আনসারুল্লাহ বাংলা টিমআরবতথ্য প্রযুক্তি ও যুদ্ধকৌশলবই ও রিসালাহমিডিয়াশাইখ আবু মুহাম্মাদ আল মাকদিসী হাফিযাহুল্লাহশামহযরত উলামা ও উমারায়ে কেরাম

সতর্কতার মধ্যম পন্থা -শায়খ আবু মুহাম্মাদ আসিম আল মাকদেসী || Ansarullah Bengali Team

بسم الله الرحمن الرحيم

فريق أنصار الله البنغالي
Ansarullah Bengali Team
আনসারুল্লাহ বাংলা টিম


يقدم
Presents
পরিবেশিত


الترجمة البنغالية للكتاب من مؤسسة دار التبيان

The Bengali Translation of the Book by At-Tibyan Publications
বাংলায় অনূদিত আত-তিবয়ান পাবলিকেশন্সের বই



الحذر والكتمان
Precaution, Secrecy and Concealment:
সতর্কতা, গোপনীয়তা এবং ধুম্রজালঃ


بين الإفراط والتفريط
Balancing between Negligence and Paranoia
সতর্কতার মধ্যম পন্থা


للشيخ أبي محمد المقدسي (فك الله أسره)
By Sheikh Abu Muhammad Asim al-Maqdisi (May Allah Release Him)
লেখক শাইখ আবু মুহাম্মদ আসিম আল-মাকদিসি (আল্লাহ্ তাঁকে মুক্ত করুন)


كلمة المرور
Password:
পাসওয়ার্ডঃ

&h9^g5@8J0)@l8*%V


تحميل
Download
ডাউনলোড

PDF
পিডিএফ

https://archive.org/download/PrecautionSecrecyAndConcealmentbalancingBetweenNegligenceAndParanoia/balance.pdf

MS Word
এম এস ওয়ার্ড

https://archive.org/download/AnsarullahBengaliTeamPresentsPrecautionSecrecyAndConcealmentbalancing/balance.doc

Archive Page
https://archive.org/details/BengaliTranslationOfTheBookByAt-tibyanPublicationsPrecautionSecrecy
https://archive.org/details/AnsarullahBengaliTeamPresentsPrecautionSecrecyAndConcealmentbalancing
অনলাইনে পড়ুন
https://justpaste.it/sotorkotar_moddom_pontha


لا تنسونا من صالح دعائكم
Don’t forget us in your sincere prayers
আপনাদের আন্তরিক দোয়ায় আমাদেরকে ভুলবেন না

=================

সতর্কতার মধ্যম পন্থা – শায়খ আবু মুহাম্মদ আসিম আল মাকদিসি (হাফি)

প্রকৃত মুমিন কখনো একই গর্ত থেকে দু’বার দংশিত হয় না


 

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম

আল্লাহ্‌ রব্বুল আলামীন ঈমানদারদের আদেশ দিয়ে বলেছেন-

হে ঈমানদাররা! তোমরা তোমাদের সতর্কতা অবলম্বন করো, অতঃপর হয় দলে দলে বিভক্ত হয়ে কিংবা ঐক্যবদ্ধভাবে অভিযানে বেরিয়ে পড় (সূরা আন নিসাঃ আয়াত ৭১)

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা আরও বলেন-

তোমরা সতর্কতা অবলম্বন করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তা’য়ালা কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন । (সূরা আন নিসাঃ আয়াত ১০২)

অতএব আল কুর’আনের এ সব আয়াত সন্দেহাতীতভাবে প্রমান করে যে, সতর্কতামূলক উপায়ে অবলম্বন করা, সতর্ক পদক্ষেপ নেয়া, সাবধান থাকা এবং সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে প্রয়োজনে বিশেষ কোন তথ্য অন্যের কাছ থেকে গোপন রাখা অবশ্যই শরিয়াহ সম্মত; বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তা ফরয বা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় [১]। আর একারণে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে কোন প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে গোপনীয়তা বজায় রাখার এমন কি তা সামরিক বিষয়াদি না হলেও। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সতর্কতা অবলম্বন কর এবং লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য প্রার্থনা করো, কেননা যে ব্যক্তিই কোন অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয় তাকেই ঈর্ষার পাত্র হতে হয়।[২]

 

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্‌র শত্রুদের ব্যপারে সতর্কীকরণের ক্ষেত্রে যে সব শব্দাবলী ব্যবহার করেছেন এক্ষেত্রে তাও বিশেষভাবে লক্ষনীয়। তিনি তামওয়ীহ শব্দ ব্যবহার করেছেন যার অর্থ হল, মেকি ,মিথ্যা ঘটনা সাজানো, জালিয়াত; তিনি ব্যবহার করেছেন মুখাদায়াহ যার অর্থ হল বোকা বানানো , ধোঁকা দেয়া, প্রতারণা করা ইত্যাদি। আল্লাহ্‌র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সতর্ক্তা বলতে নিছক স্পর্শকাতর তথ্য গোপন করাকেই বুঝাননি বরং এসব শব্দ তিনি প্রয়োগ করেছেন আগ বাড়িয়ে পরিকল্পিত শত্রু সেনাদের মধ্যে দ্বন্দ কলহ, মতবিরোধ ও বিভক্তি তৈরী, ফাটল ধরানো , বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করার নির্দেশ দান প্রসঙ্গে। এর প্রধান উদ্দেশ্য শত্রু সেনা ও তাদের গোয়েন্দাদেরকে বিভ্রান্ত করা।[৩]

তাবুক যুদ্ধে দুই সাহাবীর অংশগ্রহন না করা সম্পর্কিত ঘটনা প্রসঙ্গে সহীহ আল বুখারী বর্ণনায় কা’ব বিন মালিক রাঃ বলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সখনি কোন সেনা অভিযান প্রেরণ করতেন তখন (কোন অঞ্চলে বা কোন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করবেন সে সম্পর্কে) অভিযান শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তিনি সব সময় ভুল তথ্য দিয়ে রাখতেন।

তিনি তাঁর সাহাবীদের মিশন এবং তাঁর সেনা অভিযানের সফলতার লক্ষ্যে যে সকল বিষয়ের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন তাঁর মধ্যে অন্যতম হল কিতমান বা গোপনীয়তা রক্ষা। যেমন অনেক সময় তিনি কোন দিকে সেনা অভিযান প্রেরণ করতেন কিন্তু স্বয়ং সেই বাহিনীকেও বলতেন না যে তাদের গন্তব্যস্থান কোথায় ও লক্ষ্যবস্তু কি, তিনি তাদেরকে একটি চিঠিতে তাদের গন্তব্য ও লক্ষ্যবস্তু কথা লিখে দিয়ে নির্দেশ দিতেন যে অমুক স্থানে না গিয়ে বা কোন নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে যেন চিঠিটি না খোলা হয়।

এমনই একটি সেনা অভিযান ছিল আব্দুল্লাহ ইবন জাহাশ রাঃ এর নেতৃতে পরিচালিত সেই অভিযান যে অভিযানে আল হাদরামী নিহত হয়। এ ঘটনা আমাদেরকে স্পর্শকাতর সামরিক তথ্য গোপনা রাখার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়। এবং শুধু সাধারন জনগণ নয় বরং স্বয়ং মুজাহিদদের থেকেও অপারেশন বা যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তথ্য গোপন রাখার প্রমাণ রয়েছে। [৪]

এর উদ্দেশ্য হল , মুজাহিদদের কেউ যদি দুর্বল হয়ে পড়ে, কিংবা কেউ যদি কাফেরদের হাতে বন্দি হয়ে যায় তাহলে সে যেন তাদের কাছে কোন তথ্য ফাস করে না দিতে পারে [৫] , এমনকি তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয় তবুও[৬]

এমন একটি ঘটনা হল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের ঘটনা। যে ঘটনার সতর্কতারমূলক পদক্ষেপ গ্রহনের সারসংক্ষেপ বিশ্লেষন হল এমন যে-

(১) তিনি এমন সময় আবু বকর রাঃ এর কাছে এসেছিলেন যে সময়ে তিনি সাধারণতঃ কখনো আসতেন না।

(২) তিনি মুখ ঢেকে আসেন [৭]

(৩) সাহাবীদেরকে তার নিজের হিজরতের পুর্বে হিজরত করার নির্দেশ প্রদান; থচ আবু বকর রাঃ অনুযোগ করে বলেছিলেন ‘তারা আপনার অনুসারী ! (কিভাব তারা আপনাকে এই বিপদের মধ্যে রেখে চলে যাবে?)

(৪) আবু বকর রাঃ এর পুত্র আব্দুল্লাহ রাতে তাদের সাথে সেই গোপন স্থানে থাকলেও দিন শুরুর পূর্বেই তাদেরকে রেখে আবার মক্কায় চলে আসতেন, যাতে কুরায়শরা ভাবে যে তিনি রাতেও মক্কাতেই ছিলেন। এবং কাফিররা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আবু বকর রাঃ এর বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত করে সে তথ্য সংগ্রহের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। আর রাতের আঁধার নেমে আসার সাথে সাথে তিনি চলে যেতেন সেই পাহাড়ের গুহায় যেখানে তারা লুকিয়ে থাকতেন এবং তাদেরকে সকল বিষয়ে অবহিত করতেন [৮]

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাঃ এর বর্ণনায় সহীহ আল বুখারীতে ৩৯০৫ নং হাদিসে হিজরতের যে বিস্তারিত ঘটনা বর্ণীত রয়েছে সেখানে আমাদের এখানে আলোচিত প্রত্যেকটি বিষয় পাওয়া যাবে [৯]। সে বর্ণনায় এও রয়েছে যে পথিমধ্যে সুরাকার সাথে দেখা হলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন যে, ‘ আমাদের বিষয়টি অন্যদের থেকে গোপন রেখো’।

সহিহ আল বুখারীতে ‘যুদ্ধ মানেই ধোঁকা’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ই রয়েছে; আর উল্লেখিত এ হাদিসটি সে অধ্যায়ের সংকলিত [১০]। হাফেয ইবন হাজার আসকালানী এ হাদিসে উল্লেখিত ধোঁকার ব্যাখ্যায় বলেন ‘ধোঁকা অর্থ হল কোন এক জিনিস প্রকাশ করে তার অন্তরালে অন্য জিনিস গোপন রাখা। এ হাদিসে যুদ্ধে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহন এবং কাফিরদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান রাখা রাখে না এবং যে এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন নয় সে তার চারপাশের ঘটনা প্রবাহ তার বিরুদ্ধে চলে যাওয়া থেকে মোটেই নিরাপদ নয় [১১]

ইমাম বুখারী রহঃ ‘যুদ্ধে মিথ্যা বলা’ [১২] নামে আরও একটি অনুচ্ছেদ কায়েম করেছেন আর এখানে তিনি উল্লেখ করেছেন ইহুদী তাগুদ কা’ব বিন আশরাফকে সাহাবায়ে কেরাম রাঃ কিভাবে হত্যা করেছিলেন। তারা তাকে মিথ্যা কথা বলে এমনভাবে বিভ্রান্ত করেছিলেন যে সে ভাবছিল যে সাহাবায়ে কেরামগণ সত্যিই আল্লাহ্‌র রসূলের উপর চরমভাবে বিরক্ত, আল্লাহ্‌র রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক তাদের উপর আরোপিত দান সাদাকা করতে করতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এভাবে তার সাথে তারা মিথ্যা কথা বলতে থাকে যতক্ষন না তারা তাকে সম্পূর্নরূপে বাগে আনতে পেরেছিলেন এবং অতঃপর আল্লাহ্‌র এ দুশমনকে তারা হত্যা করে ফেলেন [১৩]

হাফিয ইবনে হাজার এই হাদিসের ব্যাখ্যা তার ফাতহুল বারী গ্রন্থে তিনটি ক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলার বৈধতা প্রসঙ্গে অন্য আরও একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন যে হাদিসটি ইমাম তিরমিযি রহঃ তার সুনানে উম্মে কুলসুম রাঃ এর বর্ণনায় সংকলন করেছেন। এই তিনটি ক্ষেত্রের একটি হল যুদ্ধ। হাফিয ইবন হাজার রহঃ হাজ্জাজ ইবন ইলাতের ঘটনাটিও সেখানে উল্লেখ করেছেন যেখানে দেখা যায় হাজ্জাজ ইবন ইলাত তার সম্পদ অক্ষার লোকদের কাছ থেকে ফেরত পাওয়ার জন্য রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মিথ্যা বলার অনুমতি প্রাথনা করেন [১৪]

ইমাম বুখারী রহঃ ৩৮৬১ নং হাদিসে হযরত আবু যার রাঃ এর ইসলাম গ্রহনের ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। এ ঘটনাটি বিশ্লেষন করলেও আমরা সতর্কতা অবলম্বন বিষয়ে গুরত্বপূর্ন শিক্ষা গ্রহন করতে পারি। আর এ ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে সাহাবায়ে কেরাম রাঃ যে কোন কাজে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহন করতেন, সতর্ক থাকতেন এবং সব সময় যত্নের সাথে গোপনীয়তা রক্ষা করে চলতেন; নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহনকে কখনো তারা অবহেলা করতেন না। আবু যার রাঃ এর আ ঘটনায় আমরা দেখতে পাই আলী রাঃ সম্পূর্ন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে কিছু না বলে কিভাবে টানা তিন দিন পর্যন্ত তাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি অপেক্ষা করেছেন তার আগমনের উদ্দেশ্য তার থেকে না জানা পর্যন্ত; এভাবে তিনি সম্পূর্ন নিশ্চিত হয়েছেন যে তিনি সত্যিই ইসলাম গ্রহনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্‌র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সাক্কাহত করতেই এসেছেন। এরপর তিনি সম্মত হন তাকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে যেতে এবং তাকে বলেন দূর থেকে তাকে অনুসরণ করতে যাতে কুরায়শরা কিছু টের না পায়। আমরা দেখতে পাই কত সতর্কভাবে আলী রাঃ পদক্ষেপ গ্রহন করেন! তিন আবু যার রাঃ কে বলেন ‘আমি যদি আপনার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন কোন কিছু আঁচ করি তাহলে আমি প্রশাব করার ভান করে রাস্তার পাশে চলে যাবো; এর পর যখন আমি আবার চলা আরম্ভ করবো আপনি আমাকে অনুসরণ করে চলতে থাকবেন যতক্ষন না আপনিও সেই বাড়িতে প্রবেশ করেন যে বাড়িতে আমি প্রবেশ করি’।

কুর’আনুল কারীমে আল্লাহ্‌ তা’য়ালা আসহাবে কাহাফের ঘটনায় আমাদেরকে দেখিয়েছেন কিভাবে সেই যুবকরা তাদের জাতির লোকদের থেকে সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন। তাদের মধ্য থেকে যাকে তারা খাবার ক্রয় করতে শহরে পাঠিয়েছিলেন তাকে তারা বলেছিলেন-

তোমরা তোমাদের একজনকে তোমাদের পয়সা দিয়ে বাজারে পাঠাও, সে গিয়ে দেখুক কোন খাবার উতম, অতঃপর তা থেকে তোমাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসুক; সে যেন অবশ্যই বিচক্ষণতার সাথে কাজ করে এবং তোমাদের ব্যাপারে কাউকে কিছু না বলে। (সুরা আল কাহাফ, আয়াত ১৯-২০)

এখানে উল্লেখিত এবং এমন অন্য আরও অনেক ঘটনা প্রমাণ করে যে , সাবধানতা অবলম্বন, সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহন, গোপনীয়তা বজায় রাখা, আল্লাহ্‌র শত্রুদের কাছে বানোয়াট ঘটনা সাজানো, তাদেরকে প্রতারিত ও বিভ্রান্ত করা, তাদের দুস্কৃতি থেকে নিজেদেরকে রক্ষার জন্য মিথ্যা কথা বলা সম্পূর্নভাবে শরিয়াসম্মত হালাল ও বৈধ এবং একারনেই কোন মুসলমানকে কিছুতেই দোষারোপ কিংবা ভৎর্সনা করা যাবে না। আর একথা অনস্বীকার্য সত্য যে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে হালাল করে দেয়া এ সুযোগকে যথাযথভাবে ব্যবহার না করা, সাবধানতা অবলম্বনের এসব পদক্ষেপকে অবহেলা আল্লাহ্‌র শত্রুদেরকে দ্বীনের দা’য়ী ও মুজাহিদদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেবে এবং কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও তাদের যাবতীয় কর্মকান্ডকে নস্যাত করে দেবে তাদের জান মাল কোরবানি করে পরিচালিত জিহাদকে বিফল করে দেবে [১৫]

শর’য়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির বৈধতা প্রমানিত হওয়ার পর এখন আমরা এর বাস্তব প্রয়োগের ব্যাপারে কিছু আলোচনা করবো।

সাবধানতা অবলম্বনের ব্যাপারে লোকেরা উভয় দিকেই প্রান্তিকতার শিকার; একদল হয়তো সতর্কতার ব্যাপারে এমন মারাত্নক উদাসীন যে বিষয়টিকে মোটেই গুরুত্ব দেয় না; অন্য দিকে একদল সতর্কতার নামে বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছে যে সব কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে একেবারে স্থবির হয়ে বসে আছে, ভীতি তাদের অন্তরে অমনভাবে ছেয়ে গেছে যে তার তাদের নিজ ছায়া দেখেও ভয়ে কেপে ওঠে, তারা মনে করে আশেপাশের সব কিছু বুঝি শুধু তারই বিরুদ্ধে কাজ করছে। কাজ আরম্ভ করার প্রথম দিকে নিরাপত্তা মূলক ব্যবস্থা গ্রহনের বিষয়টিকে অবহেলা হেতু তাদের উপর আপতিত বিপদ মুসীবতের কারণে তারা দাওয়াহ ও জিহাদের কাজ ছেড়ে দিয়ে ঘরের কোণে ঘাপটি মেরে অলস হয়ে বসে থাকে। এবং মানসিক দিক থেকে এমনভাবে ভেঙ্গে পড়ে যে তারা মনে করে তাদের সকল গোপন তথ্য বুঝি আল্লাহ্‌র শত্রুদের জানা [১৬]। আল্লাহ্‌র শত্রুদের আড়ি পাতা, দলের মধ্যে গোপন অনুপ্রবেশ, গোপন পর্যবেক্ষন, তাদের অত্যাধুনিক প্রযিক্তি ইত্যাদির ভয়ে সে এমনভাবে কুঁচকে যায় যে সে ফোন, কম্পিউটার বা অন্যান্য যোগাযোগের জন্য বার্তাবাহক হিসেবে কবুতর ব্যবহার করতে পারতো তাহলে অন্য কিছুই ব্যবহার করতো না।

অথচ এসব তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা স্বত্তেও নিজেকে এর ক্ষতিকারক দিক থেকে নিরাপদ রাখার জন্য এমন কোন মহা পন্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, সামান্য একটু সচেতনতাই এত্থেকে আপনাকে নিরাপদ রাখতে পারতো। এজন্য আল্লাহ্‌র শত্রুদের বিভ্রান্ত করার কিছু পদ্ধতি জানা, নিপুন কভার স্টোরি তৈরী করতে শেখা , তথ্য গোপন রাখার প্রযুক্তিগত আধুনিক কিছু টেকনিক শিখে নেয়া প্রতিটি মুজাহিদ ভাইয়েরই একান্ত কর্তব্য। এরফলে দেখা যাবে আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় যাদুকর তার নি যাদুতেই আক্রান্ত হয়ে পড়বে।

‘সব কিছুই তাদের পর্যবেক্ষণের আওতাধীন’ এমন কথা বলে কিংবা তাদের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আধুনিক এসব উপায় উপকরণসমূহকে দাওয়াহ ও জিহাদে কাজে ব্যবহার বন্ধ করে দেয়া, যৌক্তিক কোন বৈধ কারণ ছাড়া আধুনিক এসব যোগাযোগ মাধ্যমসমূহকে উপেক্ষা করা সেচ্ছায় পরাজয় বরণ করা ও আত্নপ্রবঞ্চনা বৈ কিছুই নয়। এর অর্থ দাঁড়াবে আল্লাহ্‌র শত্রুদের বোগাস সব প্রযুক্তির সামনে অকারনে ভেঙ্গে পরা এবং আল্লাহ্‌র শত্রুদের ক্ষমতাকে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে অতি মূল্যায়ন করা [১৭]

জেলের কষ্টকর জীবন থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া কয়েকজন যুবকের সাথে আমি দেখা করেছিলাম যারা জেলে থাকা অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের সময় একে অপরের বিরুদ্ধে জবানবন্দী দিয়েছে। এদের এক জনের সাথে কথা বলার জন্য যখন আমি বসলাম তখন সে উঠে গিয়ে রেডিওর একটি চ্যানেল ছেড়ে দিল যাতে শুধু উচ্চস্বরে বিরক্তিকর শব্দ হচ্ছিল, আমি তাকে বললাম, রেড ছাড়ছো কেন, ওটা বন্ধ করে দাও, শব্দে তো কিছু শোনা যাচ্ছে না ! সে বলল, না এটা বন্ধ করা যাবে না, আমাদের কথোপকথনকে অবোধগম্য করার জন্য এর প্রয়োজন আছে, যদি কেউ আমাদের কথাবার্তায় আড়ি পাতে? আমি তাকে বললাম, এটা তোমার নিজের ঘর, আর আমাদের কথাবার্তা একান্তই সাধারণ সামাজিক কথাবার্তা, আমরা না দাওয়াহর বিষয়ে কথা বলছি না জিহাদের , না নিরপত্তা বিষয়ক কোন ব্যাপারে ; আমার তো মনে হয় তোমার এই রেডিওর অপ্রাসঙ্গিক শব্দ ব্রং অন্যদের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক করা ছাড়া অন্য কোন উপকার আসবে না।

এদের অনেককে দেখা যায় এরা কারো সাথে ফোনে কথা বলার সময় কোন প্তয়োজন ছাড়াই এমন সব বিকৃত ও সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করে যে শুনে মনে হয় যে সে অন্য কোন ভাষায় কথা বলছে, অনেক সময় দেখবেন আপনি বুঝতেই পারবেন না এরা কি বলছে; অতছ তাদের আলোচনার বিষয় বস্তু হয়তো ছিল এমন একান্ত সাধারণ যেক্ষেত্রে এরকম সন্দেহজনক আচরেনের কোনই প্রয়োজন ছিল না। আল্লাহ্‌র শত্রুরা যদি সত্যিই তাদের এসব সন্দেহজনক সাংকেতিক কথাবার্তা আড়ি পেতে শুনে থাকে তাহলে তারাও হয়তো বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিবে। হয়তো ভাববে যে এই সাংকেতিক কথাবার্তার পেছনে নিশ্চয়ই নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার আক্রমনের চেয়েও ভয়াবহ কোন আক্রমনের পরিকল্পনা লুকিয়ে আছে।

আমাদের বুঝা উচিৎ যে সন্দেহজনক ভঙ্গিতে কথা না বলে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলাই উত্তম; অকারণ সন্দেহ সৃষ্টি করা মোটেই ঠিক নয়। এতদসত্ত্বেও কিছু লোক আছে যারা বিনা কারণেই এমন সন্দেহজনক আচরণ করতে পছন্দ করে। দেখা যায় এদের কেউ হয়তো আপনাকে ফোন করে বললো যে ‘আপনার কাছে আমার একটা আমানত আছে’। হয়তো দেখা যাবে গুরুত্বপূর্ন আমানতটি হল এক প্যাকেট চকলেট বা কোন কাপড়-চোপড়, বা এক জোড়া সানগ্লাস যেটা তার থেকে আপনি হয়তো ধার নিয়েছিলেন; আর মহা গুরুত্বপূর্ন সেই কাজটি হল এক সাথে আনন্দ করে লাঞ্চ বা ডিনার করা। এরা অকারণ অস্পষ্টতা ও নাটকীয়তা কত ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। বিশেষ করে যাদের সাথে এভাবে কথা বলছে তারা যদি এমন ব্যক্তি হন যাদেরকে সরকারী গোয়েন্দারা পর্যবেক্ষন করছে, যাদেরকে আল্লাহ্‌র শত্রুরা মনিটর করছে।

এরা যদি অখনো কারাবন্দি হয় তাহলে শত কসম করে বললেও আল্লাহ্‌র শত্রুরা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না যে সেই আমানতটি ছিল একান্ত তুচ্ছ কোন জিনিস, আর সেই গুরুত্বপূর্ন কাজটা ছিল নিছক লাঞ্চ বা ডিনার। তারা একথা বললে কিছুতেই তাদেরকে ছাড়বে না, তারা তাদের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করবে, তাদের নখ উপড়ে ফেলবে যতক্ষন না তারা স্বীকার’ করবে যে তাঁদের অস্ত্রসস্ত্র ও গোলা বারুদের মজুদ কোথায় লুকানো আছে; যতক্ষন না তারা ‘গোপন সামরিক মিটিং’ কিংবা ‘সংগঠনের’ গুরুত্বপুর্ন তথ্য দেয়ার ব্যাপারে জবানবন্দি দিতে সম্মত হয় যা সেই সাংকেতিক কথার আড়ালে লুকিয়ে আছে।

কিছু লোক আছে যারা সামান্য নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়ার আগেই আল্লাহ্‌র শত্রুদের কাছে সব কথা গড়গড় করে বল দেয়, সবার কন্টাক্ট নাম্বার দিয়ে দেয় এবং অজুহাত দেয় যে তারা শুনেছে এক ধরনের প্রযুক্তি এসেছে যার সাহায্যে মানুষের কন্ঠস্বর সনাক্ত করা যায়, মিথ্যা শনাক্তকারী মেশীনের সাহায্যে কেউ মিথ্যা বললে তাও ধরে ফেলা যায় এবং আধুনিক প্রযুক্তি মাধ্যমে দুনিয়ার সকল ফোনের কথোপকথন রেকর্ড করা হয়… ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব হাইপোথেটিক চিন্তা করে গোয়েন্দাদের কাছে তারা মিথ্যা কথা বলাকে সমীচীন মনে করে না।

আমি বুঝি না এর চেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি আর কি কি হতে পারে যে আল্লাহ্‌র শত্রুরা তাকে শনাক্ত করতে পেরেছে এবং তারা এও বুঝতে পেরেছে যে সে তাঁদের কাছে মিথ্যা বলছে। নাকি সে তাঁদের থেকে নিরীহ সাধারণ ও অমায়িক ভদ্রলোক হওয়ার সার্টিফিকেট চায়! নাকি সে মিথ্যা বলতে লজ্জাবোধ করছে সেই সব লোকদের কাছে যারা সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিশ্বাসঘাতক ও পথভ্রষ্টকারী! [১৮] অথচ তার এই মিথ্যা হয়তো আল্লাহ্‌র দ্বীনের দাওয়াহ ও জিহাদকে আল্লাহ্‌র শত্রুদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করতে পারতো, তাকে ও তার দ্বীনী ভাইদেরকে তাদের যুলুম অত্যাচার থেকে বাঁচাতে পারতো। পক্ষান্তরে আল্লাহ্‌র শত্রুদের এই জঘন্য মিথ্যাচার তো দ্বীনের দাওয়াহকে বন্ধ ও জিহাদকে উৎখাত করার জন্য; তার দ্বীনী ভাইদের উপর দমন পীড়ন ও যুলুম নির্যাতন চালানোর জন্য।

এই হল আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ও আল্লাহ্‌র শত্রুদের ক্ষমতা সম্পর্কে অতিরঞ্জিত ধারনা পোষন করা, তাদেরকে খুব ভয় করা এবং তাদেরকে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে বোকার মতো অপ্রয়োজন অতি বাড়াবাড়ি করার পরিণাম।

এতো গেল আমাদের এক শ্রেণীর ভাইদের অবস্থা , অন্য দিকে রয়েছে আমাদের সে সব ভাইয়েরা যারা সাবধানতা অবলম্বন ও নিরাপত্তা ইস্যুকে মোটেই গুরুত্ব দেয় না। দেখা যায় যে তারা তাদের গুরুত্বপূর্ন গোপন তথ্য , গুরুত্বপূর্ন তারিখ ও স্থানের নাম, সংগঠনের সদস্যদের নাম ঠিকানা , তাদের পরিকল্পনা, তাদের অর্থের উৎস, খরচের খাত ইত্যাদি সব কোন রকম সিকিউরিটি কোড ছাড়াই প্রকাশ্যে ও সাধারণ বোধ্য ভাষায় বিস্তারিত লিখে রাখে; অথচ আমরা তথ্য প্রযুক্তির এমন উন্নতির যুগে বাস করছি যেখানে তথ্য গোপন রাখার অনেক রকম নিরাপদ ও আধুনিক পদ্ধতি আমাদের হাতের নাগালে রয়েছে। এসব ভাইদেরকে দেখা যায় সাংগঠনিক, নিরাপত্তা সংক্রান্ত বা গুরুত্বপূর্ন কোন বার্তা তার কাছে আসার পর সে সেটিকে দিনের পর দিন সপ্তাহের পর সপ্তাহ পকেটে নিয়ে ঘুরছে, কিংবা তার ঘরে হয়তো মাসের পর মাস বৎসরের পর বৎসর ধরে পড়ে আছে অথচ সে তা নষ্ট করে ফেলছে না [১৯]। যেন সে অপেক্ষা করছে কখন আল্লাহ্‌র শত্রুরা আকস্মিক তার বাড়িতে হানা দিবে আর দাবি করবে যে ‘ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা’ তারা নস্যাৎ করে দিয়েছে ; আর সেও অরক্ষিত অবহেলায় ফেলে রাখা তথ্যটির কারণে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তা অস্বীকার করার সুযোগ পাবে না , আর এটি তার বিরুদ্ধে ভয়াবহ সন্ত্রাসী কাজে সম্পৃক্ততার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

এর চেয়েও যে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে তা হল তার এই অসতর্কতার কারণে অনেক ভাইয়েরা গ্রেফতারের শিকার হতে পারে, দাওয়াহ ও জিহাদের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। এদেরকে দেখা যায় কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন ছাড়া নির্বিঘ্নে সবধরনের যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে চলছে, আর কেউ যদি তাকে সাবধান হওয়ার পরামর্শ দেয়, কোন মিটিং-এর বিষয়বস্তু গোপন রাখতে বলে, বার্তাটি পড়ার পর যদি চিরকুটটি ছিড়ে ফেলতে বলে, ভাইদের আসল নাম ঠিকানা না রাখতে বলে এবং তাকে সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে বলে সে তখন বিরক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত কএ, কল্যাণকামী ভাইদেরকে গালমন্দ করে; এমনকি এগুলোকে লজ্জাকর, দুঃখজনক ও কাপুরুষতা বলে আখ্যায়িত করে। [২০]

আমি জানি না তার মধ্যে কেমন প্রতিক্রিয়া হতো যদি সে আফগানিস্তানের সেই দৃশ্য দেখত যখন সাপের গর্তে ভরা এবং দুজন মানুষের জন্য জায়গা হয় না এমন সংকীর্ণ গুহার মধ্য তার অনেক মুজাহিদ ভাইদেরকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে।

সত্যিই এমন ব্যক্তিকে ভৎর্সনা করাটা কোন অন্যায় নয় যে দুর্দশায় পতিত হওয়ার একমাত্র কারণ হল আল্লাহ্‌র রসূলের জীবনী সম্পর্কে তার অসচেতনতা, আরাম-আয়েশ মধ্যে ডুবে যাওয়া, আল্লাহ্‌র দ্বীনের জন্য একজন সত্যিকার মুজাহিদ হিসেবে সৈনিক সুলভ জীবন যাপন থেকে দূরে থাকা এবং দুনিয়াদার সাধারণ মানুষদের মতো তাগুতদের প্রচারিত তথাকথিত নিরাপদ জীবনের কুহেলিকায় ডুবে থাকে।

কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ তিতিক্ষা এবং সাধনা করে সফলতার দ্বার প্রান্তে আনা অনেক পরিকল্পনা কেবল এই অসতর্কতা, অসাবধনতা ও বেখেয়ালীপনার কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং মুসলিমদেরকে হতাশার মধ্যে ফেলেছে; একই সাথে আল্লাহ্‌র শত্রুওদের জন্য এ ঘটনা বয়ে এনেছে এক মহা আনন্দ বার্তা, তারা এটাকে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে’ তাদের নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিরাট সাফল্য হিসেবে জনগণের সামনে তুলে ধরেছে। অথচ বাস্তবে বিষয়টি হয়তো মোটেই তা নয়, এই ব্যর্থতা আল্লাহ্‌র শত্রুদের গোয়েন্দাদের কোন সফলতা ছিল না, বরং এটা ছিল ভাইদের অসতর্কতা, অসাবধানতা ও নিরাপত্তা ইস্যুকে যথাযথ গুরুত্ব না দেয়ার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি [২১]

আমার সত্যি কষ্ট হয় যখন দেখি অনেক যুবকেরা এ বিষয়ে উপদেশ গায়ে মাখে না, অন্যদের ভুল থেকে শিক্ষা নেয় না [২২] এবং একই ভুল বারাবার করতে থাকে; আর একারণে একই পরিণতি শিকার হয় [২৩] । এদের কেউ যখন জিহাদে অংশগ্রহন করার নিয়ত করে বেং এ উদেশ্যে যদি কিছু অস্ত্রশস্ত্র এদের হস্তগত হয় তাহলে সে অন্যদের কাছে কেবল অস্ত্রের কথা বলেই ক্ষান্ত হয় না বরং তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও জিহাদের পরিকল্পনা ইত্যাদি বলতে গর্ব বোধ করে। তারপর যখন আকস্মিকভাবে তাকে তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কিংবা তার বাড়ি রেইড দেয়া হয় তখন সে ভাবে কিভাবে তার পরিকল্পনা তারা জেনে গেল।

এটা সত্যি দুঃখজনক যে আমরা দ্বীনী বিষয়ে যে নিয়ম শৃঙ্খলা পালন করতে পারি না, দেখা যায় দুনিয়াবি বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন সে নিয়মে শৃঙ্খলা মেনে চলে [২৪] । সশস্ত্র সংগঠনের নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলা, গোপন সংগঠনের মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা অনেক সচেতন। আপনি দেখবেন কোন অপারেশন চালানোর ক্ষেত্রে তারাও চূড়ান্ত গোপনীয়তা বজায় রাখে, তারা কাউকে কিছু জানায় না, এমনকি স্বয়ং যারা অপারেশন চালাবে তাদেরকেও প্রয়োজনের চেয়ে বেশী কিছুই বুঝতে দেয়া হয় না। অপারেশনে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কেও কাউকে কিছু টের পেতে দেয় না, এমন কি কোথায় অপারেশনচালাবে তাও জানানো হয় কেবল অপারেশনের একান্ত পূর্ব মুহূর্তে। যারা অপারেশন চালায় তারা পর্যন্ত প্রয়োজনের চেয়ে কিছুই জানে না, অপারেশন বাস্তবায়নের জন্য ঠিক যতটুকু না জানলেই নয় ঠিক ততটুকুই কেবল জানে। তারা জানে না অর্থায়ন কে করে, অস্ত্র কোত্থেকে আসে, অস্ত্রের মজুদ কোথায় , কে এটা আমদানি করেছেন, কে বহন করে এনে দিয়েছে, অন্য সদস্যরা অন্য কোথাও আক্রমনের প্রস্তুতি নিচ্ছে কি না। এধরনের প্রতিটি স্তর হল একেকটা নিরাপত্তা চাদর; এসব বিশেষ তথ্যের ব্যাপারে সংগঠনের কোন সদস্যের উচিৎ নয় অযাচিত প্রশ্ন করা কিঙ্গা অনাধিকার চর্চা করা। যে ব্যক্তি তার নিজ সামরিক কার্যক্রমের প্রতি শ্রদ্ধা রাখে যে কিছুতেই এ ধরণের স্পর্শকাতর তথ্য যাকে না জানালেই নয় তাকে ছাড়া অন্য কাউকে দিতে পারে না। একারণে দেখা যায় এই ধরণের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করে যেসব অপারেশন পরিচালনা করা হয় তার ব্যর্থতার আনুপাতিক হার খুবই কম। অন্য দিকে দেখা যায় সশস্ত্র সংগঠনের নিয়ম শৃঙ্খলার কঠোরতা সম্পর্কে কোন ধারণা না দিয়ে দরবেশ গোছের বোকা ও নির্বোধ লোকেরা এসব সংগঠনে যোগ দিয়ে এমন ভয়াবহ রকম আত্নঘাতী ভুল করে বসে যে তার কারণে গোটা সংগঠনের কার্যক্রম ও এর সদস্যদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে যায়। অথচ নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষা, সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহ্ন, সাবধানতা অবলম্বন ও গোপনীয়তা বজায় রাখা ইত্যাদি ক্ষেত্রে গোটা মানব্জাতির সামনে মুসলিমদের হওয়া উচিৎ ছিল অনুসরনীয় আদর্শ। কেননা তাদের মহান আদর্শ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সাহাবিদের জীবনে এ বিষয়ের উপর শিক্ষণীয় এতো উদাহরণ রয়েছে যা গুনে শেষ করা যাবে না; যার কয়েকটি আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। আসলে আল্লাহ্‌র পথে জিহাদের জন্য প্রয়োজন চিতাবাঘের মত ক্ষিপ্র ও বাজ পাখির মতো দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষের; সুফী দরবেশের আর তোতা পাখির কোন প্রয়োজন এখানে নেই।

অসাবধানতার আর একটি উদাহরণ হল জাহেলী সময়ের মতো অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। অনেক যুবককে আল্লাহ্‌ তা’য়ালা তাকে হিদায়েত দান করার পরও দেখা যায় জাহেলী সময়ে সে যেমন অস্ত্রের বড়াই দেখিয়ে বেড়াতো তেমনি এখনো সে একই রকম আচরণ করে যাচ্ছে। আগেও যেমন প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াতো এখনো তেমনি করে চলছে। সে জানে না তার পূর্বেকার জীবনের সাথে এই জীবনের কতো বিস্তর ফারাক রয়েছে, সে জানে না আল্লাহ্‌র শত্রুরা তাকে আগে যে দৃষ্টিতে দেখত এখন তার মুখে দাঁড়ি গজানোর পর কিন্তু আর সেই একই দৃষ্টিতে দেখবে না। সে নতুন যে সব লোকের সাথে এখন চলা ফেরা করে, যাদের সাথে যোগাযোগ রাখে তাদের সংস্পর্শে আসার পর আল্লাহ্‌র শত্রুদের দৃষ্টিভঙ্গি তার ব্যাপারে সম্পূর্ন পরিবর্তন হয়ে যাবে। অথচ এদেরকে যদি সাবধানতা অবলম্বনের উপদেশ দেয়া হয় এরা সাবধানতাকে কাপুরুষতা ও দুর্বলতা বলে উড়িয়ে দেয়। এরপর এই অসাবধানতার কারণে যখন সে জেলে যায়, রিমান্ডের মুখোমুখি হয় তখন আর বিষয়টি সাধারণ থাকে না; [২৫] এ ধরণের লোকেরা যখন একবার বিপদে পড়ে তখন মানসিক দিক থেকে একেবার ভেঙ্গে পড়ে। এরপর এই ‘দুঃসাহসী বীর বাহাদুররা’ তাদের নিজ ছায়াকেও ভয় পেতে শুরু করে, জিজ্ঞাসাবাদের আধুনিক প্রযুক্তির সামনে একাবারে ভেঙ্গে পড়ে, আল্লাহ্‌র শত্রুদের চতুর গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের ক্ষমতার সামনে একাবারে কুঁচকে যায়। সে তার নিজের অসাবধানতা ও বোকামির কথা ঢাকতে গিয়ে আল্লাহ্‌র শত্রুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, তাদের গোয়েন্দা সংস্থার চতুরতা ও ক্ষমতার গুণকীর্তন আরম্ভ করে দেয়।

চূড়ান্ত কথা হল সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বনকে যেমন মোটেই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই তেমনি অতি সতর্কতার নামে আল্লাহ্‌র পথে জিহাদ ছেড়ে দিয়ে স্থবির হয়ে বসে থাকারও কোন সুযোগ নেই। বরং সকল ক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত মধ্যম পন্থা অবলম্বনই বাঞ্ছনীয়। এ পথের সঙ্গীদেরকে জিহাদের রক্ত পিচ্ছিল পথ পাড়ি দিতেই হবে; অতএব তাদে শত্রুদের পরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে শিথিলতা ও বাড়াবাড়ি উভয় প্রান্তিকতাকে প্রিহার করে যথাযথ নিরাপত্তামূলক সতকর্তা ও সাবধানতা অবলম্বনের কোন বিকল্প নেই।

আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করি যেন তিনি তার বন্ধুদের বিজয় দান করেন এবং তা শত্রুদের লাঞ্চিত করেন।

আল্লাহ্‌ তা’য়ালা তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সব সময়ই বিজয়ী, যদিও অধিকাংশ মানুষই তা জানে না।

(সূরা ইউসুফ, আয়াত ২১)


[১] শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রহঃ বলেন জিহাদ সংশিষ্ট বিষয়ের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে এটা শুধু বৈধই নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে দ্বীনের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে বাহ্যিক বেশভূষা ও চালচলনে কাফিরদেরকে অনুকরণ কয়া বাধ্যতামূলক। বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কাফিরদের অনুকরণের বৈধতা প্রসঙ্গে যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে তা ছিল হিজরতের পূর্বে এবং পরবর্তীতে তা মানসুখ হয়ে গেছে; কেননা তখন পর্যন্ত ইহুদীরা তাদের বেশভূষা , পোশাক-পরিচ্ছদ, হেয়ার স্টাইল কিংবা প্রতীকিভাবেও মুসলমানদের থেকে আলাদা স্বকীয়তা প্রকাশ করতে তৎপর হয়ে ওঠেনি। অতঃপর বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ, চালচলন ও বেশভূষা সকল ক্ষেত্রে কাফিরদের বিরোধিতা ও নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে চলার হুকুম আসলো হিজরতের পরে। আর মুসলিম জাতির মাঝে বিষয়টি ব্যাপকভাবে বিকশিত হয় ওমর রাঃ এর সময় থেকে। এ হুকুম হিজরতের পরে আসার কারণ হল দ্বীনের প্রভাব প্রতিপত্তি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, জিহাদের আমল আরম্ভ করা, তাদেরকে নত করে তাদের উপর জিযিয়া করা আরোপ করা ছাড়া কাফিরদের বিরোধিতা করে নিজেদের সম্পূর্ন স্বকীয়তা বজায় রেখে চলা অনেক ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব। একারণে শুরুর দিকে মুসলিমরা যখন দুর্বল ছিল তখন তাদের উপর এ হুকুম আরোপ করা হয়নি। অতঃপর আল্লাহ্‌র দ্বীন যখন স্ব মহিমায় নিজ প্রভাব নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেতখনই কেবল এই হুকুম এসেছে।

বর্তমান যুগের প্রেক্ষাপটে এর একটি উদাহরণ হল; এখনকার সময় যদি কোন মুসলিম কোন দারুল হারবে কিংবা দারুল হারবে থাকে তাহলে তাঁর উপর এটা ফরয নয় যে বেশভূষা চালচলনে তাকে স্কল ক্ষেত্রে কাফিরদের থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলতে হবে; কেননা তাঁর জন্য তা অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়াতে পারে । বরং দ্বীনী কল্যাণ থাকলে অনেক ক্ষেত্রে তাদের সাথে বাহ্যিকভাবে তাল মিলিয়ে চলা মুস্তাহাব, এমনকি অনেক সময় ওয়াজিবও হয়ে দাঁড়ায়; যদি এর মধ্যে দ্বীনী কল্যাণ থাকে। যেমন মুসলিমদেরকে তাদের চক্রান্ত ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচানোর জন্য তাদের মধ্যে গোয়েন্দাগিরী করা এবং দ্বীনী দিক থেকে কল্যাণকর এমন যে কোন প্রয়োজনে। তবে আল্লাহ্‌ তা’য়ালা যে দেশে তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করেছেন এবং কাফিরদের উপর অপমান ও জিযিয়া কর চাপিয়ে দিয়েছেন সে দেশে প্রকাশ্যে কাফিরদের বিরোধিতা করা এবং সকল দিক থেকে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে চলা ওয়াজিব। (ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম ১/৪১৮-৪১৯, তাহকীক শায়খ নাসীর আল আকল)

কারাবন্দী আপোষ হীন মুজাহিদ নেতা শায়খ আব্দুল আকদির বিন আব্দুল আযিয (আল্লাহ্‌ তাকে দ্রুত মুক্ত করুন) এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, এই গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে ইসলামের নীতি শরীয়তের সুস্পষ্ট দলীল দ্বারা প্রমানিত। এর দ্বারা সে সব লোকের বক্তব্যও বাতিল হয়ে যায় যারা দাবী করে যে ইসলামে গোপন সংগঠন করা বৈধ নয়। এটা খুবই দুঃখজনক দাওয়াহর কাজে নিয়জিত অনেক লোকেরাও গোপনীয়তা রক্ষা করার ব্যাপারে বিরুপ মন্তব্য কর থাকে। তাদের এই বিরুপ মন্তব্য প্রমাণ করে যে আল্লাহ্‌র পথে জিহাদ করার ব্যাপারে আল্লাহ্‌ তা’য়ালা প্রস্তুতি গ্রহন করার যে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর বাস্তবতা তারা মোটেই অনুধাবন করতে পারেনি। আল্লাহ্‌ তা’য়ালা বলেন, তারা যদি জিহাদের পথে বের হতে চাইত তাহলে তারা অবশ্যই কিছু না কিছু প্রস্তুতি গ্রহন করে রাখত । (সূরা আত-তাওবা , আয়াত ৪৬)

 

[২] ইমাম বায়হাকী তার শুয়াবুল ঈমান এবং ইমাম তাবরানী তার মু’জামুল কাবির গ্রন্থে হাদিসটি সংকলন করেছেন এবং ইমাম আলবানী তার সহিহ আল জামে ও সিলসিলাতুস সাহীহার মধ্যে হাদিসটিকে সহীহ সাব্যস্ত করেছেন।

[৩] এ বক্তব্যের পক্ষে জলন্ত প্রমাণ হিসেবে আমাদের সামনে রয়েছে বিভিন্ন সহীহ হাদীস ও সীরাত গ্রন্থে বর্ণিত নাঈম বিন মাসঊদ রাঃ এর ঘটনা। ঘটনাটি খন্দক যুদ্ধের সময়ের। এ যুদ্ধের মদীনার মুনাফিক ও ইহুদীরা মক্কার কাফিরদের সাথে এই মর্মে কোয়ালিশন করে যে তারা তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগিতা করবে। নাঈম বিন মাসউদ রাঃ তখনও পর্যন্ত ইসলাম গ্রহন করেছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন কুফফারদের এই কোয়ালিশনের মদীনা পক্ষের একজন গুরুত্বপূর্ন সদস্য। আল্লাহ্‌ তা’য়ালা এই সময়ে তার অন্তরে হিদায়েত ঢেলে দেন এবং তিনি গোপন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে ইসলাম গ্রহনের ঘোষনা দেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে তার ইসলাম গ্রহনের কথা গোপন রাখার নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি যদি আমাদের মাঝে থাকতে চাও থাকতে পারো, তবে (উত্তম হবে) তুমি তাদের মাঝে ফিরে যাও এবং তাদের মধ্য থেকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো; তোমার পক্ষে যতদূর সম্ভব তাদের মধ্যে থেকে তাদেরকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দাও; মনে রাখবে যুদ্ধ মানেই হল ধোঁকা। এ কালের সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য সীরাত গ্রন্থ আর-রাহীকুল মাখতুমের বক্তব্য অনুযায়ী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিমদেরকে সাহায্য করার জন্য সম্ভাব্য যে কোন রণকৌশল প্রয়োগের জন্য তাহে উৎসাহ দেন। এরপর তিনি ফিরে গিয়ে কুফফার কোয়ালিশনের প্রধান তিন পক্ষ কুরায়শ গাফতান ও ইহুদীদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলেন। তিনি বনু কুরায়যার প্রধানের সাথে সাক্ষাত করে বলেন যে কুরায়শদেরকে কিছুইতেই বিশ্বাস করবেন না, যদি তারা কাউকে আপনাদের কাছে যামিন না রাখে। তিনি তাদের নিজেদের পরামর্শ সভায় দাবী করেন যে কুরায়শরা যদি বুঝতে পারে যে মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর বিজয় লাভ করা সুদূর পরাহত তাহলে তারা তাদেরকে ফেলে চলে যাবে এবং মুসলমানরা তখন তাদেরকে একা পেয়ে তাদের উপর ভয়ানক প্রতিশোধ নিবে। এরপর নাঈম বিন মাসউদ রাঃ কুরায়শ বাহিনীর কাছে গিয়ে একই রকম কৌশল প্রয়োগ করেন, তিনি তাদেরকে বলেন যে তার মনে হচ্ছে ইহুদীরা মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করে এখন অনুতপ্ত , তারা এখন নিয়মিত তাঁর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। তারা তাঁর সাথে একটা চুক্তি করেছে যে তোমাদের থেকে জামিন স্বরূপ কয়েকজন লোককে নিয়ে তারা তাদেরকে মুসলমানদের কাছে হস্তান্তর করবে। নাঈম রাঃ কুরায়শদেরকে কিছুতেই জামিনদার না পাঠাতে পরামর্শ দেন। একইভাবে এরপর তিনি গাফতান গোত্রের কাছে গিয়েও একই কৌশল প্রয়োগ করেন। এরপর ৫ই শাওয়াল শনিবার কুরায়শ ও গাফতান উভয় গোত্র ইহুদীদের কাছে এই মর্মে বার্তা দিয়ে প্রতিনিধি পাঠায় যে তারা যেন মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে মদিনার ভেতর থেকে যুদ্ধ আরম্ভ করে। এর উত্তরে ইহুদীরা জানিয়ে দেয় যে তারা (তাদের ধর্মিয় নিষেধাজ্ঞার কারণে) শ্নিবার যুদ্ধ করতে পারবে না এবং আরও জান্য যে তারা যে তাদেরকে বিপদে ফেলে পালিয়ে যাবে না তাঁর গ্যারান্টি হিসেবে কয়েকজন জামিনদার রাখার শর্ত বাদ দিতে বলে। এভাবে তিন পক্ষের মধ্যে আস্থার সঙ্কট তৈরী হয়, একে অপরের অবিশ্বাস ও সন্দেহ করতে আরম্ভ করে, তাদের কোয়ালিশন ভেঙ্গে যায় এবং এভাবে তাদের নৈতিক ভিত্তি ভেঙ্গে ধুলোয় মিশে যায় এবং নাঈম বিন মাসউদ রাঃ এর পরিকল্পনা সফল হয়।

এভাবে গোয়েন্দাবৃত্তির ব্যবহারের আরো একটি উদাহরন পাওয়া যায় এই একই যুদ্ধে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান রাঃ কে এ কাজে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। এ ধরনের সিদ্ধান্তকর মুহূর্তে যুদ্ধের ফলাফল নিয়ন্ত্রনে গোয়েন্দা তথ্যের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ন। প্রতিরোধ যুদ্ধের এই পর্যায়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে ভাবলেন যে তিনি হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান রাঃ এর বিশেষ বুদ্ধিমত্তা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবেন।তিন পরবর্তী পধক্ষেপ গ্রহনের পূর্বে শত্রু শিবিরের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে রাতের আঁধারে হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামানকে তাদের মধ্যে পাঠিয়েছিলেন।

[৪]আল্লাহ্‌র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই নীতিই আধুনিক বিশ্বে নিরাপত্তা, গোয়েন্দা ওসামরিক বাহিনীতে principle of the need to know basis হিসেবে সবিশেষ পরিচিত, যার অর্থ হলো প্রত্যেক সদস্য কেবল ততটুকু জানবে যতটুকু তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য জানা প্রয়োজন। মুজাহিদদের জন্য নিরাপত্তা বিশ্লেষনধর্মী প্রতিষ্ঠান আবু যুবায়দা সেন্টার কর্তিক প্রকাশিত Encyclopedia of Security তে এ বিষয়ে একটি বিশ্লেষন রয়েছে, পাঠকদের জন্য আমি তাঁর কিছু অংশ তুলে ধরছি-

“ নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মানুষদেরকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এর প্রথম শ্রেণী হল যারা মুসলিম ও মুজাহিদ- (আর এখানে আমরা কেবল এই শ্রেনী সম্পর্কেই আলোচনা করব)- যারা আল্লাহ্‌র দ্বীনের বিজয়ের জন্য সক্রিয়ভাবে আল্লাহ্‌র হুকুম ও রসূলের সুন্নাহ মোতাবেক কাজ করছে, এদের মধ্যে যে নীতি অবলম্বন করা বাধ্যতামূলক তা হল ‘কেবল একান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যই প্রত্যেকে জানবে’। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ইসলামের সৌন্দর্যসমূহের মধ্যে একটি সৌন্দর্য হল কোন ব্যক্তি এমন বিষয়ে মাথা ঘামাবে না যে বিষয়ে তাঁর সংশ্লিষ্টতা নেই’। ( হাদিসটি ইমাম তিরমিযি রহঃ বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম নববী এটিকে হাসান সাব্যস্ত করেছেন) একারণে মুজাহিদ সংগঠনের প্রত্যেক সদস্যকে এমন তথ্য থেকে দূরে রাখা উচিত যা তাঁর জানার প্রয়োজন নেই। আর যাকে কাজের প্রয়োজনে তথ্য সরবরাহ করা হবে তাকেও ঠিক ততটুকু তথ্য দেওয়া হবে তার কাজটি সমাধান করার জন্য যতটুকু একান্ত জরুরী। আর কোন সদস্যের উচিত নয় দায়িত্বশীলদের কাছে এমন কিছু জানতে চাওয়া যেটা তার জানার কোন প্রয়োজন নেই। একইভাবে দায়িত্বশীলদেরও উচিৎ নয় কাউকে এমন কিছু জানান যা তার জানার কোন প্রয়োজন নেই। সংগঠনের প্রত্যেকের উচিৎ নিষ্প্রয়োজন তথ্য জানা থেকে দূরে থাকা, কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে হয়তো আমাদের মনে হতে পারে যে এটা ক্ষতির কারণ নয় কিন্তু পরবর্তীতে হয়তো দেখা যাবে এটাই ভয়াবহ কোন সমস্যার কারণ হয়ে দাড়াতে পারে।

 

সারসংক্ষেপঃ (১) কাউকে নিষ্প্রয়োজন তথ্য প্রদান থেকে বিরত থাকা। (২) যাকে তথ্য দেয়া হবে তাকে কেবল ততটুকুই দেয়া হবে যতটুকু এই মুহূর্তে তার প্রয়োজন , পরবর্তীতে প্রয়োজন সাপেক্ষে বাড়তি তথ্য প্রদান করা হবে। বিষয়টির অধিকতর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আমরা ধরে নিলাম যে কোন একটি সংগঠনের যদি একজন আমীর থাকে আর তিনি যদি সংগঠনের কোন সদস্যকে দায়িত্ব দেন কোন অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের , তাহলে তার উপর অর্পিত দায়িত্বের বাইরে অন্য কোন বিষয়ে জানার প্রয়োজন তার নেই। একজন অর্থ সগ্রহকারীর নিশ্চয়ই জানার প্রয়োজন নেই কবে কোথায় কখন বা কে অপারেশন চালাবে, বা কে অস্ত্রের চালান এনে দিবে, গোলা বারুদ কোথায় মজুদ রাখা হবে ইত্যাদি। একইভাবে যারা অপারেশন পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট তাদেরও জানার প্রয়োজন নেই কে অর্থের যোগান দিচ্ছে। কারো উপর যদি একাধিক দায়িত্ব অর্পিত হয় তাহলে সেও কেবল তার উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ পালনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যই পাবে। তারপরও বলবো, আমরা এখানে প্রাথমিক পর্যায়ের ভাইদেরকে সংক্ষিপ্ত ও সামগ্রিক একটা ধারনা দেয়ার চেষ্টা করলাম মাত্র, যারা দায়িত্বশীল তাদেরকে গভীর জ্ঞানের অধিকারী এবং পূর্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়া উচিৎ যাতে তারা তাদের স্থান কাল পাত্র ও অবস্থা বিশ্লেষন করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে পারে। সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম বর্ণিত এক হাদিসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ ও আখিরাতে উপর ঈমান রাখে তার উচিৎ হয় সত্য সঠিক কথা বলা অথবা চুপ থাকা’। সহিহ মুসলিমে বর্ণিত অন্য এক হাদিসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে, ‘একজন মানুষ মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়’। আর এটা একটা প্রমানিত সত্য যে, যে ব্যক্তি বেশী কথা বলে সে বেশী ভুল করে।

শায়খ আবু যুবায়দার পরিচয়ঃ উল্লিখিত শায়খ আবু যুবায়দা হলেন জিহাদী কার্যক্রম ও অপারেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিরপত্তা বিশ্লেষনে একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি কয়েক যুগ ধরে মুজাহিদদেরকে খুবই গুরুত্বপূর্ন লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়েছেন। তার সুগভীর বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনার মাধ্যম হাজার হাজার মুজাহিদগণ আফগানিস্তানে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। তার সম্পর্কে পরবর্তীতে বিভিন পত্র পত্রিকা যে রিপোর্ট করেছে তার সার সংক্ষেপ হলঃ ‘তিনি ছিলেন আল কায়েদার সেই সব সুচতুর নেতাদের অন্যতম যারা ছিলেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে, সাধারণতঃ কোথাও তার ছবি দেখা যেতনা। তিনি যখন তখন দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানো সত্ত্বেও তার গ্রেফতারের পূর্বে সি ও আই এস আই এর পরিচালিত এক যৌথ অভিযানে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদের একটি এপার্টমেন্ট থেকে ২০০২ সালের ২৮ মার্চ ভোর রাত তিনটার সময় তিনি গ্রেফতার হন। লস এঞ্জেলস এয়ার পোর্টে হামলার দায়ে অভিযুক্ত রেসাম এর বক্তব্য মতে শায়খ আবু যুবায়দা ছিলেন মুজাহিদদের ট্রেনিং ক্যাম্পের দায়িত্বশীল, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যুবকদের কাকে কোথায় পাঠানো হবে সে সিদ্ধান্তও তিনি দিতেন, বিশেষ অপারেশনের জন্য কাকে গ্রহন করা হবে কাকে হবে না তাও তিনি বাছাই করতেন, কোন ক্যাম্পে কতো জন থাকবে তার সংখ্যাও তিনি নির্ধারণ করতেন। শায়খের সংস্পর্শে ছিলেন এমন এক ভাই আমাদেরকে বলেন যে নিরাপত্তা বিষয়ক ব্যপারে আল্লাহ্‌ তা’য়ালা তাকে বিশেষ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছেন। তিনি এতটাই চতুর যে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকেও তিনি ঘোল খাইয়ে দিয়েছেন, তিনি তাদের চোখে ধুলা দিয়ে ইসরাইলে ঢুকে সফলভাবে অপারেশন পরিচালনা করা আবার নিরাপদে বেরিয়ে এসেছেন কিন্তু তারা তার টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি। আমরা অন্তরে অন্তস্তল থেকে আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করি যেন তিনি আবার তাকে মুক্ত করে আমাদের মুজাহিদদের মাঝে ফিরিয়ে আনুন, আমীন।

[৫] অনেক সময় দেখা যায় যে দায়িত্বশীলগণ যদি কারো থেকে কিছু গোপন রাখেন তাহলে কোন কোন অতি উৎসাহী ভাইয়েরা তাদের মাথা নষ্ট করে ফেলেন। বোকার মতো বলতে থাকেন, ‘আরে ভাই আমাকে বিশ্বাস করেন না! আল্লাহ্‌র কসম করে বলছি আমি কাউকে বলবো না, আমাকে ঘটনাটি খুলে বলুন’। শুধু এতটুকুতেও তারা ক্ষান্ত হয় না, বরং যারা কিছু গোপন রাখে তাদের ব্যাপারে অবিশ্বাস, সন্দেহ পোষন ও আস্থাহীনতার অভিযোগ করতে আরম্ভ করে। অথচ বিষয়টি মোটেই তা নয় যা সে ভাবছে; তারা তাঁর প্রতি নিখাদ আস্থা বিশাস পোষণ করা সত্ত্বেও তাঁর ও তাঁর ভাইদের নিরাপত্তার কারণেই যে কেবল তাঁর থেকে বিশেষ কোন তথ্য গোপন করা হচ্ছে তা বুঝতেই চায় না। অতএব এমন বিষয়ে কখনো তথ্য গোপনাকারী ভাইদেরকে দোষারোপ করা বৈধ নয়। লেখক এখানে আল্লাহ্‌র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক তাঁর সাহাবাদের থেকে এমনকি স্বয়ং মুজাহিদদের থেকে তথ্য গোপন করার যে দলীল পেশ করেছেন তাতে কি প্রামাণিত হয় ? সাহাবীদের কেউ কি আল্লাহ্‌র রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একারণে দোষারোপ করেছেন ? কিংবা তাঁর তথ্য গোপন রাখা কি তাঁর মহান আত্নত্যাগী সাবাহীদের প্রতি তাঁর অবিশ্বাস প্রমাণ করে ? কক্ষনোই নয় ! অতএব হে ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ ভাইয়েরা ! বিষয়টি নিয়ে একটু গভীরভাবে ভাবুন।

[৬] বরং তথ্য গোপন রাখার জন্য প্রয়োজনে নিজেকে হত্যা করে ফেলাও অনেক ক্ষেত্রে বৈধ। এ বিষয়ের উপ্র আত তিবইয়ান পাবলিকেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘The Ruling Regarding Killing Oneself to Protect Information’ নামে একটি খুবই চমৎকার বই রয়েছে। পাঠকগণ বইটি পড়ে নিতে পারেন।

[৭] নির্ভরযোগ্য সীরাত গ্রন্থ আর রাহীকুল মাখতুমের ভাষ্য অনুযায়ী মক্কার কাফিররা যখন ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক সিদ্ধান্তটি গ্রহন করলো তখন জিবরীল আঃ কে পাঠিয়ে মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কুরায়শের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করা হয় এবং তাকে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরতের অনমুতি দেয়া হয়। তিনি তাঁর হিজরতের সময় নির্ধারণ করে দেন এবং তাকে সে রাতে নিজ বিছানায় ঘুমাতে নিষেধ করেন। এরপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুপুরের সময় আবু বকর রাঃ এর সাথে সাক্ষাত করতে যান হিজরতের যাবতীয় বিষয় নির্ধারণ করার জন্য। আবু বকর রাঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই অসময় আগমন এবং তাঁর মুখ ঢাক দেখে কিছুটা বিস্মিত হন। পরক্ষণেই তিনি জানতে পারেন যে আল্লাহ্‌র অনুমতি এসে গেছে এবং তিনি প্রস্তাব করেন যে তারা দু’জন একত্রে হিজরত করবেন। যাত্রার সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী রাঃ কে আল্লাহ্‌র তরফ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিএ তাঁর বিছানায় চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকতে বলেন। এরপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ঘর থেকে বের হয়ে হাতে এক মুঠো ধুলা নিয়ে সূরা ইয়াসিনের নয় নাম্বার আয়াতটি পাঠ করে ঘাতকের দিকে নিক্ষেপ করে তাদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে পড়েন অথচ তারা কিছুই টের পেল না।

[৮] আর রাহিকুল মাখতুমের বর্ণনা মতে তারা শুক্র , শনি ও রবি এই তিন রাত পর্যন্ত সে গুহায় আত্নগোপন করে থাকেন। আবু বকর রাঃ এর পুত্র আব্দুল্লাহ প্রতিদিন অন্ধকার নেমে আসার পর তাদের কাছে এসে মক্কার সর্বশেষ পরিস্থিতি তাদেরকে অবহিত করতেন; আবার ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই তিনি মক্ষায় ফিরে এসে সবার সাথে এমনভাবে মিশে যেতেন যে তারা তাঁর এই গোপন কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুই আঁচ করতে পারত না। এদিকে কুরায়শরা যখন মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আবু বকর রাঃ এর তাদেরকে ফাকি দিয়ে চলে যাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হল তখন তারা ভয়ানক ক্রোধ ও আক্রোশে ফেটে পড়লো। তারা আল্লাহ্‌র রসূলের বিছানায় শুয়ে থাকা আলী রাঃ কে কাবার চত্ত্বরে ধরে এনে তাদের দু’জন সম্পর্কে তথ্য বের করার জন্য তাকে বেদম প্রহার করল; কিন্তু তাতে কোনই লাভ হল না।

[৯] আল কায়েদার সিনিয়র কমান্ডার সায়ফ আল আদল (আল্লাহ্‌ তাকে রক্ষা করুন) এবং অন্য আরেক জন কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক আল আমান ওয়াল ইস্তিখারা নামক গ্রন্থে হিজরতের ঘটনা থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন শিক্ষণীয় বিষয়কে একত্রে সন্নিবেশিত করেছেন । যেম্নঃ-

১) আলী রাঃ কে আল্লাহ্‌র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছানায় শুইয়ে দেয়া হয়েছিল কাফির শত্রুদেরকে প্রতারিত করার জন্য।

২) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকরের কাছে আসেন দুপুরের বিশ্রাম নেয়ার সময়ে যখন খুব কম মানুষই ঘরের বাইরে থাকে।

৩) তারা আবু বকর রাঃ এর ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সদর দরজা দিয়ে বের না হয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়েছেন যাতে তাদেরকে কেউ দেখতে না পারে।

৪) তারা সরাসরি মদিনার দিকে না গিয়ে প্রথমে গিয়ে গুহায় আত্নগোপন করেন, শত্রুরা যদি মদিনার দিকে যাওয়ার রাস্তায় ওঁত পেতে থাকে তা থেকে নিজেদেরকে রক্ষার জন্য।

৫) তারা আত্নগোপনের জন্য যে গুহাটি বাছাই করেন সেটিও মদিনা যাওয়ার দিকে ছিল না বরং গুহাটি ছিল অন্য দিকে, এর উদ্দেশ্য ছিল শত্রুরা যাতে তাদেরকে অনুসরণের ব্যাপারে ধোঁকার মধ্যে পড়ে যায়।

৬) মক্কার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার জন্য আব্দুল্লাহ বিন আবু বকরের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত ছিল।

৭) আসমা বিনতে আবু বকরের মাধ্যমে তাদের নিরাপদ রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছিলো।

৮)আব্দুল্লাহ ও আসমা বিনতে আবু বকরের পদচিহ্ন মুছে ফেলার জন্য আমীন বিন ফুহায়রা এক অসাধারণ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করত। তাদের দু’জনের আসা যাওয়ার পর তাদের পদচিহ্নের উপর দিয়ে গাধার পাল চালিয়ে নিয়ে যেত যাতে তাদের পদচিহ্নগুলি একেবারে মুছে যায়।

৯) শত্রুদের হাতে গ্রেফতার এড়ানো এবং তাদেরকে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার জন্য তারা একাধারে তিন দিন পর্যন্ত গুহায় অবস্থান করেন।

১০) তারা তাদের এই গোটা সফর জুড়ে কাফিরদেরকে ধোঁকা দিয়ে যাওয়া এবং গোপনীয়তা বজায় অব্যাহত রাখেন। যেমন আল্লাহ্‌র রসূলকে দেখিয়ে এক ব্যক্তি আবু বকরকে যখন জিজ্ঞাসা করেছিল যে ইনি কে ? তিনি বলেছিলেন ইনি আমার গাইড বা পথ প্রদর্শক। লোকটি ভেবেছিল চলার রাস্তা প্রদর্শক অথচ তিনি বুঝিয়েছেন আল্লাহ্‌র দ্বীনের দিকে পথ প্রদর্শক। আর সব শেষে এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে তাদের আত্নগোপনের গুহার অবস্থান সম্পর্কে কেবল আব্দুল্লাহ তাঁর বোন আয়িশা ও আসমা রাঃ এবং তাদের ভৃত্য আমীন বিন ফুহায়রা ব্যতিত অন্য কেউ কিছুই জানত না।

 

[১০] এই অধ্যায়ে আবু হুরায়রা ও জাবির বিন আব্দুল্লাহ রাঃ এর বর্ণনায় আল হারবু খিদা’উন মর্মে যে হাদিসটি রয়েছে এর ব্যাখ্যায় ইমাম নববী রহঃ তাঁর সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন, পূর্বে সম্পাদিত নিরাপত্তা চুক্তি ভঙ্গ করা ব্যতীত যে কোন উপায়ে যুদ্ধে কাফিরদেরকে ধোঁকা দেয়ার বৈধতার আওতায় আধুনিক যুগের যে কোন প্রকারের উপায় উপকরণ অবলম্বন শামিল। যেমন ডকুমেন্টস জালিয়াতি, ভুয়া পরিচয় পত্র ও পাসপোর্ট ব্যবহার, প্রতারণামূলক আচার আচরণ ও বেশ ভূষা গ্রহ্ন ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে যে এ ব্যাপারে আমাদের মোটেই লজ্জা পাওয়া বা ইতস্তত বোধ করা উচিৎ নয়; কেননা বিষয়টি সরাসরি আল্লাহ্‌র কুর’আন ও রসূলের সুন্নাহ থেকে প্রমানিত ও নির্দেশিত। তাছাড়া ‘Central Ignorance Agency’ CIA সজ অন্যান্য সকল গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ দেশ বিদেশ সফরের সময় নিয়মিত এ ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকে। এই নিকৃষ্ট সৃষ্টি কাফির মুশরিকরা যদি আল্লাহ্‌র দ্বীনের বিরুদ্ধে কাজ করার ক্ষেত্রে এ ধরণের প্রতারণার আশ্রয় নিতে পারে তাহলে আল্লাহ্‌র দ্বীনের জন্য আত্ননিবেদিত জীবন উৎসর্গকারী, তাওহীদবাদী ও সুন্নাহর অনুসারী ঈমানদাররা কেন এসব পদ্ধতির আশ্রয় নিতে পারবে না ! যারা আল্লাহ্‌র দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য আল্লাহ্‌র তরফ থেকে , তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে সতর্কতামূলক এসব পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য নির্দেশিত হয়েছেন ! নিশ্চয়ই এই মুজাহিদগণই এসব পদ্ধতি ব্যবহারের অধিক হকদার।

আল্লাহ্‌র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এসব হাদিস প্রমাণ করে যে তিনি কত বড়ো মাপের সমর বিশারদ ছিলেন। এসব হাদিস আমাদেরকে অন্য একটি হাদিস মনে করিয়ে দেয় যেখানে তিনি বলেন, ‘ আমি হলাম রহমতের নবী ও যুদ্ধের নবী।(ইমাম ইবনে তাইমিয়ার রহঃ আস সিয়াসাতুশ শরইয়াহ গ্রন্থ থেকে হাদিসটি গৃহিত)। একটি সফল যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আল্লাহ্‌র রসূলের প্রণীত এই মূলনীতি কতটা বাস্তব সম্মত তা যে কোন চৌকস আর্মি অফিসাররা উপলদ্ধি করতে পারবেন। সামরিক দিক থেকে আল্লাহ্‌র রসূলের সফলতাও একারণে গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে দিবালোকের মতো উজ্জ্বল অধ্যায়। যদিও অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে মুসলমানরা আজকাল একথা ভুলেই গেছে যে তাদের নবী কেমন একজন বীর যোদ্ধা ও সমর বিশারদ ছিলেন।, তারা কেবল তাঁর আধ্যাত্মিক ও সামাজিক সংস্কার নিয়েই পড়ে আছে। আমরা যদি আল্লাহ্‌র রসূলের জীবনের এসব দিক ও তাঁর এসব বাণীসমূহকে সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অধ্যায়ন ও প্রচার করি তাহলে আত্নপরাজিত সেই সব তথাকথিত আধুনিকতাবাদীদেরকে কুছুটা হলেও দমন করা যাবে যারা মানুষকে প্রবঞ্চিত করার জন্য বলে বেড়ায় যে ‘ইসলাম হল মহান শান্তির ধর্ম এবং জিহাদ হল কেবল আত্নরক্ষামূলক’ এবং নবী মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন কেবল দয়ার নবী, যুদ্ধে নবীর নন। এমন ইসলাম বিরোধী কথা থেকে আমরা আল্লাহ্‌র কাছে আশ্রয় চাই! আমরা বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত সমর বিশারদদের লিখনির মধ্যেও মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এসব বক্তব্যের প্রতিধ্বন্নি দেখতে পাই। ষষ্ট শতাব্দীর চাইনিজ সমর বিশারদ সান ঝ্যু এর ইতিহাস খ্যাত সমর বিদ্যার বই ‘The Art of War’ এর মধ্যেও আল্লাহ্‌র রসূলের কথার প্রতিধ্বন্নি পাওয়া যায়। আর এ কথা সকলেরই এ বইটি সমর বিদ্যার জগতে এমনই একটি মাস্টার পিস যার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন জার্মান শটাফ নেপোলিয়ন, এমনকি প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে অপারেশন Desert Storm এর পরিকল্পনাও এই বইয়ের দ্বারা প্রভাবিত। এখানে এ বইটি থেকে কিছু কথা না বললেই নয়। এ বইতে গুরুত্বের সাথে বলা হয়েছে যে-

‘যে কোন আক্রমনের প্রধান কৌশল হল ‘হামলা করো এমন জায়গা থেকে যেখান থেকে তারা হামলার কথা চিন্তাই করে না, আঘাত করো এমন অবস্থায় যখন তারা প্রস্তুত নয়’। আর এমন আক্রমনের পরিকল্পনা কেবল তখনই সফল করা যায় যখন সকল কাজ গোপনীয়তার সাথে সম্পাদন করা যায়, সেনাবাহিনীর মধ্যে কঠোর শৃঙ্খলা বজায় রাখা যায়। আর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ন কৌশল হল, নিজেদেরকে এমন এক সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মধ্যে রাখতে হবে যাতে কিছুতেই শত্রুরা আমাদের শক্তি সামর্থ্য ও প্লান পরিকল্পনা সম্পর্কে কোন অনুমান করতে না পারে। প্রয়োজনে নিজেদের শক্তি সামর্থ্যহীন বুঝাতে হবে যাতে শত্রু পক্ষ গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে হালকা ভাবে নেয়। শত্রু শিবিরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে হবে। যখন তাদের কাছে পৌঁছে যাবেন বুঝাবেন এখনো অনেক দূরে আছেন, আর যখন দূরে থাকবেন বুঝবেন আপনি একান্ত তাদের কাছে পৌঁছে গেছেন। তারা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে তাহলে তাদের মাঝে মতবিরোধীতা তৈরী করুন। যুদ্ধকে সব সময়ই একটা ধোঁকা প্রতারণার বিষয় হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে, প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে ছদ্দাবরণে প্রকাশ করতে হবে, মিথ্যা গুজব ছড়াতে হবে। নিজেদের সম্পর্কে শত্রুকে ভুল তথ্যের উপর রাখতে পারলে তারা হিমশিম খাবে তাদের পরিকল্পনা তৈরী করতে, এতে তারা এমন জায়গাত আক্রমন করবে যেখানে আক্রমন করা দ্বারা তাদের শক্তি খর্ব হওয়া ছাড়া কিছুই লাভ হবে না, আর এমন জায়গা তারা অরক্ষিত রেখে দিবে যেখান থেকে তারা ভয়াবহ আক্রমনের শিকার হবে…। (সংক্ষিপ্ত আকারে নেয়া)

[১১] ফাতহুল বারী ৬/১৫৮

[১২] কারাবন্দী শায়খ আব্দুল কাদির বিন আব্দুল আযিয (আল্লাহ্‌ তাঁর মুক্তি তরান্বিত করুন) তাঁর রচিত ‘The Fundamental Concept Regarding Al-Jihad’ গ্রন্থে শত্রুদের সাথে মিথ্যা বলা’ অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন- ‘আমি এ অধ্যায়টিকে ‘যুদ্ধে মিথ্যা বলা’ নামে নামকরণ করিনি , কারণ শত্রুদের সাথে মিথ্যা কথা বলা যুদ্ধের সময় যেমন বৈধ তেমনি শান্তির সময়ও বৈধ। এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত দলীলসমূহ প্রণিধানযোগ্যঃ-

১) উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিনটি বিষয় ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে মিথ্যা বলার অনুমতি দিতে শুনিনি, ক. যুদ্ধের যময়, খ.মানুষের মধ্যে বিবাদ মীমাংসা করে দেওয়ার জন্য , গ. স্বামী স্ত্রীর একে অন্যের সাথে কথা বলা। (মুসনাধে আহমাদ ও আবু দাউদ; একই রকম বর্ণনা ইমাম তিরমিযী সংকলন করেছেন আসমা বিনতে ইয়াযিদের সূত্রে)

২) শান্তির সময়ে শত্রুর সাথে মিথ্যা কথা বলা অনেক কারণে বৈধ। যেমন এর দ্বারা যদি মুমিনদের দ্বীনী কিংবা দুনিয়াবী কোন কল্যাণ সাধিত হয়, অথবা কুফফারদের ক্ষতি ও ষড়যন্ত্র থেকে মুমিনদেরকে হিফাযত করার জন্য যদি মিথ্যা বলার প্রয়োজন হয়। এ বক্তব্যের পক্ষে দলীল হিসেবে রয়েছে সহীহ আল বুখারীতে ৩৩৫৮ নং হাদিসে বর্ণিত ইবরাহীম আঃ কর্তৃক মিথ্যা বলার ঘটনা। এরপর রয়েছে সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আসহাবুল উখদুদের ঘটনায় দ্বীনদার আলিম কর্তৃক বালকটিকে যাদুকর ও পরিবারের কাছে মিথ্যা বলার উপদেশ দেয়ার ঘটনা। মুমিনদের বৈষয়িক স্বার্থ রক্ষার জন্য কাফিরদের কাছে মিথ্যা বলার অনুমোদনের ব্যাপারে হাজ্জাজ বিন ইলাতের ঘটনাও শিঘ্রই আমরা ফুটনোটে উল্লেখ করবো ইনশা আল্লাহ্‌।

[১৩] কা’ব বিন আশরাফ ছিল মদিনার এক কুখ্যাত ইহুদী। সে মুশরিকদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতো, যে আল্লাহ্‌র রসূলকে অপমান করে এবং মুসলিম নারীদেরকে নিয়ে অশ্লীল কবিতা রচনা করত, বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্থেই তাকে হত্যা করার ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত রয়েছে। বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থ ‘আর রাহিখুল মাকতুমে’ ঘটনাটি এভাবে বর্ণিত রয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে একত্রিত করে একদিন বলেন, কা’ব বিন আশরাফ আল্লাহ্‌ তা’য়ালা এবং রসূলকে আহত করেছে , কে আছ যে তাকে হত্যা করতে পারবে? তখন মুহাম্মদ বিন মাসলামাহ, আব্বাদ বিন বিশর, আল হারিস বিন আওস, আবু আবস বির হিরব এবং কা’ব বিন আশরাফের দুধ ভাই সালকান বিন সালামাহ স্বেচ্ছায় এ দায়িত্ব পালনের জন্য এগিয়ে আসেন। মুহাম্মদ বিন মাসলামাহ বলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ আপনি কি চান আমি তাকে হত্যা করি? তিনি বলেন হ্যাঁ। তারপর মুহাম্মদ বিন মাসলামাহ বলেন,তাহলে আমাকে অনুমতি দিন তাঁর সাথে যে কোন ধরণের কথা বলার, তিনি বলেন, তুমি বল (যা তোমার বলার প্র্যয়োজন)। এরপর মুহাম্মদ বিন মাসলামাহ কা’ব বিন আশরাফের কাছে এসে আল্লাহ্‌র রসূলের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, এই ব্যক্তি দান সাদাকার নামে মানুষের অর্থ কড়ি নেয়া ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না, আর এটা আমাদেরকে আজ মারাত্নক কষ্টকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। একথা শুনে কা’ব বিন আশরাফ বলে যে, সমস্যার আর দেখেছ কি, আল্লাহ্‌র কসম সে তোমাদেরকে আরও ভয়াবহ সমস্যায় ফেলবে। মুহাম্মদ বিন মাসলামাহ তাঁর উত্তরে বলেন যে, এতে কোন সন্দেহ নেই, তবে যেহেতু আমরা একবার তাঁর অনুসারীর খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছি, অতএব তাঁর শেষ না দেখে ছাড়ছি না। যাই হোক শোন, আমি তোমার কাছে এসেছি কিছু অর্থ ধার নেয়ার জন্য। সে বলল, ঠিক আছে তা দেয়া যাবে, তবে বন্ধক হিসেবে কী রাখবে? তিনি বললেন, তুমিই বল তুমি কী বন্ধক চাও? পাষন্ড হৃদয়হীন ইহুদী ঋণের বিপরীতে তাদের নারী শিশুদেরকে বন্ধক হিসেবে রাখার দাবী জানালো। ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠায় দেখিয়ে মুহাম্মদ বিন মাসলামাহ বললেন, আমরা কিভাবে তোমার কাছে আমাদের নারীদেরকে রাখতে পারি অথচ তুমি হলে আরবের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম সুপুরুষ, তাছাড়া এমন কাজ করলে লোকেরা আমাকে ছিঃ ছিঃ করবে ! আমাদের সন্তানদেরকে একথা বলে লোকেরা অপমান করবে যে, আমরা সামান্য কিছু ঋনের বিনিময়ে তাকে বন্ধক রেখেছিলাম ! আমরা বরং তোমার কাছে আমাদের অস্ত্রশস্ত্র বন্ধক রাখতে পারি। কা’ব এ প্রস্তাবে সম্মত হয়। সালকান বিন সালামাহ ও আবু নায়লা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে গিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাত করে কমবেশি একই ধরণের কথাবার্তা বলে। আবু নায়লা তারপর এমনভাবে পরিকল্পনা সফল করে নিয়ে আসেন যে তিনি তাঁর সাথে কথাবার্তা বলে বন্ধক দেয়ার জন্য তাঁর কিছু বন্ধুকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁর কাছে আসার সম্মতি গ্রহণ করেন। অবশেষে তৃতীয় হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের ১৪ তারিখে রাতের বেলায় আল্লাহ্‌র রসূলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আল্লাহ্‌র নামে নিয়ে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন, আর আল্লাহ্‌র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সফলতার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করতে থাকেন।

তারা রাতের বেলায় গিয়ে তাকে ডাক দেন। তাদের ডাক শুনে সে নেমে আসে, যদিও তাঁর স্ত্রী তাকে এই বলে সর্তক করেছিল যে, ‘আমি কেমন যেন মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছি;। সে তাকে আশ্বস্ত করে যে এ তো শুধু মুহাম্মদ বিন মাসলামাহ আর আমার দুধ ভাই আবু নায়লা, তাছাড়া কোন ভদ্র লোককে রাতের বেলায় ডাক দিলে তাঁর অবশ্যই সাড়া দেয়া উচিৎ তাতে যদি সে তলোয়ারের আঘাতে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় তবুও। এদিকে আবু নায়লা তাঁর সাথীদেরকে আগেই বলে রাখে যে আমি যখন ঘ্রান শোঁকার ভান করে তার মাথা ধরবো তখন তোমরা তোমাদের কাজ সেরে ফেলবে।

সে নেমে আসার পর তারা তার সাথে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন গল্প গুজব করে; তারপর তাকে তারা একটু বাহিরে গিয়ে চাঁদনী রাতে কিছু সুন্দর সময় কাটানোর আহ্বান জানায়। বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবু নায়লা তাকে বলে যে, আরে তোমার মাথা থেকে তো চমৎকার ঘ্রাণ আসছে ! কা’ব উত্তরে বলে যে আমার এমন একজন রক্ষিতা আছে যে আরবের সবচেয়ে সুগন্ধিনি নারী। আবু নায়লা বলে আমি কি একটু তোমার মাথাটা শুঁকে দেখতে পারি? সে বলে অবশ্যই, নাও শুঁকে দেখ, আবু নায়লা তাঁর মাথা ধরে প্রথমে একবার শুঁকে ছেড়ে দেয়, একটু পর সে আবার তাঁর মাথার ঘ্রাণ শোঁকার কথা বলে (চুল ধরে) তাঁর মাথাটা নিচু করে ধরে তাঁর সাথীদেরকে বলে যে, নাও এবার তোমাদের কাজ সেরে ফেল; তখন তারা তাকে হত্যা করে ফেলে। সাহাবীদের দলটি তাদের মিশন সফল করে ফিরে আসে। অসর্তক ভুলবশতঃ তাদের একজন সাথী হারিস বিন আওস তাদেরই তলোয়ারের আঘাতে আহত হন এবং রক্তক্ষরন হতে থাকে। তারা বাকিউল গারকাদ নামক স্থানে এসে আল্লাহু আকবার বলে তাকবীর ধ্বনি দেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের তাকবীর শুনেই বুঝে ফেলেন যে তারা আল্লাহ্‌র শত্রুকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। তারা আল্লাহ্‌র রসূলের কাছে এলে তিনি তাদেরকে বলেন তোমাদের চেহারা উজ্জ্বল হোক ! তারাও বলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ আপনার মোবারক চেহারাও উজ্জ্বল হোক। অতঃপর তারা তাঁর ছিন্ন মস্তক আল্লাহ্‌র রসূলের কাছে হস্তান্তর করে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সফলতার জন্য আল্লাহ্‌র প্রশংসা করেন।

আমাদের খুব আশ্চর্য হওয়ার তেমন কোন কারণ নেই। কেননা, আমাদের এই জামানায়ও আফগানিস্তানের মুরতাদ তাগুত আহমাদ শাহ মাসউদকে হত্যার নিল নক্সাও উল্লেখিত হাদিসটিকে হুবহু অনুসরণ করে প্রণয়ন করা হয়েছিল। শায়খ উসামাহ বিন লাদেনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ফ্রেঞ্চ ভাষায় পারদর্শী দু’জন তিউনিসিয়ান ভাই সাংবাদিক সেজে তার ছবি তোলা ও সাক্ষাৎকার গ্রহনের বাহানা ধরে তার কাছে আসা যাওয়া আরম্ভ করে। সুক্ষভাবে তৈরী করা সাংবাদিক পরিচয়ের কাগজ পত্র, ফ্রেঞ্চ ভাষায় পারদর্শী হওয়া, গায়ের রঙ সাদা হওয়া ইত্যাদি সব মিলিয়ে তারা সে তাগুদের নিরাপত্তা রক্ষীদেরকে এমনভাবে বোকা বানাতে সক্ষম হন যে তারা তাদেরকে সত্যিই ফ্রেঞ্চ সাংবাদিক ভাবতে বাধ্য হয়। তারা প্রথমে আহমাদ শাহ মাসউদ, তার নিরাপত্তারক্ষী ও তার কাছে থাকা অন্যান্য ব্যক্তিদের সাথে বন্ধুত্বপুর্ন সম্পর্ক গড়ে তোলেন; একই সাথে তারা তার আচার আচরণ, অভ্যাস তার নিরাপত্তারক্ষীদের রুটিন ইত্যাদি পর্যবেক্ষন করতে থাকেন। এভাবে দীর্ঘ দিন ধরে তারা তার সাক্ষাৎকার নিতে নিতে তাদের অপারেশন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা তথ্য সগ্রহ করে ফেলেন। এরপরও তারা অপেক্ষা করতে থাকেন সঠিক সময় সুযোগের সন্ধানে। এভাবে যাওয়া আসা করতে করতে এক সময় তাদেরকে নিরাপত্তারক্ষীরা তল্লাশি করা বন্ধ করে দেয়, শুধু হাসি দিয়ে তাদেরকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে যেতে আরম্ভ করে। এভাবে এক পর্যায়ে তারা যখন সম্পূর্ন নিশ্চিত হলেন যে এবার অপারেশন চালাতে আর কোন অসুবিধা নেই তখন তারা ক্যামেরা ও অন্যান্য ফটোগ্রাফি যন্ত্রপাতির মধ্যে লুকিয়ে বিস্ফোরক নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেন এবং সে তাগুত যখন একেবারে সে যন্তপাতির কাছে আসে তখনই তারা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন। আল্লাহ্‌ তা’য়ালা আমাদের এ দুটি ভাইয়ের আত্নত্যাগকে কবুল করুন এবং তাদেরকে শহীদদের দলে শামিল করুন।

[১৪] হাজ্জাজ বিন ইলাত আস সুলামী রাঃ জনগন থেকে তার ইসলাম গ্রহনের সংবাদ গোপন রাখেন এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মিথ্যা বলার অনুমতি চান মক্কার কাফিরদের থেকে তার সমুদয় সম্পদ উদ্ধার না করা পর্যন্ত। হাফেয ইবনে হাজার রহঃ এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলে হাজ্জাজ বিন ইলাতের ঘটনা সম্পর্কে মুসনাধে আহমাদ ও সহীহ ইবন হিব্বানে যে বর্ণনা রয়েছে তাতেও তার এ মিথ্যা বলার অনুমতি সমর্থিত হয়, একই হাদিস ইমাম নাসায়ীও বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম হাকেম একে সহীহ সাব্যস্ত করেছেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে তার সম্পদ কাফিরদের হাত থেকে রক্ষার জন্য যা খুশী তাই বলার অনুমতি দান করেন। এমনকি মক্কার কাফিরদেরকে এমন কথা বলার অনুমতি তাকে দেন যে খায়বারের লোকেরা মুসলমানদেরকে পরাজিত করেছে। মনে রাখা চাই যে হাজ্জাজ ইবনে ইলাতের এ ঘটনা কোন যুদ্ধাকালীন ঘটনা ছিল না; বরং এটা ছিল স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় থাকা অবস্থার কথা। ফাতহুল বারীতেও ঘটনাটির বর্ণনা এসেছে এবং ইমাম ইবনে কাসীর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াতেও ঘটনাটি বিস্তারিত এনেছেন।

[১৫] আবু যুবায়দা সেন্টার থেকে প্রকাশিত সিকিউরিটি এনসাইক্লোপিডিয়াতে আরও বলা হয়েছে যে, উপায় উপকরণ অবলম্বন করলেই যে সফলতা আসবে বিষয়টি মোটেই তা নয়; এটা খুবই ভয়াবহ ব্যাপার যে অনেকে কেবল উপায় উপকরনের উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আমাদের মনে রাখা চাই যে আমরা উপায় উপকরণ অবলম্বন করি এ কারণে যে আল্লাহ্‌ তা’য়ালা আমাদেরকে গুরুত্বের সাথে উপায় উপকরণ অবলম্বনের আদেশ দিয়েছেন এবং উপায় উপকরণের বাস্তবেও একটা ভূমিকা রাখে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে কোন ভাই যদি সঠিকাভাবে নিরাপত্তা রক্ষার পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে তাহলে আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় তাকে গ্রেফতার করাটা মোটেই সহজ বিষয় নয়। সূরা আল মায়িদার ৬৭ নং আয়াত ‘(হে নবী) আল্লাহ্‌ তা’য়ালাই আপনাকে মানুষদের থেকে রক্ষা করবেন’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহঃ বলেন, আল্লাহ্‌র তরফ থেকে তার রসূলের জন্য এই নিরাপত্তা ঘোষনার সাথে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের সাথে নীতিগতভাবে কোন বৈপরীত্য নেই। ঠিক যেমন কোন সংঘর্ষ নেই দ্বীনকে বিজয়ী করার ব্যাপারে আল্লাহ্‌ তা’য়ালার ঘোষণা ও আমাদের প্রতি জান মাল কোরবানি করা, প্রস্তুতি গ্রহণ করা, শত্রুদের থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা ও জিহাদের নির্দেশ দানের মধ্যে। (যাদুল মা’আদ ৩/৪৮০)

আমাদের মনে রাখতে হবে যে আল্লাহ্‌ তা’য়ালা যেমন হুকমুশ শরয়ী বা ইসলামিক বিধি বিধান প্রণয়ন করেছেন তেমনি তিনিই প্রণয়ন করেছেন হুকমুল কাওনী বা প্রাকৃতিক বিধি বিধান। শরয়ী বিধানে যেমনি তিনি আমাদেরকে হুকুম দিয়েছেন সতর্কতা অবলম্বন করতে, একইভাবে আল্লাহ্‌ তা’য়ালা তার প্রাকৃতিক বিধানে এই নিয়ম রেখেছেন যে সতর্কতা অবলম্বন করলে তার ইচ্ছায় এর একটা ফলাফল আছে। ঠিক যেমন গাছের ফল খেতে চাইলে আগে বীজ বপন করে তার যত্ন নিয়ে তারপর আল্লাহ্‌র উপর তাওয়াক্কুল করতে হবে। একইভাবে কোন গোয়েন্দা সংস্থাকে ফাঁকি দিতে হলে কিংবা সফলভাবে কোন অপারেশন পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই সম্ভাব্য সকল সতর্কতা অবলম্বন করে তার পর আল্লাহ্‌ উপর তাওয়াক্কুল করতে হবে। এ প্রসঙ্গে চমৎকার একটি হাদিস সংকলন করেছেন ইমাম তিরমিযী এবং ইমাম ইবনে হিব্বান একে সহীহ সাব্যস্ত করেছেন; হাদিসটি হল এক ব্যক্তি এসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন যে আমি কি উট বেঁধে রাখবো নাকি আল্লাহ্‌র উপর তাওয়াক্কুল করব? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন, প্রথমে উট বাঁধবে তারপর আল্লাহ্‌র উপর তাওয়াক্কুল করবে। অতএব, হে আমাদের প্রান প্রিয় ভাইয়েরা ! আপনারা অবশ্যই প্রথমে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবেন তারপর আল্লাহ্‌র উপর তাওয়াক্কুল করবেন। ইমাম তাবরানী হাসান সনদের অন্য একটি হাদিস সংকলন করেছেন যেটিতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমার উপর যা আসা নির্ধারিত হয়ে আছে তা কখনো তোমার উপর থেকে সরে যাবে না, আর যা তোমার উপর আসার নয় তা কখনো তোমার উপর আসবে না।

[১৬] আল্লাহ্‌র কাছে এমন অবস্থা থেকে আশ্রয় চাই। এই অবসাদগ্রস্থ মূর্খের তাওয়াক্কুল ও ইয়াকীনের অর্থই জানে না। আল্লাহ্‌ তা’য়ালা তার নিজ মহান গুনাবলীর বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘তোমরা প্রকাশ্যে যা বল তা যেমন তিনি জানেন তেমনি যা গোপন তাও তিনি জানেন’।(সূরা ত্বা-হা, আয়াত ৭) মরহুম শায়খ আব্দুল্লাহ রাশুদ(আল্লাহ তাকে সর্বোচ্চ শহীদী মর্যাদা দান করুন) তার এক খুতবায় বলেন- ‘আমার মনে পড়ে একবার এক ছাত্র আল্লাহ্‌র নামে কসম করে বলেছিল যে পেন্টাগন হল এমন এক সুরক্ষিত স্থান যা উপর দিয়ে মাছিও উড়ে যেতে পারে না। আমি বলতে চাই যে সে নির্ঘাত আল্লাহদ্রোহীতা মূলক কথা বলেছে, তারা শুধু দুনিয়ার বাহ্যিক দিকটা সম্পর্কেই জানে, আর আখিরাত সম্পর্কে তারা একেবারেই উদাসীন (সূরা আর রুম, আয়াত ৭) , সে আসলে বিশ্বাসই করে না যে তাকে শীঘ্রই আল্লাহ্‌র সামনে দাঁড়াতে হবে, তার আসলে আখিরাতের উপর মোটেই ঈমান নেই, সে এও জানে না যে, যে কোন পরিস্থিতি যে কোন সময় আল্লাহ্‌ তা’য়ালা ঈমানদারদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারেন; যদি সে জানত তাহলে এমন কথা কিছুতেই মুখ দিয়ে উচ্চারন করতে পারতো না। এই আত্নপরাজিত আমেরিকার গোলামরা আত্নত্যাগী স্বাধীন বিবেকবান মুজাহিদ যুবকদেরকে জিহাদের মহান পথ থেকে ফিরিয়ে রাখার নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই করতে পারে না। আর এ ধরনের মানষিক গোলামদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যে স্থাপনার উপর দিয়ে তোমরা মাছি উড়ে যাওয়াকেও অসম্ভব মনে করেছিল আল্লাহ্‌র অনুমতিক্রমে মুজাহিদরা উড়ে গিয়ে সেখানে ভয়াবহ আঘাত হেনেছে। এসব গোলামদের পরাজিত করার জন্য এর চেয়ে বাস্তব আর কি প্রমাণ প্রয়োজন।

[১৭] কারাবন্দী শায়খ ফারিয আল যাহরানী (আল্লাহ্‌ তার মুক্তির পথ খুলে দিন) তাহরিযুল মুজাহিদীন আলা ইহইয়াইস সুন্নাতিল ইগতিয়াল নামক গ্রন্থে গুপ্ত হত্যার মিশন সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য মুজাহিদদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষন বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন, ‘এ বিষয়ে একটি পূর্নাঙ্গ সিলেবাস থাকা প্রয়োজন যাতে করে ভাইয়েরা নিরাপত্তা ও গোয়েন্দাগিরি সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করতে পারে এবং ইহুদী খ্রিষ্টান সহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের দক্ষতা যোগ্যতা সম্পর্কে হলিউড সহ বিভিন্ন মিডিয়া ব্যবহার করে তাদের ব্যাপারে যেসব ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরী করে রেখেছে সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে পারে। কারণ তারা তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পর্কে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরণের ভীতি সৃষ্টি করে রেখেছে। যদিও আমেরিকার টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগন আক্রমন, কেনিয়ার তানজানিয়ায় আমেরিকান এম্বেসি আক্রমন, ইয়েমেন ইউ এস এস কোন ওয়ারশিপ ইত্যাদি আক্রমন তাদের অযোগ্যতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

[১৮] আল্লাহ্‌র কাছে সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব হল সেই মুক ও বধির লোকেরা যারা আল্লাহ্‌র সাথে কুফরী করে এবং তাই তারা ঈমান আনয়ন করে না। (সূরা আল আনফাল আয়াত ৫৫)

[১৯] বিখ্যাত নিরাপত্তা ও কৌশল বিশ্লেষক শায়খ আব বকর আন নাজি তার ইদারাতুত তাওয়াহহুশ নামক গ্রন্থে এ সম্পর্ক এ সম্পর্ক এ উদাহরণ দিয়ে বলেন, কোন এক ভাইকে একবার একটি ডকুমেন্টস দিয়ে বলে দেয়া হয়েছিল যে সে যেন এটা পড়ে সাথে সাথে পুড়িয়ে ফেলে, কিন্তু সে সেটি পুড়িয়ে না ফেলে খুবই যত্নের সাথে তার বাড়িতে একান্ত গোপন এক স্থানে সে লুকিয়ে রাখে; পরবর্তীতে তাগুতী নিরাপত্তা রক্ষীরা তার বাড়ি রেইড দিয়ে যখন সব কিছু তন্ন তন্ন করে খোজা আরম্ভ করে তখন তারা সেই ডকুমেন্টসটি পেয়ে যায়। আর তার এই একটু অসতর্কতা গোটা একটা পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দেয় এবং গোয়েন্দারা আদা জল খেয়ে তদন্তে নামে। পরবর্তীতে জেলে থাকা অবস্থায় তাকে সে ডকুমেন্টসটি পুড়িয়ে না ফেলার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলে যে, ‘আমি তার মতো একজন মহান শায়খ ও কমান্ডারের নিজ লেখা কাগজটিকে আগুন পুড়িয়ে ফেলাকে সমীচীন মনে করেছিলাম না’।

[২০] সিকিউরিটি এনসাইক্লোপিডিয়াতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে যে, যে সব দরজা দিয়ে শয়তান মুজাহিদ ভাইদেরকে কাবু করে ফেলে তার মধ্যে একটি হল, ভীতু লোকদের কাজ বলে নিরাপত্তা পদক্ষেপ গ্রহণকে অবহেলা করতে উৎসাহ দেয়া। শয়তানের ওয়াস ওয়াসায় তখন সে মনে করতে আরম্ভ করে যে সে যেহেতু আল্লাহ্‌র পথে জিহাদের জন্য বেরিয়েছে এখন তার আর নিরাপত্তা পদক্ষেপ গ্রহণ করার কোন প্রয়োজন নেই, তার নিরাপত্তা এখন স্বয়ং আল্লাহ্‌ নিশ্চিত করবেন। কিন্তু সত্য হল এই যে আল্লাহ্‌ রব্বুল আলামিনের উপর তাওয়াক্কুলের প্রথম দাবীই হল তার হুকুম মাফিক সতর্কতা অবলম্বন করা। যদিও আমরা একথার উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখি যে আমাদের উপর যা কিছু আপতিত হওয়ার তা হবেই। আল্লাহ্‌র রসূলের হিজরতের ঘটনার মধ্যে আমাদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ন শিক্ষা রয়েছে। নিজের কিংবা সাথী ভাইদের জেলে যাওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে নির্ভয় উদাসীন বা ড্যাম – কেয়ার ভাব হওয়াটা ভয়াবহ এক আত্নঘাতি ভুল। সে নির্ভীক হওয়ার একটি গুণ অর্জন করার সাথে সাথে সাথী ভাই, সংগঠন ও নিজেকে অকারণ ক্ষতিগ্রস্থ করার মতো ভয়াবহ ক্রটিও অর্জন করেছে।

তাগুতী গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা কর্মীদের জন্য সবচেয়ে আনন্দদায়ক খুশির বিষয় হল কোন মুজাহিদ ভাইকে গ্রেফতার করতে পারা; আর যে কারণে তারা পা থেকে মাথা পর্যন্ত তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে তা হল তাদের হাত থেকে কোন মুজাহিদ ভাই ছুটে যায়, কিংবা কোন ভাই যখন তাদের চোখে ধুলা দিয়ে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করে কিংবা জিহাদের ময়দানে চলে যায়। অতএব আপনার সতর্কতামূলক নিরাপত্তা পদক্ষেপ গ্রহণ আল্লাহ্‌র শত্রুদের মধ্যে রাগ ও ক্ষোভের সঞ্চার করে, আর একারণে আপনি এমনিতেই আল্লাহ্‌র তরফ থেকে পুরস্কার পেতে থাকবেন; কেননা আল্লাহ্‌ তা’য়ালা বলেছেন- ‘আল্লাহ্‌র পথে ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও ক্লান্তিতে তারা যতটুকু কষ্ট পাবে, যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করে তারা কাফিরদের ক্রোধের উদ্রেক করবে এবং কাফিরদেরকে আহত করবে অবশ্যই তার বিনিময়ে একটি নেক আমল তাদের জন্য লিখে দেয়া হবে…(সূরা আত তাওবা আয়াত ১২০)

[২১] লেখকের এ বক্তবয়টি আসলেই স্বর্নালী অক্ষরে লিখে রাখার মতো। নিরাপত্তা ইস্যুতে উদাসীন ও অতি বাড়াবাড়ি উভয় প্রান্তিকতার শিকার লোকদের শিক্ষার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। অতএব বিষয়টিকে একটু গভীরভাবে একটু ভেবে দেখুন।

[২২] আবু যুবায়দা সেন্টার থেকে প্রকাশিত সিকিউরিটি এনসাইক্লোপিডিয়াতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে যে, ‘স্মার্ট হল সে যে অন্যদের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। সাথী ভাইদের ব্যাপারে শত্রুদেরকে তথ্য দেয়া যেমন হারাম তেমনি এই নিরাপত্তা ইস্যুকে উপেক্ষা করাও হারাম। কারণ এই নিরাপত্তা ইস্যুকে অবহেলা ও উপেক্ষা করার কারণেই আপনি হয়তো বাধ্য হবেন- আপনাকে বাধ্য করা হবে শত্রুদের কাছে সাথী ভাইদের তথ্য প্রদান করতে। শত্রুরা আসলে এভাবেই একজনকে গ্রেফতার করে তার থেকেই অন্যদের সম্পর্কে তথ্য আদায় করে; অন্যথায় আপনিই বলুন লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্য থেকে তারা কিভাবে একজন মানুষকে আলাদা করে চিহ্নিত করে ! নিশ্চয়ই তারই কোন ভাই শত্রুদেরকে তার কথা বলে দিয়েছে।

[২৩] এ বিষয়ে আল্লাহ্‌র রসূলের পথনির্দেশ হল সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হাদীস, যেখানে তিনি বলেন, ‘প্রকৃত মুমিন কখনো একই গর্ত থেকে দু’বার দংশিত হয় না’। আমাদের চারজন অনুবাদক ভাই সহ আরও অনেক ভাই আল্লাহ্‌র শত্রুদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর এই হাদিসটিকেই আমরা আমাদের এই প্রজেক্টের মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমরা আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করি আল্লাহ্‌ তা’য়ালা যে তাদের কষ্ট লাঘব করে দেন, তাদের সংকল্পকে আরও শক্তিশালী করে দেন, তাদের উৎসাহ উদ্দিপনা আরও বাড়িয়ে দেন, তাদের অন্তরকে প্রশস্ত করে দেন এবং তাদের ঈমান হিফাযত করেন- আমীন!!! আর সাথে সাথে আমরা স্মরণ করতে চাই আল কুর’আনের সেই আয়াত যেখানে আল্লাহ্‌ তা’য়ালা বলে, ‘তুমি বল, আল্লাহ্‌ তা’য়ালা আমাদের জন্য যা অবধারিত করে রেখেছেন তা ছাড়া কখনই আমাদের উপর কিছু আপতিত হবে না, তিনিই আমাদের মাওলা ,ঈমানদারদের উচিৎ একমাত্র আল্লাহ্‌র উপরই ভরসা করা। (সূরা আত তাওবা , আয়াত ৫১)

[২৪] এসব সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ইহুদী, নাসারা, পৌত্তলিক ও (মুসলমান নামধারী) মুরতাদ শাসকদের অনুগত সকল দেশের সামরিক বাহিনী। এছাড়া আরও রয়েছে জাতীয়তাবাদী ,স্বাধীনতাকামী, মার্ক্সবাদি, বিভিন্ন দেশের বিদ্রোহী গ্রুপ সহ আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র সমূহ। সিকিউরিটি এনসাইক্লোপিডিয়াতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে যে- ‘এটা সত্যিই লজ্জাজনক ও দুঃখের বিষয় যে তুচ্ছ দুনিয়াবী স্বার্থ হাসিলের জন্য নিবেদিত মাফিয়া চক্রের সদস্যদেরকেও নিরাপত্তা ও সাবধানতার ক্ষেত্রে অনেক সময় আমাদের ভাইর চেয়ে অনেক বেশী দক্ষ অভিজ্ঞ ও সতর্ক দেখা যায়। অথচ সতর্কতা ও সাবধানতাদে অবলম্বনের ক্ষেত্রে আমাদের উচিৎ গোটা পৃথিবীর সামনে উদাহরণ স্থাপন করা। কেননা স্বয়ং আল্লাহ্‌ তা’য়ালা আমাদেরকে তার কুর’আন ও তার রসূলের জবানে সতর্কতা অবলম্বনের কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। আর একজন মুজাহিদ কখনোই শত্রুর থেকে শঙ্কা মুক্ত নয়; অতএব যে সম্ভাব্য সকল ধরনের সাবদাহ্নতা অবলম্বন করে তারপর দৃঢ় ঈমানের সাথে আল্লাহ্‌র সাহায্য চায়সে উত্তম না কি যে উদাসীনভাবে ঘুরে বেড়ায় সে উত্তম।

[২৫] সিকিউরিটি এনসাইক্লোপিডিয়াতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে যে, ‘সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বনের বিষয়টি জিহাদী কার্যক্রম আরম্ভ করার একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকেই গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। এমন কি কোন সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়ারও আগে থেকেই সিকিউরিটি প্রটোকল মেনে চলা বাঞ্ছনীয়। এটা খুবই দুঃখজনক যে অনেক ভাইয়েরা প্রাথমিক অবস্থায় এর গুরুত্ব বুঝতেই চায় না; আর একারণে একের পর এক ভুল করে যখন সে কিংবা তার সাথী ভাই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে যায় তখন একথা ভেবে নিজের আঙ্গুল নিজে কামড়াতে থাকে আর বলে আহ! আগে থেকে যদি সর্তক হতাম, সাবধান থাকতাম! কিন্তু সময় হারিয়ে তার এই বোধোদয় তখন আর কোন কাজে আসে না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight − 7 =

Back to top button