কারাবন্দী সিংহ – শাইখ আলী আল তামিমির কিছু কথা
তারবিয়াহ
ইস্যু-৫ | ১৪৪১ হিজরি | ২০২০ ইংরেজি
বিষয়ঃ মজলুম শাইখ
কারাবন্দী সিংহ – শাইখ আলী আল তামিমির কিছু কথা
অনুবাদঃ মুহাম্মাদ সাফকাত ওয়াসি
Source: https://www.youtube.com/watch?v=wYrMl6tHNQc
তাই আমাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে – জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হল – আল্লাহর ইবাদত করা। একজন লোকের পক্ষে আল্লাহ আযযা-ওয়াযালের ইবাদতের জন্য সর্বোত্তম জায়গাটি অবশ্যই মসজিদ। কিন্তু এছাড়াও ইবাদতের মৌলিক কাজগুলো যেমন – নামাজ, আল্লাহর যিকির, দু’আ, আল্লাহর প্রতি ভালবাসা, তাঁর অনুগ্রহের আকাঙ্ক্ষা, তাঁর শাস্তির ভয়, রোজা রাখা এবং আরও অনেক কিছু, একজন মানুষ কারাগারে থেকেও ভালভাবে করতে পারবে ইনশা আল্লাহ।
ভাই ও বোনেরা –
এখন আপনাদের জানার জন্য আমার মামলাটি সম্পর্কে একটু বলি। যারা অন্য ভাইদের বিচারের সময় উপস্থিত ছিলেন তারা নিশ্চয় জানেন যে, এই ইস্যুটি অনেকদিন ধরে চলে আসছে। প্রায় দু’বছর আগে আমার বাসায় রেইড দেয়া হয়েছিল। আমার পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আমি যেই ইউনিভার্সিটিতে সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করছিলাম সেখান থেকে আমি চাকরি হারাই এবং আমি গত নয় মাস থেকে বেকার আছি।
এই সময়টাতে আমার মনে হয়েছে যে, মুসলিমদের সবাইকে শিক্ষাদান করা উচিত। আমি গত দেড় বছর ধরে সরকারকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেছিলাম। আমি স্বেচ্ছায় খোলামনে তাদের সাথে অনেকবার দেখা করেছি। হয়ত সাত-আটবার তাদেরকে ব্যাখ্যা করার, বোঝানোর, শেখানোর এবং সেতুবন্ধন গড়ার চেষ্টা করেছি। আমার ও তাদের মধ্যে যেন কোন শত্রুতা তৈরি না হয় সে চেষ্টাও করেছি।
যাইহোক, আল্লাহ সুবহানাহুহু ওয়া তা’আলার আদেশে এটি অবশেষে কোন ফল বয়ে আনে নি। আমরা সরকারের কাছে ফলাফল জানতে চেয়েছিলাম। তারা আমাকে এক সপ্তাহের সময় দিয়ে দুটি পথের একটি বেছে নিতে বলেছিল। হয় আমি ধরা দিয়ে একটি দোষ স্বীকার করব আর তারা আমাকে চৌদ্দ বছরের শাস্তি দিবে অথবা তারা আমাকে দোষী পেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিবে। আল্লাহ আযযা- ওয়া যাল আমাকে যেকোন অমঙ্গল থেকে রক্ষা করুন। আমি অবশ্য এরকম কোন চুক্তিতে সই করিনি
আমার মনে পড়ে, আমি এই ঘটনার শুরুতে যখন আমার মা বাবার কাছে যাই, আমি বেশ বিভ্রান্ত ছিলাম আমি কি করব তা নিয়ে। আর আমার মা আমাকে বলেছিলেন, “বাবা, মৃত্যু শুধু জীবনে একবার আসে।” আর আমার বাবা যিনি ৮৫ বছর বয়স্ক, কার্যত অন্ধ, আমাকে বললেন, “আমি তোমাকে নিজের আত্মা বিক্রি করে – তোমার নিজের এবং আল্লাহ তা’আলার থেকে বিতাড়িত হতে দেখার চেয়ে – তোমাকে নিজের নীতি ও বিশ্বাসের উপর সমুন্নত থেকে – কারাগারে মৃত্যুবরণ করতে দেখতে বেশি পছন্দ করব।”
আমার মনে পড়ে আমি একা একা চিন্তা করে বের করার চেষ্টা করছিলাম যে আমি এখন কি করব। শরীয়াহ আমাদের শিখায় যে, দুটি অমঙ্গলের মধ্যে ছোটটি গ্রহণ কর। কিন্তু আমার মনে পড়ে সায়্যিদ কুতুব (রঃ) (যার বই আমি পড়ে বড় হয়েছি এবং যার উপদেশগুলো আমার ভাল লাগত) জল্লাদের সামনে দাড়িয়ে বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম, সেই আঙ্গুল যা সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ ব্যতীত আর কিছু ইবাদতের যোগ্য নয়, সেটা কীভাবে এমন কিছুকে ইশারা করবে যা মিথ্যা?”
আমার মনে পড়ে ইবনে তাইমিয়্যাহ (রঃ) এর কথা। তিনি বলেছেন, “আমার শত্রুরা আমার সাথে কি করবে? আমার জান্নাত তো আমার অন্তরে; আমি যেখানেই যাই, এটা আমার সাথে যায়। আমাকে কারাগারে পাঠানো মানে আমাকে ‘খালওয়া’ (আল্লাহর প্রতি ব্যক্তিগত একনিষ্ঠা) পেতে দেয়া। আমাকে হত্যা করা হচ্ছে শাহাদাত এবং আমাকে আমার দেশ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে ‘সিয়াহাহ’ (আল্লাহর রাস্তায় সফর)।”
তাই যখন আমি এই ব্যক্তিদের কথা চিন্তা করলাম – যাদের বই আমি পড়তাম এবং তাদের চিন্তাভাবনা নিয়ে পড়াশোনা করতাম – তখন বুঝলাম যে, আমার কাছে একটি পথই আছে। সেটা হল – আমি আল্লাহ আযযা-ওয়াযালের উপর বিশ্বাস রাখব এবং তার অনুগ্রহের আশায় থাকব এবং এটা মনে রাখবো যে আল্লাহ আমার জন্য যাই ফয়সালা করবেন তা ভালোর জন্যই করবেন। উমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু যেমনটি বলতেন, “আমি সকালে যে অবস্থায় ঘুম থেকে উঠি সেটা আমার জন্য ভালো না খারাপ সেটা আমি পরোয়া করি না। কারণ আমি জানি না আমার জন্য কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ।”
আমার পরিচিত কয়েকজন জানেন যে, ইসলামী শিক্ষাদানের পাশাপাশি আমি আমার পি.এইচ.ডি. নিয়ে কাজ করছিলাম। আর মাত্র পাঁচ সপ্তাহ পরেই আমার ডক্টরাল ডিফেন্স দেয়ার তারিখ ছিল। আমার ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের মতে ক্যান্সার রোগটি বোঝার জন্য আমার রিসার্চ অনেক কাজে দিবে। কিছু লোকজন মনে করত যে – ক্যান্সার দেহে একটি বিশেষ উপায়ে তৈরি হয়। আল্লাহর রহমত ও করুণায় আমিই সর্বপ্রথম সেই তত্ত্বটি প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলাম।
একারণে আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ করেছিলাম। আমরা সরকারকে বললাম যে, “আমরা গত দেড় বছর ধরে একসাথে কাজ করেছি, তত্ত্বটি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি। কাজটি এখন শেষ পর্যায়ে। তাই আমাদের শুধু পাঁচ সপ্তাহ সময় দাও। আমাকে অভিযুক্ত করো ঠিক আছে, কিন্তু পাঁচ সপ্তাহ পরে কর। জনাব আল-তামিমিকে তার ডক্টর ডিগ্রী শেষ করতে আর তাঁর রিসার্চ পাবলিশ করতে দাও যার উপর তিনি কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন। যাতে এটা মানবতার উপকারে আসে এবং বিফলে না যায়”।
দুর্ভাগ্যক্রমে সরকার কোনো কারণ না দেখিয়েই আমাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। কেউ কেউ মনে করেন যে, এটা রাজনৈতিক কারণে হয়েছে। আর পাঁচ সপ্তাহ পরেই নির্বাচন ছিল। আর পাঁচ সপ্তাহ পর আমার অভিযোগ অবশ্যই নির্বাচনের সময় অতিক্রম করবে, যা হয়ত মিডিয়া-প্লে এর জন্য কোনো কাজে আসবে না। আল্লাহই ভাল জানেন।
ভাই ও বোনেরা,
যাইহোক, আমি আর আপনাদের সময় নিব না। আমি এই কয়েকটি কথা বললাম যাতে আমরা নিজেদের মনে করিয়ে দিতে পারি যে – সবশেষে আমরা হচ্ছি মুসলিম। আল্লাহ আমাদের জন্য যা নির্ধারণ করেন তাতেই আমরা সন্তুষ্ট। আমরা জানি যে, আমাদের জন্য আল্লাহ সুবহানাহুহু ওয়া তা’আলা যা নির্ধারণ করেছেন তা কখনোই আমরা এড়িয়ে যেতে পারবো না। আর যা তিনি আমাদের জন্য নির্ধারণ করেন নি – তা কখনোই আমাদের নিকট আসবে না।
আমরা আরও জানি যে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য ক্যান্সারে পি.এইচ.ডি. নয়, অর্থ রোজগারও নয়। আমাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে – আল্লাহর ইবাদত করা। আর আমি আল্লাহর ইবাদত বাহিরে এই মসজিদে যেমন ভাবে করতে পারতাম, কারাগারে থেকে এর থেকেও ভালোভাবে করতে পারবো ইনশা আল্লাহ।
আমি আশা করি আল্লাহ সুবহানাহুহু ওয়া তাআলা আমাকে আমার ভাই-বোনদের মাঝে শীঘ্রই পৌঁছে দিবেন। তিনি আপনাদের সবাইকে আর বাকি সকল মুসলিমদের এই পৃথিবীতে এবং আখিরাতে কল্যাণ দান করুন। আমীন – ইয়া রাব্বাল আ’লামিন।
*************