গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞের এক বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। সন্ত্রাসবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের নামে শুরু করেছিল নিধনযজ্ঞ। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল ধারাবাহিকভাবে।
এতে কমপক্ষে ২৪ হাজার রোহিঙ্গা নিহত এবং ১৮ হাজার রোহিঙ্গা নারী ধর্ষিত হন। পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন প্রায় ১১ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা।
ইতিমধ্যে আবার ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে হঠাৎ করেই ভারী অস্ত্রসহ সেনাবাহিনীর সদস্য ও সীমান্ত পুলিশের (বিজিপি) সংখ্যা বাড়িয়েছে মিয়ানমার।
শনিবার (১৮ আগস্ট) ও রোববার (১৯ আগস্ট) বান্দরবানের থানচি ও আলীকদম সীমান্ত, নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালা, আশারতলি, তুমব্রু ও ঘুনধুম সীমান্তে সেনা সদস্য ও সীমান্ত পুলিশ বিজিপির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে দেখা যায়। এ ছাড়া সীমান্ত থেকে রোহিঙ্গাদের সরে যাওয়ার জন্য আগের মতোই তারা মাইকিং করছে। রোহিঙ্গা আলী আহম্মদ জানান, দুই দিন থেকে সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ও টহল বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। তাদের ওপর হামলা হতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন নো ম্যানস ল্যান্ডের অনেক রোহিঙ্গা।
এমনিভাবে, মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সন্ত্রাসীরা কোরবানির পশুহাট থেকে রোহিঙ্গা কৃষকের গরু লুট করা শুরু করেছে।
স্থানীয় সূত্র মতে, গত শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে একদল বিজিপি সদস্য মংডু টাউনশিপের কুলাপাড়া গ্রামের গরু বাজারে আসে।
বিজিপি সদস্যরা রোহিঙ্গা কৃষকদের বিভিন্ন রকম হুমকি-ধমকি দিয়ে ১০টি গরু জোর করে লুট করে নিয়ে গেছে। প্রতিটি গরুর দাম ১০ লাখ মিয়ানমারের টাকা (কিয়াট) বলে জানিয়েছেন স্থানীয় রোহিঙ্গারা। ভুক্তভোগী একজন রোহিঙ্গা কেঁদে কেঁদে বলেন, পুরো বছর পরিশ্রম করে আমি গরুটিকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছি, যাতে ওটা বিক্রি করে কিছু টাকা আয় করতে পারি। এখন আমাকে অনাহারে থাকতে হবে। এটিই আমার একমাত্র সম্বল ছিল।
বিজিপির চাঁদাবাজিতে রোহিঙ্গারা অতিষ্ঠ : বুচিডং জেলার ইয়ংশং ঘাঁটির বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যদের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন স্থানীয় রোহিঙ্গারা। কোনো নোটিশ ও নির্দেশনা ছাড়া রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে ঢুকে তল্লাশির নামে লুটপাটও করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, সেনা-পুলিশ ও বিজিপি রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির খবর নতুন নয়। তার পরও অসহনীয় মাত্রায় চাঁদা দাবি করায় ইয়ংশং এলাকার রোহিঙ্গারা অতিষ্ঠ। বিশেষ করে তিনডিং পিঁয়ে গ্রামের রোহিঙ্গারা বিজিপিকে কিয়াট দিতে দিতে নিঃস্ব।
গত এক সপ্তাহে ৫০ লাখ মিয়ানমারের টাকা (কিয়াট) চাঁদা বিজিপির হাতে তুলে দিতে হয়েছে গ্রামটির রোহিঙ্গাদের। চাঁদা দিতে কেউ অপারগ হলে তাকে বেধড়ক মারধর করছে বিজিপি সদস্যরা।
এনভিসি না থাকলে, ঘরে মোবাইল থাকলে, বসতঘর সংস্কার করলে, বসতভিটার বাউন্ডারি দিলে এমনকি কারো ঘরে মেহমান এলেও অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করে বিজিপি। এ অপরাধের শাস্তি হিসেবে বিশাল অঙ্কের চাঁদা দাবি করে তারা।
ভোক্তভুগিরা জানিয়েছে, একবার চাঁদা দিলে ক্ষান্ত হয় না বিজিপি। দফায় দফায় তাদের দাবিকৃত অর্থ রোহিঙ্গাদের দিতে হয় । অন্যথায় শারীরিক নির্যাতন ও আটকের ভয় দেখানো হয়।
বিনা পারিশ্রমিকে রোহিঙ্গাদের শ্রমদানে বাধ্য করা হচ্ছে : গত বছরের আগস্টে সেনাবাহিনীর গণহত্যার মুখেও যেসব রোহিঙ্গা মাটি কামড়ে রয়ে গেছে তারা বিভিন্নভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে বুচিডংয়ের রোহিঙ্গাদের দৌড়ের ওপর রেখেছে সেনা কর্তৃপক্ষ। নানা কৌশলে নির্যাতন ও বৈষম্য চলছে রোহিঙ্গাদের ওপর বিনা পারিশ্রমিকে রোহিঙ্গাদের শ্রমদানে বাধ্য করছে সেনাবাহিনী।
সূত্র জানিয়েছে, বুচিডংয়ের বিভিন্ন গ্রামের রোহিঙ্গাদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনী কৃষি জমিতে কাজ করতে বাধ্য করছে। সারা দিন কাজ করালেও কোনো পারিশ্রমিক দেয়া হয় না রোহিঙ্গাদের। এমনকি খাবারো সরবরাহ করা হয় না। ফলে ক্ষুধার্ত পেটে কাজ করে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
বুচিডংয়ের কিংদং, আড্ডুইং ন্যাগাদি, ওকেহ্লা পিঁয়ে, ডাপ্পু চুং, কুন্তু এবং ইয়াকনু থিং গ্রামে জোরপূর্বক শ্রম আদায় করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে। প্রত্যেক রোহিঙ্গা পরিবার থেকে একজন সদস্য সেনাবাহিনীর কৃষি কাজে বাধ্য করছে কর্তৃপক্ষ। নির্দেশ অমান্য করলে ড়্রফেতারের হুঁশিয়ারিও রয়েছে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে।
২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর গণহত্যার পর থেকে রোহিঙ্গাদের জীবিকায়নের পথরুদ্ধ করে কর্তৃপক্ষ। ফলে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে খাদ্যাভাব চলছে। ধীরে ধীরে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হচ্ছে তারা। এর ওপর বিনাপারিশ্রমিকে শ্রমদানে রোহিঙ্গাদের কোনো ইচ্ছা নেই। কিন্তু প্রাণের ভয়ে সেনাবাহিনীর কৃষি ফার্মে যেতে হচ্ছে তাদের। সবমিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থার মাঝে দিন অতিবাহিত করছেন রোহিঙ্গা মুসলিমরা।