আকিদা-মানহাজআল-হিকমাহ মিডিয়াবই ও রিসালাহবই ও রিসালাহ [আল হিকমাহ]মিডিয়া

মারকাযুদ দাওয়া আলইসলামিয়া ঢাকার ফুযালাদের মজলিস প্রকাশিত “আপনে তালাবায়ে কেরাম সে চান্দ জরুরী গুযারিশাত” এর প্রেক্ষাপটে সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী ভাইদের প্রতি কিছু নিবেদন – মুফতি আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ আল মাহদী হাফিজাহুল্লাহ

গত ৩০শে মার্চ ২০১৯ ইং মারকাযুদ দাওয়া আলইসলামিয়া ঢাকার ফুযালাদের মজলিস প্রকাশিত
“আপনে তালাবায়ে কেরাম সে চান্দ জরুরী গুযারিশাত” এর প্রেক্ষাপটে

সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী ভাইদের প্রতি কিছু নিবেদন
– মুফতি আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ আল মাহদী হাফিজাহুল্লাহ


[সম্মানিত তাওহীদবাদী ভাই ও বোনেরা! অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই পুস্তিকাটি দ্বীনদার মহলে, বিশেষ করে উলামা-তালাবাদের মাঝে খুব প্রচার করি! আরও বিশেষ করে মারকায সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে এটা পৌঁছে দেওয়ার ফিকির করি! পিডিএফ কপি অথবা প্রিন্ট করে ছাপিয়ে সেটা সাধ্যমত উদ্দিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করি! কারো দ্বারা সম্ভব হলে বই আকারেও ছাপতে পারি, যদি নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে।]
অনলাইনে ছড়িয়ে দিন-
https://telegra.ph/markaz-nibedon-05-17

————————————-

গত ৩০ শে মার্চ ২০১৯ ইং মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া ঢাকার ফুযালাদের মজলিসে প্রকাশিত ‘আপনে তালাবায়ে কেরাম সে চান্দ জরুরি গুযারিশাত’-এর প্রেক্ষাপটে

সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী ভাইদের প্রতি কিছু আবেদন!

 

الحمد لله القائل: وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ، والصلاة والسلام على نبي الملحمة، القائل: «لا تزال طائفة من أمتى يقاتلون على الحق ظاهرين إلى يوم القيامة – قال – فينزل عيسى ابن مريم -صلى الله عليه وسلم- فيقول أميرهم تعال صل لنا. فيقول لا، إن بعضكم على بعض أمراء، تكرمة الله هذه الأمة». وفي رواية: «حتى يقاتل آخرهم المسيح الدجال». وعلى آله وأصحابه أجمعين، وعلى من تبعهم بإحسان إلى يوم الدين، اللهم انفعنا بما علمتنا وعلمنا ما ينفعنا، وألهمنا مراشد أمورنا وأعذنا من شرور أنفسنا، اللهم أرنا الحق حقا وارزقنا اتباعه وأرنا الباطل باطلا وارزقنا اجتنابه، اللّهُمّ رَبّ جَبْرَائِيلَ وَمِيكَائِيلَ وَإِسْرَافِيلَ، فَاطِرَ السّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ، عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشّهَادَةِ، أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ، اهْدِنِي لِمَا اخْتُلِفَ فِيهِ مِنَ الْحَقّ بِإِذْنِكَ إِنّكَ تَهْدِي مَنْ تَشَاءُ إِلَىَ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ، اللَّهُمَّ إني أَعُوذُ بِكَ أنْ أضِلَّ أَوْ أُضَلَّ، أوْ أزِلَّ أَوْ أُزَلَّ، أَوْ أظْلِمَ أَوْ أُظْلَمَ، أوْ أجْهَلَ أَوْ يُجْهَلَ عليَّ، سبحانك لا علم لنا إلا ما علمتنا إنك أنت العليم الحكيم.

প্রথম কথা:

প্রিয় ভায়েরা! আপনারা ইতিমধ্যেই হয়তো জানতে পেরেছেন, আমাদের দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটি ইলমী অঙ্গন; মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া, বিশ্বে চলমান জিহাদি আন্দোলন সম্পর্কে তাঁদের মূল্যবান মতামত প্রকাশ করেছেন।

বি-ইযনিল্লাহ এই প্রকাশনায় আমাদের সাথী ও সহকর্মীদের বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। জানামতের কেউ হনওনি আলহামদুলিল্লাহ। তবে আমাদের সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী ভাইদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা বিষয়গুলো ইলমিভাবে পরিষ্কার না হয়ে দ্বীনি আবেগ ও জযবা নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো আলেমের অনুসরণ করে কাজকে সমর্থন করে যাচ্ছেন। আলহামদুলিল্লাহ একই সঙ্গে তারা মারকায ও মারকায কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও আস্থা ও ভালোবাসার সম্পর্ক রাখেন। তারা হয়তো এই প্রকাশনায় কিছুটা ভাবনায় পড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে তাদের প্রতি কিছু আবেদন এবং ভাবনার কিছু দিক তুলে ধরা মুনাসিব মনে করছি।

মনে রাখতে হবে, এ লেখা কোনো গবেষণা প্রবন্ধ নয়, কারো মতের খণ্ডন বা কোনো লেখার প্রতি-উত্তরও নয়। আমরা তাঁদের প্রতিউত্তরে খুব আগ্রহীও নই। কারণ মাসায়েলের ক্ষেত্রে তাঁদের মতো বিদগ্ধ ও মান্যবর আলেমদের নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতা আমাদের জন্য সোনায় সোহাগা। সুতরাং তাঁদের কথাগুলো যদি দলিলের আলোকে সামনে চলে আসে এবং দলিলের আলোকে আমাদের অবস্থান ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা ষোঘণা দিয়ে আমাদের অবস্থান থেকে ফিরে আসব এবং তাঁদের মতামত গ্রহণ করে নিব ইনশাআল্লাহ।

পক্ষান্তরে যদি আমাদের অবস্থান ভুল প্রমাণিত না হয়, তখন আমরা পরামর্শ করে মুনাসিব মনে হলে তার জবাব লিখব ইনশাআল্লাহ। কারণ আমরা যে মাসআলার আলোকে চলছি, তা আমাদের নিজেদের রায় ও মতামত নয়; বরং তা আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্বীকৃত ও নির্ভরযোগ্য বড়দের মতামত থেকে এবং তাঁদের কোরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক বিশ্লেষণ থেকেই গ্রহণ করেছি। সুতরাং আমরা এ লেখায় কোনো মাসআলার দালিলিক বিশ্লেষণে যাব না। বরং যে জায়গাগুলোতে তাঁদের সঙ্গে আমাদের মতের ভিন্নতা আছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সে জায়গাগুলোতে আমরা যে দলিল বা ‘সংশয়’-এর কারণে তাঁদের কথা গ্রহণ করতে পারছি না, তার প্রতি সামান্য ইঙ্গিত করে যাব শুধু; যদিও তাঁদের লেখা খুবই ‘মুজমাল’ ও সংক্ষিপ্ত হওয়ায় তাঁদের সঙ্গে আমাদের মতপার্থক্যের অনেকগুলো জায়গাই অস্পষ্ট।

এক. প্রথমে এই প্রকাশনার জন্য আমরা তাঁদের শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। তাঁদের মতো ইলমি ও মান্যবর ব্যক্তিরা উম্মতে মুসলিমার সময়ের একটি গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায়-জিহাদের ইলমি বিষয়গুলো উম্মতের সামনে তুলে ধারার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন এবং সে বিষয়ে নিজেদের মূল্যবান ও প্রাথমিক মতামত প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া যদিও তা তাঁদের ফুযালাদের উদ্দেশ্য প্রকাশিত, কিন্তু তাতে ইলমী ও আমলী জীবনের এমন অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা আছে, যা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো এবং একজন আলেম ও তালিবে ইলমের সফলতার অনেক বড় মাইলফলক। আল্লাহ আমাদের সকলকে তা থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন এবং তাঁদের ইলমের ছায়া আমাদের উপর দীর্ঘায়িত করুন।

দুই. আমি ব্যক্তিগতভাবে উক্ত প্রকাশনা হাতে পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত হয়েছি এবং একে যথারীতি আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত ও আশীর্বাদ মনে হয়েছে। কারণ আমাদের দেশে কাজের প্রধান একটি সমস্যা হল, বিষয়টির প্রতি উলামায়ে কেরামের অনাগ্রহ। উলামায়ে কেরামের অধিকাংশই বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দেয়া, অধ্যয়ন করা, মাসায়েলগুলো পরিষ্কার করা –কোনোটার প্রতিই আগ্রহী নন। অনেককে অনেক চেষ্টা করেও আমরা অধ্যয়নের প্রতি মনোযোগী করতে পারিনি। উল্টো বরং ইলম ও অধ্যয়ন ব্যতীতই নীরব থাকা, নেতিবাচক অবস্থানে দৃঢ় থাকা, অনেক ক্ষেত্রে বিরোধিতা করার প্রবণতাই আমরা বেশি লক্ষ করেছি। আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা যে আলেমকেই উম্মতের দরদ এবং জিহাদের প্রতি মোহাব্বত ও ভালোবাসা নিয়ে শরীয়তের আলোকে আমাদের কাজের অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করতে দেখেছি, ফলাফলে আমরা তাঁদের সকলকেই আমাদের সমর্থক হিসেবে পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। অবশ্য যারা অধ্যয়ন না করেই বিষয়টিকে ‘মাফরূগ আনহু’ (মীমাংসিত) মনে করছেন অথবা ময়দানে সক্রিয় বিভিন্ন ব্যক্তি বা কাফেলার অনেক ভুল পদক্ষেপে প্রভাবিত ও ব্যথিত হয়েছেন এবং সবাইকে একই পাল্লায় মেপেছেন, আমাদেরকে যথাযথ বিশ্লেষণের সুযোগ পাননি, তাঁদের কথা ভিন্ন। সুতরাং এই নাযুক পরিস্থিতিতে তাঁদের মতো কাবেল ও মাকবুল ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দেয়া ময়দানে কর্মরতদের জন্য আশীর্বাদ নয় তো কী? কারণ আমরা কখনোই চাই না, তাঁরা আমাদের সঙ্গে একমত হয়ে যান; বরং আমরা শুধু চাই, আল্লাহ আমাদের উভয় কাফেলাকে হকের উপর একত্র করে দিন। ইলম ও আমলকে বিচ্ছিন্ন না রেখে তিনি যেন সত্যের উপর উভয়ের শুভ সম্মিলনের সুব্যবস্থা করে দেন।

 

তিন. আমাদের দায়িত্বশীলরা আলহামদুলিল্লাহ শুরু থেকেই আমাদেরকে শিখিয়েছেন এবং সর্বাত্মক চেষ্টা করে এসেছেন, উম্মাহর এই ক্রান্তিকালে দ্বীনের জন্য আমাদের কোরবানির প্রতিটি অংশ, মুসলিম যুবকদের বুকের তাজা রক্তের প্রতিটি বিন্দু যেন একমাত্র এবং একমাত্র সহীহ ইলম ও শরীয়তের ভিত্তিতেই মহান রাব্বে কারীমের দরবারে নিবেদিত হয়। অন্যথায় আল্লাহ না করুন, আল্লাহ না করুন- বাহ্যত দুনিয়ার আরাম আয়েশের যিন্দেগি পরিহার করে গ্রহণ করা এই কোরবানির যিন্দেগি যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মানশা ও শরীয়তের খেলাফ হয়, তাহলে তা হবে আমাদের জন্য কোরআনের ভাষায়-

قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا، الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا

“(হে নবী) আপনি বলে দিন, আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব, কর্মে কারা সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? তারা সেই সব লোক, পার্থিব জীবনে যাদের সকল শ্রম পণ্ড হয়ে গেছে; অথচ তারা মনে করে তারা খুবই ভাল কাজ করছে(কাহফ: ১০৩১০৪)

আল্লাহ আমাদেরকে এবং মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সন্তানকে এমন ক্ষতি থেকে হেফজত করুন। আমিন ইয়া রাব্বাল আলামিন।

তবে মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। আমরাও আমাদেরকে ভুলের উর্ধ্বে মনে করি না। যারা আমাদের ভুল সংশোধন করে দিবেন, তাঁদেরকে আমরা সাধুবাদ জানাই এবং আমাদের মুহসিন ও কল্যাণকামী মনে করি। সুতরাং আমাদের সাথী শুভানুধ্যায়ী সকলকে যে দু’টি বিষয় সর্বদা মনে রাখতে হবে এবং মাঝে মধ্যেই স্মরণ করে আলোচনা করে তার চর্চা তাজা রাখতে হবে, তা হল-

. যখনই শরঈ দলিলের আলোকে আমাদের আকীদা আমলের কোনো ভুল প্রমাণিত হবে, সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে ভুল পরিহার করে সত্য গ্রহণের জন্য সর্বদা বদ্ধপরিকর থাকতে হবে। তাতে আমাদের কী ক্ষতি হল, তা যেন আমাদেরকে সত্য গ্রহণে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত না করে। এমনকি আমাদের কাজের কোনো ক্ষতি হলেও না। কারণ দ্বীন আমাদের কাজ রক্ষার জন্য নয়; বরং কাজ আমাদের দ্বীন রক্ষার জন্য। আজ দ্বীন রক্ষার নামে নিজেদের গৃহীত কাজ, মসনদ কিংবা দুনিয়া রক্ষার জন্য, দ্বীনের গলায় ছুরি চালানোর যে প্রবণতা দ্বীনদার শ্রেণীর মাঝে ব্যাপক হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমরাও যেন তাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে যাই। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

لا يَدْخُل الجَنَّةَ مَنْ في قَلْبِهِ مِثْقالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ، فقال رجلٌ: إن الرجلَ يُحبّ أن يكون ثوبُه حسناً ونعلُه حسنةً، قال: إنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الجَمالَ، الكِبْرُ بَطَرُ الحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ. –صحيح مسلم برقم:275

যার অন্তরে যাররা পরিমাণ কিবির থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না এক সাহাবি আরজ করলেন, কেউ তো তার পোশাক জুতো জোড়া সুন্দর হওয়া পছন্দ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহও সুন্দর এবং তিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন কিবির হচ্ছে সত্যকে অস্বীকার করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৫)

. তবে সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকে এও মনে রাখতে হবে যে, আমরা যে অবস্থান গ্রহণ করেছি, তা যদি আমাদের সাধ্য অনুযায়ী তাহকিক করে শরীয়তের দলিলের আলোকে গ্রহণ করে থাকি, তাহলে কাজ আমাদেরকে তার উপর অবিচল থেকেই করে যেতে হবে; সংশয় নিয়ে নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত শরঈ দলিলের আলোকে সংশয় সৃষ্টি না হবে অথবা বিপরীত দিকটা দলিল দ্বারা সঠিক প্রমাণিত না হবে, ততক্ষণই আমাদেরকে তার উপর অবিচল থাকতে হবে। এটাই শরীয়তের মাসআলা এবং সর্বসম্মত নীতি। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَعْبُدُ اللَّهَ عَلَى حَرْفٍ فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهِ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انْقَلَبَ عَلَى وَجْهِهِ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةَ ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ

কিছু মানুষ আল্লাহর ইবাদত করে দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় যদি কল্যাণ তার হস্তগত হয়, তাতে তার চিত্ত প্রশান্ত হয় আর যদি ফিতনা তাকে আক্রান্ত করে, সে পশ্চাতে ফিরে যায় ফলে সে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুনিয়া আখেরাতে এটাই তো সুস্পষ্ট ক্ষতি(সূরা হাজ্জ:১১)

সুতরাং শরঈ দলিলের বিপরীতে দলিল আসার আগ পর্যন্ত, কোনো ব্যক্তির কথায় নিজের দালিলিক অবস্থানে বিন্দুমাত্র সংশয়ের সুযোগ নেই। চাই তিনি যত বড় ব্যক্তিই হোন না কেন। ব্যক্তি শরীয়তের দলিল নয়; শরীয়তের দলিল কোরআন সুন্নাহ।

. উপরোক্ত দু’টি বিষয়ের সঙ্গে আরেকটি বিষয়ও পরিষ্কার থাকা জরুরি। কারো পক্ষ থেকে চিহ্নিত আমাদের ভুলটি যদি ‘মুজতাহাদ ফিহি’ হয় এবং তাতে দলিলভিত্তিক ইখতেলাফের অবকাশ থাকে, তাহলে সেখানে ফিকহ ফতোয়ার উসূল ও দলিলের আলোকে আমাদের একটি মত গ্রহণের অবকাশ অবশ্যই থাকবে। সেখানে শরীয়ত সম্মত একটি মত গ্রহণ করার পরও অপর মতটি আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া বা তার ভিত্তিতে আমাদেরকে ভুল আখ্যায়িত করা শরীয়তের দৃষ্টিতেই অন্যায় বলে বিবেচিত হবে। তাছাড়া আমরা যেহেতু সকল মাযহাবের লোকই একই আমীরের অধীনে কাজ করি, এজন্য এমন মতভেদপূর্ণ মাসআলায় আমীরের পক্ষ থেকে কোনো একটি নির্ধারিত করে দেয়ার পর, শরীয়তের দৃষ্টিতেই আমাদের অন্য আরেকটি মত গ্রহণ করার সুযোগ থাকে না; বরং আমীরের নির্ধারিত মতটি গ্রহণ করা সকলের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে।

 

চার. প্রকাশনাটিতে তাঁরা চলমান সকল জিহাদি কার্যক্রম সম্পর্কে যে মন্তব্যগুলো করেছেন এবং তার বিপরীতে সঠিক মাসআলা হিসেবে যে কথাগুলো বলেছেন, তার কোনোটিতেই তাঁরা কোনো তথ্য উপাত্ত ও দলিল প্রমাণ উল্লেখ করেননি। হয়তো এটি তড়িৎ, সংক্ষিপ্ত ও প্রথম স্তরের কাজ হিসেবে তাঁরা তা করেননি। আমরা আশা করি খুব শীঘ্রই তাঁরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁদের দলিল প্রমাণ পেশ করবেন ইনশাআল্লাহ। সুতরাং দলিল প্রমাণ হাজির হওয়ার আগ পর্যন্ত তা আমাদের কাছে শুধুই সাক্ষরকারী ব্যক্তিদ্বয় কিংবা একটি প্রতিষ্ঠানের মতামত মাত্র। অতএব আপাতত আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করে তাঁদের রায় গ্রহণ করার সুযোগ নেই।

আর একই কারণে আমরা তাঁদের এই বক্তব্যগুলো সম্পর্কে এখানে যা বলা হয়েছে, তার অতিরিক্ত কোনো মন্তব্য করা থেকেও বিরত থাকব ইনশাআল্লাহ। আমরা মনে করব, তাঁরা যেহেতু দ্বীন ও ইলমে-দ্বীনের নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি, সুতরাং তাঁরা যা বলেছেন, তার দলিল প্রমাণ অবশ্যই তাঁদের কাছে আছে। অতএব আমরা তাঁদের মতামতকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখব এবং আদব পরিপন্থী সকল আচরণ ও উচ্চারণ থেকে বিরত থাকব। যখন প্রয়োজন হবে, ইলম ও ইখতেলাফের উসূল ও আদাব রক্ষা করে শালীনতার সঙ্গে ইলমের ভাষায় কথা বলব ইনশাআল্লাহ।

 

পাঁচ. মনে রাখতে হবে, আদাবুল ইখতেলাফ তথা মতবিরোধের শিষ্টাচার দ্বীন ও ইলমে-দ্বীনের অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আদাবুল ইখতেলাফের সীমালঙ্ঘন অনেক ক্ষেত্রে ঈমানকেও আক্রান্ত করে। একজন মুমিনের সঙ্গে ‘উখওয়াতে ঈমানী’ তথা ঈমানী ভ্রাতৃত্ব ততক্ষণ বহাল থাকে, যতক্ষণ তিনি মুমিন থাকেন এবং ততক্ষণই তার সঙ্গে ঈমানী ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখা এবং সেই ভ্রাতৃত্বের হক আদায় করা জরুরি। ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী আচরণ উচ্চারণ থেকে বেঁচে থাকাও জরুরি। আর এই ঈমানী ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক যখন একজন মুমিন থেকে উন্নীত হতে হতে একজন নেককার মুমিনের সঙ্গে স্থাপিত হয়, তখন তার গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। আরো উন্নীত হয়ে যখন তা একজন ওয়ারিসে নবী ও হামিলে অহী পর্যন্ত পৌঁছে, তখন তো তা নবীদের ঈমানী ভ্রাতৃত্বের আগের স্তরে উপনীত হয়। নবীদের সঙ্গে সামান্যতম বেয়দবিকেও আল্লাহ কোরআনে কারীমে ঈমান বিধ্বংসের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একটু গভীরভাবে দেখুন, আল্লাহ কিভাবে নবীর সঙ্গে বেয়দবির ভয়াবহতা চিত্রায়িত করেছেন-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ (1) يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ (2) إِنَّ الَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصْوَاتَهُمْ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ أُولَئِكَ الَّذِينَ امْتَحَنَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوَى لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ (3) إِنَّ الَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِنْ وَرَاءِ الْحُجُرَاتِ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ (4). الحجرات

“হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সম্মুখে তোমরা কোনো বিষয়ে অগ্রণী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর নিজেদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না এবং নিজেদের মধ্যে যেভাবে উচ্চস্বরে কথা বল, তাঁর সঙ্গে সেরকম উচ্চস্বরে কথা বলো না কারণ এতে তোমাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে; অথচ তোমরা বুঝতেও পারবে না যারা আল্লাহর রাসূলের সম্মুখে নিজেদের কণ্ঠস্বর নীচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরষ্কার

যারা কামরার বাইরে থেকে আপনাকে উচ্চস্বরে ডাকে, তাদের অধিকাংশই নির্বোধ” (সূরা হুজুরাত: ১-৪)

উক্ত আয়াতের তাফসীরে মুফতী শফি রহ. বলেছেন-

علمائے دين اور ديني مقتداؤں كے ساتھ بھي يهي ادب ملحوظ ركھنا چاهئے. معارف القرآن، ج:8،ص:100

“উলামায়ে দ্বীন ও দ্বীনের অনুসৃত ব্যক্তিদের সঙ্গেও একই রকম আদবের খেয়াল রাখা চাই[1]

অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-

وَقُلْ لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْزَغُ بَيْنَهُمْ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلْإِنْسَانِ عَدُوًّا مُبِينًا. الاسراء:53

“এবং আমার বান্দাদেরকে যা উত্তম, তা বলতে বল। নিশ্চয়ই শয়তান তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উস্কানি দেয়; শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা ইসরা: ৫৩)

এছাড়া একজন সাধারণ মুমিন সম্পর্কে কোরআন সুন্নাহর নির্দেশনাগুলোও একটু নজর বুলিয়ে দেখুন, বিষয়টি কত গভীর ও স্পর্শকাতর।

ইরশাদ হচ্ছে-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَى أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوا أَنْفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ (11). الحجرات

“হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে কেননা যাকে উপহাস করা হয়, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তমও হতে পারে এবং কোনো নারী যেন অপর নারীকে উপহাস না করে কেননা যাকে উপহাস করা হয়, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তমও হতে পারে” (সূরা হুজুরাত: ১১)

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

من صلى صلاتنا واستقبل قبلتنا وأكل ذبيحتنا فذلك المسلم الذي له ذمة الله وذمة رسوله فلا تخفروا الله في ذمته. صحيح البخاري، رقم:391

“যে ব্যক্তি আমাদের সালাত আদায় করল, আমাদের কিবলা গ্রহণ করল এবং আমাদের যবেহকৃত প্রাণী ভক্ষণ করল, সে এমন মুসলিম, যার দায়িত্ব আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের যিম্মায় সুতরাং তোমরা আল্লাহর যিম্মায় খেয়ানত করো না” (সহীহ বোখারী: ৩৯১)

 

ছয়. তাছাড়া একথা সুস্পষ্ট যে, এই লেখা যাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা আমাদের কাছে বহু কারণেই এক অনন্য উচ্চতায় সমুন্নত। বিশেষ একটি কারণ হল, আমরা এখন কাজের জন্য যাদেরকে সঙ্গে পাচ্ছি, তাঁদেরকে পাওয়ার পেছনেও তাঁদের বড় অবদান রয়েছে। কারণ আমাদের এদেশে দ্বীনি বিষয়ে `জুমূদ’ ও অন্ধ অনুসরণের যে ব্যাপক মহামারি ছিল, তা থেকে বের করে শরীয়তের বিষয়গুলোকে ইলমের আলোকে বিচার বিশ্লেষণ করার সৎ সাহস ও মানসিকতা আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে বলা যায় তাঁরাই শিখিয়েছেন। এক্ষেত্রে অন্যদের কোনো অবদান থাকলেও, তাঁরাই যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছেন, তা কিছুতেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এগুলোই আমাদের কাজের মূল ভিত্তি ও প্রধান অবলম্বন। কারণ যারা ‘জুমূদ’ ও অন্ধ অনুসরণ থেকে বের হতে পারে না, তারা কখনো গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে এসে এজাতীয় হারিয়ে যাওয়া ফরীযা আঞ্জামের কাজ করতে পারে না। সুতরাং তাঁদের এই অবদানকে আমাদের মূল্যায়ন করতেই হবে।

 

সাত. কোনো মাসআলায় আমার সঙ্গে কারো দ্বিমত হলে তাকে গোমরাহ মনে করাই বড় গোমরাহী। এমনকি বাস্তবে যদি তার অবস্থান ভুলও হয় তবুও। অন্যথায় অনুসরণ করার জন্য একজন ইমামও পাওয়া যাবে না; বরং আকাশ থেকে ফেরেশতা নামিয়ে আনতে হবে। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে যাকে তাকে যখন তখন গোমরাহ, দরবারি আলেম, উলামায়ে সূ, বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী ইত্যাদি বিষেশণে বিষেশায়িত করা নি:সন্দেহে গোমরাহী। কিন্তু অত্যন্ত দু:খজনকভাবেই লক্ষ করছি, সামাজিক মিডিয়ায় কিছু তরুন আলেম বা তালিবে ইলম এই কাজগুলো করে যাচ্ছেন। আমরা তাদেরকে বলব, এখনো সময় আছে, তওবা করে ফিরে আসুন, নিজের মূল্যবান জীবনকে নিজের হাতে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিবেন না। একটু লক্ষ করুন, হাফেজ ইবনে আসাকির রহ. বলেন-

إن لحوم العلماء مسمومة وعادة الله في هتك أستار منتقصيهم معلومة وأن من أطلق لسانه في العلماء بالثلب ابتلاه الله قبل موته بموت القلب. -شرح سنن أبي داود، عبد المحسن العباد

“উলামায়ে কেরামের গোশত বিষমিশ্রিত। আল্লাহ কর্তৃক তাঁদের মর্যাদা ক্ষুণ্নকারীদের লঞ্ছিত করার নিয়ম সকলেরই জ্ঞাতযে আলেমদের তিরস্কারে যবান দরাযি করে, আল্লাহ তাকে মৃত্যুর পূর্বেই অন্তরের মৃত্যুতে আক্রান্ত করেন।”

আমাদের কাজ হল, যদি বাস্তবেই কোরআন সুন্নাহর আলোকে কারো কথা ভুল প্রমাণিত হয়, প্রথমে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং এ বিষয়ে তার অনুসরণ থেকে বিরত থাকা। সংশোধন না হলে, তার ক্ষতি যদি মুসলমানদেরকে স্পর্শ করে, তাহলে তার কারণে যাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাদের সামনে ইলমের আলোকে আদাবুল ইখতেলাফের প্রতি লক্ষ রেখে ভুলটি চিহ্নিত করে দেয়া, যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি চিহ্নিত করারও প্রয়োজন নেই। তবে হাঁ, যদি তার মৌলিক আকীদা বিশ্বাস ও সামগ্রিক চিন্তা চেতনাই বিভ্রান্ত হয়ে যায় এবং তাতে মুসলামনদের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তাহলে অবশ্যই তাকে চিহ্নিত করে দিতে হবে, যাতে মানুষ অজ্ঞতাবশত তার অনুসরণ না করে।

বিষয়টি আসলে অনেক দীর্ঘ। এই সংক্ষিপ্ত লেখায় প্রয়োজনবোধে সংক্ষেপে দু’একটি কথা বললাম। কারো বুঝতে অসুবিধা হলে বা অস্পষ্ট থাকলে আলেম ভাইদের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝে নিবেন ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাওফীক দিলে এ বিষয়ে আমাদের ভাইদের জন্য স্বতন্ত্র একটি লেখা তৈরির ইচ্ছা আছে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ কবুল করুন এবং ইখলাস ও ইতকানের সঙ্গে তা আঞ্জাম দেয়ার তাওফীক দান করুন।

 

আট. বর্তমানে সারা বিশ্বে এমনকি বাংলাদেশেও অনেক জিহাদি কাফেলা বিদ্যমান। প্রকাশনাটিতে তাঁরা যে ভুলগুলো নির্দেশ করেছেন, তা কোন কাফেলার ভুল, তা যেমন চিহ্নিত করেননি, তেমনি কোনো কাফেলা যে বিশুদ্ধ শরঈ পদ্ধতিতে কাজ করে থাকতে পারে, তার প্রতিও সামান্য কোনো ইঙ্গিত করেননি; বরং ঢালাওভাবে সবার সম্পর্কেই কথাগুলো বলেছেন। সুতরাং একথা পরিষ্কার যে, চলমান সবগুলো কাফেলাকেই তাঁরা তাঁদের ভাষায় ‘মুহদাছ’ ও নব আবিষ্কৃত এবং শরীয়ত পরিপন্থী পদ্ধতির অনুসারী মনে করছেন।

বাস্তব যদি তাই হয়, তাহলে আমরা বলব এখানে কিছু বিষয় আছে, যেগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং সেগুলো দ্বারা যদি আমাদের প্রতি নির্দেশ করা হয়ে থাকে, তাহলে তা আমাদের প্রতি অপবাদ বৈ কি?! যদিও তাঁরা হয়তো তথ্যের অভাবে কিংবা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে এমনটি ধারণা করেছেন। আর আমাদের দুশমনরা যেভাবে আমাদের পরস্পরের মাঝে সঠিক তথ্য আদান প্রদানের ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি করে ভুল তথ্য সরবরাহ করে চলেছে, তাতে হয়তো আল্লাহর কাছে তাঁদের ওজর গ্রহণযোগ্য হতে পারে, কিন্তু তা তাঁদের মতো ইলমী অঙ্গনের গুরু দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের শান পরিপন্থী অবশ্যই। যেমন ভুলের মৌলিক বিষয়টি তাঁরা চিহ্নিত করেছেন এভাবে-

اس سلسلے ميں ايك خاكه بعض  حضرات نےايسا پيش كيا هے جس كا مدار انهوں نے متعدد شاذ يا غلو آميز آراء پر ركھا هے. ص:10

সম্পর্কে কোনো কোনো হযরত এমন একটি পদ্ধতি পেশ করেছেন, যার ভিত্তি রেখেছেন তারা অনেকগুলো শায বিচ্ছিন্ন এবং উগ্রতা মিশ্রিত মতামতের উপর

এখানে আমি আপনাদেরকে শুধু আমাদের আচরবিধির একটি অংশ স্মরণ করিয়ে দিতে চাই-

জিহাদের ফরজ আদায়ের জন্য জামাআত নিজেকে শরীয়তের ঐসব সুস্পষ্ট নীতির মাঝে সীমাবদ্ধ রাখে, যা সালাফে-সালেহীন কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে লিপিবদ্ধ করেছেন।

  1. ফলে জামাআত শত্রুদের হত্যা করা, ওদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া এবং ওদের সম্পদকে গনিমত বানানোর ক্ষেত্রে কোনো তাউয়ীল বা অস্পষ্ট কোনো অভিব্যক্তিকে ভিত্তি বানায় না, বরং শরীয়তের সুস্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত দলীলকে ভিত্তি বানায়।
  2. জামাআত নিজস্ব মুজাহিদদের এই সীমায় সীমাবদ্ধ রাখে যে, তারা যেন শত্রুর সাথে আচরণের ক্ষেত্রে, এমনকি রণাঙ্গনেও শরীয়তের মূলনীতি অনুসরণ করে এবং অসংগত ও অস্পষ্ট তাউয়ীলের ভিত্তিতে কোনো সন্দেহজনক বিষয় অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে। কাজেই, কোনো ব্যক্তির জান ও মাল সন্দেহজনক অবস্থায় থাকলে, জামাআত নিজ সাথীদেরকে তা পরিহার করে উম্মতের ফকীহ আলেমগণের বিবৃত প্রতিষ্ঠিত নীতির মাঝে সীমাবদ্ধ থাকার আদেশ দেয়।

জামাআত প্রত্যেক এমন লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা বানানো অথবা হত্যা করা থেকে বিরত থাকে, যাকে হত্যা করা শরীয়ত অনুযায়ী হয়তো জায়েয, কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের ফলে জিহাদের লাভ অপেক্ষা ক্ষতি বেশি হয় অথবা যা মুসলিম উম্মতের উপলব্ধির বাইরে এবং মুসলিম উম্মতকে জিহাদ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়

জামাআত প্রত্যেক এমন পন্থায় অর্থ-সম্পদ নেয়া থেকে বিরত থাকে, যার কারণে জিহাদ ও মুজাহিদদের বদনাম হয়।

  1. ফলে জামাআত এমন কাফের ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ-সম্পদ (ছিনিয়ে) নেয়া থেকে বিরত থাকে, যা শরীয়ত অনুযায়ী জায়েয, কিন্তু ঐ ব্যক্তি গরীব অথবা মাজলুম শ্রেণীর মানুষ হওয়ায় তাতে ইসলাম ও জিহাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহর অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো, গরীব, অভাবী ও মাজলুম শ্রেণীকে শাসক শ্রেণীর জুলুম থেকে মুক্ত করে ইসলামের ছায়ায় নিয়ে আসা।
  2. একই কারণে জামাআত গনিমতের তালিকায় এমন সুস্পষ্ট বস্তুকে নিশানা বানায়, যার ব্যাপারে কারও কোনো সন্দেহ না হয়।

একইভাবে, মুখে কালিমা উচ্চারণ করা কোনো ব্যক্তিকে তাকফির করা, তার সাথে যুদ্ধ করা, তাকে হত্যা করার ব্যাপারে জামাআত নিজেকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর সুস্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত নীতির মাঝে সীমাবদ্ধ রাখে। পাশাপাশি প্রত্যেক এমন অনুপযুক্ত তাউয়ীল থেকে নিজেকে বাঁচায়, যা শরীয়তের ভারসাম্যপূর্ণ রাস্তা থেকে মানুষকে বিচ্যুত করে। একইভাবে, জামাআতের সাধারণ সাথীদেরকেও এরকম স্পর্শকাতর বিষয়ের উপর কথা বলা থেকে বিরত রাখে এবং এসব বিষয়ে তাদেরকে হক্বপন্থী উলামায়ে কেরামের শরণাপন্ন হওয়ার নির্দেশ দেয় এবং তাদের দেয়া সীমারেখায় সীমাবদ্ধ রাখে।” (আচরণবিধির উদ্ধৃতি সমাপ্ত)

তাছাড়া আমাদের কাফেলা শুধুই একটি জিহাদি কাফেলা নয়; যদিও বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতির কারণে অনেকেই এমনটা ধারণা করে থাকেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে কাফেলাও বিষয়টি উজ্জ্বল করে তুলে ধরে। বরং এই কাফেলা আগাগোড়াই আল্লাহর যমিনে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ দ্বীন কায়েমের একটি আন্দোলন। দ্বীনের ৭৭ শাখার যে শাখাগুলো মৃত, সেগুলো যিন্দা করার দাওয়াত এবং যেগুলো বিকৃত, সেগুলো বিশুদ্ধ করার দাওয়াতই আমাদের প্রধান মিশন। যাদের অন্তত ‘দাওয়াতে ফরদিয়া’র সিলেবাস সম্পর্কে ধারণা আছে এবং দাওয়াতে ফরদিয়ার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাদের কাছে বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট। কাফেলার লক্ষ্য উদ্দেশ্যের প্রথম বিন্দুটি লক্ষ করুন-

তাওহীদ ও একত্ববাদের দাওয়াত দেয়া। অর্থাৎ, ইবাদত থেকে শুরু করে শাসনব্যবস্থা পর্যন্ত সবকিছু একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য নির্দিষ্ট করার আহ্বান জানানো।

এ সম্পর্কে আপাতত এতটুকুর উপরই শেষ করলাম।

 

নয়. এবার আমরা তাঁদের বক্তব্যগুলোর বিপরীতে আমাদের কিছু দলিল কিংবা ‘সংশয়’-এর কথা বলতে পারি, যার কারণে তাঁদের বক্তব্যের দলিল আসার আগে আমরা কথাগুলো গ্রহণ করতে পারছি না।

১. প্রকাশনাটিতে তাঁরা বলেছেন-

  1. ايك طرف تو ظلم يه هے كه عرصئه دراز سے جهاد كا فيرضه مهجور پڑا هوا هے، دوسري طرف اس كے بارے ميں معاشرےميں عجيب تطرف پايا جاتا هے، كوئي تو تحريف كرتے كرتے گويا اس كے انكار تك هي پهنچنے لگےاور يه معلوم كر كے افسوس هوا كه اب تو ايسي باتيں بعض ايسے دربار سے بھي صريح عبارتوں ميں سنائي ديتي هيں جنهيں ديوبندي هونے كا دعوى هے! انا لله وانا اليه راجعون! ص:6-7

“৮. একদিকে তো জুলুম হল, দীর্ঘকাল যাবৎ জিহাদের ফরিযা পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে আছে অপরদিকে সমাজে জিহাদ সম্পর্কে অদ্ভুত প্রান্তিকতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে কেউ তো তাহরীফ করতে করতে যেন তা অস্বীকারই করে বসবে… এবং এটা জেনে আফসোস হল যে, এখন তো এমন কথা এমন দরবার থেকেও সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে শোনা যায়, যারা দেওবন্দী হওয়ার দাবিদার ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পৃ. ৬-৭

ক. এখানে আমাদের সংশয়ের কারণ হল, তাঁদেরই ভাষায় “দীর্ঘকাল যাবৎ জিহাদের ফরিযা পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে আছে। অপরদিকে সমাজে জিহাদ সম্পর্কে অদ্ভুত প্রান্তিকতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। কেউ তো তাহরীফ করতে করতে যেন তা অস্বীকারই করে বসবে।” কিন্তু এই দীর্ঘকালে তাঁদের যে মাকাম এবং জিহাদ বিরোধীরা যেভাবে তাঁদের নীরবতাকে পুঁজি করে জিহাদের বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখে চলেছে, এই প্রেক্ষিতে তাঁদের উল্লেখযোগ্য কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ আমাদের নজরে পড়েনি। দ্বীনের অন্যান্য বিষয়ে তাঁরা আলহামদুলিল্লাহ জটিল থেকে জটিলতর এবং সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিষয়গুলোকে যেভাবে উম্মতের সামনে পরিষ্কার করে তুলে ধরছেন এবং তাহরীফাত ও খুরাফাতের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছেন, (আল্লাহ তাঁদের এই খেদমতকে উম্মতের জন্য স্থায়ী ও আরো সমৃদ্ধ করুন এবং উম্মতকে তার যথার্থ মূল্যায়ন করার এবং তা থেকে যাথাযথ উপকৃত হওয়ার ভরপুর তাওফীক দান করুন), জিহাদের বিষয়টি বর্তমান বিশ্বের সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ও জটিল হওয়া সত্বেও, এখানে তাঁদের সেরকম কোনো ভূমিকা আমরা লক্ষ করছি না।[2] আজ যখন উম্মতের কিছু তরুণ এই পরিত্যক্ত ফরিজা আদায়ের জন্য অগ্রসর হচ্ছেন, তখন তাদের ভুল ভ্রান্তি নির্দেশ করার জন্য তাঁরা প্রাসঙ্গিকভাবে সেই আলোচনা তুলে আনছেন। আমরা মনে করি, যখন উম্মতের একটি ফরীজা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে, কেউ তা আদায়ে এগিয়ে আসছে না, এই মুহূর্তে যখন কিছু তরুণ জীবন বাজি রেখে এই পথে নেমেছে, তখন তাদের কিছু ভুলভ্রান্তি থাকাই স্বাভাবিক। স্বভাবতই তখন অভিভাবকের দায়িত্ব হল, কাছে ডেকে ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দিয়ে তাদের তত্ত্বাবধান করা, তাদেরকে উৎসাহিত করা; যদি বিষয়টি জীবিত করা ফরজ মনে করেন।[3] পক্ষান্তরে যদি ফরজ মনে না করে নফল মনে করেন, তাহলে অবশ্য নফলের জন্য এই ঝুঁকিতে যাওয়া থেকে সম্পূর্ণই বারণ করতে পারেন। দ্বীনের অন্যান্য অঙ্গনে আমাদের অভিভাবকদের এমনটিই করতে দেখেছি। কিন্তু জিহাদের বিষয় আসলেই কেমন যেন তাঁদের ভূমিকা অন্যরকম মনে হয়। যেন কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখাই তাঁদের কাম্য বলে সন্দেহ হয়। আল্লাহ করুন আমার এ সন্দেহ অমূলক হোক!

খ. অধিকন্তু তাঁদের মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত জিহাদ বিষয়ক তাঁদের চিন্তা চেতনা দেখে কেউ কেউ তাঁদের ব্যাপারেও জিহাদের তাহরীফ ও ছাড়াছাড়ির প্রান্তিকতার সংশয় করছেন। এবিষয়ের উপর এক ভাই একটি লেখাও তৈরি করেছেন। শুনেছি এই লেখাটি মাসিক পত্রিকাটির তত্ত্বাবধায়কের ই-মেইলে পাঠানো হয়েছে এবং কর্তৃপক্ষের কাছে ফোনেও উপস্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আমরা এখানে সেই লেখাটি হুবহু তুলে ধরছি-

“মুহতারাম তত্ত্বাবধায়ক, মাসিক আলকাউসার!

বাদ সালাম, আমি আলকাউসারের একজন নিয়মিত পাঠক। দ্বীন ও শরীয়ত সম্পর্কে আমাদের আস্থার জায়গা এখন খুব সীমিত হয়ে এসেছে। বাহ্যত অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান; বড় বড় আলেম, কিন্তু যা বলেন এবং করেন, ঢালাওভাবে তাতে আস্থা রাখা এখন ঈমানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মাঝে আলকাউসার পেয়ে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। কারণ আলকাউসার আমাদের আস্থার কথা বলে। আলকাউসার ইলমের কথা বলে। আলকাউসার হকের কথা বলে। দলিলভিত্তিক কথা বলে। আলকাউসার কাউকে ভয় করে হকের কথা গোপন করে না। কারো অন্ধ তাকলিদ করেও দলীল থেকে চোখ বন্ধ রাখে না। তবে কিছু বিষয় আমরা মনে করি হালাত ও পরিস্থিতির কারণে হেকমতে আমলি হিসেবে এড়িয়ে যায় বা চুপ থাকে কিংবা সর্বোচ্চ তাওরিয়া করে। কিন্তু অন্যরা যেমন দ্বীন ও শরীয়তের মানশার খেলাফ বলে হেকমতের নামে চালিয়ে দেয়; পরিস্থিতির দোহাই দেয়, আলকাউসার তা করে না। হেকমতের কথা বলে হক গোপন করে না।

ইসলামের দিফা ও শাসক অংশ দু’টি আজ উম্মত ভুলে গেছে; শুধু তাই নয়; বরং তার অনুভূতিও হারিয়ে ফেলেছে। উল্টো নিজেদের সাফাইর জন্য ব্যাপকভাবে এই বিষয়গুলোর তাহরিফ ও অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিচ্ছে। ইসলামের শিরোনামে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা হয়েছে, যারা পরিষ্কার ভাষায় শরীয়াহকে পর্যন্ত ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কহীন বলে প্রত্যাখ্যান করছে। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের এক শ্রেণীর উলামায়ে কেরামও এখানে পিছিয়ে নেই। আলকাউসার যেভাবেই হোক এইসব দোষ থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছে। ওয়ালিল্লাহিল হামদ।

কিন্তু গত ডিসেম্বর ’১৬-এর সম্পাদকীয়টি পড়ে আশাহত হয়েছি। মনে হল যেন এতদিনের চিরচেনা আলকাউসারের নতুন চেহারা ভেসে উঠল। বিষয়টি কি আসলেই তা, যা আমার মনে হয়েছে? না ভিন্ন কিছু? আমি বুঝতে ভুল করেছি? দিলের তামান্না বিষয়টি আমার বোঝার ভুলই প্রমাণিত হোক। কিন্তু আমার ভুল ধরার জন্য লেখাটি কয়েকবার পাঠ করেছি। ভুল আবিষ্কারে ব্যর্থ হয়েছি। আমার ধারণামতে কয়েজন বিজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে মতবিনিময় করেছি, তারাও আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। তাই আপনার শরণাপন্ন হলাম। আশা করি আমাকে সান্ত্বনার বাণী শোনাবেন।

সম্পাদকীয়টির শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘বিশেষ সম্পাদকীয়’, যা এই সম্পাদকীয়র গুরুত্ব অন্তত আলকাউসারের জন্য অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ আলকাউসার খুব মেপে মেপে শব্দ ব্যবহার করে। আমাদের জানামতে ‘বিশেষ সম্পদকীয়’ সম্ভবত আলকাউসারের এক যুগের প্রকাশনায় এটিই প্রথম। আমরা শুনেছি, আলকাউসারের সম্পাদকীয় সম্পাদক বা তত্ত্বাধায়ক লিখেন না; লিখেন অন্য কেউ। একবার ভেবেছিলাম হয়তো বিষয়টি যিনি লিখেছেন তার অভিমত; তাঁরা দুজন দেখলে বিষয়টি এ পর্যায়ে আসত না। কিন্তু ‘বিশেষ’ শব্দটি তাতেও বাঁধ সেধেছে।

আবার বিষয়টি হল বর্তমান বিশ্বের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। মুসলিম কাফির দুই মিল্লাতের সংঘাতের ও অস্তিত্বের বিষয়। কারণ মিয়ানমারের ঘটনা তো শুধুই মিয়ানমারের নয়; তা তো বর্তমান বিশ্বে চলমান ঘটনাপ্রবাহেরই একটি অংশমাত্র।

সম্পাদকীয়তে প্রথমে বিশ্বের মোড়লশ্রেণী কুফফার ও বিশ্বব্যবস্থার মূল্যায়ন করে লেখা হয়েছে-

“সুতরাং কেউ যদি বলেন, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মুসলিম নিধনকে কার্যত মানবাধিকারের বিরোধী মনে করা হয় না, তাহলে তাকে দোষ দেয়ার উপায় নেই।… মুসলিম সমাজের বাইরের এই বৈরী পরিবেশে খুব বেশি দমে যাওয়ার কারণ নেই। কারণ ইসলাম তার সূচনা থেকেই বৈরিতার মোকাবেলা করে এসেছে। তবে মুসলমানদের মাঝেই যখন এমন একটি শ্রেণীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে, যারা ধর্মপ্রাণ হয়েও পশ্চিমাদের বন্ধুত্ব ও মানবতায় বিশ্বাস করেন, তখন সত্যিই তা হয় মর্মান্তিক বেদনার ব্যাপার। এতে শত্রুপক্ষ দুই জায়গায় বিজয়ী হয়; নির্যাতন করে এবং নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর সাথে প্রতারণা করে।”…

বর্তমান যুগে মুসলিমদের সাথে সর্বপ্রকার সহিংসতার পরও যারা মুসলিম সমাজে মানবাধিকারের কথা বলেন, এদের মাঝে আর পূর্বযুগের মুনাফিক গোষ্ঠীর মাঝে বড় কোনো পার্থক্য আছে কি? এদের এই সব আপ্তবাক্যে যারা বিশ্বাস করেন, তারা যে ওদের কাছেও হাসি ও করুণার পাত্রে পরিণত হন, তা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করা যায়, তত তাড়াতাড়ি আমাদের লজ্জা নিরসনের উপায় হয়। আমাদের কর্তব্য চারপাশের উচ্চারণগুলোর অর্থ বাস্তব দৃষ্টান্তের সাথে মিলিয়ে গ্রহণ করা। আমরা পরাজিত হতে পারি, কিন্তু প্রতারিত যেন না হই।”

এখানে খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা হয়েছে এবং কালের ভাষায় চমৎকারভাবে তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এজন্য লেখক অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার হকদার।

এরপর বর্তমান সমস্যার মূল্যায়ন ও পরিস্থিতি উন্নতির মূলনীতি আলোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে-

“বিশ্বব্যাপী এখন যে সমস্যাটি আমরা অতিক্রম করছি, এর সঠিক মূল্যায়ন এবং পরিস্থিতির উন্নতির জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে নিজেদের শেকড়ে- কুরআন সুন্নাহর কাছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবন ও জীবনীর কাছে। তাহলে আমরা দেখতে সক্ষম হব যে, বর্তমান বিশ্বমুসলিমের নিপীড়িত অবস্থার সমতুল্য দৃশ্যটি রয়েছে পবিত্র সীরাতেও।… তাঁর মক্কী জীবন পুরোটাই ছিল মাজলূমিয়্যাত ও মাকহূরিয়্যাতের যুগ। কিন্তু এ যুগের এক গুরত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, ‘হারাকাহ’। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত বিপদেও দমে যাননি।… একই সাথে দাওয়াতের বিস্তার, সাফল্য ও প্রতিষ্ঠার জন্য যোগ্য মানবশ্রেণী ও উপযুক্ত ভূমির অন্বেষণ অব্যাহত রেখেছেন।”

এরপর সীরাত থেকে হিজরত ও নুসরাতের বিষয়টি মাশাআল্লাহ বেশ চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখান থেকে আমাদের বর্তমান সমস্যার সমাধানে আলো খুঁজে নেয়ার যথেষ্ট উপাদান আছে এবং নুসরাতের বিষয়ে সাধারণ জনগণ ও শাসকশ্রেণীর করণীয় নির্ণয়ে বেশ সুন্দর রাহনুমায়ি আছে।

কিন্তু নিবন্ধের শেষ পর্যায়ে এসে লেখা হয়েছে-

“আর দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে এই সংকটের স্থায়ী সমাধান। এ প্রচেষ্টার প্রাথমিক দায়িত্ব বর্তায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সংগঠন ওআইসি এবং মুসলিম সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণের উপর। প্রতিবেশী এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তর মুসলিম দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের দায়িত্ব এক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে বেশি। জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন বিশ্বমঞ্চের মাধ্যমে জালিম বার্মা সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে আরাকানবাসীদের হত্যা-নির্যাতন বন্ধের ব্যবস্থা করানোর দায়িত্ব তো মুসলিম নেতাদেরই নিতে হবে।”

আমার প্রশ্ন হল, নির্যাতিত মুসলমানদের নির্যাতন থেকে উদ্ধার করার জন্য স্থায়ী সমাধান হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবে কোন মুনাফিকের নিকট আবেদন করেছেন?

কোরআন সুন্নাহয়, সীরাতে রাসূল ও সীরাতে সাহাবার কোথায় এমন কথা আছে যে, যারা নির্যাতন করে, এবং নির্যাতন করে প্রতারণা করে, নির্যাতন থেকে বাঁচানোর জন্য অসহায়ের মতো তাদের নিকটই আবেদন করতে হবে?

বলতে পারেন এখানে তো আমরা আবেদনের কথা বলিনি; চাপ দেয়ার কথা বলেছি। কিন্তু আমি বলব বর্তমান বিশ্বে কোন্ মুসলিম রাষ্ট্র বা কোন্ মুসলিম সংস্থা এমন আছে, যে জাতিসঙ্ঘকে চাপ দেয়ার ক্ষমতা রাখে? এবং এই লেখা থেকে চাপের অর্থ কূটনৈতিক আবেদন নিবেদনের চেয়ে অতিরিক্ত কিছু কোনো পাঠক বুঝবে কি? বা যাদেরকে বলা হয়েছে তারাও বুঝবে কি?

কোনো কাফের রাষ্ট্র মুসলিমদের বিরুদ্ধে অন্যায় করলে জাতিসঙ্ঘের মতো আইম্মাতুল কুফফারদের মাধ্যমেই কেন তাকে চাপ দিতে হবে? মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে কি আল্লাহ কোনো ক্ষমতাই দেননি? কাফেরদের বিচার কাফেরদের নিকট চাওয়া ব্যতীত আর কোনো নির্দেশনা শরীয়ত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দেয়নি?

আমরা যখন এই উপদেশগুলো দিচ্ছি, তার আগে থেকেই বিভিন্ন রাষ্ট্র ও বিশ্বসংস্থাগুলো আমাদের মতো সাদা মোল্লাদের ধোঁকা দেয়ার জন্য তথাকথিত চাপ প্রয়োগের দায়সারা মেকি বাণীগুলো তোতা পাখির মতো আওড়ে যাচ্ছে এবং আমরা দেখছি’ এতে মায়ানমার সরকারের ‘এক বাল ভি হিলা নেহি সেকা,’ ফের এই অনর্থক নসিহতের কী অর্থ?

একদিকে সারা বিশ্বে কোনো মুসলমান (কাফেরদের দৃষ্টিতে) অন্যায় করলে; হোক সে অন্যায় تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ এর অংশ ‘ইরহাব’, (যা বর্তমান বিশ্বে মুসলিম অমুসলিম সকলের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় অপরাধ), স্বার্থান্বেষী শাসক গোষ্ঠী বিচারের জন্য তাকে কাফেরদের হাতে তুলে দিচ্ছে। বিচারের নামে এমন অসংখ্য মা-বোনসহ হাজারো মুসলিম আজ কাফেরদের বন্দিশালায় যুগ যুগ ধরে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। নিত্যদিন তারা আমাদের সেই মা বোনদের ইজ্জত নিয়ে পাশবিকতায় মেতে উঠছে। অপরদিকে এখন ইলমী অঙ্গন থেকেও বলা হচ্ছে, আমাদেরকে বিচারের জন্য জাতিসঙ্ঘের শরণাপন্ন হতে হবে এবং তাদের দিয়েই বিচার করাতে হবে। তার মানে কি অপরাধী যেই হোক; আমাদের বিচারক কাফেররা? আবার বলা হচ্ছে, এটা স্থায়ী সমাধান এবং এটাই আমাদের শেকড়ের কথা এবং কোরআন হাদীস ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতের কথা। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন!

এতদিন শুনেছি আলেমরা বলেছেন জিহাদ হুকুমতের দায়িত্ব। হুকুমত না করলে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু এই লেখা থেকে তো সন্দেহ হচ্ছে, জিহাদের বিধানই শরীয়তে এখনো আছে কি না? যদি থাকত, তাহলে এখানে মুসলিম নিধনের একটি সাময়িক ও একটি স্থায়ী সামাধান দেয়া হল এবং হুকুমতের দায়িত্ব চিহ্নিত করা হল, কিন্তু জিহাদের প্রসঙ্গটি উচ্চারিত হওয়ার সুযোগ একবারও আসল না? তাহলে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো মুসলিম নিধনের প্রতিবাদে মায়ানমারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ করলে তা কি শরীয়ত পরিপন্থী হবে? না জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাস হবে? না ফিকহ ও তাফাক্কুহ পরিপন্থী এবং হেকমত পরিপন্থী কাজ হবে?

যখন দুশমনদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুরো বিশ্বের মুসলমানরাও ঢালাওভাবে মুসলমানদের জিহাদসহ সকল সশস্ত্র সংগ্রামকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বলছে, বাংলাদেশেও ফিকহ ফতোয়ার ইতিহাসের কলঙ্ক লক্ষ সাক্ষর সম্বলিত ‘ফতোয়া’র পাশাপাশি মানব বন্ধন ও খৃস্টানদের নিকট দেওবন্দি উলামা তালাবাদের তথাকথিত সন্ত্রাস দমনে প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ যাবতীয় কর্মযজ্ঞ আঞ্জাম দেয়া হচ্ছে, নিজেদেরকে শান্তিবাদী প্রমাণ করার জন্যে (বাস্তবে যা অনেক ক্ষেত্রে জিহাদ ও মুজাদিদের থেকে নিজের বারাআত প্রমাণের জন্য), যখন দেশের শীর্ষ পাঁচ আলেমের একজন বলছেন, জিহাদ হল শুকরের গোস্ত খাওয়ার মতো হাসান লিগাইরিহি, আরেক শীর্ষ বলছেন, দেশে যত অন্যায় অনাচার ও অপকর্ম চলছে, সেগুলো দমনের জন্য হুকুমতকেও এমনভাবে কাজ করতে হবে, যাতে কারো মনে কষ্ট না হয়, হিতে বিপরীত না হয়, যখন দেওবন্দের খতীবুল হিন্দ ও ‘কুতুবে আলম’ সমস্বরে বলছেন, ধর্মের কারণে কখনো হিন্দু মুসলিমের মধ্যে মারামারি তো দূরের কথা ঝগড়াও হতে পারে না, নবী সাহাবিরা তা কখনোই করেননি, দেশের জনৈক শীর্ষ পীর যখন বলছেন, এখন আমাদের সবকিছু শত্রুদের নখদর্পনে। সুতরাং এই যুগে সশস্ত্র জিহাদ সম্ভব নয়; তাই এখন (কুফরি গণতান্ত্রিক) নির্বাচনই জিহাদ। যে নির্বাচনে দাঁড়াবে, ভোট দিবে তার ফযিলত ‘কাল মুজাহিদিল কায়েমে-স সায়েমে….’ (নাউযুবিল্লাহ)। এই পরিবেশে আলকাউসারের উক্ত বক্তব্য আমরা কিভাবে কোন অর্থে গ্রহণ করব?! আলকাউসারকে এবং আপনাদেরকে আমরা তাদের থেকে কী দিয়ে পার্থক্য করব?!

নিবন্ধের প্রথমে যে, নসিহত করে বলা হল- “এদের এই সব আপ্তবাক্যে যারা বিশ্বাস করেন, তারা যে ওদের কাছেও হাসি ও করুণার পাত্রে পরিণত হন তা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করা যায় তত তাড়াতাড়ি আমাদের লজ্জা নিরসনের উপায় হয়। আমাদের কর্তব্য চারপাশের উচ্চারণগুলোর অর্থ বাস্তব দৃষ্টান্তের সাথে মিলিয়ে গ্রহণ করা। আমরা পরাজিত হতে পারি, কিন্তু প্রতারিত যেন না হই।” নিবন্ধের শেষে এসে কি উপদেশদাতাও সেই গর্তে নিপতিত হয়ে গেলেন না? তিনিও কি প্রতারিত হয়ে গেলেন না? জাতিসঙ্ঘের ইতিহাসে বা পৃথিবীর শুরু থেকে কাফেরদের জাতিগত ইতিহাসে এমন কোনো নজির কি আছে তার কাছে, যেখানে তারা নিজেদেরকে মুসলমানদের উপর ন্যায়বিচারক হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছে?

আরেকটি বিষয় দেখানো হয়েছে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের সীরাত থেকে- “কিন্তু এ যুগের এক গুরত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, ‘হারাকাহ’। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত বিপদেও দমে যাননি।… একই সাথে দাওয়াতের বিস্তার, সাফল্য ও প্রতিষ্ঠার জন্য যোগ্য মানবশ্রেণী ও উপযুক্ত ভূমির অন্বেষণ অব্যাহত রেখেছেন।”

এখানে প্রশ্ন হল, আমাদের জানামতে প্রায় দেড় যুগের বেশি সময় ধরে আফগানিস্তানের মাটিতে একদল যোগ্য মানবশ্রেণী উপযুক্ত ভূমি প্রস্তুত করে আমাদেরকে আহ্বান করে যাচ্ছেন এবং তাঁরা এখনো প্রস্তুত; আহ্বান করে চলেছেন। তারা হকের উপর আছেন একথা আমরা যতটুকু দেখেছি, কোনো মতবিরোধ ছাড়া বিশ্বের সকল উলামায়ে কেরাম সর্বসম্মতভাবে সমর্থন করেছেন (যদিও ইদানিং দেখা যায় তাদেরকেও আমাদের কেউ কেউ সন্ত্রাসী বলছেন, জানি না আমেরিকাকে খুশি করার জন্য কি না!)। কিন্তু কই, আমরা কি তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছি? বুঝলাম সাড়া দেইনি এটা আমাদের কুসূর। কিন্তু কুসূরের কথা না বলে যদি বলি আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের অনুসরণে সেই উপযুক্ত ভূমি ও যোগ্য মানবশ্রেণীর সন্ধানে আছি, তাহলে বিষয়টা কেমন নেফাকের মতো হয়ে যায় না?

লেখক আমাদের যেই শেকড় এবং সীরাত থেকে নির্যাতিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্থায়ী সামাধান বের করে আনলেন, সেখানে যে মক্কা থেকে বের করে দেয়া মুহাজির ও আনসাররা মিলে জিহাদের মাধ্যমে নিজেদের ছেড়ে যাওয়া মক্কাভূমি বিজয় করলেন, সীরাতের এ অংশ কি লেখক পড়েননি? না অন্য কোনো হেকমতে তা চেপে গেছেন? আমার তো মনে হচ্ছে যদি বলা হত, মদীনার আনসার ও মক্কার মুহাজিরদের মতো বার্মার মুহাজিরদের সঙ্গে বাংলার আনসারদের মিলে, প্রয়োজনে শক্তি অর্জনের জন্য কয়েক বছর সময়ক্ষেপণ করে সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে বার্মাকে স্বাধীন করা এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান, তাহলে বিষয়টি সীরাত ও শেকড়ের সঙ্গে হুবহু মিলে যেত।

ক্ষমা করবেন, আপনার নিকট আমার কথাগুলো হয়তো জযবাতি মনে হতে পারে। কোনো কথা অতিরঞ্জন মনে হতে পারে। কিন্তু বিষয়টি আমাকে এতই ব্যথিত করেছে যে, আমি অনেক কষ্টে রীতিমতো চোখের পানি সংবরণ করে লেখাটি শেষ করেছি। নির্মম ও অমানবিক নিষ্ঠুরতায় নির্যাতিত মুসলমানদের প্রতি এ যেন আমাদের উপহাসের এক অনিঃশেষ ধারা। যাদেরকে এই দোষ থেকে মুক্ত মনে করে গর্ববোধ করি, আজ মনে হল তারাও তাতে নিপতিত হয়ে গেল; হয়তো অবচেতনভাবে। কামনা করি তাই হোক। আশা করি আমাকে সান্ত্বনা দিবেন।

আবারো ক্ষমা চাই, বড়দের সঙ্গে কথা বলার হিম্মত ও সাহস এবং ভাষা ও ‘সালীকা’ কিছুই আমার নেই। এজন্য অনেক সংশয় নিয়ে প্রায় এক বছরেরও অধিক সময় পর লেখাটি পাঠালাম। আমার কাছেও মনে হচ্ছে কী যেন অতিরিক্ত করে ফেলেছি। এজন্য নামটি প্রকাশ করারও হিম্মত পাচ্ছি না। কিন্তু তাছাড়া আমার দিলের ব্যাথাটা মনে হয় যেন বুঝাতে পারছি না। তাই এটা আমার দুর্বলতা হিসেবে আশা করি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আমার ভুলগুলো ধরিয়ে দিলে আমি শুধরে নিব ইনশাআল্লাহ।

যেই ই-মেইল থেকে লেখাটি পাঠালাম, তাতে কিছু পাঠালে আমি পেয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।”

. তাঁরা যে বলেছেন- “দীর্ঘকাল যাবৎ জিহাদের ফরিযা পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে আছে” -এই দীর্ঘকালের মেয়াদ কতদিন? একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে শুনেছি, ফুযালাদের আগের মজলিসে বলেছেন, বিগত ৩০/৪০ বছরে সহীহ নাহজে কেউ করেছেন আমার জানা নেই।” কিন্তু বাস্তব যদি তা-ই হয়, তাহলে নিম্নোক্ত হাদীসগুলোর কী অর্থ? এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لا تزال طائفة من أمتى يقاتلون على الحق ظاهرين إلى يوم القيامة.

“আমার উম্মতের একটি দল কেয়ামত পর্যন্ত সর্বদা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে কিতাল করে যাবে।” (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ইমান, ১৫৬)

অন্যত্র বলেছেন-

الجهاد ماض منذ بعثني الله إلى أن يقاتل آخر أمتي الدجال، لا يبطله جور جائر ولا عدل عادل.

“জিহাদ চলবে; যখন আল্লাহ আমাকে প্রেরণ করেছেন, তখন থেকে এই উম্মতের সর্বশেষ ব্যক্তি দাজ্জালকে হত্যা করা পর্যন্ত। কোনো জালেম বাদশার জুলুম কিংবা কোনো ন্যায়পরায়ণ বাদশার ইনসাফই তা বাতিল করবে না।” (সুনানে আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ, ২৫৩২)

এসব কারণে আমাদের যথেষ্ট সংশয় রয়েছে, বাস্তবেই কি বিগত ৩০/৪০ বছর থেকে বিশুদ্ধ জিহাদের ধারা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত, না তা তাঁদের হাতে থাকা তথ্যের সীমাবদ্ধতা। যেই তথ্যগুলোর ভিত্তিতে তাঁরা এই দাবি করেছেন, সেগুলো কি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জিহাদরত বিশ্বস্ত মুসলিম ভাইদের থেকে নেয়া, না মুজাহিদদের শত্রু, ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের শত্রু মুনাফিকদের সি এন এন, রয়টার্স, বিবিসি, ভয়েস অব এ্যামেরিকার মতো তাবত তথ্য সন্ত্রাসের আখড়া থেকে নেয়া? এগুলো সবিস্তারে সামনে আসলেই আমরা আরো বিস্তারিত কথা বলতে পারব ইনশাআল্লাহ। যদি এসব ‘বাঘা বাঘা’ ‘রাজকীয়’ সংবাদ মাধ্যমই তাঁদের কথার ভিত্তি হয়, আর আমাদের কাছে তার ব্যতিক্রম তথ্য থাকে এবং সেই তথ্যের ভিত্তি হয়, দুর্বল মজলুম নিপীড়িত মুমিন বান্দারা, যারা বলে-

رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا

“হে আমাদের রব! আমাদেরকে বের করে নিন এ জনপদ থেকে, যার অধিবাসীরা যালিম। আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে কোনো অভিভাবক নির্ধারণ করে দিন এবং নিযুক্ত করে দিন আপনার পক্ষ থেকে কোনো সাহায্যকারী।” (সূরা নিসা, ৭৫)

এবং সেই তথ্যের ভিত্তি হয় জিহাদরত সহায় সম্বলহীন মুজাহিদ ভাইরা, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন-

مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّهَ عَلَيْهِ فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَى نَحْبَهُ وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْتَظِرُ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلًا

“মুমিনদের মাঝে এমন কিছু ব্যক্তি আছে, যারা আল্লাহর সাথে তারা যে অঙ্গীকার করেছিল, তা সত্যে পরিণত করেছে। তাদের কেউ কেউ শাহদাত বরণ করেছে আর কেউ কেউ প্রতীক্ষায় আছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি।” (সূরা আহযাব, ২৩)

-তাহলে আমরা কোনদিকে যাব?

হে আল্লাহ! আমাদের উভয় কাফেলাকে সত্যের মোহনায় মিলিযে দাও; তোমার দয়ায় এবং একমাত্র তোমার দয়ায়। আমাদের কোনো কুসূর যদি তাতে বাধা হয়ে থাকে, আমাদেরকে তা থেকে পবিত্র করে দাও। তোমার প্রিয় নিপীড়িত মাজলুম বান্দাদের কল্যাণে আামদের মিলিয়ে দাও!

 

. তাঁরা বলেছেন-

اسي طرح فريضئه  جهاد كے احياء كا يه طريقه نهيں كه اغتيالات اور تفجيرات والے حملوں هي كو جهاد سمجھ ليا جائے۔ ص:8

“এমনিভাবে জিহাদের ফরিযা জীবিত করার পদ্ধতি এটা নয় যে, গুপ্তহত্যা ও বোমা হামলাকেই জিহাদ মনে করা হবে” পৃ. ৮

এমন কোনো জিহাদি সংগঠনের কথা আমাদের জানা নেই, যারা এই কাজগুলোকেই জিহাদ মনে করে এবং এগুলোই তাদের জিহাদের মূল ভিত্তি। এজন্য সুনির্দিষ্ট তথ্য যদি তাঁদের কাছে থাকে, সেগুলো সামনে আসলে বিষয়টি আমাদের জন্য স্পষ্ট হত এবং আমরাও তাদের থেকে সতর্ক থাকার সুযোগ পেতাম। জিহাদের অঙ্গনে ধোঁকা ও প্রতারণা থাকার অজুহাতে আমরা জিহাদ বিমুখ বসে থাকতে রাজি নই; যেমনি খাবারে ভেজাল আছে বলে না খেয়ে মরতে রাজি নই। হাজারো ভেজালের মধ্য থেকে যেমনি আমাকে যথাসম্ভব বিশুদ্ধ খাবারের ব্যবস্থা করে বাঁচতে হবে, তেমনি ধোঁকা প্রতারণা থাকলেও যথাসম্ভব তা থেকে বেঁচে আমাকে জিহাদের ফরিযা আদায় করতেই হবে।

তাছাড়া জিহাদের শরঈ নীতি মেনে গুপ্তহত্যা এবং বোমা হামলাও যে জায়েয; বরং জিহাদের অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ তা কে অস্বীকার করতে পারবে? ফুকাহায়ে কেরামের অনেকেই তা স্ব স্ব কিতাবে আলোচনা করেছেন।

 

. তাঁরা বলেছেন-

احياء فريضئه جهاد كا فطري طريقه يه هے كه پهلے تمكن في الارض حاصل هوگا، اور قوت قاهره والي اسلامي امارت قائم هوگي، امير المؤمنين امر بالمعروف اور نهي عن المنكر كے سارے شعبوں كي طرح شعبئه جهاد كو بھي اسلامي احكام كے مطابق زنده كريں گے۔

تمكن في الارض، حقيقي استطاعت (وهمي استطاعت نهيں) اور امارت قاهره كي اجازت و نگراني كے بغير جهاد كرنے جانا يه جهاد كا وه طريقه نهيں جسے سنت نبوية اور اصول شرعيه كے مطابق كها جا سكتا هے۔ ص:9

“জিহাদের ফরিযা যিন্দা করার ফিতরি তরিকা হল, প্রথমে যমিনে ক্ষমতা অর্জিত হবে এবং শাসন ক্ষমতার অধিকারী ইসলামী ইমারাহ প্রতিষ্ঠিত হবে, তারপর আমীরুল মুমিনীন ‘আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকারের’ অন্যান্য শাখার মতো জিহাদকেও ইসলামী বিধি বিধান অনুযায়ী যিন্দা করবেন।

যমিনের ক্ষমতা, প্রকৃত সামর্থ্য (কল্পিত সামর্থ্য নয়) এবং শাসন ক্ষমতার নেতৃত্বের অনুমতি ও তত্ত্বাবধান ব্যতীত জিহাদ করতে যাওয়া, জিহাদের সেই পদ্ধতি নয়, যাকে সুন্নাতে নববী ও উসূলে শরীয়াহ’র মোতাবিক বলা যায়।” পৃ.-৯

এখানে আমরা সংক্ষেপে শুধু একটি কথা বলব। তারপর সামনে বিভিন্ন অংশে প্রত্যেকটি শর্তের উপরই কিছু কিছু কথা বলব ইনশাআল্লাহ।

কথাটি হল জিহাদের পূর্বে যে শাসন ক্ষমতার অধিকারী ইসলামী ইমারাহ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, তা কিভাবে কোন পদ্ধতিতে করা হবে, তার বিবরণ আসা জরুরি। তাঁরা আশা করি অবশ্যই গণতন্ত্রের কথা বলবেন না। হয়তো দাওয়াতের কথা বলবেন বা অন্য কোনো পন্থা তাঁদের কাছে আছে কি না, জানি না। কিন্তু তাঁরা যদি মনে করেন, দাওয়াতের মাধ্যমে নির্বিঘ্নে ইসলামী ইমারাহ প্রতিষ্ঠিত করে ফেলবেন, আর দুশমনরা তা হতে দিবে, তাহলে তা হবে দুশমনদের প্রতি অতিরিক্ত ‘হুসনে জান’। কোরআন সুন্নায় তাদের যে প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে এবং যুগে যুগে মুসলিম উম্মাহ তাদের সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তাতে তা কিছুতেই গ্রহণ করা যায় না। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে তা আরো সুস্পষ্ট ও প্রমাণিত। নিজেদের ঈমান আমলের অজস্র জলাঞ্জলি দিয়ে তাদের সর্বস্বীকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা অর্জনে শতভাগ সফলতা অর্জন করেও যে তা সম্ভব হয়নি এবং ওরা সম্ভব হতে দেয়নি, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণও আমাদের সামনে বিদ্যমান। বর্তমান সমগ্র বিশ্বেই বিশ্বাস ও চিন্তাগত এবং কার্যত ইসলামী শরীয়াহ ও ইসলামী ইমারাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞায় সমগ্র বিশ্বের মুসলিম অমুসলিম সকল রাষ্ট্রের শাসক গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ। কোথাও ইসলামী ইমারাহ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলেই তা যে তারা অস্ত্রের মুখে অঙ্কুরেই নি:শেষ করে দেয়ার সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে, তাতে আমাদের বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। কেউ যদি ব্যতিক্রম চিন্তা করেন এবং ‘আলমুজাররাবু লা ইউজাররাব’-এর খেলাফ করেন, তাহলে তা হবে অবাস্তব চিন্তা। সুতরাং যখন ইসলামী ইমারার প্রতিষ্ঠাই শত্রুর সশস্ত্র বাধার মুখে পড়বে, তখন তার সমাধান ও মোকাবেলা কোন পদ্ধতিতে হবে? অস্ত্রধারীদেরকে ইমারা প্রতিষ্ঠার দাওয়াত প্রদান ও গুরুত্ব বুঝানোর মাধ্যমে? বিষয়টি তাঁরা পরিষ্কার করে দিলে আমাদের বুঝতে সহজ হত।

 

. তাঁরা বলেছেন-

جهاد كے بارے ميں افراط والا جس تطرف  كي طرف  اشارة كيا گيا هے اس كا حاصل يه هے كه چونكه احياء جهاد كا فطري طريقه عموما بهت طويل وقت اور طويل محنت كو متقاضي هے اور اس ميں تساهل اور بے اعتنائي بھي عام هے، اس لئے اس كے كئے بعض لوگوں نے مختصر طريقے ايجاد كئے، اور انهي كو انهوں نے جهاد نام دے ديا هے، پھر ان طريقوں كے بارے ميں خود ان كا تجربه يا رائے بدلتا رها هے اور بعض طريقوں كے بارے ميں خود ان كے آپس ميں اختلاف بھي پيدا هوا كه اسے شرعي جهاد كها جا سكتا هے كه نهيں۔ص:9-10

জিহাদ সম্পর্কে বাড়াবাড়ির যে প্রান্তিকতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, তার খোলাসা হল, যেহেতু জিহাদের ফিতরি স্বাভাবিক পদ্ধতি সাধারণত দীর্ঘ পরিশ্রম দীর্ঘ সময়ের দাবিদার, এবং তার প্রতি শিথিলতা গুরুত্বহীনতাও ব্যাপক, এজন্য কেউ কেউ জিহাদের সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন এবং তাকেই তারা জিহাদ নাম দিয়ে দিয়েছেন তারপর এই পদ্ধতি সম্পর্কে খোদ তাদেরই অভিজ্ঞতা বা মতামত পরিবর্তনও হতে রয়েছে এবং কোনো কোনো পদ্ধতি সম্পর্কে খোদ তাদের মাঝেও মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে যে, তাকে শরঈ জিহাদ বলা যাবে কি না?”

এখানে সংশয়ের কয়েকটি বিন্দু এরকম-

ক. বাংলাদেশের কথা যদি বলি, তাহলে এখানে যদিও আমরা জিহাদের জন্য মেহনত শুরু করেছি অনেক বছর, কিন্তু মূল কিতাল এখনো শুরু করিনি। দাওয়াত ও ই’দাদের মারহালা চলছে। ঠিক কবে কিতাল করার মতো অবস্থান তৈরি হবে এবং কিতাল শুরু করা যাবে, তা আমাদেরও জানা নেই। আমরা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, পূর্ণতায় পৌঁছানো তাঁরই দায়িত্ব। সুতরাং এখানে পরিষ্কার হওয়া দরকার, মূল কিতালের আগে দাওয়াত ও ই’দাদের কাজ শুরু করতেও কি অনেক দীর্ঘ সময় দরকার? এবং আমরা তার জন্য সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি আবিষ্কার করে সময়ের আগেই কাজ শুরু করে দিয়েছি?

যদি তা না হয়, তাহলে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতির দায় আমাদের উপর আরোপ করা সঙ্গত নয়।

. আসলে তাঁদের বক্তব্য একেবারেই সংক্ষিপ্ত। একারণে বিষয়গুলো খুবই অস্পষ্ট। এখানে তাঁরা বলেছেন ‘এই নব আবিষ্কৃত পদ্ধতি সম্পর্কে স্বয়ং তাদেরই অভিজ্ঞতা ও মতামত পরিবর্তন হতে রয়েছে এবং তাদের মাঝে মতভেদও সৃষ্টি হয়েছে, তাকে শরঈ জিহাদ বলা হবে কি হবে না?’

এখানে কথা হল, জিহাদের কিছু অংশ আছে শরীয়তের মাসআলাগত বিষয়। জিহাদের অধ্যায়ে এমন অসংখ্য মাসআলা আছে। সেখানে যে মাসআলাগুলো ‘মুজতাহাদ ফিহ’ তাতে যদি যোগ্য আলেমদের মতভেদ হয় এবং কখনো নিজেদের রায়ও পরিবর্তন হয়, তাহলে সমস্যা কোথায়? সাহাবায়ে কেরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) থেকে শুরু করে সর্ব যুগের ফকীহদের মাঝে শরীয়তের কোন অধ্যায়ে এমন ঘটনা ঘটেনি? এটাই তো ফিকহের স্বাভাবিক চরিত্র যে, ইজতিহাদের অবকাশ থাকলে তাতে মতভেদ হবে এবং কেউ কেউ সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর নিজের আগের অবস্থান থেকে ফিরে আসবে। এটাই তো বরং সত্যান্বেষীর নিদর্শন।

আর জিহাদের যে অংশগুলো ব্যবস্থাপনাগত বিষয়, মাসআলার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, সেখানে মত পরিবর্তন হওয়া এবং মতভেদ হওয়া তো আরো স্বাভাবিক বিষয়। সুতরাং এখানে সমস্যাটা কোথায়, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।

আসলে তাঁরা কি এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে, মুজাহিদ আলেমদের মতভেদ ও মত পরিবর্তন এমন মাসআলায় হয়েছে, যেখানে ইজতিহাদের অবকাশ নেই? না যারা মতভেদ করেছেন, তারা মতভেদ করার যোগ্যতা রাখেন না? বিষয়গুলো বিশ্লেষণপূর্বক চিহ্নিত হওয়া দরকার। কারণ আমরা ময়দানে কর্মরত মুজাহিদ আলেমদেরকে দলিল ও ইলমের অঙ্গনে অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী পেয়েছি। ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন-

ولهذا كان الجهاد موجبا للهداية التي هي محيطة بأبواب العلم. كما دل عليه قوله تعالى: {والذين جاهدوا فينا لنهدينهم سبلنا} فجعل لمن جاهد فيه هداية جميع سبله تعالى؛ ولهذا قال الإمامان عبد الله بن المبارك وأحمد بن حنبل وغيرهما: إذا اختلف الناس في شيء فانظروا ماذا عليه أهل الثغر فإن الحق معهم؛ لأن الله يقول: {والذين جاهدوا فينا لنهدينهم سبلنا}. -مجموع الفتاوى، ج:28، ص:442، طبع مجمع الملك فهد لطباعة المصحف الشريف، 1416هـ. 1994م.

একারণেই জিহাদ হেদায়াতকে অবধারিত করে, যা ইলমের সকল অধ্যায়কে শামিল করে যেমনটি কোরআনে কারীমের নিম্নোক্ত আয়াত প্রমাণ করে– ‘যারা আমার উদ্দেশ্যে জিহাদ করে তাদেরকে অবশ্যই আমি আমার পথসমূহে পরিচালিত করি’ (সূরা আনকাবূত: ৬৯) এখানে আল্লাহ জিহাদকারীদের জন্য তাঁর সকল পথের প্রতি হোদায়াত অবধারিত করেছেন এজন্য ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক এবং আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ.সহ আরো অনেকে বলেছেন, ‘যখন মানুষ কোনো বিষয়ে মতভেদ করে, তখন দেখ জিহাদরতরা কোন মতের উপর আছেন কারণ সত্য তাদের সঙ্গেইকেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা আমার উদ্দেশ্যে জিহাদ করে তাদেরকে অবশ্যই আমি আমার পথসমূহে পরিচালিত করি[4]

 

. তাঁরা বলেছেন-

اس سلسلے ميں ايك خاكه بعض  حضرات نےايسا پيش كيا هے جس كا مدار انهوں نے متعدد شاذ يا غلو آميز آراء پر ركھا هے. ص:10

সম্পর্কে কোনো কোনো হযরত এমন একটি পদ্ধতি পেশ করেছেন, যার ভিত্তি রেখেছেন তারা অনেকগুলো শায বিচ্ছিন্ন এবং উগ্রতা মিশ্রিত মতামতের উপর

এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে আমরা আমাদের আচরণবিধির একটি অংশ উল্লেখ করেছি, যার খোলাসা হল, জিহাদের ফরজ আদায়ের জন্য আমাদের জামাআত নিজেকে শরীয়তের ঐসব সুস্পষ্ট নীতির মাঝে সীমাবদ্ধ রাখে, যা সালাফে সালেহীন কুরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে লিপিবদ্ধ করেছেন। শায বিচ্ছিন্ন ও ভারসাম্যহীন মতামত পরিহার করে কাজ করে। সুতরাং এই আপত্তিও আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

 

৭. তাঁরা ‘শায’ ও বিচ্ছিন্ন এবং বাড়াবাড়ি মিশ্রিত মতামতের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন-

مثلا يه نظريه كه آج كل كے مسلم ممالك جو ديمقراطي طريقے پر چلتے هيں، جهاں دستور مملكت اور قانون لوگوں كا وضع كرده هے، جهاں عدالت قانون وضعي كے مطابق فيصله كرتي هے وه سب دار الحرب هيں، اور وهاں كے حكام بلا استثناء سب كافر هيں، وه حكام كسي غير مسلم كو ويزا دے يه ويزا استئمان او ر معاهده كے حكم ميں نهيں آئےگا، اس لئے كوئي شخص حامل ويزا اس شخص پر حمله كر دے تو  يه نقض عهد نهيں هوگا۔ ص:10

“যেমন এই দর্শন যে, বর্তমান যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলে, যেখানকার সংবিধান ও আইন মানব রচিত, যেখানকার আদালত মানব রচিত আইনে চলে, তা সব দারুল হারব এবং সেখানকার শাসক কোনো ব্যতিক্রম বাদে সকলেই কাফের। তারা কোনো অমুসলিমকে ভিসা দিলে, সে ভিসা আমান বা অঙ্গীকারের মর্যাদা পাবে না। সুতরাং কেউ যদি উক্ত ভিসাধারীর উপর আক্রমণ করে, তাহলে তা অঙ্গীকার ভঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হবে না।”

এখানে তাঁরা তিনটি মাসআলা বলেছেন-

১ম মাসআলা. “যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলে, যেখানকার সংবিধান ও আইন মানব রচিত, যেখানকার আদালত মানব রচিত আইনে চলে, তা সব দারুল হারব।”

আমারা জানি এটিই সালাফ ও খালাফ তথা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী জুমহুরে উম্মত ও অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতামত। আশা করি আপনাদের অনেকেরই বিষয়গুলো কম বেশ দলিলের আলোকে পড়া আছে। কারো পড়া না থাকলে আলেম সাথীদের সঙ্গে পরামর্শ করে পড়ে নিন। তাছাড়া বিষয়টির উপর আমাদের স্বতন্ত্র রচনা প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে ইনশাআল্লাহ। আমরা চাচ্ছিলাম আমাদের দেশের উলামায়ে কেরামের মতামত নিয়েই বিষয়গুলো সমনে আনব। কিন্তু তাঁরা অধিকাংশই আমাদের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন না। ইতিমধ্যে কিছু মতামত অবশ্য পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু যা পেয়েছি, তার সবই দলিলশূন্য। আশা করি এবার যাঁরা বিষয়টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন, তাঁরা অতিঅবশ্যই অবিলম্বে দলিলের আলোকে বিষয়টি সামনে আনবেন এবং আমরা তা থেকে উপকৃত হতে পারব ইনশাআল্লাহ। তারপর প্রয়োজন হলে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

২য় মাসআলা. “এবং (যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলে, যেখানকার সংবিধান ও আইন মানব রচিত, যেখানকার আদালত মানব রচিত আইনে চলে) সেখানকার শাসক কোনো ব্যতিক্রম বাদে সকলেই কাফের।”

আমরা জানি এখানে যে তিনটি বৈশিষ্ট্য তাঁরা উল্লেখ করেছেন, সবগুলোর প্রত্যেকটিই স্বতন্ত্র কুফর। আর গণতন্ত্র তো একাই অসংখ্য কুফরের জনক ও সমষ্টি। বর্তমান বিশ্বের যত গণতান্ত্রিক শাসক গোষ্ঠী আছে, তারা সবাই সাংগঠনিকভাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই কুফুরগুলো নিজেরা লালন করে এবং অন্যদেরকেও তা গ্রহণ করতে বাধ্য করে। যারা এই কাজ করে, তারা যে মুরতাদ কাফেলা, সে সম্পর্কে উম্মতের নির্ভরযোগ্য কোনো আলেমের দ্বিমত আছে বলে আমাদের জানা নেই।

কাফেলা ও দলগত মুরতাদদের সম্পর্কে শরীয়তের নীতি হল, তাদের কাফেলায় যেই যুক্ত হবে, তার উপরও একই হুকুম আরোপিত হবে। এজন্য আলাদা করে প্রত্যেককে যাচাই করার প্রয়োজন নেই যে, সেও তাদের কুফুরিগুলো গ্রহণ করেই তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, না সেগুলোকে বাদ দিয়ে শুধু বৈধ অংশে তাদের সমর্থন করছে।

তবে হাঁ, ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। সেই ব্যতিক্রম হল, কেউ যদি ঘোষণা দিয়ে রাখে যে, আমি তাদের এই অংশগুলো কুফর মনে করি এবং আমার তাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ভালো একটি উদ্দেশ্য আছে। যেমন তাদেরকে এগুলো থেকে ফেরানোর জন্যই তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি, অথবা তারা যে অন্যায় অনাচারগুলো করছে, আমি সঙ্গে থাকলে কিছু কমিয়ে আনতে পারব বলে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। তাহলে তার এই যুক্তিতে তাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়াকে যদিও আমরা নাজায়েয বলব, কিন্তু তার যেহেতু কুফুরি বিষয়গুলো থেকে মুক্ত থাকার প্রামণ ও ঘোষণা রয়েছে, এজন্য তাকে আমরা মুরতাদ বলব না; বরং মুমিন হিসেবেই গণ্য করব। একারণেই যেসব উলামায়ে কেরাম ইসলামী শাসন কায়েমের কথা বলে সংসদে যান; এমনকি তারা যদি সরকারী দলের সদস্যও হন এবং কোরআন সুন্নাহ বিরোধী আইনে হাঁ বাচক ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকেন, তাদেরকেও আমরা মুরতাদ মনে করি না। যদিও তাদের এ অংশগ্রহণও আমরা জায়েয মনে করি না।

তবে ফতোয়ার নীতি হল, কাফেলাগত এসব মুরতাদের বিধান বলতে গেলে, সবসময়ই ব্যতিক্রম উল্লেখ করতে হয় না। তাছাড়া মুফতির কাছে যদি ব্যতিক্রমের তথ্য না থাকে, তাহলে সেই তথ্য অনুসন্ধানের দায়িত্বও মুফতির উপর বর্তায় না; বিশেষ করে তারা যদি طائفة ممتنعة (তায়েফায়ে মুমতানিয়াহ) তথা প্রতিরক্ষা শক্তির অধিকারী হয় এবং তাদেরকে যাচাইয়ের আওতায় আনার সুযোগ না থাকে।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার করা যায়। যেমন ধরুন কাদিয়ানি সম্প্রদায় কাফের। কিন্তু কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের সকল আকিদাই কুফর নয়। এখন তারা যদি একজন সরল মুসলমানকে তাদের কুফুরি গোপন রেখে ভালো দিকগুলো বুঝিয়ে দলভুক্ত করে নেয়, কিংবা শিয়া সম্প্রদায়ের যারা কাফের, তারা যদি কোনো সরল মুসলামনের কাছে তাদের কুফুরিগুলো গোপন করে তাদের দলভুক্ত করে নেয়, তাহলে এই ব্যক্তি ‘দিয়ানাতান’ মুরতাদ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মুফতি সাহেবকে যখন ফতোয়া জিজ্ঞেস করা হবে, কাদিয়ানিরা কাফের কি না? শিয়াদের এই সম্প্রদায় কাফের কি না? তখন তার জন্য এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, তারা কাফের। ব্যতিক্রমের কথা বলা জরুরি নয়। একইভাবে মুফতি সাহেবকে যদি কাদিয়ানি বা শিয়া সম্প্রদায়ের দলভুক্ত হওয়া সেই লোকটি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় যে, অমুক ব্যক্তি অমুক শিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বা কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, আর মুফতি সাহেবের নিকট তার সম্পর্কে ভিন্ন কোনো তথ্য না থাকে, তাহলে মুফতি সাহেবের জন্য একথা বলতে অসুবিধা নেই যে, বাস্তবেই যদি সে উক্ত কোনো দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে সে মুরতাদ। এখানে তার ব্যতিক্রমের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনো কারণ বিদ্যমান আছে কি না, তা যাচাই করা মুফতির দায়িত্ব নয়।

আসলে বর্তমান গণতন্ত্র এমন অনেকগুলো কুফর ও শিরকের সমষ্টি, যার প্রত্যেকটিই স্বতন্ত্র কুফর। এখানে আমরা সংক্ষিপ্ততাকারে শুধু মানব রচিত আইনের কুফরের প্রতি ইঙ্গিত করার জন্য নমুনা হিসেবে উলামায়ে কেরামের দু’একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি-

 

আল্লামা শানক্বিতী রহ. (মৃত্যু: ১৩৯৩ হি.)

তাফসীরুল কুরআন বিল কুরআনের অন্যতম তাফসীর গ্রন্থ ‘আদওয়াউল বায়ান’ প্রণেতা প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা শানক্বিতী রহ. স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে সম্পূর্ণ স্পষ্টরূপে এ সমস্ত শাসকদের হুকুম বর্ণনা করেছেন।

তিনি আল্লাহ তায়ালার বাণী-

﴿إِنَّ هذا القرآن يِهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ﴾

‘নিশ্চয়ই এই কুরআন হিদায়াত করে সেই আদর্শের দিকে যা সুদৃঢ়।’ (সূরা বনী ইস্রাইল, )

এর ব্যাখ্যায় বলেন-

ومن هدي القرآن للتي هي أقْوَم: بيانه أنه كل من اتبع تشريعاً غير التشريع الذي جاء به سيد ولد آدم محمد بن عبد الله صلوات الله وسلامه عليه. فاتباعه لذلك التشريع المخالف كفر بواح، مخرج عن الملة الإسلامية. اهـ

“কুরআনের নির্দেশিত সুদৃঢ় আদর্শসমূহের একটি হল- কুরআন বর্ণনা করে দিয়েছে, যে ব্যক্তি আদম সন্তানদের সর্দার মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত বিধান ব্যতীত অন্য কোনো বিধান অনুসরণ করে, তার এই বিপরীত বিধানের অনুসরণ কুফরে বাওয়াহ-স্পষ্ট কুফর, যা মিল্লাতে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়[5]

আল্লাহ তায়ালার বাণী-

﴿وَلاَ يُشْرِكُ فِى حُكْمِهِ أَحَدًا ﴾

তিনি কাউকে নিজ বিধানের ক্ষেত্রে শরীক করেন না। (সূরা কাহফ, ২৬)

এর ব্যাখ্যায় এ সমস্ত শাসকদের কুফরির ব্যাপারে একাধিক দলিল পেশ করার পর তিনি বলেন-

وبهذه النصوص السماوية التي ذكرنا يظهر غاية الظهور: أن الذين يتبعون القوانين الوضعية التي شرعها الشيطان على ألسنة أوليائه مخالفة لما شرعه الله جل وعلا على ألسنة رسله صلى الله عليهم وسلم، أنه لا يشك في كفرهم وشركهم إلا من طمس الله بصيرته، وأعماه عن نور الوحي مثلهم. اهـ

“এ সকল আসমানী দলিল-প্রমাণ দ্বারা একেবারেই সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়, যারা ঐ প্রণীত কানূনের অনুসরণ করে, যা শয়তান তার বন্ধুদের মাধ্যমে প্রণয়ন করেছে, যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলদের মাধ্যমে যে বিধান দিয়েছেন তার বিপরীত, তাদের কাফের ও মুশরিক হওয়ার ব্যাপারে শুধু সে ব্যক্তিই সন্দেহ করতে পারে, আল্লাহ যার অর্ন্তদৃষ্টি নিভিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের মতো তাকেও ওহীর নূর থেকে অন্ধ করে দিয়েছেন।

অন্যত্র বলেন-

ولما كان التشريع وجميع الأحكام، شرعية كانت أو كونية قدرية، من خصائص الربوبية. كما دلت عليه الآيات المذكورة كان كل من اتبع تشريعاً غير تشريع الله قد اتخذ ذلك المشرع ربا، وأشركه مع الله. والآيات الدالة على هذا كثيرة، وقد قدمناها مراراً. اهـ

“আইন প্রণয়ন এবং যাবতীয় বিধি-বিধান; চাই তা শরয়ী হোক বা তাকবীনি-সৃষ্টিগত হোক, এগুলো যেহেতু একান্তই রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্য- উপরোক্ত আয়াতসমূহ যেমনটা প্রমাণ করছে, তাই যে ব্যক্তিই গাইরুল্লাহর আইনের অনুসরণ করল, সে প্রকৃতপক্ষে উক্ত আইনদাতাকে রব হিসেবে গ্রহণ করল এবং তাকে আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করল। এর প্রমাণ-সম্বলিত আয়াত অনেক। বহুবার আমি সেগুলোর আলোচনা করে এসেছি।”[6]

শায়েখ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলে শায়খ রহ. (মৃত্যু: ১৩৮৯ হি.)

সউদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী আলে শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম রহ. বলেন-

لو قال من حكم القانون أنا أعتقد أنه باطل فهذا باطل لا أثر له، بل هو عزل للشرع، كما لو قال أحد أنا أعبد الأوثان واعتقد أنها باطل. اه

“মানব রচিত কানূনকে বিচারের মানদণ্ডরূপে গ্রহণকারী ব্যক্তি যদি বলেও, ‘আমি বিশ্বাস রাখি এটা বাতিল’, তাহলে তার এ কথা ধর্তব্য হবে না বরং তার এই কাজ হবে শরীয়ত প্রত্যাখ্যান। যেমন গ্রহণযোগ্য নয় ঐ ব্যক্তির কথা যে বলে, ‘আমি মূর্তি পূজা করি, তবে বিশ্বাস রাখি, এটা বাতিল’।”[7]

আরেক ফতোয়ায় বলেন-

القوانين كفر ناقل عن الملة … وأما الذي قيل فيه : كفر دون كفر، إذا حاكم إلى غير الله مع اعتقاد أنه عاص وأن حكم الله هو الحق. فهذا الذي يصدر منه المرة و نحوها. أما الذي جعل قوانين بترتيب وتخضيع فهو كفر وإن قالوا أخطأنا وحكم الشرع أعدل. اهـ

মানব রচিত কানূন এমন কুফর, যা (ব্যক্তিকে) ইসলাম ধর্ম থেকে বের করে দেয়। … আর যেটার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, তা ছোট কুফর- সেটা হচ্ছে, যখন কেউ গাইরুল্লাহর বিধানের নিকট বিচারপ্রার্থী হয়, কিন্তু সে বিশ্বাস রাখে, সে গোনাহগার হচ্ছে এবং আল্লাহ তায়ালার বিধানই হক্ব। এটা একবার দুবার হতে পারে। কিন্তু আনুগত্যের সঙ্গে সুবিন্যস্ত ও ধারাবাহিক আইন প্রণয়ন তো পরিষ্কার কুফর; যদিও বলে, ‘আমরা ভুল করছি এবং শরীয়তের বিধানই ইনসাফপূর্ণ[8]

এছাড়াও এখানে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (মৃত্যু: ৭২৮হি.), আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. (মৃত্যু: ৭৭৪ হি.), আল্লামা যাহিদ কাউসারী রহ. (মৃত্যু: ১৩৭১ হি.), আব্দুল কাদের আওদাহ রহ. (মৃত্যু: ১৯৫৪ইং)-সহ আরো অসংখ্য উলামায়ে কেরামের একই মতামত রয়েছে।

 

৩য় মাসআলা. “তারা কোনো অমুসলিমকে ভিসা দিলে, সে ভিসা আমান বা অঙ্গীকারের মর্যাদা পাবে না। সুতরাং কেউ যদি উক্ত ভিসাধারীর উপর আক্রমণ করে, তাহলে তা অঙ্গীকার ভঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হবে না।”

আমাদের জানামতে কোনো মুসলিম শাসক যখন মুরতাদ হয়ে যায়, কিংবা কোনো কাফের যখন মুসলিম ভূখণ্ড দখল করে নেয়, তখন তার থেকে ‘বারাআত’ ও সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে হলেও তার হাত থেকে উক্ত মুসলিম ভূখণ্ড দখলমুক্ত করা মুসলমানদের উপর ফরজ হয়ে যায়। তাকে কোনো প্রকার সহযোগিতা করা জায়েয থাকে না এবং তার কোনো কর্তৃত্বও মুসলমানদের উপর থাকে না। সুতরাং এই মুরতাদ বা কাফের শাসক যদি অন্য কোনো কাফের বা মুরতাদের সঙ্গে ভিসা প্রদানের মাধ্যমে নিরাপত্তা চুক্তি করে, কোনো মুসলামানের উপর সেই চুক্তি রক্ষা করার দায় আরোপিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমাদের জানামতের এটিই এখানে দলিল সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী মত। সুতরাং তাঁদের কাছে ভিন্ন কিছু থাকলে সে তথ্য সামনে আসলেই আমাদের জন্য বিষয়টি বুঝা সহজ হবে।

 

৮. এরপর তাঁরা বলেছেন-

اسي طرح جهاد كے محدث  ومختصر طريقے ايجاد كرنے والوں ميں سے بعض كے نزديك جهاد هر مؤمن پر الگ الگ فرض هے، هر ايك انفرادي طور پر اس كےلئے مسؤول هے، اس كےلئے امير المؤمنين كي اجازت شرط  نهيں، اگر شرط هو بھي تو وه امير اگرچه غائب هو اور قوت قاهره سے محروم هو پھر بھي اس امير غائب كے نام پر كسي بھي مجهول يا معروف ذمه دار نے اشاره كر ديا هو تو كسي بھي ملك ميں، اور  كسي بھي مقام پر اور كسي بھي شخص پر حمله كر دينا جائز هے، اور حمله چاهے تفجيري نوعيت كي هو، اور چاهے اغتيال كے طور پر هي كيوں نه هو، آگے اس پر كيا نتيجه مرتب هوگا اور اس كے لئے كيا وسيله اختيار كيا گيا هو هميں ديكھنے كي ضرورت نهيں!!. ص:10

এমনিভাবে জিহাদের নব আবিষ্কৃত পদ্ধতির আবিষ্কারকদের কারো কারো দৃষ্টিতে জিহাদ ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যেক মুমিনের উপর ফরজ এবং প্রত্যেকেই আলাদা করে তার জন্য জিজ্ঞাসিত হবে জিহাদের জন্য আমীরুল মুমিনীনের অনুমতি শর্ত নয় যদি শর্ত থাকে, তাও সেই আমীর যদি গায়েবও হয় এবং ক্ষমতা কর্তৃত্বশূন্য হয়, তবুও তার নামে যে কোনো জ্ঞাত বা অজ্ঞাত দায়িত্বশীল ইশারা করে দিলেই যে কোনো রাষ্ট্রে, যে কোনো স্থানে, যে কোনো ব্যক্তির উপর আক্রমণ করে দেয়া জাযেয চাই সে আক্রমণ বিস্ফোরণ প্রকৃতির কিংবা গুপ্তহত্যা পদ্ধতিরই হোক না কেন আক্রমণের ফলাফল কী দাঁড়াবে এবং তার জন্য কী মাধ্যম অবলম্বন করা হয়েছে, তা আমাদের দেখার প্রয়োজন নেইপৃ. ১০

এখানে তাঁরা তাঁদের ভাষায় জিহাদের ‘নব আবিষ্কৃত পদ্ধতি’র উদ্ভাবকদের চারটি ভুল মাসআলার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

১ম মাসআলা: “জিহাদ ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যেক মুমিনের উপর ফরজ এবং প্রত্যেকেই আলাদা করে তার জন্য জিজ্ঞাসিত হবে।”

আমরা জানি জিহাদ কখনো ফরজে কেফায়া, কখনো ফরজে আইন। ফরজে কেফায়া অবশ্যই আলাদা আলাদা করে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর ফরজ নয়; উম্মতে মুসলিমার সমষ্টির উপর ফরজ। কিন্তু এই ফরজ যখন কেউই আদায় না করে, তখন উম্মতের প্রতিটি ব্যক্তির উপরই তার দায় আরোপিত হয়। অর্থাৎ ফরজে কেফায়া আদায় না করার পরিণতিতে তা ফরজে আইনে রূপান্তরিত হয়ে যায়। কারণ যে কোনো ফরজে কেফায়ার প্রথম স্তরের ‘মুখাতাব’ ও ‘মুকাল্লাফ’ যদিও ‘আহলুল হাল ওয়াল আকদ’, কিন্তু দ্বিতীয় স্তরে প্রত্যেক মুসলমানই তার ‘মুখাতাব’ ও ‘মুকাল্লাফ’। এজন্য যখন কোনো ফরজে কেফায়া আদায় না হয়, তখন প্রত্যেকেরই তার অবস্থা অনুযয়ী তা আদায় করার ফিকির করা জরুরি। এটি যেমনি শরীয়তের মাসআলা, তেমনি একটি প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক বিষয়ও বটে। যদিও এখানে অনেকেই হয়তো বিভিন্ন ওজরের কারণে উক্ত দায় থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে, কিন্তু সেটা ওজরের কথা; মূল বিধান নয়। বর্তমানে তাঁদের ভাষায়ই জিহাদে ফরিযা পরিত্যক্ত। তহলে প্রত্যেকে তার জন্য জিজ্ঞাসিত হবে না কেন, বোধগম্য নয়?

এজন্য ফুকাহায়ে কেরাম জিহাদের ফরজে কেফায়ার ক্ষেত্রেই উদাহারণ দিয়ে বলেছেন, যদি তা আদায় না হয়, তখন তা পাঁচ ওয়াক্তের ফরজ নামায ও রমজানের ত্রিশ রোযার মতোই প্রত্যেকের উপর ফরজ হয়ে যায়। দেখুন-

আল্লামা ইবনু আবিদীন আশ-শামী রহ. (মৃত্যু: ১২৫২ হি.)

الجهاد إذا جاء النفير إنما يصير فرض عين على من يقرب من العدو، فأما من وراءهم ببعد من العدو فهو فرض كفاية عليهم، حتى يسعهم تركه إذا لم يحتج إليهم. فإن احتيج إليهم بأن عجز من كان يقرب من العدو عن المقاومة مع العدو أو لم يعجزوا عنها، لكنهم تكاسلوا ولم يجاهدوا: فإنه يفترض على من يليهم فرض عين كالصلاة والصوم، لا يسعهم تركه ثم وثم إلى أن يفترض على جميع أهل الإسلام شرقا وغربا على هذا التدريج. اهـ

যদি শত্রুরা মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালায়, তাহলে (প্রথমত) জিহাদ ফরজে আইন হয় ঐসব মুসলমানের উপর, যারা শত্রুর সবচেয়ে নিকটবর্তী। শত্রু থেকে যারা দূরে অবস্থান করছে, (শত্রু প্রতিহত করতে) যদি তাদের সাহায্যের প্রয়োজন না হয়, তাহলে তাদের উপর জিহাদ (ফরজে আইন নয়; বরং) ফরজে কেফায়া। তাই তারা জিহাদে শরীক না হওয়ারও অবকাশ আছে। তবে শত্রুর নিকটে যারা রয়েছে, তারা যদি শত্রু প্রতিরোধে অপারগ হয় বা অলসতাবশত জিহাদ না করে, ফলে শত্রু প্রতিহত করতে দূরবর্তীদের সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে তাদের পার্শ্ববর্তীদের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যাবে; যেমন নামাজ-রোজা ফরজে আইন। তখন আর তাদের জিহাদ না করার অবকাশ থাকবে না। এভাবে তাদের পরের এবং তাদের পরের পরের মুসলমানদের উপর জিহাদ ফরজে আইন হতে থাকবে। পর্যায়ক্রমে পূর্ব থেকে পশ্চিম; সমগ্র বিশ্বের সকল মুসলমানের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যাবে।[9]

জানা কথা, ফরজে কেফায়া থেকে দায়মুক্ত হওয়ার জন্য কিছু লোকের সেই কাজে রত থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং কাজটি আদায় হয় পরিমাণ লোকের তাতে যুক্ত হওয়া এবং কাজটি আদায় হওয়া জরুরি। যেমন মুসলমানরা যখন শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হয়, তখন তাদের আক্রমণ প্রতিহত করা এবং শত্রুকে পরাজিত বা বিতাড়িত করে আক্রান্তদেরকে শঙ্কামুক্ত করা পর্যন্ত তার দায় প্রত্যেক মুসলমানের উপর থেকে যাবে।

এছাড়াও কিছু ক্ষেত্র আছে, যেখানে জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায় এবং সে ক্ষেত্রগুলোতে যে জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়, তার উপর উম্মতে মুসলিমার ইজমা রয়েছে। শুধু ফরজই নয়; ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন, তখন তা ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফরজে পরিণত হয়। যাদের জন্য অন্য ফরজ আদায়ের কারণে জিহাদে যাওয়া নিষেধ থাকে, তাদের জন্যও তখন সেই ফরজ বাদ দিয়ে জিহাদে যাওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। নমুনা হিসেবে কয়েকটি উদ্ধৃতি লক্ষ করুন-

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (মৃত্যু: ৭২৮ হি.) বলেন-

وأما قتال الدفع فهو أشد أنواع دفع الصائل عن الحرمة والدين واجب إجماعا، فالعدو الصائل الذي يفسد الدين والدنيا لا شيء أوجب بعد الإيمان من دفعه، فلا يشترط له شرط  بل يدفع بحسب الإمكان، وقد نص على ذلك العلماء أصحابنا وغيرهم.اهـ

“প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ মুসলমানদের দ্বীন ও সম্মানের উপর আক্রমণকারীকে প্রতিরোধ করার সবচেয়ে গুরুতপূর্ণ স্তর, যা সর্বসম্মতিক্রমে ফরজ। যে আগ্রাসী শক্তি মুসলমানদের দ্বীন-দুনিয়া ধ্বংস করে, ঈমানের পর তাকে প্রতিরোধের চেয়ে গুরুতর ফরজ দ্বিতীয় আরেকটি নেই। এই ক্ষেত্রে কোনো শর্ত প্রযোজ্য নয়, বরং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরোধ করতে হবে। আমাদের ও অন্যান্য (মাযহাবের) ফুকাহায়ে কেরাম সকলেই তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন।[10]

ইমাম কুরতুবী রহ. (মৃত্যু: ৬৭১ হি.) বলেন-

قال ابن عطية: والذي استمر عليه الإجماع أن الجهاد على كل أمة محمد صلى الله عليه وسلم فرض كفاية، فإذا قام به من قام من المسلمين سقط عن الباقين، إلا أن ينزل العدو بساحة الإسلام فهو حينئذ فرض عين. اهـ

ইবনে আতিয়্যাহ্ রহ. বলেন, একথার উপর ইজমা চলে আসছে যে, উম্মতে মুহাম্মাদির প্রতিটি ব্যক্তির উপর জিহাদ ফরজে কেফায়া। যদি মুসলমানদের একাংশ তা আদায় করে, অন্যদের থেকে এর দায়িত্ব-ভার সরে যাবে। তবে শত্রু যদি কোনো ইসলামী ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালায়, তখন তা ফরজে আইন হয়ে যায়।[11]

ইবনুল হুমাম রহ. (মৃত্যু: ৮৬১ হি.) বলেন-

وأما العينية في النفير العام فبالإجماع. اهـ

“নফীরে আম-এর সময় জিহাদ ফরজে আইন হওয়াটা ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত।[12]

 

মুফতী শফী রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু: ১৩৯৬ হি.)

اسي طرح خدا نخواسته كسي وقت كفار كسي اسلامي ملك پر حمله آور هوں، اور مدافعت كرنے والي جماعت ان كي مدافعت پرپوري طرح قادر اور كافي نه هو، تو اس وقت بھي يه فريضه اس جماعت سے متعدي هوكر پاس والے سب مسلمانوں پر عائد هو جاتا هے، اور اگر وه بھي عاجز هوں تو ان كے پاس والے مسلمانوں پر يهاں تك كه پوري دنيا كے هر هر فرد مسلم پر ايسے وقت جهاد فرض عين هو جاتا هے، قرآن مجيد كي مذكورة بالا تمام آيات كے  مطالعه سے جمهور فقهاء ومحدثين نے يه حكم قرار ديا كه عام حالات ميں جهاد فرض كفايه هے. معارف القرآن، ج:1، ص: 518

جس وفت اسلام اور مسلمانو ں سے دفاع كي ضرورت شديد هو اس وقت يقينا جهاد تمام عبادات سے افضل هوگا، جيسا كه غزۀو خندق ميں رسول كريم صلى الله عليه وسلم كي چار نمازيں قضا هو جانے كے واقعه سے ظاهر هے. معارف القرآن، ج:1، ص: 518

“এমনিভাবে আল্লাহ না করুন, কখনো যদি কাফেররা কোনো ইসলামী রাষ্ট্রে আক্রমণ করে, এবং প্রতিরোধের জন্য নির্ধারিত বাহিনী তাদের প্রতিরোধে যথেষ্ট না হয়, তখন উক্ত ফরজ তাদের অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী সকল মুসলমানের উপর আরোপিত হয়। তারাও যদি সক্ষম না হয়, তাহলে তাদের পার্শ্ববর্তীদের উপর এবং এভাবে ক্রমান্বয়ে সমগ্র বিশ্বের প্রত্যেক মুসলমানের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। কোরআনে কারীমের উপরোক্ত আয়াতগুলো অধ্যয়ন করে, জুমহুর ফুকাহা ও মুহাদ্দিসীন রাহিমাহুমুল্লাহ এই বিধানই সাব্যস্ত করেছেন যে, স্বাভাবিক অবস্থায় জিহাদ ফরজে কিফায়া।[13]

যখন মুসলমানদের পক্ষ থেকে শত্রু প্রতিরোধের প্রয়োজন তীব্র হয়, তখন নি:সন্দেহে জিহাদ সকল ইবাদত থেকে উত্তম। যেমন খন্দকের যুদ্ধে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চার ওয়াক্ত নামায কাযা হওয়ার ঘটনা থেকে বিষয়টি পরিষ্কার।[14]

তাছাড়া আলাদা ব্যক্তির উপর যে জিহাদ ফরজ, তাও ফুকাহায়ে কেরাম কোরআন সুন্নাহর আলোকে সুস্পষ্ট বলেছেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-

فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ

“আপনি আল্লাহর পথে কিতাল করুন; আপনার আপন সত্ত্বা ব্যতীত অন্য কারো দায় আপনার উপর বর্তাবে না।” (সূরা নিসা, আয়াত ৮৪)

ইবনে আতিয়্যাহ আন্দালুসি রহ. (৫৪২ হি.) উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন,

هذا أمر في ظاهر اللفظ للنبي عليه السلام وحده، لكن لم نجد قط في خبر أن القتال فرض على النبي صلى الله عليه وسلم دون الأمة مدة ما، المعنى- والله أعلم- أنه خطاب للنبي عليه السلام في اللفظ، وهو مثال ما يقال لكل واحد في خاصة نفسه، أي أنت يا محمد وكل واحد من أمتك القول له فَقاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ ولهذا ينبغي لكل مؤمن أن يستشعر أن يجاهد ولو وحده، ومن ذلك قول النبي عليه السلام «والله لأقاتلنهم حتى تنفرد سالفتي» وقول أبي بكر وقت الردة: «ولو خالفتني يميني لجاهدتها بشمالي». اهـ 2\86=542

বাহ্যত দেখা যায় আয়াতের আদেশ শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একার জন্য। তবে কোন হাদিসেই আমরা এ কথা পাইনি যে, কোনো যামানায় জিহাদ উম্মত বাদে শুধু রাসূলের উপর ফরয ছিল। (কাজেই)- ওয়াল্লাহু আ’লাম- (আয়াতে) বাহ্যত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করা হলেও এটি পৃথক পৃথক সকলকে বলাই উদ্দেশ্যঅর্থাৎ, হে মুহাম্মাদ! আপনি এবং আপনার উম্মতের সকলের প্রতিই নির্দেশ হল, ‘তুমি (একা হলেও) আল্লাহর রাস্তায় কিতাল কর। তোমার উপর তোমার নিজের ছাড়া অন্য কারো দায়ভার বর্তাবে না’এজন্য প্রতিটি মুমিনের এই অনুভূতি রাখা উচিৎ যে, সে একা হলেও জিহাদ করবে।

একই অর্থ বহন করছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ বাণী- ‘আল্লাহর কসম! আমার গর্দান পৃথক হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অথবা আমি একা হয়ে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে যাব।’

একই অর্থ বহন করছে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ বাণী যা তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর আরবের) লোকেরা যখন মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল, তখন বলেছিলেন, ‘আমার ডান হস্ত আমার সঙ্গ না দিলে বাম হস্ত দিয়েই (অর্থাৎ কেউ আমার সাথে না থাকলে) আমি (একাই) তাদের (অর্থাৎ মুরতাদদের) বিরুদ্ধে জিহাদ করে যাব।” (তাফসীরে ইবনে আতিয়্যাহ ২/৮৬)

অন্যান্য মুফাসসিরিনে কেরামও ইবনে আতিয়্যাহ রহ. এর সাথে সহমত পোষণ করেছেন। যেমন কুরতুবি রহ., আবু হাইয়ান আন্দালুসী রহ. (৭৪৫ হি.)ও স্ব স্ব গ্রন্থে একই কথা বলেছেন।

তাছাড়া সহীহ বোখারী ও মুসলিমে বর্ণিত বিশিষ্ট সাহাবি আবু বাসীর রা. ও সলামা ইবনুল আকওয়া’ রা. এর একা জিহাদ করার বিষয়টি তো সকলেরই জানা।

আর ফরজে আইন মানেই সুনির্দিষ্ট করে প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ফরজ এবং তা আদায় না করলে ব্যক্তি গোনাহগার হয়। একথা ফিকহের একজন প্রাথমিক স্তরের তালিবে ইলমও জানে। তারপরও তাঁরা কেন এটাকে জিহাদের ‘নব আবিষ্কৃত পদ্ধতি’র আবিষ্কারকদের মত বললেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। সুতরাং তাঁদের উদ্দেশ্য দলিলের আলোকে বিস্তারিত সামনে আসলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

২য় মাসআলা:

اسي طرح جهاد كے محدث  ومختصر طريقے ايجاد كرنے والوں ميں سے بعض كے نزديك جهاد….كےلئے امير المؤمنين كي اجازت شرط  نهيں

এমনিভাবে জিহাদের নব আবিষ্কৃত পদ্ধতির আবিষ্কারকদের কারো কারো দৃষ্টিতেজিহাদের জন্য আমীরুল মুমিনীনের অনুমতি শর্ত নয়

এখানে তাঁদের উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার করার জন্য আগের পৃষ্ঠার এ সংক্রান্ত বক্তব্যটুকুও উদ্ধৃত করা যেতে পারে। সেখানে তাঁরা বলেছেন-

“জিহাদের ফরিযা যিন্দা করার ফিতরি তরিকা হল, প্রথমে যমিনে ক্ষমতা অর্জিত হবে এবং শাসন ক্ষমতার অধিকারী ইসলামী ইমারাহ প্রতিষ্ঠিত হবে, তারপর আমীরুল মুমিনীন ‘আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকারের’ অন্যান্য শাখার মতো জিহাদকেও ইসলামী বিধি বিধান অনুযায়ী যিন্দা করবেন।

যমিনের ক্ষমতা, প্রকৃত সামর্থ্য (কল্পিত সামর্থ্য নয়) এবং শাসন ক্ষমতার নেতৃত্বের অনুমতি ও তত্ত্বাবধান ব্যতীত জিহাদ করতে যাওয়া, জিহাদের সেই পদ্ধতি নয়, যাকে সুন্নাতে নববী ও উসূলে শরীয়াহ’র মোতাবিক বলা যায়।” পৃ.-৯

এখানে আমার মতো দুর্বল পাঠকের জন্য (যদি কেউ থাকেন) একটি কথা বলা মুনাসিব মনে হচ্ছে; যদিও অনেক পাঠকের কাছে তা অতিরিক্ত মনে হবে।

আমি যখন প্রথমে এই লেখাটি পড়ি, তখন উপরোক্ত অংশটি পড়ার সময় আমার একটু ভ্রম হতে যাচ্ছিল। ভেবেছিলাম তাঁরা যখন ‘ফিতরি তরিকা’ বাক্যটি প্রয়োগ করেছেন, তাহলে তার বিপরীতটাকে সর্বোচ্চ ‘গাইরে ফিতরি’ বা অস্বাভাবিক বলবেন, শরীয়ত পরিপন্থী বলবেন না। কারণ শরীয়তে এমন অনেক মাসআলা আছে, যেগুলো ফিতরি নয়, কিন্তু শরীয়ত সম্মত। যেমন ধরুন ফরজ নামাযের ফিতরি তরীকা হল, তা জামাতে সঙ্গে পড়তে হবে। তবে এটার অর্থ এই নয় যে, জামাত বাদ দিলে নামাযই হবে না বা জামাতের ব্যবস্থা না হলে নামায মাফ হয়ে যাবে। কিন্তু যখন দেখলাম পরের প্যারায় বলছেন- ‘যমিনের ক্ষমতা, প্রকৃত সামর্থ্য (কল্পিত সামর্থ্য নয়) এবং শাসন ক্ষমতার নেতৃত্বের অনুমতি ও তত্ত্বাবধান ব্যতীত জিহাদ করতে যাওয়া, জিহাদের সেই পদ্ধতি নয়, যাকে সুন্নাতে নববী ও উসূলে শরীয়াহ’র মোতাবিক বলা যায়।’ -আমার ভ্রম কেটে গেল। বুঝলাম এই পদ্ধতির বিপরীতটা শরীয়ত সম্মতই নয়।

দ্বিতীয়ত, যখন ‘আমীরুল মুমিনীন’ সংক্রান্ত অংশটি পড়ছিলাম, তখন ভাবছিলাম শব্দটির শাব্দিক অর্থ গ্রহণ করার কোনো সুযোগ আছে কি না? অর্থাৎ শাব্দিক অর্থে তার উদ্দেশ্য যদি হত ‘মুমিনদের আমীর’, তাহলে বুঝে নিতে পারতাম, জিহাদ যেহেতু স্বভাবতই একটি ইজতেমায়ি কাজ, আর যে কোনো ইজতেমায়ি কাজই সুচারুরূপে আঞ্জাম দেয়ার জন্য একজন্ আমীর জরুরি, সুতরাং জিহাদের ফরীযা আঞ্জাম দেয়ার জন্যও একজন আমীর নিযুক্ত করে নেয়া জরুরি। যেমন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لا يحل لثلاثة نفر يكونون بأرض فلاة الا أمروا عليهم أحدهم (رواه أحمد-6647)

তিন ব্যক্তির জন্য কোনো মরু ময়দানে অবস্থান করা জায়েয হবে না, যতক্ষণ না তারা একজনকে তাদের আমীর বানিয়ে নেয়(মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ৬৬৪৭)

কিন্তু যখন আগে পরে মিলিয়ে বারবার পড়লাম, দেখলাম এমন কোনো সুযোগ এখানে রাখা হয়নি। বরং এখানে ‘আমীরুল মুমিনীন’ দ্বারা উদ্দেশ্য একটি মুসলিম রাষ্ট্র তথা দারুল ইসলামের সর্বোচ্চ শাসক, যাকে ফিকহ ও শরীয়তের পরিভাষায় ‘আমীরুল মুমিনীন’ উপাধিতে স্মরণ করা হয়। বর্তমান পরিভাষায় বললে বাদশা, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী।

তাছাড়া অন্যত্র তাঁরা বলেছেন- তাদের কারো কারো বক্তব্য হল, এখন জিহাদের বিধান কার্যকর করার সামর্থ্য আছে তো এটাও এক আশ্চর্য ব্যাপার যে, জিহাদের সামর্থ্য আছে, কিন্তু খেলাফত প্রতিষ্ঠার সামর্থ নেই?! ভাবা দরকার, তোমাদের আমীরের হাতে যদি জিহাদের সামর্থ্য থাকত, তাহলে সে তোমাদের রাষ্ট্রে খেলাফতে ইসলামিয়াও প্রতিষ্ঠিত করতে পারত!” পৃ. ১০-১১

-এখান থেকেও বিষয়টি আরো পরিষ্কার যে, আলোচ্য বক্তব্যে পারিভাষিক অর্থেই আমীরুল মুমিনীন উদ্দেশ্য।

আমাদের জানামতে জিহাদ যখন ফরজে কেফায়া থাকে, তখন আমীরুল মুমিনীনের অনুমতি ও তত্ত্বাবধানে জিহাদ করতে হয়। এখানেও অনেক উলামায়ে কেরাম শর্ত করেছেন, যদি আমীরুল মুমিনীন জিহাদ করে। পক্ষান্তরে তিনি যদি জিহাদ বন্ধ করে দেন, তাহলে তার অনুমতি ছাড়াই জিহাদ করা যাবে। একইভাবে জিহাদের অনুমতি নিতে গেলে যদি জিহাদের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়, তখনও তার অনুমতি ব্যতীত জিহাদ করা যাবে।

তাছাড়া জিহাদ যখন কাফের কর্তৃক আক্রান্ত মুসলমানদের উপর ফরজে আইন হয়ে যায় এবং শাসক জিহাদ না করে, তখন তার অনুমতি ব্যতীতই জিহাদ করতে হয়; বরং আমীরুল মুমিনীন যদি নিষেধ করেন, তাহলে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে হলেও তখন জিহাদ করতে হবে। কারণ ফরজে আইন হল, আল্লাহর বিধান। সুতরাং মাখলুকের কথায় আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করা যাবে না।

ইমাম মুহাম্মাদ রহ. (মৃত্যু: ১৮৯ হি.) বলেন-

وَإِنْ نَهَى الْإِمَامُ النَّاسَ عَنْ الْغَزْوِ وَالْخُرُوجِ لِلْقِتَالِ فَلَيْسَ يَنْبَغِي لَهُمْ أَنْ يَعْصُوهُ إلَّا أَنْ يَكُونَ النَّفِيرُ عَامًّا. اهـ

“ইমাম যদি লোকজনকে যুদ্ধ করতে এবং জিহাদে বের হতে নিষেধ করেন, তাহলে তার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা তাদের জন্য উচিৎ হবে না, তবে যদি নফিরে আমহয়।[15]

একইভাবে যখন শাসক থাকে না, তখনও আক্রমণকারী কাফেরের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হয়।

فان عدم الامام لم يؤخر الجهاد لأن مصلحته تفوت بتأخيره -المغني لابن قدامة

“ইমাম যদি না থাকে, জিহাদ বিলম্বিত করা যাবে না। কারণ তাতে জিহাদের উদ্দেশ্য হাতছাড়া হবে।”[16]

এমনিভাবে শাসক যদি মুরতাদ হয়ে যায়, তার বিরুদ্ধেও জিহাদ করা ফরজ হয়ে যায়। স্বাভাবিক কথা শাসকই যখন মুরতাদ হয়ে গেল, তখন আমীরুল মুমিনীন আসবে কোত্থেকে? মুরতাদ শাসক তো ক্ষমতা ধরে রাখবে এবং তাকে সরিয়ে মুসিলম আমীরুল মুমিনীন নিযুক্ত করার জন্যই তখন জিহাদ করতে হবে। জিহাদের জন্য তখন আমীরুল মুমিনীন পাবে কোথায়? তাছাড়া সালাফের মধ্যে এমন অসংখ্য জিহাদের নজির আছে, যেখানে তাঁরা আমীরুল মুনিনীন ছাড়াই জিহাদ করেছেন। কেউ কেউ তো আমীরুল মুমিনীন যখন জুলুম অত্যাচার করে, তখন খোদ আমীরুল মুমিনীনের বিরুদ্ধেও জিহাদের কথা বলেছেন; যদিও এটা জুমহুরের মত নয়।

শাসক কাফের হয়ে গেলে যে তার বিরুদ্ধে জিহাদ করা যাবে একথা হাদীসেই বর্ণিত আছে-

‫হযরত উবাদা ইবনে সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন,

دعانا النبي صلى الله عليه وسلم فَبَايَعْنَاهُ. فكان فيما أخذ علينا أَنْ بَايَعَنَا على السمع والطاعة في مَنشَطِنا ومَكْرَهِنا، وعُسرنا ويُسرنا، وَأَثَرَة علينا، وَأَنْ لا نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَه. قَالَ: إِلاَّ أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِنَ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ. (متفق عليه وهذا لفظ مسلم.)

আমাদেরকে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডাকলেন এবং আমরা তাঁর হাতে বাইআত হলাম। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের থেকে যে বিষয়ে বাইআত নিলেন তার মধ্যে একটি ছিল, আমরা আমাদের পছন্দনীয়-অপছন্দনীয় বিষয়ে, সুখে-দুঃখে এবং আমাদের উপর যদি অন্য কাউকে প্রাধান্য দেয়া হয় তথাপিও (আমীরের কথা) শুনব ও আনুগত্য করব এবং আমরা দায়িত্বশীলের সাথে দায়িত্ব নিয়ে বিবাদে জড়াব না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন তবে হাঁ, যদি তোমরা কোনো স্পষ্ট কুফর দেখতে পাও, যার ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে, তাহলে ভিন্ন কথা(সহীহ বোখারি: ৬৬৪৭, সহীহ মুসলিম: ৪৮৭৭)

সাহাবি সালামা ইবনুল আকওয়া রা. আমীরের অধীনে থেকেও আমীরের অনুমতি ব্যতিত জিহাদ করেছেন। এমনিভাবে আবু বাসীর রা. আমীরুল মুমিনীনের আওতার বাইরে আমীরুল মুমিনীন ব্যতীত জিহাদ করেছেন।

আমাদের আকাবিরে দেওবন্দ যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন, তখন তাঁদের হাতে রাষ্ট্টক্ষমতাও ছিল না, আমীরুল মুমিনীনও ছিল না। ইতিহাসে এমন আরো অনেক জিহাদই আছে।

তাছাড়া আমরা বরং দেখেছি, ইমাম ছাড়া জিহাদ হবে না, এটা রাফেজি শিয়াদের আকিদা। ইবনু আবিল ইজ্জ হানাফি রহ. (৭৯২ হি.) রাফেজিদের আকীদা বর্ণনা করে বলেন,

‫قَالُوا: لَا جِهَادَ في سَبِيلِ الله حتى يَخْرُجَ الرِّضَا مِنْ آلِ مُحَمَّدٍ، وَيُنَادِي مُنَادٍ مِنَ السَّمَاءِ: اتَّبِعُوهُ!

তারা বলে, মুহাম্মাদ বংশের রেজার আত্মপ্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত এবং আকাশ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত যে, ‘তোমরা তার অনুসরণ কর’- আল্লাহর রাস্তায় কোনো জিহাদ হবে না” –শরহুল (আকিদাতিত তহাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ৩৮৭)

সুতরাং দিফায়ি জিহাদের জন্য আমীরুল মুমিনীন শর্ত হওয়ার বিষয়টি আমাদের বোধগম্য নয়।

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তাঁদের কথা যদি আমরা মেনেও নেই, তাহলে আমাদের আমীর ও ইমারার বিষয়টি তো আশা করি আমাদের সকল ভাইয়েরই জানা আছে আলহামদুলিল্লাহ। সুতরাং আমাদের বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

৩য় মাসআলা: যদি শর্ত থাকে, তাও সেই আমীর যদি গায়েবও হয় এবং…”

এখানেও আসলে তাঁরা কী বলতে চেয়েছেন, তার বিস্তারিত বিবরণ না আসলে কথা বলার খুব একটা সুযোগ নেই। কারণ গায়েব মানে অনুপস্থিত। কিন্তু যে আমীরুল মুমিনীনের অধীনে জিহাদ করা হবে, তাকে মুজাহিদের সঙ্গে জিহাদের ময়দানে উপস্থিত থাকতে হবে, একথা উনাদের সম্পর্কে কিভাবে ধারণা করি? সুতরাং এ অর্থ হতে পারে না। আর যদি উদ্দেশ্য হয়, অজ্ঞাত বা অপরিচিত, যেমনটি পরের লাইনে আমীরুল মুমিনীনের অধিনস্ত যিম্মাদার সম্পর্কে বলেছেন- ‘মাজহুল’। তাহলে এখানে আমাদের বুঝার বিষয় হল, আমীরুল মুমিনীন হওয়ার জন্য কী পরিমাণ পরিচিত হতে হয় এবং কার কার কাছে পরিচিত হতে হয়? সরাসরি সাক্ষাত পরিচয় থাকতে হয়, না নির্ভরযোগ্য সূত্রের সংবাদে পরিচিত হলেই যথেষ্ট? পৃথিবীর সবার কাছে পরিচিত হতে হয়, না যার সঙ্গে বাইয়াতের সম্পর্ক বা যিনি মামুর, তার কাছে পরিচিত থাকলেই চলে? এই সবগুলো বিষয় সুনির্দিষ্ট হওয়া দরকার এবং দলিলের আলোকে সামনে আসা দরকার, তাহলে আমাদের অবস্থার ভুল শুদ্ধ নির্ণয় সম্ভব হবে; অন্যথায় নয়।

৪র্থ মাসআলা: (যদি শর্ত থাকে, তাও সেই আমীর যদি গায়েবও হয় এবং) “ক্ষমতা কর্তৃত্বশূন্য হয়, তবুও তার নামে যে কোনো পরিচিত বা অপরিচিত দায়িত্বশীল ইশারা করে দিলেই যে কোনো রাষ্ট্রে, যে কোনো স্থানে, যে কোনো ব্যক্তির উপর আক্রমণ করে দেয়া জায়েয চাই সে আক্রমণ বিস্ফোরণ প্রকৃতির কিংবা গুপ্তহত্যা পদ্ধতিরই হোক না কেন আক্রমণের ফলাফল কী দাঁড়াবে এবং তার জন্য কী মাধ্যম অবলম্বন করা হয়েছে, তা আমাদের দেখার প্রয়োজন নেই

আবার একটু লক্ষ করুন- “যে কোনো রাষ্ট্রে, যে কোনো স্থানে, যে কোনো ব্যক্তির উপর আক্রমণ করে দেয়া জায়েয। চাই সে আক্রমণ বিস্ফোরণ প্রকৃতির কিংবা গুপ্তহত্যা পদ্ধতিরই হোক না কেন। এ আক্রমণের ফলাফল কী দাঁড়াবে এবং তার জন্য কী মাধ্যম অবলম্বন করা হয়েছে, তা আমাদের দেখার প্রয়োজন নেই।”

-এরকম ঢালাও অভিযোগ তাঁরা কার সম্পর্কে করেছেন, আমাদের জানা নেই। মনে হয় জিহাদের ভূমিতে এমন কিছু পাগলের দল আছে, যাদের ন্যূনতম হিতাহিত জ্ঞান বলতে কিছুই নেই। পাগল যেরকম শুধু খাওয়া আর পেশাব পায়খানা ছাড়া কিছুই বোঝে না, এরকম তারাও শুধু জিহাদ মানেই মানুষ হত্যা এবং মানুষ হত্যা মানেই জান্নাতে চলে যাওয়ার বাইরে দুনিয়া আখেরাতের আর কিছুই বুঝে না। ফলে তারা মূল্যবান জীবনের প্রতিটি বিন্দু এভাবে পানির মতো ফুঁৎকার দিয়ে সূর্যরশ্মিতে ছড়িয়ে দেয় এবং তাতে রংধনুর সাত রং দেখে দেখে উম্মাদ বিভোর হয়ে শুধু মানুষের রক্ত ঝরায়!

কাজের সুবাদে জিহাদি সংগঠনগুলো সম্পর্কে আমাদের যতটুকু ধারণা আছে, তাতে এমন কোনো জিহাদি সংগঠনের অস্তিত্ব আমাদের দেশে তো নয়ই, সম্ভবত পৃথিবীর কোথাও নেই। উনারা যেহেতু ময়দানে নেই, সুতরাং এ বিষয়ে উনাদের কাছে আমাদের চেয়ে বেশি তথ্য থাকার কথা নয়। অবশ্য ব্যতিক্রমও হতে পারে। যদি থাকে, তাহলে তাও সামনে আসা দরকার। আমাদের ভাইরা আলহামদুলিল্লাহ ময়দানে কর্মরত জিহাদি কাফেলাগুলোর মাঝেও তাদের ভুলগুলো সংশোধনের জন্য দাওয়াতের কাজ করেন। আলহামদুলিল্লাহ ইতিমধ্যে এই দাওয়াতের মা্ধ্যমে আল্লাহ মেহেরবান তাঁর বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহে কিছু কাফেলার সংশোধন করেও দিয়েছেন। সুতরাং এমন জঘন্য ভুলের শিকার কোনো কাফেলার সন্ধান পেলে আমরা তাদের কাছে সহীহ দাওয়াত নিয়ে পৌঁছার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। কারণ জিহাদ কারো ব্যক্তিগত বিষয় নয়; পুরো উম্মতের বিষয় এবং এখানকার ভুলের মাশুল পুরো উম্মতকেই শোধ করতে হয়।

আল্লাহ না করুন, যদি তাঁদের মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আমাদের সম্পর্কে এমন ধারণা করে থাকেন এবং উক্ত কথাগুলো বলে আমাদের প্রতি ইঙ্গিত করে থাকেন, তাহলে আমাদের আল্লাহর আশ্রয় নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, ওয়া লা-হাওলা ওয়া লা-কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজীম!

اللهم أرنا الحق حقا وارزقنا اتباعه، وأرنا الباطل باطلا وارزقنا اجتنابه.

 

. এরপর তাঁরা বলেছেন-

ان ميں سے بعض كا كهنا يه هے كه اب تنفيذ حكم جهاد كي استطاعت بھي موجود هے ، تو يه بھي ايك عجيب معاملة هےكه جهاد كي استطاعت موجود هے ليكن اقامت خلافت كي استطاعت نهيں هے؟!سوچھنا  چاهيے كه اگر تمهارےامير كے اندر جهاد كي استطاعت هوتي تو وه تمهارے اس ملك ميں خلافت اسلامية بھي قائم كر سكتے!

তাদের কারো কারো বক্তব্য হল, এখন জিহাদের বিধান কার্যকর করার সামর্থ্যও আছে তো এটাও এক আশ্চর্য ব্যাপার যে, জিহাদের সামর্থ্য আছে, কিন্তু খেলাফত প্রতিষ্ঠার সামর্থ্য নেই?! ভাবা দরকার, তোমাদের আমীরের হাতে যদি জিহাদের সামর্থ্য থাকত, তাহলে সে তোমাদের রাষ্ট্রে খেলাফতে ইসলামিয়াও প্রতিষ্ঠিত করতে পারত!” পৃ. ১০১১

আমাদের কাছে তো দিফায়ী জিহাদের জন্য খেলাফত প্রতিষ্ঠার মতো সামর্থ্যের শর্তটি আরো আশ্চর্য ব্যাপার মনে হয়। হতে পারে তা আমাদের অজ্ঞতার কারণেই। আর কিছু কারণের প্রতি ইতিপূর্বে আমরা ইঙ্গিত করে এসেছি। সুতরাং তাঁদের দলিল প্রমাণগুলো সামনে আসলেই আশা করি বিষয়টি পরিষ্কার হবে ইনশাআল্লাহ।

আর সামর্থ্যের বিষয়টি সম্পর্কেও আমাদের দেশে অদ্ভুত রকমের সব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলছে। তাঁদের পক্ষ থেকে এই মাসআলাটিরও বিশ্লেষণ আসা দরকার। মনে করুন, আমি মাজুর লাঠি ভর করে হাঁটছি। এর মধ্যে হাতির মতো তাগড়া দশটি দুশমন আধুনিক অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে আমার উপর ঝাঁপিযে পড়ল। তখন কতটুকু সামর্থ্য থাকলে আমি আমার হাতের লাঠিটি দিয়ে তাদেরকে পাল্টা একটা আঘাত করতে পারব, আর কী কী শর্ত ও সামর্থ্য পূরণ না হলে, আমি কোনো আঘাত করতে পারব না, শুধু চেয়ে চেয়ে আঘাত খেয়ে যেতে হবে? আঘাত করলে শরীয়ত আমাকে অতি জযবাতি ও আবেগ নিয়ন্ত্রণহীন বলে চিহ্নিত করবে?

এমনিভাবে সামর্থ্যটা কি হজ্বের সামর্থ্যের মতো উজূবের শর্ত, না নামাযের অজুর মতো আদায়ের শর্ত?

এমনিভাবে সামর্থ্যের সিদ্ধান্তটা কি শরীয়ার আলেম দিবেন, না সমর বিশেষজ্ঞ দিবেন? না উভয় মিলে যৌথ সিদ্ধান্ত দিতে হবে?

মোল্লা মুহাম্মাদ উমর রাহিমাহুল্লাহর তালেবানরা যে বিশ্বের পরাশক্তিই নয় শুধু বরং বলা যায় সমগ্র বিশ্বের মোকাবেলায় জিহাদ করলেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন, তাদের জিহাদ যদি সঠিক হযে থাকে, তাহলে তারা কী পরিমাণ সামর্থ্য নিযে জিহাদে নেমেছিলেন? পারমাণবিক বোমাসহ সর্বাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত বাহিনীর মোকাবেলায় কিছু গাধা ঘোড়া, হাতবোমা, ক্লাসিনকোভ আর রকেট লাঞ্চার ছাড়া আর কী কী সামর্থ্য ছিল তাদের?

এমনিভাবে মনে করুন দুশমন হল দশজন। আমরা আক্রান্ত মুসলিম হলাম ত্রিশ জন। ওরা একজোট হয়ে আমাদের একজনকে সকালে মারে তো বিকালে আরেকজনকে মারে। কিন্তু আমরা ত্রিশজন এক জোট হওয়ার পরিবর্তে প্রত্যেকেই ভাবি, দশজনের মোকবেলায় আমি একা একা কী করতে পারব? আমি ছোট মানুষ, আমি বললেও কি বড়রা আমার কথা শুনবে? তাছাড়া ওরা এমনিতেই তো আমাদেরকে মারছে, যদি নাড়া দেই, আরেকজনকে উদ্বুদ্ধ করতে যাই, তাহলে আরো বেশি মারবে। যারা নড়া চড়া করে, ওরা তো শুধু তাদেরকেই মারে। সুতরাং চুপ করে বসে থাক, আমার দ্বীন পলনে তো ওরা বাধা দিচ্ছে না, সক্রিয় হলে এখন যতটুকু দ্বীন পালন করতে পারছি, তাও পারব না।

-প্রশ্ন হল, এখানেও কি সামর্থ্য নেই বলে আমরা আল্লাহর পাকড়াও থেকে বেঁচে যাব? এই সবগুলো বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার।

শেষ কথা হল, স্থানীয় প্রেক্ষাপটে আমরা মাত্র দাওয়াত ও ই’দাদের কাজ করছি। সুতরাং তাঁদের এ অভিযোগ আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অবশ্য এখানে আমরা ই’দাদ সম্পর্কে তাঁদের মতামত জানার চেষ্টা করতে পারি। কারো পক্ষে নিরাপত্তা বজায় রেখে একাজটি সম্ভব হলে তার সহযোগিতা কামনা করছি। আদব ও বিনয়ের সঙ্গে একটি লিখিত ইস্তেফতা করে তার উত্তর সংগ্রহ করে দিতে পারলে কৃতজ্ঞ হব। তাহলে আমরা আমাদের চলমান কাজে তাঁদের মূল্যবান মতামত থেকে উপকৃত হতে পারব এবং তা আমাদের কাজে অনেক বড় সহায়ক হবে ইনশাআল্লাহ।

 

 

১০. তাঁরা বলেছেন-

عزيزان محترم! ياد ركھيں كه مسلم ممالك كے حكام كي عمومي تكفير (كفر مخرج از ملت كے معنى كے لحاظ سے) كے قول كو ا  گر باطل محض قرار نه بھي ديا جائے اسے صرف ايك ضعيف قول هي قرار ديا جائےپھر بھي اس پر يه تفريع كه اب ان كےعهود ومواثيق يهاں كے مواطنين كے لئےواجب الالتزام نهيں ان كا نقض نقض عهد   اور غدر نهيں، بلا شبه باطل محض هے۔ ص:12

প্রিয় ভায়েরা! স্মরণ রাখবেন, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর শাসকদেরকে (মিল্লাত থেকে বের করে দেয়ার অর্থে) ‘উমূমি তাকফিরতথা ব্যাপকভাবে সকলকে কাফের আখ্যায়িত করার বক্তব্যটি যদি সম্পূর্ণ বাতিল নাও বলা হয় এবং তাকে একটি দুর্বল মতও ধরা হয়, তবুও তার উপর ভিত্তি করে একথা বলা যে, তাদের চুক্তি ও অঙ্গীকারগুলো সে দেশের নাগরিকদের জন্য আবশ্যক নয় এবং সেগুলো ভঙ্গ করা চুক্তি ভঙ্গ গাদ্দারির আওতায় পড়বে না, –এমন কথা তো নি:সন্দেহে বাতিলপৃ.১২

এখানে কয়েকটি কথা:

ক. উমূমি তাকফীর দু’রকম হতে পারে। এক. এত আম ও ব্যাপক তাকফীর, যাতে একটি ‘মুসতাছনা’ বা ব্যতিক্রমও নেই। যেমন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সকল গণতান্ত্রিক সাংসদই কাফের ও মুরতাদ; একজনও ব্যতিক্রম নয়। দুই. এমন আম ও ব্যাপক তাকফীর, যাতে কিছু ‘মুসতাছনা’ বা ব্যতিক্রম আছে। যেমন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর গণতান্ত্রিক সাংসদরা সবাই কাফের, তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে। ভাষার নীতিতে এই দ্বিতীয় প্রকারও ‘উমূমি তাকফীরের’ অন্তর্ভুক্ত। কারণ ‘মুসতাছনা’ বা ব্যতিক্রমের প্রশ্ন তখনই আসে, যখন আমি আগের বাক্যে ‘উমূম’ ও ব্যাপকতা নির্দেশ কোনো কথা বলব। পক্ষান্তরে আমার কথায় যদি ব্যাপকাতা না থাকে, তখন ‘ইসতেছনা’ ও ব্যতিক্রমের প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। যেমন আমি যদি বলি, অনেক সাংসদই কাফের কিংবা বলি, কিছু কিছু সাংসদ কাফের, তাহলে তার সঙ্গে ‘তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে’ বলা অহেতুক। এটি যে কোনো ভাষার স্বীকৃত নীতি।

খ. এখন আমাদের বুঝার বিষয় হল, তাঁরা যে এখানে মুসলিম রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক শাসকদের উমূমি তাকফীরকে দুর্বল মত বলছেন, সেটা কোন অর্থে?

আমি বারবার পড়ে যা বুঝেছি, তা হল তাঁরা প্রথম অর্থে উমূমি তাকফীরকে দুর্বল মত বলেছেন। কারণ-

প্রথমত তাঁরা একটু আগে ১০ নং পৃষ্ঠায় তাঁদের ভাষায় মুজাহিদদের বিচ্ছিন্ন ও উগ্রতা মিশ্রিত চিন্তার উদাহরণে প্রথম অর্থে মুজাহিদদের উমূমি তাকফীরের সমালোচনা করে এসেছেন। সুতরাং এখান থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, মূলত ব্যতিক্রম ও মুসতাছনা ছাড়া উমূমি তাকফীরকেই তাঁরা দুর্বল মত বলে আখ্যায়িত করছেন।

দ্বিতীয়ত আমাদের জানামতে দ্বিতীয় অর্থে উমূমি তাকফীর, তথা কিছু ব্যতিক্রম ও মুসতাছনাসহ সাংসদদের উমূমি তাকফীর জুমহুর ও অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মত এবং কোরআন সুন্নাহর আলোকে শক্তিশালী। সুতরাং তাঁদের মতো ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমরা এমন ধারণা করতে পারি না যে, কোরআন সুন্নাহর দলিলে সমৃদ্ধ জুমহুরের মতকে তাঁরা দুর্বল বলে আখ্যায়িত করবেন।

সুতরাং বাস্তব যদি তাই হয়, তাহলে এই আপত্তিও আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ আমরা গণতান্ত্রিক সাংসদদের উমূমি তাকফীর সেই অর্থেই করি, যেখানে কিছু ব্যতিক্রমও আছে।

কিন্তু তাঁদের উদ্দেশ্য যদি এটা না হয় এবং না হওয়ার সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। কারণ এ প্রসঙ্গে তাঁদের কথা মুজমাল ও সংক্ষিপ্ত। তাহলে দলিল ভিত্তিক বিশ্লেষণ আসার আগে চূড়ান্ত কথা বলার সুযোগ নেই। ততক্ষণ আমরা অপেক্ষায় থাকব ইনশাআল্লাহ।

 

১১. তাঁরা বলেছেন-

اسي طرح يه تصور كهجمهوري نظام سياست كے ساتھ كسي قسم كا بھي تعلق شرك/كفر/حرام هےغلط هے، بلكه اس ميں تفصيل كرنا ضروري هے۔ ص:12

এমনিভাবে এই ধারণা যে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে যে কোনো প্রকারের সম্পর্কই শিরক, কুফর বা হারাম, তা ভুল বরং তাতে বিশ্লেষণ জরুরিপৃ. ১২

এখানে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কারণ আমরাও এখানে বিশ্লেষণ করি। সুতরাং তা আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যে ভাইদের আকীদা মানহাজ ও আচরণবিধি পড়া আছে, তাদের কাছে আশা করি বিষয়টি অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। তবে বিশ্লেষণে যদি দলিল ভিত্তিক ইখতলাফের অবকাশ থাকে এবং সে কারণেই কেউ ইখতেলাফ করে, তাও আমরা ‘মুখতালাফ ফিহ’ মাসআলার নীতিতেই গ্রহণ করি। আমাদের মত অন্যদেরকে মানতে হবে কিংবা তাদের মত আমাদেরকে মানতে হবে, এমন মনে করি না।

১২. তাঁরা বলেছেন-

جو شخص جمهوري نظام  كو لا ديني نظام سمجھتا هے، اس كے جو دفعات كسي كفري عقيده پر متفرع هے وه انھيں باطل سمجھتا هے، اور اس نظام كے كسي دفعه كي بھي غير شرعي تطبيق كو وه جائز نهيں سمجھتا هے، اسے صرف ووٹ دينے كي وجه سے يا انتخاب ميں شركت كرنے كي وجه سے يا پارلمينٹ ميں جانے كي وجه سے مشرك قرار دينا غلو نهيں تو كيا هے؟ ص:12

যে ব্যক্তি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধর্মহীন পদ্ধতি মনে করে, তার যে ধারাগুলো কুফরি আকিদার ভিত্তিতে রচিত, সে তা বাতিল মনে করে এবং তার কোনো অংশের শরীয়া পরিপন্থী প্রয়োগকে সে নাজায়েয মনে করে, তাকে শুধু ভোট দেয়ার কারণে কিংবা নির্বাচনে অংশগ্রহণের কারণে অথবা সংসদে যাওয়ার কারণে মুশরিক সাব্যস্ত করা বাড়াবাড়ি নয় তো কী? পৃ.১২

এখানে দুটি বিষয়কে আলাদা করা যায়-

১ম বিষয়টি হল ‘যে ব্যক্তি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধর্মহীন পদ্ধতি মনে করে, তার যে ধারাগুলো কুফরি আকিদার ভিত্তিতে রচিত, সে তা বাতিল মনে করে এবং তার কোনো অংশের শরীয়া পরিপন্থী প্রয়োগকে সে নাজায়েয মনে করে, তাকে শুধু ভোট দেয়ার কারণে’ মুশরিক সাব্যস্ত করা বাড়াবাড়ি নয় তো কী?

শুধু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট দেয়ার কারণে আমরা কাউকে কাফের বা মুশরিক মনে করি না। একইভাবে কেউ এমনটি মনে করে বলেও জানি না।

২য় বিষয়টি হল, ‘যে ব্যক্তি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধর্মহীন পদ্ধতি মনে করে, তার যে ধারাগুলো কুফরি আকিদার ভিত্তিতে রচিত, সে তা বাতিল মনে করে এবং তার কোনো অংশের শরীয়া পরিপন্থী প্রয়োগকে সে নাজায়েয মনে করে, তাকে শুধু সংসদ নির্বাচনে (চেয়ারম্যান, মেম্বার নয়। সেটা আমাদের আলোচনার বাইরে) প্রার্থী হওয়া বা সংসদ সদস্য পদ লাভ করা’র কারণে মুশরিক সাব্যস্ত করা বাড়াবাড়ি নয় তো কী?’

সংক্ষিপ্ত এই লেখাটিতে এখানে এসে আমি সবচেয়ে বেশি ভাবনায় পড়েছি, কী লিখব, কী লিখব না? ভাবনায় পড়ার কারণ এটা নয় যে, আমাদের অবস্থান আমাদের কাছে পরিষ্কার নয় বা আমাদের অবস্থানের উপর দলিল প্রমাণ নেই। বরং ভাবনার কারণ হল, বিষয়টি লম্বা, কিন্তু আমার লেখা সংক্ষিপ্ত। অল্প কথায় তা পরিষ্কার করা জটিল মনে হয়েছে। তাই এই মুহূর্তে কিছু না লেখাই মুনাসিব মনে করছি। আমাদের ভাইদের অধিকাংশেরই আশা করি বিষয়গুলো দলিলের আলোকে পড়া আছে। আপাতত এখানে শুধু এতটুকুই বলব যে, আমাদের জানামতে এখানেও আমরা উম্মতের জুমহুর উলামায়ে কেরামের মতামতের অনুসারী। বাকি আলোচ্য প্রকাশনাটিতে তাঁরা যে মতামত ব্যক্ত করেছেন, তা দলিলের আলোকে সবিস্তারে সামনে আসলে যদি কথা বলা দরকার হয়, তখনই আমরা এবিষয়ে বিস্তারিত কথা বলব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহই একমাত্র তাওফীকদাতা।

 

১৩. তাঁরা বলেছেন-

عزيزان محترم! اميد هے كه آپ ميں سے كوئي اس طرح كے غلو ميں مبتلا نهيں هوں گے، اور كسي كو مبتلا هوتے ديكھيں گے تو اكرام ومحبت كے ساتھ ان كے سامنے كسي قسم كے نزاع وجدل كے بغير صحيح صورتحال پيش كرنے كي كوشش بھي كريں گے۔

প্রিয় ভায়েরা! আশা করি আপনারা কেউ এরকম বাড়াবাড়িতে নিপতিত হবেন না যদি কাউকে নিপতিত হতে দেখেন, একরাম মোহাব্বতের সঙ্গে কোনো প্রকার বাক বিতণ্ডা ব্যাতীত সঠিক বিষয়টি উপস্থাপনের চেষ্টাও করবেনপৃ. ১৩

আমরা এই নির্দেশনার জন্য তাঁদেরকে এবং যারাই এই নির্দেশনা অনুসরণ করে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান, তাঁদের সবাইকে উষ্ণ সম্ভাষণ ও স্বাগত জানাই। আমরা আলহামদুলিল্লাহ দ্বীন ও ইলমের সত্য ও বিশুদ্ধ অংশের মুখাপেক্ষি। কখনো আমরা তা থেকে নিজেদেরকে বে-নায়ায মনে করি না। সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর আমাদের যে কোনো অবস্থান থেকে ফিরে আসাকে আমরা সৌভাগ্য মনে করি। একইভাবে কাজের জন্য যে ইয়াকিন ও জান্নে গালিব প্রয়োজন, যদিও আমরা তার উপর থেকেই কাজ করি, কিন্তু নিজেদেরকে আল্লাহর ‘মাকার’ থেকে নিরাপদ মনে করি না। এ হল আমাদের দিলের কথা এবং মুখের কথা। অবশ্য অবচেতনভাবেই যদি দিলে অন্য কিছু থাকে, তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই এবং সকলের কাছে দোয়া চাই আল্লাহ যেন আমাদেরকে এই ত্রুটি থেকে পবিত্র করে দেন।

ولا نزكي أنفسنا، إن النفس لأمارة بالسوء، اللهم لاتؤمنا مكرك، ولا تنسنا ذكرك، ولا تهتك عنا سترك، ولاتحعلنا من الغافلين، اللهم أرنا الحق حقا وارزقنا اتباعه وأرنا الباطل باطلا وارزقنا اجتنابه، اللهم اهدنا لما اختلف فيه من الحق بإذنك، اللهم اجمعنا على الحق عاجلا غير آجل، واجعلنا من الراشدين. آمين يا رب العالمين.

কিন্তু দু:খের বিষয় হল, আমাদের অনেক ভাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, বিষয়গুলো নিয়ে উলামায়ে কেরামের সঙ্গে মুযাকারা করার। বলা যায় আমরা ব্যাপকভাবেই তাদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছি না, ইল্লা মাশাআল্লাহ। কেউ কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন, কেউ সরাসারি প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন।

এ অবস্থায় তাঁদের মতো ব্যক্তিরা যখন বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন, আমরা মনে প্রাণে চাই, তাঁরা বাস্তব বিষয়টি দলিলের আলোকে আমাদের সামনে তুলে ধরুন। এ উসিলায় আমাদের উভয় কাফেলাকে আল্লাহ সত্যের মোহনায় মিলিয়ে দিন। আপনাদেরও যাদের সুযোগ আছে, নিরাপত্তা বজায় রেখে, যার যার মতো করে তাঁদের সঙ্গে এবং তাঁদের ফুযালাদের সঙ্গে আলোচনার পথ খোলার চেষ্টা চালিয়ে যান ইনশাআল্লাহ।

 

১৪. তাঁরা বলেছেন-

معتدل مزاج علمائے كرام نے وه لائحه عمل بھي پيش كيا هے، شبكه ميں اس نوع كي كتابيں بھي ملتي هيں۔

মুতাদিল মিযাজ তথা সঙ্গত ভারসাম্যপূর্ণ স্বভাবের উলামায়ে কেরাম সে (শরীয়ত সম্মত) কর্মপন্থাও পেশ করেছেন নেটে সেরকম কিতাবাদিও পাওয়া যায়পৃ.১৩

আলহামদুলিল্লাহ এটা আমাদের জন্য অনেক বড় সুসংবাদের কথা। কারণ আমরা এখন যে পদ্ধতিতে কাজ করছি, তারচেয়ে ‘মু’তাদিল’ পদ্ধতি এখনো খুঁজে পাইনি বা পেলেও বুঝিনি। এটাকেই আমরা সর্বাধিক মু’তাদিল মনে করছি। তবে তাতেও আমাদের কোনো ভুল যে হতে পারে না, তা আমরা মনে করি না। তাই আমাদের ভুলগুলো সংশোধন করার জন্য আমরা উলামায়ে কেরামের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছি এবং এখনো দিল খুলে তাঁদের সংশোধনী গ্রহণের জন্য প্রস্তুত ইনশাআল্লাহ। সুতরাং আপনাদের যার পক্ষেই সম্ভব তাঁরা যেসব ‘মু’তাদিল মিযাজ’ উলামায়ে কেরাম প্রদত্ত কর্ম পদ্ধতির প্রতি এবং যেসব কিতাবের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তা সংগ্রহ করে অধ্যয়ন করুন। আমরাও চেষ্টা করছি ইনশাআল্লাহ। যদি আমাদের সংশোধনের মতো কিছু পান বা আমরা পাই তাহলে তা অবশ্যই সংশোধন করে নিব ইনশাআল্লাহ। তাঁরাও যদি এমন কিছু পেশ করেন, বিশেষ করে সে সকল উলামায়ে কেরাম ও কিতাবের ‍সুর্দিষ্ট নামগুলো প্রকাশ করেন, আমরা কৃতজ্ঞ হব ইনশাআল্লাহ।

 

১৫. তাঁরা বলেছেন-

سمجھنا چاهيے كه ملا عمر كے دور كے طالبان كي جد جهدجهاد شرعي هو نے سے يه لازم نهيں آتا كه پاكستان كے طالبان كے اقدامات بھي جهاد هوں، حماس كے اقدامات درست هونے سے يه لازم نهيں آتا كه آي ايس كے اقدامات بھي جهاد شمار هوں۔

“বুঝতে হবে, মোল্লা ওমরের যমানার তালেবানদের চেষ্টা সাধনা শরঈ জিহাদ হওয়া একথা অবধারিত করে না যে, পাকিস্তান তালেবানদের পদক্ষেপগুলোও জিহাদ হবেহামাসের পদক্ষেপগুলো সঠিক হওয়াও একথাকে অবধারিত করে না যে, আইএসের পদক্ষেপও জিহাদ গণ্য হবে।”

সংক্ষিপ্ততার জন্য আইএস ও হামাস সম্পর্কে আপতত এখানে কিছু বলা থেকে বিরত থাকতে চাচ্ছি।

তবে মোল্লা উমরের তালেবান সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি, তারা আগে জিহাদ করেছেন এবং জিহাদ করে ইমারাহ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যখন জিহাদ শুরু করেন, তখন তাদের কোনো আমীরুল মুমিনীন ছিল না। বরং সাধারণ একজনকে আমীর নিযুক্ত করে জিহাদ শুরু করেছেন। জিহাদের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে ইমারাহ প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং আমীরুল মুমিনীন নিযুক্ত করেছেন।

মোল্লা উমরের যামানার তালেবানের কাজের মাঝে এবং পাকিস্তান তালেবানের যে অংশ মোল্লা উমরের মানহাজে কাজ করে, তাদের কাজের মাঝে কোনো ব্যবধান আছে বলে আমাদের জানা নেই। বরং মোল্লা উমর জিহাদ করেছেন এক সময়কার মুজাহিদদের বিরুদ্ধে, যারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদ করে, আফগানকে তাদের দখলমুক্ত করেছে। পক্ষান্তরে পাকিস্তান তালেবান জিহাদ করছে, গণতান্ত্রিক মুরতাদ শাসকদের বিরুদ্ধে। সুতরাং ‘মোল্লা উমরের জিহাদ ঠিক হলেও, পাকিস্তান তালেবানের জিহাদ ঠিক হওয়া জরুরি নয়’, -একথা আমাদের বোধগম্য নয়। তাদের মাঝে কোনো ব্যবধানের তথ্য যদি তাঁদের কাছে থাকে, তা সামনে আসা দরকার এবং আমাদের জানা দরকার।

তবে হাঁ, পাকিস্তান তালেবানের কিছু পদক্ষেপ যে ভুল ছিল, সে বিষয়গুলো তো তখনই মোল্লা উমরের তালেবান স্পষ্ট করে দিয়েছিল। তাছাড়া এগুলো তো ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

একইভাবে তাঁদের দৃষ্টিতে মোল্লা উমরের তালেবানের কাজের মাঝে এবং আমাদের কাজের মাঝে কী কী ব্যবধান আছে, তাও পরিষ্কার হওয়ার দরকার। আমাদের জানামতে মোল্লা উমর রাহিমাহুল্লাহর তালেবান যেই আকিদা মানহাজ ও পদ্ধতিতে কাজ করেছেন, আমাদের আকিদা মানহাজ ও কাজের পদ্ধতিও তাদের সেই স্বীকৃত আকিদা মানহাজ ও পদ্ধতির অনুরূপ; বরং বলা যায় তার উন্নত ও সর্বশেষ সংস্করণ। কারণ বিগত দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে তার উপর উলামায়ে কেরাম আরো বিস্তর গবেষণা করে তা আরো উন্নত থেকে উন্নততর এবং শরীয়তের মানদণ্ডে আরো বিশুদ্ধ থেকে বিশুদ্ধতর করেছেন। মোল্লা উমরের শরীয়াহ সম্মত ও অভিজ্ঞতালব্ধ সেই আকীদা মানহাজ ও কর্মপদ্ধতি এখন বিশ্বময় স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। আমরা সেটাই গ্রহণ করেছি; ওয়ালিল্লাহিল হামদ। সুতরাং আমরা আমাদেরকে বিশুদ্ধ করার জন্য এছাড়া আর কী করতে পারি?

 

সারকথা:

এক. এ লেখাটি কোনো গবেষণা প্রবন্ধ নয়। তাঁদের প্রকাশনার কোনো জবাব বা প্রতি উত্তরও নয়। বরং সমর্থক শুভানুধ্যায়ী ভাইদের প্রতি কিছু আবেদন এবং তাদের ভাবনার কিছু দিক উন্মোচন।

একই সঙ্গে যে বিষয়গুলো আপাত দৃষ্টিতে আমাদের অবস্থানের বিপরীত মনে হয়, সে ক্ষেত্রে কেন, কোন ‘সংশয়’ বা দলিলের কারণে আমরা তা গ্রহণ করতে পারছি না, তার প্রতি কিছু ইঙ্গিত। যদিও তাঁদের বক্তব্য খুবই মুজমাল ও সংক্ষিপ্ত হওয়ায় মতবিরোধের অনেকগুলো জায়গা এখনো খুব সুস্পষ্ট নয়।

দুই. আমরা আলহামদুলিল্লাহ, শরীয়তের উসূল অনুযায়ী কোরআন ‍সুন্নাহর দলিলের আলোকে আমাদের আকিদা মানহাজ ও কাজের পদ্ধতি ঠিক করেছি এবং তার উপর অবস্থান করে কাজ করার চেষ্টা করছি। সুতরাং এর বিপরীতে যতক্ষণ শরঈ দলিলের আলোকে কোনো কিছু প্রমাণিত হয়ে না আসবে, ততক্ষণ কোনো ব্যক্তির কথায় শরীয়তের দৃষ্টিতেই আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করার সুযোগ নেই।

তিন. তাঁরা প্রকাশনাটিতে যা বলেছেন, তা শুধুই তাঁদের মতমত। এখানে তাঁরা তাঁদের মতামতের পক্ষে দলিল প্রমাণ পেশ করেননি। তবে আমরা বিশ্বাস করি, তাঁদের মতো দায়িত্বশীল ও বরেণ্য ব্যক্তিরা অবশ্যই দলিল ছাড়া কথা বলবেন না। সুতরাং তাঁরা যা বলেছেন, তার দলিল তাঁদের নিকট অবশ্যই আছে। আশা করি অচিরেই তাঁরা তা পেরেশান-হাল উম্মতের সামনে তুলে ধরবেন ইনশাআল্লাহ।

চার. যেহেতু তাঁদের কথার দলিল আছে বলে আমরা মনে করি এবং তাঁদেরকে আস্থাভাজন ব্যক্তিত্ব মনে করি, এজন্য আমরা তাঁদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তা নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা কিছুতেই সঙ্গত মনে করি না। সামাজিক গণমাধ্যমে যারা এ নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছেন, সেগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে যে বিষয়গুলোতে তাঁদের সঙ্গে আমাদের মতবিরোধ আছে বলে মনে হচ্ছে, সেগুলোতে আমাদের কাছে যেহেতু তাঁদের দলিল স্পষ্ট নয়, তাই আপাতত আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ নেই।

 

পাঁচ. তাঁদের দলিল প্রমাণ সামনে আসার পর যদি আমাদের অবস্থান ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলে অবশ্যই আমারা আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করে সঠিক পথ গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত আছি এবং থাকব ইনশাআল্লাহ। তবে যদি ভুল প্রমাণিত না হয়, অথবা ফিকহ ফতোয়ার আলোকেই তাতে মতপার্থক্যের অবকাশ থাকে, তাহলে সেখানে উভয়ের জন্যই অপরের মতামতকে ‘আদাবুল ইখতিলাফের’ নীতিতে গ্রহণ করা জরুরি। আমরা তাই করব এবং তাঁদের প্রতিও আমরা তাই নিবেদন করব।

এই পর্যায়ে শ্রদ্ধাস্পদ আমীরুল মুমিনীন মোল্লা মুহাম্মাদ উমর রাহিমাহুল্লাহর একটি অমীয় বণী স্মরণ করে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ করছি-

“যারা আমাদের ব্যাপারে সন্দেহ করেন- আমরা কী করছি? তাদের কাছে আমাদের সবিনয় নিবেদন, এখানে আসুন এবং কাছ থেকে আমাদের ও আমাদের প্রচেষ্টাগুলো দেখুন। এরপর আমাদের প্রয়াসকে কুরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে যাচাই করুন। আমরা যদি কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ করি, তাহলে তাদের অধিকার থাকবে- আমাদের বিরোধিতা করার। আর যদি আমরা ইসলামী শরীয়তের প্রতিষ্ঠিত সরল পথের উপর থাকি, তাহলে তারা জেনে রাখুক, এটিই আমাদের পথ এবং আমরা কখনই এই পথ থেকে বিচ্যুত হব না। যদি আমরা এই পথ থেকে একটুও বিচ্যুত হই, তাহলে আমরা সত্যিকার মুসলমান হবো না বরং শুধু নাম সর্বস্ব মুসলমান হব।”

وما توفيقي إلا بالله، وما علينا إلا البلاغ، وصلى الله تعالى عليه وعلى آله وأصحابه وسلم تسليما كثيرا كثيرا.

                                                                                     وكتبه العبد:

    أبو محمد عبد الله المهدي

٢٠  شعبان ، ٤١ ٠٤ هـ.

 ٧ ٢  ابريل، ٠١٩ ٢  م

[1] মাআরেফুল কুরআন, ., পৃ.১০০

2  যতটুকু হয়েছে, তাকে তাঁদের শান অনুযায়ী উল্লেখযোগ্য বলার সুযোগ আদৌ নেই। তাঁরা কিতাবুল জিহাদের ভূমিকা লিখেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি যখন প্রতিকূল হয়ে গেল, তখন থেকে তা বাজার থেকে উধাও হয়ে গেল এবং ছাপাও বন্ধ হয়ে গেল। অন্য সকলের মতো তাঁদের খেদমতও যদি এরকম অনুকূল পরিবেশ পরিস্থিতির পথ ধরে হারিয়ে যায়, তাহলে এখানে আমরা কী বলব, খুঁজে পাই না।

3 ক্ষমা করবেন! আমার এই লেখা যদি মুরুব্বিদের কারো হাতে পড়ে যায়, তাহলে তাঁদের দায়িত্ব শেখাচ্ছি বা হেদায়াত দিচ্ছি বলে ‘বদ জান’ করবেন না। আমার এ লেখা আদৌ মুরুব্বিদের জন্য নয়। বরং এ লেখা শুধুই আত্মপক্ষ সমর্থন। এ লেখা শুধুই আমাদের সমর্থক শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি জবাবদিহিতা, যারা আমাদেরকে বিশ্বাস করেন।

[4] মাজমু’ আল-ফাতাওয়া, খ. ২৮, পৃ. ৪৪২

[5] আদওয়াউল বায়ান, খ. ৩ পৃ.৪০

[6] আদওয়াউল বায়ান, খ. ৭, পৃ. ১৫৩

[7] আলফাতাওয়া, খ. ৬, পৃ. ১৫৭

[8] আলফাতাওয়া, খ. ১২, পৃ.২৮০

[9] রদ্দুল মুহতার, খ. ৩, পৃ. ২৩৮

[10] ফাতাওয়া আল কুবরা, খ. ৪, পৃ. ৬০৮

[11] তাফসীরে কুরতুবী, খ. ৩, পৃ. ৩৮

[12] ফাতহুল কাদীর, খ. ৫, পৃ. ৪৪০

[13] মাআরেফুল কোরআন, খ. ৪, পৃ. ৩৩৫-৩৩৬

[14] মাআরেফুল কোরআন, খ. ৪, পৃ. ৩৩৫-৩৩৬

[15] আস-সিয়ারুল কাবীর, খ. ২, পৃ. ৩৭৮

[16] আলমুগনি, ইবনে কুদামাহ রহ, খ. ১০, পৃ. ৩৭৫

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 + ten =

Back to top button