নির্বাচিতপ্রবন্ধ-নিবন্ধ

মর্মস্পর্শী || আমি মগ দেখি নি, আমি শাহ পুরি দ্বীপের মাঝি দেখেছি।

এই সফরনামাটি লিখেছেন ভাই আব্দুল্লাহিল বাকি, পাঠকদের জন্য আমরা তাঁর ফেসবুক ওয়াল থেকে কাটছাঁট ব্যতিত পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা ভাইকে নিরাপদ রাখুন। আমিন।

  • নির্বাহী এডমিন

১৩/৯/১৭
প্রথমে টেকনাফের একজন বয়োবৃদ্ধ শায়খুল হাদীস আমাদেরকে জানালেন মায়ানমার সীমান্তে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আটকে পরেছে যারা টাকার অভাবে বাংলাদেশে আসতে পারছে না। উনি আরও বললেন, যারা বাংলাদেশে চলে এসেছে তারা কেউ না খেয়ে মরে যাবে না ইনশাল্লাহ। কিন্তু ওপারে যারা টাকার অভাবে আসতে পারছে না তারা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে আছে। কারণ সেখানে তাদের কোন খাবার নেই, নেই কোন আশ্রয়। আপনারা যদি সত্যি আল্লাহু সুবহানুহু তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য কিছু করতে চান তবে এই অসহায় মানুষগুলোকে উদ্ধার করুণ।

১৪/৯/১৭
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়া কিছু ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে মায়ানমার সীমান্তে নাক্ষংদিয়া দ্বীপে হাযার হাযার নারী, শিশু আটকে পরে আছে। তারা বাচার জন্য মুসলিম উম্মাহর কাছে কাকুতি মিনতি জানাচ্ছে। কিন্তু কোন মাঝি তাদের পার করছে না। কারণ তাদের পকেটে একটি কানাকড়িও নেও। আহ! কি নির্দয় এই মাঝিগুলো! কি পাষাণ এদের হৃদয় গুলো! যায় হোক আমরা কয় জন আল্লাহর নগণ্য বান্দা আল্লাহর উপর ভরসা করে সীদ্ধান্ত নিলাম, এই অধম বান্দাগুলো জীবিত থাকতে কাউকে টাকার অভাবে ওপাড়ে মরতে দেওয়া হবে না ইনশাল্লাহ।

১৫/৯/১৭
আমাদের চার জনের একটি টিম পৌঁছে গেল শাহ পুরি দ্বীপে। মিশিনঃ নাক্ষংদিয়া, মায়ানমার।

কথা হল স্থানীয় মানুষগুলোর সাথে। জানতে চাইলাম মাঝিদের নাম পরিচয় এবং ঠিকানা। কথা বলতে বলতে একজনের থেকে পেয়েও গেলাম স্থানীয় এক মাঝির নাম ও ঠিকানা। তার নাম নুরুল কবীর, ঠিকানা শাহ পরি দ্বীপের মাঝপাড়া। ছূটে চলল আমাদের টিম মাঝপাড়ার উদ্দেশ্যে। সিএনজি ড্রাইভার দেখিয়ে দিলেন আমাদের কবীর মাঝির বাড়ি। ড্রাইভারই আমাদেরকে দেখয়ে দিল নূরুল কবীরকে। ষাটোর্ধ একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ। আপাদমস্তক সুন্নতি বেশ ভুষা। কথা বার্তায় শুধু আল্লাহ্‌ রাসুলের নাম। তিনি জানালেন বিগত দিনগুলো তে তিনি কিভাবে রোহিঙ্গাদের সাহায্য সহযোগীতা করেছেন। বললেন তিনি নিজের নৌকায় করে তাদেরকে এনেছেন, নিজের বাড়িতে রেখে তাদেরকে খাওয়াইছেন। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম কবীর চাচাকে পেয়ে। আল্লাহই যেন আমাদের মিলিয়ে দিল সবকিছু।

কবীর চাচার সঙ্গে দরকষাকষি হল, প্রতি নৌকা ২২ হাযার টাকা এবং প্রতি নৌকায় পনের জন করে প্রাপ্ত বয়স্ক নারী এবং পুরুষ আসতে পারবে। সাথে ছোট বাচ্চারা ফ্রী। আমরা কাল বিলম্ব না করে রাজি হয়ে গেলাম। নুরুল কবীরের চারটি নৌকা যাবে আজকেই নাক্ষংদিয়ার উদ্দেশ্যে। কথা হল মাঝিদের সাথেও। তারা বিভিন্ন কারগুজারি শুনালেন, জানালেন কিভাবে মজলুম রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সময় তারা জীবন বাচিয়েছেন। আমরাও আবেগ আপ্লুত হয়ে গেলাম তাদের কথা শুনে। আমরা প্রতিনিয়ত আল্লাহু সুবহানাহু তায়ালাকে স্বরণ করছি এবং তার সাহায্য কামনা করছি।

নুরুল কবীর আমাদের জন্য চা নাস্তার ব্যবস্থা করলেন। চা খেতেই খেতেই আমরা কবিরের মাঝিদের জিজ্ঞাস করলাম, ওই পাড়ে কি নাসাকা বাহিনী থাকে না? সে জানালো, নাসাকারা একটু দূরে থাকে। তবে তারা পলায়নপর রোহিঙ্গাদের কিছু বলে না। আমি বললাম, সেখানে রিস্ক কেমন? তারা জানলো কোন রিস্ক নাই। তৎক্ষণাৎ আমাদের একজন ভাই বলে উঠলেন, তাহলে কি আমরা আপনাদের সাথে যেতে পারব? তারাও আগ পিছ কোন কিছু না ভেবেই উত্তর দিল, হ্যা পারবেন!

বল এখন আমাদের কোর্টে। তাহলে কি আমরা ওপাড়ে চলে যাবো আমাদের মাজলুম ভাই বোনদের উদ্ধার করতে? নিজ হাতে ক্ষুধার্ত জীর্ণ শীর্ণ পরে থাকা নিথর দেহগুলো কোলে করে নৌকায় উঠানোর এই মওকা হাতছাড়া করা কি ঠিক হবে? বিশেষ করে সমগ্র প্রক্রিয়াটার স্বচ্ছতার জন্যও আমাদের যাওয়া জরুরী। আমাদের মধ্যে একটা আশংকা কাজ করছে, এমন হবে না তো আমাদের টাকায় মাজলুমরা না এসে টাকা ওয়ালারাই চলে আসল। অর্থাৎ মাঝিরা দুই দিক থেকেই টাকা খেল। কিন্তু আবার অন্য দিকগুলোও চিন্তা করতে হচ্ছে। অচেনা অজানা জায়গায় যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনা ঘটে যায়?
চিন্তা ভাবনা, তর্ক বিতর্ক ও ইস্তিখারা শেষে সীদ্ধান্ত হল আমাদের একজন ভাই যাবেন তাদের সঙ্গে। মাঝিরা যেন আকাশ থেকে পরলেন আমাদের সীদ্ধান্তে! কিন্তু আমাদের না নিয়ে তাদের এখন আর কোন উপাই নেই। আমাদের ভাইটি শার্ট প্যান্ট পরিবর্তন করে লুঙ্গি গ্যাঞ্জি পড়ে নিলেন। তাকে দেখতে যেন অবিকল মাঝির মতই লাগে। নৌকায় উঠার আগে দুই রাকাত সালাত আদায় করে আমাদের ভাইটি রওনা দিলেন। তখন বাজে দুপুর দুইটা ত্রিশ মিনিটের কাছাকাছি।

আমাদের নৌকা ওপাড়ে পৌঁছানোর পরেই মাঝিদের আসল চেহেরা বের হয়ে আসল। আমাদের সামনেই এই মাঝিরা রোহিঙ্গাদের মাল সামানা নিজেদের নৌকায় উঠালো। রোহিঙ্গারা কাকুতি মিনতি করছিলো মাঝিদের কাছে। বলছিলো ভাই আল্লাহর দোহায় লাগে এই গুলো আমাদের শেষ সম্বল, দীর্ঘ পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে আমরা অনেক কষ্টে এইগুলো নিয়ে এসেছি। কিন্তু এই মাঝিগুলো যে দেখতে মানুষের মত হলেও আসলে জন্তু জানুয়ার ছাড়া কিছুই নয়। কয়েকজন রোহিঙ্গা সাগরে মাছ ধরার অনেক দামী একটা জাল নিয়ে এসেছিল বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্য। জালটির দাম নাকি লক্ষ টাকার উপরে। এই কবীর মাঝির লোক গুলো সেটা নৌকায় উঠানোর চেষ্টা করছিলো। তবে ওরাও এবার জীবন মরণ সীদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। ওদের কথা আমরা মগদের যে জাল নিতে দেয় নি সে জাল আমরা জীবন থাকতে বাংলাদেশী মাঝিদের নিতে দেব না, এতে প্রাণ গেলেও যাক। এবার মাঝিরা কিছুটা পিছু হটল, আগে যা নৌকায় উঠায়েছিল তাই নিয়েই চলে আসল। আমরা অবাক হয়ে যাচ্ছি আমাদের সাথী ভাই নৌকাতে অবস্থান করার পরেও তাদের ডাকাতি করতে সামান্যতম কুণ্ঠা হল না। অন্য সময় কি করে একমাত্র আল্লাহই জানে।

ফেরার পথে আমাদের সাথী ভাইকে বিভিন্নভাবে তারা হেনস্তা করা শুরু করে। সাগরের মাঝে এনে ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। তারপর বড় বড় রামদা বের করে প্রসর্শন করা শুরু করল! জানি না অস্ত্র প্রদর্শনের পেছনে উদ্দেশ্য কি ছিল। যায় হোক তারা যে পেশাদার ডাকাত এই নিয়ে কোন সন্দেহ থাকল না।

(নুরুল কবীরের মাঝিদের ছবি আপলোড করা হল। তবে তাদের নাম জানা নেই)

১৬/৯/১৭
আমরা যখন দেখলাম শাহ পুরীর মাঝি নামক জলদস্যুদের সাথে আমরা পেরে উঠব না তখন আমরা কুতুপালং ক্যাম্পের অসহায় রোহিঙ্গাদের দিকে মনোযোগ দিলাম। কুতুপালং এর শেষ মাথায় একজনের দেখা মিলল যে শাহ পরীর জলদস্যুদের নির্যাতনের জীবন্ত সাক্ষী। তার ভাষ্য অনুযায়ী তাদের সাথে পাচ হাযার টাকা চুক্তি হয়েছিল শাহ পরী দ্বীপে পৌছে দেওয়ার জন্য। নৌকাতে উঠার সময়তেই তাদের থেকে পাচ হাযার করে টাকা নিয়ে নেওয়া হয়। সাগরের মাঝ পথে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে মহিলাদের কানের দুল নাকের ফুল থেকে শুরু করে সব খুলে নেয় ওই জানোয়ার গুলো। পুরুষদের একটি লুঙ্গি ছাড়া আর কোন কিছু রাখে নাই এই জানায়োর গুলো। হাড়ি, পাতিল থেকে শুরু করে গরু ছাগল যা এনেছিল সবই মাঝি নামক জলদস্যুগুলো রেখে দেয়।

আব্দুল হামিদ ভাই আরও জানালো শাহ পরী দ্বীপের তীরে না এসে সাগরের মাঝে গলা পানিতেই তাদের সবাইকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। বড়রা চলে আসতে পারলেও শিশুরা সবাই আসতে পারে নি। কারণ বড়দের গলা পানি শিশুদের ডুবা পানি। আর অনেক মহিলার চারটা পাচটা বাচ্চা। একজন মহিলা কয়জনকে আনবে? দুই একজন বাচ্চাকে এনেছে বাকিদের সাগরে আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করে দিয়ে এসেছে। সেই ভাই জানালো তাদের নৌকারই কয়েকজন শিশু শাহ পরী দ্বীপের তীরেই মারা গেছে। ভাইরাল হয়ে যাওয়া একজন বোনের উপুর হয়ে পরে থাকা মৃত দেহ অনেকেই দেখেছেন। নিশ্চিত থাকুন ওই বোনকে কোন মগ বা নাসাকা হত্যা করে নাই, তাকে শাহ পরীর মাঝি নামক জলদস্যু গুলোই হত্যা করেছে। কারণ মগরা মারলে সাগর পর্যন্ত লাস আসত না। আর টড়লার ডূবি হলে অনেক মানুষ মারা যেত। কিন্তু এরকম একজন নয়, দুই জন, হাযারো বোন আমাদের দেশী মগদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। যখনই কেউ চাহিদা মত টাকা পয়সা দিতে পারে না তখনই তাকে সাগরের মাঝ পথে নৌকা থেকে ফেলে দেওয়া হয়। সাগরের মাছগুলোর খাবার হয়ে সাগরে বিলিন হয়ে গেছে অসংখ্য নাম পরিচয়হীন আরাকানী মা বোন।

এবার শুনুন এরকমই একজন বোনের বাস্তব কাহিনী। বোনের নাম নূর বেগম, বয়স ত্রিশের কিছু বেশী হবে। সেই বোন তারা স্বামী সন্তান সব হারিয়ে এক কাপড়ে চলে এসেছিল মায়ানমার সীমান্তে। অনেকের সাথে সেও নৌকায় উঠেছিল কিন্তু নৌকার মাঝিকে দেওয়ার মত কিছুই ছিল না তার। কোন কিছু না পেয়ে নৌকার মাঝি আলম তাকে শাহ পরী দ্বীপে আটকে রাখে। পঞ্চাশ হাযার টাকা না দিলে তাকে জবাই করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। তিন দিন অকথ্য শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের পরে তাকে বিশ হাযার টাকার বিনিময়ে ছেরে দেওয়া হয়। নূর বেগমের একজন আত্মীয় সৌদি আরবে অবস্থান করছে। সে হেলাল নামক শাহ পরীর এক বিকাস এজেন্টের নাম্বারে বিশ হাযার টাকা দিলে আলম মাঝি তাকে ছেড়ে দেয়।

আজকে সকালেও নূর বেগমকে ফোন দিয়েছিলাম, সে জানালো এখন সে নয়াপরা ক্যাম্পে খাবার ও থাকার খুব কষ্টে আছে। আমি কুতুপালং ক্যাম্পে ব্যস্ত থাকায় তার কোন খোজ খবর নিতে পারি নাই।

মাঝির নামঃ আলম
পিতাঃ মোতালেব
ঠিকানাঃ ডাঙ্গা পাড়া, শাহ পরী দ্বীপ
বিকাস এজেন্টঃ হেলাল

নূর বেগম আমাকে জানিয়েছেন, সে দুনিয়াতে কোন বিচার চান না। সে আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছেন। কিন্তু আজকে যদি নুরুল কবীর, আলম গং দের বিচার না হয় তবে আমাদের ভবিষ্যতেও উপর হয়ে পরে থাকা মা বোনের লাস দেখতে হবে। প্রোফাইল পিকচার বানাতে হবে সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গা শিশুর লাস। আমরা মগ বৌদ্ধদের কাছে অনেক আগেই আত্মসমর্পণ করেছি, এবার কি শাহ পরী দ্বীপের মাঝি নামক জলদস্যুদের কাছেও আত্মসমর্পণ করব?

Related Articles

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × five =

Back to top button