ও এতো সময় পাওয়া যায় না যে বিস্তারিত দলিল প্রমাণ দিয়ে বুঝাবে। অতঃএব এমন সংক্ষিপ্ত সময়ে তাকে প্রামাণ্য জবাবের পরিবর্তে অভিযোগমূলক জবাব দেয়াই উত্তম, অর্থাৎ যে অভিযোগ সে আপনার আন্দোলন সম্পর্কে করছে তার জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্নের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তার কোন ত্রুটি দেখিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দিন। কুরআনে কারীমের অনেক স্থানে এর উপমা বিদ্যমান। যেমন ইয়াহুদিদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُواْ بِمَا أَنزَلَ اللّهُ قَالُواْ نُؤْمِنُ بِمَا أُنزِلَ عَلَيْنَا

অর্থাৎ যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ তা’আলা যা অবতীর্ণ করেছেন তার ওপর ঈমান আনো, তারা বলে আমরা ঈমান এনেছি তার ওপর যা আমাদের ওপর নাজিল করা হয়েছে। [সূরা বাকারা-৯১] এর জবাবে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে কুরআনের সত্য হওয়ার প্রমাণ দেননি বরং এই বলে তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন-

قُلْ فَلِمَ تَقْتُلُونَ أَنبِيَاء اللّهِ مِن قَبْلُ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ

অর্থাৎ, তাহলে যদি ঈমানদার হয়ে থাক তোমরা তোমাদের নবীদেরকে কেন হত্যা করেছে । [সূরা বাকারা -৯১]

এমনিভাবে ইয়াহুদিরা বলে, আমরা আল্লাহর প্রিয় এবং তার পুত্র। আল্লাহ তা’আলা তার জবাবে বলেন, মাহবুবতো তার হাবীবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সুতরাং তোমরাও মৃত্যু কামনা করো যদি প্রকৃত সত্যবাদী হও।

আপনার নিকট যদি সময় সংক্ষিপ্ত হয় এবং প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্য সংশোধন না হয় বরং উদ্দেশ্য হলো সমালোচনা; তাহলে তার সাথে বিতর্কে জড়ানো এবং জ্ঞানগর্ব প্রমাণাদী দেয়া আপনাকে বিপদেই ফেলতে পারে। এ জন্য এমন পরিস্থিতিতে উল্টো তার ওপর প্রশ্ন উত্থাপন করে তাকে আত্মরক্ষামূলক পজিশনে নিয়ে যান এবং তাকে জিজ্ঞেস করুন যে, তুমি কোন মুখে প্রশ্ন করো যখন তোমাদের নিজেদের কার্যক্রমই এমন এমন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের ইতিহাসের প্রথম সারিয়্যা মক্কার দিকে প্রেরণ করলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.) কে তার আমির নিযুক্ত করলেন। এই সারিয়ায় সাহাবাদের হাতে এক কাফির নিহত হলো। এই ঘটনা নিষিদ্ধ মাসে সংঘটিত হলো। সাহাবায়ে কিরাম মনে করেছেন যে এখনো নিষিদ্ধ মাস আরম্ভ হয়নি। ঐ সময় পর্যন্ত নিষিদ্ধ মাসগুলোতে (রজব, জিলক্বদা, জিলহজ্জ মুহাররম) কিতালের অনুমতি ছিলো না। মক্কার কাফিরগণ আকাশ মাথায় উঠিয়ে ফেললো এবং বলতে লাগলো দেখো মুহাম্মদের সাথী সঙ্গীরা এখন সম্মানিত মাসগুলোরও সম্মান করে না।

আল্লাহ তা’আলা নিজে এই কাফিরদের জবাব দিয়েছেন যে, তোমরা যারা একটি হত্যাকাণ্ডের ওপর এতটা চিৎকার-চেচামেচি করছে এবং তাৎক্ষণিক খুব আখলাক ও ভদ্রতার কথা বলছো, তোমরা নিজেদের আচলের দিকে চুপি চুপি তাকিয়ে দেখো যে তোমরা তো তারাই যারা নিজেরাও আল্লাহকে মানতে অস্বীকার করো এবং অন্যদেরকেও আল্লাহর পথে বাধা প্রদান করো। তোমাদের ভদ্রতার আলামত তো হলো এই যে তোমরা মুসলমানদেরকে মসজিদে হারামের মতো পবিত্র স্থান হতে এবং তাদের আবাসভূমি মক্কা থেকে বের করে দিয়েছো যা অবশ্যই যে কোন ভদ্র মানুষের জন্য সবচেয়ে লজ্জার কথা। সুতরাং তোমাদের কুফরী ও তোমাদের এই প্রতারণা সবচেয়ে বড় ফেতনা এবং ফেতনা হত্যার চেয়েও বড় অপরাধ। কাফিরদের এক প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহ তা’আলা এই কাফিরদের এতোগুলো দোষ বর্ণনা করলেন যে তারা চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হলো। এই ঘটনায় ঈমানদারদের জন্য এই শিক্ষা বিদ্যমান, যখন কাফির মুসলমানদেরকে প্রশ্ন করবে তখন ঈমানদারগণ তাদের সাথে মিলে তাদেরই বুলি না আউড়িয়ে বরং সে সময় মুসলমানদের আত্মরক্ষা করা উচিৎ। তবে যেখানে একে অপরের সংশোধনের ব্যাপার হয় সেখানে অভ্যন্তরীণভাবে নিজেদের মধ্যে অবশ্যই সংশোধন করা উচিত। হ্যা কোন মুসলমান প্রকাশ্যে মুরতাদ কাফির এবং কাদিয়ানীদের সাথে মিলে জিহাদ ও মুজাহিদদের সমালোচনা করা উচিত নয়। যে এমনটি করবে সে কাদিয়ানীদের আত্মাকে খুশি করলো এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার প্রভু আল্লাহ তা’আলাকে কষ্ট দিল।

বার. দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে দাওয়াত দেয়া

দাওয়াতের ময়দানের যেই সতর্কতাসমূহ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে এর দ্বারা কেউ আবার এই কথা বুঝবেন না যে দাওয়াতের মধ্যে দুর্বলতা প্রকাশ করা চাই, বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহস ও দৃঢ়তার সাথে মানুষের সামনে দাওয়াতকে উপস্থাপন করেছেন। যেমন মক্কার কাফিরদের দ্বিতীয় প্রতিনিধি দল যখন আবু তালেবের নিকট আসলো তখন চাচা আবু তালেব ডেকে পাঠালেন এবং অবস্থার ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা দিলেন, যা শুনে মানবতার ইমাম রহমাতুললিল আলামীন এই শব্দসমূহ উচ্চারণ করলেন। হে চাচা! এই লোকেরা যদি আমার ডান হাতে সূর্য আর বাম হাতে চন্দ্র রেখে দেয় যেনো আমি দাওয়াত ছেড়ে দেই তাহলেও আমি তা ছাড়তে পারবো না হয়তো আল্লাহ তা’আলা এই দ্বীনকে বিজয়ী করবেন অথবা আমি থাকবো না আমাকে হত্যা করে দেয়া হবে।

তের. পরীক্ষার মুখোমুখী হলে দৃঢ়পদ থাকা

দ্বীনের দাওয়াত এবং পরীক্ষা একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ইমাম শাফিয়ী (রহ.) কে কেউ জিজ্ঞেস করল কোন দাঈ উত্তম? যার শুরুতেই বিজয় অর্জন হয়ে গেছে? না কি সে যিনি দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদের সম্মুখীন হয়েছেন তার পরে তার বিজয় অর্জিত হয়েছে? ইমাম সাহেব (রহ.) উত্তর দিলেন যে-

لايمكن حتى يبتلى والله تعالی ابتلى أولي العزم من الرسل فلما صبروا مكنهم

 অর্থাৎ, পরীক্ষা ব্যতীত বিজয় অর্জন অসম্ভব। আল্লাহ তা’আলা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আম্বিয়ায়ে কিরামকেও পরীক্ষায় অবতীর্ণ করেছেন। এ কারণেই তারা যখন (এই পরীক্ষায়) দৃঢ়তার প্রমাণ দিলেন তখনই আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে বিজয় দান করলেন।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাকামে ইবরাহীমের পাশে নামাজ আদায় করছিলেন অমনি উকবা ইবনে আবী মুয়ীত উঠে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাদর তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে টান দিল এবং এত জোড়ে টানল যে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপুর হয়ে পড়ে গেলেন। লোকজন চিৎকার করতে শুরু করল। তাদের ধারণা ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করে ফেলা হয়েছে। হঠাৎ আবু বকর সিদ্দীক (রা.) রাগান্বিত অবস্থায় আসলেন এবং নবীজীর বাহুতে ধরে উঠালেন এবং কাফিরদের সম্বোধন করে বললেন, তোমরা কি একজন মানুষকে শুধু এজন্য হত্যা করবে যে সে বলে আমার প্রভু আল্লাহ। তারপরে লোকেরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে পৃথক হয়ে গেল এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও পুনরায় নামাজে মশগুল হয়ে গেলেন। নামাজ থেকে ফারেগ হয়ে নবীজী কুরাইশ সর্দারদের পাশ দিয়ে গেলেন যারা বাইতুল্লাহর ছায়ায় বসে ছিল এবং বললেন, হে কুরাইশের দল! ঐ সত্তার কসম যার কবজায় মুহাম্মদের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান, আমাকে তোমদের নিকট তোমাদেরকে জবাই করার জন্য পাঠানো হয়েছে এই বলে নবীজী কণ্ঠনালীর দিকে ইশারা করলেন।

এই ছিলো অভিশপ্ত উকবা ইবনে আবী মুয়ীত হেরেমে সিজদা অবস্থায় যে নবীজীর উপর উটের নাড়িভুড়ি চাপিয়ে দিয়েছিলো। হযরত ফাতেমা (রা.) চার পাঁচ বছর বয়সের ছিলেন। তিনি দৌড়ে আসলেন এবং নবীজীর উপর থেকে নাড়িভুড়ি সরিয়ে দিলেন। আল্লাহ তা’আলা তার হাবীবকে বললেন

فَإِن كَذَّبُوكَ فَقَدْ كُذِّبَ رُسُلٌ مِّن قَبْلِكَ جَآءُو بِٱلْبَيِّنَٰتِ وَٱلزُّبُرِ وَٱلْكِتَٰبِ ٱلْمُنِيرِ

অর্থাৎ এজন্য তারা যদি আপনাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে, তাহলে আপনার পূর্ববর্তী রাসূলদেরকেও তো মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে। [সূরা আলে ইমরান -১৮৪]

لَتُبْلَوُنَّ فِي أَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِن قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا أَذًى كَثِيرًا ۚ وَإِن تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ ذَٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ

অর্থাৎ তোমাদেরকে তোমাদের জীবন ও সম্পদ দ্বারা পরীক্ষা করা হবে। এবং আহলে কিতাব ও মুশরিকদের পক্ষ থেকে কষ্টদায়ক কথা অবশ্যই শুনতে হবে, এবং যদি তোমরা এই সকল কষ্ট ও কঠোর কথার মোকাবেলায় দৃঢ়পদ থাকো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো তাহলে তা মজবুত কাজের মধ্যেই হবে।

ইতিহাস সাক্ষী যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর জীবন উৎসর্গকারী সাহাবায়ে কিরাম এই দ্বীনকে দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের শরীরকে রক্তাক্ত করেছেন। জলন্ত কয়লাকে নিজের শরীরের চর্বি দিয়ে ঠাণ্ডা করেছেন। ইসলামী আইনকে বিজয়ী করার জন্য নিজের ঘরবাড়ি ছেড়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সকল সাহাবায়ে কিরাম (রা.) কিতাল ফী সাবীলিল্লাহ করতে ছিলেন যতক্ষণ না আল্লাহ তা’আলা তার দ্বীনকে বিজয়ী করেছেন। আজ এই কথার খুবই প্রয়োজন যে খিলাফত প্রতিষ্ঠার দাওয়াতদাতা ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতকে ধারণ করে, দাওয়াত ও কিতালকে সাথে নিয়ে চলবে। দিন-রাত এক করবে এবং এই পথে নিজের জীবনকে আল্লাহ তা’আলার নিকট সোপর্দ করে দেবে জিহাদের পথে শাহাদাতের পিছনে ছুটে চলা এবং তা পেয়ে যাওয়া অনেক বড় সাফল্যের ব্যাপার।

 

সমাপ্ত

 

শেষ কথা

আল্লাহ তা’আলার বান্দাদেরকে মানুষের বানানো নিজামের ইবাদত থেকে বের করে আল্লাহ তা’আলার নিজামের দিকে ডাকা বাস্তবেই অনেক কঠিন কাজ, কিন্তু সকল নবী রাসূল এই উদ্দেশ্যের জন্যেই কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করেছেন। এজন্য আজও এই উদ্দেশ্যের জন্য যদি মুজাহিদদের কুরবানী দিতে হয়, পরীক্ষা ও জটিলতা এসে আঁকড়ে ধরে, তাহলে এটা আল্লাহ তা’আলার সুন্নাত; কিন্তু যদি এই সব কিছুর বিনিময়ে আমাদের মাওলা আমাদের ওপর রাজি হয়ে যান তাহলে এই সকল কঠোরতা সহ্য করা কোন দামি সওদা নয়। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত যদি পরিপূর্ণ হেদায়েতের ওপর এসে যায়, আল্লাহ তা’আলার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো তন্ত্র-মন্ত্রের বিরোধিতা ঘোষণা দিয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠার দিকে এসে যায়। আল্লাহ তা’আলার জমিনে আল্লাহ তা’আলার শরিয়ত প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দুশমনদের সাথে কিতালের জন্য উঠে দাঁড়ায় তাহলে এই হিজরত, এই বিরহ, এই আঘাত যা দূরপাল্লার মিজাইল দ্বারা লেগেছে অথবা দুশমনের জুলম-নির্যাতনের দ্বারা এবং সেই আঘাতপ্রাপ্ত হৃদয় যা আপনজনদের কণ্ঠ ও কলম উপহার দিয়েছে। সব কিছু আনন্দচিত্তে কবুল। চারা গাছে ফুল ফোটানোর জন্য বাগানের কাঁটা সহ্য করেই যাবো। দাঈদের জন্য দুশমনের নিক্ষিপ্ত কাদায় কি করে আপত্তি হবে? পদ্মফুল কুড়াতে গেলে কাদা তো লাগবেই। যদি নিজের ব্যক্তিত্বের কুরবানী দিয়ে অন্যদের আরাম ও প্রশান্তি পৌঁছানোর সুন্নাত পৃথিবীতে না থাকে তাহলে মা-কে মা বলবো কিভাবে যিনি অন্যের জন্য নিজেকে মিটিয়ে দেন। সুতরাং জিহাদ ও খিলাফতের দাওয়াত দানকারীদেরকেও এই দাওয়াতের জন্য নিজেকে বিলীন করে দিতে হবে। নিজের বর্তমান উম্মতের ভবিষ্যতের জন্য এবং নিজের নির্ঘুম রাত উম্মতের ঘুমের জন্য যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোলামদের ঘর বাঁচানোর জন্য নিজের ঘর উজার হয়ে যায় তাতে কী আসে যায়? রাহমাতুললিল আলামীনের উম্মতের শান্তি ও তৃপ্তির জন্য যদি নিজের ভুখ ও ক্ষুধা সহ্য করতে হয়। তাহলে সমস্যা কি? নিজের ঘর না বানাতে পারলাম কিন্তু উম্মতের বাচ্চা-কাচ্চাদের ঘর বেঁচে যাবে। কোথাও ইরাক ও সিরিয়া, কাবায়েল ও আফগানিস্তান বানাতে দেয়া যাবে না। তোমার জীবন অতি মূল্যবান নয়, মূল্যবান বানিয়ে লও। যারা জীবন মূল্যবান বানানোর প্রতিজ্ঞা করেছে, পথে নেমেছে তারা যেন প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করে, তারা যেন পথ থেকে ফিরে না আসে। যারা নগণ্য জীবনটা মূল্যবান-পথে বিলিয়ে দিবে, যারা প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবে-তাদের জন্যই রয়েছে খোদায়ী ওয়াদা।

ذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

বাস্তবেই এটা অনেক সফল সওদা যার মধ্যে কোন রকমের লোকসান নেই।

وصلى الله على نبينا محمد و على اله و صحبه و سلم!

******

 

 [১. টিকা. তবে শ্লোগান ও প্রচারণা নির্ধারণের সময় একথা মনে রাখা চাই যে এই শ্লোগান ও প্রচারণা শরঈ সীমানায় থেকে শরীয়ত সমর্থিত ইহকালীন ও পরকালীন ফজিলত ও বরকতের বহিঃপ্রকাশের জন্য যেন হয়। সাধারন জনগণের মতো যারা শুধু দুনিয়াবী উপকার ও চাহিদাকেই সামনে রেখে নিজেদের শ্লোগান ও ওয়াদা ঠিক করে তাদের মতো যেন না হয়।]

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 − 4 =

Back to top button