উস্তাদ উসামা মাহমুদ হাফিযাহুল্লাহপ্রবন্ধ-নিবন্ধ

Lightbulb মানুষ মুসলমান হওয়াকে সহজ মনে করে! -সম্মানিত শাইখ, উস্তাদ উসামা মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ

মানুষ মুসলমান হওয়াকে সহজ মনে করে!
-সম্মানিত শাইখ, উস্তাদ উসামা মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ
‘আছহাবুল উখদূদ’ এর হাদীসকে ভিত্তি করে এই ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখেছেন।
ঈমান এবং ঈমানী পরীক্ষা একইসাথেঃ
বাদশাহর বাতিল ধর্মের বিরুদ্ধে যুবক বিদ্রোহী হয়ে ওঠে যখন কিনা সন্ন্যাসীর ধর্ম সত্যের সৈনিক হয়ে ওঠে, অতঃপর যখন যুবক আল্লাহর দাসত্বের দাওয়াত নিয়ে ময়দানে নেমে আসে তখন আল্লাহ তা’আলা তার হাত দ্বারা অলৌকিকতা প্রকাশ করেন, তার দাওয়াতের ফলে সমাজের স্থবির জলে নড়াচড়ার সৃষ্টি হয় অর্থাৎ আন্দোলনের সৃষ্টি হয়, আর তার দাওয়াত মানুষের হৃদয় ও মস্তিষ্কে বসতে শুরু করে । যখন সন্ন্যাসী যুবকের দাওয়াত এবং আন্দোলন সম্পর্কে অবগত হন, তখন সন্ন্যাসী যুবককে বলেন : ” أَيْ بُنَيَّ أَنْتَ الْيَوْمَ أَفْضَلُ مِنِّيْ “, “হে আমার ছেলে ! তুমি তো এখনই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে গিয়েছ ।”, ” قَدْ بَلَغَ مِنْ أَمْرِكَ مَا أَرَى “, “তোমার প্রকৃত স্বরূপ আমি বুঝতে পারছি ।” , ” وَ إِنَّكَ سَتُبْتَلَى ” , “সুতরাং তোমার উপর (বাদশাহর) আদেশ তথা নির্যাতনও তাড়াতাড়ি এসে যাবে ।” , ” فَإِنْ ابْتُلِيْتَ فَلَا تَدُلَّ عَلَىَّ “, “যদি তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হও তবে তুমি আমার কথা প্রকাশ করে দিও না ।” সন্ন্যাসীর এই কথোপকথনটি পরবর্তী তিনটি বিষয়বস্তুর কেন্দ্রবিন্দু এবং ” و إنك ستبتلى “, “সুতরাং তোমার উপর আদেশ তথা নির্যাতনও তাড়াতাড়ি এসে যাবে ” এই বাক্যটিতে তারিখে ঈমান তথা ঈমানের ইতিহাস বিষয়ক আলোচনা রয়েছে যে, রাহে হক তথা সত্য পথের সঙ্গে বিপদ-আপদ এবং ঈমানের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আপতিত হবার সম্পর্ক খুবই ওতপ্রোত; এ যেন একটি আরেকটির আঁচল স্বরূপ। যিনি যত বেশি ঈমানদ্বার হবেন ও যত বেশি সৎপথে পরিচালিত হবেন তিনি তত বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হবেন । এই বাস্তবতার ইলম সন্ন্যাসীরও ছিল । তিনি যুবকটিকে বলেছিলেন যে, “তুমি সেরা” । মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করতে ময়দানে নামা কোন সাধারণ কাজ নয় । এই পথটিকে বাছাই করা বিশাল বড় একটি কাজ । এর জন্য তোমাকে অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে । সন্ন্যাসীর কথা হুবহু সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল । বাদশাহ যুবকের জীবনকে দুর্বিষহ করে দিয়েছিল । তাকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল । তাকে হত্যা করার জন্য বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল । এবং শেষ পর্যন্ত বাদশাহর হাতেই ঐ যুবকের শাহাদাত হয়েছিল । আসলে মূলকথা তো এই যে, আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার পূর্ণ করার পথটি কোন তাজা ফুলের ডালি নয় বরং, এই পথটি ফুলের পরিবর্তে কাঁটা দিয়ে পরিপূর্ণ । এই পথে দ্বন্দ্ব, ঝামেলা, বিচ্ছিন্নতা, কষ্ট, উদ্বেগ, মারধর, কারাবন্দি, অনাহার, নির্বাসন, মৃত্যু সহ আরও বিভিন্ন নির্যাতনেরর সম্মুখীন হতে হয় তাও আবার একই সাথে । যিনি আল্লাহ তা’আলাকে সন্তুষ্ট করতে এবং তার জান্নাতসমূহ অর্জন করতে তীব্র আগ্রহী; তার উচিত, এই বাস্তবতাকে বুঝা ও স্মরণে রাখা এবং এই বিষয়টি নিজের হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে সতেজ-সচল রাখা । আর যে আল্লাহর কিতাবের সম্পর্কে ধারণা রাখে না এবং নবী-আম্বিয়া, সিদ্দিকীন, শুহাদা ও সালেহীনগণের জীবনী সম্পর্কে ধারণা রাখে না, সে তারিখে ঈমান তথা ঈমানের ইতিহাস বুঝতে সক্ষম হয় না ।
যখন ঈমানকে সম্মান করা হয় নাঃ
ঈমান আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় আমানত । আর এই আমানতের সুরক্ষার বিনিময়ে আল্লাহ তা’আলা তাঁর সন্তুষ্টি ও পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন । আল্লাহ পাকের কিতাবে বলা হয়েছে যে, এই পুরষ্কারগুলি কেবলমাত্র তাদের জন্য যারা এই আমানতের মূল্য উপলব্ধি করতে পারে, যারা মনে করেন যে, এর বিনিময়ে আল্লাহর চিরস্থায়ী জান্নাতসমূহ পাওয়া যাবে আর সেই সাথে আল্লাহর সাক্ষাতও মিলবে । সুতরাং, এই ধরণের মানুষের কাছে তাদের জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল; এই আমানতকে রক্ষা করা এবং এর রক্ষার্থে যা প্রয়োজন তাই পূর্ণ করা। এই আমানতের হক্ব আদাই করা কোন সাধারণ কাজ নয় । এই প্রচেষ্টায়, যতই উত্থান-পতন হোক না কেন এবং যাত্রাটি যতই দীর্ঘ ও কঠিনই বা হোক না কেন তারপরও তাদের ঈমান, সংকল্প এবং ইচ্ছার মধ্যে কমতি আসে না । দুঃখ-কষ্ট তাদেরকে সঠিক পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে না । দুনিয়ার সুখ-সমৃদ্ধি ও লোভ-লালসা তাদেরকে ধোঁকা দিতে পারে না । নেয়ামত ও স্বচ্ছলতা তাদের কাছে ধরা দেয়, স্বাচ্ছন্দ্যে তারা দিন কাটায় অথবা ফুলে-ফলে তাদের চারিদিক সুশোভিত হয়। তাদের ভাগ্যে কষ্ট ও দুর্দশা রয়েছে । তারা উভয় অবস্থাকেই নিজেদের জন্য পরীক্ষা মনে করেন । কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং ধৈর্য ধারণ করা হচ্ছে তাদের পথের পাথেয় । আর এভাবেই তারা প্রতিটি সমস্যা ও পরীক্ষার পথ হক্বের উপর অবিচল থেকে অতিক্রম করেন । আর এভাবেই আল্লাহ তা’আলার সাথে তাদের সম্পর্ক আগের চেয়ে আরও গভীর হতে থাকে । পক্ষান্তরে, যাদের ঈমানী দাবি হলো অর্থবিত্তের বাণিজ্যের মত, বৈষয়িক লাভ-লোকসানের দিকেই যাদের নজর, তারাও তাদের কার্যকলাপ দ্বারা পরীক্ষিত ও চিহ্নিত হয়ে যায়। যদি তাদের সফরটি দীর্ঘ হয় এবং তাদের জন্য সত্য পথের পরীক্ষাগুলি বাড়তে থাকে তবে তারা থেমে যায় । আল্লাহর প্রতিশ্রুতিগুলো সম্পর্কে সন্দেহ করতে থাকে । অলসতা এবং সামান্য সাহসে বদলে যায় তাদের তৎপরতা । আর যে সফর মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদতের প্রতিজ্ঞা দিয়ে শুরু হয়েছিল তা গন্তব্যে পৌঁছার আগেই শেষ হয়ে যায় । আল্লাহ রব্বুল ইজ্জত এই ধরণের লোকদের সম্পর্কে বলেছেন :

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَعْبُدُ اللّٰهَ عَلَى حَرْفٍ فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهٖ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انقَلَبَ عَلَى وَجْهِهٖ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةَ ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ
মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়িত হয়ে আল্লাহর এবাদত করে। যদি সে কল্যাণ প্রাপ্ত হয়, তবে এবাদতের উপর কায়েম থাকে এবং যদি কোন পরীক্ষায় পড়ে, তবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ইহকালে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত। এটাই প্রকাশ্য ক্ষতি। [সূরা হাজ্ব(২২):১১]


এই পরিণতির কারণ কী? এই পরিণতির কারণ হচ্ছে ঈমানকে অমূল্যায়ণ করা এবং সত্য পথ সম্পর্কে ভুল ধারণা করা । জান্নাতসমূহ বিভিন্ন অসুবিধা দ্বারা আবৃত, আর জান্নাত পাওয়ার জন্য কোন ধরণের অপরাধ গ্রহণযোগ্য নয় । অথচ তাদের সমস্ত পেরেশানি এমন এক দুনিয়ার জন্য যার মূল্য মশার পালকের মতো । গুরুত্বতা, নিরানন্দ, কষ্ট, কঠোর শ্রম, পরিকল্পনা এবং কৌশল ইত্যাদি সব কিছু এই নিকৃষ্ট দুনিয়ার জন্য । আর অপরদিকে গুরুত্বের অভাব, উদাসীনতা, আত্মতুষ্টি, অলসতা ইত্যাদি সব আখেরাতের জন্য । সুতরাং তাদের কাজ-কর্মে স্পষ্ট ফুটে ওঠে যে, এই ধোঁকার ঘর তথা দুনিয়াই হল তাদের কাছে মূল্যবান । আর আসল ও চিরন্তন গন্তব্য তথা আখেরাত সম্পর্কে না তাদের কোন চিন্তা আছে আর না তাদের কাছে এর কোন মূল্য আছে । দুনিয়াকে মূল্যায়ন করা এবং ঈমানকে অমূল্যায়ন করার মাধ্যমে তাদের পরিচয়ও পাওয়া যায় যে, তারা কোন জীবনের উপর বিশ্বাস রাখে আর কোন জীবনের উপর সন্দেহ পোষণ করে ।

আল্লাহর জান্নাত কোন সাধারণ পণ্য নয়ঃ
পৃথিবীতে এমন কোন উপকার নেই এবং এমন কোন মূল্যবান জিনিস নেই যা কোন প্রকার কষ্ট এবং তার মূল্য পরিশোধ করা ব্যতীত পাওয়া যায় । আর, আমি বিশ্বাস করি যে সমগ্র মহাবিশ্বে ঈমানের চেয়ে মূল্যবান নেয়ামত আর দ্বিতীয়টি নেই । এই মহামূল্যবান নেয়ামত তথা ঈমানকে কি কোন প্রকার কষ্ট না করে এবং তার মূল্য পরিশোধ না করে পাওয়া যাবে? আল্লাহর চিরস্থায়ী নিয়ামতসমূহ যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শুনেনি, পৃথিবীর কেউ কল্পনাও করেনি তা কি কোন প্রকার কষ্ট না করে এবং তার মূল্য পরিশোধ না করে পাওয়া যাবে? “আমি মুসলমান” শুধু এই কথাটা বললেই কি পাওয়া যাবে? না, পাওয়া যাবে না । এমনটা কিভাবে হতে পারে ? আল্লাহর পণ্য কি এতই সস্তা ? হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম বলেছেন : ” أَلَا إِنَّ سِلْعَةَ اللهِ غَالِيَةٌ ” , ” জেনে রাখ / শোনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর পণ্য তথা আল্লাহর জান্নাতসমূহ অনেক মূল্যবান।” নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও খাহেশাতসমূহকে হত্যা করা ব্যতীত আল্লাহর এই জান্নাতসমূহ পাওয়া যাবে না । নিজের সর্বস্ব তথা জান-মাল একমাত্র আল্লাহ তা’আলার জন্য নিঃশেষ করে দেওয়ার পর আল্লাহ তা’আলা তাঁর জান্নাতসমূহ দিয়ে থাকেন । আল্লাহর রাস্তা বিভিন্ন বালা-মুছিবত দ্বারা পরিপূর্ণ । দুধ পানকারী এবং রক্ত প্রবাহিতকারী ​​উভয় প্রেমিক একই সাথে চলবে এবং উভয়ের শেষ পরিণতি একই হবে তা অসম্ভব । যখন আল্লাহ ওয়ালাদের এবং দুনিয়ার ওয়ালাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই এক নয়, তখন গন্তব্য কিভাবে এক হতে পারে? আসলে মূল কথা তো হচ্ছে এই যে, ঈমান কেবল ইলম জানার নাম নয় যে, কোন ব্যক্তি কিছু শোনল-পড়ল, কিছু জিনিসকে সমর্থন করল এবং সেগুলির কয়েকটিকে খণ্ডন করল আর তাতেই পুরো জীবন কাটিয়ে দিল যেমনভাবে ঈমান থেকে বঞ্চিতদের সাথে হয়ে থাকে । না, বিষয়টি এমন নয় ! ঈমান হচ্ছে আসমানসমূহের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা’আলার সাথে ওয়াদা করার নাম, এই ঈমানের মধ্যে ভালবাসা-ঘৃণা, বন্ধুত্বতা-শত্রুতা, চেষ্টা-সাধনা ইত্যাদি সবই আছে । এখানে তো পদে পদে পরীক্ষা, বালা-মুছিবত যা অতিক্রম করার ফলে জানা যায় যে, কে আল্লাহর পণ্য (জান্নাত) পাওয়ার জন্য তীব্র আগ্রহী এবং এই নিকৃষ্ট দুনিয়ার দিকে তাকায় না? আল্লাহ রব্বুল ইজ্জত বলেছেন: ” أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا “ , “মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা ঈমান এনেছি “ (আর তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে) ” وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ “, “এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? [সূরা আনকাবুত(২৯):২] “এমনটা কখনও হবে না বরং অবশ্যই তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে । ” وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ “, “আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল”; আর এটা আল্লাহ তা’আলার সুন্নাত, ” فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ “, “আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যে, কারা সত্যবাদী এবং কারা মিথ্যুক। [সূরা আনকাবুত(২৯):৩]” আরবী ভাষায়, ফিতনাহ্ বলতে, আগুনের চুল্লিতে স্বর্ণ পুড়িয়ে এর আসল অংশ এবং মিশ্রিত অংশ পৃথক করার প্রক্রিয়াকে বোঝায় । এমনিভাবে আল্লাহ তা’আলা বান্দাদেরকে দুঃখ-কষ্টের মাঝে ফেলে তাদের ক্বলবের আসল রূপ প্রকাশ করেন যাতে তারা সংশোধিত হতে পারে । এটি আল্লাহ তা’আলার প্রতি মুমিনদের ভালবাসা বৃদ্ধি করে । এভাবে আল্লাহ তা’আলা তাদের ঈমানকে শক্তিশালী করেন এবং তাদের আমলকে পবিত্র করেন, তবে যাদের অন্তরে সন্দেহ রয়েছে, আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস রয়েছে এবং দুনিয়ার প্রতি প্রেম রয়েছে; আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত পরীক্ষা তাদের আসলরূপ প্রকাশ করে দেয় । জান্নাতসমূহে পৌঁছানোর জন্য পরীক্ষা নামক চুল্লির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করার অর্থ যা মহান আল্লাহ তা’আলা তাঁর গ্রন্থের বহু জায়গায় উল্লেখ করেছেন ; কোথাও একেবারে নিরঙ্কুশ দুর্ভোগ ও বিচারের মধ্য দিয়ে যাওয়া প্রয়োজন বলে ঘোষণা করেছেন, আবার কোথাও দ্বীনের নুসরতে বালা-মুছিবত ও জিহাদ-কিতাল এর কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, এই পরীক্ষাগুলিতে ধৈর্য ধারণ না করে আল্লাহর জান্নাতে যাওয়া তোমাদের জন্য কল্পনা বৈ আর কিছুই নয় ।
আল্লাহ রব্বুল ইজ্জত বলেছেন:


أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُواْ الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللّهُ الَّذِينَ جَاهَدُواْ مِنكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ
তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জেহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্য্যশীল। [সূরা ইমরান(৩):১৪২]


এমনিভাবে আরও বলেছেন:


وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ
আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যে পর্যন্ত না ফুটিয়ে তুলি তোমাদের জিহাদকারীদেরকে এবং সবরকারীদেরকে এবং যতক্ষণ না আমি তোমাদের অবস্থান সমূহ যাচাই করি। [সরা মুহাম্মাদ(৪৭):৩১]


এবং আরও বলেছেন:

وَلَوْ يَشَاء اللَّهُ لَانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ
আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের কতককে কতকের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। [সূরা মুহাম্মাদ(৪৭):৪]

তারিখে ঈমানের সবকঃ
যদি কেউ কোন রাস্তা দিয়ে তেমন কোন কষ্ট বা পেরেশানি ছাড়াই অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছে যায় তবে নতুন কোন যাত্রী বড় কোন মুছিবত দেখার সাথে সাথে ভাববে, রাস্তা তো সহজ ছিল কিন্তু এখন কেন সমস্যা হল ! আর যদি একের পর এক সমস্যা আসতেই থাকে তবে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে যে, সে থেমে যাবে এবং ফিরে যাওয়ার চিন্তা শুরু করে দিবে । বিপরীতে, যে সফরের ইতিহাসই এমন যে, তাতে যেই গিয়েছেন তাকেই কাটিয়ে উঠতে হয়েছে কলিজা কাঁপানো অসংখ্য কষ্ট, খাড়া উপত্যকা এবং সংখ্যাতীত উত্থান-পতনের মুখোমুখি হয়ে সমস্ত ধরণের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার পরেই তিনি তার গন্তব্য খুঁজে পেয়েছেন; কোন ব্যক্তি যদি এই ধরণের পথে কোন পরীক্ষার সম্মুখীন হন তবে তাকে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না, হতাশ হয়ে ফিরে আসা যাবে না বরং তিনি এই তাকলিফকেই সত্য পথের চিহ্ন মনে করবেন এবং বুঝতে পারবেন যে, “হক্ব রাস্তা এটাই”, ” هَذَا مَا وَعَدَنَا اللّٰهُ وَ رَسُولُهٗ “, “আল্লাহ ও তাঁর রসূল এরই ওয়াদা আমাদেরকে দিয়েছিলেন । [সূরা আহযাব(৩৩):২২]” যতবার তোমরা পড়ে যাবে, ততবার তোমরা আবার উঠে দাঁড়াবে । গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, কেবলমাত্র সেই লোকেরা এই সফরের জন্য বের হবে যারা গন্তব্যে পৌঁছতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ । এই দৃঢ় সংকল্প এবং মহব্বতই বার বার নীচে পড়ে যাবার পরে পুনরায় তাদেরকে দাঁড় করাবে । তবে, গন্তব্যের সাথে যাদের সম্পর্ক কেবল জিহ্বার ডগায়; তারা তো কয়েক কদম এগিয়ে যেতেও সক্ষম হবে না ।

رستے ميں جو كانٹے آئے، پهولوں سے گو زياده تهے
منزل كے متلاشى چلتے رہنے پر آماده تهے
পথ কন্টকাকীর্ণ ছিল, ফুলের চেয়ে বেশি কাঁটা ছিল
তারপরও গন্তব্যের অনুসন্ধানকারীগণ তাদের সন্ধান চালিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিল

এটাই হচ্ছে হক্ব রাস্তার উদাহরণ । আল্লাহ তা’আলার কিতাবে এসেছে যে, যদি তোমরা সত্যি সত্যিই জান্নাতে যেতে চাও তবে শুনে নাও ! তোমাদের পূর্বে যারা এসেছে তাদের উপর বালা-মুছিবতের পাহাড় ছিল, যখন তারা এই বালা-মুছিবতসমূহকে সহ্য করেছেন তখন তারা এই গন্তব্যে পৌঁছেছেন ।


أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُواْ الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِينَ خَلَوْاْ مِن قَبْلِكُم مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاء وَالضَّرَّاء وَزُلْزِلُواْ حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُواْ مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللّهِ أَلا إِنَّ نَصْرَ اللّهِ قَرِيبٌ
তোমাদের কি এই ধারণা যে, তোমরা জান্নাতে চলে যাবে, অথচ তোমরা সেই লোকদের অবস্থা অতিক্রম করনি যারা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়েছে। তাদের উপর এসেছে বিপদ ও কষ্ট। আর এমনি ভাবে শিহরিত হতে হয়েছে যাতে নবী ও তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে পর্যন্ত একথা বলতে হয়েছে যে, কখন আসবে আল্লাহর সাহায্যে! তোমরা শোনে নাও, আল্লাহর সাহায্য একান্তই নিকটবর্তী। [সূরা বাকারা(২):২১৪]


এরপর এই তারিখে ঈমান এটাও বর্ণনা করে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে যত বেশি প্রিয় ছিল, যার যত বেশি খালেস ঈমান-আমল ছিল সে তত বেশি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করেছিল । “হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে يا رسولَ اللهِ ! أيُّ الناسِ أشدُّ بلاءً ؟ হে আল্লাহর রসূল ! কারা সবচেয়ে বেশি বালা-মুছিবতে আপতিত হয়েছেন ? কারা সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত হয়েছেন ? قال : الأنبياءُ ، ثم الصالحون ، ثم الأمثلُ فالأمثلُ مِنَ النَّاسِ তিনি বললেন: সবচেয়ে বেশি নবীগণ, তারপর সালেহীন, তারপর মানুষের মধ্যে যারা আল্লাহ তা’আলার যত বেশি নিকটে তারা তত বেশি পরীক্ষিত হয়েছেন । يُبتلى الرجلُ على حسبِ دِينِه মানুষের মধ্যে যে পরিমাণ দ্বীন ইসলাম রয়েছে সে অনুযায়ী তাকে পরীক্ষা করা হয় । فإن كان في دِينِه صلابةٌ زِيدَ في بلائِه যদি তার দ্বীনের মাঝে শক্তি থাকে তবে তার পরীক্ষাও শক্ত হয় । وإن كان في دِينِه رِقَّةٌ ، خُفِّفَ عنه আবার যদি তার দ্বীনের মাঝে দুর্বলতা থাকে তবে তার পরীক্ষাও দুর্বল তথা হালকা হয় । ولا يزالُ البلاءُ بالمؤمنِ حتى يمشي على الأرضِ وليس عليه خطيئةٌ আর মু’মিন বান্দার উপর পরীক্ষা চলতে চলতে এমন এক সময় আসে যখন উক্ত বান্দা যমীনের উপর হাঁটে এমন অবস্থায় যে, তার কোন গোনাহ্ নেই” । আম্বিয়ায়ে কেরামের ইতিহাস দেখুন; আল্লাহর খলিল ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম যিনি নবীগণের পিতা এবং মুত্তাক্বীনদের সবচেয়ে বড় ইমাম ছিলেন । ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম কি এ সম্মান কোন বালা-মুছিবত-পরীক্ষা ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন ? না, তিনি ফ্রীতে পাননি; কোথায় সম্মান ফ্রীতে পাওয়া যায় ? ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছে, তিনি দেশত্যাগ করেছেন, নির্বাসিত হয়েছেন, নিজের প্রিয় সন্তান ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে কুরবানী করার আদেশ প্রাপ্ত হয়েছিলেন, আর তিনি নিজের বুকে পাথর রেখে নিজের কলিজার টুকরা সন্তানের গলায় চুরি চালিয়েছেন । ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর চোখ নিজের ছেলেকে হারানোর কষ্টে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল । ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামের মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল । ইউসুফ আলাইহিস সালামকে জেলখানায় রাখা হয়েছিল, বেশ কয়েক বছর বন্দীত্বের কষ্ট সহ্য করেছিলেন এবং শেষে ভয়ংকর পরীক্ষা তথা মিশরের রাজার স্ত্রীর ফেতনার মাঝেও আল্লাহর শোকরগুজার বান্দা ছিলেন । আইউব আলাইহিস সালাম দীর্ঘ অসুস্থতা এবং চরম পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছেন । ইউনুস আলাইহিস সালাম পানিতে পড়েছেন এবং মাছের পেটে ছিলেন । নূহ্ এবং লূত আলাইহিমাস সালামের শত শত সাল নিজের ক্বওমের বদ আখলাক এবং বিরোধিতা সহ্য করে কাটিয়েছিলেন । মূসা আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈলের হাতে বেহিসাব নিপীড়িত হয়েছিলেন ……. আর হক্ব তো এটা যে, আল্লাহর এই নবী এবং আউলিয়ার মধ্য থেকে এমন কে আছেন যিনি কোন প্রকার পরীক্ষা ব্যতীত বিগত হয়েছেন ? তারিখে ঈমান তথা ঈমানের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, ঈমানদ্বারদেরকে জীবন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে কিন্তু তারপরও তারা ঈমানকে ত্যাগ করেননি । তাদের শরীরকে করাত দ্বারা ছিঁড়া হয়েছে তারপরও তারা দৃঢ়তার পাহাড় ছিলেন । হযরত খাব্বাব (রাযি:) এর হাদিস যেহেনে আছে যে, যখন হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম তাদেরকে এই বাস্তবতা বললেন এবং শেষে বললেন ” و لكنكم تستعجلون “,”কিন্তু তোমরা তো তাড়াতাড়ি পেতে চাও” ফলে তোমরা তাড়াতাড়ি দেখতে চাও ! এই তারিখে ঈমান বর্ণনা করে যে, আল্লাহর ইবাদত করতে হলে অনেক বড় বড় দায়িত্ব নিতে হয় । এই রাস্তা অবশ্যই কন্টকাকীর্ণ কিন্তু এটাই জান্নাতের পথ এবং এটাই সিরাতে মুস্তাক্বীম !! ঈমানের এই যাত্রা পথে ঈমানের অসম্মান তথা পরীক্ষা হয় । যার ঈমান যত বেশি শক্তিশালী হয় তাকে তত বেশি ঈমানী পরীক্ষা করা হয় আর যখন ঈমানী পরীক্ষা উপর ধৈর্য ধারণ করা হয় এবং এমন কোন বক্র রাস্তায় চলে যাওয়া হয় না যা আল্লাহর কাছে অপছন্দ তখন তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায় তথা তার ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পায় । অর্থাৎ এই রাস্তায় ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি হয় ঈমানী পরীক্ষা উপর ধৈর্য ধারণ করার মাধ্যমে । যে যত বেশি ধৈর্য ধারণ করবে তার ঈমান তত বেশি বৃদ্ধি পাবে অর্থাৎ শক্তিশালী হবে ।

ঈমানী পরীক্ষা থেকে পালানো অসম্ভব…….!
আল্লাহ তা’আলার কিতাবে এবং হাদীসে ঈমানদ্বারকে ক্ষমা প্রার্থনা করার আদেশ করা হয়েছে । আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বালা-মুছিবত সহ্য করার ফলে অবশ্যই অবশ্যই অনেক প্রতিদান পাওয়া যায় । কিন্তু মানুষ তো দুর্বল আর দৈর্য ধারণ করাও কোন সহজ কাজ নয় তাছাড়া জানা নেই যে, কোন্ বালা-মুছিবত মানুষের ঈমান ও আমলে সালেহকে ক্ষতির সম্মুখীন করে ফেলে । এই জন্য বান্দার নিজের পক্ষ থেকে পরীক্ষার তামান্না করা উচিত নয় । আল্লাহ রব্বুল ইজ্জত বলেছেন: ” أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ “, “মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা ঈমান এনেছি (আর তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে) এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না?” এই আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, ঈমানী পরীক্ষা থেকে বাঁচার জন্য বান্দার সমস্ত চেষ্টা-সাধনা অকার্যকর হয়ে যাবে আর ঐ পরীক্ষার মোকাবিলা করতেই হবে । বান্দা আল্লাহ তা’আলার কাছে ঈমানের নিয়ামত চায় কিন্তু এই ব্যবসায় অপর দিক থেকে ঈমানের নিয়ামতের সাথে সাথে এর পরীক্ষাও আসে আর যখন এমন হয় তখন বিচলিত হওয়া যাবে না, পদচিহ্নগুলিকে বিচ্ছিন্ন হতে দেওয়া যাবে না । ঈমান এবং ঈমান আনার পর এর সাথে যুক্ত বিষয়াদি থেকে পালানোর ইচ্ছা করা যাবে না । শাইখ আবূ ক্বাতাদা রহ. বলেছেন: হেদায়াত প্রাপ্ত ব্যক্তি হক্বের সাথে সম্পর্কিত বালা-মুছিবত-পরীক্ষার কারণে কখনও হক্ব পথ থেকে চলে যান না কেননা তিনি জানেন যে, এই বালা-মুছিবত-পরীক্ষার উপর সবর তথা দৈর্য ধারণ করার ফলাফল হল হেদায়েত, ইলম এবং তাক্বওয়া । আর এই তিনটি সিফতই দ্বীনের ইমামত তথা মূল আরকান বা উপাদান । পক্ষান্তরে, মানুষ যদি বালা-মুছিবত-পরীক্ষা দেখে ঈমানের উদ্দেশ্য এবং আল্লাহর আদেশ থেকে পালানোর ইচ্ছা করে তবে এমন করা ঈমান গ্রহণ করার পক্ষে সত্যায়ন করে না । আর বান্দা যত বেশি ঈমানের উদ্দেশ্য পূরণ করা থেকে বিরত থাকবে তত বেশি ঈমানের হাক্বীক্বত তথা বাস্তবতা থেকে দূরে থাকবে । শাইখ আবূ ক্বাতাদা রহ. সূরা আনকাবুতের তাফসীরের অন্যত্র বলেছেন যে, “ঈমান এবং তাসলীম (আত্মসমর্পন) উভয়ের সম্পর্কের মাঝে খলা নামক কোন বস্তু নেই অর্থাৎ এমন নয় যে, মানুষ ঈমানের কোন হাক্বীক্বত তথা বাস্তবতাকে ক্বলব ও আমল থেকে বের করে দিবে আর ঈমানের বিপরীত বস্তু উক্ত খালি স্থান দখল করে নিবে না । বিষয়টি এমন নয় ! বরং যতটুকু জায়গা থেকে ঈমান বের হয়ে যাবে ততটুকু জায়গা ঈমানের বিপরীত বস্তু দখল করে নিবে । যদি ঈমানী শর্তসমূহ পূর্ণ না হয় তবে উক্ত স্থান কুফর দখল করে নেয় । যদি ওয়াজিব বিষয়াদি আমলের মধ্যে আনা না হয় তবে ফিসক্ব উক্ত স্থান নিজ থেকেই দখল করে নেয় । আর যদি মুস্তাহাবসমূহের উপর আমল না করা হয় তবে সে অনুযায়ী আল্লাহর নৈকট্যতা থেকে মাহরূম তথা বঞ্চিত হয়ে যায়, যেমনভাবে হাদীসও রয়েছে যে, বান্দার ফরজ আমলসমূহের পর নফল মুস্তাহাবের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভ হয় । অর্থাৎ বান্দা যতটুকু নফল আদায় করা থেকে বিরত থাকবে ততটুকু আল্লাহর নৈকট্যতা থেকে মাহরূম তথা বঞ্চিত থাকবে ।” সুতরাং মুমিনের উচিত অন্য সব কিছুকে এক পাশে রেখে তার সম্পূর্ণ দৃষ্টি ঈমানের হেফাজতে রাখা এবং ঈমানের উদ্দেশ্যসমূহ পূর্ণ করা, যদিও এই কারণে ঈমানের সাথে সম্পর্কিত বালা-মুছিবত-পরীক্ষার সম্মুখিন হতে হবে । “ইমাম ইবনে কাইয়্যিম রহ. অনেক বড় সুন্দর কথা বলেছেন এই ” وَعَسَى أَن تَكْرَهُواْ شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَعَسَى أَن تُحِبُّواْ شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ وَاللّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ “ আয়াত খানা নকল করে: যখন বান্দা এই বাস্তবতা বুঝতে সক্ষম হয় যে, নিজের নিকটে যে কাজ অপছন্দীয় কিন্তু এর শেষ পরিণাম কল্যাণকরও হতে পারে আবার নিজের নিকটে যে কাজ পছন্দনীয় এর শেষ পরিণাম অকল্যাণকর ও হতে পারে । সুতরাং বান্দা নিজের পছন্দনীয় অবস্থার উপরও কখনও সন্তুষ্ট হয় না এবং শেষ অপছন্দনীয় পরিণতি উপরও কখনও সন্তুষ্ট হয় না । কেননা সে জানে না যে, সে যে পেরেশানিকে মুছিবত মনে করছে হতে পারে এই পেরেশানি কল্যাণ ও খুশীতে রূপ নিয়ে শেষ হবে । যেহেতু শেষ ফলাফল সম্পর্কে মানুষের ইলম নেই বরং এই ইলম মানুষের রব আল্লাহ তা’আলার কাছে , এই জন্য বান্দার উচিত অবস্থা ভাল না মন্দ সেই কথা চিন্তা না করে নিজের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য শুধু আল্লাহ তা’আলার আদেশ মান্য করার মধ্যে রাখা । এর ফলে যদি সমস্যার সৃষ্টি হয় তবু অবিচল থাকা । কোন্ অবস্থার ফলাফল বান্দার জন্য সুখের কারণ এবং কোন্ অবস্থার ফলাফল বান্দার জন্য বালা-মুছিবত-চিন্তার কারণ যেহেতু এই বিষয়ে বান্দার ইলম নেই সেহেতু এই বিষয়ে বান্দা সন্দেহ করতেই পারে কিন্তু তাতে তো কোন সন্দেহ হবার কথা নয় যে, আল্লাহ তা’আলার আদেশের উপর আমল করার ফলাফল সর্বদাই খুশী, আনন্দ, কল্যাণ এবং তৃপ্তির হয় । যদিও কখনও কখনও মুশকিল হয়ে যায় (ফাওয়ায়েদ)।” মানুষের মস্তিষ্কও এমনটাই বলে যে, কোন কাজ করার বা না করার ভিত্তি কাজটি কঠিন নাকি সহজ তা নয় বরং কাজটি কতটুকু উপকারী এবং কতটুকু জরুরী তা দেখে নির্ণয় করতে হয় । কেউ কি তিক্ত ঔষধকে শুধুমাত্র তার তিক্ততার জন্য ছেড়ে দেয় ?

পরীক্ষার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়ার বাস্তবতা এবং প্রয়োজনীয়তাঃ
ইবলিশের শয়তান বাহিনী হউক মানুষের মধ্য থেকে বা জ্বীনদের মধ্য থেকে এদেরকে আল্লাহ তা’আলাই সৃষ্টি করেছেন, শক্তিও আল্লাহ তা’আলাই দিয়েছেন এবং আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছার কারণেই এরা ঈমানদ্বারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে । আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: ” وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نِبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الإِنسِ وَالْجِنِّ “, “এমনিভাবে আমি প্রত্যেক নবীর জন্যে শত্রু করেছি মানব শয়তান ও জ্বিন শয়তানকে।” ” يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا “, “তারা ধোঁকা দেয়ার জন্যে একে অপরকে কারুকার্যখচিত কথাবার্তা শিক্ষা দেয়।” ” وَلَوْ شَاء رَبُّكَ مَا فَعَلُوهُ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُونَ “, “যদি আপনার পালনকর্তা চাইতেন, তবে তারা এ (আম্বিয়াদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ এবং ফাসাদ) কাজ করত না। [সূরা আন’য়াম(৬):১১২]” যখন মুমিনদের বিচ্ছিন্নতা ও বস্তুগত দুর্বলতা তখন শত্রুদের শক্তি ও অগ্রগতি অবশ্যই দিলকে ব্যথিত করে । যদি আল্লাহ তা’আলা চান তবে কাফেরের এই শান-শওকত এক সেকেন্ডে হিরো থেকে জিরো হয়ে যাবে । আর যদি মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ একবার كُنْ (কুন্ তথা হও) বলেন তবে তাদের মস্তিষ্ক ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পঙ্গু হয়ে যাবে তখন সমস্ত রিসোর্স এবং প্রযুক্তি ছেড়ে দিতে হবে । আল্লাহর জন্য এটা কোন মুশকিলই না । আল্লাহ তা’আলা তো সমস্ত কিছুর উপর ক্ষমতাবান । আল্লাহ তা’আলা সংকোচনকারীও আবার সম্প্রসারণকারীও । শক্তি ও ক্ষমতা হ্রাসকারীও আল্লাহ তা’আলা আবার এ সমস্ত কিছুর দাতাও আল্লাহ তা’আলা । কুফরকে যেহেতু এই শক্তি ও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাহলে এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈমানদ্বারদের ঈমানকে পরীক্ষা করা কেননা শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করাও আল্লাহ তা’আলার ইবাদত এবং ঈমানদ্বারগণ দৈর্য ধারণ করে নাকি অদৈর্য হয়ে এই কাফেরদের সামনে মাথা নত করে যারা কিনা নিজেরাও আল্লাহ তা’আলার মাখলুক এবং আল্লাহ তা’আলার মর্জির সামনে অসহায় । ” وَجَعَلْنَا بَعْضَكُمْ لِبَعْضٍ فِتْنَةً أَتَصْبِرُونَ وَكَانَ رَبُّكَ بَصِيرًا “, “আমি তোমাদের এককে অপরের জন্যে পরীক্ষাস্বরূপ করেছি। দেখি, তোমরা সবর কর কিনা। আপনার পালনকর্তা সব কিছু দেখেন। [সূরা ফুরকান(২৫):২০]” ” وَلَوْ يَشَاء اللَّهُ لَانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ “, “আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি (তোমাদেরকে এই আদেশ এই জন্য দিয়েছেন যাতে) তোমাদের কতককে কতকের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। [সূরা মুহাম্মাদ(৪৭):৪]” । তাই ঈমানদ্বারগণ এই বাহিনীগুলোকে দেখে না পেরেশান হন আর না আতঙ্কিত হন । জানা কথা এই যে, এদের মূল শিকড় আল্লাহ তা’আলার কাছে । আল্লাহ তা’আলা এদেরকে ঢিল দেন তো এরা ঈমানদ্বারদের উপর আক্রমণ করে এবং জুলুম-নির্যাতন করে । কিন্তু যদি ঈমানদ্বারগণ আল্লাহ তা’আলার আদেশসমূহ পালন করে, ইদাদ-ক্বিতাল এর ফরজিয়াত আদায় করে, কুরবানি করে এবং বালা-মুছিবত থাকা সত্ত্বেও দৃঢ়পদ থাকে তবে আল্লাহ তা’আলা কাফেরদেরকে কোণঠাসা করে দেন । এই যুদ্ধ-বিগ্রহ, বালা-মুছিবত মুমিনদেরকে আল্লাহ তা’আলার নিকটবর্তী করে । মুমিনগণ বুঝতে সক্ষম হয় যে, সমস্ত কিছু আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকেই হয় । তাই মুমিনগণ শুধুমাত্র আল্লাহ তা’আলার উপরই ভরসা করে এবং আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য ও মহব্বতের মধ্যে পানাহ খোঁজেন । মুমিনগণ জানেন যে, এই চুল্লি কখনও শীতল হয় না । কখনও এই আকারে আবার কখনও অন্য আকারে গরম থাকে অর্থাৎ মুমিনের ঈমান পরীক্ষা করার চুল্লি সর্বদাই উত্তপ্ত থাকে । ঈমানদ্বারগণ এর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে সত্য ও আনুগত্যের পাহাড় হন । এর মাধ্যমে ঈমানদ্বারগণের তরবিয়ত হয়, ঈমান বাড়ে এবং সর্বশেষ আল্লাহ তা’আলার চিরস্থায়ী জান্নাতসমূহ পেয়ে যায় । অর্থাৎ এই ঈমানী পরীক্ষাই মুমিনকে সংশোধন করে, শক্তিশালী করে, আল্লাহ তা’আলার নিকটবর্তী করে এবং মহব্বত বৃদ্ধি করে । আর যাদের সম্পর্ক এই নিকৃষ্ট দুনিয়ার সাথে, তাদের এখলাছ যখন ঈমানী পরীক্ষার কষ্টি পাথরের সংস্পর্শে আসে তখন তাদের আসল চেহারা বেড়িয়ে আসে । শহীদ সাইয়্যিদ ক্বুতুব রহ. ঈমানদ্বারগণের জন্য ঈমানী পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করতে বলেল: “মানুষকে ঈমানী পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা খুবই জরুরী । হক্বের পক্ষে সংগ্রামকারীগণকে আল্লাহ তা’আলা বিপদ-আপদের পরীক্ষায় নিক্ষেপ করে, বালা-মুছিবত ও ক্ষুধার যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করিয়ে, জান-মালের ক্ষতি দিয়ে তাদের দৃঢ় অন্তরগুলোর পরীক্ষা নেন । ” وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوفْ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الأَمَوَالِ وَالأنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ “, “এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। [সূরা বাকারা(২):১৫৫]” ঈমানী পরীক্ষা খুবই জরুরী যাতে ঈমানদ্বারগণ নিজেদের আকীদাহর মূল্য বুঝতে পারেন, কেননা এটাই বাস্তব যে, যারা নিজেদের আকীদাহর কারণে যত বেশি বালা-মুছিবতের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে তাদের আকীদাহ তাদের কাছে তত বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে । নয়তো ঐ আক্বীদাহ তো অনেক দুর্বল বলে প্রমাণিত হবে যার জন্য বালা-মুছিবতের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা হয়নি । কোন একটি মুছিবত আসার শুরুতেই নিজের আক্বীদাহকে দূরে নিক্ষেপ করে দেয় । সুতরাং ঈমানী পরীক্ষার এই বুনিয়াদী মূল্য যা অন্যের কাছে প্রকাশ করার আগে নিজের মালিকের অন্তরের মধ্যে ঈমানের মূল্য অনুভব করায় । অন্য লোকদের কাছে ঈমানের মূল্য শুধুমাত্র তখনই প্রকাশ পায় যখন ঈমানদ্বার নিজের ঈমান-আক্বীদাকে বাঁচানো জন্যে বালা-মুছিবতের জ্বলন্ত চুল্লির মধ্যে প্রবেশ করানোর পরও দৃঢ়পদ থাকেন । এরপর পরীক্ষা নিজেই ঈমানদ্বারকে পরিশুদ্ধ করে এবং ঈমানদ্বারের মাঝে ঐ সকল লুকায়িত শক্তিসমূহকে স্থান দেয় যেগুলো ঈমানী পরীক্ষার আগে কেউ ধারণাও করতে পারে না । এভাবে ঈমানদ্বারগণের অন্তরগুলোতে (খায়ের ও মারেফত এর) ঐ নতুন চক্ষু শুধুমাত্র তখনই ফোটে যখন হক্ব রাস্তায় তাদের অন্তরগুলোর উপর ভারী হাতুড়ির আঘাত লাগে । এমনিভাবে আরো একটি হাক্বীকত এটাও যে, কোন এক মুমিনের অন্তরে ইসলামী মূল্যবোধ এবং এর বুনিয়াদী চিন্তা-ধারণা ততক্ষণ পর্যন্ত সহিহ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ঈমানী পরীক্ষার মোকাবিলা করবে । এই ঈমানী পরীক্ষাই ঈমানদ্বারগণের চোখের মরীচিকা দূর করে এবং অন্তর থেকে ঝং দূর করে । এরপর সবচেয়ে বেশি জরুরী কথা হল এই যে, পরীক্ষার সময় অন্য কারো উপর ভরসা থাকে না শুধুমাত্র আল্লাহ তা’আলার উপরই ভরসা থাকে, সমস্ত আজে-বাজে বিভ্রম এবং (গাইরুল্লাহর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত) আশাগুলো নিমিষেই অকার্যকর হয়ে যায় এবং দিল শুধুমাত্র এক আল্লাহর দিকে অভিমুখী হয় যেখানে শুধু আল্লাহর রহমতের ছায়া ছাড়া আর অন্য কোন ছায়া নেই । এটা তখন হয় যখন সমস্ত পর্দা জ্বলে সরে যায়, অন্তর্দৃষ্টি সঠিক ভাবে অসংখ্য কাজ করতে সক্ষম হয়, মহাশূন্যের শেষ প্রান্ত পর্যন্তও কাজ করে এবং আল্লাহকে ছাড়া আর কেউ নজরে আসে না, আল্লাহর ক্ষমতা ছাড়া আর কারো ক্ষমতা নজরে আসে না, আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইচ্ছা নজরে আসে না, আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে আশ্রয় নেই……. আল্লাহ তা’আলা ঈমানী পরীক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছেন এই জন্য যে, যাতে অন্যদের থেকে মুজাহিদগণকে নির্বাচন করে আলাদা করা যায়, যাতে তাদের অবস্থা প্রকাশ করে স্পষ্ট হওয়া যায়, যাতে আহলে ঈমান এবং আহলে নিফাকের কাতারগুলির মাঝে জগাখিচুড়ী না থাকে, যাতে মুনাফিকরা নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখতে না পারে আর যাতে ঐ সকল দুর্বল ঈমানদ্বার ও অজ্ঞ লোকেরাও নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখতে না পারে যারা ঈমানের রাস্তায় বালা-মুছিবত আসতেই আর্তনাদ ও চিৎকার শুরু করে দেয় ।”

শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড এবং পছন্দসই আমলঃ
হাদিস অনুসারে সন্ন্যাসী যুবককে নিজের থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করেছিলেন এবং বলেছিলেন: “أَيْ بُنَيَّ أَنْتَ اليوم أفضل مني”,”হে আমার ছেলে ! তুমি তো এখনই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে গিয়েছ ।” যুবক বয়সের দিক থেকেও সন্ন্যাসীর থেকে ছোট ছিল এবং ঈমানের দিক থেকেও নতুন ছিল । তারপরও যুবক শ্রেষ্ঠ কিভাবে হল ? শাইখ আবূ ক্বাতাদাহ রহ. বলেন যে, এত্তেবা তথা অনুসরণ, এতায়াত তথা আনুগত্য, ইবাদত তথা দাসত্ব ও মুজাহাদা তথা কষ্ট-পরিশ্রমের মাধ্যমেই আল্লাহর অভিভাবকত্ব পাওয়া যায় কিন্তু এর মধ্যে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নির্বাচন করার দখল রয়েছে । আল্লাহর এই নির্বাচন কোন কারণ ছাড়া হয় না বরং অবশ্যই এর কোন কারণ রয়েছে । তারপর বলেছেন যে, এটা দিলের সাথে সম্পর্কিত এবং আল্লাহ তা’আলা দিলসমূহকে পর্যবেক্ষণ করে তার ওলীগণকে নির্বাচন করেন । অর্থাৎ যদি দিল বেশি পবিত্র হয়, যদি দিল আল্লাহর মহব্বতে পূ্র্ণ থাকে, যদি দিলের মধ্যে ঈমানদ্বারগণের জন্য মহব্বত থাকে আর কুফ্ফারদের জন্য শত্রুতা থাকে, যদি দিলের মধ্যে হক্বকে সাহায্য-সহযোগিতা করার সাহস ও ইচ্ছা থাকে থাকে এবং যদি দিলের মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবান হওয়ার প্রচণ্ড উন্মাদনা থাকে ; তবে এগুলো সেই গুণাবলী যা আল্লাহ তা’আলার প্রিয় বান্দাদের মাঝে থাকে এবং এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার কাছে শ্রেষ্ঠত্ব বৃদ্ধি পায় । সন্ন্যাসী যুবককে নিজের থেকে শ্রেষ্ঠ বললেন এর একটি কারণ এটাও যে, যুবক তো দ্বীনকে সাহায্য করার জন্য দুর্দান্ত সাহস আর কোন ভয় ছাড়া ময়দানে নেমে ছিলেন যখন কিনা সন্ন্যাসী নিজের জন্য নির্জনে বসে ইবাদত করাকে নির্বাচন করেছিলেন । তারপরও সন্ন্যাসী তার এই গোপনে থাকা এবং বিপদ-আপদের মোকাবিলা না করাকে নিজের বুদ্ধিমত্তা বলে প্রকাশ করতেন না, দ্বীন সম্পর্কে তার এই সহিহ বুঝ ছিল যে তা দাওয়াতে দ্বীন ও দুনিয়া, বাতিলের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং এই রাস্তায় বালা-মুছিবত সহ্য করাকে সবচেয়ে মহান ও সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন, কিন্তু নিজের মানবীয় দুর্বলতার কারণে বাতিলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে লড়াই করা হয়নি । এমনিভাবে এটাও এক অসাধরণ কথা যে, সন্ন্যাসীর মনে হয়েছে যে যুবকের উপর ঈমানী পরীক্ষা আসবে। তিনি জানতেন যে, হক্বের সাহায্যের সাথে পরীক্ষা অবশ্যই আসে । কিন্তু এরপরও তিনি যুবককে দ্বীনের দাওয়াত থেকে নিষেধ করেননি, তিনি এটা বলেননি যে, তোমার কারণে আমার কাছেও বালা-মুছিবত আসতে পারে, এই জন্য তুমিও এই কাজ ছেড়ে দাও । না, তিনি এমনটি বলেননি । দ্বীনের যে খেদমত এবং নসরত নিজে করতে পারেননি তা থেকে তিনি যুবককেও বাঁধা দেননি এবং যুবকের মনোবল ভাঙ্গে দেননি । বেশির চেয়ে বেশি সন্ন্যাসী একটি আবেদন করেছিলেন আর তা এই ছিল যে, বাদশাহর নির্যাতনের সময় যেন যুবক সন্ন্যাসীর নাম না নেয় । এরপর আরও সূক্ষ্ম বিষয় এটি যে, সন্ন্যাসী যদিও পরীক্ষা থেকে বাঁচতে চেষ্টা করতেন, কিন্তু উনার চেষ্টা ও চাওয়ার বিপরীতে তাকেও সর্বশেষ পরীক্ষার সম্মুখিন হতে হয়েছিল । যুবককে গ্রেফতার করার পর নির্যাতনের কারণে যুবক সন্ন্যাসীর নাম প্রকাশ করে দিয়েছিল তো তখন সন্ন্যাসীকেও নির্যাতনখানার ভিতর যেতে হয়েছিল । তারপরও তিনি যুবককে ভাল-মন্দ কিছুই বলেননি এবং এমনও বলেননি যে, তোমার কারণে আমার উপরও কঠিন দিন আসল । না, তিনি এমন কিছুই বলতে পারেননি কেননা তিনি ঈমানের এই সবক জানতেন যে, ঈমানী পরীক্ষা থেকে পালানোর পরও রাহে হক্ব তথা সত্য পথে ঈমানী পরীক্ষা এসেই যায় আর তখন দৈর্য ধারণ করার ফলেই আল্লাহ তা’আলার কাছে স্থান এবং মর্যাদা পাওয়া যায় । বান্দাদের নির্বাচন সহজ-সরল হয় এবং নিজেদের মানবীয় দুর্বলতার কারণে যথাসম্ভব ঈমানী পরীক্ষা থেকে বাঁচার চেষ্টা করে কিন্তু যদি আল্লাহ তা’আলা ঈমানী পরীক্ষা দেন তবে আল্লাহ তা’আলার সিদ্ধান্তের উপর সন্তুষ্ট থাকার মধ্যেই মঙ্গল রয়েছে (১)। সন্ন্যাসীও এটাই বলেছেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার হক্বের মধ্যে তার পরিকল্পনার চেয়ে আল্লাহর পরিকল্পনা উত্তম । যুবক যখন আল্লাহ তা’আলার সিদ্ধান্তের উপর সন্তুষ্ট হয়েছে তখন আল্লাহ তা’আলা তাকে শাহাদাতের মরতবা দিয়ে সমুন্নত করেছেন।

টীকা – ১.“এখানে একটি বিষয় ভালোভাবে বুঝে নেওয়া জরুরী। তা হলো: ইকরাহ তথা জোরপূর্বক বাধ্যকরণের কারণে কালিমায়ে কুফর তথা কুফুরী বাক্য উচ্চারণ করার অবকাশও আছে বলা হয়েছে। কিন্তু ইকরাহের কারণে কালিমায়ে কুফর বলা এক বিষয়, আর বাতিলের ভয়ের কারণে নিজের দ্বীন পরিত্যাগ করা, হক্বের বিরুদ্ধে কাতারবন্দী হওয়া এবং আহলে বাতিলকে তথা তাগুতকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা; সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়, যাকে কোন আলেম-ই সঠিক বলেন নি।”

(চলবে, ইংশাআল্লাহ)

সূত্র: নাওয়ায়ে গাজওয়ায়ে হিন্দ ম্যাগাজিন থেকে অনূদিত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight − seven =

Back to top button