প্রবন্ধ-নিবন্ধ

ভারসাম্যহীন উগ্র আস্ফালন!

মুহতারামের শেখ সাদীর ভিত্তিহীন অপবাদ ও উগ্র বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তার স্ট্যাটাসে মন্তব্য হিসাবে নিচের লেখা তৈরি করা হয়েছিল। কমেন্ট করতে না পারায় স্ট্যাটাস আকারে পোস্ট করা হয়। সেই স্ট্যাটাসও কোন এক অজানা কারণে ফেসবুক সরিয়ে দেয় (!)। তাই নোট আকারে আবার এই লেখা দেওয়া। – মুহতারাম শেখ সাদি,
গত প্রায় এক মাস ধরে আমি আপনার লেখাগুলো পর্যবেক্ষন করলাম। কয়েকটি বিষয় লক্ষ করলাম।
প্রথমত আপনি যেই উদ্ধৃতি ও দলীলগুলো দেন সেগুলো ঐগুলোর উপর ভিত্তি করে করা আপনার অধিকাংশ দাবি সমর্থন করে না। যেমন ৯/১১ এর ব্যাপারে তালিবানের একটি বার্তা ও তার উপর ভিত্তি করে আপনার উপসংহার একটি উদাহরন। এ বার্তা থেকে বেশি থেকে বেশি যা বলা যায় তা হল এই কথার অনেক অর্থের মধ্যে একটি অর্থ এটি হতে পারে। অথচ আপনি এর থেকে সুনির্দিষ্ট একটি দাবি নিয়ে আসছেন ইমারতে ইসলামিয়াহর অনেক কার্যক্রম ও অন্যান্য বক্তব্য থেকে যার বিপরীত প্রমান দেওয়া যায়। অথচ আপনি প্রমান করার চেষ্টা করলেন ‘তালিবান এ আক্রমন সম্পর্কে জানতো না’, ‘তাঁরা এই আক্রমন সমর্থন করে না’, এটি করা ‘ফিকহ অনুযায়ী নাজায়েজ’, ‘কায়েদা জাত মিথ্যুক’, ‘তালিবানদের বোকাসোকা নেতাদের বোকা বানানো হয়েছে’ ইত্যাদি।
অথচ সেই একই তালিবান বলেছে –
“শহীদী অভিযানের সত্যতা হল যে তা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে । একজন মুজাহিদ তার শরীরে বেঁধে বা গাড়িতে করে বিস্ফোরক নিয়ে তা বিপুল সংখ্যক শত্রুর মাঝে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, আর ফলে একটি মাত্র প্রানের বদলে শত্রুর বিপুল ক্ষতি সাধিত হয় । যে আমেরিকানরা ২০০১ এর পর থেকে নিরীহ আফগানদের উপর শক্তি/দাপট দেখিয়ে আসছিল, তাদেরকেই এখন দেখা যায়, আলোচনায় বসার চেষ্টা করতে, এই যুদ্ধ থেকে বের হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করতে । ৯/১১ এর প্রভাব এর সাক্ষ্য দেয় ! ১৯ জন দৃঢ়চিত্ত মানুষ একটি অসাধারন প্রচেষ্টায় ইতিহাসের স্রোতের দিক পরিবর্তনে সক্ষম হয় । এটা মূলত কাফিরদের অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছে এবং বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পিত তাদের পৃথিবীব্যাপী উপনিবেশ স্থাপন প্রচেষ্টা পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে।
যদি ঐ এক বক্তব্য থেকে আপনি আপনার পছন্দের উপসংহারে পৌছে যান এবং সেটাকেই সত্য বলে প্রমাণে সচেষ্ট হন, তবে তার বিপরীত প্রমান এ বক্তব্য থেকেই করা সম্ভব।
এছাড়া এধরনের দাবির ব্যাপারে অনেক প্রশ্ন থেকে যায়। যেমন ইমারতের অজান্তে তাঁদের অনুমতি ছাড়া যদি আক্রমন হয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, তাহলে সেই বিভ্রান্তি ২০০২ এর মধ্যেই কেটে গেছে। তারপরও কেন ইমারতে ইসলামিয়া এই নাজায়েজ বক্তব্যের ব্যাপারে কিছু বললো না, কেন আমীরুল মুমীনীন মোল্লাহ মোহাম্মদ ওমর ২০০২ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত এ নিয়ে কিছু বললেন বা করলেন না? বরং আমীরুল মুমিনীন মুল্লাহ আখতার মনসুর রাহিমাহুল্লাহ, মোল্লা দাদুল্লাহ, সিরাজ হাক্কানিসহ অনেকে বিপরীত ধরনের বক্তব্য দিলেন? একইভাবে ২০০১ এর আগেও তো আল-কায়েদা আমেরিকার উপর হামলা করেছে। ১৯৯৮ সালে তাঁরা নাইরোবি ও দারুস সালামে আমেরিকান দূতাবাসে হামলা করেছে, দায়ও স্বীকার করেছে। তালিবান ও মোল্লাহ ওমর রাহিমাহুল্লাহ কি এটাও জানতেন না? তাঁদের রাজনৈতিক একটি বক্তব্য থেকে যা আপনি “অকাট্যভাবে প্রমান” করে দিলেন, তাদের কর্মগত ও অন্যান্য বক্তব্য থেকে প্রমান দিয়ে একইভাবে আরেকজন বিপরীত দাবি ‘অকাট্যভাবে’ প্রমান করে দিতে পারবে।অথচ আপনি একে দাবি করছেন অবিসংবাদিত, নিঃসন্দেহ সত্য হিসাবে। তাঁরা করলে এটা হাস্যকর তাবীল। আপনি করলে এটা ‘দালীলিক ইলমি’ আলোচনা, কারণ আপনি অনেক উক্তি নিয়ে এসেছেন সেটা এখন প্রাসঙ্গিক হোক বা না হোক। আপনার দলীল থেকে আপনার দাবি প্রমান হোক বা না হোক! আজিব ব্যাপার!
এই বিষয়ে আপনার বলা বেশির ভাগ কথার ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য। আপনি কট্টর আহলে হাদিস ও মাজহাবিদের অপছন্দ করার কথা বলেন অথচ তাদের অনেকগুলো গুরত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আপনার মধ্যে পাওয়া যায়।
যেমন > ইখতিলাফি বিষয়ে ইখতিলাফকে অস্বীকার করা বা চেপে যাওয়া। এমনভাবে কথা বলা যে আপনি যা বলেছেন সেটাই একমাত্র সঠিক মত। ভিন্নমতের স্বপক্ষে দলীলগুলো, বক্তব্য, ফতোয়া চেপে যাওয়া।
> ইখতিলাফি বিষয়ে আপনার সাথে না মেলা মতকে বিদআহ, গুলুহ এগুলো বলা।
>খুঁজে খুঁজে যে আছার ও আকওয়াল আপনার পক্ষে যায় সেগুলো উপস্থাপন করা, এগুলোর উপর ভিত্তি করে নিজের একটা ফতোয়া দেওয়া বাকিসব এড়িয়ে যাওয়া।
>উদ্ধৃতি থেকে যেটা প্রমান হয় না সেটা দাবি করা। ইচ্ছামত ব্যাখ্যা করা। ইচ্ছামতো কিয়াস করা।
>নিজের মত, মাজহাব এর পক্ষে যা যায় শুধু সেটা গ্রহণ।
>যখন যার যে মতটা গ্রহণ করলে নিজের কথার পক্ষে প্রমান দেওয়া যায়, তখন সেটা গ্রহণ।
>আপনি ভুল স্বীকারের কথা বলেন, কিন্তু স্পষ্ট ভুলকে স্বীকার করেন না। বরং যখন সেটা ভুল প্রমাণিত হয় তখন সেটা বাদ দিয়ে ভিন্ন একদিকে আলোচনাকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা।
>কট্টর হানাফি মাজহাবিরা ইমাম শাফেয়ী, মালিক কিংবা আহমেদের সমালোচনা করে না, বরং তাদের দিকে নিসবত করে। কিন্তু যখন এই ইমামদের মাজহাবের কোন আমল আহলে হাদিস বা অন্য কেউ করে তখন তাদের সমালোচনায় উঠেপড়ে লাগে। কট্টর আহলে হাদিসরাও এই কাজ করে। আপনিও করেন। যেই মত বিন বাজ বা আল-ফাওজান বা সুলাইমান বিন আব্দুল্লাহ দিয়েছে সেটা দেওয়ার জন্য তাদের কথা বলেন না, যে তাদের মত অনুসরণ করছে তাঁকে আক্রমন করেন। যেই কথা বলার কারণে অমুক দল বিদআতি হয়ে গেল, সেই একই কথা যেই আলিম বলেছেন তার মত কি ভুল, কেন ভুল, আপনি কোন দলীল ও যোগ্যতায় ভুল ধরছেন এমন সব আলোচনা এড়িয়ে যান।
>সার্বিকভাবে কথা ও সমালোচনার ক্ষেত্রে ইনসাফ, আদব ও আমানতদারিতা, আরেকজনে হুসনে জন না দেওয়া এবং সমালোচনায় উগ্রতা।
এসবই আপনার মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান।
আপনার যেসব দাবির মধ্যে নানা মাত্রায় এগুলোর কোন কোনটি বা সবগুলো পরিলক্ষিত হয়েছে তার মধ্যে আছে –
– শাইখ আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদিসি তাকফিরের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক স্বীকার করে না (এবং আল-কায়েদাও করে না কারণ “মাকদিসির মানহাজই আল-কায়েদার মানহাজ”, যদিও এ বক্তব্যও ভুল।) – প্রমান দেওয়া হল যে শাইখ এবং আল-কায়েদা উভয়েই প্রতিবন্ধকের অস্তিত্ব স্বীকার করে না।
– শাইখ মাকদিসি ও আল-কায়েদা তাকফিরের ব্যাপারে ‘গুলাত’ (সৌদির ব্যাপারে হারুরিয়া!) আহলুস সুন্নাহর মানহাজের উপরে নেই। – আহলুস সুন্নাহর আলিমদের বক্তব্য থেকে দেখানো হল যে তারা সাক্ষ্য দিচ্ছেন তাদের উসুল এই ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহর উসুলই। (আপনি বলতে পারতেন যে তাঁরা প্রয়োগে কিছু ভুল করেছে, সেটা একটা লেভেলে গ্রহণযোগ্য হত। কিন্তু আপনি সেটা বলেননি)
– তারপর রাজনৈতিক বক্তব্য থেকে প্রমান করার চেষ্টা করলেন তালিবান আর আল-কায়েদার ‘আকাশ-পাতাল’ পার্থক্য – প্রমান দেওয়া হল রাজনৈতিক বক্তব্য, সাক্ষাৎকার থেকেই যে তারা “আমাদের লক্ষ্য এক, শত্রু এক, উদ্দেশ্য এক”, “সম্মানিত ভাই”, “আপনাদের জন্য আমাদের ইমারত বারবার কুরবান হোক” এই ধরনের কথা বলেন। আপনার দাবি অনুযায়ী তাহলে তালিবান শতাব্দীর সবচেয়ে বড় “গর্দভ” বা “নিরেট বোকাদের” অন্যতম। কারণ “ফিকহে নাজায়েজ করার” অনেক বছর পরও তাঁরা এসব কথা বলে যাচ্ছে।
– একবার বলেন আপনি কায়েদার নাড়ীনক্ষত্র জানেন, আরেকবার বলেন এক্টিভিস্ট ছিলেন। অথচ কাফের ও মুরতাদরাও স্বীকার করে যে আল-কায়েদা সেন্ট্রালের উচ্চপদস্থ নেতারাও তাদের কাজের সাথে সম্পর্কিত বিষয় ছাড়া সামগ্রিক সব ব্যাপারে ও স্ট্রাটেজির ব্যাপারে জানে না। সেই জায়গায় আপনি নারীনক্ষত্র জেনে বসে আছেন। তারা জাত মিথ্যুক এইসেই সব জেনে বসে আছেন। আল্লাহু মুস্তায়ান।
– আপনি বললেন মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য করা শুধু অন্তরের শর্ত কুফর, অন্যথায় গুনাহ। যারা এটা মানবে না তারা আহলুস সুন্নাহর আকিদা মানহাজে নেই – অথচ আগের পরের, আপনার পছন্দের অপছন্দের অনেক আলিমের বক্তব্য দিয়ে এটি প্রমান করা হল যে কাফিরদের সাথে মুওয়ালাত সবসময় কুফর না, কিন্তু মুযাহারা কুফর আকবর ও রিদ্দা কোন তাফসিল ছাড়াই। আপনি এটা স্বীকার করলেন না। এড়িয়ে গেলেন। এমনকি আপনার কমেন্টে এসেও অনেক ভাই দলীল দিলেন। কিত্নু আপনি একবারও এই কথা বললেন না যে, ‘আমি যেটাকে ঢালাওভাবে ভুল মত, গোমরাহি, বিদআহ, গুলুহ বলেছি অনেক আলিম সেই মত গ্রহন করেছেন’। আপনি এসব আলিম ও তাদের মতের ভুল ধরার যোগ্য কি না, এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম কি না, সেই আলোচনা দূরে থাক, আপনি এই বাস্তবতা স্বীকারও করলেন না এ নিয়ে কোন দালীলিক আলোচনাও করলেন না। কেবল সার্চ দিয়ে নিজের মতের পক্ষে পাওয়া কিছু উদ্ধৃতি অনুবাদ করে দিয়ে সেখান থেকে হুকুম বের করে নিয়ে আসলেন!
প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে একই ব্যাপার, সুবহানআল্লাহ!
– হুজ্জত কায়েম হয়েছে কি না, হুজ্জত কায়েমের শর্ত কী? হুজ্জত কায়েম কী কী করলে হয়? সেগুলো কী পূর্ণ হয়েছে কি না, এগুলোর পক্ষে কোন প্রমান ছাড়াই বলে দিলেন ‘এরা হুজ্জত কায়েম ছাড়াই তাকফির করে। এরা গুলাত, হারুরিয়াহ”
– দাবি করলেন সকল ধরনের নাওয়াকিদের ক্ষেত্রে হুজ্জত কায়েম শর্ত – অথচ এর বিপরীতে অনেক আলিমের অনেক বক্তব্য বিদ্যমান।
– দাবি করলেন সেকুলারিজমের জন্য তাকফির করা যাবে না, যে স্পষ্ট বলছে ইসলামী শাসন না সেকুলারিজমের শাসন চাই,– তখনও সেটাকে কুফর আকবর বলা যাবে না।
এবং এরকম আরো অনেক দাবি, মন্তব্য। এর সাথে অপবাদ দেওয়া তো আছেই। বস্তুত নিখীল বাংলা ফেসবুক আল-কায়েদা বিরোধী মোর্চাতে আপনি ছাড়া আরো যারা যারা আছেন সাদিদ মালেক, আসাদুজ জামান, শরীফ আবু হায়াত, মাসুদ আছারী, আকতার বিন আমির, এবং ফরিদউদ্দিন মাসুদ ও এদের সার্কেলরা, এদের মধ্যে উল্লেখিত প্রথম তিন গোত্রের চেয়ে পরের তিন গোত্রের সাথে আপনার মিল বেশি। কারণ প্রথম তিন গোত্র বিরোধিতা করলেও নিজের দাবি ও সমালোচনার মধ্যে তুলনামূলকভাবে সামান্য হলেও আদল-ইনসাফ করার চেষ্টা করে। ভুল হলে, নিজেদের অজ্ঞতা থাকলে সেটা স্বীকার করে।
আপনি সমালোচনা করবেন, বিরোধিতা করবেন, মানুষকে সতর্ক করবেন – ভালো কথা। যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে হয় তাহলে আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত দিন অতঃপর আপনার এ ব্যাপারের ভুল, অপরাধ ও অপবাদগুলোকে নেক আমলে পরিণত করে দিন। কিন্তু আপনি সাধারণ ইনসাফ, সততা ও স্বচ্ছতা সাথে সেটা করবেন। আপনি নীতিগত অগ্রগণ্যতার দাবি করবেন কিন্তু কাজে উলটো পাওয়া যাবে এমন হলে তো হবে না। এই মানের কথাবার্তা বলে আপনি “মানহাজের ভিত ভাঙ্গার” স্বপ্ন দেখলেও আখেরে এতে আপনি নিজের ক্ষতিই করছেন। এখন হয়তো অনেক ভাই আপনার ‘দলীল’ দেখে বিভ্রান্ত হচ্ছে, যেমন মাদখালিদের দাওয়াহ পেলে প্রথম প্রথম অনেক ভাই হন, কিন্তু আপনি যদি এইভাবে এই ধরনের বিকৃত পদ্ধতিতে ‘দাওয়াহ’, ‘নসিহাহ’ আর ‘ইসলাহ’ করেন, তাহলে একসময় এরাই আপনাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করবে, যেমন লুতফর ফরাজি, ইমাম হোসেন, মাসুদ আছারিকে নিয়ে হাসাহাসি করা হয়। এই জাতীয় কথাবার্তা বলে আপনি “মানহাজের ভিত ভাঙ্গার” স্বপ্ন দেখলেও আখেরে এতে আপনি নিজের ক্ষতিই করছেন। মানুষ বিদ্বেষ ও ক্রোধে অন্ধ হয়ে যায়, এ বিষয়টি সম্পর্কে সতর্ক হলে আপনার লাভ বৈ ক্ষতি হবে না।
[সংগৃহীত]

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

6 + eight =

Back to top button