ইতিহাস- ঐতিহ্যনির্বাচিতবই ও রিসালাহ

শতাব্দীর আন্দামান থেকে বলছি

শতাব্দীর আন্দামান থেকে বলছি

DOWNLOAD LINK

 

 

Bangla Word [Size 1.18M ]

https://www.mediafire.com/file/rpvv3djqigq9kc9/Torture+at+Bangladeshi+Guantanamo+Bay.docx/file

https://mega.nz/file/i9oQHYxL#q258dxvTAZ2CQa7ML-TdVbSrpP7v6j-VOVQosCc1nyg

https://sotabdirandaman.files.wordpress.com/2021/03/torture-at-bangladeshi-guantanamo-bay.docx

https://www104.zippyshare.com/v/6Sxandxs/file.html

https://files.fm/f/6ja695858

https://archive.org/download/torture-at-bangladeshi-guantanamo-bay_202103/Torture%20at%20Bangladeshi%20Guantanamo%20Bay.docx

https://archive.org/details/torture-at-bangladeshi-guantanamo-bay-english_202103

 

English Word [Size 1.20M ]

 

https://archive.org/download/torture-at-bangladeshi-guantanamo-bay-english/Torture-at-bangladeshi-guantanamo-bay_english.docx
https://archive.org/details/torture-at-bangladeshi-guantanamo-bay-english_202103

 

Bangla PDF [Size 3.1M ]

https://mymegacloud.com/index.php?dl=896b6a1b023857b37aeae118c383d582
https://archive.org/download/torture-at-bangladeshi-guantanamo-bay/Torture%20at%20Bangladeshi%20Guantanamo%20Bay.pdf
https://bayfiles.com/Pd6bxfUdq0/Torture_at_Bangladeshi_Guantanamo_Bay_pdf
https://racaty.net/ezbilbqnkx7z
https://top4top.io/downloadf-1892fw0tl1-pdf.html
https://www.solidfiles.com/v/38Z6rxLQnxq5r

 

 

English PDF [Size 829.1K ]

https://mymegacloud.com/index.php?dl=7829ced71c72615a255323a79dfd90bd
https://archive.org/download/torture-at-bangladeshi-guantanamo-bay/Torture-at-bangladeshi-guantanamo-bay_english.pdf
https://bayfiles.com/Pd6bxfUdq0/Torture_at_Bangladeshi_Guantanamo_Bay_pdf
https://racaty.net/nlxvdy7q2u19
https://top4top.io/downloadf-1892yjoql2-pdf.html
https://www.solidfiles.com/v/38Z6rxLQnxq5r

শতাব্দীর আন্দামান হতে বলছি

(এই লিখা মূলত: ত্বাগুত বাহিনীর হাতে আটক শত শত মুজাহিদ ভাইদের উপর অমানুষিক নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনার খন্ডচিত্র। বাংলার এই মুসলিম জনপদে কালিমার পতাকাবাহীদের উপর এরূপ জঘন্য অত্যাচার কল্পনাপ্রবন মানুষও কল্পনা করতে পারবে না। সভ্য জনপদে, মুসলিম জনপদে তাগুতের এই নির্যাতন ও জুলুম নিপীড়ন উপনিবেশিক শাসনের কালাপানির দ্বীপান্তরের কুখ্যাত আন্দামান দ্বীপের নির্যাতনকে, ইয়াহুদী-নাসারাদের তৈরি ও গুয়ান্তানামো বে কেও হার মানায়। আসলে এসব তাগুতী বাহিনীরা তো তাদের প্রভু ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের দালাল, ওদের থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, ওদেরকে খুশি করতে সব করতে প্রস্তুত। মুখোশধারী ও মুসলিম নামধারী এসব নরপশুগুলো তাওহীদের সৈনিকদের অব্যাহতভাবে যে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, তা চোখে না দেখলে অথবা ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে অনুভব করা অসম্ভব। এখানে কতিপয় নির্যাতিত মুসলিমের জবানবন্দি সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো। এই মুজাহিদদের মুখ নি:সৃত বর্ণনা ও প্রতিনিয়ত যা কিছুর তারা মোকাবিলা করছে তা স্বাক্ষ্য দেয়, বাংলার প্রতিটি মুজাহিদদের জন্য আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের নির্যাতন সেলে পরিণত হয়েছে)

সমস্ত প্রশংসা সেই মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার জন্য যিনি ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য আর কোনো ইলাহ নেই। যিনি একক, যার কোনো শরীক নেই। যিনি ন্যায় অন্যায় পার্থক্য করার জন্য দিয়েছেন ফুরক্বান। আমি আবারো প্রশংসা জ্ঞাপন করছি সেই আল্লাহর যিনি ইবরাহীম (আলাই ওয়া সাল্লাম) কে হিদায়াত দিয়ে রক্ষা করেছিলেন মূর্তিপূজক মুশরিকদের অগ্নিকুণ্ড থেকে। যিনি মুসা (আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং বানী ইসরাইলকে মুক্তি দিয়েছিলেন দাম্ভিক ও অত্যাচারী ফিরাউন এবং তার অনুসারীদের থেকে, হাওয়ারীনদের দ্বারা ঈসা (আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাতকে শক্তিশালী করেছিলেন। যিনি আবু তালিবের গুহায় রসূল (সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মু’মিনদের সাহায্য করেছিলেন এবং যুগে যুগে যিনি অত্যাচারী কাফির মুশরিকদের ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়ে মু’মিনদের বিজয় দিয়েছিলেন।

সালাত এবং সালাম বর্ষিত হোক নাবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আহলে বাইত, সাহাবীগন এবং কিয়ামত অবধি তার একনিষ্ঠ অনুসারীগনের প্রতি। দোয়া এবং মাগফিরাত কামনা করছি সেই সব মর্দে মু’মিনদের জন্য যাদের রক্তে সিক্ত এই জমীন। আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি, পরাক্রমশালী আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইবাদাত যোগ্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর বান্দা এবং রসূল।

আমার এ লিখা এমন কতিপয় ভগ্ন হৃদয় নির্যাতিত-নিপীড়িত ও আক্ষেপ সর্বস্ব মু’মিনদের আর্তনাদ, যাদের মধ্যে অনেকের সামান্যতম কষ্ট সহ্য করার শক্তিও এখন আর অবশিষ্ট নেই। এমতাবস্থায় এসব বিপদগ্রস্থ বান্দা-তারা তাদের রবের নিকট মুক্তির আশা পোষণ করে। আজ তারা নিকৃষ্ট মানসিকতা সম্পন্ন জালিমের হাতে বন্দি। তারা কল্পনাতীত দু:খ এবং দুর্দশায় পতিত। তাদের অধিকাংশকে অন্ধকারাচ্ছন্ন, সংকীর্ণ ও নির্যাতন নিষ্পেষণে সমৃদ্ধ টর্চারসেল অতিক্রম করতে হয়েছে। তাদের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা আজ কারাগারের নিষ্ঠুর প্রাচীর বেষ্টনীর মধ্যে স্তব্ধ হয়ে আছে।

অনেক সময় এসব হৃদয়হীন অসভ্য জালিমদের আচার ব্যবহার দেখে মুক্তির আশা ভুলেই গিয়েছিল। তবে আল্লাহর রহমত থেকে তারা নিরাশ হয়নি। এসব দুরাত্মা হীন প্রকৃতির লোকগুলির নিত্যনতুন অত্যাচার উৎপীড়নে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার উপক্রম, কিছু ভাই মানসিক ভারসাম্য ধরে রাখতে পারেনি। সত্য সত্যই আজ তারা পরমুখাপেক্ষী, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। জালিম ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের দোসররা এমন হীন কাজ করতে ও বাকী রাখে নাই যা তাদের বিবেকে বাধে। অনবরত সহ্য করতে হচ্ছে নির্যাতন, অপমান, মনুষ্যত্ব বিরোধী নিষ্ঠুর আচরণ। কেন এই উৎপীড়ন? কিই বা তাদের অপরাধ? একমাত্র অপরাধ তারা তাওহীদবাদী মুসলিম। এমনকি সমাজ ও সাক্ষ্য দেয় এরা ভাল মানুষ। তাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছে যাদের গ্রেপ্তারের বিভীষিকাময় ইতিহাস অভিন্ন। তাদেরই একজন তাদের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণা করলেন এভাবে-

পড়ন্ত বিকেলে যখন পীচঢালা রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম তখন পাশি দিয়ে একটি কালো রংয়ের গাড়ি দ্রুতবেগে অতিক্রম করল। পরক্ষণে আবার মোড়ঘুরে আমার সামনে এসে ব্রেক করল। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই চোখ বেঁধে গাড়িতে উঠিয়ে দ্রুতবেগে স্থান ত্যাগ করল। যখন চোখ খুলল তখন নিজেকে এক নোংরা জলাশয়ের পাশে দেখতে পেলাম। একজন লোক তড়িঘড়ি করে আমার নাকে মুখে ভিজা গামছা দিয়ে ঢেকে পানি ঢালতে শুরু করল। পাশ থেকে একজন বলল, ‌’গাড়িতে যা করলাম, তা প্রাথমিক আপ্যায়ন তাতে তুই মুখ খুলিসনি শালা। কুত্তার বাচ্চা এখন তোর বাপ বলবে। পিছন থেকে হাতকড়া পরানো হতে তিন/চারজন লোক চেপে ধরল, কয়েকজন পায়ের উপর চাপ দিয়ে রাখলো। চোখের সামনে মৃত্যু হাতছানি দিতে লাগলো।

মনে পড়লো আম্মার ইবনে ইয়াসীর (রাদিআল্লাহু আনহু) কে কুপের মধ্যে চুবিয়ে শাস্তি দেয়ার ঘটনা। কিছুক্ষণ পরপর প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে লাগল। মনে হল এই কষ্টের চেয়ে মৃত্যু অনেক সুখকর। আমার বেগতিক দেখে পাশের একজন বলল, ‘কুত্তার বাচ্চার জন্য গরম পানি দরকার’। এই বলে পানি ঢালার সময় আরো বাড়িয়ে দিল, বুঝলাম মৃত্যু নিশ্চিত। মৃত্যুর সম্মুখীন হলে শরীরে এত শক্তি কোথা থেকে আসে আল্লাহ ভাল জানেন। আমার শরীরের ঝাকুনিতে তিন/চার জন লোক হাত ছেড়ে এক অপরের উপর পড়ে গেল। এভাবে চলল জীবন-মরণ পরীক্ষা।

মুমূর্ষ অবস্থায় চোখ বেঁধে নিয়ে চলল অজানা গন্তব্যে। যখন চোখ খুললাম ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজেকে খুঁজে পেলাম। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর এপাশ-ওপাশ করতে ব্যথা হচ্ছিল। এ অবস্থায় ঘুমানোর ইচ্ছা করছিলাম। এমন সময় বৈদ্যুতিক বাতির ঝাঁঝালো আলোতে ঘুমের সাধ মিটে গেল। সাথে সাথে রুমের ভিতর কয়েকজন যুবক ঢুকে টেনে তুলল। হাত-পা বেঁধে একটি কাঠের ফ্রেমের মধ্যে হাত ও পায়ের ফাঁক দিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে ঝুলিয়ে দিলো। মাথা নীচের দিকে ঝুলছে, পায়ের গোড়ালি ও নিতম্ব একসাথে আটসাঠ হয়ে লেগে আছে।

আগ্রাসী পদক্ষেপে বুটের শব্দতুলে অফিসার গোছের ২জন লোক সাথে কয়েকজন সিপাহী নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। সবাই ইউনিফর্ম পরিহিত। বুঝতে কষ্ট হলনা এরাই হচ্ছে দেশের কুখ্যাত এলিট ফোর্স (RAB)। অফিসার গোছের লোকটি বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠল। হাঁটু, পায়ের তলা ও নিতম্বে আঘাতের পর আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্ত ঝড়তে লাগল, হারামজাদা, ‘এখনো সময় আছে স্বীকার কর, প্রাণ রক্ষা পাবে’। এভাবে কত সময় কাটল বলতে পারি না।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখি, টাইলস করা মেঝেতে হালকা বেডের উপর শুয়ে আছি। সেই কর্দমাক্ত স্যাঁতস্যাঁতে কক্ষ নেই। কানে মৃদু আওয়াজ এল ধমকের সুরে কেউ বলছে তার সাথে এমন আচরণ করলে কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। সাথে সাথেই একজন অফিসার পাশে দাঁড়ানো দেখতে পেলাম। সে আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করল, ভাবখানা এমন যে কেউ আমার সাথে অন্যায় করে ফেলেছে। আমাকে বলল, ‘তোমার কিছুই হবে না, তুমি শুধু আমাদের একটু সহযোগিতা কর। তুমি দেশের নাগরিক, তোমার উপর যে জুলুম করেছে তারও বিচারের ব্যবস্থা আছে। সন্ত্রাসীরা দেশ ও জাতির শত্রু, তবে না জেনে বুঝে যারা মগজ ধোলাইয়ের শিকার ওদের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব আমাদের।’ আমাকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার কঠোর নির্দেশ দিয়ে চলে গেল।

আভিজাত্যের ছোঁয়ায় পরিপূর্ণ কক্ষ দেখে মনে হল কোন অফিস। উন্নতমানের খাবার, কি সুন্দর ব্যবহার মনে হল পাঁচ তারকা হোটেলকে হার মানাবে। এখন শরীর একটু সুস্থ লাগল। দুইজন যুবক এসে আমাকে অন্য একটি রুমে নিয়ে গেলে চেয়ারে বসা সেই অফিসারটি সহাস্যে জানতে চাইল আমি কেমন আছি, শরীরের অবস্থা কেমন। সব শুনে বলল, ‘তুমি চিন্তা করো না তোমার বাবা মা সবাই ভাল আছে, আর একটু সুস্থ হও তখন বাড়ি যেও। তবে বাড়িতে না গিয়ে বিদেশে চলে গেলেই ভাল হবে। যাই হোক সন্ত্রাসীরা যাতে তোমার মা বাবার কোনো ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য তোমাদের সপরিবারে বিদেশে চলে যাওয়ার সব ব্যবস্থা আমি করে এসেছি, এই দেখ বিমানের টিকেট। পাসপোর্টের ঝামেলা বিশেষভাবে সমাধান করেছি। ঊর্ধ্বতন অফিসারের নিকট আমি তোমার ব্যাপারে সব বলে এসেছি। তাছাড়া নিরপরাধ ও অনুতপ্ত নাগরিকের ব্যাপারে সরকারও আন্তরিক। তুমি নির্ভয়ে আমাকে সব বলতে পার।

রুমের যা অবস্থা চারদিকে হাড়গোড়, কংকাল, ভয়ানক সব নির্যাতনের চিত্র ও উপকরণে সাজানো রয়েছে। দূরের কোনো স্থান থেকে আর্তচিৎকারের শব্দ ভেসে আসছে। সব দেখে ক্ষণিকের সুখ নিমেষে হারিয়ে গেল। তুমি কি ভাবছ? অফিসারটির শান্ত কণ্ঠ। আমার নির্বিকার ভাব দেখে আমাকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করল, ‘তুমি যদি সত্য প্রকাশ করতে না চাও, অবশ্য সত্য প্রকাশ না করে পারবে না। তোমার ও তোমার পরিবারের সুখ-দু:খের বিষয়টি ভেবে দেখার দায়িত্ব তোমার। আমি কথা দিচ্ছি তোমার ভবিষ্যৎ, সব বিষয় আমরা ভেবে দেখব’।

আমি সোফার মধ্যে বসে আছি এমন সময় কয়েকজন যুবককে নিয়ে আসা হল। সবার চেহারায় নির্যাতনের ছাপ স্পষ্ট। দুয়েকজন ব্যতীত অন্যদের চিনতে পারলাম না। দুজন যুবক আমাকে সনাক্ত করল এবং তাদের উত্তর শুনে অফিসারটি সন্তুষ্ট হল। তাদের নিয়ে যাওয়া হল স্বীকারোক্তি দিয়ে রাজসাক্ষী হতে। অফিসারটি বলল, ‘দেখ তোমার ব্যাপারে আমরা সবাই জানি। তবুও আমি চাই তুমি তথ্য দিয়ে অনুতপ্ততা প্রকাশ কর। আমাকে কতগুলো ছবি দেখানো হল যা থেকে আমার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি প্রমাণ হয়। সবচেয়ে খারাপ লাগল যখন যুবকেরা আমার ব্যাপারে স্বাক্ষ্য দিল।

অফিসারটি বললো, ‘ঠিক আছে তোমাকে কিছুই বলতে হবে না, শুধু এই কাগজে সই কর’। আমার না বোধক উত্তরে অফিসারটি স্বমূর্তি ধারণ করল। কয়েকজন সিপাহী আমাকে ধরে ফেলল, অন্য একটি চেয়ারে বসিয়ে আটকে দিল। শুরু হল নির্যাতনের নতুন অধ্যায় মাথা ঘুরতে লাগল, চেয়ারসহ আমি ঘুরছি, মনে হচ্ছে কেউ আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি অজ্ঞানপ্রায়। দফায় দফায় চলল নির্যাতন।

যখন জ্ঞান ফিরল দেখলাম অন্ধকারে আমি পরে আছি। একটু অনুভূতি জাগতেই আঁতকে উঠলাম, হাত দিয়ে দেখি পরনে কাপড় নেই। আলো জ্বলতেই অন্য কোথাও সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় স্যাঁতস্যাঁতে কক্ষে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। এ অবস্থায় নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলাম না। দু’চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে লাগল। এলিট ফোর্সের (RAB) কয়েক সদস্য এগিয়ে এসে আমাকে উঠে দাড়াতে বলল। লজ্জায়, অপমানে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।

আবার প্রশ্নের পর প্রশ্ন। হাতে পায়ে ইলেকট্রিক শক দেয়া শুরু করল। একজন শয়তান এসে মেটাল ডিটেক্টরের মত একটা যন্ত্র দ্বারা লজ্জাস্থানে ইলেকট্রিক স্পার্ক দিতে লাগল। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছি। হায়রে দুনিয়া। এটা নাকি মুসলিমদের দেশ। হঠাৎ করে পেছন থেকে লাথি দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল। আবারও শক দিতে লাগল, হাত পায়ের আঙ্গুল অবশ হয়ে এল, কালো রং ধারণ করল। দুজন লোক ক্রমাগত আমাকে লাথি মারতে লাগল। শরীরের বিভিন্ন স্থান দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করল। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় শরীর কাঁপছে, পানি চাইলে পানি দিচ্ছি বলে গায়ের উপর প্রস্রাব করে দিল।

এরই মধ্যে একজন যুবককে নিয়ে আসল। ছেলেটি শুধুই কাঁদছে। ওরা চলে গেলে তার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করলাম। কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে চাইলে সে বলল, ‘সব শেষ হয়ে গেছে এখন আর সান্ত্বনা দিয়ে কি লাভ।’ সে জানায় তার ভাইকে বাড়িতে না পেয়ে তাকে সাদা পোশাকের কিছু লোকেরা ধরে নিয়ে আসে। নির্যাতন করতে করতে বড় ভাই কোথায় তা জানতে চায়। না বললে কিছুক্ষণ পর মা-বাবা ও বোনকে ধরে নিয়ে আসে। তাদের সামনে আমাকে এবং আমার সামনে তাদেরকে নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে পরিবারের একজন আমার কাছে এ ব্যাপারে তথ্য রয়েছে বলে জানায়।

আমি বলতে না চাইলে তারা আমার পোশাক খুলে নেয়। একজন লাথি দিয়ে বাবাকে আমার উপর ফেলে দিয়ে বলাৎকার করতে বলে। নাহলে, মা বোনদের আমাদের সামনে শ্লিলতাহানীর হুমকি দেয়। বাবার কাপড়-চোপর আমার চোখের সামনে খুলে নেয়। আমি জানিনা দুনিয়াতে এর চাইতে কঠিন ও ঘৃণিত পরিস্থিতির কারো সম্মুখীন হতে হয়েছিল কিনা? আমি আর সহ্য করতে পারিনি যখন বাবা আঘাতের পর আঘাতে জর্জরিত হয়ে আমার সামনে অসহায়ের মত আসলেন। আমি চিৎকার দিয়ে বললাম ‘আমি সব জানি, সব বলব, শুধু আমার মা বনোদেরকে যেতে দাও।‘ একজন সামনে এসে সব রেকর্ড করে নির্দিষ্ট জায়গায় মেসেজ পাঠালো। তাদেরকে যেতে দিয়ে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।

চোখ দুটো ক্লান্তিতে বুজে আসছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতে পারি নি। হঠাৎ কে যেন মুখে বুট দিয়ে লাথি মারল, সাথে সাথে পা বেঁধে মাথা নীচের দিক দিয়ে ঝুলিয়ে দিল। হাতে বৈদ্যুতিক শক দিতে আরম্ভ করল। মাথা ঝিমঝিম করছে। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে পানি খেতে চাইলাম। অফিসারের অনুমতি নিয়ে পানি দেয়া হল।

এখন আমি অন্য কোথাও আছি বলে মনে হল। পাশে বেশ সুঠাম দেহের দুজন তরুণ পরে আছে, হাত দিয়ে সতর ঢাকার চেষ্টা করছে। কথা বলার কোনো সুযোগ পেলাম না। আমারা যাতে না ঘুমাতে পারি সেজন্য ঝুলিয়ে রাখল হাতকড়া পড়িয়ে। সবার পা ফাঁক করে পেছনে আলাদা আলাদা দু’টো খুঁটির সাথে বেঁধে রাখল। মাথায় ও শরীরে বিভিন্ন স্থানে অসহ্য ব্যথা অনুভব করলাম। কিছুক্ষণ পর এ অবস্থায় ঘুম আসতে চাইলে শক দিতে আরম্ভ করল। রাত-দিন এভাবে (রাত-দিন বুঝিনি অনুমান করে হিসাব করতাম) চলতে থাকলে মানসিক ভারসাম্য হারানোর উপক্রম হল।

এবার আমাকে একটা ছোট রুমে দাড় করিয়ে রাখল। একসুতা নড়াচড়া বা বসার সুযোগ নেই। মনে হল এর চেয়ে ঝুলন্ত অবস্থায়ই ভাল ছিল। এ অবস্থায় কিছু শুকনা রুটি খেতে দিল। খেতে পারছি না দেখে পানি এনে দিল। পানি ও রুটি খেতে কষ্ট হল না। এখন আর ঘুম ধরে রাখতে পারছি না। ঘুমানোর চেষ্টা করলাম মাত্র মাথার উপর বিকট শব্দ করে ধারালো এবং তীক্ষ্ণ সুচাগ্র মাথা বিশিষ্ট লোহার থাম নীচের দিকে আস্তে আস্তে নামতে দেখলাম। ভয়ে আর্তচিৎকারে থামটি থেমে গেল। মনে মনে স্থির করলাম এ অবস্থা থেকে মৃত্যুই শ্রেয়। আবার ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। সাথে সাথে আবার বিকট শব্দ। এবার আমি চুপ থেকে শেষ দেখার ইচ্ছা করলাম। কিন্তু থামটি যতই নীচে আসছে শরীরের রক্ত ততই লাফাতে শুরু করল।

আমি আর পারছি না, ঘুমাতে দিচ্ছে না, জেগে থাকাও সম্ভব হচ্ছে না। আর কত নির্ঘুম থাকতে হবে। বুটের শব্দ শুনে সামনে তাকাই দেখি কয়েকজন ঊর্ধ্বতন অফিসার। আমাকে সত্য বলতে এবং তাদের সাহায্য করতে বলল। আমি অসম্মত হলে আরো ভয়াবহ পরিণতির কথা জানালো। আমি আর চোখের পাতা ধরে রাখতে পারলাম না। সাথে সাথে চোখের পাতার উপর তীব্র আলো পড়ল। চোখ বন্ধ করেও লাভ হল না, আলোর তীব্রতা মাথা ভেদ করবে বলে মনে হচ্ছিল। ছোট্ট পাইপ সদৃশ জায়গায় দাড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ফেটে রক্ত ঝরবে বলে মনে হচ্ছিল। আর পারলাম না, সব বলতে রাজী বলে জানালাম তবে আগে ঘুমাতে চাই। সেই স্থান থেকে নামাতেই ফ্লোরে পরে গেলাম।

ঘুম থেকে জেগে দেখি আমি পোশাক পরিহিত। আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করে আজকের গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ড চাইল। তা মঞ্জুর করে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে আমি কিছু জানি না বলে জানালাম। নির্যাতনের নব সূচনা উন্মোচিত হল। পুলিশের লোকজন আমাকে একটি চৌবাচ্চায় ছেড়ে দিল। তিন/চার ফুট নীচে পাইপ সদৃশ চৌবাচ্চার তলায় পা ঠেকল। সাথে সাথে বিষধর সাপের চেয়েও বিষাক্ত কিছু দংশন করতে লাগল। বুঝতে পারলাম শিং মাছ কাটা ফুটাচ্ছে। আর্তচিৎকারের সাথে সাথে জ্ঞান হারালাম। পায়ের ক্ষত এখনো আগের মতই।

চোখ বেঁধে অজানার উদ্দেশ্যে নিয়ে চলল, যখন থামল নিঝুম রাত। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা তার উপর লজ্জা নিবারণের মত কোনো কপর নেই। হঠাৎ আলো জ্বলতেই ইউনিফর্ম পরিহিত একজন মহিলা অফিসার সাথে কয়েকজন তরুণী সিপাহী নিয়ে প্রবেশ করল। স্পর্শকাতর অঙ্গে খুঁচিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করতে লাগল। আল্লাহর কাছে এই ফিতনা থেকে মনে প্রাণে আশ্রয় চাইলাম। অফিসার চলে গেলে মেয়েগুলো উত্যক্ত করতে আরম্ভ করল। আল্লাহর কাছে স্বকাতরে প্রার্থনা করি তিনি যেন এই অশ্লীল ফিতনা থেকে মু’মিনদের রক্ষা করুন। ভাবতে অবাক লাগে অফিসারদের নির্দেশের কাছে এরা নিজেদের ইজ্জত বিকিয়ে দিচ্ছে। ৪ জন কখনো ৬ জন নিজেদের আব্রু সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উত্যক্ত করে চলল।

প্রস্রাবের রাস্তায় নল ঢুকিয়ে, বৈদ্যুতিক স্পার্ক দিয়ে, প্রস্রাব না করতে বাধ্য করে, শরীরের অনুভূতির স্থানে বিপদজনক স্পর্শ দিয়ে ধ্বংসাত্মক আবেদন তীব্র করতে মানুষিক নির্যাতন অব্যাহত রাখল। ঠাণ্ডার প্রকোপ নেই মনে হচ্ছে এখন, আস্তে আস্তে কক্ষ গরম হচ্ছে। তবে উত্তেজক গান বাজনা অব্যাহত রইল। একজন তরুণী একাকী অবস্থান করছে। আমি তার বেইজে নাম দেখে আগেই নিশ্চিত হলাম সে মুসলিম ঘরের সন্তান। নাসীহামূলক কিছু মর্মস্পর্শী কথা বলে তার বিবেক জাগ্রত করতে চেষ্টা করলাম। আল্লাহর ইচ্ছায় ক্ষণিকের জন্য হলেও তার বিবেক জাগ্রত হল। প্রশ্ন করায় সে জানাল, ‘কোনো যুবক/পুরুষ আমাদের দেখে উপেক্ষা করা তো দূরের কথা, আমাদের কাছে পেতে তারা জীবন বাজি রাখতে দ্বিধা করবে না। কিন্তু আপনারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই জন্যই আপনাদের পুরুষদের উত্যক্ত করতে নারীদের এবং নারীদের উত্যক্ত করতে পুরুষদের ব্যবহার করা হয়।’

পরবর্তীতে জানতে পারলাম ভাইদের সম্মুখে আমাদের সম্মানিত মা বোনদের অশ্লীল হয়রানী করা হয়, যা দেখে কোনো সন্তান, ভাই, বাবা স্থির থাকতে পারে না। ঘৃণিত পন্থায় তথ্য উদঘাটন করতে এদের বিবেক বাধে না। হে আল্লাহ! আমাদের অসহায়ত্ব তোমার কাছে নিবেদন করছি। নিশ্চয়ই তুমি মাজলুমের দোয়া কবুল করে থাক। রাগে দু:খে পাগল প্রায় হয়ে গেলাম। তাদের কথায় রাজি না হলে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছিল। শরীর আর ফুলের আঘাতও সইতে অক্ষম। কাপড়-চোপড় হীন এভাবে বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব।

চোখ বেঁধে অন্য কোথাও নিয়ে গেল। বুঝলাম বেশী দূরে নেয়নি। চোখ খুলে যা দেখলাম তা বর্ণনা করা অসম্ভব। এই মুসলিম জনপদে মানুষ মানুষের সাথে এত নিকৃষ্ট ও জঘন্য আচরণ করছে যা অতিকল্পনাপ্রবন মানুষও ভাবতে পারবে না। এখন আর আমি নিজের জন্য ভাবছি না। ভাইদের করুন অবস্থা দেখে বিশেষত সম্মানিত ভাইদের অবস্থা জেনে আমি আর স্থির থাকতে পারছি না। সারা শরীর কাঁপছে, বাকরুদ্ধ হয়ে আসছে। প্রত্যক্ষ করলাম মুজাহিদদের জন্য কেন এত সুসংবাদ আল্লাহর তরফ থেকে। একজন মুরাবিত, মুজাহিদ আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহীমাহুল্লাহ) ঠিকই তার বন্ধু হারামাইনে ইবাদাতকারী ফুদাইল ইবনে আইয়াদ কে উদ্দেশ্য করে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘তুমি যখন পবিত্র হারামাইনে অশ্রু ঝরাও, আমরা তখন কাবার রবের দ্বীন কায়েম করতে রক্ত ঝরাই।’

সবাই বিবস্ত্র পড়ে আছি জালিমের জিন্দাখানায় এরা এর নাম দিয়েছে ইন্টারোগেশন সেল। এই হল জিজ্ঞাসাবাদের স্বরূপ। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুম তদুপরি শারীরিক-মানসিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ এই মুজাহিদিন ভাইয়েরা। কাউকে আবার গ্রেপ্তারের পর বারুদ ঢেলে হাত, দাড়ি, শরীর পুড়িয়ে দিয়েছে। অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পা গুড়িয়ে দিয়েছে। চিকিৎসার নামে সামান্য আহত ভাই-বোনদের হাত-পা কেটে পঙ্গু করেছে। আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি আয়রন কাটারের ভোতা অংশ দিয়ে টেনে টেনে নাবীর সুন্নাহ দাড়িকে উপরে ফেলা হয়েছে, আমি নিজেও এর ভুক্তভোগী, অথচ দাড়ি রাখা আমাদের জন্য ওয়াজিব।

সপ্তাহের পর সপ্তাহ ঝুলিয়ে রেখেছে। নখ উপরে ফেলেছে। বিবস্ত্র করে শরীরের আকর্ষণীয় এবং স্পর্শকাতর ও অতি স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে মোমবাতির উত্তপ্ত ফোঁটা ফেলে ধীরে ধীরে অর্ধসিদ্ধ করা হয়েছে। দুটো মই উপরে নীচে রেখে পিষে ফেলা হয়েছে। অনেক ভাইকে ছোট একটি রুমে লোহার একটি চেয়ারে বসিয়ে হাত, পা ও শরীর বেঁধে ফেলে, হাই ভোল্টেজের বাল্ব মাথার উপরে ও চারিদিকে এমন নিকটে রাখে মনে হয় সেখানে সহজেই পানি ফুটবে। আসামীদের একটি লোহার পাত্রে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে প্রস্রাব করতে বাধ্য করা হয়। এতে পুরুষাঙ্গ দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসার উপক্রম হয় এবং কখনো রক্ত বেরিয়ে আসে। হাতে তারকাটা মেরে গাছে অথবা খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, হাত পায়ের আঙ্গুলে সুই ঢুকানো হয়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে দফায় দফায় বৈদ্যুতিক শক দিয়ে প্রায় পুড়িয়ে ফেলা হয়। যেসব ভাইদেরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তাদের শাহাদাত ও বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে ফেলা হয় অথবা নষ্ট করা হয়। এমনকি হাতের কব্জি কেটে, পা নষ্ট করে পঙ্গু করে ফেলে যাতে বাইরে গেলে আর কাজ করতে না পারে। সুতি কাপড় বা তোয়ালে তরল পদার্থ (মদ, বিয়ার, কোমল পানীয়) অথবা পানিতে ভিজিয়ে তা দিয়ে সম্পূর্ণ মাথা মুড়িয়ে / বেধে তারপর পানি ঢালা হয়, এতে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এটা অত্যন্ত কঠিন। নির্যাতন নিপীড়নের সবগুলো কথা লিখতে পারলে আগামী প্রজন্ম জানতে পারত সঠিক ইতিকথা। কোথায় এদের মানবতা? কোথায় এদের প্রতিশ্রুতি? কোথায় এদের মানবাধিকারের শ্লোগান, ফাঁকা বুলি? আমরা জাতির সন্তানদের বলব এদের ধোঁকায় পড়বেন না, ভীত হবেন না। অগ্রসর হউন দুর্বার গতিতে, মু’মিনদের বিজয় সুনিশ্চিত।

যাইহোক, ভাইদের করুন অবস্থা দেখে বুঝলাম নতুন কোন ফন্দি এটেছে মানুষ নামের এই জানোয়ারগুলো। আমাদের গতিবিধি মনিটরিং করা হচ্ছিল। আবেগ তাড়িত হয়ে কিছু করলে তার সূত্র ধরে আবার জেরা। তবুও একজন ভাই ঝুঁকি নিয়ে ইংগিতে জানালেন তাদের দেওয়া পানি না খেতে বা কম খেতে। কারণ পানিতে হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ মেশানো আছে। এখন সব পরিষ্কার হয়ে গেল কেন শুকনা রুটির সাথে পানি দিয়েছিল। পানি খাওয়ার পর কেনইবা ঘুম বেড়ে যেত দ্বিগুণ।

চিন্তার রেশ না কাটতেই নারী-পুরুষ ইউনিফর্ম পরিহিত কয়েকজন অফিসার ও সিপাহীর বুটের শব্দে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল। কাগজ কলম দিয়ে সই করতে বলা হল। আমি বললাম ভাইদের নামে আনীত অভিযোগ সব মিথ্যা। আমি মিথ্যার স্বাক্ষী হব না। নির্যাতনের নতুন মাত্রা যোগ হল। অনুগত ভাইদের দিয়ে সম্মানিত ভাইদের প্রহার করানো হল। যাদের সামনে গেলে দ্বীনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হতাম, যাদের সেবা করারও সুযোগ পেত না সবাই। সেই ভাইদের আজ অপমানিত করার জন্য সবাইকে একসাথে এভাবে ‘অমানবিক’ অবস্থায় রেখেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারলাম এমন পরীক্ষায় পড়তে যাচ্ছি, যা পূর্বের কোনো পরীক্ষার সাথে তুলনা করাই যায় না।

সুঠাম সুদর্শন ভাইদের উপর পাশবিক অত্যাচারের হুমকি দিয়ে তাদেরকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে কয়েকজন হায়েনা হাত বেঁধে বুট দিয়ে পা চেপে ধরল। ক্রোধে শরীর কাঁপছে কিন্তু কেহই বন্ধন মুক্ত নয়। কি করব? কিংকর্তব্যবিমূঢ়! শুরু হল আরেক অধ্যায়। হুমকি, প্রহার, বৈদ্যুতিক শক কাজ হল না দেখে নিকৃষ্ট এক শয়তান মুদ্রণ অযোগ্য ভাষায় গালি দিয়ে বলল, ‘তুই স্বাক্ষী দিতে হবে না তোর বাবাকে বলাৎকার কর। তা না হলে কারো রেহাই নেই’। এই বলে ভাইয়ের উপর চেপে ধরল। আল্লাহু আকবার বলে উচ্চস্বরে হুংকার দিয়ে গড়িয়ে পড়লাম বললাম, ‘আমি সই করব, তবে ভাইদের আগে কাপড় পড়তে দিন’।

আমাকে চোখ বেঁধে অন্যত্র নিয়ে চলল, জানিনা তাদের ভাগ্যে কি হল। সেখানের পরিবেশ দেখে নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করলাম। বলল, কি কি বলে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের সহযোগীতা করতে পারবে বল, তোমার কোনো ভয় নেই।’ আমি নীরব দেখে আবারও প্রলোভন দিল। একজন নরপশু এসে আমার গলায় কাপড়ের তৈরী ভিজা প্যাড শক্ত করে গলায় পেঁচিয়ে দিল। যখন নিশ্চিত হল আমি তাদের ধোঁকা দিয়েছি, সাথে সাথে কাপড়ের ভিজা প্যাডে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হল। বাকরুদ্ধ মুমূর্ষু এক জীবন্ত এক লাশ!!! “হে আল্লাহ তুমি আমাকে যে সাহায্য করবে তার আমি কাঙ্গাল। আমার অসহায়ত্ব আমি তোমার কাছেই নিবেদন করছি। আমাকে এবং মু’মিন ভাইদেরকে তুমি ক্ষমা কর। মহা ফিতনা থেকে তুমি আমাকে মুক্তি দাও। ভাইদের জন্য তুমি উত্তম ব্যবস্থা কর। হে আল্লাহ! আমার পরিবার পরিজনদের আমি তোমার কাছে সোপর্দ করলাম। জালিমের হাতকে তুমি সংযত কর। তাদের মধ্যে তুমি অনৈক্য তৈরী করে দাও। এদেরকে তুমি ধ্বংস কর।

রক্তাক্ত এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করা হল। ইশারায় জানালাম আমি স্বীকারোক্তি দিতে অসম্মত, অপারগ। বেঞ্চ থেকে আমাকে ম্যাজিস্ট্রেট লাথি দিয়ে ফেলে দিলে মুখে রক্ত জমে যায়। অবস্থার অবনতির আশংকায় আমাকে কারাগারের প্রেরণ করে। মৃতপ্রায় শরীর নিয়ে আমাকে অনেক পুরনো নোংরা দুটি কম্বলে শুতে দিল। কারাগারের হাসপাতালের বিশেষ সুবিধা বঞ্চিত করে একাকী এক রুমে আমাকে থাকতে দিল। দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকার পর আল্লাহর অশেষ রহমতে শরীর সুস্থ হতে লাগল। কারাগারে গুলিবিদ্ধ ভাইদের বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকতে দেখে নিজের দু:খকে তুচ্ছ মনে হল। এখানে আমাদের ভাইদের আসামীদের জন্য যে সাধারণ মর্যাদা দেয়া তো দূরের কথা সার্বক্ষণিক তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের পাত্র হয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।

অনেক কিশোর ভাইদেরকে দুর্ধর্ষ আসামীদের পাশে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের নিকৃষ্ট পাশবিক যৌন নির্যাতন থেকে বাঁচতে কোমলমতি ভাইদের রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে কত ভাই যে প্রশাসনের লাঠিচার্জের সম্মুখীন হয়েছে তার হিসাব নেই। ঢালাওভাবে ভাইদের বেঁধে হাঁটু, পায়ের তলা, নিতম্ব ইত্যাদি জায়গায় আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে বিভিন্ন কারাগারে চালান দেয়া হয়েছে বিদ্রোহী বলে। যাতে সেখানে আবারো চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়। তথাকথিত আইনি সহায়তা, ডিনাই পিটিশন করতে দেয়া হয়নি। দেখা সাক্ষাতের মৌলিক অধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয় জেলে প্রবেশের পরে প্রথম দিকে দীর্ঘদিন। এমন অনেক জেল যেখানে ঈদের সময়ও দেখা করতে দেয় না। বাবা-মায়ের দেয়া টাকা পয়সা অনেক সময় কারা কর্তৃপক্ষ আত্মসাৎ করে। শালীনতা বহির্ভূতভাবে প্রায়ই তল্লাশির নামে হয়রানী করা হয়। ধূমপায়ী, মাদকাসক্ত, নিকৃষ্ট আসামীদের সাথে থাকতে বাধ্য করা হয়। দিনরাত পায়ে ডাণ্ডা বেড়ী পরিয়ে রাখে। যক্ষ্মার মত অসুস্থ ভাইদেরও কোনোরূপ চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে না। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে অনেক ভাই পঙ্গুপ্রায় এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া ভাইকে হার্ট অ্যাটাক বলে চালিয়ে দিচ্ছে।

দিনরাত সামরিক নজরদারীর মত নিয়ন্ত্রিত বিধি অনুসরণ করতে হয়। লেখা পড়ার মৌলিক অধিকারও ছিনিয়ে নিয়েছে। একটি কলম পাওয়া গেলে একশ লাঠির আঘাত করতে নির্দেশ দেয়। সামান্য ছুতা ধরে কালো জম টুপি পড়িয়ে রাখা হয়, চোখ বেঁধে আসামীদের সামনে ঘোরানো হয় এবং হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে উঁচু গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়। বিনা অপরাধে বছরের পর বছর বন্দী করে রাখা হয়েছে। তাদের আদালতেও পাঠানো হয় না, সার্বক্ষণিক নিকৃষ্ট আচরণ অব্যাহত থাকে। অন্য আসামীদেরকে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়। বিরোধ মারাত্মক আকার ধারণ করলে প্রশাসন তখন তাদের পক্ষাবলম্বন করে উল্টো ভাইদের শাস্তি দেয়। দু’একজন ইসলামি মাইন্ডের জেল সুপার যদি ভালো আচরণ করে তবে তাদের বিভাগীয় পর্যায়ে শোকজ করা হয়। তবে এদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। অবশ্য তারা ভাইদের আখলাকে মুগ্ধ হয়েই ভাল ব্যবহার করে।

বিবেক সম্পন্ন মানুষ নির্যাতন সহ্য করতে হলেও সম্মান হারাতে চায় না। আর আমার সম্মানিত ভাইদের বছরের পর বছর অপমান ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই তাদের নিত্যসঙ্গী। হে আল্লাহ! তুমিই আমাদের একমাত্র অভিভাবক, তুমিই সাহায্যকারী। তুমিই শিশু মুসার প্রতিপালক। তুমিই আজিজুল হাকিম, আর আমরা তোমার পথে মাজলুম। হে আল্লাহ। হে উত্তম ব্যবস্থাপক। আমাদের ক্ষমা কর, তোমার পথে যারা অগ্রণী তাদের সঙ্গী কর। ঈমানের পথে চলার শক্তি বৃদ্ধি কর।

হে মুসলিম ভাইয়েরা যারা জেলের বাহিরে আছেন, আপনাদের আহবান জানাচ্ছি, আপনারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আদেশ পালনে ব্রতী হউন। শত দু:খ কষ্টের মধ্যেও আপনারা আল্লাহর পথে জিহাদে অটল আছেন, যা দেখে আমরা অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করি। আমরা জানি এই জমীনে আমরা শুধু একা মাজলুম নই, এই কাফেলা অনেক ভারী। আমরা চাই বন্দী মুসলিম, মুসলিমাদের জন্য আপনাদের দোয়া এবং ভালবাসা। ইয়াহুদী-খ্রিস্টান, মুশরিক-কাফের, মুরতাদ, নাস্তিক তাগুতদের অন্ধকুঠিরে যারা আজ নিপীড়িত তাদের জন্য আপনাদের কিছু করার সম্ভব কিনা? এবং অসম্ভবকে সম্ভব করতে আপনারা কোনো কিছু করতে আদিষ্ট কিনা? আপনারা স্মরণ করুন আল্লাহর নির্দেশ,

“আর তোমাদের কি হল? তোমরা যুদ্ধ করছ না আল্লাহর পথে এবং সেসব অসহায় দুর্বল নর-নারী ও শিশুদের জন্য যারা বলে: হে আমাদের রব! এ এলাকা থেকে আমাদেরকে বের করে নাও, এখানকার বাসিন্দারা বড়ই জালিম। আর তোমার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের সাহায্যকারী করে দাও।” (সূরা নিসা, ৪:৭৫)

মহান আল্লাহই আমাদের এই অমানুষিক নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ সুগম করবেন। তিনিই এই অবর্ণনীয় বেদনাময় পরিস্থিতি থেকে আমাদের উদ্ধার করবেন। যে সমস্ত জঘন্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় ও অযত্ন অবহেলায় আমরা ছটফট করছি তিনিই আমাদের সেই ব্যাধির কবল থেকে আরোগ্য দান করবেন। যারা আমাদেরকে অন্যায়ভাবে এখানে বন্দী করে রেখেছে, তাদের হাত তিনি শিথিল করে দিবেন। আমাদের ক্রন্দন, আমাদের অসহায়ত্ব তাঁরই কাছে নিবেদন করছি। হে আল্লাহ! আমাদের পালনকর্তা! আমাদের রব্ব! আমাদের এই জালিম সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দাও। তোমার পক্ষ থেকে সাহায্যকারী, ওয়ালী প্রেরণ কর। তুমিইতো অক্ষম মাজলুমের পক্ষে উদ্ধত জালিমের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ কর। সবশেষে যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য। সালাত এবং সালাম নবী মুহাম্মদ, আহলে বাইত ও সাহাবায়ে আজমাঈনের প্রতি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five − 3 =

Back to top button