প্রবন্ধ-নিবন্ধশাইখ আদম ইয়াহইয়া গাদান রহিমাহুল্লাহ

কে ছিলেন আদাম ইয়াহইয়া গাদান (রহিমাহুল্লাহ)?

আদাম ইয়াহইয়া গাদান,

দাদারা খ্রিষ্টান, নানারা ইয়াহুদী। ছোট কালেই দেখতেন তার বাবা একধরণের মিক্সড ধর্ম পালন করতেন। একবার দেখেছেন রমজানে রোজা রাখার চেষ্টা করছেন। ঘরে সব ধর্মের বই-ই ছিল। তার পরিবার, টিপক্যাল আমরিকান পরিবার থেকে একটু অন্যধরণের ছিল। তারা থাকতেন শহর ছেড়ে অনেক দূরে একটি গ্রামে। তার বাবা বিশ্বাস করত যে স্কুলে কোন পড়া-লেখা হয় না, তাই তাদের ভাই-বোন কাউকেই স্কুলে পাঠান নি। ঘরে বাবা-মা দু’জনে মিলে তাদের পড়াশুনা করিয়েছেন।

একবার নানার বাড়ি গিয়ে ইসলাম সম্পর্কে কিছুটা জেনে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। বাসায় কোথায় যেন একটা কুরআন ছিল। একদিন বাবাকে বললেন যে, কুরআনটা তিনি একটু পড়বেন। তো তার বাবা একটা বুক শেলফের উপর থেকে কুরআনটি নামিয়ে ধুল ঝেড়ে তাকে দিলেন। তিনি কুরআনের ইংরেজী অনুবাদ পড়তে থাকলেন। কিছুদিন পর বাবাক বললেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করতে চাই। তার বাবা কোন বাধা দিলেন না। ৮০ ‘র দশকের একেবারে শেষ দিকের ঘটনা, কিশোর আদাম ইয়াহইয়া গাদান শুধু কুরআনের ইংরেজী অনুবাদ পড়েই ইসলাম গ্রহণ করলেন।

কৈশরের শেষে তিনি এক জায়গায় কাজ পেলেন। কাজের জন্য তিনি পরিবার ছেড়ে অন্য জায়গায় আসতে হল। তার বস একজন মুসলিম ছিল। এভাবেই দিন যাচ্ছিল। তিনি বিভিন্ন ধরণের মুসলিম গ্রুপের সাথে পরিচিত হওয়া শুরু করলেন। প্রায় প্রত্যেক গ্রুপেরই নিজ নিজ মসজিদ ছিল। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা আয়োজন করত। তিনি সবার কথাই শুনতেন। তিনি চেষ্টা করতেন সবার সাথেই যোগযোগ রাখতে।

একদিন কি হল, তিনি অফিসে কোন একটা কাজে ভুল করে ফেলেন। তার বসের এবং তার সেই ভুলের কারণে মন খারাপ হয়ে যায়। তখন তার সেই বস তাকে সান্তনা দিতে গিয়ে বলেন, দেখো এই দুনিয়া তো অনেক গুরুত্বহীন, এই গুরুত্বহীন কাজে এত মন খারাপ করলে কেমনে হবে? মুসলিমদের এসব ছোট-খাটো বিষয়ে মন খারাপ করা উচিত না। দেখো তুমিও হয়ত একদিন জিহাদ করবে, শহীদ হবে। কথাগুলো তার কাছে একটু অন্য রকম মনে হল। এভাবে কখনো কেউ কথা বলে নি। তিনি নিজেও কখনো জিহাদ করে শহীদ হবার কথা চিন্তাও করেন নি। কিন্তু তিনি কেন হঠাৎ তাকে এই কথা বললেন, এবং সেই কথা তার কানেই বারবার বাজছিল, কেন এমন হচ্ছিল তিনি বুঝতে পারছিলেন না। তিনি অতৃপ্তিতে দিন পার করতে লাগলেন।

একদিন শুনলেন যে আফগানে তালিবান নামক একটি দল ক্ষমতা দখল করে ইসলামি ইমারাত ঘোষণা করেছে। আমরিকান মুসলিম কমিউনিটিগুলো এ নিয়ে মুখোরোচক গল্পে মশগুল। নানান জনের মুখে নানান কথা। একদিন একভাইকে দেখলেন, তিনি নাকি আফগান থেকে এসেছেন। সকলকে খুব গর্ব করে আফগানের কাহিনীগুলো শুনাচ্ছিলেন। তিনি ধীরে ধীরে তার সাথে বন্ধুত্ব পাতালেন। একদিন সেই আফগান ফেরত ভাইটি তাকে কিছু ভিডিও দেখালেন, বললেন যারা যেতে চায়, তাদের জন্য তিনি ব্যবস্থা করতে পারবেন। তো তিনি রাজি হয়ে গেলে।

ভিসার জন্য শেইভ করে ছবি তুললেন। তার ফ্রেন্ড সার্কেল তো আবাক! “কিরে আদম তুই দাড়ি কেঁটে ফেলছিস? আর কয়দিনই বা হুজুর হয়ে থাকতে পারবি!” এত কিছু শোনার টাইম নাই তার। কাউকে না জানিয়ে একেবারে পাকিস্তান চলে এলেন সেই আফগান ফেরত ভাইয়ের সাথে। সেখানে অনেক ঝামেলা পেরিয়ে আফগানিস্তান। এমনিতেই তিনি ক্লান্ত, তার উপর কারো সেই দিকে কোন খেয়াল নেই, সোজা তাকে ট্রেনিং ক্যাম্পের দিকে পাঠিয়ে দেয়া হল। তিনি এখন কাউকে বলতেও পারছেন না যে তিনি জাস্ট দেখার জন্য এসেছেন, ট্রেনিং নেয়ার জন্য না। কিন্তু এক ট্রেনিং ক্যাম্পে টিকতে পারছেন না দেখে, তারা তাকে অন্য ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু তার অবস্থা ক্রমশই খারাপ হতে লাগল।

পাকিস্তান থেকে আফগানে আসার পথে কিছু ভাইয়ের সাথে তার পরিচয় করে দিয়েছিল আফগান ফেরত সেই ভাইটি। তাদের একজনকে পেয়ে গেলেন। তিনি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। কিছুটা সুস্থ হবার পর তিনি আমরিকা ফেরত যাবার জন্য রওনা হলেন। পথে সেই পরিচিত ভাইটির সাথে দেখা। “আরে আদাম, কই যাচ্ছ? চলে যাচ্ছ বুঝি? কষ্ট তো আসবেই, কিন্তু এত বড় সুযোগ ক’জনকেই বা আল্লাহ তা’আলা দেন?” তিনি কিছু নসীহাহ করলেন। কিন্তু তিনি আমরিকা ফেরত চলে আসলেন।

তো তার পরিবার বন্ধু-বান্ধাব অবাক! “এতদিন পর কোথা থেকে উদয় হলি? কোন খোঁজ-খবর নাই।” তিনি এইসেই বলে এড়িয়ে গেলেন। তো দিন যাচ্ছে, তার আর আমরিকা ভাল লাগছে না। এবার তিনি একেবারে নিয়াত করে ফেললেন। মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলেন, এবং যাবার জন্য সব কিছু গুছিয়ে নিলেন। একদিন হঠাৎ করে আবারো কাউকে না জানিয়ে স্বপ্নের ভূমি খুরাসান রওনা হয়ে গেলেন।

এই কয়দিনে তালিবানরা যথেষ্ঠ বিতর্কিত হয়ে গিয়েছে বিশ্বব্যাপী। বাস্তবেই শরীয়াহ আইন প্রয়োগের কারণে বিশ্বব্যাপী তাদের ব্যাপক সমালোচনা চলছে। খোদ মুসলিমরাই তাদের সমালোচনা করছে। এযুগে কি আর শরীয়াহ আইন প্রয়োগ চলে? শরীয়াহ আইন তো থাকবে জাস্ট সংবিধানে, নাম মাত্র। এগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করা তো বর্বরতা। এই আগুনে ঘি ঢেলে দিল, যখন শাইখ উসামা আর তার দলকে আফগানে আশ্রয় দেয়া হল। বিশ্বব্যাপী আফগানের ইসলামী ইমারাত মুলিমদের কাছে কঠোর শরীয়াহ আইনের বাড়াবাড়ির দেশ আর কাফিরদের কাছে বর্বর শরীয়াহ আইন এবং আমরিকা বিরোধী সন্ত্রাসী উসামার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত হতে লাগল।

তো আদাম ইয়াহিয়া গাদান, মোটামুটি ট্রেনিং নিলেন। বিদেশিদের মূলত আল-ক্বায়িদাই ট্রেইন করতো। তো তাকেও আল-ক্বায়িদার সাথেই পাঠিয়ে দেয়া হল। তো একদিন তালিবানদের ম্যাগাজিন আল-ইমারাহ প্রুফ রিডিং এর কাজ আসল। তিনি তো সেই ইংরেজি দেখে তাজ্জব। বরং তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নিজেই আবার অনুবাদ করবেন। তো তাকে সেই আল-ইমারাহ ম্যাগাজিনের কাছে একটি পত্রিকা অফিসে নিয়োগ দেয়া হল। তিনি বলেন সেই অনুবাদের কাজ করতে গিয়ে তার আরবী আরো মজবুত হয়েছিল।

একদিন দেখলেন সবাই খুব প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। তিনি তার এক সাথী তালিবানকে জিজ্ঞেস করলেন,

“এত প্রস্তুতি কিসের?”

সেই তালিবানটি বলল,

“ড. আইমান আয-যাওয়াহিরী আসছেন আজকে।”

“তিনি কে?”

“তুমি ড. আয-যাওয়াহিরীকে চেনো না? তিনি মিশরী জিহাদী দলেন নেতা।”

এভাবে একে একে তিনি অনেক নেতাদের সামনা-সামনি দেখলেন। তাদের ইতিহাস, পরিচিতি জানা শুরু করলেন। শাইখ উসামার একটা শর্ট ভিডিও আছে যেখানে তিনি বসে গুলি করছেন। সেইখানে আশেপাশে উৎসুক লোকগুলোর মধ্যে তিনি আদাম ইয়াহিয়া গাদানও একজন ছিলেন। সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ মূহুর্ত ছিল আমীরুল মু’মিনীন মোল্লা মুহাম্মাদ উমারকে প্রথমবার সামনাসামনি দেখা। তিনি প্রথমে তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে পারেন নি।

আদাম ইয়াহিয়া গাদান, শাইখুল মুজাহিদ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযাম (রহ) -এর খুব ভক্ত বনে যান। এবং তিনি আযযাম আল-আম্রিকি নামে লেখা-লেখি শুরু করেন। শাইখ যাওয়াহিরী একবার তার লেখা পড়েন, তার কাছে খুব ভালো লাগে। তিনি তাকে ইংরেজিতে ভিডিও বানানোর নির্দেশ দেন। তিনি ভিডিও বানিয়ে শাইখ যাওয়াহিরীকে দেখান। তো শাইখ তাকে বিভিন্ন জিনিস ঠিক করতে বলেন, নসীহা দেন কিছু ব্যাপারে, ভিডিও ব্যাপারে কিছু দিক নির্দেশনা ইত্যাদি দেন। এভাবে তিনি কিছু নসীহাহ, আহবান, পশ্চিমাদের ব্যাপারে কিছু ভিডিও তৈরী করেন। মিডিয়ার কাজের ক্ষেত্রে যে দুই ব্যাক্তির অবাদান অনেক বড় ছিলো তাদের একজন হলেন ,আজ্জাম আল আম্রিকি এবং সামীর খান রাহিমাহুল্লাহ । অ্যামেরিকা যখন দেখল , একজন সাদা চামড়ার কেও আমেরিকান উচ্চারনে তাদেরকেই হুমকি দিচ্ছে , তখন তাদের কি অবস্থা হয়েছিল একটু কল্পনা করুন ।

এর মধ্যে ৯/১১ এর ঘটনা ঘটল। এতদিন আমরিকা মাঝে মধ্যে ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালাচ্ছিল আরব সাগরে তাদের নৌবহর থেকে। এবার সরাসরি ল্যান্ড ইনভেইনশনের ঘোষণা দিল। আরবের দোশগুলোতে বিমান ঘাটি বসানো হল। পাকিস্তানের করাচী বন্দরে আমরিকার সেনাদের নিয়ে বড় বড় নেভাল শীপগুলো আসা শুরু করল। পাকিস্তান সরকার, সেনাবাহিনী, এবং আইএসআই এর প্রবল নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে কথিত সুপার পাওয়ার আমরিকার সাহসী সৈন্যরা করাচী বন্দর থেকে লজিস্টিক সাপোর্টের বহর নিয়ে আফগান যাত্রা শুরু করল। এরই মধ্যে, কাতার, সৌদি, আমিরাত, কুয়েত এইসব দেশ থেকে আমরিকার জঙ্গী বিমানগুলো এসে কাবুলে এয়ার স্ট্রাইক শুরু করে দিয়েছে।

একদিনের ঘটনা, আদাম ইয়াহিয়া গাদান ওরফে আযযাম আল-আম্রিকি তার পত্রিকা অফিসে সকালে ঘুমিয়ে যান। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখেন, মোল্লা উমার সহ, আরো কয়েকজন হাই প্রোফাইল জিহাদী নেতা সেই অফিসের একটি রুমে মিটিং করছেন। সেই অফিসের এক কর্মচারী কোন কারণে টেলিফোন উঠায়, হঠাৎ মোল্লা উমার তার হাত ধরে ফেলে বলেন, “তুমি কি চাও আমাদের সবার উপর আমরিকা বোমা বর্ষণ করুক।” তিনি সেখান থেকে আরেক জায়গায় রওনা দিলেন; কিছু ঘন্টা পরে শুনেন যে, তাদের পত্রিকা অফিসে এয়ার স্ট্রাইক হয়েছে। তার শিড়দাঁড় অজানা আতঙ্কে ঠান্ডা হয়ে গেল। তিনি যেই শাইখের কাছ থেকে খবরটা শুনেছিলেন, তিনি তাকে বলেন, “তোমার ভয় পাওয়ার কারণটা আমি বুঝেছি।আলহামদুলিল্লাহ… তাদের কোন ক্ষতি হয় নি।” এই কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরিকা যদি জানত কয়েক মূহুর্তের ব্যবধানে আমরিকা তার এত বড় বড় শত্রুদের মিস করে ফেলছে, আমরিকানরা বোধহয় রাগে তাদের চুল ছিড়ে ফেলত।

তিনি আরো অনেকের সাথে পরে পাক-আফগান বর্ডারে চলে আসেন। সেখানে কিছু দিন, এরপর পাকিস্তান। সেখানে তাদের অনেক কষ্টকর সময় পাড়ি দিতে হয়েছে। কতজনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনিও কয়েকবার পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে পড়েও আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।

এভাবেই চলে আসছে। ২০১৫ সালে আযযাম আল-আম্রিকিকে একটি ড্রোন হামলার মাধ্যমে আমরিকানরা হত্যা করতে সফল হয়। রহিমাহুল্লাহ! এই ড্রোনও সম্ভবত ইসলামের তথাকথিত খেদমতকারী আরবের অথবা পাকিস্তানের কোন এয়ার বেইস থেকে উড়ে এসেছিল। এবং এজন্যই পরকার সত্য, এজন্যই জান্নাত-জাহান্নাম সত্য। এজন্যই নবীজী (সা) বলেন, দুনিয়াতে যে যার সাথে থাকবে, পরকালেও সে তার সাথে থাকবে। এজন্যই আমাদের কালিমা লা~ ইলাহা ইল্লাল্লাহ। কারণ আল্লাহ তা’আলা দেখে নিতে চান যে কারা আসলে এই কালিমার সাথে সৎ, এবং কারা এর হক্ব আদায় করতে জান-মা কুরবান করে। আল্লাহ তা’আলা আদাম ইয়াহিয়া গাদানের শাহাদাত কবুল করুক। এবং তার হত্যাকারী, তাদের সহায়তাকারীদের দুনিয়াতেই লাঞ্ছিত করুক, যদি না তারা ফিরে আসে সিরাতুল মুস্তাকিমে…

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 − 6 =

Back to top button